২৬. শ্রাদ্ধপর্ব্বাধ্যায়–কৃষ্ণের উপদেশ

২৬তম অধ্যায়

শ্রাদ্ধপর্বাধ্যায়—কৃষ্ণের উপদেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর বাসুদেব গান্ধারীকে ধরাতলে নিপতিত দেখিয়া কহিলেন, “রাজ্ঞি! অবিলম্বে গাত্রোত্থান করুন, এক্ষণে আর শোক করা কর্ত্তব্য নহে। আপনার অপরাধেই অসংখ্য বীর নিহত হইয়াছে। আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন অতি দুরাত্মা, পরশ্রীকাতর, আত্মাভিমানী, নিষ্ঠুর ও গুরুজনের নিতান্ত অবাধ্য ছিল। আপনি তাহার দুষ্কৃতকার্য্যে সাধুবাদ প্রদান করিতেন, এক্ষণে কি নিমিত্ত আত্মদোষক্ষালনার্থ আমার উপর দোষারোপ করিতেছেন? যাহা হউক, অতঃপর দুঃখপরিত্যাগ করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। গতানুশোচনদ্বারা [অতীত বিষয়ের জন্য শোক] দুঃখ দ্বিগুণ হইয়া ওঠে। বিশেষতঃ ব্রাহ্মণী পুত্র হইলে তপানুষ্ঠান করিবে, বৈশ্যা পুত্র হইলে পশু পালন করিবে, শূদ্রা পুত্র হইলে দাসত্ব স্বীকার করিবে; তুরঙ্গী শাবক হইলে দ্রুততর ধাবমান হইবে; গাভী বৎস হইলে ভার বহন করিবে এবং আপনার মত ক্ষত্রিয়ারা পুত্র হইলে সমরমৃত্যু লাভ করিবে বলিয়াই গর্ভধারণ করিয়া থাকেন।”

মহাত্মা বাসুদেব এই কথা কহিলে গান্ধারী উহা নিতান্ত অপ্রিয়বোধে শোকাকুলচিত্তে তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র স্বীয় বুদ্ধিবিপাকজ[১] শোক সংবরণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! এই যুদ্ধে যেসমুদয় সৈন্য সমাগত হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কতকগুলি নিহত হইয়াছে, আর কতকগুলিই বা জীবিত আছে, যদি তুমি উহা অবগত থাক, তাহা হইলে কীৰ্ত্তন কর।”

যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক যোধদিগের সদ্‌গতিবর্ণন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “কৌরবনাথ! এই যুদ্ধে শতাধিক, ষট্‌ষষ্টি কোটি বিংশতি সহস্র [একশত ছেষট্টি কোটি কুড়ি হাজার] সৈন্য নিহত হইয়াছে এবং চতুর্বিংশতি সহস্র একশত পঞ্চাষষ্টি যোদ্ধা জীবিতাবস্থায় পলায়ন করিয়াছে।” তখন ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে পুরুষসত্তম! তুমি সর্ব্বজ্ঞ; অতএব নিহত ব্যক্তিরা কোন্ কোন্ স্থানে গমন করিয়াছে, তাহা কীর্ত্তন কর।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মহারাজ! এই যুদ্ধে যাঁহারা হৃষ্টচিত্তে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহারা ইন্দ্রলোকে, যাঁহারা মৃত্যু অবধারণ করিয়া অসন্তুষ্টচিত্তে নিহত হইয়াছেন, তাঁহারা গন্ধর্ব্বলোকে, যাঁহারা শরণার্থী হইয়া সমরে পরাঙ্মুখ হইবার সময় অস্ত্রাঘাতে নিহত হইয়াছেন, তাঁহারা গুহ্যকলোকে, যাঁহারা সমপরাঙ্মুখ হওয়া নিতান্ত লজ্জাকর বোধ করিয়া অস্ত্রশস্ত্রবিহীন হইয়াও শত্রুর অভিমুখে গমনপূর্ব্বক অস্ত্রাঘাতে দেহত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহারা ব্রহ্মসদনে এবং যাঁহারা সমরাঙ্গনের বহির্ভাগে নিহত হইয়াছেন, তাঁহারা কথঞ্চিৎ উত্তরকুরুতে গমন করিয়াছেন।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “বৎস! তুমি কোন জ্ঞানপ্রভাবে সিদ্ধপুরুষের ন্যায় এই সমস্ত বিষয় অবলোকন করিতেছ? যদি বলিবার কোন বাধা না থাকে, তবে কীৰ্ত্তন কর।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “কৌরবনাথ! পূর্বে আমি আপনার আদেশানুসারে বনবাসী হইয়া তীর্থযাত্রাপ্রসঙ্গে বনমধ্যে ভ্রমণ করিতে করিতে দেবর্ষি লোমশের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম। তাঁহার অনুগ্রহেই জ্ঞানযোগে দিব্যচক্ষু লাভ করিয়াছি।”

যুদ্ধে মৃতগণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ানুষ্ঠান

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির। এই সমরে যেসমুদয় ব্যক্তি নিহত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে যাহারা অনাথ বা বান্ধবসম্পন্ন ও যাহাদের অগ্নিহোত্র সঞ্চিত [রক্ষিত] নাই, তাহাদিগকে ত’ বিধিপূর্ব্বক দগ্ধ করিতে হইবে? এক্ষণে আমরাই বা কিরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিব? আর গৃধ্র প্রভৃতি পক্ষিগণ যাহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছে, তাহাদিগের ঔর্দ্ধদেহিক কাৰ্য্য হইলে তাহারা ত’ সদগতিলাভ করিতে পারিবে?”

হে জনমেজয়! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম্মরাজকে এই কথা কহিলে তিনি সুশর্ম্মা, ধৌম্য, সঞ্জয়, মহাত্মা বিদুর, যুযুৎসু এবং ইন্দ্রসেনপ্রমুখ অমাত্য, ভৃত্য ও সারথিগণকে কহিলেন, “তোমরা অচিরাৎ বীরগণের প্রেতকাৰ্য্য সম্পাদন কর। ইহাদিগের শরীর যেন অনাথের ন্যায় ধ্বংস না হয়।” ধর্ম্মরাজ এইরূপ আদেশ করিলে সুশর্ম্মা প্রভৃতি ব্যক্তিগণ অবিলম্বে অগুরুচন্দন, কালীয়ক [কুঙ্কুম], ঘৃত, তৈল, গন্ধ, ক্ষৌমবস্ত্র, মহামূল্য কাষ্ঠ, ভগ্নরথ ও বিবিধ প্রহরণ আহরণপূর্ব্বক পরমযত্নে চিতা প্রস্তুত করিয়া প্রাধান্যানুসারে [শ্রেষ্ঠতানুসারে] ঘৃতধারাসমাহুত [ঘৃতাহুতিদ্বারা সংস্কৃত] হুতাশনে মহারাজ দুৰ্য্যোধন, তাঁহার ভ্রাতৃগণ, শল্য, শল, ভূরিশ্রবা, জয়দ্ৰথ, অভিমন্যু, দুঃশাসনতনয়, লক্ষ্মণ, ধৃষ্টকেতু, বৃহন্ত, সোমদত্ত, সৃঞ্জয়গণ, ক্ষেমধন্বা, বিরাট, দ্রুপদ, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, যুধামন্যু, উত্তমৌজা, কোশলরাজ, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, শকুনি, অচল, বৃষক, ভগদত্ত, কর্ণ, কর্ণের পুত্রগণ, কেকয়গণ, ত্রিগর্ত্তগণ, রাক্ষসে ঘটোৎকচ, অলম্বুষ, রাজা জলসন্ধ ও অন্যান্য শতসহস্র নরপতির মৃতদেহ দগ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় কোন কোন মহাত্মা পিতৃযজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া সামবেদ গান করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ মৃত ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত শোক করিতে লাগিল। সেই রজনীতে সাম ও ঋগবেদধ্বনি এবং রমণীগণের আর্ত্তনাদে সমুদয় প্রাণীগণ মূর্চ্ছিতপ্রায় হইল। হুতাশন ধূমশূন্য ও প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। বোধ হইতে লাগিল যেন নভোমণ্ডলে গ্রহসমুদয় মেঘে পরিবৃত হইয়াছে। যেসমস্ত ব্যক্তি নানাদেশ হইতে আগমনপূর্ব্বক অনাথ হইয়া প্রাণপরিত্যাগ করিয়াছিল, মহাত্মা বিদুর ধর্ম্মরাজের আদেশানুসারে তৈলসংসিক্ত রাশি রাশি কাষ্ঠে চিতা প্রস্তুত করিয়া তাহাদিগকে একত্র দাহ করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে বীরগণের দাহক্রিয়া সমাধান হইলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রসর করিয়া ভাগীরথীর অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।