০১. সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের হ্রদ নিকটে গমন

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকাইল দুর্য্যোধন।।
পাণ্ডবের সৈন্যগণ খুঁজিয়া বেড়ায়।
দুর্য্যোধন রাজারে দেখিতে নাহি পায়।।
আপন শিবিরে যান ধর্ম্ম নরবর।
দুর্য্যোধন খুঁজিতে পাঠান নিজ চর।।
এত শুনি জিজ্ঞাসিল শ্রীজনমেজয়।
কহিলা অপূর্ব্ব কথা মুনি মহাশয়।।
কুরুকুলপতি মহারাজ দুর্য্যোধন।
হ্রদ মধ্যে কি প্রকারে রহিল তখন।।
কি উপায় করিলেন পিতামহগণ।
শুনিবার বাঞ্ছা বড় কহ তপোধন।।
মুনি বলে অবধান কর নরপতি।
যেইমতে হত দুর্য্যোধন দুষ্টমতি।।
গদাপর্ব্ব কথা কহি শুন নৃপবর।
যেইমতে পুনরপি হইল সমর।।
শত্রুজয়ী লোক অপমানে কোপ মন।
দ্বৈপায়ন হ্রদে প্রবেশিল দুর্য্যোধন।।
গদার প্রহারে বীর সলিল বিদারি।
তাহাতে পশিল রাজা হাতে গদা করি।।
ভ্রাতৃ বন্ধু সহিত নৃপতি যুধিষ্ঠির।
দুর্য্যোধন অন্বেষিতে যান বহু বার।।
বন উপবন খুঁজিলেন নানা দেশ।
না পাইয়া দুর্য্যোধনে ভাবেন বিশেষ।।
মারিয়া বিপক্ষ করিলাম কোন্ কার্য্য।
পুনর্ব্বার দুর্য্যোধন লইবেক রাজ্য।।
পুনর্ব্বার আসিয়া করিবে মহারণ।
পলাইয়া আছে কোথা রাজা দুর্য্যোধন।।
এত কহি বসিয়া আছেন ধর্ম্মরায়।
হেথা তিন বীর দুর্য্যোধন কাছে যায়।।
অশ্বন্থামা কৃতবর্ম্মা কৃপ সুপন্ডিত।
হ্রদের নিকটে গিয়া হৈল উপনীত।।
জলস্তম্ভে দুর্য্যোধন আছেন নির্জ্জনে।
হ্রদের উপরে থাকি ডাকে তিনজনে।।
উঠ উঠ ‍রাজা যুদ্ধে না হও বিমুখ।
যুধিষ্ঠিরে জিনিয়া ভুঞ্জহ রাজ্যসুখ।।
পলাইয়া কেন তুমি পাও অধোগতি।
রণেতে কাতর নহে ক্ষত্রিয় এ মতি।।
পাণ্ডবের সৈন্য সব করিব সংহার।
রাখিতে নারিবে কৃষ্ণ সহায় তাহার।।
তা সবার বাক্য শুনি বলে দুর্য্যোধন।
বড় ভাগ্যে সংগ্রামে তরিলা তিনজন।।
যে বলিলে সে সম্ভবে তোমা সবাকায়।
যুদ্ধে জয়ী হব তোমা সবার কৃপায়।।
পড়িল আমার সৈন্য নাহি একজন।
পাণ্ডবের সৈন্য সব করে মহারণ।।
একেশ্বর সমর না হয় সমুচিত।
বলবন্ত সহিত সংগ্রাম নহে হিত।।
তবে অম্বন্থামা বহু দর্পের আগার।
প্রতিজ্ঞা করিল করি মহা অহঙ্কার।।
এই আমি মারিব সকল পরদল।
উঠ দুর্য্যোধন না হইও হীন বল।।
পাঞ্চালক সোমবংশ করিব সংহার।
আমার প্রতিজ্ঞা এই শুন সারোদ্ধার।।
পাঞ্চালক সোমবংশ করিব সংহার।
আমার প্রতিজ্ঞা এই শুন সারোদ্ধার।।
পঞ্চালে না মারি যদি কবচ এড়িব।
ধিক্ অকারণ ব্যর্থ শরীর ধরিব।।
এ নহে ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম শুন মহারাজ।
প্রাণপণ চেষ্টায় সাধিব নিজকাজ।।
শুন মহারাজ তুমি নাহি কর ভয়।
চারি বীরে মারিব বিপক্ষ দুরাশয়।।
এই তিন থাকিতে তোমার কেন ডর।
পুনরপি চারি বীর করিব সমর।।
হয় ধনঞ্জয়ে জিনি পুনঃ রাজ্য পাব।
নহে বা সমরে পড়ি সদ্য স্বর্গে যাব।।
হেন জানি দুর্য্যোধন রণে দেহ মন।
চারি মহাবীরেতে করিব মহারণ।।
হেন কথা শুনি বলে রাজা দুর্য্যোধন।
শুন মহারথী সব আমার বচন।।
প্রাণেতে পীড়িত আমি শুন চারি বীর।
অস্ত্রাঘাতে ভগ্ন মম সকল শরীর।।
রণ জিনিবারে যদি করিয়াছ মন।
আজি নিশি বঞ্চিয়া করিব কালি রণ।।
এই কথা আলাপে আছেন চারিজন।
পক্ষী মারিবারে ব্যাধ গেল সেই বন।।
ভীমের তোষণ লাগি মৃগয়া করিয়া।
সেই হ্রদে জলপানে গেল মৃগ লৈয়া।।
সেই ব্যাধ শুনিল সকল সমাচার।
ব্যাধ বলে বড় কর্ম্ম হইল আমার।।
যাহারে খোঁজেন সদা রাজা যুধিষ্ঠির।
হ্রদে পলাইয়া আছে সেই কুরুবীর।।
যুধিষ্ঠিরে কহিলে এ সব বিবরণ।
আনন্দিত হইবেন পাণ্ডুর নন্দন।।
এত ভাবি ব্যাধগণ হরষিত মনে।
দ্রুতগতি নিবেদিল ভীমের চরণে।।
ভীমসেন শুনি হল হরষিত মন।
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরে কহিল তখন।।
জলমধ্যে আশ্রয় করিল দুর্য্যোধন।
কুলের কলঙ্ক পাপ বড়ই দুর্জ্জন।।
ভীমের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।
ভ্রাতৃবন্ধু সহ রাজা আনন্দে অস্থির।।
যথা আছে জলমধ্যে রাজা দুর্য্যোধন।
তথাকারে সর্ব্ব বীর করিল গমন।।
কৃষ্ণে আগু করি সবে তথা গেল চলি।
পাণ্ডুর নন্দন সব বলে মহাবলী।।
সৈন্য সহ চলিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।
যথা জলমধ্যে আছে দুর্য্যোধন বীর।।
কটকের নিনাদ হইল বিপরীত।
শব্দ শুনি চারি বীর হৈল বড় ভীত।।
কৃপ কৃতবর্ম্মা বলে হইল অকাজ।
সৈন্য সহ আইলেন যুধিষ্ঠির রাজ।।
কি করিব মহারাজ বলহ উপায়।
কোন আজ্ঞা হয় দুর্য্যোধন কুরুরায়।।
দুর্য্যোধন বলে হও তোমরা অন্তর।
আমি মায়া করি থাকি জলের ভিতর।।
রাত্রি অনুসারে সবে হবে এক স্থানে।
যুধিষ্ঠিরে মারি পুনঃ সাধিব সম্মানে।।
রাজার বচনে চলি গেল তিনবীর।
নরপতি ডুবাইল সলিলে শরীর।।
তিনজন বনমধ্যে করিল নিবাস।
রাজারে স্মরিয়া ঘন ছাড়িল নিশ্বাস।।
নানা শোকে সন্তাপ করয়ে তিন বীর।
হেনকালে তথা আইলেন যুধিষ্ঠির।।
হ্রদতীরে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণে জিজ্ঞাসেন।
জল মধ্যে দুর্য্যোধন কিমতে আছেন।।
ধর্ম্মরাজ-বাক্য শুনি বলেন শ্রীহরি।
মায়াবন্ত দুর্য্যোধন আছে মায়া করি।।
মন্ত্রের প্রভাবে আছে সেই দুরাচার।
উপায়েতে রাজা দেখা পাইবে তাহার।।
মায়া করি ইন্দ্র সব দানবে দলিল।
বামন হইয়া হরি বলিরে ছলিল।।
উপায়েতে কার্য্য সিদ্ধ করে বিজ্ঞজনে।
চিন্তহ উপায় রাজা আমার বচনে।।
তোমা হৈতে অভিমানী বড় দুর্য্যোধন।
সহিতে না পারে কভু নিন্দার বচন।।
মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।
যাহায় শ্রবণে নর হয় নিষ্কলুষ।।