০১. পঞ্চ-পাণ্ডবের অজ্ঞাত বাসের মন্ত্রণা

জন্মেজয় বলে, কহ শুনি তপোধন।
দুর্য্যোধন ভয়েপূর্ব্ব পিতামহগণ।।
বিরাট নগর মধ্যে রহিল অজ্ঞাতে।
বৎসরেক যাপন করিল কোন্ মতে।।
কহেন বৈশম্পায়ন, শুন মহারাজ।
দ্বাদশ বৎসর অন্তে অরণ্যের মাঝ।।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডবেরা পাঞ্চালী সহিত।
বহু দ্বিজগণ সঙ্গে ধৌম্য পুরোহিত।।
বলেন সবার প্রতি ধর্ম্মের তনয়।
সবে ‍জান, পূর্ব্বে যাহা হইল নির্ণয়।।
দ্বাদশ বৎসর অন্তে অজ্ঞাত বৎসর।
অজ্ঞাতে রহিব কৃষ্ণা পঞ্চ সহোদর।।
বরষ মধ্যেতে যদি প্রকাশিত হব।
পুনশ্চ দ্বাদশ বর্ষ বনবাসে যাব।।
বিচারিয়া কহ ভাই ইহার বিধান।
অজ্ঞাত থাকিব এক বর্ষ কোন স্থান।।
সেই ‍দিন হবে কালি রজনী প্রভাতে।
বিচারিয়া যুক্তি কহ আমার সাক্ষাতে।।
এত শুনি কহে ভীম রাজারে চাহিয়া।
তোমার পার্থবীর উপেক্ষা করিয়া।।
মোর ‍আগে কে যুঝিবে পৃথিবীর মাঝ।
হেন জন চক্ষে নাহি দেখি ধর্ম্মরাজ।।
মৃত্যু সম বনে দুঃখ দ্বাদশ বৎসর।
তোমার নিয়মে বঞ্চিলাম নৃপবর।।
পাণ্ডবের পতি তুমি, পাণ্ডবের গতি।
তুমি যেই পথে যাবে, সবে সেই পথি।।
কহিলেন ধর্ম্মরাজ দ্বিজগণ প্রতি।
সবে জান আমাকে যা কৈল কুরুপতি।।
অজ্ঞাত থাকিব এক বরষ লুকায়ে।
ততদিন যথাস্থানে সবে রহ গিয়ে।।
বিধাতা করিল মোর এমত কুদিন।
মৃত্যু সম নির্ব্বাহিব ব্রাহ্মণ বিহীন।।
মেলানি করিয়া দ্বিজগণে নৃপবর।
দু-নয়নে বহে অশ্রুধারা ঝর ঝর।।
ভ্রাতৃগণ ধৌম্য আদি যত দ্বিজ আর।
রাজারে বুঝান সবে বিবিধ প্রকার।।
বিপদকালেতে রাজা অধৈর্য্য না হবে।
ধীর হৈলে শত্রুগণে বিজয় করিবে।।
বড় বড় রাজগণ বিপদে পড়িয়া।
পুনরপি রাজ্য লভে মন্ত্রণা করিয়া।।
অসুরের ভয়ে ইন্দ্র রহেন লুকায়ে।
বলিরে ছলিলা হরি বামন হইয়ে।।
উপায় করিয়া ইন্দ্র অসুরে মারিল।
কাষ্ঠমধ্যে থাকি অগ্নি খাণ্ডব দহিল।।
তুমিহ এখন রাজা বুঝ কালগতি।
ধৈর্য্য ধরি পুনরপি শাস বসুমতী।।
এত বলি শান্ত করি তুষিল রাজায়।
আশীর্ব্বাদ করি তবে দ্বিজগণ যায়।।
তবে ধর্ম্মরাজ সব ভ্রাতৃগণে লয়ে।
এক ক্রোশ দূরে যান সে বন ছাড়িয়ে।।
জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণ প্রতি।
কোথায় অজ্ঞাতরূপে করিবে বসতি।।
রম্যদেশ দেখি সবে রব গুপ্তবেশে।
একস্থানে ছয় জনে থাকিব বিশেষে।।
এতশুনি সবিনয়ে কহ ধনঞ্জয়।
ধর্ম্মের বরেতে রাজা নাহি কোন ভয়।।
অজ্ঞাত রহিব সবে, কে পাবে নির্ণয়।
দেশ নাম কহি রাজা, যথা মনে লয়।।
পাঞ্চাল বিদর্ভ মৎস্য বীহ্লীক ও শাল্ব।
মগধ কলিঙ্গ শূরসেন কাশী মল্ল।।
এই সব দেশ, তব যথা লয় মনে।
অজ্ঞাতে রহিব তথা ভাই পঞ্চ জনে।।
রাজা বলে, মৎস্যদেশে বিরাট নৃপতি।
সত্যশীল শান্ত ধর্ম্মশীল মহামতি।।
তথায় বঞ্চিতে মন ‍হতেছে আমার।
তোমা সবাকার চিত্তে কি হয় বিচার।।
সবারে দেখিব, সবে থাকিব গুপ্তেতে।
অন্য জন কেহ যেন না পারে লক্ষিতে।।
বৃকোদর কহে তবে চাহিয়া রাজায়।
কহ কোন্ বেশে রাজা বঞ্চিবে তথায়।।
নিন্দিত নহিবে কর্ম্ম, নহে কোন ক্লেশ।
বিচারিয়া নরপতি কহ উপদেশ।।
ইহা সম দুঃখ আর নাহিক রাজন।
রাজা হয়ে পরবশ, পরের সেবন।।
মহাপাপে দুঃখ যথা পায় পাপিগণ।
কোন্ কর্ম্ম নির্ব্বাহিবে, বল রাজন।।
রাজা বলে, কহি আমি বঞ্চিব যেমতে।
ন্যায়কর্ত্তা হব আমি বিরাট সভাতে।।
বলাইব কঙ্ক নাম, পাশায় পণ্ডিত।
ব্রহ্মচর্য্য ধর্ম্মশাস্ত্র জানি সর্ব্বনীত।।
মণিরত্ন যত আছে, জানি তার মূল্য।
যুধিষ্ঠিরের সৃহৃদ ছিনু প্রাণ তুল্য।।
কহিয়া শাস্ত্রের কথা তুষিব রাজারে।
এরূপে বঞ্চিব ভাই বিরাট-নগরে।।
ভীমে চাহি বলিলেন ধর্ম্ম-নরনাথ।
কহ ভাই কোন্ বেশে বঞ্চিবে অজ্ঞাত।।
পদ্মপুষ্প হেতু গন্ধমাদন পর্ব্বতে।
রক্ষোহীন হৈল ক্ষিতি তোমার ক্রোধেতে।।
হিড়িম্বক বক জটাসুর কির্ম্মীরাদি।
নিষ্কণ্টক কৈলে মারি সাগর অবধি।।
কিরূপে বঞ্চিবে ভাই বিরাট নগরে।
এত শুনি কহে ভীম ধর্ম্মের গোচরে।।
বল্লব নামেতে আমি হব সূপকার।
রন্ধন করিতে নাহি সমান আমার।।
পরিচয় দিয়া তেজ দেখাব রাজনে।
মল্লযুদ্ধে হারাইব যত মল্লগণে।।
বৃষ ব্যাঘ্র হিংস মেষ মহিষ কুঞ্জর।
ধরিয়া আনিয়া দিব রাজার গোচর।।
যুধিষ্ঠির গৃহে পূর্ব্বে ছিনু সূপকার।
কৌতুকে রাখেন মোরে রাজা দয়াধার।।
এত বলি পরিচয় দিব বিরাটেরে।
শুনিয়া সন্তুষ্ট চিত্ত নৃপ যুধিষ্ঠিরে।।
পার্থ প্রতি ‍চাহিয়া বলেন নরবর।
কই ভাই কিবা মতে বঞ্চিবে বৎসর।।
অগ্নিরে নিরোগ কৈলে জিনি পুরন্দর।
জিনিলে বাহুর বলে ধরা একেশ্বর।।
দেব মধ্যে ইন্দ্র যথা, দানবেতে বলি।
ত্রিভুবনে পূজ্য যথা রুদ্রেতে কপালী।।
আদিত্যেতে বিষ্ণু যথা স্থিরে মেরুবৎ।
গ্রহমধ্যে চন্দ্র যথা গজে ঐরাবত।।
ঋষিমধ্যে শুদ্ধ যথা শুকদেব মুনি।
আয়ুধেতে বজ্র যথা শব্দে কাদম্বিনী।।
তাদৃশ পাণ্ডব মধ্যে অর্জ্জুন প্রধান।
পরাক্রমে তুমি বাসুদেবের সমান।।
ত্রিভুবনে বিস্তারিত যার রূপ গুণ।
কি মতে লুকাবে ভাই কহত অর্জ্জুন।।
দুই হস্তে ধনুর্গুণ ঘর্ষণের চিহ্ন।
কিমতে লুকাবে ভাই সব্যসাচী চিহ্ন।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব আছয়ে উপায়।
নপুংসক-বেশে আমি আচ্ছাদিব কায়।।
দুই হস্ত আচ্ছাদিব শঙ্খ আচ্ছাদনে।
মস্তকে ধরিব বেণী, কুণ্ডল শ্রবণে।।
রাজা জিজ্ঞাসিলে দেব এই পরিচয়।
পূর্ব্বেতে ছিলাম আমি পাণ্ডব-আলয়।।
রাজপত্নী দ্রৌপদীর ছিলাম নর্ত্তক।
নৃত্যগীতে বিজ্ঞ আমি, জাতি নপুংসক।।
শিখাইতে পারি আমি অন্তঃপুর বালা।
এই বৃত্তিজীবি জানি, নাম বৃহন্নলা।।
নকুলে ডাকিয়া জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মরায়।
কত ভাই লুকাইবে কিমত উপায়।।
দুঃখ ক্লেশ নাহি জান, অতি সুকুমার।
বালকের প্রায় তুমি পালিত আমার।।
ত্রৈলোক্য জিনিয়া রূপ পরম সুন্দর।
ভ্রাতৃগণ প্রাণ-তুল্য গুণের সাগর।।
নকুল বলিল, দেব কর অবধান।
এই পরিচয় দিব বিরাটের স্থান।।
অশ্ববৈদ্য নাহি কেহ আমার সমান।
অশ্বের চিকিৎসা জানি, গ্রন্থিক আখ্যান।।
কড়িয়ালি দিব আমি যে ঘোড়ার মুখে।
কোনকালে তার দুষ্টভাব নাহি থাকে।।
এইরূপে গুপ্ত করি আপনার কায়।
বৎসরেক মহারাজ বঞ্চিব তথায়।।
তবে জিজ্ঞাসেন রাজা সহদেব প্রতি।
বিবিধ বিচারে বিজ্ঞ, বুদ্ধে বৃহস্পতি।।
জননী কুন্তীর সদা অতি প্রিয়তর।
কি মতে বঞ্চিবে ভাই অজ্ঞাত বৎসর।।
সহদেব কহে, তবে শুন নৃপবর।
বিরাট রাজার গবী আছে বহুতর।।
গোধন রক্ষক হই, জাতি যে গোয়াল।
মৎস্যদেশে বলাইব নাম তন্তিপাল।।
দ্রৌপদীরে কহে তবে নৃপতি কাতর।
কিমতে বঞ্চিবে কৃষ্ণা অজ্ঞাত বৎসর।।
রাজকন্যা রাজত্নী দুঃখিনী আজন্ম।
নাহি জান সাধারণ স্ত্রীলোকের কর্ম্ম।।
পুষ্পমাল্য আভরণ ভার নাহি সয়।
কিরূপে অধীনা হয়ে রবে পরালয়।।
প্রাণাধিক প্রিয় তোমা দেখি অনুক্ষণে।
পর আজ্ঞা বহনেতে বঞ্চিবে কেমনে।।
কৃষ্ণা বলে, চিন্তা রাজা না করিহ মনে।
যেমতে বঞ্চিব আমি বিরাট ভবনে।।
তোমা সবাকার মনে নাহি হবে দুঃখ।
সদাই দেখিব রাজা সবাকার মুখ।।
বিরাট রাজার ‍রাণী সুদেষ্ণা নামেতে।
তার স্থানে বৎসরেক বঞ্চিব অজ্ঞাতে।।
তারে কব সৈরন্ধ্রীর বেশ কর্ম্ম জানি।
শুনিয়া অবশ্য মোরে রাখিবেন রাণী।।
এত শুনি হৃষ্ট চিত্তে ধর্ম্মের নন্দন।
অগ্নিহোত্র ধৌম্য-হস্তে করেন অর্পণ।।
আছিল যতেক দাস দাসী দ্রৌপদীর।
পাঞ্চালে যাইতে আজ্ঞা দেন যুধিষ্ঠির।।
ইন্দ্রসেন আদি করি যতেক সারথী।
রথ লয়ে সবে চলি যাহ দ্বারাবতী।।
পথে জিজ্ঞাসিলে লোক কহিবে সবারে।
না জানি কোথায় গেল পঞ্চ সহোদরে।।
কালি সবে এক স্থানে ছিলাম কাননে।
আমা সবা ছাড়ি কোথা পশিলা নির্জ্জনে।।
তবে ধৌম্য কহিলেন বহু উপদেশ।
অজ্ঞাত সময়ে হতে পারে নানা ক্লেশ।।
বহু অপমান হৈলে তাহা সম্বরিবে।
যখন যেমন হয় বুঝিয়া করিবে।।
ক্ষত্রমধ্যে অগ্নিসম তোমা পঞ্চ জনে।
সকলে তোমার শত্রু জানহ আপনে।।
গুপ্তভাবে গুপ্তবেশে থাক ভালমতে।
রাজসেবা করি সদা রবে রাজপ্রীতে।।
ক্ষুধা-তৃষ্ণা তেয়াগিবে আলস্য শয়ন।
বিশ্বাস করিবে নাহি নৃপে কদাচন।।
রাজার সম্মুখে আর পশ্চাতে না রবে।
তাঁর বামপার্শ্বে কিম্বা দক্ষিণে থাকিবে।।
কোন কার্য্য হেতু যদি রাজা আজ্ঞা করে।
আপনার প্রাণপণে করিবে সত্বরে।।
অন্তঃপুর নারীসহ না কহিবে কথা।
মিথ্যা বাক্য রাজারে না কহিবে সর্ব্বথা।।
হরষেতে মত্ত নাহি হয়ে কদাচন।
রাজা সনে না কহিবে রহস্য বচন।।
সন্নিকটে না থাকিয়া অন্তরে থাকিবে।
লাবালাভ না বিচারিয়া আদেশ পালিবে।।
ভ্রাতা বন্ধু পুত্রে নাহি নৃপতির প্রীত।
সেই সে আপন, কর্ম্ম করে মনোনীত।।
আমি কি কহিব তুমি জানহ সকলে।
কাল কাটি পুনরপি আসিও কুশলে।।
এত শুনি উঠি তবে ভাই পঞ্চ জন।
প্রদক্ষিণ করি ধৌম্যে চলেন তখন।।
কাম্যবন ছাড়ি যান যমুনার পার।
বামেতে শাল্বের দেশ, দক্ষিণে পাঞ্চাল।।
শূরসেন রাজ্যমধ্যে করিয়া প্রবেশ।
পদব্রজে বলি যান বিরাটের দেশ।।
মৎস্যদেশ ছাড়ি গেলা ধৌম্য তপোধন।
শ্রমযুক্তা হয়ে কৃষ্ণা বলেন বচন।।
চলিবার শক্তি আর নাহিক নৃপতি।
আজি নিশি এক ঠাঁই করহ বসতি।।
নিকটে না দেখি, দূরে বিরাট নগর।
কালি প্রাতে গুপ্তভাবে যাব নৃপবর।।
নৃপতি বলেন, কালি হইব অজ্ঞাত।
অনর্থ ঘটিবে, হৈলে লোকেতে বিদিত।।
পার্থে ডাকি আজ্ঞা দেন ধর্ম্মের তনয়।
দ্রৌপদীর স্কন্ধে করি লহ ধনঞ্জয়।।
আজ্ঞামাত্র ধনঞ্জয় করিলেন স্কন্ধে।
ঐরাবত-স্কন্ধে যে ইন্দ্রাণী আনন্দে।।
নগর বিরাট আছে অতি অল্প দূর।
হেনকালে বলিলেন ধর্ম্ম নৃপবর।।
সশস্ত্র নগরে যদি করিবে প্রবেশ।
দৃষ্টিমাত্রে সর্ব্বলোক চিনিবে বিশেষ।।
বাল বৃদ্ধ যুবা জানে গাণ্ডীব বিখ্যাত।
হেন স্থানে রাখ, যেন লোকে নহে জ্ঞাত।।
অর্জ্জুন বলেন, দেখ এই শমীদ্রুম।
ভয়ঙ্কর শাখা সব পরশিছে ব্যোম।।
আরোহিতে না পারিবে অন্য কোন জন।
ইহাতে ‍রাখি যে অস্ত্র যদি লয় মন।।
অর্জ্জুনের ‍বাক্যে রাজা করিয়া স্বীকার।
কহিলেন রাখ যেন না হয় প্রচার।।
তবেত গাণ্ডীব ধনু খসাইয়া গুণ।
গদা শঙ্খ আদি যত অস্ত্রপূর্ণ তূণ।।
বসনে আচ্ছাদি সব একত্র ছান্দিয়া।
রাখিলেন উচ্চতর শাখাতে বান্ধিয়া।।
শ্মশান নিকটে ছিল যত গোপগণ।
সবাকারে পুনঃ পুনঃ বলেন বচন।।
পথেতে আসিতে বৃদ্ধা জননী মরিল।
অগ্নির অভাবে বৃক্ষে স্থাপিত হইল।।
কুল ক্রমাগত মম আছে এই পথ।
কিবা অগ্নি দহি, কিবা করি এই মত।।
তবে জয় বিজয় জয়ন্ত জয়ৎসেন।
জয়দ্বল পঞ্চ নাম গুপ্তে রাখিলেন।।
পঞ্চ পাণ্ডবের এই নাম সমুদয়।
যথাক্রমে রাখিলেন ধর্ম্ম মহাশয়।।
সাধ্বী দ্রৌপদীর নাম মালিনী হইল।
ছয় জনে ছয় নাম যুধিষ্ঠির দিল।।