০৪. সংসারে জন্ম-মৃত্যু বিষয়ে নরক-রাজার উপাখ্যান

তবে জন্মেজয় কহে, শুন মুনিবর।
তদন্তরে কি হইল কহ অতঃপর।।
মুনি বলে, শুন তবে রাজা জন্মেজয়।
তদন্তরে যে হইল শুনহ নিশ্চয়।।
সংসার প্রসঙ্গ এই বনে যে আছয়।
কহিব অপূর্ব্ব কথা শুন মহাশয়।।
ব্রাহ্মণে কহেন কথা নরকেতে শুনে।
হইবে নরকক্ষয় বেদের বচনে।।
দেহ ধরি জন্ম হয় সংসার ভিতরে।
জরা মৃত্যু আদি লোক সবারে সংহারে।।
সাগর পর্য্যন্ত আছে যত যত জন।
বিধির নির্ণয় তার অবশ্য মরণ।।
প্রথম বয়সে কেহ মরে যুবাকালে।
উত্তম কালেতে কারে মৃত্যুতে সংহারে।।
আসন ভূষণ দেখ উত্তম ভোজন।
রূপবান কুলবান অতি মরোরম।।
সম্পত্তি বিপত্তি সব দেহ সঙ্গে যায়।
কালে সব সংহারিবে কহিনু নিশ্চয়।।
বেশবন্ত মরয়ে, মরয়ে ছদ্মলোক।
বলবন্ত মরয়ে দুর্জ্জনে দিয়া শোক।।
বৈদ্যেতে চিকিৎসা করে সে বা মরে কেনে।
নানান ঔষধি জানে, বৈদ্যশাস্ত্র জানে।।
নারী সব মরয়ে, মরয়ে নপুংসক।
মহা মহা গজ মরে, মরয়ে মশক।।
যোগী সিদ্ধ মরয়ে, মরয়ে বিদ্যাধর।
সিদ্ধ সে মরয়ে জ্বরে শুদ্ধ কলেবর।।
চন্দ্র সূর্য্য ধ্বংস হবে কিরণ যাহার।
আপনি মরিবে ধাতা ব্রহ্মাণ্ড-ঈশ্বর।।
রূপবন্ত আরোগ্য যে সৌভাগ্য সম্পদ।
মরিবে সকল লোকে সম্পদ বিপদ।।
বাঞ্ছয়ে অনেক পুত্র কেনে কার আশ।
বহুপুত্রবন্ত হই করে অভিলাষ।।
ভবিতব্য যেই থাকে ভুঞ্জিবে অবশ্য।
তোমাকে কহিনু এই সংসার রহস্য।।
যেমত যাহার মন তেন তার মতি।
যেমত করিবে কর্ম্ম হবে সেই গতি।।
জন্মিলে মরণ আছে শুনহ রাজন।
পূর্ব্বেতে করিলে যাহা পাইবে এখন।।
যেই জন পূর্ব্বজন্মে পরহিংসা করে।
রহিতে না পারে সেই জন্মমাত্র মরে।।
যন্ত্রণা-কারণ তার হয় গর্ভবাস।
ভূমিষ্ঠ হইলে মাত্র তাহার বিনাশ।।
যত জন্মে পুনঃ পুনঃ ততবার মরে।
নানা দুঃখ পায় সেই হেনমত করে।।
পুণ্যবন্ত লোক যত জন্ময়ে সংসারে।
নানা যজ্ঞ নানা দান সেইজন করে।।
ভারতে জন্মিয়া সেই করে নানা সুখ।
অল্পকালে দেহ ছাড়ে শুনহ কৌতুক।।
বিকা জ্যেষ্ঠ কিবা শ্রেষ্ঠ মরে সর্ব্বজন।
কোনজন চিরজীবী নহে অনুক্ষণ।।
কেহ শাস্ত্র দৃষ্টি করি করয়ে বিচার।
এবিধ কৌতুক দেখ সংসার মাঝার।।
সংসারেতে পুণ্যবন্ত হয় যেই জন।
তার মৃত্যু নষ্ট নয় শুনহ কারণ।।
সেই জন জন্মিয়া কখন নাহি মরে।
কখন সংসারে থাকে কভু স্বর্গপুরে।।
যথা ইচ্ছা তথা থাকে সাধু যেইজন।
জানাইল সাধুজন এই সে কারণ।।
পৃথিবীতে সেই নাহি থাকে বহুদিন।
অল্পকালে মরে সেই না হয় প্রবীণ।।
যার যেইমত ইচ্ছা সেইমত করে।
বলিল যে সাধুজন মরিয়া না মরে।।
স্বর্গে গেলে সাধুজন রহে সেই স্থান।
পৃথিবীতে আসি করে দান যজ্ঞ ধ্যান।।
তপ জপ হয় সদা দান যজ্ঞ হয়।
সেই সে জানিহ সাধু কহিনু নিশ্চয়।।
পাপিজন-তত্ত্ব কহি শুনহ বচন।
তার বুদ্ধি ভাল নাহি হয় কদাচন।।
নষ্টযুক্তি বিনা তার সুষ্ঠুবুদ্ধি নহে।
ধর্ম্মকার্য্য তার গায়ে অগ্নিসম দহে।।
সুজেনের নিন্দা করে ধর্ম্মান্বিত দেখি।
না করে গুরুকে মান্য এই সে নারকী।।
অর্থ উপার্জ্জন করে পেয়ে বহু দুখ।
সেই সে জানিবে পাপী ধর্ম্মেতে বিমুখ।।
মরিলে হারায় সেই আপনার দেহ।
পৃথিবীতে নানা জন্ম হয় আসি সেহ।।
স্থাবর জঙ্গম আদি যত বৃক্ষ আছে।
বিশ লক্ষ বর্ষ সেই জন্ম হয় গাছে।।
তদন্তরে ফিরে সেই জলের ভিতর।
নবলক্ষ বর্ষ সেই হয় জলচর।।
তদন্তরে পক্ষী দশ লক্ষেক বৎসরে।
পক্ষীযোনি হয় সেই পক্ষীর উদরে।।
তারপর একাদশ লক্ষের ভ্রমণ।
নানামত ক্রিমি হৈয়া জন্মে সেইজন।।
এইমত ভ্রমে সেই মাটীর ভিতরে।
তদন্তরে জন্ম হয় পশুর উদরে।।
পৃথিবীর মধ্যে দেখ যত পশু হয়।
ত্রিশ লক্ষ বর্ষ সেই পশুযোনি পায়।।
তার পরে জন্ম হয় মনুষ্যের ঘরে।
চারি লক্ষ জন্ম জন্মে মনুষ্য-উদরে।।
যত যত জাতি আছে ক্রমে জন্ম হয়।
নিজ কর্ম্মার্জ্জিত সেইমত ফল পায়।।
সেই জন্ম পেয়ে যদি ভাল কর্ম্ম করে।
তবে সেই পাপে মুক্ত হয় পুনর্ব্বারে।।
ধর্ম্ম নাহি চিন্তি যেই পাপ করে ঘরে।
তাহার নিস্তার নাই কহিনু তোমারে।।
কহিল চৌরাশী লক্ষ যোনির ভ্রমণ।
এই তত্ত্ব জানে যেই সাধু সেই জন।।
তেনমত সুখ-দুঃখ জানিহ রাজন।
ধর্ম্মপথ-বিজ্ঞ যেই সাধু সেই জন।।
ঔষধি না মানে যেই নিন্দয়ে শাস্ত্রেতে।
আপনাকে স্বয়ং বলি জানে সর্ব্বমতে।।
দুইখানি কাষ্ঠ যেন ভাসাইল জলে।
তেনমত জন্ম হয় এই মহীতলে।।
সকল সংসার মিথ্যা শুন নৃপবর।
অনাথের নাথ কৃষ্ণ চিন্ত গদাধর।।
নারীগণ পতিসেবা করে অনুক্ষণ।
পতি হল হৈলে সবে করয়ে রোদন।।
কাল সংহারিবে সর্ব্ব প্রাণী নাহি দেখে।
কোথা হৈতে কোথা যায় কেহ নাহি লেখে।।
কার পুত্র কার ভ্রাতা কেবা কার পতি।
কেবা কার ভাই হয় কেবা কার মিতি।।
পথের সংযোগ যেন একত্তর হয়।
একযোগে হৈয়া সবে পথে যেন রয়।।
তার পরে যায় যার যথা প্রয়োজন।
আপন আপন কার্য্যে করয়ে গমন।।
সেইমত যায় সবে কেবা কারে রাখে।
বিধির ঘটন যেন একত্তর থাকে।।
সেমত তো মরে রাজা যত বন্ধুজন।
নিজ নিজ স্থানে সবে করিল গমন।।
আপনার কর্ম্ম-ফলে সব জীব ফিরে।
অধর্ম্ম হইলে তোরে ধর্ম্মেতে সংহারে।।
ধর্ম্ম বড় কেহ নহে শুনহ রাজন।
ধর্ম্মবন্ত লোকের কখন নহে মরণ।।
পুরাতন ছাড়িয়া নূতন বস্ত্র পরে।
সেইমত সাধুজন মরিয়া না মরে।।
বাদিয়ার বাজি যেন সংসারের হাট।
আপনি বসিয়া হরি দেখে সব নাট।।
শিশুগণ যেমত ধূলায় খেলে ঘর।
ঘর বাড়ী করি যেন খেলে নিরন্তর।।
সর্ব্ব শিশুগণ যেন একত্র হইয়া।
ধূলি ঘর করি যেন ফিরে বেড়াইয়া।।
সেই খেলা খেলে যেন সর্ব্বজীবগণ।
কেহ নাহি জানে পাছে হইবে মরণ।।
মৃত্যুরূপ আছে এক তাহা নাহি জানে।
শিশুরূপে সর্ব্বজনে ফিরে সর্ব্বস্থানে।।
ধন জন যত দেখ সব সাধারণ।
হরির চরণ বিনে সব অকারণ।।
কপালে আছয়ে ধন দেখিতে না পায়।
যাহা লিখে দেন বিধি সেইমত হয়।।
কপালে লিখয়ে বিধি বসিয়া ত ঘরে।
তাহার অক্ষর কাটে কে আছে সংসারে।।
কপালে সংহার করে বিধি যাহা লিখে।
কোথা থাকে কোথা যায় কেহ নাহি দেখে।।
কুম্ভকার চক্র যেন পাক দিয়া ফিরে।
তেনমত জন্ম-মৃত্যু পাক দিয়া ঘুরে।।
ধর্ম্ম কর্ম্ম নিরন্তর করিবে সদাই।
না ছাড়িবে ধর্ম্মপথ মহাক্লেশ পাই।।
হেন তত্ত্বকথা যদি কহিল ব্রাহ্মণে।
শুনিয়া নরকরাজা শান্ত ততক্ষণে।।