১২. মৃত্যুর উৎপত্তি ও বর্ণন

তদন্তর পিতামহে ধর্ম্মের তনয়।
করাযোড়ে জিজ্ঞাসেন, কহ মহাশয়।।
মৃত্যু হেন বস্তু কেবা করিল সৃজন।
পূর্ব্বাপর আছে কিবা ব্যাপিত ভুবন।।
মৃত্যু বলি কোন্ জন এ তিন ভুবন।
ছোট বড় সর্ব্ব জীবে করয়ে নিধন।।
কে সৃষ্টি করিল মৃত্যু, হৈল কি কারণে।
মৃত্যুতে সংসারে হরে বড় বড় জনে।।
যম বলে কাহারে সে ধরে কোন বেশ।

ভীষ্ম বলিলেন, বলি শুনহ রাজন।।
মৃত্যুর বৃত্তান্ত কথা অদ্ভূত কথন।
যবে করিলেন ব্রহ্মা সৃষ্টির পত্তন।।
মৃত্যু হেন বস্তু নাহি হইল সৃজন।
সংসার ব্যাপিল জীবে কেহ না মরয়।।
পৃথিবী না সহে ভার রসাতলে যায়।
শুনিয়া সকল তত্ত্ব চিন্তি প্রজাপতি।।
স্বায়ম্ভূব নামে এক করিল উৎপত্তি।
স্বায়ম্ভূব পুত্র হৈল রুচি মহাশয়।।
ভরতাদি সপ্ত হৈল তাহার তনয়।
সপ্ত পুত্রে সপ্ত দ্বীপে দিল অধিকার।।
জম্বুদ্বীপ মাগিলেন, ভরত-কুমার।
জ্যেষ্ঠপুত্রে জম্বুদ্বীপ দিল অধিকার।।
নাহি দিল ভরতেরে করি সুবিচার।
প্লক্ষদ্বীপে অধিকার দিলেন ভরতে।।
না লইল অধিকার ভরত কোপেতে।
সন্ন্যাসী হইয়া ক্রোধে হইল বাহির।।
তপস্যা করিতে গেল পর্ব্বত মিহির।
মহাতপ আরম্ভিল রুচির নন্দন।।
অনাহারে বাতাহারে মুদিত লোচন।
এইরূপে রহে ষাটি সহস্র বৎসর।।
তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা দিতে আসিলেন বর।
না লইল বর সেই রহিল মৌনেতে।।
পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মা কহিলেন বহুমতে।
দেখি মহাক্রুদ্ধ হইলেন সৃষ্টিধর।।
নেত্রানলে জন্মিল অসুর ভয়ঙ্কর।
সেইত অসুর জন্বুদ্বীপেতে ব্যাপিল।।
সহিতে না পারি ভার পৃথিবী কাঁপিল।
ব্রহ্মারে সদনে পৃথ্বী গুহারি করিল।।
পৃথ্বী সন্ত্বাইয়া তাঁর ভাবনা হইল।
চিন্তিয়া গেলেন ব্রহ্মা যথা ভগবতী।।
ললাট হইতে ঘর্ম্ম উপজিল তথি।
সেই ঘর্ম্ম মৃত্যু নামে লভিল জনম।।
মহাভয়ঙ্কর মূর্ত্তি বড়ই বিষম।
ব্রহ্মারে চাহিয়া মৃত্যু বলিল বচন।।
আজি সর্ব্ব জীবে আমি করিব নিধন।
একজন না রাখিব পৃথিবীতে আর।।
ছোট বড় সর্ব্ব জীবে করিব সংহার।

এতেক বলিয়া মৃত্যু কাঁপে থর থর।।
হাসিয়া মৃত্যুকে কহিলেন সৃষ্টিধর।
ক্রোধ সন্বরহ মৃত্যু শুনহ বচন।।
জন্বুদ্বীপে শীঘ্রগতি করহ গমন।
ধর্ম্মাধর্ম্ম বুঝি দণ্ড কর জীবগণে।।
ব্যাধিরূপ হয়ে কর জীবের নিধনে।
সর্ব্বত্র ব্যাপক হও বরেতে আমার।।
চতুর্দ্দশ ভুবনেতে কর অধিকার।
চতুঃষষ্টি ব্যাধি সৃজি দেন তার সনে।।
প্রেতপুরে যমরাজা চলিল তখনে।

পুরী চতুর্দ্দিকে তার অপূর্ব্ব রচন।।
তার কথা কহি শুন ধর্ম্মের নন্দন।
দেবঋষি সন্ন্যাসী যে মরে নৃপবর।।
উত্তর দ্বারেতে যায় যমের নগর।
পশ্চিম দুয়ার হয় অতি রম্যস্থল।।
নানা দ্রব্য ভোগ্য আছে অমৃত সকল।
সম্মূখ যুদ্ধেতে পড়ে যেই যোদ্ধাগণ।।
পশ্চিম দুয়ারে যায় যমের সদন।
পূর্ব্বদ্বারখানি দেখি পরম সুন্দর।।
দধি দুগ্ধ ভক্ষ্যদ্রব্য পরম সুন্দর।
স্বামীর সহিত মরে যত নারীগণ।।
স্বামী লয়ে পূর্ব্বদ্বারে করয়ে গমন।
দক্ষিণ দ্বারের কথা কহনে না যায়।।
শুনিলে লোমাঞ্চ হয় সকলের গায়।
দক্ষিণ দুয়ারে বহে বৈতরণী নদী।।
পাপীর শরীর দহে পরশয়ে যদি।
মস্তকে মারায়ে দূত অস্ত্রের প্রহার।।
সাঁতারিয়া পাপী সব হয় তাহে পার।
পার হতে আছে ভয়, শুনহ কাহিনী।।
কৃমিতে মাথার খুলি খায় ইহা জানি।
ঠাঁই ঠাঁই একেশ্বর হৈতে হয় পার।।
শৃগাল কুক্কুরে খায় ঘোর অন্ধকার।
চৌরাশী নরককুণ্ড তাহার দক্ষিণে।।
তাহার সকল কথা শুন সাবধানে।
বজ্রকীট পোকা আছে তাহার ভিতর।।
গ্রাসে গ্রাসে পাপী বেড়ি খায় নিরন্তর।
স্বামীবাক্য নাহি মানে, স্থাপিত হরণ।।
দেবতারে নিন্দে আর নিন্দয়ে ব্রাহ্মণ।
তাহারে ফেলায় ঘোর নরক ভিতরে।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম বিবেচনা চিত্রগুপ্ত করে।
মহাকুণ্ড নাম ধরে পুরিত শোণিত।।
শতেক যোজন তাহা কণ্টকে পূরিত।
সে নরকে গোবধ স্ত্রীবধকারী যায়।।
সর্ব্বাঙ্গে পোড়য় তাহে নরক পীড়য়।
তাহা ভাজা হয় পাপী আপনার তৈলে।।
ব্রহ্মবধ কর কিম্বা সুবর্ণ হরিলে।
মিথ্যা কথা কহে যেবা হরয়ে শাসন।।

কুম্ভীপাক নরকেতে তাহার গমন।
যে মহারৌরব নাম নরক বিশেষ।।
শুনহ তাহার কথা বলিব অশেষ।
তনয়া বিক্রয় যেবা করে মূঢ়জন।।
সে মহারৌরবে হয় তাহার গমন।
আর যেবা মহাপাপ করে মহীতলে।।
একে একে নরক ভূঞ্জয়ে বহুকালে।
সংক্ষেপে জানহ যমপুরীর কথন।।
কহিব ধর্ম্মের ফল শুনহ রাজন।
যার যেবা ধর্ম্মাধর্ম্ম করিয়া বিচার।।
ছোট বড় সবাকার কহিব বিস্তার।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে পরলোক তরি।
শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।।
একচিত্তে একমনে শুনে যেই জন।
সর্ব্বধর্ম্ম ফল লভে নাহিক সংশয়।।
সর্ব্বত্র অভীষ্ট লাভ সর্ব্বত্র বিজয়।
অন্তকালে পতি হয় বৈকুন্ঠ উপর।।
নাহিক সংশয় ইথে ব্যাসের উত্তর।
কাশীরাম দেব চিত্ত গোবিন্দ চরণে।।
একচিত্তে একমনে শুনে সর্ব্বজনে।