২১৩. অর্জুনবনবাস পর্বাধ্যায়

২১৩. অর্জুনবনবাস পর্বাধ্যায় – অর্জুন-কর্তৃক ব্রাহ্মণের গোধন-উদ্ধার, প্রতিজ্ঞালঙ্ঘনে অর্জুনের বনগমন

ত্রয়োদশাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—পাণ্ডবগণ নারদ সমক্ষে এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহারা স্বীয় শস্ত্রবলে ক্রমে ক্রমে অন্যান্য ভূপতিগণকে বশীভুত করিলেন। দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা সেই অপরিমিত বলশালী পঞ্চ ভ্রাতার বশবর্তিনী হইলেন। পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে পত্নীলাভ করিয়া যেরূপ প্রীত হইয়াছিলেন, দ্রৌপদীও তাহাদিগকে পতি পাইয়া তদ্রূপ অনিন্দিত হইয়াছিলেন। মহাত্মা পাণ্ডবগণের ধর্মানুষ্ঠান জন্য সমস্ত কুরুদেশ দোষশূন্য ও সুখসমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিল।

তাঁহাদের রাজ্য প্রাপ্তির বহুদিন পরে কতিপয় তস্কর একত্র হইয়া এক ব্রাহ্মণের কতকগুলি গোধন অপহরণ করিল। তাহাতে ব্রাহ্মণ ক্রোধে কম্পিত হইয়া খাণ্ডবপ্রস্থে আগমনপূর্বক উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতে করিতে পাণ্ডবগণের নিকট কহিতে লাগিল, হে পাণ্ডবগণ! ক্ষুদ্র নৃশংস চৌরগণ এই রাজ্য হইতে আমার গোধন হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছে, তোমরা ত্বরায় রক্ষা কর। হে পাণ্ডবগণ! প্রশান্ত ব্রাহ্মণের হবিঃ কাকে ভক্ষণ করিতেছে; নীচ পণ্ড শৃগাল শার্পলের শূন্য গুহায় প্রবেশ করিতেছে; যে রাজা ষষ্ঠাংশ কর গ্রহণ করিয়াও প্রজাগণকে রক্ষা না করেন, তিনি রাজ্যস্থ সমস্ত লোকের সমগ্ৰপাপের ভাগী হয়েন। হে পাণ্ডবগণ! চৌরে ব্রাহ্মণের ধন অপহরণ করিতেছে, ধৰ্মার্থ নাশ হইতেছে এবং আমি কাতর স্বরে ক্রন্দন করিতেছি; অতএব তোমরা আমাকে রক্ষা কর।

কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয়সমীপে রোরুদ্যমান ব্রাহ্মণের সেই সকল কাতরোক্তি শ্রবণে অনুকম্পাপরতন্ত্র হইয়া মাভৈঃ বলিয়া তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিলেন। ঐ সময়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আয়ুধাগারে দ্রৌপদীর সহিত অধ্যাসীন ছিলেন। অর্জুন দুঃখাৰ্ত্ত ব্রাহ্মণের রোদনে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়াও পূৰ্বপ্রতিজ্ঞানুসারে আয়ুধাগারে প্রবেশ করিতে পারিলেন না এবং যুধিষ্ঠিরের অনুমতি না লইয়া গমন করিতেও সমর্থ হইলেন না। তখন তিনি দোলাচলচিত্ত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, নির্দোষ ব্রাহ্মণের ধন অপহৃত হইয়াছে, ব্রাহ্মণ বোদন করিতেছেন, উহার অশ্রু প্রমার্জন করা নিতান্ত কর্তব্য : এদিকে মহারাজকে উপেক্ষা করিয়া গমন করিলে মহান্ অধর্ম জন্মে। কি করি! যদি দ্বারস্থ য়োরুদ্যমান ব্রাহ্মণকে রক্ষা না করি, তাহা হইলে জনসমাজে আমাদের রাজ্যপালনে উপেক্ষাজ কলঙ্ক ঘোষণা হইবে, আর যদি মহারাজের অনুমতি না লইয়া যাই, তাহা হইলে তাহার অপমান করা হয় এবং যদি তাহার অনুমতি লইবার নিমিত্ত অনুধাগারে প্রবেশ করি, তাহা হইলে প্রতিজ্ঞা লঙ্ন জন্য আমাকে বনে গমন করিতে হয়। কিন্তু রাজসন্নিধানে গমন করিলে আর সকল দোষই পরিহার করা হয়। যাহা হউক,প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন জন্য মহান্ অধর্মই হউক বা বনে বাসই হউক, ব্রাহ্মণের গোধন রক্ষা করা সর্বতোভাবে কর্তব্য; যেহেতু শরীর রক্ষা অপেক্ষাও ধর্মের গৌরব অধিক।

কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয় মনে-মনে এইরূপ নিশ্চয় করিয়া শস্ত্রাগারে প্রবেশ করিলেন এবং মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি লইয়া হৃষ্টচিত্তে ধনুঃশর গ্রহণপূর্বক ব্রাহ্মণকে কহিলেন, হে ব্রাহ্মণ! শীঘ্র আমার সহিত আগমন করুন। পরস্পাপহারী সেই ক্ষুদ্র চৌরগণ এখনও বহু দূরে পলায়ন করিতে পারে নাই; আমি ত্বরায় তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া আপনার গোধন আনয়ন করিতেছি। মহাবাহু অর্জুন ব্রাহ্মণকে এই কথা বলিয়া ধনু ও বৰ্ম ধারণপূর্বক রথে আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিলেন। পরে অল্পক্ষণের মধ্যেই বাণদ্বারা দক্ষগণকে সংহার করিয়া ব্রাহ্মণের গোধন লইয়া তাঁহাকে প্রদান করিলেন। ব্রাহ্মণ অর্জুন কর্তৃক এইরূপে উপকৃত হইয়া প্রসন্নচিতে তাহার যশঃ কীর্তন করিতে লাগিলেন।

মহাত্মা ধনঞ্জয় এইরূপে ব্রাহ্মণের উপকার করিয়া স্বভবনে প্রত্যাগমন করিলেন এবং সমস্ত গুরুজনকে অভিবাদন করিয়া ও তাঁহাদের কর্তৃক অভিনন্দিত হইয়া মহারাজ ধর্মরাজের সন্নিধানে গমনপূর্বক কহিতে লাগিলেন, হে প্রভো! আপনি দ্রৌপদীসহবাসে আয়ুধাগারে অবস্থিত ছিলেন, সেই সময়ে আমি তথায় প্রবেশ করিয়া নিয়ম উল্লঙ্ন করিয়াছি, তমিমি এক্ষণে পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞানুসারে বনে গমন করিব, আপনি অনুমতি করুন। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির সহসা অর্জুনমুখে এই অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন এবং সবাষ্প গদগদ স্বরে কহিতে লাগিলেন, হে ভ্রাতঃ! যদি তুমি আমাকে প্রভু বলিয়া জ্ঞান কর, তবে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি কেবল ব্রাহ্মণের উপকারার্থে আমার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিলে, তাহাতে আমার কিছুমাত্র অপ্রিয়ানুষ্ঠান করা হয় নাই, আমার সে বিষয়ে সম্মতি আছে। সস্ত্রীক কনিষ্ঠের গৃহে প্রবেশ করিলেই জ্যেষ্ঠের অধর্ম হইয়া থাকে, কিন্তু সপত্নীক জ্যেষ্ঠের গৃহে প্রবেশ করাতে কনিষ্ঠেয় কিছুমাত্র পাপ নাই। অতএব হে মহাবাহহ! তুমি আমার বচনানুসারে বনগমনে নিবৃত্ত হও; তোমার ধর্মলোপ হইবে না; তুমি যাহা করিয়াছ, তাহাতে, আমার অণুমাত্রও অবমাননা হয় নাই।

অর্জুন কহিলেন, হে মহারাজ! আপনিই কহিয়াছেন, ছলপূর্বক শ্মাসুষ্ঠান করিবে না; অতএব আয়ুধ স্পর্শ করিয়া কহিতেছি, আমি কদাচ সত্য। হইতে বিচলিত হইব না। মহাত্মা অর্জুন এই বলিয় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের। অনুমতি গ্রহণ পুরঃসর দ্বাদশ বর্ষ বনবাসে যাত্রা করিলেন।