০২. পঞ্চ পাণ্ডবের বিরাট রাজসভায় প্রবেশ

কাঁখেতে দেবন মণি মাণিক্যের সাজ।
সভামাঝে প্রথমতঃ যান ধর্ম্মরাজ।।
যুধিষ্ঠির রূপ দেখি মুগ্ধ মৎস্যপতি।
সভাজন প্রতি চাহি কহে শীঘ্রগতি।।
এই যে পুরুষ আসে কন্দর্প আকার।
ইহাকে কখন কেহ দেখেছ কি আর।।
ইন্দ্র চন্দ্র সূর্য্য সম প্রভা কলেবর।
ঐরাবত সম গতি পরম সুন্দর।।
কাঞ্চন পর্ব্বত যেন ভূমে শোভা পায়।
আমার সভায় আসে, বুঝি অভিপ্রায়।।
ক্ষত্রিয় লক্ষণ সর্ব্ব, ব্রাহ্মণের নয়।
রাজচক্রবর্ত্তী প্রায় সর্ব্ব তেজোময়।।
যে কাম্য করিয়া এই আসিতেছে হেথা।
ক্ষত্র দ্বিজ যেবা হৌক পূরাব সর্ব্বথা।।
হেন বিচারিতে উপনীত ধর্ম্মরাজ।
কল্যান করিয়া দাণ্ডাইল সভামাঝ।।
নমস্কার করি মৎস্যপতি মৃদুভাষে।
বিনয় পূর্ব্বক ধর্ম্মরাজকে জিজ্ঞাসে।।
কে তুমি, কোথায় বাস, এলে কোথা হৈতে।
কোন্ কুল গোত্রে জন্ম, কেমন বংশেতে।।
যে কাম্য তোমার, মাগি লহ মম স্থান।
রাষ্ট্রপুর গৃহ দণ্ড ছত্র আর যান।।
তোমারে দেখিয়া মম হেন মনে লয়।
যাহ মাগ তাহা দিব করেছি নিশ্চয়।।
এত শুনি কহিছেন ধর্ম্ম-অধিকারী।
বৈয়াঘ্র আমার গোত্র, কঙ্ক নাম ধরি।।
যুধিষ্ঠির নৃপতির ছিনু আমি সখা।
কিছু ভেদ নাহি ছিল যেন আত্মা একা।।
শত্রু নিল রাজ্য, বনে গেল পঞ্চ ভাই।
তাঁর সম লোক আমি বিশেষ নিপুণ।।
হেথা আসিলাম আমি শুনি তব গুণ।।
এত শুনি মৎস্যরাজ বলেন হরিষে।
সদাই আমার বাঞ্ছা এমত পুরুষে।।
দৈবযোগে মম ভাগ্যে তোমারে পাইনু।
রাজ্য ধন তব করে সকলি অর্পিনু।।
আমার সদৃশ হয়ে থাকহ সভায়।
যত মন্ত্রী পাত্র মোর সেবিবে তোমায়।।
এত শুনি বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
কোন দ্রব্যে কভু মম নাহি প্রয়োজন।।
হবিষ্য আহারী আমি, শয়ন ভূমিতে।
কিছু যদি লাগে, তবে লৈব তোমা হৈতে।।
হেনমতে সেই স্থানে রহে যুধিষ্ঠির।
কতক্ষণে উপনীত বৃকোদর বীর।।
হাতেতে করিয়া চাটু মৃগপতি গতি।
হেমন্ত পর্ব্বত প্রায় কিবা যূথপতি।।
সভাতে প্রবেশে যেন বাল-সূর্য্যোদয়।
দেখি রিবাটের মনে হইল বিস্ময়।।
রাজার সভায় উপনীত বৃকোদর।
জয় হৌক, বলি বীর তুলে দুই কর।।
চতুর্ব্বর্ণ শ্রেষ্ঠ আমি হই যে ব্রাহ্মণ।
গুরু-উপদেশে পারি করিতে রন্ধন।।
মোর সম রন্ধনেতে নাহি সূপকার।
মল্লযুদ্ধাভ্যাস কিছু আছয়ে আমার।।
এত শুনি মৎস্যপতি বলেন বচন।
সূপকার তোমারে না লাগে মম মন।।
কুবের ভাস্কর যেন শোভিয়াছে ভূমি।
সর্ব্বক্ষিতি পালনের যোগ্য হও তুমি।।
সূপকার যোগ্য তুমি নহ কদাচন।
এত শুনি বৃকোদর বলেন বচন।।
যুধিষ্ঠির নৃপতির ছিনু সূপকার।
আমাতে বড়ই প্রীতি আছিল রাজার।।
সিংহ ব্যাঘ্র বৃষ আর মহিষ বারণ।
যাহা সহ যুঝাইবে, দিব আমি রণ।।
মল্লযুদ্ধে আমা সম নাহিক মানুষে।
আমার পালিল রাজা কৌতুক বিশেষে।।
বল্লব আমার নাম ‍রাখে ধর্ম্মরাজ।
তাঁহার অভাবে ভ্রমি পৃথিবীর মাঝ।।
বিরাট কহিল, ইথে নাহিক সংশয়।
তোমার সব কথা বিচিত্র কিছু নয়।।
বসুন্ধরা শাসিবারে যোগ্য হও তুমি।
যে কামনা কর তুমি দিব তাহা আমি।।
আমার আল যত আছে সূপকার।
সবার উপরে তব হবে অধিকার।।
এত বলি পাকগৃহে ভীমে পাঠাইল।
এমতে রহিল ভীম কেহ না জানিল।।
তবে কতক্ষণে আসিলেন ধনঞ্জয়।
স্ত্রীবেশ কুণ্ডল শঙ্খ করেতে শোভয়।।
দীর্ঘকেশ বেণী নামিয়াছে পৃষ্ঠোপরে।
ভূমিকম্প যেন মত্তগজ-পদভরে।।
দূরে দেখি সভাসদে কহে মৎস্যপতি।
এই যে আসিছে যুবা ছদ্ম নারীজাতি।।
ইহারে কখন কেহ দেখেছ কি আর।
মনুষ্য না হয় এই দেবের কুমার।।
ইহাকে দেখি আশ্চর্য্য হয়েছে সবাই।
কেবা এ বুঝহ শীঘ্র আসিছে হেথায়।।
এই মত মৎস্যপতি চিত্তে বিচারিতে।
উপনীত হইলেন অর্জ্জুন সভাতে।।
পার্থে হেরি সভাজন মানিল বিস্ময়।
সবিস্ময়ে ধনঞ্জয়ে সবে নিরখয়।।
বিস্ময়েতে জিজ্ঞাসেন বিরাট রাজন।
কহ কেবা হও তুমি কাহার নন্দন।।
কোন প্রয়োজনে হেথা তব আগমন।
ক্ষম হৈলে করি তব প্রার্থনা পূরণ।।
অর্জ্জুন বলেন, আমি হই যে নর্ত্তক।
যেই হেতু বহুকাল আসি নপুংসক।।
নৃত্যগীতে মম সম নাহিক ভুবনে।
শিখাইতে পারি আমি দেবকন্যাগণে।।
বিরাট বলিল, ইহা নাহি লয় মন।
এ কর্ম্মের যোগ্য তুমি নহ কদাচন।।
এই যে স্ত্রীবেশ তুমি ভূষিয়াছ গায়।
তোমার অঙ্গেতে ইহা শোভা নাহি পায়।।
ভূতনাথ-অঙ্গে যথা ভস্ম আচ্ছাদিল।
দিনকর তেজ যেন মেঘেতে ঢাকিল।।
তোমার এ ভুজতেজ যে ধনু সহিল।
সে ধনুর তেজে সব পৃথিবী কাঁপিল।।
পার্থ কহিলেন, রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
তাঁর ভার্য্যা দ্রৌপদীর ছিলাম গায়ন।।
শত্রু রাজ্য নিল, তাঁরা প্রবেশিল বন।
এই হেতু তব রাজ্যে আসিনু রাজন।।
আমি নপুংসক রাজা নাম বৃহন্নলা।
নৃত্য গীত বাদ্য শিক্ষা দেই রাজবালা।।
রাজা বলে, বৃহন্নলা রহ মম ঘরে।
সব সমর্পণ আমি করিনু তোমারে।।
ধন জন পুত্র দারা রাখ এই পুর।
পুত্র তুল্য তুমি এই রাজ্যের ঠাকুর।।
উত্তরাদি কন্যা যত আছে মম পুরে।
নৃত্য গীতে বিশারদা করহ সবারে।।
এত বল অন্তঃপুর মধ্যে পাঠাইল।
এমতে রহেন পার্থ কেহ না জানিল।।
নকুল ক্ষণেক পরে করে আগমন।
দূর হৈতে নৃপ তাঁরে করে নিরীক্ষণ।।
মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হৈল শশধরে।
সূতবেশ তুরঙ্গ প্রবোধ বাড়ি করে।।
দুইবিতে অশ্বগণ করে নিরীক্ষণ।
মদমত্ত গতি যেন প্রমত্ত বারণ।।
প্রণমিয়া দাঁড়াইল রাজ সভাতলে।
কোমল মধুর ভাষে নৃপতিরে বলে।।
অশ্ব চিকিৎসক, নাম গ্রন্থিক আমার।
জীবিকার্থে আসিলাম তোমার আগার।।
রাজা বলে, এলে ‍তুমি কোন্ দেশ হৈতে।
দেবপুত্র প্রায় তোমা, লয় মম চিতে।।
নকুল বলিল, কুরু ধর্ম্মের নন্দন।
লক্ষ লক্ষ অশ্ব তাঁর না যায় গণন।।
সব অশ্ব পালিবারে মোরে নিয়োজিল।
আমার পালনে অশ্বগণ বৃদ্ধি হৈল।।
কড়িয়ালি দেই আমি যে ঘোড়ার মুখে।
কোনকালে তার দুষ্টভাব নাহি থাকে।।
রাজা বলে, যত মম আছে অশ্বগণ।
সকলি রক্ষার্থ তোমা করিনু অর্পণ।।
নকুল করিল অশ্বগৃহেতে গমন।
কতক্ষণে সহদেব দিল দরশন।।
তরুণ অরুণ যথা উঠে পূর্ব্বভিতে।
অগ্নিশিখা যেন যজ্ঞে দেখি আচম্বিতে।।
গোপজাতি যেন ধরিয়াছে নট বশে।
গোপুচ্ছ ছান্দ দড়ি আছয়ে বিশেষ।।
রাজা সহ সবিস্ময় যত সভাজন।
প্রণাম করিয়া বলে, মাদ্রীর নন্দন।।
জীবিকার্থে আসিলাম তোমার নগর।
গবী রক্ষা হেতু মোরে রাখ নৃপবর।।
আমার রক্ষণে গবী ব্যাধি নাহি জানে।
ব্যাঘ্রভয় চৌরভয় নাহি কদাচনে।।
বিরাট বলিল, ইথে তুমি যোগ্য নহ।
কে তুমি, কি নাম ধর, সত্য করি কহ।।
ইন্দ্র চন্দ্র কামদেব জিনি তব ‍মূর্ত্তি।
বুদ্ধি পরাক্রমে বুঝি রাজচক্রবর্ত্তী।।
বৃহস্পতি শুক্র সম নীতি তব ভাষ।
খড়গধারী হস্ত তব, পদ্মধারী পাশ।।
সহদেব বলে, জান পাণ্ডুর নন্দন।
তাঁহার যতেক গবী লোকে অগণন।।
করিতাম সেই সব গোধন পালন।
মম গুণে প্রীত ছিল পাণ্ডুর নন্দন।।
আর এক মহৎ কর্ম্ম জানি নরনাথ।
ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান মম জ্ঞাত।।
পৃথিবী ভিতরে নৃপ যত কর্ম্ম হয়।
গৃহেতে বসিয়া তাহা জানি মহাশয়।।
ধর্ম্মরাজ সভাতলে ছিনু দীর্ঘকাল।
যুধিষ্ঠির মোরে নাম দিল তন্তিপাল।।
রাজা বলে, যত বল, সম্ভবে তোমারে।
যে কাম্য তোমার থাকে, লহ মোর পুরে।।
যত গবী আছে মম আর রক্ষিগণ।
তোমারে দিলাম সব, করহ পালন।।
এমত কহিয়া সহদেবে মহামতি।
পঞ্চ জনে বাঞ্ছামত দেন নরপতি।।
মৎস্যদেশে পাণ্ডবেরা রহেন গোপনে।
অস্তগিরি মধ্যে যেন সহস্রকিরণে।।
রহিল অনল যেন ভস্মমধ্যে লুকি।
কেহ না জানিল, সবে অনুক্ষণ দেখি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।