সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৯. জীবন-মৃতের জাদুঘর

জীবন-মৃতের জাদুঘর

সৌরজগতের দূরতম গ্রহ প্লুটো। তারও কক্ষপথের ওপারে।

মহাশূন্যচর ‘ইলকর’ সবে প্রবেশ করেছে আন্তর্নক্ষত্র ব্যোমমার্গে। ভীতত্রস্ত এক বৈমানিক নায়ক এসে কমান্ডারের সমুখে দাঁড়ালেন—

‘মালিক! একটা দুঃসংবাদ না-জানালে নয়। জনৈক তত্ত্বাবধায়কের অবহেলায় একটা রুম রয়ে গিয়েছে তৃতীয় গ্রহে। তার দেহের ভিতরকার যন্ত্রপাতি সবসমেতই।’

কমান্ডারের ত্রিকোণ চোখ দুটো বুজে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তারপরই তা খুলল আবার। কণ্ঠ থেকে স্বর যা বেরুল, তাতে উত্তেজনার কোনো আভাস নেই।

‘রুমটার বিবরণ?’

‘এইচ-৯ জাতীয়। এক-শো ষাট পাউন্ড প্লাস, পনেরো মাইনাস। গতিবৃত্তের সর্বাধিক ব্যাসার্ধ ত্রিশ মাইল।’

কয়েক মিনিট সাড়া নেই কমান্ডারের। তারপর তিনি বললেন, ‘এখন তো ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কয়েক হপ্তা পরে ওদিকে আবার যাব যখন, রুমটাকে তুলে নেব। হারালে চলবে না। অত্যন্ত দামি যন্ত্র, শক্তির সীমা নেই, আর সে-শক্তি বাইরে থেকে আমদানি করবার দরকার নেই, দেহের ভিতরেই তৈরি হচ্ছে চাহিদামতো। না, অমন মূল্যবান জিনিস হারাতে পারি না।’

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার তিনি বললেন, ‘দোষী লোকটাকে কঠিন সাজা দিতে চাও।’ কথা যেন তরোয়ালের মতো ধারালো।

কিন্তু ইলকর আর তৃতীয় গ্রহে ফিরতে পারেনি। ‘রিগেল’ নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি পৌঁছোতেই এক বোম্বেটে বিমানের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। তার চ্যাপটা গড়ন, আংটির আকার। দুই পক্ষই শুরু করল আগুন ছুড়তে। লড়াইয়ের শেষে দু-খানা বিমানেরই অবস্থা শোচনীয়। কাঠামো আধাআধি গলে গিয়েছে, দুটো ধাতুপিণ্ডই তেজস্ক্রিয়তায় আচ্ছন্ন। কয়েক ডজন মৃতদেহ জঠরে নিয়ে রিগেল-পুঞ্জের চারপাশে তারা দুটোই পাক খেতে থাকল অনন্তকাল ধরে। কক্ষপথটা ছোটো নয়, একবার ঘুরে আসতেই লাগে লক্ষ কোটি বছর।

ওদের হিসাবে যেটা তৃতীয় গ্রহ ছিল, আমরা যাকে বলি পৃথিবী, সেখানে তখন চলছে সরীসৃপ-যুগ।

সে-যুগ পালটালো। কত কত লক্ষ লক্ষ যুগ এল আর গেল। তারপর একদিন দু-জন মানুষ এসে নামল কানাডার রকি পর্বতের এক বিজন উপত্যকায়। ছোট্ট একখানা সি-প্লেনে চড়ে তারা এসেছে। মালগুলো সব নামিয়ে দিয়ে ওয়াল্ট লেনার্ড আবার চড়ে বসল বিমানে। বিমান উঠে যাচ্ছে আকাশে, নীচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে জিম আরউইন—

‘আমার চিঠিখানা পাঠিয়ে দিস ভাই বাড়িতে, ভুলিস না।’

‘মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে ডাকে ফেলব।’ চেঁচিয়ে জবাব দিল ওয়াল্ট, ইঞ্জিনের মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘ইউরেনিয়াম কিন্তু পাওয়াই চাই। আর দেখিস, ভালুক থেকে হুঁশিয়ার, রকি পর্বতের ভালুক বড়ো ভয়ানক।’

সি-প্লেন উড়ে চলে গেল, পিছনে ধোঁয়ার লেজুড় রয়ে গেল ফেনার মতো সাদা। সে লেজুড়ও মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জিম আরউইন ধীরে ধীরে টোকা দিচ্ছে নিজের নাকে। গা শিরশির করছে তার। এই রকি পর্বতে তিন হপ্তা একা থাকবে সে, একেবারে একা। বিমানটা যদি ফিরতে না-পারে কোনো কারণে, মৃত্যু তার নিশ্চিত।

লোকালয় এখান থেকে শত শত মাইল দূরে। পাহাড় আর বন, বন আর পাহাড়। এই গোটা অঞ্চলটাই বনে-পাহাড়ে ভরতি। পাহাড়ে চিরতুষার। জঙ্গল এত নিবিড়, সৃষ্টির শুরু থেকে তার ভিতর মানুষের পা পড়েনি কোনোদিন। যথেষ্ট খাবার সঙ্গে নিয়েও যদি বহির্জগতের দিকে রওনা হয়, তারও কোনো আশা নেই পথের শেষে পৌঁছোবার। এদিকে তো জিম আরউইনের জন্য যা খাদ্য রেখে গেল ওয়াল্ট, তাতে টেনেটুনে ওই তিন হপ্তাই চলবে হয়তো। তার বেশি আর না।

কিন্তু কেন এসব চিন্তা? ওয়াল্ট আসবেই, নির্দিষ্ট দিনেই আসবে। ও-চিন্তা ছেড়ে দিয়ে জিমের এখন কাজে নেমে পড়া দরকার। ইউরেনিয়াম খোঁজার কাজ। যদি পেয়ে যায়, দেদার পয়সা রোজগার হবে কমিশন হিসেবে, কোম্পানি দেবে। পয়সার লোভেই সে এই বিপজ্জনক কাজ করতে রাজি হয়েছে। স্ত্রী আসতে দিতে চায়নি। কোনোরকমে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেখে এসেছে। দারিদ্র্যের বড়ো জ্বালা। হয়তো ঘুচতে পারে সে জ্বালা চিরদিনের জন্য, এই আশায় বুক বেঁধে সে এসেছে রকি পর্বতে। সেই আশাতেই বুক বেঁধে তার স্ত্রী-পুত্র বসে আছে সুদূর পল্লিগৃহে, তার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়। ভগবান করুন, সে প্রতীক্ষা যেন ব্যর্থ না-হয়।

পাকা বনচরেরা কোনো ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করে না। নজর রাখে যাতে তোড়জোড়ের প্রত্যেকটা কাজ হয় নিখুঁত। খুঁত থাকলে অনর্থ ঘটবেই। আর লোকালয়ে যে অনর্থকে লঘু করে দেখা সম্ভব হতে পারে, বনাঞ্চলে তাই হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক।

পাহাড়ের গায়ে ঠেকনো দিয়ে একটা চালা প্রথমেই তুলে ফেলল জিম। কালটা গরমের, থাকতে হবে মাত্র তিন হপ্তা। এর জন্য ওর চেয়ে পাকা বন্দোবস্ত কিছু দরকার নেই। জিনিসপত্র সব এনে চালার তলায় রাখছে জিম। সকাল বেলায়ই রোদ এমন প্রখর যে এরই মধ্যে সে ঘর্মাক্ত কলেবর। সব মাল সাজানো হয়ে গেলে ত্রিপল চাপা দিল তার উপরে। বৃষ্টি যদি হয়, ত্রিপলেই তা আটকাবে। তা ছাড়া জন্তু-জানোয়ার যদি এসে পড়ে, খাবারগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলতে চায়, তারাও বাধা পাবে ওই ত্রিপলেই।

সব জিনিসই চালার তলায়, একটি ছাড়া। সে জিনিস হল ডিনামাইট। সেটা মাটির তলায় পুঁতে রাখল আন্দাজ শো-দুই গজ দূরে। তাও ত্রিপল-জড়ানো, যাতে ভিজে না-ওঠে। নিজের শোবার ঘরে যারা উগ্র বিস্ফোরক রাখে, তারা নিরেট বোকা।

প্রথম দুটো হপ্তা কোনদিক দিয়ে কেটে গেল, জিম তা টেরও পেল না। খেটেছে উদয়াস্ত, উৎসাহিত হয়ে ওঠার মতো কোনোকিছু আবিষ্কার করতে পারেনি। একটামাত্র দিক এখন দেখতে বাকি আছে, সেটাতে তল্লাশি চালাবার পক্ষে হাতের এই একটা হপ্তাই পর্যাপ্ত বই কী। তৃতীয় হপ্তার গোড়াতেই এক সকালে সে রওনা হল সেইদিক লক্ষ করে। উপত্যকাটার উত্তর-পূর্ব কোণ। এদিক পানে একদিনও আসা হয়নি আগে।

সাজসরঞ্জাম সবই সে সঙ্গে নিয়েছে। ইস্তক ইয়ার ফোন পর্যন্ত। আপাতত সেটা উলটো করে লটকে রেখেছে কানে, যাতে ওর চিরন্তন সাঁ সাঁ আওয়াজে স্বাভাবিক প্রাণশক্তি ঘুলিয়ে যেতে না-পারে। হাতে রাইফেল, অসম্ভব ভারী। এটা ঘাড়ে নিয়ে কোনো মেহনতের কাজে বেরুনের ঝকমারি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু কানাডার ভালুক ভয়ানক চিজ। এ উপত্যকায় তাদের দেখা মিলতে পারে যেকোনো মুহূর্তেই। যা-তা অস্ত্র নিয়ে তাদের মোকাবিলা করা অসম্ভব। এই ৩০-০৬ রাইফেলও অনেক সময় হার মেনে যায় ওদের কাছে।

এ যাবৎ দু-দুটো ভালুক মেরেছে জিম। মেরে খুশি হয়নি। কারণ সত্যিকার দেখবার মতো জন্তুই বটে ওরা। আর সংখ্যাও ওদের দিনদিনই কমে আসছে। ভবিষ্যতে আর না মারতে হলে বেঁচেই যায় জিম। তবে রাইফেল, না মারতে হলেও উপকারে আসে। যে ভালুক একবার রাইফেল থেকে গুলি ছুটতে দেখেছে, সে প্রায়ই ভবিষ্যতে রাইফেলওয়ালাদের এড়িয়ে চলে।

রাইফেল রয়েছে, কাজেই পিস্তল নেওয়ার আর দরকার নেই। ওটা চালার ভিতরই রেখে গেল জিম।

যে কাজে এসেছিল, তা-কিছুই এ-যাবৎ করতে পারেনি। সেদিক দিয়ে তার মনটা খারাপ থাকারই কথা ছিল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল পথ চলতে চলতে সে মনের আনন্দে শিস দিচ্ছে। হাওয়া নির্মল। তুষারের ছোঁয়াচ লাগার দরুন অল্প ঠান্ডা। পাহাড়ের মাথায় বারোমেসে বরফে নীলচে-সাদা রং, তার উপর আবার দীপ্ত রৌদ্রের ঝলমলানি। পৃথিবী, আকাশ, উপত্যকা, উপবন সব জোড়া এক মনমাতানো বাসন্তী সুবাস। মানুষের মনের সাধ্য কি যে উৎফুল্ল না-হয়ে পারে?

জিমের মতলব, পুরো একটা দিন সে ক্রমাগত পথ চলবে উত্তর-পূর্বে। যেখানে পৌঁছোবে, তন্নতন্ন করে খুঁজবে সেই অঞ্চলটা। এ কাজে সে পুরো দেড় দিন সময় দিতে পারে এখনও। তারপর অবশ্য ফিরতেই হবে তাকে, কারণ ওয়াল্ট লেনার্ডের ফিরে আসার সময় হয়ে যাবে ততদিনে।

বিপদ-আপদের কথা বলা যায় না। অজানা পথে চলতে হলে কিছু-না-কিছু খাদ্য সঙ্গে রাখতেই হয়। জিমের সঙ্গেও সেই ব্যবস্থাটুকুই আছে শুধু। ওটা হল শেষের সম্বল। ওতে হাত দেবার দরকার এক্ষেত্রে হবে না বলেই জিমের আশা। দিনের-দিন খাবার সে সদ্য সদ্য জুটিয়ে নেবে। একটা খরগোশ মেরে, লতাপাতার আগুনে ঝলসে নেওয়া তো শক্ত নয় কিছু। আর ছোটো ছোটো নদী তো অগুন্তি! মাঝে মাঝে রামধনুর রং ঝলকাচ্ছে তাদের জলে।

সারা সকাল হেঁটেই চলল জিম। সঙ্গে গেইগার কাউন্টার আছে। কোথাও খনিজ পদার্থের শিরা থাকলে সে-যন্ত্রে টুংটাং আওয়াজ শুরু হবে। এযাবৎ দুই-চারবার হয়েছেও সেরকম আওয়াজ, কিন্তু অতিঅল্প সময়ের জন্য। অর্থাৎ শিরা এখনও পুষ্টিলাভ করেনি, বা শিরা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। পুরিপুষ্ট শিরার কাছে এলে কাউন্টার ক্রমাগত বাজতেই থাকত, আর সেইক্ষেত্রেই পরীক্ষা করে দেখার দরকার হত যে খনিজটা ইউরেনিয়াম না অন্য কিছু।

না, মনের আনন্দ উবে যাচ্ছে। ইউরেনিয়াম না-পেলেই যে নয়! পয়সার যে বড়ো দরকার! স্ত্রী পথ চেয়ে বসে আছে। তাকে শেষপর্যন্ত হতাশ হতে হবে? ওঃ!

কিন্তু রকি পর্বতের বিজন উপত্যকায় ঘুরতে ঘুরতে হতাশাকে বেশি আমল দেওয়া নিরাপদ নয়। খিদে পেলেই খেতে হবে। পথ চলবার সময় হুঁশিয়ার থাকতে হবে। দুই মিনিট বসে বিশ্রাম নিতে হলেও স্থানটা পরখ করে নিতে হবে সাবধানে।

হতাশায় মুষড়ে পড়ার স্থান-কাল এটা নয়। ভবিষ্যৎ যতই অন্ধকার হোক, বর্তমানে হাত-পা এলিয়ে দিলে চলবে না। এখন খিদে পেয়েছে, খাওয়ার চেষ্টা দেখতে হবে। সমুখে ওই ছোটো নদী, মাছ ধরা যাক একটা। ঝোলা থেকে ছিপের টুকরোগুলো বার করে জোড়া দিতে বসল জিম। বসল একটা ঘাসে-ঢাকা নীচু পাথরের উপরে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল একবার। জায়গাটা বসবার পক্ষে নিরাপদ তো?

আর নিরাপদ! পিছন দিকে চোখ ফেরাতেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল তার। চোয়াল দুটো ঝুলে পড়ল দারুণ বিভীষিকার। এ কি কোনো দানবের কসাইখানা নাকি? নানারকমের জন্তুর ধড়! সমান্তরাল তিন সারিতে পর পর সাজানো। যতদূর দৃষ্টি চলে, সেই তিন সারি সোজা চলে গিয়েছে ঝোপঝাড়, বনবাদাড়ের বুক চিরে।

কত রকমের যে জন্তু! কাছাকাছি যেগুলো রয়েছে, তাদের বরং চেনা যায়— হরিণ, ভালুক, কাউগার, পাহাড়িয়া ভেড়া— এইসব। কিন্তু ওদিকটাতে? জবড়জং সব জানোয়ার, লম্বা লম্বা চুল সারা গায়ে, গড়নে সংগতি নেই, পূর্ণতা নেই, দেহগুলোকে বিশেষ কোনো ঢং দেবার কথা যেন বিধাতা পুরুষের মনেই পড়েনি।

তাদেরও ওদিকে? সারি সারি সরীসৃপের দেহ, এমন এমন বীভৎস সব আকৃতি, দম-আটকানো দুঃস্বপ্নেও যা কেউ দেখেনি কখনো। এদেরই একটা, লাইনের প্রায় শেষ মাথায়, বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করল জিমের। চেহারাটা চেনা। ঠিক এই জন্তুই সে মিউজিয়ামে দেখেছে। তবে এর চেয়ে ঢের বড়ো। বড়ো, তবে হাতে বানানো। মাটির তলায় কয়েক লক্ষ বছরের পুরোনো একটা অসম্পূর্ণ কঙ্কাল খুঁজে পেয়েছিলেন পণ্ডিতেরা। তুলে এনে তারই অবলম্বনে গড়ে তুলেছেন প্রাচীন পৃথিবীর সেই বিস্মৃত স্টেগোসাউরাস। মিউজিয়ামের সেই হাতে-গড়া মূর্তিটা ছিল বৃহৎ, জিমের সমুখে যেটা রয়েছে, নিজস্ব রক্তমাংসে যা এখনও সজীব বলেই মনে হয়, তার আকার একটা টাটু ঘোড়ার চেয়ে বড়ো নয়।

প্রায় বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে জিম হেঁটে চলেছে, দুই লাইন ধড়ের মাঝখান দিয়ে। কী বিরাট প্রদর্শনী! কত জাতের জীব! কত কত যুগের জীব! ময়লা হলদে রং একটা বিশাল সরীসৃপ, গায়ে তার সাপের মতো আঁশ, তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই আরও যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল জিম। প্রাণীটার এক চোখের পাতা যে নড়ছে!

ব্যাপারখানা আসলে কী, এইবার মাথায় এসেছে জিমের। আঁধারে যে তথ্য ছিল আচ্ছন্ন, তা বিদ্যুৎ চমকে র মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এই জীবগুলো একটাও মরেনি। পক্ষাঘাতে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। কে জানে কত যুগ যুগ ধরে। নিশ্চয়ই যুগ যুগ আগেকার জীব এরা। ওই স্টেগোসাউরাসের কথাই ধরো না কেন! কত লক্ষ বছর আগে ওরা পৃথিবীতে বিচরণ করত, হিসাব করতে গেলে মহা মহা পণ্ডিতেরও মাথা গুলিয়ে যাবে।

কে সে অনুসন্ধিৎসু সমজদার, যে সৃষ্টির শুরু থেকে প্রতি যুগের প্রতি স্তরের প্রাণী, স্থলচর, জলচর, উভচর, বায়ুচর পশু পক্ষী সরীসৃপ— প্রতি জাতির এক একটা সজীব নমুনা সংগ্রহ করে সযত্নে রক্ষা করেছে এই অভাবনীয় জাদুঘরে? ধরেছে জ্যান্ত অবস্থায়, মানুষের অজানা কোনো বৈজ্ঞানিক কৌশলে দেহগুলোকে নিঃসাড় করে রেখেও তার ভিতরে প্রাণটাকে ধরে রেখেছে অবিনশ্বর করে? অবিনশ্বর যে, তার প্রমাণ তো ওই নোংরা হলদে সরীসৃপটা? লক্ষ বছরের পুরোনো দেহে এখনও চোখের পাতা নড়ছে!

কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে জিমের দরদর ধারায়। স্টেগোসাউরাসেরা যখন চরে বেড়াত এই উপত্যকায়, সে আজ কত দিনের কথা!

আরও এক অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়েছে জিমের। সারিবদ্ধ প্রাণীগুলো আকারে আয়তনে প্রায় সবাই সমান। অতিরিক্ত বড়ো প্রাণী একটাও না। সেগুলোকে যেন ইচ্ছে করে বাদ দেওয়া হয়েছে? ধরো যেমন অতিকায় টাইর‌্যানোসাউরাস। নেই একটাও সেখানে। ধরো ম্যামথ, তাও নেই। কেন নেই? যে দানবের রচনা এই পিলে চমকানো প্রদর্শনী, সে কি বৃহৎ জন্তু ধরতে অপারগ ছিল?

ভাবতে শুরু করেছিল জিম, কিন্তু বেশি ভাববার সময় পেল না। পিছনে ঝোপঝাড়ে সড়সড় শব্দ শুনেই সে সাবধান হয়ে গেল।

এক সময়ে পারদ নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল জিমকে, কোনো একটা কারখানায়। আজ এক সেকেন্ডের জন্যে তার মনে হল— গলানো পারার আর্দ্ধেক ভরতি একটা চামড়ার বস্তা যেন গড়াতে গড়াতে ফাঁকা জায়গাটায় এসে ঢুকছে। গোলমাল ওই বস্তুটার গতি সেইরকমই। যে জিনিস একাধারে পাতলা আর ভারী, তাকে গড়িয়ে দিলে সে তো ওইভাবেই চলবে!

কিন্তু, চামড়ার বস্তা? উঁহু, চামড়াও নয়। কী ও তাহলে?

গায়ে ওর ডজন ডজন আব। অন্তত প্রথম নজরে আব বলেই জিমের মনে হয়েছিল ওই ফুলো ফুলো জায়গাগুলোকে। একটু ভালো করে দেখতেই এখন বুঝতে পারল, আব নয়, ধড়ের ভিতরকার কোনো অজানা কলকবজা ঠেলে বেরুতে চাইছে ওই স্ফীতিগুলোর তলা থেকে।

কিন্তু জিনিসটা যে সত্যি সত্যি কী, তা পর্যবেক্ষণের জন্য ওখানে তো আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। কারণ ওই গোলকটা গড়াতে গড়াতে তেড়ে আসছে তার দিকে। আসছে, ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ মাইল বেগে। আসতে আসতে হাতিয়ার বার করছে নানারকম। ওই আবগুলো থেকেই বেরুচ্ছে হাতিয়ার। একবার বেরুচ্ছে একবার ঢুকে যাচ্ছে ধড়ে, আবারও বেরুচ্ছে— ঠিক যেন ধাতুময় বল্লম এক প্রস্থ, তবে বল্লমের মতো সুঁচোলো নয়, এদের ডগায় পেঁয়াজের মতো আকারের পরকলা।

জিমের সন্দেহ নেই যে ওই বল্লমধারী গোলকের মতলবটি সাধু। ওই যে নানা ধরনের বিবিধ জাতের প্রাণী জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি পর্যায়ে স্থির হয়ে রয়েছে লাইন বেঁধে, ওই লাইনের শেষ সংগ্রহ হিসেবে জিমকে অনন্তকালের জন্য স্থিতু করাই উদ্দেশ্য তার। সেইজন্যই এই পশ্চাদ্ধাবন।

একটা অর্থহীন অর্ধোক্তি জিমের মুখ থেকে ঠিকরে বেরুল। তারপর একদৌড়ে পিছিয়ে এল অনেকখানি। কাঁধ থেকে নামিয়ে নিল রাইফেল। ওই গোলকটা আন্দাজ ত্রিশ গজ পিছনে রয়েছে। গতিবেগ খুব দ্রুত নয় ওর, কিন্তু সে-বেগ এক সেকেন্ডের জন্যও হ্রাস পাচ্ছে না একটুও। একভাবে একনাগাড়ে এই দৌড়, এ যেন ক্রুদ্ধ গণ্ডারের দ্রুত ধাবনের চেয়েও ভয়াবহ!

জিম অভ্যস্ত ক্ষিপ্রহস্তে কার্তুজ পুরে ফেলল রাইফেলের নলীতে। কুঁদোটা গালের সঙ্গে ঠেকিয়ে চামড়া-ঢাকা গোলকটার দিকে তাক করল। ফসকাবার কোনো উপায় নেই। দুপুর-রোদের ভিতর অতবড়ো লক্ষবস্তুটা মাত্র কুড়ি গজ তফাতে। ঘোড়া টিপতে গিয়ে জিমের মুখে ফুটে উঠল হিংস্র হাসি। এই ধাতু দিয়ে মোড়া ১৮০ গ্রেন পরিমাণ ছোটো বুলেটগুলোর শক্তি তার জানা আছে। সাতাশ-শো ফুট গতি ওর প্রতি সেকেন্ডে। চোখের পলকে ওই পিশাচ রূং ফুটো হয়ে দলা পাকিয়ে যাবে একটি বুলেটে।

রূং? কী জানি কেন জিমের মনে হল জিনিসটার নাম রূং হওয়াই উচিত। ভয়াবহ অথচ দুর্বোধ্য বস্তুর ওইরকম আজগুবি নামকরণ মানুষ খেয়ালবশেই করে থাকে।

হোয়াম! কাঁধে লাগল ধাক্কা, যেমন লেগে থাকে। ঈ-ঈ-ঈ-ঈ—

এ কী! বুলেট ঠিকরে ফিরে এসেছে একটা নাকিসুরের চিৎকার তুলে! জিম আঁক করে নিশ্বাসটা গিলে ফেলল। এ কী? মাত্র বিশ গজ দূর থেকে? রূং-এর গায়ে লেগে রাইফেলের বুলেট ফিরে এসেছে। যেমন আসে ট্যাঙ্ক-এর গায়ে প্রতিহত হলে?

উন্মাদের মতো সে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে লাগল। কিছুতেই কিছু হয় না। লাগে আর ঠিকরে পড়ে। রূং অব্যাহত গতিতে এগুচ্ছে। মাত্র ছ-ফুট দূরে রয়েছে ওটা। এইবার জিমের খেয়াল হল, রূং তার আবের তলা থেকে বার করেছে আঁকশিমুখো ঝিকমিকে আঙুল কয়েকটা, সেইসব আঙুলে উঠোনো রয়েছে পিচকারির মতো এক ফাঁকা নল, তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা চুইয়ে পড়ছে সবুজ একটা তরল পদার্থ।

জিম পিছন ফিরে দৌড়োল তিরবেগে।

মানুষটা তেমন মোটাসোটা নয়, দৌড়োনো তার অভ্যাসও আছে। রূংকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সহজ তার পক্ষে। রূং অত জোরে দৌড়োতে পারবে না। পারলে কি আর দৌড়োত না? ওর গতিবেগ সীমাবদ্ধ।

কিন্তু, হোক-না সীমাবদ্ধ! না-পারুক বেগ বাড়াতে! তাতেও কি ওর শিকারের নিস্তার আছে? রূং যদি সারাদিন ওই পাঁচ মাইল বেগেই দৌড়োতে থাকে, তার যান্ত্রিক দেহে ক্লান্তি আসবে না। ওদিকে যে জীব তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে? সে কতক্ষণ একটানা দৌড়োতে পারবে? সে তো দু-ঘণ্টা দৌড়োলেই নেতিয়ে পড়বে অবসাদে!

জিম দৌড়োচ্ছে তার ফেলে-আসা আস্তানার দিকে। সেখানে তার মালপত্র আছে বলেই নয়, ওয়াল্ট লেনার্ড সি-প্লেন নিয়ে নামবে সেইখানেই। তা ছাড়া, এক গাদা ডিনামাইট রয়েছে সেখানে। রাইফেল ব্যর্থ হয়েছে, এখন ডিনামাইটে ওড়ানো যায় কি না এই দুশমনকে, সেটার পরীক্ষা হতে পারে, সেই নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পৌঁছোতে পারলেই।

দৌড়োচ্ছে জিম, আর একটা একটা করে ভারী জিনিস ফেলে যাচ্ছে পথে। গেল খাবারের ঝোলা, গেল যন্ত্রপাতি, তারপর গায়ের কোট, পায়ের বুট। দিনটা গরম, তায় দৌড়ের দরুন দেহ আরও গরম হয়েছে। জামা, জুতোর অভাবে হঠাৎ ঠান্ডা লেগে মারা পড়তে হবে না। আর রূং-এর জাদুঘরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে ঠান্ডা লেগে মরাও কি ভালো নয়?

ভারী জিনিস একমাত্র রয়েছে রাইফেলটা। এটাও কি ফেলে দিতে হবে? নিরুপায় না-হলে নয়। সমুখে একটা খাড়া টিলা পেয়ে আঁচড়-পাঁচড় কেটে তার মাথায় চড়ে বসল জিম। রূংও এসে দাঁড়িয়েছে সেই টিলার নীচে। জিম অনেকখানি নিশ্চিন্ত। ওই আধা ভরতি বস্তার মতো থলথলে দেহ নিয়ে রূং কি আর পাহাড়ে উঠতে পারবে?

না, তা পারল না, কিন্তু হাত বার করল তিনখানা। ধাতুর হাত, মাথায় আঁকশির মতো নখ। এক একটা বাঁশের মতো লম্বা। তা দিয়ে অনায়াসে টিলার মাথা নাগালে পাবে। উঠে আসছে সেই তিনখানা হাত। জিম দিল লাফ উলটো দিক দিয়ে। লাফিয়ে পড়ল টিলার মাথা থেকে সমতলে। মরে যেতে পারত, কিন্তু রূং-এর জাদুঘরে আশ্রয় নেওয়ার চাইতে মরা মন্দ কী? পড়েছিল ঝোপের উপরে, চোটও বেশি লাগেনি।

তিনখানা ধাতুর হাত গুটিয়ে নিয়ে পশ্চাদ্ধাবন করতে খানিকটা সময় লাগল রূং-এর। ইতিমধ্যে জিম এগিয়ে গিয়েছে খানিকটা। টিলার মাথায় বিশ্রামও পেয়েছে মিনিট দশেক। আবার কিছুক্ষণ ও যুঝতে পারবে।

আগের দিন ঘণ্টা দশেক সে হেঁটেছিল, মাইল ত্রিশ-বত্রিশ। আজ সেই দূরত্বটাই সে ছুটে পেরিয়ে এল ছ-ঘণ্টায়। নিজের আস্তানায় যখন পৌঁছোল হাঁপাতে হাঁপাতে, তখন রূংও কিন্তু সামান্য কয়েক মিনিটের পথ পিছনে রয়েছে। তাও থাকত না পিছনে, যদি-না এক অতিকায় ভালুক এসে রূং-এর পথ আটকাত।

আটকাল কয়েক মিনিটের জন্যই। একখানা প্রকাণ্ড খাঁড়া বেরিয়ে এল রূং-এর আবের ভিতর থেকে, আর ভালুকের গলাটা চিরে ফেলল একটি কোপে। তারপর সে আবার অনুসরণ করল জিমের।

এই ফাঁকে জিম তার ডিনামাইট এনে সাজিয়ে ফেলেছে পথের উপরে। বরাবর জিম লক্ষ করছে যে, ওরই পায়ের দাগ অনুসরণ করে করে রূংটা অনুসরণ করছে ওকে। কাজেই—

যে পথে ও নিজে এসেছে, সেই পথের উপরে ডিনামাইট সাজিয়ে রাখলে, রূংও নিশ্চয় সেই ডিনামাইটের উপর দিয়ে হাঁটবে। রূং-এর ওখানে পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে, একটা হিসাব করে নিল ও। তারপর ডিনামাইটে পলতে লাগিয়ে দৌড়ে চলে গেল দূরে।

একটা শব্দ যেন কোথা থেকে কানে আসছে জিমের। কিন্তু এমন সময় নেই, যে চারিদিকে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করবে, যে শব্দটা কীসের বা কোথা থেকে আসছে। একবার মনে হল, তারই মাথার ভিতর থেকে বেরুচ্ছে ওটা। মাথা ঘুরছে, টলছে, ফেটে যেতে চাইছে— উত্তেজনায়, পরিশ্রমে, নৈরাশ্যে। ডিনামাইটেও যদি না-মরে রূং? রাইফেলে মরেনি, রকি পর্বতের রাজা ভালুক ওর কিছু করতে পারেনি। ডিনামাইটও যে ব্যর্থ হবে না ওই অমর যন্ত্রদানবের বেলায়, তা কে বলতে পারে?

ডিনামাইটের গাদার উপরে উঠেছে রূং। জিমও পলতেয় আগুন দিল। আর প্রলয় নির্ঘোষে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ হল যেই, সেই আওয়াজে ওরও মাথার ভিতরে একটা বিস্ফোরণ হয়ে গেল যেন। জিম উলটে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

না মরেনি জিম, মাথার শিরা ছিঁড়েও না, রূং-এর কবলে পড়েও না। সে বেঁচে গেল। কারণ সোঁ সোঁ শব্দ যেটা একটু আগে হচ্ছিল সেটা সি-প্লেনের। ওয়াল্ট ফিরে এসেছে।

জিমের যখন জ্ঞান হল, তখন তাকে নিয়ে সি-প্লেন আকাশে উড়ছে। আস্তানা ছেড়ে যায়নি অবশ্য, রূংকে ওই দেখা যায়, মামুলি পাঁচ মাইল বেগে ও ফিরে চলেছে ওর জাদুঘরে।

‘মরেনি ডিনামাইটেও?’ ক্রুদ্ধ জিম আরউইনের প্রথম জিজ্ঞাসা।

‘না, মরেনি।’ বলল ওয়াল্ট। ‘কিন্তু কী ওটা? ব্যাপার কী?’

জিম সব বলল। ওয়াল্ট একটু ভেবে, হেসে বলল, ‘ইউরেনিয়াম না-পেয়ে থাকি, নেই? রোজগারের পথ খুলে গেছে। রূং অন্তত ছ-ঘণ্টা সময় নেবে তার জাদুঘরে ফিরতে। আমাদের লাগবে চার মিনিট। কাজেই ওর সংগ্রহ থেকে এই বেলা বেছে বেছে গোটাকতক লক্ষ বছর আগেকার জীবন্মৃত জীবকে যদি আমরা প্লেনে তুলে ফেলি, তাদের দাম বাবদ সভ্য জগতের যেকোনো মিউজিয়াম পঞ্চাশ ডলার আমাদের গুনে দেবে।’