০৯. চন্দ্রকালী পর্ব্বতে নকুলের ও নন্দিঘোষ পর্ব্বতে অর্জ্জুনের দেহত্যাগ

মুনি বলে কহি শুন নৃপ জন্মেজয়।
চলিল উত্তরমুখে পাণ্ডুর তনয়।।
যাইতে উত্তরমুখে দেখেন রাজন।
সরোবর তীরে লিঙ্গ অতি সুশোভন।।
গঙ্গার সদৃশ দেখি সুনির্ম্মল জল।
কোকনদ প্রফুল্ল সহস্র শতদল।।
সরোবর আছে শত যোজন বিস্তার।
জল দেখি নৃপতির আনন্দ অপার।।
মৃগ পক্ষী হংস চক্র বিহরে বিস্তর।
ভ্রমর ঝঙ্কারে বনে জলে জলচর।।
অপরূপ দেবের দুর্ল্লভ সেই স্থান।
বসন্তে পবন মত্ত কোকিলের গান।।
পদ্মে আচ্ছাদিত সব নাহি দেখি নীর।
নিত্য স্নান হয় যাতে সদা ইন্দ্রাণীর।।
সেই সরোবরে স্নান করি চারিজন।
শোক দুঃখ ছাড়ি কিছু স্থির হৈল মন।।
তাহার পশ্চিমে গিরি চন্দ্রকালী নাম।
স্ফটিক নির্ম্মল দীপ্ত চন্দ্রের সমান।।
ভূবনের সার সে পর্ব্বত সুশোভন।
তাহাতে পাণ্ডব করিল আরোহণ।।
হিমে অঙ্গ জ্বর জ্বর গিয়া হিমালয়।
তাহে উঠি পাণ্ডব করেন জয় জয়।।
ধীরে ধীরে যান হিমে পদ নাহি চলে।
ঋষি মুনি তপস্বী দেখেন গঙ্গাকূলে।।
ষোড়শ সহস্র লিঙ্গ দেখি পঞ্চানন।
ভক্তিভাবে প্রণাম করেন চারিজন।।
বিচিত্র মণ্ডপ নানা দেবের আবাস।
ঋষি মুনি জপ তপ করে চারি পাশ।।
নৃসিংহের মূর্ত্তি দেখি পর্ব্বত উপরে।
দেবকন্যাগণ তাতে নিত্য পূজা করে।।
চারি ভাই প্রণাম করেন তাঁর পায়।
নৃসিংহ উদ্ধার কর ঘন বলে রায়।।
হিরণ্যকশিপু মারি রাখিলা প্রহলাদ।
স্বর্গপথে পাণ্ডবে রাখিবা অপ্রমাদ।।
অভয় নৃসিংহ নাম যে করে স্মরণ।
জলে স্থলে ভয় তার নাহি কদাচন।।

এত বলি বর মাগি নৃসিংহের ঠাঁই।
বিষাদ সন্তাপ তাপে যান চারি ভাই।।
কতদূরে দেখিলেন গিরি মনোহর।
নানা ধাতু বিরচিত প্রবাল পাথর।।
পশ্চাৎ করিয়া গিরি চলেন উত্তরে।
হিমেতে মন্থর পদ চলিতে না পারে।।
নকুলের অঙ্গে পড়ে শোণিত বহিয়া।
পর্ব্বতে পড়িল বীর আছাড় খাইয়া।।
গোবিন্দ চিন্তিয়া চিত্তে ত্যজিল পরাণ।
স্বর্গপুরে প্রবেশিল কৃষ্ণ বিদ্যমান।।

ধর্ম্মেরে কহিল তবে ভীম মহামতি।
পড়িল নকুল বীর শুন নরপতি।।
পাছে দেখি ধর্ম্মরাজ ভাবিলেন চিতে।
ছয় জন মধ্যে তিন রহিল পর্ব্বতে।।
তিনলোকে দুর্জ্জয় নকুল মহাবীর।
যাহার সংগ্রামে দেবাসুর নহে স্থির।।
হেন ভাই পড়ে মম পর্ব্বত উপরে।
কোন সুখে কি বলিয়া যাব স্বর্গপুরে।।
তাপের উপরে তাপ শোকে মহাশোক।
কাহারে কহিব দুঃখ হরি পরলোক।।
যামদিক যেই ভাই জিনিল সকলে।
যজ্ঞ করিবার কালে ধন আনি দিলে।।
স্বর্গ নাহি গেলা ভাই পড়িলে পর্ব্বতে।
তোমার বিচ্ছিদে প্রাণ ধরিব কিমতে।।

কান্দি জিজ্ঞাসেন ভীম নৃপতির স্থানে।
কোন পাপে নকুল পড়িল এইখানে।।
যুধিষ্ঠির কন শুন ভাই, বৃকোদর।
কুরুক্ষেত্রে হয় যবে ভারত সমর।।
কর্ণের সমর হৈল আমার সহিতে।
সেই কালে নকুল আছিল মম ভিতে।।
কর্ণের সংগ্রামে যবে মম বল টুটে।
সহায় না হৈল সেই বিষয় সঙ্কটে।।
যুদ্ধ না করিল ভাই আমার রক্ষণে।
এই পাপে পর্ব্বতে পড়িল পরিণামে।।

ইহা বলি যুধিষ্ঠির কান্দিতে কান্দিতে।
চলেন উত্তরমুখে ভাবিতে ভাবিতে।।
কতদূরে মহাহিমে যান তিন জন।
নন্দীঘোষ গিরি করিলেন আরোহণ।।
পদ্মরাগে বিরাজিত গিরি মনোহর।
নানা জাতি নর নারী পরম সুন্দর।।
মণি বিভূষিত যত দেবের বসতি।
সে বনেতে অক্ষয় অব্যয় হয় গতি।।
তিন ভাই করি তথা গোবিন্দ পূজন।
যোড়হাতে করিলেন কৃষ্ণের স্তবন।।
ভক্তিভাবে স্তুতি করে হয়ে কৃতাঞ্জলি।
জলপান করে যান হয়ে কুতূহলী।।

ভয়ঙ্কর নন্দীঘোষ পর্ব্বত বিশাল।
হিমাগমে মহাশীত বহে সর্ব্বকাল।।
পশু পক্ষী গাছ লতা নাহি সেই দেশে।
হিমের প্রতাপে নাশ হয়েছে বিশেষে।।
হিম ভেদি অর্জ্জুনের হরিল যে জ্ঞান।
গোবিন্দ ভাবিয়া চিত্তে ত্যজিলেন প্রাণ।।
দেবাসুরে দুর্জ্জয় সে পার্থ মহাবীর।
পতনে পর্ব্বতে কম্প পৃথিবী অস্থির।।
উল্কাপাত ঘোর বহে প্রলয়ের ঝড়।
ভল্লুবাদি বরাহ গণ্ডার আদি ঘোড়।।

ভীমসেন বলে শুন ধর্ম্মের নন্দন।
পর্ব্বতে পড়িয়া পার্থ ত্যজিল জীবন।।
যার পরাক্রমে যক্ষ নর নহে স্থির।
হেন ভাই পড়ে শুন রাজা যুধিষ্ঠির।।
প্রাণ দিল নন্দীঘোষ পর্ব্বত উপরে।
এত বলি বৃকোদর কান্দে হাহাকারে।।
চমৎকার চিত্ত হৈয়া চান ধর্ম্মরাজ।
না চলে চরণ চক্ষে নাহি দেখে কাজ।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে বিরচিল কাশীদাস।।