২৪. নবম দিনের যুদ্ধের যুক্তি

তবে রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ে পুছিল।
কহত সঞ্জয় তবে কি কর্ম্ম হইল।।
সঞ্জয় বলেন, রাজা কর অবগতি।
দুঃখচিত্তে নিজালয়ে এল কুরুপতি।।
সহোদরগণ সঙ্গে করিয়া রাজন।
ভয়ে কম্পমান গৃহে কৈল প্রবেশন।।
সিংহাসন ছাড়ি রাজা বসিল ভূমিতে।
চতুর্দ্দিকে ভ্রাতৃগণ বসিল বেষ্টিতে।।
দুই পাশে বসিল যতেক রাজগণ।
ভগদত্ত প্রতীপাদি যতেক রাজন।।
সুশর্ম্মা সৌবল আদি যত নরপতি।
সভাতে বসিলা সবে হৈয়া দুঃখমতি।।
অনেক চিন্তিয়া তবে রাজা দুর্য্যোধন।
দূত প্রেরি আনাইল ভীষ্ম আর দ্রোণ।।
ভূরিশ্রবা দ্রৌণি আদি যত বীরগণ।
যার যেই আসনে বসিল সর্ব্বজন।।
তবে পুনঃ নরপতি হৃদয়ে ভাবিয়া।
কর্ণেরে আনিল শীঘ্র দূত পাঠাইয়া।।
রাজার আদেশে কর্ণ এল ততক্ষণ।
আলিঙ্গন করি কর্ণে বলয়ে বচন।।
সেনাপতি হও তুমি কি বলিব আর।
দিনে দিনে ক্ষীণবল হইল আমার।।
আপনারে দ্বারে কাঁটা রোপিনু আপনি।
সেনাপতি না করিনু আগুপাছু গণি।।
আগে যদি তোমারে দিতাম সৈন্যভর।
তবে কেন এত দুঃখ হইবে আমার।।
মান্য করি পিতামহে কেনু সেনাপতি।
স্নেহ করি পাণ্ডবে না মারে মহামতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ দ্রৌণি আদি বাহ্লীক রাজন।
সোমদত্ত কৃপাচার্য্য এই ছয় জন।।
স্নেহভাবে পাণ্ডবে না করয়ে নিধন।
সেনাপতি হও তুমি রণে বিচক্ষণ।।
পূর্ব্বে অঙ্গীকার কৈলে সভার ভিতরে।
পাণ্ডবেরে মারিয়া রাজত্ব দিবে মোরে।।
মোর মনস্কাম তুমি করহ পূরণ।
মহারণে মার তুমি পাণ্ডব-নন্দন।।
এতেক শুনিয়া কহে রাধার কুমার।
এখন না লব আমি সেনা-অধিকার।।
যাবত থাকিবে রণে ভীষ্ম মহামতি।
তাবত না হব আমি সৈন্য-অধিপতি।।
প্রতিজ্ঞা করিল ভীষ্ম সবার গোচর।
আমি বিদ্যমানে নাহি কর্ণের সমর।।
ক্ষত্রিয় প্রতিজ্ঞা না রাখিলে পাপ হয়।
তেকারণে অবধানে শুন মহাশয়।।
যে আজ্ঞা করিবে তাহা করিব পালন।
মেলানি করহ যাই আপন ভবন।।
এত বলি কর্ণ বীর গেল নিজালয়।
ভীষ্মেরে চাহিয়া বলে গান্ধারী তনয়।।
পূর্ব্বে অঙ্গীকার তুমি করিলে আপনে।
রণমধ্যে সংহারিবে পাণ্ডুপুত্রগণে।।
স্নেহ-ভাব করি নাহি করহ নিধন।
কি করিব এবে মোর অদৃষ্ট লিখন।।
এই ভিক্ষা মাগি আমি করি পরিহার।
সেনাপতি যোগ্য হয় রাধার কুমার।।
এত শুনি কহে ক্রোধে গঙ্গার কুমার।
অরুণ লোচন দুই ঘূর্ণিত আকার।।
বহু বাখানহ তুমি কর্ণ ধনুর্দ্ধরে।
নিমিষেকে সংহারিবে পাণ্ডুর কুমারে।।
কোন ছার কর্ণ বীর সংহারিবে তারে।
ইন্দ্র নারে জিনিবারে পাণ্ডুর কুমারে।।
দুই দনি আমি আর থাকিব সমরে।
তবে তুমি সেনাপতি করিহ কর্ণেরে।।
দেখিব কেমনে জিনে পাণ্ডুপুত্রগণ।
মুহূর্ত্তেকে প্রাণ দিবে পতঙ্গ সমান।।
পূর্ব্বেতে তোমারে আমি কহিনু বিস্তর।
না শুনিলে কারো বোল করি অনাদর।।
অর্জ্জুনের পরাক্রম দেখেছ নয়নে।
জানিয়া আমারে দোষ দেহ অকারণে।।
খাণ্ডব-দাহনে অগ্নি পরিত্রাণ কৈল।
বাহুযুদ্ধে পঞ্চাননে সমরে জিনিল।।
কালকেয় নিবাতকবচ দৈত্যগণ।
মারি নিষ্কণ্টক কৈল যত দেবগণ।।
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে জিনিলেক রণে।
একেশ্বর পরাজিল যত রাজগণে।।
তদন্তর সংগ্রামে জিনিল যদুবলে।
সুভদ্রা হরিয়া নিল নিজ বাহুবলে।।
ভীমের বিক্রম যত খ্যাত ত্রিভুবন।
হিড়িম্ব রাক্ষস আদি করিল নিধন।।
রাক্ষস দানব যক্ষ অগ্রে নহে স্থির।
যক্ষ রক্ষ মারিলেক বৃকোদর বীর।।
উত্তর-গোগৃহ রণে বীর ধনঞ্জয়।
একেশ্বর সবারে করিল পরাজয়।।
কর্ণবীর তখন কি করিল তোমার।
দৃষ্টিমাত্র চূর্ণ কৈল সবার অহঙ্কার।।
তদন্তরে বনমধ্যে গন্ধর্ব্বের পতি।
শূন্যপথে বান্ধি তোমা লৈল মহামতি।।
রাখিতে নারিল তাহে কর্ণের শকতি।
ছাড়াইয়া দিল তবে পার্থ মহামতি।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি তোমার গোচরে।
কালি যুদ্ধে পরাজিব পাণ্ডুর কুমারে।।
কৃষ্ণ সহ অর্জ্জুনে জিনিব কালি রণে।
শোক ত্যাগ কর রাজা আমার বচনে।।
শোকের সময় এই নহে মহাশয়।
শত্রুর বাড়য়ে বল বিক্রম হরয়।।
এত শুনি দুর্য্যোধন হরিষ অন্তর।
কৌরবের দলে দুঃখ নাহি অতঃপর।।
চরমুখে বার্ত্তা পেল ধর্ম্ম নৃপমণি।
কৃষ্ণার্জ্জুন ভীমে আনি বলয়ে কাহিনী।।
প্রতিজ্ঞা করিল পার্থ গঙ্গার নন্দন।
সাবধান হৈয়া সবে করিবেক রণ।।
এত শুনি ভীম কহে রাজার গোচর।
কালি দুর্য্যোধনের হরিব অহঙ্কার।।
এত বলি সিংহনাদ কৈল মহাবল।
পাণ্ডবের দলে হৈল জয় কোলাহল।।
ভীষ্মপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে ব্যাসের বচন।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।