১৮. সপ্তম দিবসের যুদ্ধের যুক্তি

জিজ্ঞাসিলা জন্মেজয় করিয়া বিনয়।
শুনি কি কহিলা তবে অম্বিকা-তনয়।।
মুনি বলে, জন্মেজয় শুন সাবধানে।
এতেক শুনিয়া অন্ধ হৃষ্ট হৈল মনে।।
সঞ্জয়েরে জিজ্ঞাসিল করিয়া মিনতি।
কি প্রসঙ্গ হৈল তবে কহ মহামতি।।
মহাবল গঙ্গাপুত্র সমরে দুর্জ্জয়।
সংগ্রামেতে পরাজিত পাণ্ডুর তনয়।।
গৃহে আসি কি যুক্তি করিল যুধিষ্ঠির।
কিবা যুক্তি কৈল কহ দুর্য্যোধন বীর।।
নিজালয়ে আসিয়া ত পাণ্ডু-বংশপতি।
সিংহাসন ছাড়ি তবে বসিলেন ক্ষিতি।।
অধোমুখ করি রাজা ভূমিতে বসিল।
ভ্রাতৃবন্ধুগণ সবে ডাকিয়া আনিল।।
ভীমসেন ধনঞ্জয় মাদ্রীর নন্দন।
বিরাট দ্রুপদ আদি কেকয় রাজন।।
অভিমন্যু আদি করি যত রাজগণ।
নৃপতিরে বেড়িয়া বসিল সর্ব্বজন।।
দুঃখচিত্তে কৃষ্ণেরে কহেন নরপতি।
অবধান শুনহ গোবিন্দ মহামতি।।
পূর্ব্বে নিবেদন আমি করিনু তোমারে।
সংগ্রামে জিনিতে আমি নারিব ভীষ্মেরে।।
মহাবল গঙ্গাপুত্র সমরে প্রখর।
ভৃগুরাম সদৃশ সমরে ধনুর্দ্ধর।।
ইন্দ্রসহ আইসে যদি সব দেবগণ।
তথাপি জিনিতে নারে শান্তনু-নন্দন।।
মহা মহাবীর যত সমরে প্রখর।
বাণেতে পাড়িল রাজা গঙ্গার কোঙর।।
শত্রুভয়-বিদলিত যেন দৈত্যগণ।
ভীষ্মভয়ে মোর সৈন্য হইল তেমন।।
ভ্রাতৃ মিত্র সৃহৃদাদি যত বীরগণ।
ভীষ্ম বাণাঘাতে সবে সংশয় জীবন।।
আজ্ঞা কর নিবেদন করি যদুপতি।
যুদ্ধে কার্য্য নাহি মোর বনে করি গতি।।
পুনরপি বনবাসে করিব গমন।
তপস্বী হইয়া বনে করিব ভ্রমণ।।
তপ জপ সাধিয়া শোধিব কলেবর।
রাজপদে বাঞ্চা মোর নাহি দামোদর।।
এত শুনি কহে কৃষ্ণ হয়ে ক্রোধমুখ।
ভয় পরিহর রাজা নাহি কোন ‍দুখ।।
অর্জ্জুনের বিক্রম না জান নরবর।
অচিরেতে সংহারিবে গঙ্গার কোঙর।।
শত ভাই নৃপতি সহিত দুর্য্যোধন।
সবারে মারিবে বীর পবন-নন্দন।।
সত্য কৈনু রাজা আমি অগ্রেতে তোমার।
প্রকারেতে ভীষ্মে দেখ করিব সংহার।।
প্রতিজ্ঞা করিল ভীষ্ম মহা গুণধাম।
দশদিন কুরুক্ষেত্রে করিব সংগ্রামে।।
মহাজন প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিলে পাপ হয়।
তেকারণে গঙ্গাপুত্র সংগ্রামেতে রয়।।
ষষ্ঠদিনে যুদ্ধ কৈল ভীষ্ম মহাজন।
তিন দিন বহির্ভূতে হইবে নিধন।।
আমার প্রতিজ্ঞা তুমি জানহ রাজন।
সৃজন পালন আমি সংহার কারণ।।
আমি রাখি আমি মারি কৃষ্ণ মোর নাম।
বিদ্যমানে কালি তুমি দেখিবে সংগ্রাম।।
এতেক কহিল যদি দেব জগৎপতি।
কহিতে লাগিল তবে পার্থ মহামতি।।
অকারণে নরপতি করহ ভাবন।
ভয়েতে বিক্রম টুটে শুনহ রাজন।।
গোবিন্দের বাক্য রাজা কভু মিথ্যা নয়।
অচিরেতে কুরুবংশ যাবে যমালয়।।
হর্ত্তা কর্ত্তা হয় এই দেবকী নন্দন।
ইনি যে কহিবে তাহা না হয় খণ্ডন।।
মোর বাক্য শুন রাজা না কর শোচন।
এত বলি প্রবোধিয়া সান্ত্বাল রাজন।।
তদন্তরে কহিতে লাগিল বৃকোদর।
প্রতিজ্ঞা করিয়া কহে রাজার গোচর।।
কালিকার যুদ্ধ মোর করিবে গোচর।
অর্দ্ধ সৈন্য কৌরবের করিব সংহার।।
গজবাজি হানিয়া করিব খণ্ড খণ্ড।
মৃগপাল মধ্যে যেন কেশরী প্রচণ্ড।।
এত বলি সিংহনাদ কৈল ততক্ষণ।
প্রতিজ্ঞা করিল যত বীর জনে জন।।
জয় জয় শব্দ হৈল পাণ্ডব-বাহিনী।
চরমুখে দুর্য্যোধন এ সকল শুনি।।
শীঘ্রগতি ভীষ্ম দ্রোণে ডাকিয়া আনিল।
মহাযোধগণে তবে সবারে বলিল।।
অশ্বত্থামা জয়দ্রথ গঙ্গার নন্দন।
সোমদত্ত সুশর্ম্মাদি বাহ্লীক রাজন।।
ভূরিশ্রবা ভগদত্ত আদি নরপতি।
ত্রিগর্ত্ত সৌবল আদি শল্য যোদ্ধাপতি।।
সভাতে বসিল সবে সিংহ অবতার।
হেনকালে যুক্তি কৈল গান্ধারী কুমার।।
অবধানে পিতামহ শুন নিবেদন।
চর আসি যাহা কৈল শুনহ কারণ।।
যুধিষ্ঠিরে নারায়ণ বুঝাইল নীত।
প্রতিজ্ঞা করিল কৃষ্ণ অর্জ্জুন সহিত।।
আমি আদি ধৃষ্টদ্যুম্ন বিরাট নৃপতি।
শিখণ্ডী দ্রুপদ আদি সাত্যকি প্রভৃতি।।
তোমার বধের হেতু চিন্তিল প্রকার।
সাবধানে কালি তুমি করিবে সমর।।
এত বলি দুর্য্যোধন চাহে যোধপানে।
প্রতিজ্ঞা করিল তবে ক্রোধে দুঃশাসে।।
সাক্ষাতে অনল আনি করিল সত্যতা।
কালি আমি মারিব শিখণ্ডী মহারথা।।
প্রতিজ্ঞা করিল তবে দ্রোণ মহাশয়।
মোর হাতে পাঞ্চালের বংশ হবে ক্ষয়।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন আদি আর যত দুরাশয়।
মোর হাতে হইবে সবার বীর্য্যক্ষয়।।
তবে ভীষ্ম অশ্বত্থামা গুরুর নন্দন।
প্রতিজ্ঞা করিল কুরুবীর জনে জন।।
সঞ্জয় বলেন, শুন অম্বিকা-নন্দন।
যুদ্ধের বারতা তবে কহিব এখন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুন পুণ্যবান।।