১৮. হংসধ্বজ রাজার নগরে অশ্বের গমন ও তদুপলক্ষে নানা সংবাদ

সেই দেশে হংসধ্বজ নামে নৃপবর।
বড়ই ধার্ম্মিক রাজা ধর্ম্মেতে তৎপর।।
সুরথ সুধন্বা তার দুইটি নন্দন।
বিষ্ণুভক্ত দুইজন বিষ্ণুপরায়ণ।।
ঘোড়া উপনীত হৈল তাহার নগরে।
দূত গিয়া সমাচার কহিল রাজারে।।
যুধিষ্ঠির করিলেন অশ্বমেধ ক্রতু।
অর্জ্জুন আইল অশ্ব রাখিবার হেতু।।
নগরে আইল ঘোড়া শুনহ রাজন।
সঙ্গে আসিয়াছে তার বহু সৈন্যগণ।।
দূতমুখে কথা শুনি রাজা আনন্দিত।
আলিঙ্গন দূতে দেন মনে হয়ে প্রীত।।
কি কহিলে আরে দূত শুভ সমাচার।
আইল আমার পুরে পাণ্ডুর কুমার।।
আজি সে আমার জন্ম হইল সফল।
অর্জ্জুন আগত পুরে বড়ই মঙ্গল।।
যেখানে অর্জ্জুন তথা দেব নারায়ণ।
এই কথা অতি সত্য কহে মুনিগণ।।
দেখিব মাধবে আমি পাণ্ডব মিলনে।
চিরদিন সাধ আছে কৃষ্ণ দরশনে।।
ধরিয়া যজ্ঞের ঘোড়া আনহ সত্বরে।
এত বলি নৃপতি ডাকিল অনুচরে।।
পাইয়া রাজার আজ্ঞা অনুচরগণ।
সরিল যজ্ঞের ঘোড়া করিয়া যতন।।
অশ্ব লয়ে দিল হংসধ্বজের গোচরে।
মহানন্দে নরপতি আপনা পাসরে।।
সতন করিয়া অশ্ব রাখিল রাজন।
অর্জ্জুনে ধরিতে পুনঃ করিলেক মন।।
হংসধ্বজ বলে ওহে শুন বীরগণ।
যতন করিয়া সবে ধরিবা অর্জ্জুন।।
তবে সে পাইব আমি কৃষ্ণ দরশন।
সবান্ধবে পরশিব তাঁহার চরণ।।
এ বড় আমার সাধ আছয়ে অন্তরে।
দেখিব সে নারায়ণ আপনার ঘরে।।
আমার তপের ফল হইল উদয়।
সে কারণে আইলেন পাণ্ডুর তনয়।।
বান্ধহ যজ্ঞের ঘোড়া আর নাহি ডর।
এখনি অর্জ্জুন সহ হইবে সমর।।
ঘোড়া বান্ধা গেলে পার্থ কোথাও না যাবে।
অর্জ্জুন হইতে সবে গোবিন্দ দেখিবে।।
উত্তপ্ত করহ তৈল তাম্রের কুণ্ডেতে।
শীঘ্র রণে না আসিলে ফেলিবে তাহাতে।।
এত বলি রাজা দিল দামামা ঘোষণ।
পরস্পর সে কথা শুনিল সর্ব্বজন।।
রাজার আদেশ পেয়ে রাজ পুরোহিত।
তাম্রের কটাহে কৈল তৈলেতে পূর্ণিত।।
তৈল তপ্ত যতনে করিল মুনিবর।
তাহা শুনি ভয় পায় যত ধনুর্দ্ধর।।
সত্বরে আইল সবে নানা অস্ত্র ধরি।
বিমানে চড়িয়া কেহ তুরঙ্গ উপরি।।
নৃপতি তনয় যে সুধন্বা ধনুর্দ্ধর।
শীঘ্রগতি আইসে সেই করিতে সমর।।
হেনই সময়ে তবে সুধন্বার নারী।
যোড়হস্ত করি বরে লজ্জা পরিহরি।।
শুন প্রাণনাথ তব কোথায় গমন।
নানা অস্ত্র বান্ধিয়াছ কিসের কারণ।।
সুধন্বা বলেন তত্ত্ব নাহি জান তুমি।
যুদ্ধ হেতু আদেশ করেন নৃপমণি।।
অর্জ্জুন আইল পুরে তুরঙ্গ লইয়া।
ঘোড়া ধরিলেন পিতা দূত পাঠাইয়া।।
অর্জ্জুন সারথি কৃষ্ণ জানিয়া শ্রবণে।
যুদ্ধ অভিলাষ পিতা কৈল সে কারণে।।
চিরদনি আছে সাধ কৃষ্ণ দরশনে।
অর্জ্জুন ধরিতে আজ্ঞা দিল সে কারণে।।
সেই হেতু দিল রাজা নগরে ঘোষণা।
সাজিয়া চলিল যুদ্ধে যত রাজসেনা।।
শুন প্রিয়ে পিতার মনের অভিলাষ।
আনিয়া দেখাব আজি দেব শ্রীনিবাস।।
যাত্রা করি যাই আমি করিবারে রণ।
জয়ধ্বনি দিয়া গৃহে করহ গমন।।
প্রভাবতী বলে নাথ শুন সাবধানে।
আজি ঋতুভোগ তুমি কর মম সনে।।
একে প্রতিব্রতা আমি শুন প্রাণেশ্বর।
প্রভাতে যাইবে কালি করিতে সমর।।
ঋতুস্মান করিয়াছি নিবেদি তোমারে।
পুত্রদান দিয়া যাও যুদ্ধ করিবারে।।
অর্জ্জুন সহিত যাও করিবারে রণ।
এ কথা শুনিয়া মম চমকিত মন।।
পাণ্ডবের সখা কৃষ্ণ বিদিত সংসারে।
কেমন করিয়া তুমি জিনিবে তাহারে।।
আমি যে অবলা জাতি তাহে কুলনারী।
পুত্র না হইলে তবে কি প্রকারে তরি।।
তোমার ঔরসে মম হইবে তনয়।
ঋতুর পালন কর শুন মহাশয়।।
শুন প্রাণনাথ মোরে না কর নিরাশ।
পিতৃলোকে রাখ জল গণ্ডষের আশ।।
সংসার অসার দেখ সার নারায়ণ।
পুত্রদান দিয়া মোরে করহ গমন।।
সুধন্বা বলিল তবে শুনহ সুন্দরী।
মিথ্যা পুত্রে কিবা কার্য্য যদি তুষ্ট হরি।।
প্রভাবতী বলে নাথ এ নহে বিচার।
জনম বিফল অঙ্কে পুত্র নাহি যার।।
পুন্নাম নরকে তার নাহিক নিষ্কৃতি।
এ সব শাস্ত্রের কথা শুন প্রাণপতি।।
ব্যাস বশিষ্ঠাদি যত মহামুনিগণ।
পুত্র জন্মাইল সবে শুন নিবেদন।।
ইথে দোষ নাহি, মোরে দেহ পুত্রদান।
তবে গিয়া সংগ্রামে দেখিবে ভগবান।।
সুধম্বা বলিল শুন আমার বচন।
করিল আমার পিতা নিদারুণ পণ।।
শীঘ্রগতি যেইজন না আসে সমরে।
তাহারে ফেলিবে তপ্ত তৈলের উপরে।।
তপ্ত তৈলে ফেলাইবে তবে নরপতি।
প্রাণভয়ে সর্ব্বজন গেল শীঘ্রগতি।।
পশ্চাৎ যাইব আমি নহে ভাল কাজ।
ক্রোধ করি তৈলেতে ফেলিবে মহারাজ।।
শুন প্রভাবতী তুমি আজ থাক ঘরে।
সংগ্রাম জিনিয়া আমি তুষিব তোমারে।।
প্রভাবতী বলে কথা শুন প্রাণেশ্বর।
অর্জ্জুনে জিনিবা তুমি অতি সে দুষ্কর।।
সখা যাঁর নারায়ণ সংসারের সার।
এ তিন ভুবনে পরাজয় নাহি তাঁর।।
ভকতবৎসল হরি রাখেন অর্জ্জুনে।
পূরিয়া আমার আশ তুমি যাহ রণে।।
পঞ্চশরে জর্জ্জর হইল কলেবর।
আলিঙ্গন দিয়া মোরে তোষহ সত্বর।।
ঋতুর রক্ষণে নাহি দিনের বিচার।
এ সকল শাস্ত্র কথা তব জ্ঞাত সার।।
ভার্য্যার বচন বীর নারিল লেঙ্ঘিতে।
হাসিয়া যুদ্ধের সাজ এড়িল ভূমেতে।।
সুধম্বা শয়ন কৈল খট্টার উপরে।
ভুঞ্জিয়া শৃঙ্গার তুষ্ট করিল ভার্য্যারে।।
প্রভাবতী গর্ভ ধরে বীর কৈল স্নান।
যুঝিতে সুধম্বা যুদ্ধে করিল প্রয়াণ।।
কুবলয়া নামে তার আইল ভগিনী।
সুধম্বা গমনে দেয় জয় জয় ধ্বনি।।
যাহ যাহ সাধু ভাই অর্জ্জুনের রণে।
তোমা হৈতে কৃষ্ণ আমি দেখিব নয়নে।।
সুধন্বার জননী পাইল সমাচার।
পুত্রের সম্মূখে আসে ‍আনন্দ অপার।।
শীঘ্র যাহ আরে পুত্র করিতে সমর।
তোমা হৈতে আজি সে দেখিব গদাধর।।
যেখানে অর্জ্জুন তথা দেব নারায়ণ।
সত্য বলি এই কথা বলে সর্ব্বজন।।
বিলম্ব না কর পুত্র চলহ সত্বরে।
পূর্ব্ব পুণ্যফলে ঘোড়া আইল নগরে।।
চিরদিন আছে সাধ কৃষ্ণ দরশনে।
দেখিব পরমানন্দে অর্জ্জুন মিলনে।।
জননীর বচন শুনিয়া হরষিত।
প্রণাম করিয়া মায়ে চলিল ত্বরিত।।
হেথা দেখ সর্ব্ব সৈন্য সাজিয়া আইল।
হংসধ্বজ মহারাজ সবারে দেখি।।
সুধন্বারে না দেখিয়া বলে নরপতি।
কেন দিল নারায়ণ এমন সন্ততি।।
কোপে হংসধ্বজ কহিলেন পুরোহিতে।
আজি সুধন্বাকে তৈলে ফেলহ নিশ্চিতে।।
পুত্র হয়ে না পালিল পিতার বচন।
হেন ছার পুত্র মম নাহি প্রয়োজন।।
পুরোহিত সহ রাজা এ কথা কহিতে।
সুধন্বা আইল তথা পিতার সাক্ষাতে।।
প্রণাম করিয়া পুরোহিতের চরণে।
রাজারে প্রণাম করে রাজ সম্ভাষণে।।
সুধন্বারে দেখি রাজা বলে কুবচন।
এখন বাহির দুষ্ট হলি কি কারণ।।
ঘোড়া রাখিবারে পার্থ আসে মম পুরে।
যত্ন করিলাম তারে ধরিবার তরে।।
অর্জ্জুন ধরিলে পাব কৃষ্ণ দরশন।
বুঝিয়া করিনু আমি নিদারুণ পণ।।
ত্বরায় সাজিয়া যেবা না আসে সমরে।
তাহারে ফেলিব তপ্ত তেলের ভিতরে।।
ভয়েতে সাজিয়া এল যত সেনাগণ।
সে ভয় তোমার মনে নাহিক স্মরণ।।
সুধন্বা বলেন পিতা কর অবধান।
অস্ত্র লয়ে আসি আমি করিতে সংগ্রাম।।
হেনকালে প্রভাবতী সম্মূখে আইল।
ঋতুর রক্ষণ হেতু আমারে কহিল।।
মহাপাপ হয় ঋতু না কৈলে রক্ষণ।
অতএব বিলম্ব হইল সে কারণ।।
ইহা শুনি বলে হংসধ্বজ নরপতি।
জন্মিলে আমার কুলে তুমি পাপমতি।।
যুদ্ধের সময় তোর নারীতে যতন।
আরে দুষ্ট দেখিব কেমনে নারায়ণ।।
তুমি সে আমার কুলে পাপিষ্ঠ হইলে।
ছাড়িয়া ক্ষন্ত্রিয়ধর্ম্ম কামে মন দিলে।।
কৃষ্ণেতে বিমুখ হৈলে যাহ তৈল পাশে।
উচিত যে শাস্তি হয় ভুঞ্জহ বিশেষে।।
না করিলে ঋতু রক্ষা হয় মহাপাপ।
কি বুঝিয়া সুধন্বারে দেহ মনস্তাপ।।
সুধম্বা বৈষ্ণব বড় জানহ আপনি।
লঘুপাপে গুরদণ্ড নহে নৃপমণি।।
পাত্রের বচনে রাজা বলে পুরোহিতে।
সুধম্বা আমার পুত্র আসিল পশ্চাতে।।
ঋতুরক্ষা হেতু যে বিলম্ব হৈল তার।
কহ প্রভু কি হইবে ইহার বিচার।।
ওহে রাজা সর্ব্বগুণে তুমি নরপতি।
প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘিতে চাহ দেখিয়া সন্ততি।।
ক্ষন্ত্রেয় প্রতিজ্ঞা ধর্ম্ম ঘোষে সর্ব্বজন।
পুত্রস্নেহে ধর্ম্মপথ করিছ লঙ্ঘন।।
এত বলি সভা হৈতে যায় পুরোহিত।
মহাক্রোধভরে চলে অধর কম্পিত।।
না থাকিব তোর দেশে শুন নরপতি।
দেখিনু তোমার রাজা এবে পাপেমতি।।
এত শুনি হংসধ্বজ কহিল পাত্রেরে।
আমি যাই পুরোহিত আনিবার তরে।।
তপ্ত তৈলে সুধম্বাকে ফেলাইবে তুমি।
সুধন্বারে পুনঃ যেন নাহি দেখি আমি।।
অন্যের বচনে পুরোহিত না আসিবে।
যতন করিয়া আম আনি গিয়া তবে।।
এত বলি হংসধ্বজ চলিল সত্বরে।
সুমতি পাত্রের পুত্র বলে সুধন্বারে।।
আপনি শুনিলে তুমি রাজার বচন।
তৈল পাশে দ্রুত যাও রাজার নন্দন।।
সুধন্বা বলেন তৈলে ত্যজিব জীবন।
বড় দুঃখ না দেখিনু কমললোচন।।
মহাভরতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।