০২. পাণ্ডবগণের কেদার পর্ব্বতারোহন

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
চলেন উত্তরমুখে পাণ্ডুপুত্রগণ।।
দানব ঈশ্বর শিব রচিত সুবর্ণে।
নানা ধাতু বিদ্যমান শোভে প্রতি বর্ণে।।
মস্তকে শোভিত মণি মুকুতার পাঁতি।
অন্ধকারে দীপ্ত করে যেন দিনপতি।।
দিব্য সরোবর তথা সুবাসিত জল।
হংস চক্রবাক শোভে প্রফুল্ল কমল।।
তাহা দেখি পঞ্চভাই জলেতে নামিয়া।
করেন তর্পণ স্নান পিতৃ উদ্দেশিয়া।।
স্নান করি কুণ্ড হতে উঠি ছয়জন।
দানব ঈশ্বরে আসি করিল পূজন।।
কেহ স্তব করে কেহ শিব সেবা করে।
অষ্টাঙ্গ প্রণাম কেহ করে লুঠি শিরে।।
ভক্তিভাবে ভোলানাথে মাগিলেন বর।
তোমার প্রসাদে যেন দেখি দামোদর।।
এত বলি প্রণমিয়া করি জলপান।
উত্তরমুখেতে পুনঃ করিল প্রয়াণ।।
কতদূর যাইতে দেখেন সরোবর।
জল দেখি তুষ্ট হন পঞ্চ সহোদর।।
জল পান করি স্নিগ্ধ হন পঞ্চজন।
ত্যজিলেন মেঘনাদ পর্ব্বতের বন।।
কেদার পর্ব্বতে তবে করি আরোহণ।
বড় সুখ পাইলেন দেখি উপবন।।
কেদার পর্ব্বত সেই অতি সুশোভন।
যাহাতে শুনেন কর্ণে স্বর্গের বাজন।।
পর্ব্বতে উঠিয়া ভাবিছেন হৃষীকেশ।
পৃথিবী চাহিয়া রাজা না পান উদ্দেশ।।
অতিশয় উচ্চ গিরি বড় ভয়ঙ্কর।
লক্ষ গজ পরিমাণ বিস্তার উপর।।
পর্ব্বতের চারি পাশে শোভে নানা বৃক্ষ।
কিন্নর গন্ধর্ব্ব কন্যা আছে লক্ষ লক্ষ।।
জিনিয়া সাবিত্রী সতী সুন্দর কামিনী।
ভ্রমর গুঞ্জরে যেন প্রফুল্ল পদ্মিনী।।

পাণ্ডবের রূপ দেখি মোহে নারীগণ।
কহিতে লাগিল কিছু মধুর বচন।।
কোথা হৈতে আগমন যাবে কোথাকারে।
কিবা নাম কোন্ বর্ণ কহিবা আমারে।।
ধর্ম্ম বলিলেন চন্দ্র বংশেতে উৎপত্তি।
যুধিষ্ঠির নাম মম পাণ্ডুর সন্তুতি।।
জ্ঞাতিবধ পাতকে অস্থির মম মন।
স্বর্গে যাব কৃষ্ণ আজ্ঞা দিলেন যেমন।।
অতএব রাজ্য ছাড়ি যাই স্বর্গপুরে।
এই পরিচয় কন্যে জানাই তোমারে।।

এত শুনি পুনরপি বলে কন্যাগণ।
পৃথিবী ছাড়িয়া যদি আইলে রাজন।।
কি হেতু পাইয়া দুঃখ যাহ স্বর্গপুর।
এই দেশে থাক হৈয়া রাজ্যের ‍ঠাকুর।।
দেখহ আমার পুরী পরম সুন্দর।
শোক রোগ ব্যাধি জরা নাহি নৃপবর।।
চন্দ্র সূর্য্য জিনি শোভা আবাস উদ্যান।
কিন্নর নগরে রাজা হও মতিমান।।
তিন লক্ষ কন্যা মোরা হব তব দাসী।
করিব চামর সেবা চারি পাশে বসি।।

এত শুনি ধর্ম্মরাজ বলেন তখন।
কৃষ্ণের আজ্ঞায় যাব অমর ভুবন।।
দ্বাপর হইল শেষ কলি আগমন।
যদুবংশ লইয়া গেলেন নারায়ণ।।
তাঁর দরশন বিনা রহিতে না পারি।
অতএব স্বর্গে যাব দেখিতে মুরারি।।
করিলাম সঙ্কল্প যাবৎ প্রাণ থাকে।
না করিব রাজ্যভোগ যাব স্বর্গলোকে।।

শুনি কন্যাগণ পুনঃ কহে যুধিষ্ঠিরে।
কেমনে যাইবে স্বর্গে মানব শরীরে।।
মনুষ্য দুর্গম স্বর্গ শুন নরপতি।
শরীর ত্যজিয়া সে গেলেন যদুপতি।।
এই দেশে গঙ্গাতীরে থাকি কত কাল।
দেবদেহ পেয়ে স্বর্গে যাবে মহীপাল।।
আমাদের সঙ্গে থাক হাস্য রঙ্গ রসে।
কতক দিবস কাল কাট অনায়াসে।।

রাজা বলিলেন যে তোমরা মাতৃসম।
তোমা সবাকার মায়া মনেতে দুর্গম।।
নিষ্ঠূর শুনিয়া নিবর্ত্তিল কন্যাগণ।
চলেন উত্তরমুখে পাণ্ডুর নন্দন।।

পর্ব্বত দেখেন বীর অতি মনোহর।
বিরাজিত অর্দ্ধ অঙ্গ শঙ্করী শঙ্কর।।
নানা রত্ন বিভূষিতা আসন গম্ভীরা।
অন্ধকার আলো করে যেন চন্দ্র তারা।।
তাহে বিরচিত কুণ্ড ত্রিভুবন সার।
স্ফটিক সমান শুভ্র চন্দ্রের আকার।।
কুণ্ডে নামি স্নানদান করি পঞ্চজন।
দুই কুল কৌরবের করেন তর্পণ।।
স্নান করি তিনবার প্রদক্ষিণ কৈল।
মণিময় মহেশে দেখি তুষ্ট হইল।।
বিমল ঈশ্বর শিব সাক্ষাতে দেখিয়া।
প্রণাম করেন সবে অঙ্গ লোটাইয়া।।
কৃমী কীট পশু পক্ষী যদি তথা মরে।
রুদ্ররূপ ধরি তারা যায় রুদ্রপুরে।।
এ সকল তত্ত্ব শুনি লোকের বদনে।
পুনঃ পুনঃ প্রণাম করিল ছয়জনে।।
ভক্তিভাবে ভোলানাথে মাগিলেন বর।
ভূতনাথ ভূতাধীশ তুমি ভূতেশ্বর।।
কৃত্তিবাস কালীকান্ত দেহ এই বর।
তোমার প্রসাদে যেন দেখি দামোদর।।

বর মাগি ছয়জন চলে তথা হৈতে।
পর্ব্বত কেদার পার হল মহা শীতে।।
যাইতে উত্তরমুখে পাণ্ডুর নন্দন।
দুই জলাশয় তাহে দেখে সুশোভন।।
ধর্ম্মের নির্ম্মাণ তাতে প্রফুল্ল কমল।
হংস চক্রবাক ক্রীড়া করয়ে সকল।।
অপ্সরী কিন্নরী তথা নানা ক্রীড়া করে।
মুনিগণ তপ করে পর্ব্বত উপরে।।
খেলয়ে মর্কটগণ পেয়ে দিব্য শাখী।
বিবিধ বিধানে সুখ করে পশু পাকী।।
কতক্ষণ বিশ্রাম করিয়া তার তীরে।
জল হেতু ভীমেরে পাঠান সরোবরে।।
ভারত-পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
তাঁহার আশিসে রচে কাশীরাম দাস।।