১১. অভিমন্যুর জন্ম-বৃত্তান্ত

মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
শিবিরে গেলেন রাজা শোকাকুল মন।।
বিলাপ করেন ধর্ম্ম কুন্তীর নন্দন।
ভূমিতে বসিয়া সবে ত্যজিয়া আসন।।
হেনকালে আসি সত্যবতীর নন্দন।
দেখেন ধর্ম্মের পুত্রে শোকাকুল মন।।
ব্যাসে দেখি সর্ব্বজন নমিল উঠিয়া।
ধর্ম্মে জিজ্ঞাসেন ব্যাস আশীর্ব্বাদ দিয়া।।
কি কারণে শোক কর ধর্ম্মের নন্দন।
ইহার বৃত্তান্ত বল আমারে এখন।।

এত শুনি যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের তনয়।
কান্দিয়া বলেন শুন ব্যাস মহাশয়।।
মহালোভি দুষ্টমতি আমি কুলাধম।
পৃথিবীতে পামর নাহিক আমা সম।।
রাজ্যলোভে কার্য্যে বাধা ধর্ম্মপথ রোধ।
নহে কি উচিত জ্ঞাতি সহিত বিরোধ।।
রাজ্যলোভে কার্য্যে বাধা ধর্ম্মপথ রোধ।
নহে কি উচিত জ্ঞাতি সহিত বিরোধ।।
রাজ্যলোভে করিলাম বড় অপকর্ম্ম ।
বুঝিলাম আচার সে বিচারে অধর্ম্ম।।
পাঠানু বালক, শত্রু সমূহের মাঝে।
কহিতে ফাটয়ে বুক হেট হই লাজে।।
কহিল আমারে শিশু করিয়া সম্ভ্রম।
ব্যূহ প্রবেশিতে পারি না জানি নির্গম।।
কহিল এ কথা পুত্র মোরে বারে বারে।
তথাপিও যত্ন করি পাঠাইনু তারে।।
সমরে অধিক সৈন্য বধিয়াছে সুত।
করিল প্রলয় যুদ্ধ দেখিতে অদ্ভুত।।
অন্যায় করিয়া কুরু শিশুবধ করে।
দ্রোণ আদি সপ্তরথী বেড়ি তারে মারে।।
অন্যায় সমরে বধে অভিমন্যু বীর।
নিবারিতে শোক আমি হয়েছি অস্থির।।
এত বলি কান্দিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।
অভিমন্যু মহাশোকে হইয়া অস্থির।।

ব্যাস বলিলেন শোক ত্যজহ রাজন।
খণ্ডাইতে নারে কেহ দৈব নির্ব্বন্ধন।।
মনস্থির কর, শুন আমার বচন।
আর্জ্জুনির পূর্ব্বকথা করহ শ্রবণ।।
মুনিশাপে চন্দ্র জন্মে শুভদ্রা উদরে।
তাহার বৃত্তান্ত কহি তোমার গোচরে।।
চন্দ্রলোকে গেল গর্গ মহাতরোধন।
সঙ্গেতে আছিল তার বহু শিষ্যগণ।।
চন্দ্রের নিকটে সবে উত্তরিল গিয়া।
সেই স্থানে মুনিগণ রহে দাণ্ডহিয়া।।
রোহিণী সহিত চন্দ্র ক্রীড়ায় আছিল।
হেনকালে গর্গমুনি সেই স্থানে গেল।।
মদনে মোহিত চন্দ্র অন্য মন ছিল।
গর্গমুনি দেখি চন্দ্র পূজা না করিল।।
এতেক দেখিয়া মুনি কুপিত হইয়া।
চন্দ্র প্রতি সেইক্ষণে বলেন ডাকিয়া।।
অহঙ্কারে মত্ত হয়ে না দেখ নয়নে।
কি কারণে অমান্য করিলে মুনিগণে।।
ব্রাহ্মণ হেলন কর মত্ত দুরাচার।
আজি আমি করিব ইহার প্রতিকার।।
মনুষ্যলোকেতে গিয়া জন্মহ সত্বর।
ক্রোধে এই শাপ দিল গর্গ মুনিবর।।
শুনিয়া মুনির শাপ রজনীর পতি।
অশেষ বিশেষে করে মুনিবরে স্তুতি।।
অজ্ঞানে ছিলাম আমি মুন মুনিবর।
যাইতে মনুষ্যলোকে বড় লাগে ডর।।
কৃপায় শাপান্ত মুনি আজ্ঞা কর মোরে।
কতদিনে মুক্ত হয়ে আসি হেথাকারে।।

তুষ্ট হয়ে বলে তারে গর্গ মুনিবর।
তোমার শাপান্ত এই শুন শশধর।।
অর্জ্জুনের পুত্র হবে শুভদ্রা উদরে।
করিয়া বীরের কার্য্য পড়িবে সমরে।।
সম্মুখ সংগ্রামে পড়ি ত্যজিবে জীবন।
ষোড়শ বৎচর অস্তে পুনরাগমন।।
এই হেতু চন্দ্র জন্মে সুভদ্রা উদরে।
অভিমন্যু জন্মকথা জানাই তোমারে।।
পূর্ব্বে হইয়াছে এইরূপেতে নির্ণয়।
অতএব শোক না করিহ মহাশয়।।

পুনশ্চ বলেন রাজা শুন মুনিবর।
কেমনে কহিব ইহা পার্থের গোচর।।
কি বলিয়া প্রবোধিব ভাই ধনঞ্জয়।
শুনিয়া কি বলিবেন কৃষ্ণ মহাশয়।।
কি বলিয়া প্রবোধিব সুভদ্রার মন।
বিরাটকন্যার দশা হইবে কেমন।।
রাজ্য আশে হারাই হাতের রত্ননিধি।
না পারি ধরিতে বুক বিড়ম্বিল বিধি।।
এতেক বলিয়া রাজা করেন রোদন।
ব্যাসের প্রবোধে স্থির তবু নহে মন।।
অকালে না মরে কেহ জানিহ রাজন।
কালপ্রাপ্ত হইলে না রহে কদাচন।।
অর্জ্জুনের সহিত আপনি নারায়ণ।
অর্জ্জুনের শোক করিবেন নিবারণ।।
এতেক শুনিয়া রাজা ত্যজেন রোদন।
নিরুৎসাহে বসিল যতেক যোদ্ধাগণ।।
যুধিষ্ঠিরে প্রবোধিয়া ব্যাস তপোধন।
করিলেন আপনার স্থানেতে গমন।।
দ্রোণপর্ব্ব পুণ্যকথা রচিলেন ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দাস।।