৯. ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে

৯. ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে

“১৯৭২ সালের স্মৃতির ক্ষত এখনও যেন ঠিক শুকোয়নি”–বসু বললেন, “বাহাত্তরের নির্বাচনটা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের এক নির্লজ্জ প্রহসন।” প্রথমদিকে ঘোরতর আপত্তি থাকলেও জনগণের চাপে শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচন ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। পশ্চিমবঙ্গে এবার যুদ্ধ পি ডি এ (প্রোগেসিভ ডেমোক্রেটিক অ্যালায়ান্স) এবং সি. পি. আই. (এম) চালিত বামফ্রন্টের মধ্যে। নির্বাচনের দিন ধার্য হল ১১ই মার্চ। ১৯৭২ সালের ১১ই মার্চ দিনটা বসু সারাজীবন মনে রাখবেন। আগেই বুঝতে পেরেছিলেন গোলমাল হবে কিন্তু তার মাত্রাটা যে এত বেশি হবে সেটা তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল।

নির্বাচনের সপ্তাহ পাঁচেক আগে বসু জ্যোতির্ময় বসুর সঙ্গে দিল্লী গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। বসু খবর পেয়েছিলেন চৌত্রিশটি বুথে কংগ্রেস গোলমাল করবে, সেখানে জালভোটের ব্যবস্থা হয়েছে। খবরটা ইন্দিরা গান্ধীকে জানাতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না, আমি সভা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি।” “যাবেন আর কোথায়, এ তো আপনারই বাড়ি”—বসু আবহাওয়া লঘু করার জন্য বলেন। কোনও কাজ হয় না। বসু বোঝেন ইন্দিরা কোনও সাহায্য করতে রাজী নয়’। এ প্রসঙ্গে বসু বললেন “আমি নেহরুর সঙ্গে অনেকবার পার্টির তরফ থেকে নানা কাজে দেখা করেছি। নেহরুও ঐরকম হঠাৎ রেগে উঠতেন, কিন্তু তাঁর একটা যুক্তিবাদী মন ছিল, স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতাও ছিল, তাঁর তোষামোদীদের কথায় তিনি ওঠাবসা করতেন না। ইন্দিরা বাবার জুতো পায়ে গলিয়েছে ঠিকই, আর ভারতের রাজনীতিও বহু দিন ধরে খুব কাছ থেকেই দেখেছে কিন্তু তার মেজাজ অযৌক্তিকভাবে দপ্ করে জ্বলে উঠত। তার খামখেয়ালিপনা বড় বেশি ছিল আর ফলাফলের কথা না ভেবেই নিজের লোকেদের সে সমর্থন করে যেত।”

“আমি সেদিন আমার নির্বাচনী কেন্দ্র বরানগরে ঢুকতেই পারিনি, আমার কমরেডরাও কেউ পারেনি”–বসু সখেদে জানালেন, “ফলে নির্বাচনী প্রচার আমি করতেই পারিনি।” রোজই বোমা পড়ত, গুণ্ডাবাজি হত। একদিন বসু ঠিক করলেন নির্বাচনী কমিশনার মিঃ সেনবর্মার সঙ্গে দেখা করবেন। বেশ কয়েক মাস ধরে তাঁকে অনুরোধ করার পর তিনি উপদ্রুত এলাকাগুলি পরিদর্শন করতে গেলেন। বেলেঘাটা, ২৪পরগণার কয়েকটা জায়গায় তিনি ঘুরে এলেন। বেলেঘাটায় মিঞাবাগান এলাকার যাবার পথেই এক বিপদের সম্মুখীন হলেন মিঃ সেনবর্মা। একদল গুণ্ডা পাইপগান, বোমা, পিস্তল নিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরল। তিনি নিরাপত্তার কারণে আর এগোতে সাহস করলেন না। ফিরে গিয়ে অবশ্য সেজন্য কোনও ব্যবস্থাও নিলেন না। পয়লা মার্চ বসু দেখা করলেন রাজ্যপালের সঙ্গে—উদ্দেশ্য যাতে ভোটার এবং পোলিং এজেন্টরা ভোটের দিন শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারে তাঁকে সেই অনুরোধ করা। রাজ্যপালের আশ্বাসবাণী বসুর রীতিমত ফাঁকা মনে হয়েছিল। তখন বসু গেলেন তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের নিকটতম পুলিস থানায়। সেখানেও একই ব্যাপার। উদাসীন ব্যবহার, শুকনো আশ্বাস। বসু আশা ছাড়লেন না। সব রকম চেষ্টাই চালিয়ে গেলেন, সি. পি. আই-এর কাছে চাইলেন সহযোগিতার হাত। সি. পি. আই. সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিল। মিলিটারিও মোতায়েন করা হয়েছিল। তারাও কোনও কাজে এল না। অনেক কমরেড বলেছিলেন হিংসার জবাব হিংসা দিয়েই দিতে। বসু তা চান নি—”হিংসা হিংসারই জন্ম দেয়। আমি বুঝেছিলাম অবস্থা সঙ্গীন, সরকার এই চক্রান্তের পেছনে রয়েছে, শুধু শুধু কয়েকটা নির্দোষ জীবন ক্ষয় করে কি লাভ?”

ভোটের দিন সকালবেলা বসু যখন বরানগরে পৌঁছলেন, তখন ভোট শেষ। তখন সবে সকাল সাড়ে দশটা। বসুর পোলিং এজেন্টদের বার করে দেওয়া হয়েছে, ব্যালট কাগজ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, ব্যালট বাক্সেরও একই অবস্থা। এই প্রহসন বসু আর সহ্য করতে পারলেন না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের রিটানিং অফিসারকে একটা চিঠি লিখে ফেললেন। চিঠিতে লিখিতভাবে জানালেন, যেহেতু এই নির্বাচন ন্যায়সংগত পথে অনুষ্ঠিত হয়নি, তিনি এই নির্বাচন থেকে নিজের নাম তুলে নিচ্ছেন। চিঠিটা জমা দিয়ে বসু সোজা চলে গেলেন পার্টি অফিসে। পার্টি অফিসে তখন স্রোতের মত অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। বিকেল ৪টের সময় প্রমোদ দাশগুপ্ত দিল্লীতে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনারকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে পরিস্থিতি রিপোর্ট করলেন। ভোট গণনার কাজেও একই জালিয়াতি করা হল। ১৩ই মার্চ পার্টি ঠিক করল গণনাকেন্দ্রে তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে না। বাম ফ্রন্টের অন্যান্য দলও একই সিদ্ধান্ত নিল।

ফলাফল কি হবে তা তো জানাই ছিল। যে সি. পি. আই. (এম) প্রায় বছরখানেক আগে ১১৩টি আসন পেয়েছিল সেই সি. পি. আই. (এম) পেল মাত্র ১৩টি আসন। বসু সি. পি. আই. প্রতিদ্বন্দ্বী শিবপদ ভট্টাচার্যের কাছে ৩৮,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন। “ইন্দিরা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, এই বিপুল মার্জিন দেখে”, বসু হেসে বললেন, “শুনেছিলাম সিদ্ধার্থকে বলেছিল, লোকে বিশ্বাস করবে তো জ্যোতি এত বড় মার্জিনে হেরেছে?” “আসলে ওদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোনও উপায়ে ভোটটা জেতা, পেশী, টাকা কোনও কিছুই ওরা বাকী রাখেনি”–বসু মন্তব্য করেন।

কংগ্রেস-সি. পি. আই. আঁতাতে সরকার গঠিত হল। সি. পি. আই-এর সমর্থন রইল বাইরে থেকে। সিদ্ধার্থশংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। প্রথমেই তাঁর কাজ হল সরকারের একটা নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তোলা। তিনি বেশ সাড়ম্বরেই ঘোষণা করলেন এই সরকার শ্রমিকদের, কৃষকদের আর সাধারণ মানুষের সরকার। তিনি বিধানসভায় প্রোগেসিভ ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স-এর মুখ্য নেতা নির্বাচিত হলেন, সি. পি. আই-এর পরিষদীয় দলের নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জি নির্বাচিত হলেন উপ-মুখ্য নেতা। নতুন কংগ্রেস সরকার শপথ নিল ২০শে মার্চ। তখন রাজ্যপাল ছিলেন অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস।

সি. পি. আই. (এম) বিধানসভায় বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিল। বসু বললেন “ঐ মন্ত্রীসভার কোনও বৈধতা ছিল না, ঠিক করলাম আমরা পাঁচ বছর ঐ বিধানসভায় যাব না বরং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখব আমরা।” ২৮শে মার্চ ময়দানে এক জনসভায় বসু মন্তব্য করেন “এই বিধানসভার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।” সারা শহরে বসুর এই মন্তব্য নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শ্যামসুন্দর গোয়েঙ্কা নামে একজন প্রাক্তন কাউন্সিলর বসুর বিরুদ্ধে সিটি সিভিল কোর্টে মামলা দায়ের করেন। কংগ্রেস পরিষদীয় দলের সম্পাদক লক্ষ্মীকান্ত বসু বিধানসভায় বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং সভার অবমাননা করার জন্য বসুর শাস্তি দাবী করেন।

নির্বাচনের কিছুদিন পর জয়প্রকাশ নারায়ণ কলকাতায় আসেন এবং বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বসুর সঙ্গে তাঁর আগেই ভাল পরিচয় ছিল, বসুর দাদা সৌরীন্দ্রকিরণ তাঁর সঙ্গে আমেরিকায় পড়ার সময় এক সঙ্গে থাকতেন। জয়প্রকাশ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের হাল দেখে রীতিমত ব্যথিত হন—’এটা কি বৈধ নির্বাচন? মনে হচ্ছে সারাদেশে গণতন্ত্র যেন ভেঙে পড়েছে। আমাদের এর প্রতিবাদ করা দরকার’—জয় প্রকাশ নারায়ণ বলেছিলেন।

তিনি বসুকে জানান শীঘ্রই এ ব্যাপারে তিনি একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করবেন। বসু বললেন, তিনি তাঁকে কাগজপত্র, প্রমাণ সাক্ষ্য ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করবেন। অবশ্য এর বেশি ব্যাপারটা আর এগোল না কারণ সিদ্ধার্থশংকর রায় ইচ্ছা করে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে দিলেন।

সারারাজ্যে যখন এমন নৈরাজ্য চলছে তখন বসুর কাছে এল ইংল্যাণ্ডের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এক আমন্ত্রণ। বসু সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি দিলেন ইংল্যাণ্ড। এই ইংল্যাণ্ডেই ত্রিশ বছর আগে তিনি কমিউনিজমে দীক্ষা নিয়েছিলেন। “তিন দশক বাদে গিয়ে বেশ ভালই লেগেছিল”, বসু জানালেন “তবে দেখলাম অনেক জায়গাই আমূল বদলে গেছে, আর এমন অনেক জায়গায় গেলাম যেখানে ছাত্র থাকার সময় যাওয়া হয়ে ওঠেনি—যেমন লেক ডিস্ট্রিক”। তবে সফরটা নিছক ছুটিকাটানোর সফর ছিল না। রোজই প্রায় দুটো তিনটে কাজের প্রোগ্রাম থাকত, বক্তৃতা, আলোচনাচক্র এইসব। দেশের বাইরে গেলে বসু একেবারে অন্য রকম। মনটাকে সমস্যার উদ্বেগে ভারাক্রান্ত হতে দেন না মোটেই। তিনি প্রথমে ছিলেন সস্ত্রীক উডগ্রী-এ; কাজকর্মের, সভাসমিতির চিন্তা অন্যের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন পুরোপুরি। সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে শুনে নিতেন সারাদিন কি প্রোগ্রাম আছে। তারপর স্নান করে বেরোবার জন্য একেবারে তৈরি। “সেবার অনেক জায়গা যাওয়া হয়েছিল”, বসু বললেন “বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, লীষ্টার, নটিংহাম, ডাবি এবং গ্লাসগো।”

একদিন তাঁর মিটিং ছিল রেড লায়ন স্কোয়ারে কনওয়ে হলে। পার্টি এই মিটিং- এর ব্যবস্থা করেছিল। বিরাট সভাঘর প্রচুর শ্রোতায় ভরে গেছে। বসুর গোড়া থেকেই কেমন যেন একটা খটকা লাগছিল—অনেকদিনের অভিজ্ঞতা, শ্রোতার নাড়ির স্পন্দন ভালই শুনতে পান। তাঁর মনে হচ্ছিল শ্রোতাদের মধ্যে কোথাও কেমন একটা চাপা অস্থিরতা রয়েছে। সভা শুরু হল, বসু যেই বলতে শুরু করবেন ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনদিক থেকে আওয়াজ উঠল ‘নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ’। জনা বিশেক লোক মঞ্চের দিকে ধেয়ে এল, একজন বসুকে ধরতে চেষ্টা করল, সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা এগিয়ে এসে বসুকে ঘিরে ধরে, আক্রমণকারীরা ব্যর্থ হয় কিন্তু বেশ হাতাহাতি চলে খানিকক্ষণ। হঠাৎ সোহন সিং সান্ধু, শক্তপোক্ত রেলিং চ্যাম্পিয়ন কয়েকটা লোককে ঘাড় ধরে তুলে অবলীলাক্রমে সভাঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন মহিলা বসুকে লক্ষ্য করে পচা ডিম ও টম্যাটো ছুঁড়ে মারলেন। পরে বসু জেনেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন উপাচার্যের কন্যা ঐ মহিলা ছিলেন এক মাওবাদী। তিনি বসুকে ‘সংশোধনবাদী’ বলে ধরে নিয়েছিলেন। বসু বললেন, “একজন শ্রোতা জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি ক’জন নকশালবাদী মেরেছেন? এই প্রশ্নটা শোনামাত্র শ্রোতাদের আর এক অংশ হো হো করে হেসে উঠেছিল। কেননা ঐ শ্রোতা এতই অজ্ঞ ছিল যে সে জানতই না যে মারা তো দূরের কথা, আমরা নকশালদের ছেড়ে দিয়েছিলাম।” যাইহোক আধঘণ্টা পর পুলিস এল, ততক্ষণে নকশালবাদীদের চিহ্নিত করা গেছে। বসু বক্তৃতা শুরু করলেন, বললেন প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে, নির্বিঘ্নে সভা শেষ হল। ফেরার পথে বসু পার্টিকর্মীদের কাছে ভাল করে জেনে নিলেন এরা কারা, এদের অভিমত বা আদর্শ কি, উদ্দেশ্যই বা কি ছিল ইত্যাদি।

১৯৯৬ সালে বসু যখন লন্ডনে, অর্থাৎ পাক্কা চব্বিশ বছর পরে, নেহরু সেন্টারে এক মহিলাকে এক ভদ্রলোক যখন বসুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছেন, বসু বললেন “ওনাকে বিলক্ষণ চিনি, আমার এক সভায় আমাকে ডিম আর টম্যাটো ছুঁড়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ‘এইম’টা ঠিক ছিল না, আমার গায়ে লাগেনি।” ভদ্রমহিলা তখন লজ্জা লুকোবার পথ পান না।

লন্ডনে সভাসমিতির পরে বসু গেলেন ইয়োরোপের বেশ কয়েকটি দেশে— বেলজিয়াম, জার্মানি, নেদারল্যাণ্ড। সাধারণ মানুষের মত ভিড়ে হেঁটে, দোকান-বাজার করে, প্লাস্টিক ব্যাগে জিনিসপত্র বয়ে কি আনন্দই না পেতেন!

“আসলে দেশে পুলিশ পাহারার মধ্যে থেকে নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু আর থাকে না, তাই বিদেশে গেলে নিজেকে বেশ স্বাধীন নাগরিক বলে মনে হয়”–বসু বলেন। দেশে ফেরার আগে আবার কয়েকদিন লণ্ডনে কাটালেন। দেখা করলেন ইংরেজ বৌদি আইরিনের সঙ্গে। (আইরিন যখন প্রথম ভারতে আসেন তখন বসু নেহাতই কিশোর। ১৯৭২ সালে আইরিন রীতিমত বৃদ্ধা। বসুকে দেখে তাঁর আনন্দ আর ধরে না—সেই ছোট লাজুক ছেলেটি আজ এতবড় হয়েছে! বসুর কাছে পুরো ব্যাপারটা মনে হয়েছিল যেন ‘দ্বিতীয়বার ঘরে ফেরা’।

সাত সপ্তাহ নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে কাটিয়ে বসু যখন দেশে ফিরলেন তখন রাজ্যের অবস্থা উত্তাল। নতুন মন্ত্রীসভায় ঘুণ ধরেছে। কংগ্রেস-সি.পি.আই. বোঝাপড়া আগের মত মসৃণ নেই। এদিকে খাদ্যসমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ১৯৭৩ সালের ১০ই অক্টোবর প্রমোদ দাশগুপ্ত মুখ্যমন্ত্রীকে খাদ্যসমস্যা এবং খাদ্যনীতি সম্বন্ধে কয়েকটি সদর্থক পরামর্শসহ একটি চিঠি লেখেন। বসু বুঝলেন, সিদ্ধার্থশংকর রায় পরিকল্পিতভাবে নিপীড়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্দ্বিধায় বসু জানালেন, “সিদ্ধার্থ নকশালদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের জন্য দায়ী। ওর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কারণ এই কাজে কেন্দ্রের মদত ছিল। নির্মম আচরণের জন্য অফিসারদের পুরস্কৃতও করা হত”, বসু আরও বললেন “তখন চলছিল ‘হিংসার রাজনীতি’ আর সিদ্ধার্থই ছিল এর প্রধান হোতা। ওর ১৭-দফা প্রোগ্রাম ছিল একটা বড় ভাঁওতা।” সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নিজের মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যই মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যে ও জনবিরোধী কাজকর্মে অসন্তুষ্ট ছিলেন। সি.পি. আই.(এম) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য ধর্মঘট ডাকে, তাছাড়া ১৯৭৪-এর ৮ই মে অনুষ্ঠিত হয় সারা ভারত রেল ধর্মঘট। চারিদিকে তখন অত্যাচার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নানা ধরনের গণ-আন্দোলন চলতে থাকে।

সারা ভারতে তখন চলছে ইন্দিরার অবাধ স্বৈরতন্ত্র। তখন এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসমসাহসী আন্দোলন চালিয়েছিলেন সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। “তবে একটা সময় এল”, বসু বললেন “যখন ইন্দিরা বুঝল এই ‘গরীবি হটাও’ স্লোগান দিয়ে আর কাজ চলবে না, লোকে কংগ্রেসকে সমালোচনা করতে শুরু করেছে।” কেন্দ্রে কংগ্রেসে তখন বড় রকমের ফাটল ধরেছে। তার প্রতিফলন পশ্চিমবঙ্গেও পড়েছিল। নিজেদের মধ্যে বিবাদ এমন একটা পর্যায়ে তখন পৌঁছেছিল যে, কোনও কোনও কংগ্রেস নেতাকে নিরাপত্তারক্ষী নিয়েও ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত। ফোন ট্যাপিং-এর ঘটনা আখছার ঘটত। সিদ্ধার্থশংকর রায়ের বিরুদ্ধে যেসব কংগ্রেসকর্মী ছিলেন তাঁদের মিসাতে গ্রেপ্তার করানো হয়েছিল। যখন কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল রায়কে হত্যা করা হল তখন সিদ্ধার্থবাবু নামেই তদন্ত চালিয়েছিলেন। তার থেকে বেশি তৎপর হয়েছিলেন ওয়াংচু কমিশনের তদন্তের ব্যাপারে—এই কমিশনের কাজ ছিল অপেক্ষাকৃত স্বাধীনমনস্ক মন্ত্রীদের কাজকর্মের তদন্ত করা। “কথাবার্তায় চাতুর্য আর চমকের জন্য সিদ্ধার্থ বিখ্যাত ছিল, কিন্তু প্রশাসক হিসাবে সে ছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ”–বসু মন্তব্য করেন।

১২ই জুন ১৯৭৫ সাল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের জজ জগমোহনলাল সিন্হা এক ঐতিহাসিক রায়ে নির্বাচনী বিধি উল্লঙ্ঘন করার অপরাধে ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ খারিজ করে দিলেন। এ ছাড়াও ৬ বছরের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বন্ধ করে দিলেন। পরের দিন বেরল গুজরাট বিধানসভার ফলাফল। দেখা গেল কংগ্রেস ভীষণভাবে পরাজিত হয়েছে। ইন্দিরার মনোবল ভেঙে গেল। সুপ্রিমকোর্টে আপীল তাঁকে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারল না। তাঁর লোকসভার সদস্যপদ থেকে গেল কিন্তু ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হল। দেশের অবস্থা তখন করুণ। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের জোয়ার চলছে। এদিকে পদত্যাগ করতে ইন্দিরা মোটেই রাজী নন। তিনি স্বৈরতন্ত্রের পথই বেছে নিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬শে জুন সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষিত হল। বলা হয়ে থাকে সিদ্ধার্থশংকর রায় যখন এর খসড়া তৈরি করেছিলেন তখন উপস্থিত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ডি. কে. বড়ুয়া। জরুরী অবস্থায় গণতন্ত্র হত্যা করা হল, সব ধরনের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব করা হল। গণমাধ্যমগুলির অধিকার চলে গেল। মিসা, ডি. আই. আর. এবং অন্যান্য নিপীড়নকারী আইন পুরোদমে চালু করা হল। বিরোধী দলগুলোর ওপর অত্যাচার শুরু হল। সংসদীয় কাজকর্মেও গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রইল না। অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকে এই সময় অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। ২৬শে জুন বসু কলকাতাতেই ছিলেন। তবে ঐ সময় বসুকে গ্রেফতার করা হয়নি। গ্রেফতার হয়েছিলেন এ. কে. গোপালন, ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ, গোবিন্দ পিল্লাই, অহল্যা রঙ্গনেকার, হনুমন্ত রাও, এম. বাসবপুন্নাইয়া এবং জ্যোতির্ময় বসু। —আসলে পশ্চিমবঙ্গে যবে থেকে সিদ্ধার্থ এসেছে তখন থেকেই জরুরী অবস্থা চলছিল। আমাদের কাছে এই অত্যাচার এমন কিছু নতুন ছিল না। সারাদেশে জরুরী অবস্থা চালু হল অনেক পরে, আমরা এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম ১৯৭১ সাল থেকে”, বসু বললেন, “সিদ্ধার্থ চিরকালই আমাকে ওর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে এসেছে, ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কোনও দিনই এক ছিল না।” ১৯৫৮ সালে সিদ্ধার্থশংকর রায় যে কংগ্রেসবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন, বসুর সেটা যুক্তিসংগত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালে ইন্দোচীন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় উনি যেভাবে হঠাৎ সেই অবস্থান পালটেছিলেন সেটা সত্যিই নিন্দনীয় ছিল। “সিদ্ধার্থ অত্যন্ত সুবিধাবাদী, আদর্শ বলে ওর কিছুই নেই, তাছাড়া উচ্চাকাঙ্খী এবং ক্ষমতালোভী”—সত্তর সালের পশ্চিমবঙ্গ প্রসঙ্গে বসু সিদ্ধার্থশংকর রায় সম্বন্ধে এই মন্তব্য করেন।

১৯৭৬ সালের ৫ই জুন জয়প্রকাশ নারায়ণ কলকাতায় এলেন। বিশাল মিছিল বেরোল। সি. পি. আই. (এম) এই আন্দোলনে সক্রিয় সহায়তাও করল। কিন্তু বাদ সাধল কংগ্রেস। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সভা হবার কথা। সেখানে কংগ্রেসিরা হামলা শুরু করে দিল। রাস্তায় ব্যারিকেড করা হল, কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের এক মহিলা নেত্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ীর বনেটের ওপর উঠে নাচানাচি শুরু করল, আর চলল অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের বন্যা। কিন্তু জনস্রোত অব্যাহত রইল, জনসমর্থনও প্রত্যাহৃত হল না। সেদিন বসু বুঝেছিলেন কংগ্রেসী সন্ত্রাসের রাজত্বে সাধারণ মানুষ তাঁদের পাশেই আছে। এই উপলব্ধি তাঁকে সেই সময়ে যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় একটা কমিটি গঠন করা হয়েছিল—পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ অ্যান্ড ডেমোক্রাটিক রাইটস। এই কমিটি একটি স্টিয়ারিং কমিটিও গঠন করেছিল। বসু তার সদস্য হয়েছিলেন। কমিটি ঠিক করেছিল পাঁচদফা দাবির ভিত্তিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে একটি স্মারকলিপি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। এর মধ্যে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবী, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের দাবী এবং দমনমূলক সব আইন বাতিলের দাবীও ছিল।

দুঃস্বপ্নের মত ছিল এই কয়েকটা বছর। তবুও বসু হাল ছাড়েন নি। আশাও হারাননি। ‘এই দিন পাল্টাবেই, আমরা এই দুস্তর পথ পেরোবই, জয় আমাদের হবেই একদিন’—এই কথাগুলোই তাঁর মনের মধ্যে অবিরত বাজত। সারাদিন সভাসমিতি, মিছিল, সাধারণ মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদান করে রাতে হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে যখন ফিরতেন তখন আর শরীরে কিছু থাকত না। বসু তখন সবে ষাট পেরিয়েছেন, দৌড়াদৌড়ি করতেন ত্রিশ বছরের যুবার মত। সারাদিন ক্লান্তি কাকে বলে জানতেন না। ‘এই ভীষণ কালো দিন শেষ হতে আর দেরী নেই, মাথায় পৃথিবী ভেঙে পড়েনি —এই ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুম এসে যেত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *