০১. দুর্য্যোধনের প্রতি ভীষ্মাদির হিতোপদেশ

জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ তপোধন।
সত্য হতে মুক্ত যদি হৈল পঞ্চজন।।
আপন বিভাগ রাজ্য লাভের কারণ।
কহকিবা করিলেন পিতামহগণ।।
ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্য্যোধনে বুঝবারে।
কোন্ দূত পাঠালেন হস্তিনানগরে।।
উত্তর গোগ্রহ যুদ্ধ কৌরব প্রধান।
পাইলেন অর্জ্জুনের স্থানে অপমান।।
শিবিরে আসিয়া কিবা করিল বিচার।
কহ শুনি মুনিবর করিয়া বিস্তার।।

মুনি বলে শুনহ নৃপতি জন্মেজয়।
যুদ্ধে পরাভূত হয়ে কৌরব তনয়।।
লণ্ড ভণ্ড হয়ে রাজা আইল শিবিরে।
মহামনস্তাপ হেতু দুঃখিত অন্তরে।।
শিবা হাতে সিংহ যেন পেয়ে অপমান।
দোর্দ্দূলের হাতে যেন কুঞ্জরপ্রধান।।
একাপার্থ করিলেন সবাকারে জয়।
ব্যকুল কৌরব অতি পেয়ে লজ্জা ভয়।।

কর্ণ বলিলেন রাজা ত্যজ চিন্তা মনে।
উপায়ে মারিব পঞ্চ পাণ্ডুপুত্রগণে।।
বাসব উপায়ে বৃত্রাসুরেরে মারিল।
উপায় করিয়া শিব ত্রিপুরে বধিল।।
বিনা উপায়েতে সিদ্ধ না হয় রাজন।
উপায় সৃজিয়া মার পাণ্ডুপুত্রগণ।।
বিরাট নগরে দূত দেহ পাঠাইয়া।
পাণ্ডবে হেথায় আন কপট করিয়া।।
মুখ্য মুখ্য সেনাপতি যত বীরগণে।
সঙ্গেতে করিয়া তুমি রাখ এইখানে।।
বিরাট দ্রুপদ আর ভাই পঞ্চজন।
ভোজন কারণে রাজা কর নিমন্ত্রণ।।
সূপকারগণে সবে সঙ্কেত করহ।
অন্নপান সনে বিষ সবাকারে দেহ।।
বিষপানে হীনবল হবে সর্ব্বজন।
যতেক প্রহরী বেড়ি করিবে নিধন।।
পূর্ব্বাপর আছে হেন শাস্ত্রের বিহিত।
বলে ছলে শত্রুকে মারিবে সুনিশ্চিত।।
ছল করি ফল মধ্যে রহি পুরষ্কার।
নমুচি দানবে পাঠাইল যম ঘর।।
সে কারণে এই যুক্তি কহিনু তোমারে।
মারহ পাণ্ডুর পুত্র বুদ্ধি অনুসারে।।
নতুবা সকল সৈন্যে সাজ নরপতি।
বিরাট নগরে চল যাইব সম্প্রতি।।
বিরাটের পুর সব চৌদিকে বেড়িয়া।
অগ্নি দিয়া পাণ্ডবেরে মার পোড়াইয়া।।
ইমত বিধান করহ নরবর।
উলম্ব উচিত নহে করহ সত্বর।।

বলিলেন রাজা ইহা নাহি লয় মনে।
তার শক্তি মারিবে পাণ্ডব পঞ্চজনে।।
এতেক উপায় আমি করিলাম পূর্ব্ব।
কপট পাশাতে তার হরিলাম সর্ব্ব।।
পরে দিই বনবাস দ্বাদস বৎসর।
বৎসরেক অজ্ঞাত বসতি তার পর।।
সভামাঝে পাণ্ডব করিল যেই পণ।
তাহাতে হৈল মুক্ত দৈব নিবন্ধন।।
আমার উপায় যত হইল বিফল।
এখন সহায় তার হৈল মহাবল।।
যে হোক সে হোক যুদ্ধ করিলাম পণ।
বিনা যুদ্ধ রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।
আমারে জিনিয়া পাণ্ডুপুত্র ‍রাজ্য লয়।
আমি বা পাণ্ডবে জিনি মম রাজ্য হয়।।
প্রতিজ্ঞা আমার এই না হইবে আন।
ইহার উপায় সখা করহ বিধান।।
না মারিব যে পর্য্যন্ত পাণ্ডু-পুত্রগণ।
রাজ্যে রাজ্যে অনুচর করহ প্রেরণ।।
নিবসেন যত রাজা মম অধিকারে।
যুদ্ধ হেতু বরিয়া আনহ সবাকারে।।
সবা মধ্যে প্রধান সুমন্ত্র নরপতি।
কলিঙ্গ কামদ ভোজ বাহিলক প্রভৃতি।।
সুশর্ম্মা নৃপতি আদি যত রাজগণ।
যুদ্ধ হেতু সবাকারে করহ বরণ।।
একাদশ অক্ষৌহিণী করহ সাজন।
হইবে অবশ্য যুদ্ধ না হয় খণ্ডন।।
অস্ত্র শস্ত্র বহুবিধ করহ সঞ্চয়।
মিত্রামিত্র বলাবল করহ নির্ণয়।।

রাজার বচন শুনি রাধার নন্দন।
সাধু সাধু বলিয়া প্রশংসে সেইক্ষণ।।
উত্তম বলিয়া যুক্তি নিল মম মনে।
তুমি হে ক্ষন্ত্রিয়শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি বলে গুণে।।
দেবগণ মধ্যে যেন দেব শচীপতি।
প্রজাপতি মধ্যে যেন দক্ষ মহামতি।।
তারাগণ মধ্যে যেন শীতল কিরণ।
তাদৃশ ক্ষন্ত্রিয় মধ্যে তোমারে গণন।।
ক্ষত্রধর্ম্ম শাস্ত্র যত আছে পূর্ব্বাপর।
ক্ষন্ত্রিয় হইয়া যুদ্ধে না করিবে ডর।।
সে কারণে ক্ষত্রধর্ম্ম করাহ উদয়।
যুদ্ধ হেতু বরহ যতেক রাজচয়।।
হয় বা না হয় যুদ্ধ বিধির লিখন।
সৈন্য সমাবেশ কর না ছাড় বিক্রম।।

এত বলি আজ্ঞা দিল ডাকি অনুচরে।
লিখিলেন লিখন সমস্ত নৃপবরে।।
অনন্তরে কহিলেন গঙ্গার তনয়।
যে যুক্তি করিলা মম হৃদয়ে না লয়।।
ভাই ভাই বিচ্ছেদ হইতে না যুয়ায়।
হিত উপদেশ রাজা কহিব তোমায়।।
মান বৃদ্ধি নাই ইথে না হইবে যশ।
হারিলে জিনিলে তুল্য না হবে পৌরষ।।
অতএব যুদ্ধে রাজা নাহি প্রয়োজন।
পাণ্ডব সহিত সবে করহ মিলন।।
পাণ্ডবেরা ‍নাহি তব করে অত্যাচার।
আপনি ইচ্ছায় ভাগ যে দিবে তাহার।।
তাহা পেয়ে সুখী হবে ভাই পঞ্চজন।
এক্ষণে এমত বুদ্ধি না কর রাজন।।
পাশায় জিনিয়া তুমি নিলে সর্ব্ব ধন।
তবু তারা তোমা প্রতি নহে ক্রোধমন।।
যে সত্য করিল তারা সবার সাক্ষাতে।
ধর্ম্ম অনুসারে মুক্ত হইল তাহাতে।।
পূর্ব্বে ছিল তাহাদের যেই অধিকার।
তাহা ছাড়ি দিতে হয় উচিত তোমার।।
তাহাতে প্রবোধ যদি নহে কদাচন।
তবে যেই মনে লয় করিও তখন।।
পূর্ব্বে অঙ্গীকার তুমি করিলে আপনে।
সত্য হতে মুক্ত যদি হয় কদাচনে।।
পুনঃ আসি রাজ্য তবে লইবে পাণ্ডব।
সেইকালে সাক্ষাতে আছিনু মোরা সব।।
এক্ষণে যাহাতে তুষ্ট কুন্তীপুত্র সব।
তাহা দিয়া রাজা তুমি প্রবোধ পাণ্ডব।।
তাহা দিয়া প্রবোধহ পাণ্ডু পুত্রগণে।
ভাই ভাই বিরোধ না হয় প্রয়োজনে।।

ভীষ্মের এতেক বাক্য শুনি দুর্য্যোধন।
ক্ষণেক থাকিয়া তবে বলিলা বচন।।
শত্রুকে ভজিব আমি মনে নাহি লয়।
যে হোক সে হোক যুদ্ধ করিব নিশ্চয়।।
ক্ষত্রমধ্যে অযোগ্যতা গণি এই কর্ম্ম।
শত্রুকে যে রাজ্য ত্যজে, ধিক্‌ তার জন্ম।।

বলিলেন ভীষ্ম তবে যাহা ইচ্ছা কর।
শুনিলে উপদেশ যুদ্ধানলে মর।।
অনন্তরে দ্রোণ কৃপ বাহলীক রাজন।
অষ্টকেতু ধৃতরাষ্ট্র গুরুর নন্দন।।
বিদ্যুর প্রভৃতি আর যত মন্ত্রিগণ।
একে একে দুর্য্যোধনে কহিল বচন।।
ভীষ্ম যে কহিলা তাহা কর মহারাজ।
ভাই ভাই বিরোধে না হয় ভদ্র কাজ।।
হলক্ষয় হইবেক লোকে অপমান।
তাহাতে পৌরুষ কিছু না হয় বিধান।।
আপন পৈতৃক ভাগ যে হয় উচিত।
তাহা দেহ পাণ্ডবেরে শাস্ত্রীয় বিহিত।।
যে সত্য করিল তাহা সভায় গোচর।
তাহাতে হইর মুক্ত পঞ্চ সহোদর।।
পূর্ব্বে যেই অধিকার ছিল তা সবার।
যাই ইন্দ্রপ্রস্থ তুমি দেহ পুনর্ব্বার।।
করিলে অপমান না করিল মনে।
অন্য কেহ হৈলে না সহিত কদাচনে।।
বাসুর নরমধ্যে খ্যাত পঞ্চজন।
মূর্ত্তেকে জিনিবারে পারে ত্রিভুবন।।
উত্তর গোগ্রহে যুদ্ধ দেখিলে আপনে।
একেশ্বর ধনঞ্জয় সবাকারে জিনে।।
বিরাটের গাভীগণ মুক্ত করি দিল।
ধায় অর্জ্জুন বীর কারে না মারিল।।
আমায় আক্রোশ যদি থাকিত তাহার।
তার কেন সংগ্রামে করিল পরিহার।।
অন্তর দেখ রাজা গন্ধর্ব্ব প্রধান।
আমায় ধরিয়া নিয়া করিল প্রয়াণ।।
মুখ্য মুখ্য যতেক ছিলেন সেনাপতি।
ছাড়াইতে না হইল কাহার শকতি।।
তোমারে আক্রোশ যদি পাণ্ডবের ছিল।
তবে কেন পার্থ তোমা মুক্ত করি দিল।।
যদি বল উত্তর গো গ্রহে ধনঞ্জয়।
পরকার্য্যে অপমান করিল আমায়।।
দ্রৌপদীর বাক্য পার্থ নারে খণ্ডিবারে।
এই হেতু গাভী মুক্ত করিল প্রকারে।।
ভাই ভাই যুদ্ধে কিছু নাহি অপমান।
জয় পরাজয় মানি একই সমান।।
কহিলে পরম শত্রু মোর পঞ্চজন।
তাহারে ভজিলে হয় কুযশ ঘোষণ।।
তুমি শত্রুভাব কর তাহারা না করে।
জ্ঞাতি মধ্যে যে জন অধিক বল ধরে।।
সে হয় প্রধান রাজা কহিনু নিশ্চয়।
পূর্ব্বের কাহিনী শুন কহি যে তোমায়।।

ত্রেতাযুগে ছিল রাজা লঙ্কার ঈশ্বর।
বাহুবলে জিনিল সকল চরাচর।।
ক্ষন্ত্রবংশে চূড়ামণি শ্রীরাম লক্ষণ।
তাঁহাদের সহ দ্বন্দ্বে হইল নিধন।।
মুখ্য মুখ্য যতেক আছিল সেনাগণ।
শক্তি না হইল কার করিতে মোচন।।
অহিংসা পরমধর্ম্ম শাস্ত্রেতে বাখানে।
হিংসা সম পাপ নাহি বলে জ্ঞানিজনে।।
অগ্র হৈতে হিংসাবুদ্ধি যেই জন করে।
পঞ্চ মহাপাপ আসি বেড়য়ে তাহারে।।
জগতে অকীর্ত্তি ঘোষে লোকে নাহি মানে।
কহিব পূর্ব্বের কথা শুন সাবধানে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।