২৩৩. পুত্রনাশশঙ্কায় মন্দপালের বিলাপ, পুত্রগণ সমীপে মন্দপালের আগমন

২৩৩. পুত্রনাশশঙ্কায় মন্দপালের বিলাপ, পুত্রগণ সমীপে মন্দপালের আগমন

ত্রয়স্ত্রিংশদধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, এদিকে মহর্ষি মন্দপাল স্বীয় পুত্র চতুষ্টয়ের নিমিত্ত সাতিশয় চিন্তাকুল হইলেন। তিনি পুত্রগণের পরিত্রাণাৰ্থ অগ্নির নিকট নিবেদন করিয়াও তৎকালে মনে মনে অসুখী হইতে লাগিলেন। মহর্ষি মন্দপাল সন্তানদিগের নিমিত্ত নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া অতি কাতরস্বরে লপিতাকে সোধিয়া কহিলেন, লপিতে! এক্ষণে আমার পুত্রগণ না জানি কিরূপ কাতর হইতেছে। তাহারা অজাতপক্ষ এবং আত্মরক্ষায় অশক্ত। অগ্নি ক্রমে ক্রমে অধিকতর প্রজ্বলিত হইতেছেন এবং বায়ুও প্রবল বেগে প্রবাহিত হইতেছেন; বোধ করি, তাহারা অগ্ন্যুৎপাত হইতে মুক্ত হইতে পারিবে না। আহা! তাহাদের মাতা দীনা জরিতা স্বীয় পুত্রগণকে পরিত্রাণ করিতে না পারিয়া এবং তাহাদিগকে অশরণ দেখিয়া যৎপরোনাস্তি শোকার্ত হইবে, সন্দেহ নাই। আমার পুত্রগণ অদ্যাপি উড্ডয়ন বা গমন করিতে সমর্থ হয় নাই, জরিতা কি প্রকারে তাহাদিগকে লইয়া পলায়ন করিবে! হাঁ! পুত্র জারিতারে! হা বৎস সারিসৃক্ক! হা স্তম্বমিত্র! হা পুত্র দ্রোণ! হা প্রিয়ে জরিতে! না জানি, তোমরা এখন কতকষ্ট পাইতেছ।

সপিতা মহর্ষি মন্দপালের এইরূপ বিলাপবাক্য শ্রবণে সাতিশয় অসূয়াপরতন্ত্র হইয়া কহিতে লাগিলেন, দেখ! তোমার পুত্রদিগের নিমিত্ত কিছু মাত্র চিন্তা নাই; তুমি স্বয়ং কহিয়াছ, তাহারা ঋষি। হে মহর্ষে! উহারা বীৰ্যবান্ ও তেজস্বী; অগ্নি হইতে উহাদের কিছুমাত্র শঙ্কা নাই। বিশেষতঃ তুমি তাহাদিগকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত অগ্নিকে অনুরোধ করিয়াছিলে। মহাত্মা হুতাশনও তোমার অনুরোধ শ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন; তিনি কখনই আপনার প্রতিজ্ঞা বিফল করিবেন না। অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, তুমি পুত্রগণের নিমিত্ত কিছুমাত্ৰ উৎকণ্ঠিত নও; কেবল আমার অমিত্রা সেই জরিতাকে মনে হইয়াছে বলিয়াই এত অনুতাপ করিতেছ। নিশ্চয় বুঝিলাম, আমার প্রতি তোমার আর পূর্বের মত স্নেহ নাই। স্নেহবান ব্যক্তির পুত্র কলত্রাদি সুহৃজ্জনের প্রতি উপেক্ষা করা নিতান্ত অবিধেয়; অতএব তুমি সেই জরিতার নিকটেই গমন কর, আর বৃথা অনুতাপ করিবার আবশ্যকতা নাই। আমি কুপুরুষাশ্রিতা নারীর ন্যায় এককিনী জীবন যাপন করিব।

মন্দপাল কহিলেন, লপিতে! তুমি মনে করিয়াছ, আমি নিতান্ত কামান্ধ লোকের ন্যায় কেবল স্ত্রীসম্ভোগার্ধে পৃথিবীমণ্ডলে ভ্রমণ করিতেছি, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে। অপত্যোৎপাদন করাই আমার উদ্দেশ্য। আমার সেই অপত্যগণ এক্ষণে বিপদগ্রস্ত হইয়াছে। যে মূঢ় ব্যক্তি ভূতার্থ পরিত্যাগ করিয়া ভবিষ্যৎ অবলম্বন করে, সে সমস্ত লোকের অবমানাস্পদ হয়। ঐ দেখ, প্রজ্বলিত হুতাশন কাননস্থ সমস্ত বৃক্ষ দগ্ধ করিয়া আমার মন সাতিশয় সন্তাপিত ও উদ্বেজিত করিতেছে। আমি আর স্থির হইতে পারিতেছি না। পুত্রগণের নিকট চলিলাম। তোমার যাহা ইচ্ছা হয়, কর।

এদিকে অগ্নি মন্দপালের পুত্ৰচতুষ্টয়ের নিকট হইতে দূরতর প্রদেশে গমন করিলে, পুত্রবৎসল জরিতা শাবকগণের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া দেখিল, তাহারা সকলেই অগ্নি ইহতে পরিত্রাণ পাইয়াছে, কিন্তু সাতিশয় যোদন করিতেছে। জরিত তাহাদিগকে তদবস্থ দেখিয়া পুত্রবাৎসল্য প্রযুক্ত পুনঃ পুনঃ স্নেহা মোচনপূর্বক অতি কাতরস্বরে একে একে তাহাদের সকলের নিকট গমন করিয়া স্নেহপ্রকাশ করিতে লাগিলেন। তদনন্তর মহর্ষি মন্দপাল সহসা তাহাদের নিকট উপস্থিত হইলেন, কিন্তু তাঁহারা কেহই তাঁহাকে অভিনন্দন করিলেন না। তিনি ব্যাকুলহৃদয়ে বারংবার পুত্রগণকে ও জরিতাকে সম্বোধন করত জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহারা কেহই ভাল মন্দ কিছুই বলিলেন না। তখন মহর্ষি জরিতাকে সম্বোধিয়া কহিলেন, জরিতে। তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র কে? তৎ কনিষ্ঠ কে? তৃতীয় কে? এবং সর্বকনিষ্ঠই বা কে? আমি দুঃখিত হইয়া বারংবার তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি প্রত্যুত্তর করিতেছ না। আমি তোমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছি বটে; কিন্তু তোমাদের নিমিত্ত আমার মন এক মুহূর্তও সুস্থির নহে।

জরিতা মহর্ষিয় ঐরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, মহর্ষে! জ্যেষ্ঠ পুত্রে তোমার প্রয়োজন কি? তৎকনিষ্ঠেই বা প্রয়োজন কি? এবং তৃতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্রেই বা তোমার আবশ্যকতা কি? তুমি এই হতভাগিনীকে পরিত্যাগ করিয়া যাহার নিকট গমন করিয়াছিলে, সেই চারুহাসিনী তরুণী লপিতার নিকটেই পুনর্বার গমন কয়।

মন্দপাল কহিলেন, জরিতে! স্ত্রীলোকের পুরুষান্তর সেবন ও সপত্নীয় সহিত বিবাদ করা; অপেক্ষা পারত্ৰিকমঙ্গল বিনাশক, বৈরাগ্নিদীপক ও উদ্বেগজনক আর কিছুই নাই। সুব্রত৷ সৰ্বভূতবিতা অরুন্ধতী বিশুদ্ধভাব, প্রিয়কারী, হিতসাধনতৎপর, সপ্তর্ষিমধ্যস্থ মহাত্মা বশিষ্ঠ ঋষির মহিলার সংসৰ্গাশঙ্কা করিয়া তাহার অবমাননা করিয়াছিলেন, সেই নিমিত্ত তিনি লক্ষ্যালক্ষ্য ও অনভিরূপা হইয়াছেন। আমি অপত্য দর্শনাভিলাষে আগমন করিয়াছি, তুমিও আমাকে সেইরূপ অপমান করিতেছ। পুরুষের ভাৰ্যার প্রতি সর্বতোভাবে বিশ্বাস করা কদাপি কৰ্তব্য নহে, যেহেতু পতিপরায়ণা কামিনীও পুত্রবতী হইলে স্বামীর প্রতি পূর্বের ন্যায় অনুরক্তা থাকে না।

মহর্ষি মন্দপালের বাক্যবসানে তাহার পুত্রতুষ্টয় তৎসমীপে সমুপস্থিত হইয়া যথোচিত পিতৃভক্তি প্রদর্শন করিল এবং মহর্ষিও সাতিশয় সমাদর পূর্বক স্বীয় সন্তানগণকে আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন।