৯. অর্জুন
মিতুলের অর্জুনকে খুব পছন্দ ছিল। ওর বিয়ের সময়ে অর্জুনও প্রচুর খেটেছিল সংকর্ষণ, শিবু, নীলুর সঙ্গে। মা-বাবা একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিতলির ব্যাপারে। তখনই অর্জুন কমনওয়েলথ স্কলারশিপটার জন্য চেষ্টা করছে, আর তিতলিকেও উৎসাহ দিচ্ছে বাইরে যাবার জন্য।
‘সোনার বেনেদের বাড়ির বউ হবি?’ মৌসুমী গোপন সুরে বলেছিল,—’জানিস তো? ওরা কী করে? জেনে রাখ—ওদের ট্রেডমার্কটা। বিকেলে গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, পশ্চাদ্দেশে আলতা মেখে, বিনা পেটিকোটে হাওয়ার মতো হালকা ফিনফিনে বেগম বাহার শাড়ি পরে, খোঁপাতে সোনার চিরুনি গুঁজে, মাথা অবধি হিরের গয়না পরে বেনে বউরা ছাদে ওঠে বিকেলের ঠান্ডা হাওয়া খেতে। তখন আশপাশের সব বাড়ির ছেলেরাও হুড়োহুড়ি করে যে যার ছাদে হাওয়া খেতে। অর্জুনকে বিয়ে করলে কিন্তু তোকেও রোজ বিকেলে ওই কর্ম করতে হবে, বুঝলি? পেছনে আলতা মেখে—’
‘চুপ। এক থাপ্পড় মারব—ফের যদি—যততো বাজে কথা—পারিসও বাবা তুই—কে বিয়ে করছে রে অর্জুনকে?’
‘কেন, তুমি?’ রিলা বলত। ‘অমন রাজপুত্তুরের মতো বর খবদ্দার ছেড়ে দিবি না,—মৌ স্রেফ হিংসে করে ওইসব বলছে। পেলে ও-ও ছাড়ত নাকি?’
তখনও মৌ দিল্লি স্কুলে যায়নি, তখনও দেবের সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। মোটামুটি ধরেই নিয়েছিল সকলে, সকলে মানে কলেজে এবং বাড়িতে—যে তিতলির বিয়ে স্থির। অর্জুনের সঙ্গে। অর্জুন সুপুরুষ, সচ্চরিত্র, বিদ্বান এবং পুরুষানুক্রমে ধনী।—সুপাত্র হতে তার কোনও বাধাই নেই। জাতপাত নিয়ে কে আর মাথা ঘামাচ্ছে এখন? বেনেতে-বামুনে বিয়ে হলে, হবে। অমন কত হচ্ছে! বামুন-কায়েতে তো হলই, মিতুলের বেলা। ছেলে নিয়ে কথা।
ছেলেটা ভালো, আর বাবা-মা দুজনেই মাটির মানুষ। ওঁদের পরিবারের মেয়েরা বেশি দূর পড়ে না, তাই তিতলির উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাঁদের গর্বের অন্ত ছিল না। অর্জুনের ঠাকুমা জীবিত ছিলেন। ঠাকুমা তখনই আদর করে তিতলিকে নাতবউ বলে ডাকতেন। অর্জুন মিটির মিটির হাসত, বাধা দিত না। কলেজ থেকে প্রায়ই ওদের বাড়িতে গিয়ে অনায়াসেই অর্জুনের বিরাট খাটে শুয়ে একঘুম দিয়ে নিত তিতলি। অর্জুন অবশ্যই ঘরে থাকত না তখন ওর ছোট, ছোট ভাইঝি-ভাইপোরা এসে তিতলির কাছে ঘেঁষে শুতে চেষ্টা করত। গল্প শুনতে চাইত। দরজা সবসময়ে খোলা রাখা ও বাড়ির নিয়ম ছিল। সে তুমি ঘুমিয়েই থাকো আর জেগেই থাকো। প্রিভেসি বলে কোনও ব্যাপার ছিল না। সব্বাই আসছে-যাচ্ছে। অত বড় বাড়ি, বাড়িভরতি মানুষ, তবু অর্জুনের একলার জন্য দু-খানা বড় বড় ঘর। একটা পড়বার আরেকটা শোবার। ছেলেদের খুবই আদর দেওয়া হয় ও বাড়িতে। আর পড়ুয়া ছেলে বলে অর্জুনের তো খাতিরের অন্ত ছিল না। পড়াশুনোর খুব একটা চল ছিল না তো ও-বাড়িতে।
তিতলিদের তো একটা নিজস্ব পড়ার টেবিল পর্যন্ত ছিল না। পড়ার ঘর তো নয়ই। দাদা তো বাড়িতেই পড়তে পারত না।—এমনকি শুতেও পেত না বাড়িতে। কী অদ্ভুতভাবেই পড়াশুনোটা চালিয়েছে দাদা! তখন এতটা বুঝতেও পারেনি তিতলি।
কিন্তু অজুর্ন এখানে কী করছে? কলকাতায়? বুকের মধ্যে ভীষণ এক ঝোড়ো বাতাস গজরাচ্ছে—দুলতে দুলতে দোলনা হঠাৎ অনেকটা উপরে উঠে গেল যেমন বুকের মধ্যে ফাঁকা লাগে, কান ঝিমঝিম করে, অনেকটা সেইরকম লাগছে এখন তিতলির।
একমাথা বাদামি চুল তেমনি আছে, একটুও পাতলা হয়নি—একটুও পাক ধরেনি। একটু কি ক্লান্ত? শিরদাঁড়াটা একটু কি কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো? এখনই? কতই বা বয়েস? অর্জুনের পরনে হলুদ র্শাট, ফ্যাকাশে ব্লু জিনস। পায়ে দামি জুতো। কিন্তু ঠিক NRI NRI দেখাচ্ছে না। মনে হচ্ছে না বাইরে থেকে মাত্র দু-দিন এসেছে, চলে যাবে বিদেশের আবার। মিতুলকে দেখলেই যেমন বোঝা যায়, ও কলকাতায় থাকে না। ও বিদেশের মানুষ। কেন, কীজন্য, সেটা ব্যাখ্যা করা শক্ত। নিশ্চয়ই ওদের হাবভাবে, সাজগোজে, চলাফেরায় কিছু একটা আছে, যেটা ধরিয়ে দেয় ওরা প্রবাসী। মেয়েদের বেলায় এটা যতটা বেশি করে বোঝা যায়, ছেলেদের বেলায় অতটা না। কাচের ঘর থেকে তিতলি ভালো করে দেখে নিল ওকে। আরেকবার। দীর্ঘকায়। সুপুরুষ। বুদ্ধিমান। চোয়ালের হাড়ে চৌকো একটা নিষ্ঠুর কোণ আছে। অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে কতগুলো কাগজপত্র ধরে। চোখের চশমার ফ্রেমটা নতুন। ও কি প্রবাসী? ও কি প্রবাসী নয়? চেহারা কিছুই বলে দিচ্ছে না। কত বছর পরে ওদের দেখা হল? একযুগ কেটে গেছে। শেষবার দেখা হয়েছিল ইংল্যান্ডে—তিতলি যখন আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে—পথে থেমেছিল, অর্জুনের সঙ্গে দেখা করবে বলে। সেই শেষবার।
.
সৌমী ঝকঝকে মেয়ে। পনেরো মিনিটের কাজ দশ মিনিটে সেরে ফেলল। আবার দু:খ প্রকাশ করল, ব্যাংক খোলা, তাই যেতে পারবে না শ্রাদ্ধসভায়। কিন্তু মৎস্যমুখীতে যেতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। নিজেই একটা সান্ট্রো চালিয়ে ঘুরে বেড়য় সৌমী।
ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিতলি। দেখল তারই ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে বসে সেই সব কাগজপত্তর পড়ছে অর্জুন। ওর আসাটা জানতেও পারেনি, এতই মনোযোগ।
‘অর্জুন।’
‘কেঁপে উঠল। দৃশ্যত কেঁপে উঠল অর্জুন। কয়েকটা দরকারি কাগজ খসে পড়ল কোল থেকে। তাড়াতাড়ি তিতলি নীচু হয়ে কুড়িয়ে দিল—’স্যরি, চমকে দিলাম।’
‘এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?’ কাগজপত্র গুছোতে থাকে অর্জুন।
‘হয়ে গেল! শি ইজ ভেরি এফিশিয়েন্ট।’
‘সত্যি, আই টু অ্যাডমায়ার হার হিউজলি।’ সামান্য হেসে একটা ইতস্তত করে অর্জুন বলে, ‘চল না, কোথাও গিয়ে একটু বসি। বসবি?’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিতলি বলল, ‘ইনফ্যাক্ট, পারলে খুব ভালো লাগত। কিন্তু আজকে সম্ভব নয়। বলতেও খারাপ লাগছে রে। এতদিন পরে দেখা হল। কিন্তু মায়ের শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে বেরুব দিদির সঙ্গে—দিদি এসে বসে থাকবে বাড়িতে।’
‘বেরুবি? কষ্ট করে কেউ তো আর বাড়ি যায় না, কুরিয়ারে কার্ড পাঠিয়ে দেয়। আর ফোন করে মুখ বলে দেয়। সংকু কোথায়?’
‘এসেছে বোম্বে থেকে। ওর তো বউ পার্শি, একটু অন্যরকম। দাদা শ্রাদ্ধের দিন যা করার সবই করবে। এখন আমরা করছি সলতে পাকানোর কাজটা।’ তিতলি হাসে। ‘কার্ডটা হারিয়ে ফেলিস না। ওতে অ্যাড্রেসগুলো আছে। শ্রাদ্ধ একুশে, মঠে। ‘মৎস্যমুখী,’ তেইশে। পারলে যাস—মা তোকে স্নেহ করতেন।’
অর্জুন উত্তর দেয় না। বড় দরজাটা খুলে ধরে তিতলির জন্য। দুজনে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
‘ ”মৎসমুখী”-টা মার জন্য কেনা নতুন ফ্ল্যাটেই হবে—আয়রনি অফ লাইফ—’ তারপরই তিতলি সন্ধিগ্ধ সরু চোখে জুড়ে দেয়—’তুই এখনও মাছ-মাংস খাস তো? নাকি, গুজরাটিদের মতো—’ তিতলিকে কথা শেষ করতে দেয় না অর্জুন।
‘তা খাই। গুজরাটি হওয়াটা কমপ্লিট হয়নি।’
হঠাৎ সব কথা ফুরিয়ে যায়। একটা ভারী নৈ:শব্দ্য দুজনের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে। কথা কইতে-কইতে ওরা রাসবিহারী এভিনিউতে এসে পড়েছে। সামনে একটা ট্যাক্সি পেয়েই হাত তুলে থামাল তিতলি। উঠে পড়ে অর্জুনকে বলল—’তোকে কোথাও নামিয়ে দিতে পারি?’
‘আমি তো উলটোদিকের যাত্রী’—
‘তাহলে চলি? মনে থাকে যেন একুশে সকালে, আর তেইশে বিকেলে— কার্ডে আমার মোবাইল নম্বরও আছে—সীয়ু’—অর্জুনের এক হাতে কার্ডটা, অন্য হাতে ব্যাংকের কাগজপত্র। হাত তুলে অর্জুন বলে—’সীয়ু।’