১৪. যুধিষ্ঠিরের বৈকুণ্ঠে গমন ও শ্রীকৃষ্ণ দর্শন

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
নিজ পুণ্যে স্বর্গে গেল ধর্ম্মের তনয়।।
পুষ্পরথে আরোহিয়া যান বিষ্ণুপুরে।
অপ্সর অপ্সরীগণ সদা নৃত্য করে।।
কেহ ছত্র ধরে কেহ চামর বাতাস।
দুই দিকে সারি সারি দেবের আবাস।।
ব্রহ্মলোকে দেখি রাজা ব্রহ্মা চতুর্ম্মূখে।
প্রণমিয়া সম্ভাষা করিলেন কৌতুকে।।
সমাদর করি ব্রহ্মা করি আলিঙ্গন।
চারি মুখে প্রশংসেন ধর্ম্মের নন্দন।।
তথা হৈতে নরপতি নানা স্বর্গ দেখি।
অপূর্ব্ব কৈলাসপুরী দেখিয়া কৌতুকী।।
চন্দ্রখণ্ড জিনি পুরী পরম উজ্জ্বল।
দিবা রাত্র সমজ্ঞান সদা ঝলমল।।
গণেশ কার্ত্তিক নন্দী ভূঙ্গী মহাকাল।
সবা দেখি আনন্দিত ধর্ম্ম মহাপাল।।
হরগৌরী দোঁহে দেখি অজিন আসনে।
ভক্তিভাবে দণ্ডবৎ করেন চরণে।।
আইসহ নরপতি বলে শূলপাণি।
ভাল হৈল এলেস্বর্গে ত্যজিয়া অবনী।।
তোমা হেন পুণ্যবান নাহি ত্রিভুবনে।
স্বকায় চলিয়া এলে অমর ভুবনে।।

এত বলি করিলেন প্রেম আলিঙ্গন।
প্রণাম করিয়া যান পাণ্ডুর নন্দন।।
কতক্ষণে বৈকুণ্ঠে হইয়া উপনীত।
পুরী দেখি নরপতি হৈলেন চিন্তিত।।
কিরূপে নির্ম্মাণ করিলেন নারায়ণ।
ত্রিভুবনে পুরী নাহি ইহার তুলন।।
প্রবেশ করেন পুরী জয় জয় দিয়া।
রত্নাসনে নারায়ণ দেখিলেন গিয়া।।
রথ হৈতে নামি পুরে যান পদব্রজে।
প্রণাম করেন গিয়া বিষ্ণু চতুর্ভুজে।।
বিদ্যমানে নারায়ণ দেখিয়া নৃপতি।
চমৎকার মানিলেন অঙ্গেয় বিভূতি।।
হস্ত পদ সুশোভিত কর্ণে শতদল।
মকর কুণ্ডল কর্ণে করে ঝলমল।।
শ্যাম অঙ্গে পীতম্বর ‍হাটক নিছনি।
নব জল মাঝে যেন হয় সৌদামিনী।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শোভে চারি হাতে।
শ্রীবৎস কৌস্তুভমণি শোভে মরকতে।।
বাম দিকে কমলা দক্ষিণে সরস্বতী।
এই বেশে হৃষীকেশে দেখেন ভূপতি।।
অষ্টাঙ্গে প্রণাম করি পড়েন চরণে।
বলিছেন নারায়ণ আনন্দিত মনে।।
আইসহ নরপতি ধর্ম্মপুত্র ধর্ম্ম ।
চিরকাল না দেখিয়া পাই ব্যথা মর্ম্ম ।।
আগুসরি উঠিয়া করেন আলিঙ্গন।
বসিবারে দেন দিব্য কনক আসন।।
পদ পাখালিতে বারি যোগায় দেবতা।
চামর বাতাস করে ইন্দ্র চন্দ্র ধাতা।।
সুখাসনে দুইজনে বসিয়া কৌতুকে।
গোবিন্দ বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসেন হাসিমুখে।।

যুধিষ্ঠির কহিলেন ধীরে পর পর।
পরীক্ষিতে করিলাম রাজ্য দণ্ডধর।।
দ্রৌপদী সহিত পঞ্চ আসি স্বর্গপথে।
মহাহিমে পাঁচ জনে পড়িল পর্ব্বতে।।
শোকে ‍দুঃখে একাকী আইনু স্বর্গলোকে।
শরীর সার্থক হৈল দেখিয়া তোমাকে।।

শুনিয়া কহেন সমাদরে নারায়ণ।
অগ্রে আসিয়াছে তারা আমার সদন।।
করযোড়ে কহিলেন ধর্ম্মের তনয়।
নয়নে দেখিলে তবে হয়ত প্রত্যয়।।
শুনি নারায়ণ তবে সঙ্গেতে লইয়া।
চলেন উত্তরমুখে দ্বার খসাইয়া।।
দক্ষিণেতে হয় শমনের অধিকার।
চর্ম্মচক্ষে দেখে তথা সব অন্ধকার।।
প্রবেশ করেন সেই পুরে নরপতি।
দেখিতে না পান রাজা কেবা আছে কতি।।
যুধিষ্ঠিরে সবে পেয়ে জ্ঞাতি গোত্রগণে।
চতুর্দ্দিকে ডাকে সবে হরষিত মনে।।
দ্রোণ কর্ণ ভীষ্ম শত ভাই দুর্য্যোধন।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুর শকুনি দুঃশাসন।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল সুন্দর।
ঘটোৎকচ জয়দ্রথ বিরাট উত্তর।।
অভিমন্যু বিকর্ণ পাঞ্চালী পুত্রগণে।
কুন্তী মাদ্রী দুই দেখি পাণ্ডুরাজ সনে।।
দ্রৌপদী গান্ধারী আদি যত কুরুনারী।
অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী আছে সেই পুরা।।
সবে বলিলেন ধর্ম্ম তুমি পুণ্যবান।
স্বকায়ে দেখিলে স্বর্গে দেব ভগবান।।
অল্প পাপ হেতু মোরা সদা পাই ক্লেশ।
সবাকারে উদ্ধারিয়া লহ নিজ দেশ।।

এত শুনি যুধিষ্ঠির চান চারি কোনে।
দেখিতে না পান মাত্র শুনিলেন কাণে।।
নরক দেখিয়া রাজা মনে পায় ভয়।
অনুমানে বুঝিলেন এই যমালয়।।
ভাবিত হইয়া জিজ্ঞাসিলেন কৃষ্ণেরে।
কেন কৃষ্ণ নাহি দেখি জ্ঞাতি বান্ধবেরে।।
কেন বা হইল মম নরক দর্শন।
বিশেষ কহিয়া কৃষ্ণ স্থির কর মন।।

গোবিন্দ বলেন রাজা করহ শ্রবণ।
কিছু পাপ হতে হৈল নরক দর্শন।।
জ্ঞাতি গোত্র নাহি দেখ তথির কারণে।
পাপক্ষয় হৈল এবে ত্যজ ভয় মনে।।
জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল কহ মুনিবর।
কোন্ পাপ করিলেন ধর্ম্ম নরবর।।
আজন্ম তপস্বী জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী।
দান ধর্ম্মে মতি সদা পাতক বিবাদী।।
তাঁহার হইল পাপ কেমন প্রকারে।
মুনিবর বিস্তারিয়া কহিবা আমারে।।