০৮. অদিতির তপস্যা ও বিষ্ণুর স্তব

হৃদে বিচারিল তবে দেবের জননী।
উপায় না দেখি আর বিনা চক্রপাণি।।
সংসারের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব নারায়ণ।
বিশ্বস্রষ্টা পোষ্টা তিনি সংহার কারণ।।
তাঁহা বিনা এ বিপদে কে করিবে ত্রাণ।
তিনি ভক্তজনে কৃপা করেন প্রদান।।
বিনা তপে তুষ্ট নহিবেন ভগবান।
ভাবিয়া ক্ষীরোদকূলে করিল প্রস্থান।।
করিল কঠোর তপ দেবের জননী।
তিন দিনে খায় তবে তিনাঞ্জলি ‍ানি।।
অনন্তরে মাস মধ্যে খায় একবার।
তারপরে দেবমাতা থাকে অনাহার।।
ধ্যান অবলম্ব হেতু করে নিরূপণ।
ঊর্দ্ধদৃষ্টি রহে, মাত্র পবন অশন।।
তপেতে তাপিত হৈল এ তিন ভুবন।
দেখিয়া চিন্তিত হইলেন পদ্মাসন।।
দেবগণে ডাকি বলিলেন পিতামহ।
তপ পরীক্ষিতে শীঘ্র সকলেতে যাহ।।
ব্রহ্মার আজ্ঞায় ইন্দ্র আদি দেবগণ।
মায়ের সাক্ষাতে গেল পরীক্ষা কারণ।।
ইন্দ্র বলে, শুন মাতা মম নিবেদন।
আত্মাকে এতেক কষ্ট দেহ কি কারণ।।
আমা সবাকার দুঃখ অদৃষ্টে লিখন।
শুভকাল হৈলে দুঃখ হবে বিমোচন।।
অশুভ সময়ে কর্ম্ম ফল নাহি ধরে।
বেদের নিয়ম হেন শাস্ত্রের বিচারে।।
এক্ষণে অশুভকাল হইল আমার।
সে কারণে এত দুঃখ না হয় অনিবার।।
অদৃষ্টে থাকিলে দুঃখ না হয় খণ্ডন।
সে কারণে শুন মাতা মম নিবেদন।।
আত্মাকে এতেকক্লেশ দেহ কি কারণ।
তপ ত্যাগ করি মাতা স্থির কর মন।।
মাতৃহীন তনয়ের নাহি সুখলেশ।
সদাই দুঃখিত সেই, পায় নানা ক্লেশ।।
ধর্ম্মহীন জনে যেন ব্যর্থ উপার্জ্জন।
ভক্তিহীন জ্ঞানিজন যেন অকারণ।।
শ্রদ্ধাহীন শ্রাদ্ধ যেন, বীজহীন মন্ত্র।
শাস্ত্রহীন গুরু যেন, যোগহীন তন্ত্র।।
সে কারণে নিবেদন শুনহ জননী।
আপনার আত্মা রক্ষা করহ আপনি।।
তোমার প্রসাদে মাতা শুভ কাল হৈলে।
দৈত্যগণেরে মোরা জিনিব অবহেলে।।
এতেক বলিল যদি দেব সুরপতি।
ধ্যান ভঙ্গ করি মাতা চাহে ক্রোধমতি।।
নয়ন শ্রবণ হৈতে অগ্নি বহিরায়।
ভয় পেয়ে দেবগণ পলাইয়া যায়।।
ব্রহ্মার সাক্ষাতে গিয়া করে নিবেদন।
শুনি ব্রহ্মা চলিলেন সহ দেবগণ।।
ক্ষীরোদের কূলে গিয়া স্তুতি করিলেন।
তুষ্ট হয়ে নারায়ণ দর্শন দিলেন।।
নব জলধর জিনি অঙ্গের বরণ।
পীতবাস পরিধান রাজীবলোচন।।
আজানুলম্বিত বনমালা বিভূষিত।
নূপুর কঙ্কণ হার মুক্তা বিরাজিত।।
দিব্যমূর্ত্তি পুরোভাগে দেখি নারায়ণে।
করিলেন স্তুতি প্রণিপাত দেবগণে।।
স্তুতিবশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগৎপতি।
দেবগণ প্রতি কহে মধুর ভারতী।।
শীঘ্র হবে তোমাদের দুঃখ বিমোচন।
যাহ নিজ স্থানে চলি যত দেবগণ।।
এত বলি, অন্তর্হিত হন নারায়ণ।
যথাস্থানে গেল ইন্দ্র আদি দেবগণ।।
অদিতি তপেতে তপ্ত এ তিন ভুবন।
প্রত্যক্ষ হইয়া হরি দেন দরশন।।
সজল জলদ যেন অঙ্গের বরণ।
কোটি শশী জিনি মুখ, রাজীবলোচন।।
কোকনদ কর পদ, অধর অতুল।
খগরাজ জিনি নাসা যেন তিলফুল।।
কাঞ্চন বরণ জিনি অম্বর শোভন।
আজানুলম্বিত বনমালা বিভূষণ।।
শ্রবণে কুণ্ডল দোলে, অতি শোভা করে।
দেখিয়া মানিল দেবী বিস্ময় অন্তরে।।
সাক্ষাতে দেখিয়া সেই কমললোচনে।
দণ্ডবৎ প্রণমিল ভক্তিযুত মনে।।
করযোড়ে স্তুতি তবে করিল বিস্তর।
জয় জয় নারায়ণ, দেব দামোদর।।
শিষ্টের পালক, নমো দুষ্ট বিনাশন।
নমো হয়গ্রীব মধুকৈটভ-মর্দ্দন।।
নমো আদি অবতার, মৎস্য কলেবর।
নমো কূর্ম্ম অবতার, নমস্তে ভূধর।।
নমস্তে বরাহরূপ মোহিনী আকৃতি।
অবতার শিরোমণি নমো জগৎপতি।।
তুমি ইন্দ্র, তুমি চন্দ্র, তুমি বৈশ্বানর।
আকাশ পাতাল তুমি দেব গদাধর।।
অন্তরীক্ষ নাভি তব, পাতাল চরণ।
পৃথিবী তোমার কটি, অস্থি গিরিগণ।।
তোমার বিভূতি এই সকল সংসার।
আত্মরূপে সর্ব্বস্থানে করিছ বিহার।।
পুরুষপ্রধান তুমি আদি নারায়ণ।
বিষম সঙ্কটে দেব করহ তারণ।।
এইরূপে স্তুতি করে দেবের জননী।
প্রসন্ন হইয়া কহিলেন চক্রপাণি।।
তোমার স্তবেতে তুষ্ট হইলাম আমি।
মনোনীত বর দিব, মাগি লহ তুমি।।
যদি বা অসাধ্য হয় ভুবন ভিতরে।
অঙ্গীকার করিলাম দিব তা তোমারে।।
ভক্ত যাহা বাঞ্ছা করে মম সন্নিধান।
দেই তারে, অবশ্য না করি আমি আন।।
ভকত-বৎসল আমি ভক্তের কারণে।
আত্মদান দিয়া তুষি সেই ভক্তজনে।।
সতী সাধ্বী গুণবতী বড় ভাগ্যবতী।
করিলে কঠোর তপ আমাতে ভকতি।।
সে কারণ বশ আমি হলেম তোমার।
বর ইচ্ছা আছে যদি, মাগ সারোদ্ধার।।
এত শুনি কহিলেন দেবের জননী।
যদি বর দিবে তবে দেব চক্রপাণি।।
নিষ্কন্টক করি দেহ মম পুত্রগণে।
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব নিল অসুর দারুণে।।
ধরিয়া মানবরূপ মম পুত্রগণ।
সঙ্গোপনে মহীতলে করিছে ভ্রমণ।।
গুরু আরাধিয়া বলি মহাবল ধরে।
আমার তনয়গণে জিনিল সমরে।।
পুত্রদের কষ্ট আমি দেখিতে নারিনু।
তপস্যা করিয়া তাই তোমা আরাধিনু।।
দেহ মম পুত্রগণে নিজ অধিকার।
অসুরের অহঙ্কার করহ সংহার।।
দৈত্যারি পুণ্ডরীকাক্ষ শ্রীমধুসূদন।
এই বর আজ্ঞা মোরে কর নারায়ণ।।
এত শুনি শ্রীগোবিন্দ করে অঙ্গীকার।
তোমার গর্ভেতে আমি হব অবতার।।
ধরিয়া বামনরূপ ছলিব বলিরে।
তব পুত্রগণ পাবে নিজ অধিকারে।।
রাখিব অদ্ভূত কীর্ত্তি যাইব ধরণী।
এত শুনি কহে পুনঃ কশ্যপ রমণী।।
উপহার কর প্রভু হেন লয় মনে।
আমার গর্ভেতে তুমি জন্মিবে কেমনে।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড তব এক লোমকূপে।
তোমার গর্ভেতে আমি ধরিব কিরূপে।।
যাঁর তত্ত্ব যোগিগণ না পায় উদ্দেশে।
সকল সংসার মুগ্ধ যাঁর মায়াবশে।।
তাঁহারে কিরূপে আমি করিব ধারণ।
হেন বুঝি উপহাস কর নারায়ণ।।
হাসিয়া কহেন হরি, উপহাস কেনে।
ভিন্ন ভাবে নাহি ভাবি আমি ভক্তজনে।।
ভক্তজন সবে পারে আমারে ধরিতে।
তুমি সতী সাধ্বী ভক্তি সাধিলে আমাতে।।
সে কারণে তব গর্ভে হব অবতার।
নিজালয়ে এবে ‍তুমি কর আগুসার।।
এত বলি নিজ স্থানে যান নারায়ণ।
প্রণমিয়া দেবমাতা করিল গমন।।
স্বামীরে কহিল দেবী এ সব কাহিনী।
শুনি হৃষ্ট হইল কশ্যপ মহামুনি।।
তবে কত দিন পরে দেব দামোদর।
করিলেন সুপবিত্র অদিতি-উদর।।
দিব্যরূপ ধরে তবে দেবের জননী।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন মুনি।।
জন্মিবেন নারায়ণ জানিয়া নিশ্চয়।
নানা স্তুতি করিলেন ঋষি মহাশয়।।
নমো নমো নারায়ণ অখিল পালক।
নমো যজ্ঞকায় হিরণ্যাক্ষ-বিনাশক।।
নমস্তে নৃসিংহরূপী দৈত্য বিনাশন।
নমো সর্ব্বময় নমো জগৎপালন।।
জগৎ নায়ক নমো নমো জগৎপতি।
নমো কূর্ম্ম অবতার মোহিনী আকৃতি।।
নমো যোগপরায়ণ নমো যোগরূপ।
নমো যোগপরায়ণ নমো যোগরূপ।
নমো জগৎপাতা তুমি, সবাকার ভূপ।।
নমো জগৎকর্ত্তা তুমি, নমো নারায়ণ।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে তোমার ভ্রমণ।।
তুমি সৃজ, তুমি পাল, করহ সংহার।
তোমার বিভূতি দেব সকল সংসার।।
শিষ্টের পালন কর, দুষ্টের সংহার।
সে কারণে মম ঘরে হৈলে অবতার।।
নমস্তে বামনরূপ আদি সনাতন।
এইরূপে স্তুতি করিলেন তপোধন।।
স্তুতিবশে সুপ্রসন্ন হয়ে পীতবাস।
কশ্যপের পুত্ররূপে হলেন প্রকাশ।।
অদিতির গর্ভে জন্ম লইলেন হরি।
সম্বরি বিরাট দেহ খর্ব্বমূর্ত্তি ধরি।।
জন্মমাত্র কহিলেন পিতারে কুমার।
ঝটিতে আমার কর ব্রাহ্মণ-সংস্কার।।
শুনিয়া কশ্যপ মুনি শুভক্ষণ ধরি।
আপন পুত্রেরে তবে দিলেন উত্তরী।।
কশ্যপেরে কহিলেন দেব নারায়ণ।
মহাযজ্ঞ করে বিরোচনের নন্দন।।
অসংখ্য অসংখ্য ধন দ্বিজে করে ‍দান।
সে কারণে তথা আমি করিব প্রয়াণ।।
মাগিয়া আনিব দান বলি দৈত্যেশ্বরে।
এত বলি চলিলেন বলির দুয়ারে।।
বলি রাজা যজ্ঞ করে বসি যজ্ঞস্থলে।
দ্বারে দেখি বামনেরে শুক্র গুরু বলে।।
অবধান কর বলি, বলিব বিশেষ।
এই যে বামন আসে বালকের বেশ।।
অদিতির গর্ভে জন্ম বিষ্ণু অবতার।
তোমারে ছলিতে করিয়াছে আগুসার।।
যে কিছু মাগিবে দান, না দিবে ইহারে।
এত শুনি বলি দৈত্য কহিলেন তাঁরে।।
না বুঝিয়া গুরু হেন কহ অকারণ।
স্বয়ং নারায়ণ যদি এই যে বামন।।
যাঁহার উদ্দেশে যজ্ঞ করি চিরকাল।
তিনি যদি ইনি, তবে কি ভাগ্য বিশাল।।
ব্রহ্মা আদি দেব যাঁর পূজয়ে চরণ।
উদ্দেশে মাগয়ে বর যত দেবগণ।।
সেই প্রভু আসে যদি আমার আলয়।
তবে গুরু অতিগুরু মম ভাগ্যোদয়।।
যে কিছু মাগিবে দান, দিব তা নিশ্চয়।
ইহাতে বিরোধী কেন হও মহাশয়।।
ধর্ম্মকর্ম্মে বাধা দেও, অতি অনুচিত।
এত শুনি শুক্র গুরু হলেন দুঃখিত।।
শাপ দিল বলি দৈত্যে অতি ক্রোধভরে।
মম বাক্য না শুনিলে ধন-অহঙ্কারে।।
এই শাপে লক্ষ্মীভ্রষ্ট হবে এইক্ষণে।
এত বলি শুক্র গুরু গেল ক্রুদ্ধমনে।।
হেনকালে উপনীত হৈল নারায়ণ।
বামন আকৃতি রূপ অরুণ বরণ।।
দেখি যজ্ঞ হোতাগণ মানিল বিস্ময়।
উঠে করযোড়ে বিরোচনের তনয়।।
প্রণাম করিয়া দিল বসিতে আসন।
সভামধ্যে দ্বিজশিশু বসেন বামন।।
অপরূপ রূপধারী কশ্যাপ কুমার।
দেখি লোমাঞ্চিত বলি, সানন্দ অপার।।
কৃতাঞ্জলি করি স্তুতি করে মতিমান।
আজি যে সফল মম যাগ যজ্ঞ দান।।
আজি যে সফল জন্ম হইল আমার।
নারায়ণ আসিলেন আমার আগার।।
চাহ যাহা দিব তাহা, না হবে অন্যথা।
ত্রিভুবন চাহ যদি অর্পিব সর্ব্বথা।।
শুনিয়া কহেন হাসি কপট বামন।
বহু দানে আমার কি আছে প্রয়োজন।।
ব্রাহ্মণ-বালক আমি তপস্যা তৎপর।
গ্রামে ভূমে আমার কি কাজ দৈত্যেশ্বর।।
ধ্যানে তপে জপে মম যায় অনুক্ষণ।
মুনিকুলে জন্ম মোর, শুনহ রাজন।।
অরণ্যনিবাসী আমি ফলমূলাহারী।
সে কারণে কহি, শুন দৈত্য অধিকারী।।
যদি দিবে তুমি দান করিয়াছ মনে।
তিন পদ ভূমি দেহ মাপিয়া চরণে।।
তপ করিবারে চাহি বসিয়া তাহাতে।
ইহা ভিন্ন অন্য কিছু না চাহি তোমাতে।।
ভূমিদান সম ফল নাহি ত্রিভুবনে।
ভূমিদানের মাহাত্ম্য শুন নৃপমণে।।
সুঘোষ নামেতে এক আছিল ব্রাহ্মণ।
সৌভরি নগরবাসী দরিদ্র-লক্ষণ।।
ধনার্থে করিল বহু রাজ্য পর্য্যটন।
না মিলিল ধন তার অদৃষ্ট কারণ।।
ছয় পত্নী পুত্র পৌত্র বহু পরিজন।
উপার্জ্জক সেই মাত্র একাকী ব্রাহ্মণ।।
নিরন্তর ভিক্ষা মাগি আনয়ে ব্রাহ্মণ।
ভ্রমণ ব্যতীত নহে উদর ভরণ।।
এক দিন দ্বিজবর ভিক্ষায় না গেল।
আলস্য করিয়া নিজ গৃহেতে রহিল।।
অন্ন হেতু কান্দে তার যত শিশুগণ।
শুনিয়া হৃদয়ে তাপ পাইল ব্রাহ্মণ।।
আপনারে নিন্দা করি অনেক কহিল।
নিরর্থক জন্ম মোর জগতে হইল।।
ধনহীন মনুষ্যের জন্ম অকারণ।
মনুষ্যের মধ্যে কেহ না করে গণন।।
চণ্ডাল যবন আদি যত নীচ জাতি।
ধনাঢ্য হইলে পায় সর্ব্বত্র সুখ্যাতি।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র যত জন।
ধনহীন হৈলে কেহ না করে গণন।।
ভার্য্যা পুত্র অরি হয়, মিত্র না আদরে।
ধনহীন হৈলে কিছু করিবারে নারে।।
এইমত চিন্তা করি কাতর ব্রাহ্মণ।
নগর ত্যজিয়া গেল লয়ে পরিজন।।
অবন্তী-নগরে বিপ্র করিল বসতি।
বৃত্তি দিয়া বিপ্রবরে স্থাপিল নৃপতি।।
সেই পুণ্যফলে অবন্তীর নরপতি।
দুই কল্প ইন্দ্র সহ করিল বসতি।।
সে কারণে অবধান কর দৈত্যেশ্বর।
ত্রিভুবনে নাহি ভূমি-দানের উপর।।
তিন পদ ভূমিমাত্র দান মাগি আমি।
ইহা দিয়া মোরে রাজা সন্তোষহ তুমি।।
বলি বলে, বামন হে বুঝি বল বাণী।
ত্রিপদে তোমার তৃপ্তি, তাহা নাহি মানি।।
এই দান দিতে মম চিত্তে নাহি আসে।
সংসারেতে অপযশ ঘুষিবে বিশেষে।।
অপযশ হৈতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠমধ্যে গণি।
সে কারণে অবধান কর দ্বিজমণি।।
নগর চত্বর গ্রাম যাহা ইচ্ছা মনে।
সকল মাগিয়া দান লহ মম স্থানে।।
এত শুনি হাসি পুনঃ বলেন বামন।
ইহাতে আমার কিছু নাহি প্রয়োজন।।
অঙ্গীকার করি বলি কহে অনুচরে।
ভৃঙ্গারে ভরিয়া জল আনহ সত্বরে।।
হাতে জল করি বলি দান দিতে যায়।
দেখি দৈত্যগুরু তবে চিন্তিল উপায়।।
বজ্রকীটরূপে গুরু প্রবেশে ভৃঙ্গারে।
নল রুদ্ধ করে, জল যেন না নিঃসরে।।
ভৃঙ্গার ঢালিলা জল নাহি পড়ে হাতে।
দেখি বলি দৈত্যেশ্বর পড়িল লজ্জাতে।।
এ সকল তত্ত্ব জানিলেন নারায়ণ।
বলি প্রতি কহিলেন, শুনহ রাজন।।
ভৃঙ্গারের দ্বার মুক্ত কর কুশাঘাতে।
এত শুনি হাতে কুশ লইলা ত্বরিতে।।
বজ্রসম হৈল কুশ ঈশ্বর কৃপাতে।
নির্ঘাত বাজিল ভার্গবের চক্ষুপথে।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কভু না হয় খণ্ডন।
এক চক্ষু অন্ধ তার হৈল সেইক্ষণ।।
কাতর ভার্গবমুনি গেল নিজ স্থান।
বলি দৈত্য বামনেরে দিল ভূমিদান।।
দান পেয়ে হরি তবে নিজমূর্ত্তি ধরে।
মহাভয়ঙ্কর মূর্ত্তি হৈল কলেবরে।।
দেখিতে দেখিতে অঙ্গ বাড়ে ক্রমে ক্রমে।
মুহূর্ত্তেকে তনু গিয়ে ঠেকিলেক ব্যোমে।।
ত্রিভুবন যুড়ি তনু হইল বিস্তার।
জল স্থল সব স্থান হৈল একাকার।।
পৃথিবী সহিত হরি সকল নগর।
এক পায়ে ব্যাপিলেন দেব দামোদর।।
সপ্ত স্বর্গ ব্যাপিলেন আর এক পায়।
আর পা রাখিতে স্থল নাহিক কোথায়।।
ডাক দিয়া বলিরাজে বলে বনমালী।
চাহিলাম তব স্থানে তিন পদ স্থলী।।
দুই জদ ভূমিমাত্র পাইলাম আমি।
আর পদ রাখি কোথা, স্থান দেহ তুমি।।
এত শুনি বলে বিরোচনের নন্দন।
অঙ্গীকার পূর্ণ মম কর নারায়ণ।।
আমার মস্তকে পদ দেহ জগৎপতি।
নরক হইতে মোরে কর অব্যাহতি।।
এত শুনি ধন্যবাদ দিয়া নারায়ণ।
বলির মস্তকোপরি দিলেন চরণ।।
নানাবিধ মতে বলি পূজিল চরণ।
গরুড়েরে আজ্ঞা করিলেন নারায়ণ।।
বলিরে পাতালে লয়ে বান্ধে সেইক্ষণ।
সাধু সাধু ধন্যবাদ করে দেবগণ।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ আসিয়া হরিষে।
হরিকে করিল স্তুতি অশেষ বিশেষে।।
ইন্দ্রেরে ইন্দ্রত্ব দিয়া দেব ভগবান।
অন্তর্হিত হয়ে যান আপনার স্থান।।
যাহা জিজ্ঞাসিলে রাজা কহিনু তোমারে।
সেইরূপ দুর্য্যোধন অহঙ্কার করে।।
ধনমদে মত্ত হয়ে নাহি মানে কারে।
না শুনে কাহার বাক্য, মত্ত অহঙ্কারে।।
অচিরেতে যুদ্ধে ক্ষয় হবে কুরুকূল।
কুরুকুল প্রতি দেখি বিধি প্রতিকূল।।
দুর্য্যোধন পাপে বংশ হইবেক ক্ষয়।
জানিহ নিশ্চয় এই শুন মহাশয়।।
ইহা বলি উঠিয়া সে ধৌম্য তপোধন।
পাণ্ডব সভাতে উত্তরিল সেইক্ষণ।।
ধৌম্যে দেখি আস্তে ব্যস্তে পঞ্চ সহোদর।
বসিতে দিলেন দিব্য সিংহাসনোপর।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পূজি জিজ্ঞাসেন বাণী।
একে একে সব কথা কহে ধৌম্যমুনি।।
তোমার কারণে রাজা সকলে বুঝাল।
কারো বাক্য দুর্য্যোধন কর্ণে না শুনিল।।
অহঙ্কার করি আরো বলে কুবচন।
বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।
যত শক্তি আছে তার কহিবে পাণ্ডবে।
লইবারে ধন রাজ্য জিনিয়া কৌরবে।।
এত শুনি পঞ্চ ভাই কহেন বচন।
কুলক্ষয় হেতু বিধি করিল সৃজন।।
মহাযুদ্ধে হইবেক, কুলের সংহার।
শুনিয়া চিন্তিত অতি ধর্ম্মের কুমার।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, তরে ভবতরি।।
ব্যাসের বচন ইথে নাহিক সংশয়।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।