MRIয়মাণ – নবনীতা দেবসেন

MRIয়মাণ

মেয়ের আমার মেজাজ ভালো নেই।

কেন নেই? না সে চোদ্দোর বদলে আঠারো ঘণ্টা অফিসে থাকতে পারছে না। ওই যে কী একটা বিশ্রি রকম মাথা ঝিন ঝিন, কান রিন রিন, ঘাড় কন কন, হাত কেমন—কেমন, মুখ শিরশির, চোখে ফুলঝুরি, আর এটা ভুলে যাচ্ছি, সেটা ভুলে যাচ্ছি।

—চোখে ফুলঝুরি? ডাক্তার কী বলছে?

—ডাক্তার? হুঁ, আমার বলে মরবার সময় নেই, দেখছো না চটিতে সেপ্টিপিন? মুচির কাছে যাবার পর্যন্ত সময় হচ্ছে না—অছেদ্দায় ঠোঁট উলটে মেয়ে হেঁট হয়ে চটির সেপ্টিপিনটা ঠিক করে নেয়।

—তুই তো কালাপানির পারে পাঠানো পাথরভাঙা কয়েদিদেরও দুদুভাতু করে ছেড়ে দিলি রে? ঢের ঢের চাকরি দেখেছি ভাই এমন জিনিস তো—

—আহা, এটা কি পার্মানেন্ট অবস্থা? এখন সেকশনে লোক কম। আরও চারজন এসে গেলেই সব নরম্যাল হয়ে যাবে—

—চা—র—জন? তদ্দিনে তো তুই অক্কা পেয়ে যাবি রে?

উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। ছেঁড়া চটি পায়ে মেমসাব গম্ভীরসে লেংচে লেংচে, খুব ডিগনিফায়েড মাপামাপা পদক্ষেপে, অফিসে বেরিয়ে যান। কখন ফিরবেন কিছুই ঠিক নেই। মাঝে মাঝে ফোন করে অবশ্য মাকে মনোবল সাপ্লাই করবেন। প্রচণ্ড ঘ্যানর ঘ্যানর করে, ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, অবশেষে জবরদস্তি ধরে নিয়ে গেলুম। মন দিয়ে কমপ্লেন শুনলেন ডাক্তার। যত্ন করে আপাদমস্তক পরীক্ষা করলেন। তারপরে শুরু করলেন গল্পস্বল্প।

তুমি কী করো? ক’টা থেকে ক’টা আপিসে থাকতে হয়? উইক এনডে কী করো? শেষ কবে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে? কবে নতুন শাড়ি, পোশাক কিনেছ? বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডাটাড্ডা কতক্ষণ মারো? উইনডোশপিং—এ যাও? গানটান শুনতে যাও, কনসর্ট—টনসর্টে? তোমার হবি কী? ঘরের কাজ, রান্নাবান্না কে করে? তুমিই? কখন এসব করো?—ডাক্তারের প্রশ্নের চোটে মেয়ের মুখ তন্দুরি হচ্ছে। কিন্তু ভদ্রভাবে জবাব দিয়ে যাচ্ছে। দেখে—শুনে ডাক্তার বললেন, তিনরকম সম্ভাবনা। এক, stress at work, দুই, চোখের ভেতরে কিছু গ্রোথ পাকিয়ে থাকতে পারে, তিন, নার্ভের বান্ডিলে জট হওয়াও সম্ভব। চোখ এবং স্নায়ু আগে পরীক্ষা করে দুটোই যদি নিষ্কলঙ্ক অপাপবিদ্ধ প্রমাণিত হয়, তবে নিঃসন্দেহে কাজের চাপই এজন্যে দায়ী।

—কারণ যাই হোক, তোমার কিন্তু লাইফস্টাইল বদলাতেই হবে। ‘অল ওয়ার্ক নো প্লে’ জীবনে কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। জীবনযাত্রার প্রণালী বদল করতেই হবে। যদি চোখ বা নার্ভের জন্য এসব না হয়, তবে ওষুধে এর উপশম হবে না। বিশ্রাম চাই। এসব এ যুগের বিশেষত্ব, stress related aches pains, অতএব change your life-style, take it easy, learn to relax, take time off, সিনেমা দ্যাখো, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে যাও তাদের নেমন্তন্ন করো, গান বাজনা শুনতে যাও, উইক এন্ডে পিকনিকে যাও। Enjoy life. স্মৃতিকে ওভারলোড করলে তার কী দোষ? কাজ কমাও, রিল্যাক্স করো, স্মৃতিও ফিরে আসবে। ব্যথা বেদনা, ঝিন ঝিন করাও কমবে, অতিরিক্ত ক্লান্তির ফুলঝুরিও চোখ থেকে মুছে যাবে। একটু শরীর মনকে বিশ্রাম দাও আরাম দাও, ছুটি দাও। Give yourself some rest. —চুপচাপ, ভদ্র, সভ্য, হাসিমুখে বসে মেয়ে বড় বড় চোখ মেলে বয়স্ক ডাক্তারের উপদেশ শ্রবণ করছে। আর আমি তো টের পাচ্ছি, মনে মনে বলছে, রাবিশ। কিন্তু আমি ডাক্তারের প্রতি অতীব প্রসন্ন। এই কথাগুলোই এত দিন আমি বলছি, কানে তুলছে না। এবার যদি তোলে!

প্রথমে চোখ।

চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে গোলমাল করেনি, চোখটা খুবই খারাপ, মাঝে মাঝে যেতেই হয়। অনেক পরীক্ষা—নিরীক্ষা হলো। না, চোখের জন্যে নয়। কিন্তু স্নায়ুচিকিৎসকের কাছে যেতে তুলকালাম বাধাল।—কেন, আমি কি নিউরোটিক, যে নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে হবে?

—নিউরোটিক হতে হবে কেন? মিগ্রেনের জন্যে কি তুমি যাওনি কলকাতাতে অনুপমবাবুর কাছে? তোমার যে এত ব্যথাবেদনা, ঝিন ঝিন শির শির শির, সে সব তো নার্ভের কারণে হতেই পারে? চিকিৎসা হবে না? গেল বটে, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শটা শুনে বেঁকে বসল।

—ক্ষেপেছ তোমরা? পাঁচ—ছ হাজার টাকা? কেন আমি শুধু শুধু এম আর আই করাতে যাব? আমার কি ব্রেন টিউমর সন্দেহ করছে?

—ষাট ষাট! ও কি কথা? বলে মনে হল এটা ভুল স্টেপ। অন্য পথ চাই।

—সন্দেহ করছে কি করছে না কেমন করে জানব? এম. আর. আই. সেই জন্যেই তো করা? যদি না হয়, ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু নিশ্চিত হতে হবে তো?

মেয়ে গজ গজ করে বলল—মশা মারতে কামান দাগা! স্ক্যানিং করলেই তো হয়? সেটা অনেক কম খরচ। কিন্তু ততক্ষণে ব্যাপারটা জামাইবাবাজির মাথায় পাকাপাকি ঢুকে গেছে। সে ফিলডে নেমে পড়ল।

—স্ক্যানিং অতটা ডিটেইলড হয় না, এম. আর. আই. যত পারফেক্ট। চোখটা এলিমিনেটেড হয়েছে, এবারে নার্ভটা এলিমিনেট করা দরকার—

—হ্যাঁ হ্যাঁ, চোখমুখ, হাত—পা যা পারিস, সবকিছুই এলিমিনেট করে দে—মার সঙ্গে তুইও আর জুটিস না!

কিন্তু ততক্ষণে জুটে গেছি দুজনে। একদিকে বরের আর একদিকে মায়ের সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে বীর নারী শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারলে না। তাকে ‘আনডার প্রোটেস্ট’ ধরে নিয়ে যাওয়া হল এম. আর. আই ক্লিনিকে।

মেয়ে চুপ।

—কি রে? ভয়—ভয় করছে না তো?

—কী যে বলো না মা? মেয়ের স্বরে ধিক্কার ফুটে উঠল। ভয়? ভয়ের কোনও কারণ আছে? রাগ হচ্ছে আমার। টোটাল ওয়েস্ট কি না! বড়মেয়ের আমার জাঁদরেল বলে নাম আছে। তার দিদিমারই মতন। (মার মতই বা নয় কেন?) মেয়ে বাঁ হাত নেড়ে মায়ের বোকা বোকা কথা উড়িয়ে দিয়ে বললে—এটা তো আমার শরীরে স্পর্শই করছে না—ভয় কিসের? কাটা—ছেঁড়া নেই, নল পুরে দেওয়া নেই অনেকটা এক্সরে—র মতই, ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স….. মেয়ের বাগ্মিতা এক সেকেন্ড আটকে গেল।

—আইটা কিসের জন্যে যেন, মা?

মাকে জিজ্ঞেস করায় অবশ্য মা ধন্য। আজকাল তো মা—ই ওদের সব সময় জিজ্ঞেস করে—জ্ঞান অর্জন করেন। জীবনে আমাদের ‘রোল’ পালটে গেছে, নতুন জগতে অজস্র নতুন ইনফরমেশন—এই ইনফরমেশন এক্সপ্লাশনের যুগে আমি বেশ পিছিয়ে পড়ছি স্বীকার না করে উপায় নেই। ছোটবেলায় ওরা প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে আমাকে—এখন আমি প্রশ্নে প্রশ্নে উত্ত্যক্ত করি ওদের। এই একটা জ্ঞান দেবার চান্স পেয়েও হায়, গ্রহণ করতে পারলুম না।

—’আই’ কিসের জন্যে আমি কি জানি? ‘এম. আর’, যে ‘ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স’ সেটাও তোর মুখেই এই জানলুম। ‘আই’ বোধহয় ‘ইনভেস্টিগেশন’।

ভুল। ‘আই মানে ‘ইমেজিং’—সেটা জানা গেল ক্লিনিকে ঢুকে।

ওরা মেয়েটাকে একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে চলে গেল। দরজার ওপরে বড় বড় হরফে লেখা—‘MAGNATOM’ …. আর হরেক রকমের ছবি আঁকা। ছুরি , কাঁচি, নেলক্লিনার, ঘড়ি, গয়না। এসব বস্তু বাইরে খুলে রেখে দিয়ে যেতে হবে। ‘ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স’ নইলে সব গুবলেট হয়ে যাবে।

জামাইবাবাজি গটগটিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল যে ঘরে ডাক্তারেরা গুলতানি করছে। রাজপুত্তুর যেমন তলোয়ার নিয়ে রাজকন্যেকে রক্ষা করে, তেমনি এক অদৃশ্য তরবারি বুঝি তার চোখে চমকাচ্ছে। ওই ঘরটাতে তাঁর বউয়ের মগজের অন্দরমহলের চলচ্চিত্র দেখবেন, আর তাই নিয়ে খোসগল্প করবেন ছোকরা ডাক্তারের ঝাঁক, বরমশাই সেখানেই পাহারা দিতে গেলেন। গাড়িতে একবার বউকে ভয় দেখিয়ে বলেছিল—এবারে এক্কেবারে সব ধরে ফেলব। তোর ব্রেনটার ভেতরে যে কী কেলেংকারি কাণ্ড হয়। ‘ইলেকট্রো—ম্যাগনেটিক ওয়েভ’ স—ব আমরা দেখতে পেয়ে যাব। আর তোর উপায় নেই—বউ তখন চুপ করে ছিল। এখন ক্লিনিকে এসে দেখছি বরের মুখটাই যেন বউয়ের চেয়ে বেশি শুকনো।—কী জানি কী দেখব, এই ভয়ে কাঁটা।

অনন্তকাল পরে তো মেয়ে উদয় হলেন। কিঞ্চিৎ পরিশ্রান্ত কিঞ্চিৎ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। এটা তো মোটামুটি সরল ব্যবস্থা, স্ক্যানিংয়ের চেয়েও সোজা। শিরায় শিরায় রং ভরে দেয় না, যে বিভ্রান্ত দেখাবে। একবার আমাকে সি. টি. স্ক্যান করা হয়েছিল ‘ডাই’ ঢুকিয়ে শিরাতে। ও বাবা সে কী নেশা! চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ‘মাতাল’ হয়েছিলুম। না পারছিলুম নিজে নিজে হাঁটতে, না যুক্তিযুক্ত বাক্যালাপ করতে। চোখেও আবছা দেখছিলুম, মনেও আবছা। রং যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে—মর্মে মর্মে রং লেগেছিল বটে। কিন্তু মেয়ের তো হবার কথা ছিল না! ওর রক্তে তো রং মেশানো হয়নি? অবশ্য পিকো নিজে হেঁটেই বেরুল। বেশ স্বাভাবিক। একটু বেশিই গম্ভীর। মা বলেই বোধহয় টের পাচ্ছি, ভেতরে ভেতরে মেয়ে বিচলিত। এমনিতেই রাশভারি। দিম্মার মতন, এখন একটু ভারটা বেশি বলে মনে হচ্ছে।

উদ্বেগ তো হবারই কথা।

যতক্ষণ না রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে, শান্তি নেই। মুখে এতক্ষণ যতই উড়িয়ে দিক, ভাবনা তো হওয়াটাই স্বাভাবিক।ব্রেন বলে কথা। মূল ধরে টান।

এতক্ষণ ধরে ‘সোসাইটি’ ‘স্টারডাস্ট’ পড়েছি বলে কি আমারই উদ্বেগ চাপা পড়েছে?

—কি রে? কেমন লাগছে?

—ভালো।

—কেমন হল তোর পরীক্ষানিরীক্ষা?

—ভালো।

—কী করল ওরা তোকে নিয়ে ঘরের মধ্যে?

—কিচ্ছু করেনি।

—তা হলে এতক্ষণ কী করছিলি?

—শুয়েছিলাম।

—কোথায় শুলি আবার? খাট আছে?

—একটা টেবিলে।

—এক্স—রে টেবিলের মতন?

—অনেকটা, একটু আলাদা।

গাড়িতে উঠে বসেছি কথা বলতে বলতে। মেয়ের কথা বলার উৎসাহ খুবই কম মনে হচ্ছে, কিন্তু আমার কৌতূহল প্রচুর।

—বলেছিল কুড়ি মিনিট—লাগিয়ে দিল দেড় ঘণ্টা। ব্যাপার কী?

—অনেকবার করে করল যে।

—কেন, ভুলভাল হয়ে যাচ্ছিল নাকি বারবার?

—কি জানি?

—কিছু বলল নাকি?

—কি আবার বলবে?

—এই কী দেখল—টেখল?

—কিছু বলেনি।

—রিপোর্ট কবে দেবে?

—কাল।

এবারে বরের মুখ ফুটল।

—তোর ব্রেনে কিছু নেই।

—মানে?

—মানে ছবিতে দেখলাম তো। পুরো ফাঁকা। নো গ্রে ম্যাটার।

—আমিও তো দেখলুম একটা সরু মতন, লম্বা মতন জিনিস তো?

—সেটা তোর ব্রেন নয়। ব্রেনের কেমন চেহারা হয় জানিস না? তুই যেটা দেখেছিস সেটা তোর গলা।

—গলা?

—তোর ব্রেনটা অবশ্য গলাতেই। তুই ঠিকই দেখেছিস।

—বাজে বকিস না। মেয়ে এবার জাগ্রত হচ্ছেন।

—কী দেখলি ও ঘরে, সত্যি করে বল।

—বললাম তো? মনিটরে তোর ব্রেনটা খুঁজে পাচ্ছিল না ওরা। ক্রেনিয়মে কিছু নেই। ডান দিকেও ফাঁকা বাঁ দিকেও ফাঁকা। তাই তো অতবার করে এম. আর. আই. করল। পাঁচ হাজার টাকা পাঁচ বার উসুল হয়ে গেছে। খুঁজে বের করতে হবে তো? সত্যিই নেই, নাকি displaced হয়ে ব্রেনটা ঘাড়ে টাড়ে নেমে এসেছে,—তা সত্যি কোথাও কিচ্ছু নেই। একটা ধ্যাবড়া মতন empty space তোর ব্রেন। নো গ্রে ম্যাটার। রিম ঝিম তো করবেই।

—চুপ কর। ভাল লাগছে না।

ভালো যে লাগছে না সে তো আমিও টের পাচ্ছি। তবে জামাইয়ের ঠাট্টা ইয়ার্কি থেকে আমার মনটা হালকা হয়ে গেছে। নিশ্চয় ভয়ের কিছু নেই মগজে। সাবধানে কথা ঘোরাই।

—শরীর ভালো লাগছে না? টায়ার্ড লাগছে?

—ওই আর কি।

—কেন, ব্যাপারটা কী রকম রে? কষ্টকর? ব্যথা ট্যাথা লাগে নাকি?

—ব্যথা লাগে না তবে খুবই কষ্টকর। চাইনিজ টর্চার টাইপের।

—সে কি রে?

—ওই রকম অবস্থায় রেখে দিলে কারুর ব্রেনই নর্মালি ফাংশন করবে না মা। মোস্ট আনকমফর্টেবল। আমি আর জীবনে এম. আর. আই. করাচ্ছি না। এই শেষ।

—শেষ মানে? এই তো প্রথম। জামাই টিপ্পনি কাটে।—আনকমফার্টেবল কেন? দিব্যি তো চিৎপটাং হয়ে শুয়েছিলি দেড় ঘণ্টা। ঘুমিয়ে নিলেই পারতিস।

—ঘু—ম…? গাঁক করে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে পিকো, আমরা কেঁপে উঠি।

—ঘুমুব? কী ভীষণ শব্দ হয় ওর ভেতরে, জানিস? ভয়ংকর সব আওয়াজ হয় কানের মধ্যে খুব জোরে জোরে দারুণ যন্ত্রণাদায়ক, অতি আনপ্লেজেন্ট অভিজ্ঞতা, খুবই স্ট্রেসফুল—আমি শুধু ভাবছিলুম অন্য কেউ হলে কী হত? কোনও বয়স্ক হার্টের রুগী—টুগি হলে বোধহয় মরেই যেত। টেরিফায়িং এক্সপিরিয়েন্স, আই টেল য়ু।

আমার বীরাঙ্গনা কন্যা হঠাৎ টেরিফায়িং বলবে একটা মেডিক্যাল—চেক—আপ—কে? নিজেই বলেছিল কাটা নেই ছেঁড়া নেই স্পর্শ পর্যন্ত করবে না। সবটাই তো যন্ত্র করছে। ছবি তুলছে মগজের কারিকুরির। আর কিছু নিরীহ মনুষ্য পাশের ঘরে কাচের জানলার ওপাশে বসে বসে মনিটরের পর্দায় সেই সব ছবি দেখতে দেখতে গভীর বৈজ্ঞানিক আলোচনা করছে, আর এ বোতাম সে বোতাম টিপছে। এতে ভয় পাবার আছেটা কী? টেরিফায়িং কেন বলল? ঠিক করে সবটা জানা দরকার।

বাড়ি ফিরে ভালো করে এক কাপ চা নিয়ে গুছিয়ে বসলুম। —এবার আমাকে সব খুলে বল দিকিনি, কী কী ঘটল ওই ঘরে? যন্ত্রটা কেমন ধারা? কেন টেরিফায়িং? কিসের ভয়?

চায়ে চুমুক দিয়েই মেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক। সহজ গলায় বলল—ভয় কি একটা? এক রকমের ভয়? ভয় নানা রকমের—একটার পর একটা, নতুন নতুন ভীতিপ্রদ, চমকদার সিচুয়েশন—সে ঠিক বর্ণনা করা যায় না। অনুভব করবার জিনিস।

—ও বাবা, শুনে তো মনে হচ্ছে তুই ডিজনিল্যান্ডের টানেল অফ হররসে ঢুকেছিলি। অন্ধকার সরু টানেলের মধ্যে জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছিস নৌকোতে চড়ে, হঠাৎ কোথাও হাঁ করে কুমীর মাথা তুলছে, কোথাও হালুম করে বন থেকে বাঘ লাফ দিচ্ছে, কোথাও কঙ্কালের নাচ হচ্ছে, মৃতদেহ খল খল করে হাসছে।

—ঠিক! ঠিক! অবিকল তাই মা! ইট ইজ ইন ফ্যাক্ট আ টানেল। আমাকে একটা টানেলের মধ্যেই তো শুইয়ে দিল, ভীষণ সরু টানেলটা—আর বুক—চাপা নিচু সিলিং—শুইয়ে দিয়ে আমার মুণ্ডুটাকে একটা শক্তমতন ফ্রেমের মধ্যে আটকে দিল। মুণ্ডুর আর নট—নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। ধর যদি উড়ো চুল পড়ে আমার গালে সুড়সুড়ি দেয়, আমি মাথা নাড়তে পারব না। কী ভয়াবহ অবস্থা, ভেবে দ্যাখো মা? আমার তবু তো বয়েসটা কম, বাই নেচার ভীতু নই, সাহসী, বুদ্ধিসুদ্ধিও যথেষ্ট আছে (এখানে আমার জামাই খুক খুক করে একটা হাড়—জ্বালান হাসি হাসিল), হার্ট ঠিক, প্রেসার ঠিক, হাঁপানি নেই, ক্লসট্রোফোবিয়া নেই, মোটামুটি ইনফর্মড, র‍্যাশনাল লোক—আর মোটাও নই। নর্মাল চেহারা—স্বাস্থ্য নর্মাল শিক্ষা, নর্মাল স্বভাবচরিত্র—আমারই যদি এই অবস্থা হয় তা হলে অন্যদের কী হবে ভাবো? ধর যদি কেউ মোটা হয় তার তো ভুঁড়ি আটকে যাবে সিলিংয়ে, আর হাতটা ঘষটে যাবে দুধারের দেয়ালে, কারুর যদি ক্লসট্রোফোবিয়া থাকে, তার কথা ছেড়েই দিচ্ছি—হাঁপানি যার নেই তারও হাঁপ ধরবে, হার্ট, প্রেসার সব গোলমেলে হয়ে যাবে—হয়তো অ্যাংজাইটি অ্যাটাক হয়ে মরেই যাবে! কী জানি কেন, সম্ভবত ওই মুণ্ডুটাকে চেপে ধরে গারদবন্দী করে রাখার জন্যেই—দারুণ ইনসিকিয়োর আর হেলপলেস লাগে। বুক ধুকপুক করা শুরু হয়ে যায়। মানে, ভয় পেলে যে রকম হয়, তেমনি আর কি। জানি অকারণ, কিন্তু নার্ভের অটোম্যাটিক রেসপন্স তো যুক্তিতর্কের কারণ মেনে হয় না?

—শরীর বিপদের সংকেত জানায় নিশ্চয়ই তাই ওরকম বুক ধুকপুকুনি—

—আমারই যদি এরকম স্ট্রেন হয়, সব জেনে, সব বুঝে, তা হলে ছোটদের কিংবা বুড়োদের কিংবা সিরিয়াস রুগীদের কিংবা অজ্ঞ মানুষদের পাড়াগাঁয়ের লোকেদের কী অবস্থা হবে?

—গ্রামের লোকদের নিয়ে ভাবিস না, ওদের আর এম. আর. আই. করতে হয় না, ওরা এম. আর. আইয়ের হেলপ বিনাই দিব্যি মরে যায়। জামাই উত্তর যুগিয়ে দেয়। আমি মূল আলোচনার সূত্রে ফেরত যাই।

—তোর মুণ্ডুটাকে তো ফ্রেমে আটকে দিল, তারপর? হাত—পাগুলো বেঁধে দিল নাকি?

—না। তা বাঁধেনি, কিন্তু ওই যে পাশবালিশের ওয়াড়ের মতন একটা টানেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, নড়াচড়া তো সবই বন্ধ। সব মুভমেন্টস রেস্ট্রিকটেড হয়ে গেছে, হাতদুটো ভাঁজ করে দিয়েছে কোলের ওপর আর হাতের মধ্যে একটা রবারের বল ধরিয়ে দিয়েছে লক্ষ্মণের ফলের মতন। সেটা নাকি অ্যালার্ম বেল। টিপলেই ভ্যাঁপ্পো ভ্যাঁপ্পো করে বেজে উঠবে ওদের ঘরে। কোনও কারণে ওদের ডাকতে হলে ওইটে টিপলেই হল। ওই অত সফিস্টিকেটেড ব্যাপারস্যাপারের মধ্যে এটা ঠিক যেন একটা সাইকেল রিকশার হর্ন।

—যাক, তবু ভালো। একটা যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। অতটা নিরাপত্তাহীন লাগা উচিত নয়।

—হ্যাঁ, বন্দিনী অবস্থায় জেলের ওয়ার্ডেনকে ডাকবার জন্যে কলিং বেল দিয়েছিল তোকে—জামাইয়ের মন্তব্য চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি বলি,—তুই তো শুয়ে আছিস টানেলের ভেতরে, হাতে রিকশার হর্ন। ওরা তারপরে কী করল?

—ওরা মানে? ঘরে তো কেউ নেই। সকলেই পাশের ঘরে। কাচের জানলা দিয়ে আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি। ওরা মনিটরে আমার ব্রেনটা দেখছে। সেইটেই তো আসল ভয়।

—ভয় মানে কিসের ভয়?

—স্ক্রিনে তো আমার ব্রেনের রিঅ্যাকশনগুলো সব ইলেকট্রে—ম্যাগনেটিক ওয়েভে আঁকা হয়ে যাচ্ছে, মা?

—তাতে কী হয়েছে? সেটাই তো টেস্ট করছে।

—ঈশ, এটা কেন বুঝছ না? ফর এগজাম্পল, ধরো যদি আমার ভয় করত? মানে, করতেও তো পারত? একটা স্ট্রেঞ্জ, আনফ্যামিলিয়ার সিচুয়েশনে, কনফাইন্ড অবস্থায়, বিশ্রি একটা যন্ত্রের মধ্যে পরাধীন হয়ে ভয়—টয় তো করতেই পারে মানুষের? ধরো যদি আমার ভয় করত, তবে তো ডাক্তারগুলো মনিটরের স্ক্রিনে সেই ভয়টা দেখতে পেয়ে যেত। তাই না? সবুজ আলোর কিরি কিরি খোঁচা খোঁচা লাইনে আমার ইলেকট্রনিক ফিয়ার—ওয়েভসগুলো স্পষ্ট স্পষ্ট সব ফুটে উঠছে, আর সবাই সব দেখে ফেলছে—ঈ—শ। কী লজ্জার ব্যাপার, ভাবতে পারছ?

—বাঃ, ভয় যদি করেই, সেটা তুই আটকাবি কেমন করে? সেটা তো কারুর হাতের মধ্যে নয়?

—নয়, কিন্তু একটা চেষ্টা তো অন্তত করা উচিত? যাতে ভয় না করে? ভয়টা জন্মাতেই যাতে না পারে? আমি সেই চেষ্টাটা করছিলুম।

এবার সত্যি খুব ইমপ্রেসড হই—আজকালকার ছেলেমেয়েরা কত কী জানে। আগে থেকেই ভয়ের গোড়া কেটে রাখছে। অপূর্ব। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল।

—কেমন করে চেষ্টা করলি? ভয়টা রুখতে পারলি?

—হুঁ, তা পারছিলুম বইক। একদম গোড়াতে ছাড়া। মেশিনের মধ্যে দিল তো ঢুকিয়ে, তারপর কী বীভৎসই সব আওয়াজ শুরু হল মা! পিলে চমকানো শব্দ। আমি ঠিক করে নিলুম আমি একটা শব্দেও ভয় পাবো না। শব্দগুলো যতক্ষণ অপরিচিত, রহস্যময় থাকবে, ততক্ষণই হয়তো ওই ওরে বাবা রেসপন্সটা আসবে। কিন্তু শব্দগুলোকে আমি যদি আইডেনটিফাই করতে পারি কোনও ফ্যামিলিয়র সাউন্ড হিসেবে, তা হলে আর ওই ভয়ের প্রতিক্রিয়া হবে না। পরিচিত পৃথিবীর বহু চেনা শব্দে তো আশ্চর্যের কিছু নেই, ভীতিরও নয়। এবার যত শব্দ হবে, আমি আমার কোনও একটা বহু পরিচিত আওয়াজের সঙ্গে সেটাকে মিলিয়ে নেব।

প্রথমেই ‘গাঁক’ করে বিকট জোরে একটা শব্দ হতেই ভয়ে চমকে উঠেছিলুম। তারপর এই প্ল্যানটা ঠিক করে নিলুম। মনে মনে তৈরি হয়ে গেলুম ওই রকমের শব্দ আরও অনেক হবে। ওটাই হয়ে থাকে। এটা ‘মাইক টেস্টিং’ হচ্ছে। তারপর অন্য এক রকমের শব্দ হবে। সেটা হয় তো ছন্দোময় হবে, সুরেলাও হতে পারে। ‘মাইক টেস্টিং’টা গাঁক গাঁক করে বার কয়েক হল। তৈরি থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকবারই বুক ধড়াস করে উঠছিল। তারপর এল ট্রেন। ট্রেনের মতন ছন্দে ছন্দে ঝিকঝিক ঝিক ঝিক….আমি ধরে নিলুম লম্বা একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। যাচ্ছে, যাচ্ছে, ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক…. হঠাৎ শব্দটা বদলে গেল একটা গড় গড় গড় …. শব্দ হতে লাগল। আমি ভেবে নিলুম রেলগাড়িটা ব্রিজের ওপর উঠেছে। খানিক গড় গড়—তারপরই হঠাৎ নিঃশব্দ। সব সুনসান। কোনও শব্দ নেই। একটু পরে শুরু হল। টুং টাং টুং টাং…. আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি পিংপং বল লাফাচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে শূন্যে একটা ফ্লুওরেসেন্ট শাদা বল … হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। পিংপং বল নেই শুধু অন্ধকার।

—অন্ধকার? ঘরে আলো ছিল না?

—আমি তো চোখ বুজে শুয়ে আছি। তাই অন্ধকার। চোখ খুললে তো দেখব চোখের পাতা সিলিংয়ে ঠেকছে। আর চারিদিকে গোল হয়ে ছাদ গড়িয়ে নেমে এসে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। এটা কি চোখ মেলে দেখবার বস্তু?

—তা অবশ্য নয়। হ্যাঁ—পিংপং বলের নৃত্য তো থেমে গেল। এবারে? এর পরে কী হল?

—তারপরে জেনারেটর চলল।

—সে কি? অ্যাঁ? এতবড় জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, সেসব লোডশেডিংয়ে আটকে যায়? জেনারেটরে যে টেস্টের রেজাল্ট ভুল হয়ে যাবে না তার কী গ্যারান্টি? দিল্লি বিদ্যুৎ নিগমের কিনা এই অবস্থা, খোদ রাজধানীতে? ছি ছি, পাঁচ হাজার—

—”আঃ হা, মা, সত্যি সত্যি কি জেনারেটর চলল না কি? তুমি কী হয়ে যাচ্ছ, মাগো? তোমার সঙ্গে তো কথা বলাই কঠিন। পিংপং বল কি সত্যি লাফাচ্ছিল?

—তা কেন, ওটা তোর ভিজুয়াল ইম্যাজিনেশন—

—সেটা মাথায় ঢুকল, তো জেনারেটরটা কেন ঢুকল না? জেনারেটর চলেনি, একটা নতুন ঘট ঘট ঘট ঘট শব্দ হচ্ছিল, আমি সেটাকে মনে মনে ধরে নিলুম—এটা বেশ জেনারেটর চলবার চেনা আওয়াজ। এইভাবে প্রত্যেকটা শব্দকে আমি আমার চেনা কোনও শব্দের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করে ফ্যামিলিয়ারাইজ করে নিচ্ছি আর কি! যাতে করে অপরিচয়ের ভয়টা কেটে যায়—সিম্পল! বুঝতে পারছ না?

—কেন পারব না? সত্যি সত্যি কি ঘরের মধ্যে ট্রেন ঢুকেছিল ভেবেছিলুম? তবে তোদের দিল্লিতে এমনই অতিরিক্ত লোডশেডিং হয় (আহা, তোদের তো ডঃ শঙ্কর সেন নেই) তাই ভেবেছি জেনারেটরের কথাটা বুঝি তোর গল্পের বাইরে। তা বেশ, ঘট ঘট ঘট ঘট করে জেনারেটর চলছে—

—বেশ অনেকক্ষণ চলবার পরে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বিরতি। আমি ভেবেছি কুড়ি মিনিট বোধহয় হয়ে গেছে—অমনি একটা গিরিগিরিগিরিগিরি’—

—গিরি—গিরি—গিরি—গিরি?

—হ্যাঁ অনেকটা পুরনো এ.সি. চলবার মতন শব্দ। পুরনো এ.সিগুলোয় এক রকমের শব্দ হয় না?

—এক রকম কেন? পুরনো এ.সি. থেকে তো রকম বেরকমের শব্দ হয়। মার সুরফ্রিজটা শেষ জীবনে ঢম ঢম করত, ডাক্তার পালেরটা ঘটাং ঘটাং করে, ভেতরের ফ্যানটা বোধহয়—এ বিষয়ে আমার অনেক বক্তব্য ছিল, মেয়ে থামিয়ে দেয়। — সেও হয়েছিল। টেবিল ফ্যানের ব্লেড যদি বেঁকে গিয়ে ফ্রেমটার সঙ্গে ধাক্কা খায় তা হলে একটা খটাং খটাং হয় না? গিরি—গিরির পরে ওইটে হয়েছিল। বেশ রেগুলার ইন্টারভ্যালে হচ্ছিল, কিন্তু ওটা চলবার সময়েই আর একটা আওয়াজ আরম্ভ হয়ে গেল, আর গোলমাল বাধল সেইটেই।

—গোলমাল?

—হ্যাঁ, মানে খটাং খটাং বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু চিড়—চিড়—চিড়—চিড় বন্ধ হল না। শব্দটা কেমন জানো মা, ওই যে ইলেকট্রিক ড্রিল কিম্বা ইলেকট্রিক করাত চালানোর সময়ে যে নীল স্পার্কস বেরোয়, আর তখন একটা চিড়িক চিড়িক শব্দ হয়? বুঝতে পেরেছ? ঠিক সেই রকম। আমি তো টের পেয়ে গেছি নির্ঘাৎ শর্ট সার্কিট—শর্ট সার্কিট হলেও ও রকম চিড়—চিড় শব্দ হতে দেখেছি। এ বার আগুন লেগে যাবে, আর আমি এখানে বন্ধনদশায় পুড়ে মরব, নড়তে চড়তে পারব না। আমি কি ওদের জানিয়ে দেব, যে শর্ট সার্কিট হয়েছে? প্যাঁক প্যাঁক হর্নটা বাজিয়ে দেব? ওরা আসবে। এসে জিজ্ঞেস করবে—’ইয়েস ম্যাডাম? হোয়াট ইজ ইট?’ আমি বলব—’নো রীজন টু প্যানিক, বাট দেয়ার্স আ শর্ট সার্কিট সাম হোয়্যার’—লোকটা মৃদু হাসবে। হেসে বলবে,—নট টু ওয়ারি ম্যাডাম, এভরিথিং ইজ আলরাইট।’ বলে কৃপাদৃষ্টি হানবে। কেননা ওরাই তো সব ব্যাপারটা কন্ট্রোল করছে, শর্ট সার্কিট হলে ওরাও টের পেত। অতএব সম্ভবতই শর্ট সার্কিট হয়নি। সম্ভবতই এই চিড়—চিড়ও ওদের ‘স্বাভাবিক’ আওয়াজ। ওরই মধ্যে আমার এটাও খেয়াল হল, যে যদি সত্যি সত্যিই ভয়ংকর কিছু ঘটে, ধরো আমার যদি শরীরটরির খারাপ লাগে, তখন বেল বাজালে ওরা ভাববে প্যানিক করছি, হেলেদুলে ধীরে সুস্থে আসবে। পালে বাঘ পড়বার কাহিনী রিপিটেড হবে। তার চেয়ে বাবা চুপচাপ শুয়ে থাকাই ভালো। বুকের ওপর ভাঁজ করা দুটো হাত, মাথার চারপাশ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ফ্রেম, নাকের ডগায় ছাদ ঠেকে যাচ্ছে। এই চমৎকার অবস্থায় শুয়ে শুয়ে ভালো কিছু ভাববার চেষ্টা করি বরং। চিড় চিড় শব্দটা অভ্যেস হয়ে গেছে। এতক্ষণে অফিসে থাকলে কী কী কাজ করা হয়ে যেত—ভাবছি, হঠাৎ ট্যাঁ—করে তীব্র একটা হুইসিল, পিলে চমকান শব্দ। হুইসিল দেওয়া কেটলিগুলা যেমন আওয়াজ করে—তেমনি। একবার নয়, বারবার প্রত্যেকবারই মনে করি ‘এই শেষ’—আবার—ট্যাঁ—! যেবার মনে মনে রেডি হয়েছি, ওয়েট করছি কখন ট্যাঁ হবে, আর হল না। সব নিস্তব্ধ নিশুতি। একটুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে শুরু হল ছোট্ট একটা শব্দ। মৃদু, স্পষ্ট। টুক টুক… টুক টুক… এই মনে কর মার্বেলের গুলি যদি কেউ মেঝেয় বাউন্স করে, তা হলে যেমন আওয়াজ হবে, তেমনি।

দিব্যি চলছিল, টুকটুক … বেশ সুদিং আওয়াজ, হঠাৎ কান ফাটিয়ে বিকট শব্দ ঘ্যাঁ—অ্যাঁ—চ ভীষণ জোরে ব্রেক কষবার মতন। ভাবলুম যাক বাবা মেশিনটা এবার অফ হয়ে গেল। তা নয়, তক্ষুণি আবার ঘাঁক করে হেঁচকি তুলে মেশিন শুরু হবার লক্ষণ। বিশ্রি জোরে। হয়েই বন্ধ। অনেকক্ষণ কোনও শব্দ হচ্ছে না। কানের ভেতরে আমি নিজেরই শরীরের ভাইব্রেশেনের শব্দ ন—ন—ন—ন—ন—ন শুনতে পাচ্ছি। সর্বক্ষণই আমি দেহে মনে, অর্থাৎ কানে—মনে, বীভৎস, অশ্রুতপূর্ব কোনও আওয়াজ শোনবার জন্যে প্রস্তুত, এবং শোনামাত্র সেটাকে কোনও চেনা আওয়াজে শব্দান্তরিত করে ফেলতে রেডি।—ভয়ের কিছু নেই, এটা একটা এম. আর. ই. করবার মেশিন মাত্র—আমি স্বেচ্ছায় এর মধ্যে ঢুকেছি, কেউ জবরদস্তি আমাকে বন্দী করে এখানে পুরে দেয়নি, এই যন্তরটা মধ্যযুগীয় নৃশংস শাস্তির কোনও বর্বর কলকব্জা নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের মানব হিতৈষণার দীপ্ত উদাহরণ, একটু আধটু শব্দটব্দ তো হবেই, একটাই মাত্র ইন্দ্রিয়ের ওপর চাপ দিচ্ছে, বাকি চারটেকে তো শান্তিতে রেখেছে—আর কতক্ষণই বা?

এমনি সময়ে আমার মনে একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা উদয় হল।

রোজ রোজ কাগজে পড়ছি দিল্লিতে দিনে দুপুরে সশস্ত্র ডাকাতি হচ্ছে—ব্যাংকে, বাড়িতে, দোকানে। ডাক্তারের ক্লিনিকেই বা হবে না কেন? এখানেও তো প্রচুর কাঁচা টাকার লেনদেন হচ্ছে রোজ। কত মূল্যবান যন্ত্রপাতির ছড়াছড়ি। ধর যদি এখন ডাকাতেরা এসে ও ঘরের লোকজনগুলোকে বন্দুক দেখিয়ে বন্দী করে ফেলে, দিস ইজ আ হোলড আপ বলে? আমার কী হবে তখন? কেউ তো জানতেও পারবে না এই ঘরে এই সরু টানেলের মধ্যে আমি শুয়ে রয়েছি। এইখানেই আমি আটকে থাকব, থেকেই যাব। ইনডেফিনিটলি যতক্ষণ না আমার বর ছাড়া পাচ্ছে কোনও রকমে, এবং এসে আমাকে এই যন্ত্র থেকে উদ্ধার করছে। এই ভেবে আমার ভয় ভয় করতে শুরু করেছিল, এমন সময়ে একটা হাড় হিম করা চাপা টিক—টিক—টিক—টিক শব্দ শুরু হলো। সিনেমায় দেখেছি, এই শব্দটা টাইম বোমার। শব্দটা চলতে লাগল… এই ক্লিনিকটা কাদের? আমরা কি তবে সাবোটাজের শিকার হয়েছি?

—কোনও টেররিস্ট অ্যাকটিভিটি চলছে কি এখানে? কে জানে কারা কোথায় কী রেখে গেছে—শব্দটা বাড়তে তাকে—ঠিক ঘড়ির মতন শব্দ—কিন্তু ঘড়ি নেই—মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে শব্দটা পাল্টে গেল। ঝিনি ঝিনি ঝিনি ঝিনি করে একটা মৃদু মেটালিক সাউন্ড, কাঁসার বাসনে ধাক্কা লাগলে যেমন একটা ঝঙ্কার বাতাসে লেগে থাকে, তেমনি একটা কাঁপন আমার মাথার ভেতরে বাজতে লাগল। বাজতে বাজতে … অকস্মাৎ একটা সিরিয়াস সমস্যা আমার মনে এল। রীতিমত উদ্বেগজনক—এতক্ষণ যে সব কথা মনে হচ্ছিল এটার কাছে সেসব কিছুই নয়। মনে হল, এই যে এতক্ষণ ধরে আমি আমার ব্রেনটাকে ম্যাগনেটিক ফিলডের সামনে পেতে দিয়েছি এর ফল তো পরে নিদারুণ হতে পারে।

—অ্যাঁ? কী বললি? নিদারুণ ফল হতে পারে?

এতক্ষণ চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে মেয়ের অসাধারণ শব্দকল্পদ্রুম শুনছিলুম আর মনে মনে তারিফ করছিলুম। —’কী দারুণ কল্পনাশক্তি মেয়েটার—শব্দ আর দৃশ্যকে কি চমৎকার মেলাতে পারে—আর বর্ণনার ক্ষমতাই বা কেমন তুলনাহীন।’ এবারে বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে উঠেছে।

—কী আবার নিদারুণ ফল হতে পারে রে?

—ব্রেন—ড্যামেজ। ব্রেন—ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। একটা ম্যাগনেট কাছে নিয়ে গেলে কম্পিউটর পর্যন্ত গোলমাল হয়ে যায়, ঘড়ি নষ্ট হয়ে যায়, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্তর সব ধ্বংস করে দিতে পারে ম্যাগনেট—আর ব্রেনের মত এমন একটা সূক্ষ্ম, ডেলিকেট মেকানিজম কি আর অ্যাফেকটেড হবে না? চুম্বকের টানে পড়ে ব্রেনের ভেতর কে জানে কী হচ্ছে? এক্কেবারে পার্মানেন্ট ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে ব্রেন—সেলসের।

—রি—ল্যাক্স, পিকো, তোর ব্রেনের ওই ভয়টা নেই। ও যা ড্যামেজড হবার আগেই হয়ে গেছে—বরের মুখের সান্ত্বনা বাক্য শেষ হল না, বউয়ের ড্যামেজড ব্রেন থেকে বুলেটের মত উত্তর ছিটকে এল—তা নইলে আর তোকে বিয়ে করেছি? আমি তাড়াতাড়ি অন্য কথা বলি :

—’আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কী বলছিলি তুই, ব্রেন ড্যামেজের কথাটা?

—বলছি। অন্য যে সব ডেনজার, মানে ওই চিড় চিড়, অর্থাৎ শর্ট সার্কিট, কিম্বা ডাকাতের স্টিক আপের ভাবনা, কিম্বা টিক টিক, মানে টেররিস্টদের টাইম বম্ব—এগুলো তো কেবল পসিবিলিটিজ, সম্ভাবনা মাত্র, বিভিন্ন যুক্তিযুক্ত কল্পনা।

কিন্তু ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং করাতে গিয়ে মুণ্ডুটাকে যে ম্যাগনেটিক ফিলডের সামনে ধরে দিয়েছি সেটা তো কল্পনা নয়, সম্ভাবনাও নয়, বাস্তব ঘটনা। এখন আমার মস্তিষ্ক কোষের ওপরে, ব্রেন সেলসের ওপরে, চুম্বকের এফেক্ট নিশ্চয়ই হচ্ছে, এবং তা থেকে রক্ষা পাবার কোনও উপায়ও আমার জানা নেই। এখন যদি এইজন্যে আমার মগজের যাবতীয় পজিটিভ নেগেটিভ ব্যালান্স গড়বড় হয়ে যায়,

—তোর মগজের যন্ত্রপাতি আবার কবে ঠিকঠাক ব্যালান্স ছিল?—স্বামী সন্দেশ।

—তুই থাম—তুই আর কথা বলিস না। তোর জন্যেই তো হল। মার কথায় নেচে উঠে তুইই তো এইখানে ধরে আনলি আমাকে! আগামী দশ বছরের মধ্যেই যদি আমি সিনাইল হয়ে যাই তা হলে তুমি দায়ী, বুঝেছ অপু? আমার ব্রেন সেলসের যদি প্রি—ম্যাচিওর এজিং শুরু হয়, তা হলে তো আর্লি সেনিলিটি সেট—ইন করতেই পারে? এই ম্যাগনেটিক ফিলডের কতখানি ক্ষতি করবার ক্ষমতা কেউ তা জানে?

—শুধু শুধু অত ভয় পাসনি মা। কত লোকের তো এম.আর.আই হচ্ছে, কই ব্রেন ড্যামেজের কথা শুননি?

—এত আগে শুনবে কেমন করে? ছোটবেলাতে কি তোমরা জানতে যে বারবার এক্সরে করলে রেডিয়াম এক্সপোজারে মানুষের শরীরে ক্যানসারের ভয় আছে? আস্তে আস্তে জানা যাবে, সময়কালে জানতে পারবে। ততদিন হয়তো আমি আলজাইমার, কি পার্কিনসনে ভুগছি।

—চুপ কর পিকো! ছিঃ ছিঃ, যা মুখে আসে তাই বলবি? সত্যি তোর মাথাটা বেশ বিগড়েছে দেখছি, ব্রেনটি ভালই অ্যাফেকটেড হয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে।

—কিছুই টের পাচ্ছ না তোমরা। আমিই কি সবটা বুঝিয়ে বলতে পারছি? …যখন ওই ট্রামের ঘণ্টির মতন টিং টিং টিংটা চলেইছে, চলেইছে, আর আমার মনে হচ্ছে আমি ট্রামের মধ্যে শুয়ে শুয়ে এসপ্ল্যানেড—টু—জোকা, আর জোকা— টু—এসপ্ল্যানেড, যাচ্ছি—আর—আসছি—হঠাৎ আমার দিব্য জ্ঞানের উদয় হল।

—আবার দিব্যজ্ঞান? অনেকবার তো বিভিন্ন পার্থিব—অপার্থিব জ্ঞানের উদয় হল তোর—আর জ্ঞান দিসনি পিকো, চা খা…

বরের কথা পুরো ইগনোর করে পিকো বলল—আমি বুঝলুম এতক্ষণ ধরে আমার যা যা ভয় করছিল সবই ভুল। অত ড্রামাটিক কিছুই ঘটবে না। টাইম বোমাটা ফাটেনি, জলে ডুবে গেছে, ডিটোনেটেড হয়ে গেছে, ডাকাতদের বয়ে গেছে এম. আর. আই. ক্লিনিকে আসতে, আর শর্ট সার্কিট হলেও এরা সেটা টের পাবে আমার অনেক আগেই। ব্রেন ড্যামেজের দুর্ঘটনাটা ঘটে যাচ্ছে, এবং ইররিভার্সিব্ল,—কিন্তু ওটার ফলাফল জানতে হলে বেঁচে থাকতে হবে দূর ভবিষ্যতে। সম্ভবত তার আর সুযোগ আসবে না। এই যে আমার মাথাখানাকে মোস্ট আনকম্ফর্টেবল পজিশনে চাদ্দিকে ফ্রেম দিয়ে এঁটে রেখেছে, পিলরিবক্সে আসামির মাথা পুরে দেওয়ার মতন, কিংবা গিলোটিনে,—কেবল ওখানে লোকেরা হেঁটমুণ্ডে থাকে, আমি এখানে উটমুখো হয়ে আছি। এবং সেইটেই বিপজ্জনক। এই যে আমি কাশতে পারছি না, হাঁচতে পারছি না, এটাই তো ফেটাল হতে পারে। এখন যদি আমার শ্বাসনালীতে বে—মক্কায় থুতু আটকে যায়? আমি কী করব? না পারব গিলে ফেলতে না পারব তুলে ফেলতে। হঠাৎ যদি বিষম লেগে যায়, আর বিষম লাগার সময়ে আমার যদি হাতের প্যাঁক প্যাঁকটার কথা মনে না পড়ে? তা হলে তো আমি গলায় থুতু আটকেই মরে যাব? থুতু গিলতে বিষম লেগে মরে যাওয়াটা কোনও হিরোয়িক ডেথ নয়, ট্রাজিক ডেথও নয়, গ্রোটেস্ক। লোকে বলবে, ‘আনফরচুনেট’, বলবে ‘টু ব্যাড’, মনে মনে হাসি পাবে, কিন্তু হাসবে না। সেই টোকিওতে ডিনার টেবিলে গলায় হাড় আটকে বাঙালি এয়ার মারশ্যাল প্রাণত্যাগ করেছিলেন—আর এই এম.আর.আই টেবিলে গলায় থুতু আটকে আমি প্রাণত্যাগ করব—তিনি বন্দী ছিলেন এটিকেটের ফ্রেমে, আমি বন্দী বিজ্ঞানের ফ্রেমে। থুতু গিলতে গিয়ে মরেছে—শুনলে লোকে বলবে কী? এরা কেউ দোষী হবে না। এভাবে মরে যাওয়াটা হবে, নট উইথ আ ব্যাঙ বাট আ হুইম্পার—যত এসব ভাবছি ততই গলা যাচ্ছে শুকিয়ে আর ক্রমশ মুখে থুতু জমে উঠছে—এমন অবস্থায় একজন লোক টানেলের ওদিকে হাসিহাসি মুণ্ডু বাড়িয়ে বলল—

—থ্যাংকিউ ম্যাডাম, ইটস ওভার। তারপর আমাকে বের করে নিল ট্রে সুদ্ধু টেনে। ব্যস। হয়ে গেল। বাঁচা গেল। এতক্ষণে মেয়ে হাসল। আজকের দিনের প্রথম হাসি।

—ট্রে—সুদ্ধ টেনে? ট্রে মানে?

—আহা, আমাকে তো একটা ট্রেতে শুইয়েছিল প্রথমে?

—ট্রে—তে শুইয়েছিল? কী রকম ট্রে? স্ট্রেচার বল?

—ধুৎ, স্ট্রেচার কেন হবে, ট্রে। ট্রে। প্লাস্টিকের ট্রে। লম্বা মতন। একটা মানুষের মাপে। ওটা ট্রে—ই।

আমার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মত একটা দৃশ ঝলসে উঠল। খুব পরিচিত দৃশ্য।

—লম্বা মতন ট্রেতে শুইয়ে, তোকে একটা সরু মতন টানেলের মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল?

—হ্যাঁ, টানেলটার ভেতরে আলো জ্বলছে—দেখা যাচ্ছিল—

—আবার আলোও দেখা যাচ্ছিল? বলিস কী রে? অ্যাঁ? আমি আঁতকে উঠি। —ওরে পিকো। তোকে ওরা একটা ট্রেতে শুইয়ে হাত দুটো কোলের ওপর ভাঁজ করে দিয়ে সরু বন্ধ টানেলের ভেতরে পুরে দিল? টানলের মধ্যে আলো জ্বলছিল। ওরে বাবা রে কী ভয়ংকর কাণ্ড!

এতে কার না আতঙ্কে হাত পা শিটিয়ে যাবে! শুধু ঢোকালেই তো আমি ভয়ে মরে যাব—অত শব্দ টব্দ শুনতে হবে না, কেবল প্রণালীটাই যথেষ্ট। এ যে হুবহু বিদ্যুৎচুল্লিতে বডি পুরে দেবার প্রসেস রে। ট্রেতে শুইয়ে, বুকের ওপর হাত দুটো সরু টানেলের ভেতরে ঠেলে দেওয়া… টানেলের ভেতরে আগুনের আভা… এ তো ক্রিমিনাল! এ তুলনা যার মনে আসবে, তক্ষুনি সে হার্ট ফেল করবে। আমি লাফ দিয়ে গিয়ে আমার একমাত্র বড় মেয়েটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি।

—ষাট ষাট … ওরে আমার সোনা রে, ভাগিস তুলনাটা তোর মাথায় আসেনি? এতই উর্বর কল্পনাশক্তি তোর মগজে গিজগিজ করছে, এটা মনে পড়লে মরেই যেতিস।—মেয়ের বদলে জামাই মন্তব্য করল :

—হয় তো সাবকনশাসে এটাই মনে পড়েছিল, তাই অত রকমের কনফিউজড ডেনজার সিগন্যাল দিচ্ছিল ওর ড্যামেজড ব্রেন সেলস—এইসব কারিকুরিই তো দেখছিলাম আমরা মনিটরের স্ক্রীনে—ব্রেনটা তো গড়ের মাঠ, যেটুকু গ্রে ম্যাটার আছে, তা সবটা ভয়ে বরফ হয়ে গেছে—সবুজ রঙের খোঁচা খোঁচা, কিরিকিরি লাইনে আমরা সবাই মিলে ওটাই তো দেখছিলাম, পর্দায় তোর ইলেকট্রনিক ফিয়ার ওয়েভস—র লম্ফঝম্ফ—এবার সত্যি সত্যি মেয়ে তেড়ে গেল তার বরের দিকে, বর ছুটে পালাল তার পড়ার ঘরে।

আর আমারও এতক্ষণে খেয়াল হল : ওই ঘরের দরজায় লেখা ছিল MAGNATOM—ওটা MAGNATOMB এর মতো শুনতে, এবং ‘M.R.I. মৃ’হয়।

শারদীয় দেশ, ১৯১৭

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *