২৯. দ্রোণের সহিত কর্ণের বাগবিতণ্ডা ও ভীষ্ম কর্ত্তৃক সান্ত্বনা

এইরূপে দুই মুখে শুনি কটূত্তর।
ক্রোধমুখে কহে তবে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
জানিয়াছি আমি তোমা সবাকার মতি।
ভয়েতে পাণ্ডবগণে করহ ভকতি।।
উদর পূরিয়া ভোজ্য খাইবারে পার।
যুদ্ধকাল দেখি এবে সমরেতে ডর।।
যাহ বা থাকহ তুমি, যেই লয় মন।
সহজে ভিক্ষুক তুমি, জাতিতে ব্রাহ্মণ।।
ভিক্ষাজীবী সনে দ্বন্দ্ব কোন্ প্রয়োজন।
যথা যাও তথা হবে উদর ভরণ।।
যজ্ঞ নিমন্ত্রণে পিণ্ডজীবী যেই জন।
তাহার সহিত দ্বন্দ্বে কোন্ প্রয়োজন।।
যাহ তুমি যথা ইচ্ছা, কেহ নাহি রাখে।
মম পরাক্রম আজি দেখিবেক লোকে।।
কর্ণের এতেক বাক্য দ্রোণ গুরু শুনি।
ক্রোধে কম্পে অঙ্গ, নেত্রে নির্গত আগুনি।।
বুঝিয়া বিষম কার্য গঙ্গার নন্দন।
কৃতাঞ্জলি করি বলে দ্রোণেরে বচন।।
মোরে দেখি ক্ষম এবে গুরু মহাশয়।
মূর্খ জন জানি তাপ খণ্ডাহ হৃদয়।।
সাধু সুপণ্ডিত হইবেক যেই জনে।
অজ্ঞানের অপরাধ নাহি শুনে কাণে।।
চন্দ্র সূর্য্য তেজ যথা সর্ব্বত্র সমান।
সেইরূপ ব্রাহ্মণের সর্ব্বে সমজ্ঞান।।
ক্ষমহ আচার্য্য-পুত্র, ক্রোধকাল নয়।
শত্রু উপস্থিত হৈল, যুদ্ধের সময়।।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলি সর্ব্বলোকে জানে।
দুর্য্যোধনে অন্ধ বলি জানহ এক্ষণে।।
সাক্ষাতে গাণ্ডীব ধনু শুনেছি টঙ্কার।
তথাপিহ বলে রাজা অন্য কেহ আর।।
পশুমাত্রে ঘ্রাণে জানে নিজ বৈরিগণে।
পশুর সদৃশ জ্ঞান নাহি দুর্য্যোধনে।।
আরেরে দুর্ম্মতিগণ আচার্য্যে নিন্দহ।
অহঙ্কারে ছন্ন হয়ে কিছু না দেখহ।।
এক সূর্য্য তেজ অঙ্গে সহনে না যায়।
তোমার আছয়ে শত্রু পঞ্চ সূর্য্যপ্রায়।।
উদয় হইল আসি পঞ্চ বিকর্ত্তন।
কিমতে না কবে ইহা জ্ঞানবন্ত জন।।
এত বলি গঙ্গাপুত্র দ্রোণে নমস্করি।
সান্ত্বাইলা পিতা পুত্রে বহু স্তব করি।।
তবে দুর্য্যোধন বহু বিনয় বচনে।
করযোড়ে দাণ্ডাইল গুরু-বিদ্যমানে।।
ক্ষমহ আচার্য্য, অপরাধ করিলাম।
অজ্ঞান হইয়া আমি তোমা নিন্দিলাম।।
দ্রোণ বলে, তব প্রতি নাহি করি ক্রোধ।
পূর্ব্বেই ভীষ্মের বাক্যে হয়েছে প্রবোধ।।
তবে দ্রোণ চাহি বলে যত বীরগণে।
উপায় করহ শীঘ্র উপস্থিত রণে।।
এক কাজে আসিলাম হৈল অন্য কাজ।
দৃঢ়মতে থাক যেন নহে পাছু লাজ।।
শুনি দুর্য্যোধন জিজ্ঞাসিল পিতামহে।
এই যদি ধনঞ্জয় সর্ব্বলোকে কহে।।
ত্রয়োদ্শ বর্ষ তবে নিয়ম করিল।
না হইতে পূর্ণ যদি আসি দেখা দিল।।
ইহার বিধান কেন না কর আপনে।
এয়োদশ বর্ষ পুনঃ যাবে সবে বনে।।
ভীষ্ম বলে, পূর্ণ হৈল বর্ষ ত্রয়োদশ।
অধিক হইল আর দিন সপ্তদশ।।
দ্বিপক্ষেতে মাস, পক্ষ পঞ্চদশ দিনে।
দ্বাদশ মাসেতে হয় বৎসর প্রমাণে।।
এমত নিয়মে হয় বৎসর বঞ্চিল।
তবু সপ্তদশ দিন অধিক হইল।।
পঞ্চবর্ষে দুই মাস অধিক যে হয়।
তাহা সহ পূর্ব্বে নাহি করিলে নির্ণয়।।
নিয়ম করিয়াছিল তাহা গোঁয়াইল।
সময় পাইয়া আসি উদয় হইল।।
একে ত পাণ্ডুর পুত্র সবে ধর্ম্মবন্ত।
তার জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির গুণে নাহি অন্ত।।
অনন্ত দুষ্করকর্ম্ম দয়াশীল লোকে।
মৃত্যু ইচ্ছে, তবু মিথ্যা নাহি কহে মুখে।।
নিশ্চয় অর্জ্জুন এই, জন নরপতি।
ইহার উপায় রাজা কর শীঘ্রগতি।।
পৃথিবী দলিতে পার্থ পারে একেশ্বরে।
কি ছার কৌরব তার সহিতে সমরে।।
সে কারণে কহি তোমা শুন দুয্যোধন।
এখন করহ প্রীতি যদি লয় মন।।
দুর্য্যোধন বলে, হেন না কহিও আর।
জীয়ন্তে পাণ্ডব সহ কি প্রীতি আমার।।
নাহি ভাগ দিব আমি, যুদ্ধ মোর পণ।
ইহা জানি সমুচিত করহ আপন।।
শুনি ভীষ্ম দিব্য ব্যূহ করিল রচন।
যোদ্ধাগণে বিচারিয়া ‍রাখে স্থানে স্থান।।
মধ্যেতে রহিল দ্রৌণি, দ্রোণ সব্য-ভিতে।
কৃপাচার্য্য আচার্য্যের রহিল বামেতে।।
দ্রোণরথ-রক্ষী হৈল বহু মহারথী।
বিকর্ণ সৌবল আর বীর বিবিংশতি।।
সর্ব্বসৈন্য-অগ্রে সূতপুত্র মহাবল।
পাছু রহিলেন ভীষ্ম রক্ষা হেতু দল।।
মধ্যেতে করিয়া গবী রাজা দুর্য্যোধন।
চতুর্দ্দিকে সাবধানে রহে সৈন্যগণ।।
দৃঢ় অস্ত্রধারী রক্ষী রহে ব্যূহমুখে।
চন্দ্রাকার ব্যূহ রচে দুর্ভেদ ত্রিলোকে।।
পীযূষ-পয়োধি সম বিরাটপর্ব্ব-কথা।
বেদব্যাস বিরচিত অপরূপ গাথা।।
ব্যাস-পদে নহি, কৃষ্ণ-পদে অভিলাষ।
পয়ার প্রবন্ধে রচে কাশীরাম দাস।।