মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৪

মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৪

বিদুর ইতিমধ্যেই ভীমের হাত থেকে ধৃতরাষ্ট্রকে অনেকখানি সরিয়ে আনতে পেরেছেন। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিন ভ্রাতাই একসঙ্গে একই শিক্ষায় একই সহবতে বড় হয়ে উঠেছেন, ধৃতরাষ্ট্র সকলের চাইতে বড়ো, ভালোবাসাই স্বাভাবিক। তা ব্যতীত, ব্যাসদেবের রচনায় বিদুরকে ধর্মাতা এবং পরম বুদ্ধিমান বলে জানানো হয়েছে। বিদুর যে প্রকৃতই ধর্ম সে বিষয়ে দ্বৈপায়ন একটা গল্পও পাঠকদের উপহার দিলেন। মাণ্ডব্য নামে এক মৌন তপস্বী ছিলেন। একদিন কয়েকজন চোর চুরি করে রাজরক্ষীদের ভয়ে পালিয়ে যেতে যেতে মাণ্ডব্যের আশ্রমে ঢুকে সব ধন-দৌলত সেখানেই লুকিয়ে রাখলেন। রক্ষীরা খুঁজে খুঁজে সেই আশ্রমে এলেন। সেখানে সমস্ত অপহৃত ধন দেখে মাণ্ডব্যকে রক্ষীরা নানা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করার জন্য কোনো জবাব দিলেন না। তখন চোরেদের সঙ্গে রক্ষীরা মাণ্ডব্যকে ধরে নিয়ে গিয়ে শূলে চড়ালেন। মাণ্ডব্যর কিন্তু তাতে মৃত্যু হল না। শেষে রাজা তার পরিচয় পেয়ে শূল থেকে নামালেন। কিন্তু শূলের অগ্রভাগ ভেঙে দেহে রয়ে গেল। একদিন তিনি ধর্মরাজের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন কর্মের ফলে আমাকে এই দণ্ড দিয়েছেন? ধর্ম বললেন, আপনি বাল্যকালে একটি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তারই এই ফল। মাণ্ডব্য বললেন, ‘আপনি লঘু পাপে আমাকে এই গুরু দণ্ড দিয়েছেন। আমার শাপে আপনি শূদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন।’

সেই শাপের ফলেই ধর্ম বিদুররূপে দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন। সুতরাং সেই ধর্মের প্রতি ভক্তি থাকা, বিশ্বাস থাকা, কিছু আশ্চর্য নয়। বিদুর যদি সচেষ্ট হন ভীষ্মর হাত থেকে ধৃতরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনা কিছু কঠিন কাজ নয়। বস্তুত, ধৃতরাষ্ট্রও যে খুব অনিচ্ছুক ছিলেন তা নয়, তিনি রাজা, অথচ রাজ্য চালাচ্ছেন ভীষ্ম, এই অবস্থাটা তার মনে হয়তো একটা কণ্ঠকের মতো বিধেও থাকতো। প্রজারা ভীমের অধীন, ভীমের প্রতিই তাদের অবিচলিত শ্রদ্ধা। এটা তার রাজার সিংহাসনে বসে ভালো লাগার কথা নয়। ক্রমে ক্রমে হয়তো একটা হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। ধূর্ত বিদুর সেই সুযোগটা গ্রহণ করে ক্ষণকাল অপেক্ষমাণ না থেকে তৎক্ষণাৎ সেই ক্ষেত্রে বারিসিঞ্চন করতে আরম্ভ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীমের সঙ্গে কোনো পরামর্শ অপেক্ষা বিদুরের বুদ্ধিকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। বিদুরও অনবরত কুপরামর্শ দিয়ে দিয়ে দৃষ্টিহীন মানুষটিকে একেবারে দুর্বল করে ফেললেন। স্বীয় স্বার্থের জন্য তার যেভাবে চলা প্রয়োজন, যেভাবে বলা প্রয়োজন, চুম্বকের মতো ধৃতরাষ্ট্রকে সেভাবেই চালাতেন। তাহলে ছবিটা ঠিক এই দাড়ালো যে কুরুকুলের প্রধান শক্ৰ সত্যবতী, অর্থাৎ কলকাঠিটা তিনিই নেড়েছেন, আর সেই শক্রতাঁকে অব্যাহত রাখার প্রধান সহায় তার অবৈধ পুত্রের অবৈধ পুত্র বিদুর আর ভীমের কেন সত্যবতীর প্রতি এই অন্ধ আনুগত্য সেটা অবশ্য গভীর অন্ধকারেই প্রলেপিত হয়ে থাকলো।

কুরুরাজ্যের একটি সুস্থ বংশধর বিষয়ে হত্যার ন্যায় একটি ভয়ঙ্কর শব্দ কী দুঃসাহসে বিদুর উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন তার কারণটাও ক্রমশ বোধগম্য হলো। যে কোনো অবৈধ সন্তান, কি আর্য কি অনার্য, সব সমাজেই অপাঙক্তেয়। তাদের অধিকার সীমিত। তিনি যে সিংহাসনের অধিকার পাননি, সেই জ্বালা মেটাবার একটাই মাত্র উপায় ছিলো বিদুরের যুধিষ্ঠিরকে দুৰ্যোধন অপেক্ষা বয়সে বড় দেখানো এবং যুধিষ্ঠির যে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ পুত্র সেটা সকলকে জানানো। আর অন্য চারটি পুত্র কার দ্বারা জন্মগ্রহণ করেছে তা না জানলেও, এঁরাই যে যুধিষ্ঠিরকে সর্বপ্রকারে রক্ষা করবে সেটা ঠিক জানেন। সুতরাং, নিজে রাজ্য না পেলেও তাঁর পুত্র তো পাবে। আর পাবে এই চারটি ভ্রাতার সাহায্যেই তিনি তখন রাজার পিতা হয়ে সেই সম্মান ভোগ করবেন, আর কুরুরা হবে তাঁর তাঁবেদার। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই পাণ্ডু আর মাদ্রীর মৃত্যু ব্যতীত সম্ভব নয়।

যদি তাই হয়, তবে এমন হওয়া কি অসম্ভব যে এই পুত্রদের বিষয়ে পাণ্ডু কিছুই জানতেন না, অর্থাৎ তিনি ক্ষেত্ৰজ পুত্র গ্রহণ করেননি? সেজন্যই তাদের অস্তিত্ব প্রকাশিতব্য ছিলো না? দুৰ্যোধনের জন্মের পরে যে জ্বালা যন্ত্রণা প্রতিহিংসা বিদুরকে প্রায় উন্মত্তের মতো তাঁকে হত্যা করবার জন্য দিশাহারা করে তুলেছিলো। সেই অনুভূতি পুনরায় তাঁর মনকে গ্রাস করলো। কুন্তী কুমারী জীবনে যেমন কর্ণের জন্মদাত্রী হয়েছিলেন, যুধিষ্ঠিরের জন্মদাত্রীও ঠিক একইভাবে হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের পরে যে কুন্তী আরো দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তাদের কোনো পিতৃপরিচয় অনুমান করা শক্ত, তবে এটা অনুমান করা যায় পাণ্ডু তার প্রথমা পত্নী অপেক্ষা মাদ্রীর সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতেন। কুন্তীরও স্বামীকে সাহচর্য দেবার মতো সময় থাকতো না।

ধৃতরাষ্ট্রের তখন বিদুরের চক্ষুই তাঁর চক্ষু, বিদুরের শ্রবণই তাঁর শ্রবণ, বিদুরের বুদ্ধিই তাঁর বুদ্ধি, বিদুরের বাক্যই তার বাক্য। দুর্যোধন বিষয়ে তাঁর পিতৃস্নেহ প্রকৃতিগত ভাবে থাকলেও, তিনিও জানেন তার ছেলে অত্যন্ত দুরন্ত। দুর্যোধনের মাতা কে তা যেমন আমরা জানি না, মনে হয় দুৰ্যোধনও জানেন না। অতএব মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ, দুই-ই তার নিকট প্রায় শূন্য। পাঁচটি পুত্রের জন্য কুন্তীর মাতৃস্নেহ দেখতে দেখতে এমন হতে পারে, এই অভাববোধ তাঁকে কষ্ট দিতো। তবে ভ্রাতারা তাঁকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, সেখানেই তার অনেক অভাব পূরণ হয়ে যায়। ধৃতরাষ্ট্র পিতা সেটা ঠিক, কিন্তু কার গর্ভে জন্মেছিলেন সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। একশোজন ভ্রাতা, কোন ভ্রাতা কোন মায়ের গর্ভজাত সন্তান সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে শিশুকাল থেকেই। বীজ যার বৃক্ষও তার, এই নীতিই পালিত হয়েছে সেখানে পুত্রের প্রয়োজন, পুত্র পেলেই হলো। কোন ক্ষেত্রের বৃক্ষ সেটা বড়ো কথা নয়, কার ক্ষেত্রের বীজ সেটাই আসল। মাতারা প্রয়োজন ফুরোলেই অনাবশ্যক হিশেবে পরিত্যক্ত। সত্য ঘটনাটা আর উদঘাটিত হয় না। সেটা উহ্য।

জানাবার প্রয়োজন না থাকলেই সেটা উহ্য। রাজা-মহারাজারা ইচ্ছেসুখ নারীসংগম করতে পারতেন। সমাজ সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য সেই স্বীকৃতি নরজাতীয় সব মানুষের বেলাতেই অটুট, এখনো অটুট। তবে রাজাদের বেলায় সামান্য পার্থক্য এই যে পতি যার গর্ভেই সন্তান উৎপাদন করুন না কেন, মাতা হবেন তার বিবাহিতা পত্নী। অথাৎ পতি পরমগুরুর এই সব দুস্কৃতিকেও হতভাগ্য রমণীটিকে মান্য করতে হবে। সেই হিশেবেই গান্ধার তাদের মাতা। অনুমিত হয় গান্ধারী যখন পেটে টিউমার নিয়ে দু বছর অসুস্থ ছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র তখনই বিভিন্ন রমণীসঙ্গ করে এতোগুলো মানবসন্তানকে পৃথিবীতে এনেছিলেন। আমরা গান্ধারকেই ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র মহিষী বলে জানি, কিন্তু মহাভারতের অনেক স্থলে উল্লেখ আছে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীগণের। তবে সেইসব পত্নীগণকে আমরা প্রত্যক্ষ করি না। দুৰ্যোধনও করেন না। পৈতৃক অধিকারে গান্ধারকেই মাতা হিশেবে গ্রহণ করলেও, পুত্রদের প্রতি কুন্তীর যে স্নেহ, যে মাতৃভাব, গান্ধারীর নিকট সেটা তিনি পাননি।

অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে মস্তিষ্ক ঘৰ্মাক্ত করে লাভ নেই। মহারাজা শান্তনুর প্রাসাদ এখন অনার্য এবং অবৈধ শোণিতেই বিধৌত। এই কঠিন কার্যটি মাতা সত্যবতীই অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। সত্যবতীর দুর্দান্ত সাহস ও অনমিত ইচ্ছার শক্তি লৌহ-সদৃশ তথাপি, বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ পুত্ররা দ্বৈপায়নের ঔরসে জন্মালেও কুরুবংশের সন্তান বলেই খ্যাত হবে। সে পরিচয়টা নির্মুল করার জন্যই তথাকথিত পাণ্ডবগণের একবিন্দু অনিষ্টের সম্ভাবনাতেও বিদুর এবং তদীয় পিতা দ্বৈপায়ন অস্থির হয়ে ওঠেন। অনেক তথ্য সযত্নে এড়িয়েও যান। অবশ্য সেই ফাকটুকু সব সময়েই তিনি অতি সুন্দর একটি রূপকথা দিয়ে ভরে দেন। কোনো অভাববোধ থাকে না। সেই সময়ে সেই সব উপাখ্যানকে অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে না। উপাখ্যানগুলো যেন অলঙ্কার। পড়তে পড়তে মনে হয় একটা স্বপ্নের জগতে এসে উপস্থিত হয়েছি।

যেমন গান্ধারীর গর্ভধারণ। যা আমাদের জানানো হয়েছে তা হলো দুই বৎসর তিনি গর্ভধারণ করেছিলেন। তারপর দেখা গেলো গর্ভে কোনো সন্তান নেই। একটি শক্ত মাংসপিণ্ড বেরিয়ে এসেছে তার পরিবর্তে ব্যাসদেবের আদেশেই গৰ্ভচু্যত মাংসপিণ্ডকে তিনি মৃতপূৰ্ণ শতসংখ্যক কুম্ভ প্রস্তুত করে কোনো গুপ্তস্থানে রেখে তাতে জলসেচন করতে লাগলেন। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই সেইসব মাংপেশী শত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেলো। তারপর সেইসব খণ্ড অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ হলে গান্ধারী সেই সকল খণ্ড পূর্বপ্রস্তুত কুম্ভগুলোর মধ্যে সুদৃঢ়রূপে স্থাপন করে অতি সাবধানে রক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে আরো দুই বৎসর গত হলে সেইসব কুম্ভ উদঘাটন করে প্রথমে দুৰ্যোধন জন্মালেন। পরে আরো নিরানব্বইটি পুত্র জন্মালো। তার মানে এইসব মানব সন্তানদের পৃথিবীতে পদার্পণ করতে মোট চার বৎসর লাগলো।

এ গল্পটি অবশ্যই কল্পনাজগতের বিশেষ একটি অবদান সন্দেহ নেই। এমন একটা ঘটনা কখনো কি প্রকৃতি ঘটাতে পারে? সমস্ত ব্যাপারটার মূল ভাষ্যটিই হলো যুধিষ্ঠিরকে যে কোনো প্রকারে জ্যেষ্ঠ দেখানো। শুধু তাই নয়, তার জন্য যদি ষড়যন্ত্র করে পাণ্ডু এবং মাদ্রীকে হত্যা করতে হয়, সেটা গোপন করতেও দ্বৈপায়নের চিন্তার প্রয়োজন হয় না। সততারও প্রয়োজন হয় না। যদিও আমরা পাঠকরা জানি তিনি একজন মহৎ, নিষ্কাম, নিরপেক্ষ, ব্রহ্মচারী, যে ব্রহ্মচর্যের মস্তকে পদাঘাত করে যে কোনো নারীর শয্যায় শায়িত হতে তিনি এক মুহুর্ত চিন্তা করেন না। পাণ্ডু বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ, কিন্তু বিদুর কোনোভাবেই কুরুবংশের সঙ্গে যুক্ত নন। একজন দাসীর পুত্র ব্যতীত তার অন্য কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু যুধিষ্ঠির বিদুরের পুত্র। এই যুধিষ্ঠিরকে শান্তনুর সিংহাসনে বসাতে হলে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশাবে পরিচিতি করাবার প্রয়োজন আছে। যে কারণে বিদুর রাজত্ব পাননি, যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ না হলে সেই একই কারণে রাজত্বের অধিকারী হতে পারবেন না। সেজন্যই পাণ্ডুর ইহলীলা সম্বরণ করার প্রয়োজন ছিলো। তা যদি তিনি স্বাভাবিক উপায়ে না করেন সে ব্যবস্থাও বিদুর করবেন। কিন্তু সাক্ষী-প্রমাণ লুপ্ত করবার জন্য মাদ্রীকেও পৃথিবী থেকে মুছে না দিলে চলবে কেন? পতিবিয়োগে কুন্তী কাঁদেননি। কাঁদলেন, যখন সর্বসমক্ষে মৃতদেহ দুটি ভৰ্ম্মে পরিণত হলো এবং তিনি নির্দোষ বলে পরিগণিত হলেন। রচয়িতা আমাদের জানিয়ে দিলেন কুন্তীর ক্ৰন্দনে বনের পশুপাখিও ব্যথিত হয়ে পড়েছিলো। অথচ, অকস্মাৎ দু-দুজন মানুষ যখন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, স্বতঃই যখন মানুষের বক্ষ থেকে পাজরভাঙা ক্ৰন্দন উত্থিত হয়, তখন তিনি নিঃশব্দ। কেন? এই জিজ্ঞাসারও কি কোনো জবাব আমরা পেয়েছি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *