১৫. উলূকের পত্যাবর্ত্তন ও দুয্যোধনের দ্বারকা গমন

দূত গিয়া দুর্য্যোধনে কহিল বারতা।
আপনি বরিতে কৃষ্ণে যাহ তুমি তথা।।
আপনি অর্জ্জুন আসি বরিবে কৃষ্ণেরে।
সে কারণে নারায়ণ কহিলা আমারে।।
প্রথমে আমারে আসি যে জন বরিবে।
তার পক্ষ অবশ্যই মোরে হতে হবে।।
সমান সম্বন্ধ মম কুরু পাণ্ডুগণ।
দুই কুল হিত আমি চিন্তি অনুক্ষণ।।
আর যে কহিল, তাহা শুন কুরুপতি।
পাণ্ডবের সহ তোমা করিতে পীরিতি।।
পাণ্ডবের সহ বিরোধিতে নিষেধিল।
সব যদুগণে তাহে অনুমতি দিল।।
অল্পকার্য্যে কুলক্ষয় নাহি প্রয়োজন।
চিত্তে যাহা লয়, তাহা করহ রাজন।।
এতেক দূতের বাক্য শুনি মহারাজ।
মুহূর্ত্তেকে যাত্রা কৈল না করিল ব্যাজ।।
অল্প সৈন্য সঙ্গে নিল শীঘ্র যাইবার।
দ্বারকা নগরে রাজা হইল আগুসার।।
দুর্য্যোধন উত্তরিল দ্বারকা নগরে।
সৈন্য সব রাখি গেল পুরের বাহিরে।।
একেশ্বর পুরে প্রবেশিল কুরুনাথ।
যেই গৃহে নিদ্রাগত আছে জগন্নাথ।।
তথা গিয়া উত্তরিল রাজা দুর্য্যোধন।
অচেতনে নিদ্রা যান দেব নারায়ণ।।
দিব্য সিংহাসন দেখে কৃষ্ণের শিয়রে।
ভৃঙ্গারেতে জল আছে, দেখিল শিয়রে।।
বিস্ময় মানিয়া রাজা ভাবে মনে মন।
আমার মর্য্যাদা বেশ জানে নারায়ণ।।
না আসিতে আমি হেথা দিব্য সিংহাসন।
আপন শিয়রে কৃষ্ণ করেছে স্থাপন।।
পাদ্য অর্ঘ্য রাখিয়াছে দিব্য জলাধার।
আমার সম্ভ্রম হেতু নানা উপচার।।
নিশ্চয় হইবে কৃষ্ণ আমার সারথি।
এত বলি সিংহাসনে বসে কুরুপতি।।
পরে ধনঞ্জয় আসিলেন ভক্তি করি।
একাকী প্রবেশ করিলেন অন্তঃপুরী।।
বসুদেব উগ্রসেন আদি যদুগণে।
একে একে প্রণমিল যথাযোগ্য জনে।।
মাতুলগণেরে পার্থ করিয়া সম্ভাষ।
তথা হৈতে চলিলেন যথা শ্রীনিবাস।।
অচেতনে নিদ্রাগত আছে নারায়ণ।
শিয়রে বসিয়া তাঁর রাজা দুর্য্যোধন।।
সিংহাসনে বসিয়াছে বাসবের প্রায়।
দেখি চিত্তে চিন্তা করিলেন ধনঞ্জয়।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া পার্থ যুক্তি করি মনে।
বসিলেন গিয়া কৃষ্ণ-পাদপদ্মাসনে।।
কৃষ্ণের চরণপদ্ম চাপে ধীরে ধীরে।
দেখি দুর্য্যোধন ক্রুদ্ধ হইল অন্তরে।।
বলিতে না ‍পারে কিছু ভাবে মনে মন।
কুরুবংশে জন্মি করে হেন আচরণ।।
বংশের অধম এই কুলের অঙ্গার।
কোন্ বা বড়াই এই দেবকী-কুমার।।
আমারে নাহিক ভয় নাহি লাজ মনে।
ব্যর্থ নাম পার্থ বলি ধরে অকারণে।।
অন্য হৈলে করিতাম এখনি সংহার।
বিশেষ আমার শত্রু জ্ঞাতি পাপাচার।।
এইরূপে মনে মনে নিন্দিছে রাজন।
সব জানিলেন অন্তর্য্যামী নারায়ণ।।
তথাপি উত্তর কিছু না দিলেন হরি।
নিদ্রায় অলস যেন সিংহাসনোপরি।।
কতক্ষণে নিদ্রাভঙ্গ হইল তাঁহার।
উঠিয়া সম্মূখে দেখে কুন্তীর কুমার।।
আলিঙ্গন দিয়া জিজ্ঞাসিলেন কুশল।
একে একে ধনঞ্জয় কহেন সকল।।
অবশেষে শ্রীগোবিন্দে কহে ধনঞ্জয়।
কৌরব পাণ্ডবে যুদ্ধ হইবে নিশ্চয়।।
তেঁই যুধিষ্ঠির পাঠাইলেন আমারে।
সারথি করিয়া যুদ্ধে তোমা বরিবারে।।
রথের সারথি তুমি হইবে আমার।
এত শুনি শ্রীগোবিন্দ করে অঙ্গীকার।।
শুনিয়া অর্জ্জুন হইলেন হৃষ্টমন।
পরে দেখিলেন কৃষ্ণ রাজা দুর্য্যোধন।।
মান্য করি সম্ভাষেন উঠি নারায়ণ।
কি আনন্দ, আজি দেখি কৌরব-নন্দন।।
কোন প্রয়োজনে হেথা কৈলে আগমন।
কি কার্য্য তোমার কহ, করিব সাধন।।
যদি বা দুষ্কর কর্ম্ম হয় অতিশয়।
আমা হৈতে হয় যদি করিব নিশ্চয়।।
তব কার্য্যে প্রীত আমি, তব আজ্ঞাকারী।
যে আজ্ঞা করিবে, তাহা সাধিবারে পারি।।
সমান সম্বন্ধ মম কুরু পাণ্ডুগণ।
উভয় কুলের হিত বাঞ্ছি অনুক্ষণ।।
চন্দ্র সূর্য্য তেজে যথা নাহি ভিন্ন জ্ঞান।
সেইরূপে দুইকুল রাখিব সমান।।
উভয় কুলের হিত করি প্রাণপণ।
যে আজ্ঞা করিবে তাহা করিব সাধন।।
ইহা শুনি বলে তবে রাজা দুর্য্যোধন।
আগে দূতমুখে তোমা করিনু বরণ।।
তাহাতে করিলে অঙ্গীকার নারায়ণ।
যে জন আমারে আগে করিবে বরণ।।
তাহার স্বপক্ষ আমি হইব নিশ্চয়।
সে কারণে আসিলাম তোমার আলয়।।
বহুক্ষণ হৈল, আমি আসিয়াছি হেথা।
পশ্চাৎ আসিল হেথা পার্থ মহারথা।।
তোমার সারথ্যগুণ বিখ্যাত ভুবনে।
ইন্দ্রের মাতলি সম শুনিনু শ্রবণে।।
মহাযুদ্ধে হবে তুমি আমার সারথি।
সে কারণে এই স্থানে আসি যদুপতি।।
ইথে মান অপমান নাহি যদুমণি।
অবধান কর কহি পূর্ব্বের কাহিনী।।
ত্রিপুর জিনিতে যবে যান শূলপাণি।
ব্রহ্মারে সারথি কৈল পরাক্রম জানি।।
ত্রিপুর-বিজয়ী শিব সারথির গুণে।
বৃহ্স্পতি সারথি যে ইন্দ্র-দৈত্যরণে।।
দেবের পরম গুরু অঙ্গিরানন্দন।
স্বধর্ম্ম জানিয়া তবু করে সূতপণ।।
বৃহস্পতিরে সারথি করি বজ্রপাণি।
বৃত্রাসুরে মারিলেন, বিখ্যাত ধরণী।।
গোবিন্দ বলেন, তুমি কহিলে প্রমাণ।
আগে মোরে বরিয়াছে অর্জ্জুন ধীমান।।
আগে তুমি আসিয়াছ জানিব কেমনে।
আগে আমি অর্জ্জুনেরে দেখেছি নয়নে।।
সারথি করিয়া মোরে করিল বরণ।
ইহার উপায় কিবা কহ দুর্য্যোধন।।
ব্যতিক্রম করি যদি দুই কুল হিতে।
আমার কুযশ বহু ঘুষিবে জগতে।।
দশ দিন করি যদি পার্থের সারথ্য।
দশ দিন করি যদি তোমার সূতত্ব।।
এমত নিয়ম হলে উপহাস লোকে।
সে কারণে দুয্যোধন কহি যে তোমাকে।।
তুমি কুরুপতি রাজা জগতে বিদিত।
তোমার মর্য্যাদা গুণ ঘোষে অপ্রমিত।।
কুরুবংশে যদুবংশে চেদি ভোজবংশে।
রবিবংশোদ্ভব যত রাজা অবতংশে।।
তব কার্য্যে হিত সবে তোমার শাসিতে।
তোমার অপ্রিয় কেহ নহে পৃথিবীতে।।
তোমারে করিবে মান্য যত রাজগণ।
অগ্রেতে করিল পার্থ আমাকে বরণ।।
তীর্থযাত্রা হেতু যবে যান হলপাণি।
কুরু পাণ্ডবের দ্বন্দ্ব চরমুখে শুনি।।
যুদ্ধ করিবারে করিলেন নিবারণ।
খণ্ডিতে না পারি আমি তাঁহার বচন।।
আমা আদি করি সবে যত যদুগণ।
যুদ্ধ করিবারে মানা করিল তখন।।
উভয় কুলের কোন পক্ষ না হইব।
রামের বচন কেহ লঙ্ঘিতে নারিব।।
করিব কেবল আমি মাত্র সূতপণ।
সে কারণে কহি আমি রাজা দুর্য্যোধন।।
নারায়ণী সেনা মম আছে কোটি সাত।
মম সম তেজবন্ত জগতে বিখ্যাত।।
মহাবলবান সবে বিক্রমে অপার।
এক এক জন হয় সান আমার।।
প্রতাপেতে কার্ত্তবীর্য্য সম জনে জন।
মহারথি মধ্যে গণি বিপক্ষে শমন।।
আমাকে ইচ্ছহ কিম্বা সেনা নারায়ণী।
নিশ্ছয় আমাকে কহ নৃপ-চূড়ামণি।।
ইহা শুনি দুর্য্যোধন ভাবিল অন্তরে।
কোন্ কার্য্য সিদ্ধ হবে নিলে গোবিন্দেরে।।
নারায়ণী সেনা যদি পাই কোটি সাত।
করিব তুমুল যুদ্ধ পাণ্ডবের সাথ।।
একাকী ইহারে নিলে হবে কোন্ কাজ।
এতেক ভাবিয়া চিত্তে কহে কুরুরাজ।।
আমার সহায় দেহ সেনা নারায়ণী।
আমারে সাহায্য এই কর চক্রপাণি।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা যে ইচ্ছা তোমার।
শুনি হৃষ্টচিত্ত হৈল কৌরব-কুমার।।
নারায়ণী সেনা লয়ে গেল দুর্য্যোধন।
দেখিয়া অর্জ্জুন হৈল বিষণ্ন বদন।।
জয় প্রভু জগন্নাথ, জয় চক্রধারী।
তোমার মহিমাগুণ কি বর্ণিতে পারি।।
শিষ্ট জনে পাল তুমি, দুষ্টেরে সংহার।
এই হেতু জগনআথ নাম যে তোমার।।
দারুরূপে পূর্ণব্রহ্ম নীলাচলে বাস।
জগজ্জন হিতে তব অতুল প্রকাশ।।
অনুক্ষণ তোমার চরণে রহু নতি।
কাশীরাম দাস কহে মধুর ভারতী।।