২৫. নবম দিনের যুদ্ধারম্ভ

সঞ্জয় বলেন, শুন অন্ধ নরপতি।
রজনী প্রভাতে কুরু-পাণ্ডবের পতি।।
দুই দলে সাজিল অনেক যোধগণ।
রথী মহারথী পত্তি না যায় লিখন।।
দুই দলে বাদ্য বাজে না হয় বর্ণন।
দুই দলে ভয়ঙ্কর হৈল ঘোর রণ।।
রথীকে ধাইল রথ গজ ধায় গজে।
আশোয়ারে আশোয়ার মল্লে মল্ল যুঝে।।
মাহুতে মাহুতে যুঝে ঘোর দরশন।
নানারূপে দুই দলে বাণ বরিষণ।।
তবে ভীষ্ম মহাবীর গঙ্গার নন্দন।
আকর্ণ পূরিয়া টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ।।
বশিষ্ঠের শিক্ষা যত দিব্য অস্ত্র ছিল।
ক্রোধে বীর পাণ্ডু- সৈন্য উপরে বর্ষিল।।
এক অস্ত্রে প্রসবয়ে লক্ষ লক্ষ শর।
মুষল মুদগর শেল পরিঘ তোমর।।
কালান্তক যম ভীষ্ম রণ অবতার।
শত শত রহারথী করিল সংহার।।
লক্ষ লক্ষ গজ বাজি পত্তি অগণন।
সংহার করিল ভীষ্ম রণে বিচক্ষণ।।
ভয় পেয়ে পাণ্ডুসৈন্য রণে ভঙ্গ দিল।
সিংহ দেখি পশু যেন ভয়ে পলাইল।।
সৈন্যগণ ভঙ্গ দেখি দেব জনার্দ্দন।
অর্জ্জুনে চাহিয়া তবে বলয়ে বচন।।
প্রতিজ্ঞা করিলে তুমি ভীষ্মেরে মারিতে।
না মারিলে অপযশ হৈবে ত্রিজগতে।।
তাহার সময় এই শুন সাবধানে।
ক্ষত্রধর্ম্ম রাখি মার গঙ্গার নন্দনে।।
আজি যদি ভীষ্মেরে সংগ্রামে দেহ আশ।
প্রায় বুঝি সর্ব্ব সৈন্য করিবেক নাশ।।
আপনার সত্য বাক্য করহ পালন।
উপরোধ এড়ি মার গঙ্গার নন্দন।।
দেখ সর্ব্বসৈন্য আজি ভঙ্গ দিল রণে।
উপহাস করয়ে কৌরব দুষ্টগণে।।
এত শুনি ক্রোধ করি ইন্দ্রের তনয়।
গোবিন্দে বলিল শীঘ্র বাহ রথ-হয়।।
আজ্ঞামাত্র জনার্দ্দন রথ চালাইল।
ভীষ্মেরে অগ্রেতে রথ শীঘ্রগতি নিল।।
অর্জ্জুনে দেখিয়া ভীষ্ম সিংহনাদ করি।
বরিষয়ে দিব্য অস্ত্র গগন আবরি।।
মুহূর্ত্তেকে শরজালে অর্জ্জুনে ছাইল।
কুজ্ঝাটিতে গিরিবর যেন আচ্ছাদিল।।
দশদিক অন্ধকার রোধিল বাতাস।
শূন্যপথ নাহি দেখি রবির প্রকাশ।।
সম্ভ্রম পাইলা বড় কৃষ্ণ মহাশয়।
মনে ধৈর্য্য হৈয়া চলাইলা রথ-হয়।।
হাসিয়া গাণ্ডীব হাতে কৈল ধনঞ্জয়।
আকর্ণ পূরিয়া ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া।।
মহাশব্দে মোহিত হইল কুরুগণ।
দিব্য অস্ত্র এড়ে তবে ইন্দ্রের নন্দন।।
খুরুপা নামেতে বাণ এড়িল অর্জ্জুন।
হাত হৈতে ভীষ্মের কাটিল ধনুর্গুণ।।
গুণ সহ ধনুক পড়িল ভূমিতল।
অন্য ধনু হাতে নিল ভীষ্ম মহাবল।।
গুণ দিয়া ধনুকেতে যোড়ে দিব্য শর।
সেই ধনু কাটি ফেলে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
প্রশংসিয়া অর্জ্জুনেরে গঙ্গার নন্দন।
অন্য ধনু লৈয়া করে বাণ বরিষণ।।
ভৃগুপতিদত্ত ধনু শত্রুঞ্জয় নাম।
দশব্যাম-তালসম বলে অনুপাম।।
সেই ধনু লৈয়া ভীষ্ম নাম অস্ত্র এড়ে।
অন্ধকার করি গিয়া পার্থ গায়ে পড়ে।।
নির্ভয় শরীর পার্থ সমরে প্রখর।
পুনরপি শরজালে ছাইল অম্বর।।
নানা অস্ত্র বৃষ্টি করে ভীষ্মের উপর।
বরিষা কালেতে যেন বর্ষে জলধর।।
ততোধিক ভীষ্মবীর এড়ে অস্ত্রগণ।
বাণে হাণি শরজাল কৈল নিবারণ।।
দোঁহে দোঁহাপরি বাণ করে বরিষণ।
মহাবলবন্ত দোঁহে মহা বিচক্ষণ।।
দিব্য অস্ত্রশিক্ষা দোঁহে বিক্রমে সোসর।
দুই বৃষ যুঝে যেন গোঠের ভিতর।।
দুই মত্ত হস্তী যেন করে মহারণ।
দোঁহে দোঁহাকারে অস্ত্র এড়ে প্রাণপণ।।
শেল শূল শক্তি জাঠি মুষল মুদগর।
ইন্দ্রজাল ব্রহ্মজাল আদি অস্ত্রগণ।
জলবৃষ্টি হয় যেন বাণ বরিষণ।।
শত শত বাণ দোঁহে একেবারে এড়ে।
অন্ধকার করি বাণ দোঁহে গায়ে পড়ে।।
ক্রোধে ভীষ্ম মহাবীর পূরিল সন্ধান।
বশিষ্ঠের শিক্ষা অস্ত্র সূচীমুখ নাম।।
আকর্ণ পূরিয়া বিন্ধে পার্থের শরীর।
দারুণ প্রহারে মোহ গেল পার্থবীর।।
সর্ব্বাঙ্গে বহিয়া পড়ে রুধিরের ধার।
ব্যগ্র হৈল সংগ্রামেতে দেবকী-কুমার।।
অবসর পেয়ে তবে ভীষ্ম মহাবীর।
জর্জ্জরিত কৈল বাণে কৃষ্ণের শরীর।।
শরে আবরিল ভীষ্ম পার্থ মহাবীরে।
দৃষ্ট নাহি হয় পার্থ সমরে ভিতরে।।
ত্রস্ত হৈল যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের নন্দন।
ভীমসেনে ডাকি রাজা বলয়ে বচন।।
দেখ দেখ কৃষ্ণার্জ্জুনে ভীম মহাযোধ।
শরে আবরিল ভীষ্ম দৃষ্টি করি রোধ।।
শীঘ্রগতি যাহ ভাই সাহায্য কারণ।
যেই মতে রক্ষা পায় ইন্দ্রের নন্দন।।
চক্রবক্র অভিমন্যু আদি বীরচয়।
সৌমক পাঞ্চাল ভোজ নির্ভীক হৃদয়।।
লইয়া সহস্র রথী বেড়ি ভীষ্মবীর।
মারহ তাহারে হয়ে নির্ভয় শরীর।।
যুধিষ্ঠির বাক্যে ভীম লয়ে বীরদলে।
গঙ্গার কুমারে আবরিল মরজালে।।
হাসিয়া লইল ভীষ্ম হাতে শরাসন।
বাণে কাটি শরজাল কৈল নিবারণ।।
শীঘ্রহস্ত মহাবলী ভীষ্ম মহাবীর।
দশবাণে বিন্ধে ভীমসেনের শরীর।।
অষ্টবাণে সাত্যকিরে কৈল অচেতন।
দশবাণে অভিমন্যু বিন্ধে ততক্ষণ।।
একে একে বাণেতে জিনিল সর্ব্বজন।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সৈন্যগণ।।
নানা শক্তি করি পার্থ রাখিতে না পারে।
ভঙ্গ দিয়া সর্ব্বসৈন্য পলায় সত্বরে।।
অস্ত্রে অস্ত্রে হানাহানি অতি ঘোর রণ।
সহস্র সহস্র রথী হইল নিধন।।
পাণ্ডবের ভাগ্যে হৈল দিবা অবসান।
নহে সর্ব্ব সৈন্য ভীষ্ম করিত নিধন।।
বিষাদিত চিত্ত হৈল রাজা যুধিষ্ঠির।
সর্ব্ব সৈন্যে চলি গেল আপন মন্দির।।
হইয়া সানন্দ চিত্ত রাজা দুর্য্যোধন।
সর্ব্ব বলে চলি গেল আপন ভবন।।
দুই দলে পড়ি গেল বহু সৈন্যগণ।
রথী মহারথী পত্তি না হয় লিখন।।
অলঙ্কারে সুশোভন হৈল রণস্থল।
কোলাহল করে যত কুক্কুর শৃগাল।।
অসংখ্য কবন্ধ নাচে গগন উপর।
ভয়ঙ্কর রণস্থল দেখি লাগে ডর।।
মুনি বলে, জন্মেজয় কর অবধান।
নবম দিবস যুদ্ধ হৈল সমাধান।।
মহাভারতের কথা অমৃত- লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে ভব তরি।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীরাম দাস কৃষ্ণ দাসানুজ।।