০৩. ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ব্যাসের হিতোপদেশ

বিষাদ করয়ে নরপতি পুত্রশোকে।
রাজারে বেড়িয়া কান্দে যত পুরলোকে।।
তবে ব্যাস কহিলেন শুন নৃপবর।
গত জীব হেতু তুমি শোক কেন কর।।
আর শোক না করিহ গুনহ রাজন।
মন দিয়া শুন দুর্য্যোধনের কথন।।
একদা গেলাম আমি ব্রাক্ষার সভায়।
নারদাদি মুনিগণ আছিল তথায়।।
হেনকালে পৃথিবী করিল নিবেদন।
পরিত্রাণ আমারে করহ পদ্মাসন।।
হরি করিলেন যত দানব সংহার।
ক্ষন্দ্রকুলে তাহারা জন্মিল পুনর্ব্বার।।
পৃথিবীর বাক্য শুনি দেব প্রজাপতি।
আশ্বাস করিয়া তাঁরে কহিল ভারতী।।
ধৃতরাষ্ট্র তনয় নৃপতি দুর্য্যোধন।
কুরুবংশে জন্মিবে সে বড়ই দুর্জ্জন।।
সে তোমার খন্ডাইবে ভার গুরুতর।
শুন বসুমতী তুমি আমার উত্তর।।
শুনিয়া কাশ্যপী স্ততি অনেক করিলা।
যোড়হাত করি পুনঃ কহিতে লাগিলা।।
কেমন প্রকারে মোর ঘুচিবেক ভার।
কহ পিতামহ তার করিয়া বিস্তার।।
ব্রক্ষ্মা কন কুরু পান্ডু ভাই দুইজন।
চন্দ্রবংশে উৎপন্ন হইবে বিচক্ষণ।।
পান্ডুর তনয় পঞ্চজন তুল্য দেব।
ধর্ম্ম ভীম অর্জ্জুন নকুল সহদেব।।
ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির হইবে নন্দন।
দুর্য্যোধন দুঃশাসন আদি শত জন।।
রাজ্য হেতু বিবাদ হইবে দুইজনে।
পান্ডুর নন্দন যুধিষ্ঠির রাজা সনে।।
আপনি সহায় কৃষ্ণ হবেন তাঁহার।
কুরুক্ষেত্রে হইবেক ঘোর মহামার।।
কুরুক্ষেত্রে ক্ষভ্র যত সংহার হইবে।
শুন বসুমতী তব ভার না থাকিবে।।
যাহ যাহ বসুমতী আপনার স্থান।
দুর্য্যেধন হেতু তব হবে পরিত্রাণ।।
এত বলি পৃথিবীরে করিল বিদায়।
এই সব কারণ যে জানিনু তথায়।।
সেই দুর্য্যোধন হৈল তোমার তনয়।
কলি প্রবেশের অগ্রে শুন মহাশয়।।
মহামহীপাল হৈল মহা ক্রোধশালী।
গান্ধারী উদরে জন্মে সাক্ষাৎ যে কলি।।
সবে হৈল মহা ক্রোধশালী।
গান্ধারী উদরে জন্মে সাক্ষাৎ যে কলি।।
সবে হৈল দুর্নিবার শত সহোদর।
কর্ণ হৈল সখা তার শকুনি বর্ব্বর।।
ক্ষন্ত্রিয় বিনাশ হেতু অনর্থ অঙ্কুর।
শুন মহারাজ সব শোক কার দূর।।
কৌরব পান্ডবে হৈল ঘোরতর রণ।
কুরুক্ষেত্রে সর্ব্বজন হইল নিধন।।
এই পূর্ব্ব কথা আমি জানাই তোমারে।
এত বলি ব্যাসদেব বুঝান তাঁহারে।।
হেনকালে সঞ্জয় করিয়া যোড়হাত।
করি এক নিবেদন শুন নরনাথ।।
নানাদেশ হইতে অনেক নরপতি।
অভ্যর্থিয়া আনিলেক তোমার সন্ততি।।
সবান্ধদে কুরুক্ষেত্রে হইল নিধন।
তা সবার প্রেতকর্ম্ম করহ রাজন।।
সঞ্জয়ের বাক্যে রাজা নিশ্বাস ছাড়িল।
মৃতবৎ হয়ে রাজা ধরণী পড়িল।।
বিস্তর প্রবোধ তারে দেয় বার বার।
রথসজ্জা করে কুরুক্ষেত্রে যাইবার।।
ধৃতরাষ্ট্র আপনি কহিল বিদুরেরে।
স্ত্রীগণে আনহ শীঘ্র গিয়া অন্তঃপুরে।।
এত বলি ধৃতরাষ্ট্র রথেতে চাপিল।
স্ত্রীগণে আনিতে তব বিদ্যুর চলিল।।
বিদ্যুর বলিল শুন গান্ধার নন্দিনী।
কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করিলেন নৃপমণি।।
ভীষ্ম দ্রোণাচার্য্য আর কর্ণ মহাজন।
শত ভাই দুর্য্যোধন ত্যজিল জীবন।।
একাদশ অক্ষৌহিনী ত্যজিল পরাণ।
প্রেতকর্ম্ম হেতু রাজা করিল প্রস্থান।।
পুত্রশোক শুনি দেবী হইল বিমনা।
অন্তঃপুরে কান্দি উঠে ছিল যত জনা।।
অন্দরে উঠিল ক্রন্দনের কোলাহল।
হার ছিঁড়ে বস্ত্র ছিঁড়ে লোটায় ভুতল।।
কপালে কঙ্কণাঘাত শুনি গন্ডগোল।
প্রলয়কালেতে যেন জলের কল্লোল।।
বিদুর বলেন ইহা উচিত না হয়।
কুরুক্ষেত্রে চল সবে রাজার আজ্ঞায়।।
বিদুরের বাক্য শুনি গান্ধারী তখন।
বধূগণ সঙ্গে করে রথ আরোহণ।।
ঘরে ঘরে মহাশব্দ উঠিল ক্রন্দন।
বাল বৃদ্ধ তরুণ কান্দয়ে সর্ব্বজন।।
দেবগণ নাহি দেখে যে সব সুন্দরী।
রণস্থলে যায় তারা একবস্ত্র পরি।।
সাধারণ জন সব দেখয়ে সবাকে।
এড়াইতে নারে কেহ দৈবের বিপাকে।।
সমান সকল দিন নাহি যায় কার।
দেখিয়া শুনিয়া লোক না করে বিচার।।
হ্রাস বৃদ্ধি কৌতুকাদি সৃজে নারয়ণ।
দেখিয়া না মানে তাহা অতি মূঢ়জন।।
একবস্ত্র পরিল রাজার পাটেশ্বরী।
পুত্রগণ শোকে মুক্ত হইল কবরী।।
শত শত দাসীগণ যার সেবা করে।
সে জন পড়িয়া কান্দে ভূমির উপরে।।
গলাগলি করি কান্দে যতেক সতিনী।
আহা মরি কোথা গেল কুরু নৃপমণি।।
কেহ দুগ্ধপোষ্য শিশু ফেলাইয়া দূরে।
হা নাথ হা নাথ বলি কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে।।
মুক্তকেশে কান্দে কেহ শ্বশুরের আগে।
যোড়হাত করি দেহ স্বামীদান মাগে।।
কেহ বলে রাজ্য দেহ পান্ডব নন্দনে।
কেহ বলে কৃষ্ণ আসে তোমা বিদ্যমানে।।
কেহ বলে মিথ্যা কথা নাহিক সংগ্রাম।
কৌরব পান্ডবে প্রীতি হল পরিণাম।।
মিথ্যা কথা কেহ কহিল রাজার গোচরে।
কুশলে আছয়ে কুরু সংগ্রাম ভিতরে।।
এত বলি নারীগণে করয়ে করুণা।
তা শুনি রাজার মনে লাগিল বেদনা।।
চারিভিতে বেড়িয়া কাঁদে ঘত নারী।
নগরে বাহির হৈল কুরু অধিকারী।।
গান্ধারী চাপিল রথে যত বধূ সঙ্গে।
শোকাকুল সকলেতে বস্ত্র নাহি অঙ্গে।।
বিচার নাহিক আর শোকে অচেতনা।
হতপতি নারীগণ হইল উন্মনা।।
পরিল বসন কেহ করিয়া যতন।
অঙ্গেতে তুলিয়া দিল নানা আভরণ।।
চরণে নূপুর পরে দোসারী মুকুতা।
সিন্দূর পরিল কেহ করি পূর্ণ সিথাঁ।।
চন্দনের বিন্দু তার চারিদিকে দিল।
সুন্দর অলকা তাহে বেষ্টিত করিল।।
তাম্বুল ভক্ষণ করি নানা গীত গায়।
চরণে ণূপুর কেহ করি নাচিয়া বেড়ায়।।
কেহ অসিচর্ম্ম করে বীরবেশ ধরি।
ধেয়ে যায় কুরুক্ষেত্রে প্রতি অনুসরি।।
মুক্তকেশা আম্রশাখা লয়ে কত জনা।
কেহ পথে পড়ে, কেহ শোকে অচেতনা।।
অনেক চলিল নারী পতি পুত্র শোকে।
প্রবোধ করিতে তারে নারে কোন লোকে।।
হস্তিনা হইল শূণ্য কেহ না রহিল।
রাজার সঙ্গেতে রাজবধূগণ চলিল।।
প্রথম বয়সে কেহ দেখিতে উত্তমা।
মুক্তকেশে খায় যেন সোণার প্রতিমা।।
হেনমতে কুরুক্ষেত্রে যায় নরপতি।
সঙ্গেতে নাহিক রথ সৈন্য ঘোড়া হাতী।।
যুবতী সমূহ সঙ্গে চলিল রাজন।
শূন্য হৈতে কৌতুক দেখয়ে দেবগণ।।
শোকাকুল হয়ে পথে যায় নরপতি।
হেনকালে অশ্বথামা কৃপ মহামতি।।
কৃতবর্ম্মা সহ পথে হৈল দরশন।
নিরখিয়া রাজাকে আইল তিনজন।।
পরিচয় নৃপতিকে দিল আপনার।
ধৃতরাষ্ট্র বলে তবে কহ সমাচার।।
কৃতাঞ্জলি হয়ে বলে সেই তিনজন।
অবধানে শুন রাজা সব বিবরণ।।
মুখে না আইসে বাক্য কহিতে ডরাই।
কহিবার যোগ্য নহে মনে দুঃখ পাই।।
শুন কহি মহারাজ সব সমাচার।
কুরুক্ষেত্রে হৈল যত ক্ষত্রিয় সংহার।।
একাদশ অক্ষৌহিনী সকলি মরিল।
অশ্বথামা কৃতবর্ম্মা কৃপ এড়াইল।।
দৈবে না হইল তিন জনার মরণ।
শত ভাই সহিত পড়িল দুর্য্যোধন।।
করিল দুষ্কর কর্ম্ম ভীম দুরাচার।
একেলা মারিল তব শতেক কুমার।।
গুনহ গান্ধারী দেবী করি নিবেদন।
ভীম করিলেক কুরুবংশের নিধন।।
যত কর্ম্ম করিলেক দুর্য্যোধন বীর।
যত কর্ম্ম করিলেক দুঃশাসন ধীর।।
শতপুত্র তোমার করিল যত কর্ম্ম।
যেমন আছিল মাতা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম্‌।।
পরাক্রম করিয়া পড়িল ঘোর রণে।
সুরপুরী গেল সবে চাপিয়া বিমানে।।
শোক পরিহর দেবি না কর বিলাপ।
দুর্য্যোধন প্রাণপনে করিল প্রতাপ।।
অন্যায় করিয়া ভীম ভাঙ্গিলেক উরু।
সেই ক্রোধে করিলাম মোরা কর্ম্ম গুরু।।
সবান্ধবে পাঞ্চালেরে করিনু সংহার।
বধিলাম দ্রৌপদীর পঞ্চটী কুমার।।
পান্ডবের রণে অবশেষে সপ্তজন।
শ্রীকৃষ্ণ সাত্যকি পঞ্চ পান্ডুর নন্দন।।
শুনহ সকল কথা না করিহ ভয়।
অবিলম্বে কুরুক্ষেত্রে চল মহাশয়।।
আজ্ঞা দেহ আমরা আপন স্থানে যাই।
কুরুক্ষেত্রে আছয়ে পান্ডব পঞ্চভাই।।
এত বলি রাজার লইল অনুমতি।
প্রদক্ষিণ করিয়া চলিল শীঘ্রগতি।।
হস্তিনাপুরেতে গেল কৃপ মহাশয়।
কৃতবর্ম্মা চলি গেল আপন আলয়।।
ব্যাসের আশ্রমে গেল দ্রোণের নন্দন।
কুরুক্ষেত্রে গেল হেথা অন্ধক রাজনে।।
ধৃতরাষ্ট্র আইল শুনিয়া পঞ্চভাই।
শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুক্তি করেন সবাই।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন যদুনাথ।
কুরুক্ষেত্রে আইলেন দেখ জ্যেষ্ঠতাত।।
কিমতে তাঁহাতে আমি মুখ দেখাইব।
জিজ্ঞাসিলে সমাচার কি কথা কহিব।।
গান্ধারীর ক্রোধে আর নাহিক নিস্তার।
কি উপায় করি কৃষ্ণ বল এইবার।।
সতীর অবার্থ বাক্য শুন নারায়ন।
আজি প্রাণ হারাইব ভাই পঞ্চজন।।
বৃথা যুদ্ধ করিলাম বৃথা পরাক্রম।
বৃথা গুরুহত্যা আর জ্ঞাতির নিধন।।
বৃথা বধিলাম পুত্র সৃহৃদ বান্ধব।
বৃথা যুদ্ধ করিলাম শুন শ্রীমাধব।।
আজি গান্ধারীর ক্রোধে নাহিক নিস্তার।
অপান্ডব হইবেক সকল সংসার।।
শুন কৃষ্ণ তোমারে করি নিবেদন।
প্রাণ লয়ে পলাউক ভাই চারিজন।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল কুমার।
পলাইয়া প্রাণ রক্ষা করুক এবার।।
আমি যাব ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী গোচরে।
শাপ দিয়া ভস্মরাশি করুন আমারে।।
আমার জীবনে আর নাহি প্রয়োজন।
লোকের ‍সাক্ষাতে নাহি দেখাব বদন।।
যুধিষ্ঠির বচন শুনিয়া চক্রপানি।
বলিলেন তাঁরে তবে সুমধুর বাণী।।
শুন রাজা ভয় তুমি কর কি কারণে।
রাখিতে মারিতে কেহ নাহি আমা বিনে।।
সবাকার আত্মা আমি পুরুষ প্রধান।
আমা বিনা রাখিতে মারিতে নারে আন।।
সবে মেলি চলি যাব নৃপতির স্থানে।
দূর কর ভয় তুমি আমার বচনে।।
গান্ধারী না দিবে শাপ আমি ইহা জানি।
হরষিত চিত্তে তুমি চল নৃপমণি।।
কৃষ্ণের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।
হাসিয়া বলেন তবে শুন যদুবীর।।
তোমার আজ্ঞাতে তবে সবে চলি যাব।
শীঘ্রগতি চলহ বিলম্ব না করিব।।
অনুমতি দিল কৃষ্ণ রাজার বচনে।
হরষিত চলে সবে রাজ সম্ভাষণে।।
পঞ্চ ভাই কৃষ্ণ সহ যান দ্রুতগতি।
রাজার চরণে সবে করিল প্রণতি।।
আমি যুধিষ্ঠির বলি পরিচয় দিতে।
রথ হৈতে ধৃতরাষ্ট্র নামিল ভূমিতে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।