০৫. দ্রোণের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
যেইমতে যুদ্ধ করে সব রাজগণ।।
দ্রোণ ধনঞ্জয়ে যুদ্ধ কি দিব তুলনা।
রাম রাবণের যুদ্ধ নাহি হয় সীমা।।
দ্রোণ গুরু দেখি তবে বীর ধনঞ্জয়।
করপুটে প্রণমেন করিয়া বিনয়।।
অর্জ্জুন বলেন গুরু কহ বিবরণ।
যুধিষ্ঠিরে ধরিতে বলেন দুর্য্যোধন।।
এমত প্রতিজ্ঞা কেন করিলা আপনে।
আমি জীতে ধরিতে না পারিবে রাজনে।।

এত শুনি দ্রোণাচার্য্য সহাস্য বদন।
অর্জ্জুনের প্রতি তবে বলিল বচন।।
যুধিষ্ঠিরে আজি আমি ধরিব সমরে।
দেখি তুমি রক্ষা কর কেমন প্রকারে।।
দুর্য্যোধন রাজা হেতু করি মহারণ।
প্রতিজ্ঞা পালন আমি করিব সাধন।।
এত শুনি অর্জ্জুন বলেন আরবার।
যুধিষ্ঠিরে ধরিবেক এত সাধ্য কার।।
এত শুনি হন গুরু ক্রোধে হুতাশন।
অর্জ্জুন উপরে করে বাণ বরিষণ।।
শিষ্য স্নেহ উপরোধ আজি নাহি মনে।
সম্বর, সংশয় আজি যুচাইব রণে।।
এত বলি এড়ে বাণ অগ্নি অবতার।
হাসিয়া সম্বরে তাহা ইন্দ্রের কুমার।।
দশ বাণ এড়ে গুরু পূরিয়া সন্ধান।
অর্দ্ধপথে অর্জ্জুন করেন খান খান।।
বাণ ব্যর্থ দেখি গুরু ক্রুদ্ধ অতিশয়।
গগন ছাইল তবে করি অস্ত্রময়।।
তবে ধনঞ্জয় বীর পূরিয়া সন্ধান।
নিমিষেতে নিবারেন আচার্য্যের বাণ।।
অর্জ্জুন এড়েন বাণ যেন যমদণ্ড।
ধনু কাটি দ্রোণের করেন খণ্ড খণ্ড।।
আর ধনু লয়ে দ্রোণ পূরিয়া সন্ধান।
অর্জ্জুন উপরে মারে হুতাশন বাণ।।
হইল সংগ্রাম স্থলে সব অগ্নিময়।
পলায় সকল সৈন্য রণে নাহি রয়।।
এড়িয়া বরুণ বাণ ইন্দ্রের নন্দন।
নিমিষেকে নিবারেণ ঘোর হুতাশন।।
জলেতে হইল পূর্ণ সংগ্রামের স্থল।
শোষকাস্ত্রে নিবারিল দ্রোণ মহাবল।।
বায়ু অস্ত্রে সেনাগণে করিল অস্থির।
আকাশাস্ত্রে নিবারেন পার্থ মহাবীর।।
তবে অতি ক্রোধাবিষ্ট বীর ধনঞ্জয়।
চারি বাণে কাটিলেন তাঁর চারি হয়।।
চারি বাণে ধ্বজ কাটি করিলেন খণ্ড।
দুই বাণে কাটিলেন সারথির মুণ্ড।।
আর দশ বাণ তাঁর তারা হেন ছুটে।
আচার্য্যের বুকে অর্জ্জুনের বাণ ফুটে।।
বাণাঘাতে দ্রোণাচার্য্য হইল বিকল।
হাহাকার শব্দ করে যত কুরুবল।।
আর রথ আনি তবে দ্রোণেরে লইল।
রথ লয়ে সারথি সত্বর পলাইল।।
দ্রোণ ভঙ্গ দেখি তবে পার্থ মহাবীর।
বাণবৃষ্টি করি সৈন্য করেন অস্থির।।

ভীম দুর্য্যোধন দোঁহে হইল সমর।
সব যোদ্ধাগণ দেখে হইয়া অন্তর।।
গদাযুদ্ধ করে দোঁহে, দোঁহে গদাধর।
হুহুঙ্কার শব্দ ছাড়ে মহাভয়ঙ্কর।।
বায়ুর সমান গদা ফিরায় মস্তকে।
মহাক্রোধে দুইজন প্রহারে দোঁহাকে।।
দোঁহার প্রহার কারো নাহি লাগে গায়।
কেবল হইল যুদ্ধ গদায় গদায়।।
রাশি রাশি পড়ে খসি তাহাতে অনল।
চমকিয়া উঠে কুরু পাণ্ডবের দল।।
পর্ব্বত পড়িল যেন পর্ব্বত উপর।
দুইজনে দেখাযায় দুই মহীধর।।
জর্জ্জর হইল দোঁহে খাইয়া প্রহার।
নিস্তেজ হইল ধৃতরাষ্ট্রের কুমার।।
যুদ্ধ ত্যজি দুর্য্যোধন পলাইয়া যায়।
বৃকোদর বীর তার পাছে পাছে ধায়।।
দেখি তবে ধাইল যতেক যোদ্ধাগণ।
ভীমের উপরে করে বাণ বরিষণ।।
গদা লয়ে বৃকোদর বায়ুবেগে ধায়।
রথ গজ চূর্ণ করে সম্মূখে যে পায়।।
তবে দুর্য্যোধন বীর হইয়া কাতর।
যুঝিবারে দিল দশ সহস্র কুঞ্জর।।
হস্তীগণে লইয়া মাহুত সেনাপতি।
ভীমের উপরে সে আইল শীঘ্রগতি।।
কুঞ্জর দেখিয়া বীর হরিষ অন্তর।
রথ এড়ি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।।
ছাগলের পাল দেখি ব্যাঘ্র যেন ধায়।
শত শত হস্তী বীর মারে এক ঘায়।।
প্রহারে প্রহারে গদা ‍আধা হয় খণ্ড।
তাহা ফেলাইয়া বীর ধরে করি শুণ্ড।।
অন্তরীক্ষে ঘুরাইয়া ফেলায় কুঞ্জরে।
স্থির বায়ু মধে রহে গগন উপরে।।
ভগ্ন গদা ফেলাইল শূন্য হৈল কর।
শূন্য করে যুদ্ধ করে বীর বৃকোদর।।
হ্স্তীর উপরে হস্তী মারে ফেলাইয়া।
হস্তী হস্তী চাপনে পড়িল চূর্ণ হৈয়া।।
শূন্যহস্তে ভীমবীর যুঝে রণমাঝে।
হেন বীর নাহি দেখি, অস্ত্র ধরি যুঝে।।
মহাক্রোধে বৃকোদর হৈল ভয়ঙ্কর।
অবিলম্বে মারে দশ সহস্র কুঞ্জর।।
রণমধ্যে বৃকোদর নিরস্ত হইল।
দেখিয়া সূর্য্যের পুত্র অগ্রেতে ধাইল।।
নানা অস্ত্র প্রহারয়ে ভীমের উপর।
কর্ণেরে দেখিয়া ধায় বীর বৃকোদর।।
মূষ্টাঘাতে মারিল রথের চারি হয়।
এক চড়ে সারথিরে দিল যমালয়।।
মহাক্রোধে লাথি মারে রথের উপর।
চূর্ণ হয়ে রথ পড়ে সংগ্রাম ভিতর।।
রথ চূর্ণ দেখি পলাইল কর্ণ বীর।
ভীমের সম্মূখে আর কেহ নহে স্থির।।
শূন্যহস্ত বৃকোদর সংগ্রাম ভিতর।
রথ তুমি মারে আর রথের উপর।।
যেই দিকে বৃকোদর ক্রোধদৃষ্টে ধায়।
হয় হস্তী রথ রথী সকল পলায়।।
ভারত যুদ্ধের কথা কে বর্ণিতে পারে।
অদ্ভূত দেখিয়া দেবগণ কাঁপে ডরে।।
হেনকালে অস্ত গেল দেব দিবাকর।
কৌরব পাণ্ডব গেল আপনার ঘর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুন পুণ্যবান।।