পৃথিবী যখন ধ্বংস হল
ফট-ফট-ফট-ফট মোটরবোট চলেছে বার্টের।
খাল এখানে তত চওড়া নয়, জোর মাইল দেড়েক-দুই। অবশ্য এটা শাখা মাত্র। মূল খাল, যা মেরু থেকে মেরু পর্যন্ত চলে গিয়েছে মঙ্গল গ্রহটার বুক চিরে। তার প্রসার এক এক জায়গায় ষাট মাইল পর্যন্ত রয়েছে।
শাখা যে কত, তার গোনাগুনতি নেই। উপনিবেশ থেকে এই চারদিনের রাস্তা অতিক্রম করে আসতে আসতে ডাইনে-বাঁয়ে কয়েক-শো চোখে পড়েছে বার্টের। তার কোনোটাই দেড়-দু মাইলের কম নয় বিস্তারে। তারাও আবার দেদার উপশাখা ছড়িয়ে দিয়েছে এধারে-ওধারে। শাখার শাখা, তস্য শাখা, সবচেয়ে কনিষ্ঠ যারা, তাদের উপর দিয়ে, মঙ্গলের মানুষ না-পারুক, বার্টের মতো পৃথিবীর মানুষ লাফিয়েই এপার-ওপার করতে পারে অনায়াসে।
ওসব শাখা-প্রশাখাতেও বার্ট যাতায়াত করে থাকে বই কী! খদ্দের আছে ওর সবদিকেই। গ্রহটার একান্ত নিরালা কোণে কোণেও। খালের ধারে ধারে এক একখানা ভাঙা বাড়ি। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়িতে যেতে হলে মোটরবোটেও এক বেলার ধাক্কা। গ্রাম বলে কিছু নেই মঙ্গলে, কোনোদিনই ছিল না বোধ হয়। আছে অবশ্য শহর। অর্থাৎ শহরের ভগ্নাবশেষ। পেল্লায় পেল্লায় শহর যে সেকালের বড়োকত্তারা গড়েছিলেন মঙ্গলে, গত দশ বছর ধরে প্রত্যেকবারের নিঃসঙ্গ জলযাত্রায় বার্ট তার নতুন নতুন পরিচয় পেয়েছে।
কারা যে ছিলেন ওই বড়োকত্তারা, মঙ্গলের মানুষ কেউ এখন তা বলতে পারে না। তাঁরা সব নিঃশেষ হয়ে গেছেন। তাঁরাই গড়েছিলেন ওইসব শহর, ওইসব নিভৃত পল্লিভবন, তাঁরাই কেটেছিলেন এইসব অগণিত খাল-উপখাল মরুভূমিকে সরস শ্যামল করবার জন্য। তাঁরা আজ আদৌ নেই, তাঁদের বাড়ি আর শহরও ভেঙে পড়ে আছে, কিন্তু অজর অক্ষয় হয়ে এখনও গ্রহ জুড়ে বিরাজ করছে নীল জলের সম্ভার নিয়ে ওই আশ্চর্য রকমের সোজা রহস্যময় খালের মালা।
নীল জলের দুই কূলে সবুজ খেত। তাদের বিস্তার খুব বেশি নয়। আধ মাইলের বেশি নয় কোথাও। খেতটুকু ফুরোলেই শুরু হল লাল ধুলোয় ঢাকা দিগন্তবিস্তারী প্রান্তর। তাদের মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো রুক্ষ পাহাড়, নিরেট লাল পাথরের স্তূপ এক একটি। এই সর্বগ্রাসী লাল রঙের দরুনই পণ্ডিতেরা ‘লাল গ্রহ’ নামকরণ করেছিলেন মঙ্গলের, আর ওরই অধিষ্ঠাতা দেবতাকে কল্পনা করেছিলেন রণদেবতা বলে।
উপনিবেশ থেকে বেরুবার সময় কোনোবারই বার্ট পথের মাঝে কোথাও থামে না, সোজা চলে যায় তার টহল-সীমার শেষপ্রান্ত অবধি, পুরো পাঁচদিনের পথ মোটরবোটের। এখানে অ্যানিকার খামার, একটা ভাঙা বাড়িকে ঘিরে বারোখানা খেত, যার মোট আয়তন পৃথিবীর পরিমাণে কুড়ি একরের বেশি হবে না। নদীর অঢেল জল সত্ত্বেও সেসব খেতের কোনোরকম শস্যেই পৃথিবীর ধান যব গমের সতেজ শ্যামলিমা নেই, কেমন যেন হলুদপানা মরাংচে চেহারা তাদের।
হ্যাঁ, উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে প্রতিবারই সে সোজা চলে আসে অ্যানিকার খামারে। এখানকার কাজ সেরে ফেরার পথে একে একে দেখা দেয় অন্য খরিদ্দারদের খামারে। পুরো চক্কোরটা সমাধা করে উপনিবেশে ফিরতে মাস তিনেক লাগে তার। ফেরার সময় আর কাজ নেই কিছু বিশেষ। একটা ঝালাইয়ের দোকান ওর আছে বটে কলোনিতে, কিন্তু তাতে আর ক-টা বাসন আসে রোজ? তার মতে ঝালাইওয়ালা গণ্ডা গণ্ডা রয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, আর সেসব লোকের উপরে আস্থাও বেশি উপনিবেশিদের। কারণ তারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর হাজির থাকে দোকানে, বার্টের মতো হঠাৎ ডুব দেয় না দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে।
ডুব? না-দিয়ে পারে না বার্ট। উপনিবেশের অন্য সবাইয়ের মতো দিনের পর দিন শুয়ে-বসে জাবর কাটতে সে পারে না। সকালটা দোকানে বসা, বিকালটা পথে পথে আড্ডা দেওয়া, সন্ধ্যাটা ক্লাবঘরে গিয়ে সস্তা দেশি মদ ঢক ঢক করে গেলা, আর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর জন্যে হা-হুতাশ করা— এরকমভাবে জীবনযাপন করতে পারে না বার্ট।
হারিয়ে গেল পৃথিবীটা। বিধ্বস্ত, বিলুপ্ত হয়ে গেল বার্টের চোখের সামনেই। ও তখন আকাশপথে; মঙ্গলযাত্রী আন্তর্গ্রহ-বিমানে যান্ত্রিকের পদ নিয়ে সেইবারই সে প্রথম বেরিয়েছে মহাশূন্য অভিযানে। বয়স তখন মাত্র একুশ।
যাত্রা শুরুর পর চারদিনের দিন রাত্রি বেলায় ওটা ঘটল। বার্টের তখন কাজের পালা নয়, নিজের দোলনায় সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ কে তাকে টেনে নামাল। ‘ওঠ! ওঠ! শিগগির আয়! দ্যাখ এসে কী সর্বনাশ হচ্ছে!’
কোনোরকমে পোশাকটা গায়ে চড়িয়ে আবেগের সঙ্গে সে বেরিয়ে এসেছিল। হাওয়া চলাচলের জন্য সারি সারি গবাক্ষ বিমানের গায়ে। বন্ধ ছিল সবই। একটা টেনে খুলে ফেলল আবেল, বার্টকে নিয়ে দাঁড়াল সেইখানে।
নীচে ওই পৃথিবী। কী হচ্ছে ওখানে? আগুন! আগুন! লেহি-লেহি শিখা উঠছে আগুনের, দাউ দাউ করে জ্বলছে পর্বতপ্রমাণ প্রলয় বহ্নি। পৃথিবীর বুক ফেটে শতচির হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটা ফাটল থেকে রক্তজটার ঝাঁকানি দিয়ে উল্লম্ফে বেরিয়ে পড়ছে অগ্নিপিশাচেরা, বুঝি-বা বার্টদের এই পলাতক প্লেনখানাকে পায়ের তলায় টেনে নামাবার জন্য।
কেউ বলল দেশে দেশে মজুদ পারমাণবিক বোমার গাদায় গাদায় বিস্ফোরণ ঘটেছে একসাথে। কেউ আবার তর্ক তুলল, তা যদি হত, পৃথিবী ফাটত না, নীহারিকার আকারে জ্বলতে জ্বলতে ক্রমশ বিলুপ্তির মুখে এগিয়ে যেত। আসল কথা, কেউ-ই কিছু বুঝতে পারেনি। স্রেফ এইটুকু ছাড়া যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে পৃথিবী, নুড়ির মতো ক্ষুদে ক্ষুদে গ্রহাণুর বিস্তীর্ণ এক বলয় রচনা করেছে সূর্যের চারদিকে অনন্তকাল ধরে ঘুরপাক খাওয়ার জন্য।
জননী ধরণীর অপঘাত মৃত্যু চোখে দেখেও কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চায়নি অনেকের। চায়নি বার্টেরও। অনেকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সেও দাবি তুলেছিল, বিমান পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়া হোক। পৃথিবীতে, মানে যেখানটাতে ছিল পৃথিবী, সেই জায়গাটাতে। কী হল, তা দেখা উচিত। যদি কোনোদিক দিয়ে সাহায্য করা যায়, তাও করা উচিত। বিমানের অধ্যক্ষ কিন্তু সায় দেননি বার্টদের প্রস্তাবে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ফিরে যাওয়া শুধু নিরর্থক নয়, বিপজ্জনকও।
বিপজ্জনক, কারণ পৃথিবী নেই, তার সে আবহাওয়াও নিশ্চয়ই নেই। সেখানে ফিরে গেলে অন্য কোনোভাবে না-হলেও নিশ্বাস নেবার মতো বাতাসের অভাবেই মারা পড়তে হবে। মঙ্গলে যাওয়ার জন্য বেরুনো হয়েছে, মঙ্গলেই যাওয়া যাক। সেখানে উপনিবেশ আছে। হাজার দুই মানুষ আছে সেখানে। পৃথিবীরই মানুষ, শতাধিক বছর তারা বাস করছে সেখানে। পৃথিবীর সভ্যতারই একটা ধারা সেখানে বইছে, তা সে ধারার প্রবাহ যত ক্ষীণই হোক।
মঙ্গলে পৌঁছোল তারা। আরও আরও বিমান এসে নামতে লাগল, একটা একটা করে। পৃথিবী থেকে এরা অভিযানে বেরিয়েছিল, কেউ শুক্রে, কেউ বৃহস্পতির কোনো একটা চন্দ্রে, কেউ-বা অন্য কোথাও। কেউ বাণিজ্যিক ব্যাপারে, কেউ উপনিবেশ স্থাপনের যোগ্য নতুন কোনো গ্রহ আবিষ্কারের আশায়, কেউ-বা শুধুই বৈজ্ঞানিক গবেষণার দায়িত্ব নিয়ে। এরা ফিরে এল মঙ্গলে, কারণ পৃথিবী নেই এবং মঙ্গলই হল একমাত্র গ্রহ, যেখানে পৃথিবীর জীবনের স্বাদ খানিকটা পেতে পারে পৃথিবীর মানুষ। যেমন ঘোল খেয়ে দুধের স্বাদ আন্দাজ করার চেষ্টা করে অনেকে।
একুশ বছর বয়সে বার্ট নেমেছিল মঙ্গলে, এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। দীর্ঘ চোদ্দো বছর। মানুষটা সে বরাবরই ভবঘুরে প্রকৃতির, দুঃসাহসিক। মঙ্গলের উপনিবেশে ক্রমোন্নতির যে প্রেরণা আসত পৃথিবী থেকে, তার উৎস এখন শুষ্ক। সে অভাবের ফল হয়েছে মারাত্মক। উপনিবেশিরা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। দুই ডজন বিমান অলস হয়ে পড়ে আছে, একটাও আকাশে ওড়ায় না কেউ!
চাষবাস, ঘরবাড়ি গড়া, অল্পস্বল্প কারিগরি— যেটুকু নইলে গেরস্তালির কাজই অচল হয়ে পড়ে, এই নিয়েই তুষ্ট আজকাল উপনিবেশিরা। কোথায় গেল খনি খুঁড়ে পাথর তোলা, কোথায় গেল মেরুতে মেরুতে ঘুরে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করা। দিনের অর্ধেক কাটে ঘুমে, সিকি ক্লাবে, বাকি সিকিটুকু সময় একান্ত অনিচ্ছুক ভাবেই ওরা কাজ করে। যে কাজটুকু না-করলে চলবেই না, সেইটুকুই শুধু।
এ জীবন বরদাস্ত হয়নি বার্টের। তাই সে উপনিবেশে টিকতে পারে না। তাই সে বেরিয়ে পড়ে খালে খালে বিচরণ করবার জন্য। এ মোটরবোট তার নিজের হাতে তৈরি। দু-বছর লেগেছিল তৈরি করতে, কারণ বোট তৈরি করার রেওয়াজ নেই এখানে, জানেও না কেউ ও-বিদ্যে। বার্টই কি জানত? না-জেনেও সে গড়ে তুলেছে একখানা। দেখতে মোটেই ভালো হয়নি, কিন্তু কাজ দেয় সুন্দর।
উপনিবেশিরা মনে করে, বার্ট একটা আধ-পাগলা।
আজ দশ বছর খালে খালে ঘুরছে বার্ট। গিয়েছে মঙ্গলের সব অঞ্চলে, ঢুকেছে নানা সম্প্রদায়ের ঘরোয়া মহলে। চোদ্দোটা ভাষা চালু রয়েছে মঙ্গলবাসীদের ভিতরে। তার মধ্যে চারটি ভাষায় বার্ট কথা কইতে পারে মঙ্গলিদেরই মতো, বাকি দশটাতেও কাজ চালিয়ে নিতে পারে মোটামুটি রকমে।
কোনো বাড়িতে প্রথম বার যখন যায় বার্ট, বাড়ির লোকগুলির নাম লিখে নেয় খাতায়। দ্বিতীয় বার সেখানে যাওয়ার আগে সেই নামগুলি পড়ে নেয় একবার। ফলে যখনই যেখানে যাক, অন্তরঙ্গভাবে কথা কইতে পারে সকলের সঙ্গে। এমন লোককে কে-না ভালোবাসবে? যেখানে যায় বার্ট, সেইখানেই তার সমাদর। তার কাজের খাতিয়ে নয়, তার স্বভাবের খাতিরে।
অ্যানিকার বাড়িতে বোট ভিড়িয়ে বার্ট ডাঙায় নামল পাঁচ দিনের দিন। একটা ঝোলায় ঝালাইয়ের যন্ত্রপাতি, পরনে ছেঁড়া পোশাক, পায়ে ছেঁড়া জুতো। নিজের হাতে তৈরি জিনিস, কারণ কিনতে তো পাওয়া যায় না ওসব। আগে ওসব জিনিস চালান আসত পৃথিবী থেকে। এখন তো আর আসে না। অথচ এখানে ওসব তৈরি করবার মতো কলকারখানা গড়ে ওঠেনি, উঠবেও না। গড়বে কে? উপনিবেশিদের উৎসাহ কোথায়?
মঙ্গলের সব বাড়ি যেমন, অ্যানিকার বাড়িও তেমনি ভাঙা। বড়োকত্তারা গড়ে গিয়েছিলেন এসব বাড়ি, সেই কত শতাব্দী আগে। নিরেট পাথরে গড়া হলেও উপরতলাটা ভাঙা, অব্যবহার্য। নীচের তলায় অনেক ঘর। বসবাসের জন্য আর ক-টা কামরা দরকার হতে পারে? দুই-একখানা গোলাঘর হিসেবে ব্যবহার হয়, বাকি সব পড়ে থাকে বন্ধ হয়ে।
বন্ধ থাকে বলেই যে খালি থাকে, তা কিন্তু নয়। প্রত্যেকটা ঘরে দশ-বিশটা করে বেনিকুকের আড্ডা। অনেকটা পৃথিবীর কাঠবিড়ালের মতো। তফাত এই, এরা সব পোষমানা। আর মস্ত গুণ, কোনো ক্ষতি করে না গেরস্তর। হাতে করে ছড়িয়ে না-দিলে কোনো জিনিস খাবে না। মানুষের আদরের ভিখিরি, আদর করেও মানুষকে। গৃহপালিত জীব বলতে মঙ্গলে বেনিকুকেরাই।
বার্ট জানে তা। তাই তার মোটরবোটে বড়ো একবস্তা চিনে বাদাম থাকে প্রতিবারই। যেকোনো বাড়িতে উঠবার আগে পকেটে সে কয়েক মুঠো বাদাম ভরে নেয়, আর বাড়ির ভিতর ঢুকবার আগে ওগুলো ছড়িয়ে দেয় বেনিকুকদের জন্য। দেখতে দেখতে দলে দলে ছুটে আসে আদুরে বেনিকুকেরা, এক একটা করে বাদাম মুখে নিয়ে পরস্পরে রেষারেষি শুরু করে বার্টের কাঁধে চড়ে বসবার জন্য।
আগে দোরগোড়ায় বাদাম ছড়িয়ে দিয়ে তারপর অ্যানিকার দিকে তাকাল বার্ট। অ্যানিকা ওদিকে দাঁড়িয়ে যবুই গুঁড়ো করছে হাত-ঢেঁকিতে, পৃথিবীর যবেরই এক বন্য সংস্করণ ওই যবুই। যবুই নামটাও উপনিবেশিদের দেওয়া। আদিবাসিদের ভিতরে ওর অন্য নাম আছে— কুহিলাং-বিট্টো।
অ্যানিকার মুখ অন্যদিকে ফেরানো, কাজেই বার্টকে সে এতক্ষণ দেখতে পায়নি। এইবার বেনিকুকদের উল্লাসের চেঁচামেচি শুনে সে ফিরে তাকাল। সমুখে অতিথি দেখেই মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্ভাষণ জানাল, ‘এসো, এসো, পৃথিবীর মানুষ, ক-দিন থেকেই ভাবছি, তোমার আসার সময় হল আবার। আছো তো ভালো?’
নিজের কুশলসংবাদ জানাবার পরে নাম ধরে ধরে এ-বাড়ির প্রত্যেকের খবর জিজ্ঞাসা করতে লাগল বার্ট। যবুই গুঁড়ো করতে করতে অ্যানিকাও জবাব দিতে থাকল হাসিমুখে। ‘বড়োকত্তারা এ গরিবদের মনে রেখেছেন বাবা! তাঁদের দয়ায় সব কিছু ভালোই যাচ্ছে। ফসল উঠেছে ভালো, তবে খেতগুলো কতক কতক পড়ে থাকছে তো! চষে তুলবার লোক কই? সব জমি চষতে পারলে আমি এর চেয়ে তিনগুণ ফসল পেতাম। ওই একটা ছেলে টামনাক, ও আর কত করবে? বড়ো মেয়ে গুইকার স্বামীকে ধরে আনতে হয়েছে কয়েক দিন ব্যাগার দিয়ে যাওয়ার জন্য। তা ওকে তো আর প্রতিবারই পাব না! নিজের খামার আছে তো ওর।’
হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে নিয়ে অ্যানিকা বলল, ‘এবার তোমার জন্য বড়ো কাজ একটা রেখেছি বাবা! বাসনকোসন যন্ত্রপাতি যেমন প্রতিবারই কিছু কিছু থাকে, এবারও রয়েছে তেমনি। কিন্তু আসলে ঠেকে গিয়েছি বড়ো ঘরখানার দরজা নিয়ে। একটা পাল্লা ওর খুলে গিয়েছে। টামনাক অনেক মেহনত করেছে, কিন্তু লাগাতে পারেনি ঠিকমতো। আসলে কারিগরি জিনিসটা আসে না এ দেশের মানুষের। তোমরা পৃথিবীর মানুষেরা কী চমৎকার কাজ করো যে ওসব দিকে! কত অল্প সময়ে কী মজবুত মেরামত! না, কারিগরিতে মঙ্গলের লোক কিছু নয়।’
বার্ট অবাক হয়ে ভাবে, মঙ্গলের মেয়ের মুখে এই কথা? কারিগরিতে মঙ্গলের লোক কিছু না? তা হলে ওই বিরাট খাল কারা খুঁড়েছিল মঙ্গলে? বড়োকত্তারা কি মানুষ ছিলেন না?
অ্যানিকার মুখের কথা আবারও মোড় খেয়েছে, ‘তুমি কেন যে এমন ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াও? থাকো-না! ঘাঁটি হয়ে আমার কাছে থাকো-না! এত খেত-খামার, অর্ধেক আমি তোমায় দিয়ে দেব। ওই জাইলোটা রয়েছে, আমার ছোটো মেয়ে—’
জাইলো? হ্যাঁ, তিনমাস আগেও জাইলোকে দেখেছে বার্ট। পৃথিবীতে মেয়েদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি অবশ্য একটু অন্যরকম, তা হলেও জাইলোকে দেখতে বেশ ভালোই। আর স্বভাব? স্বভাবটি ওর ভারি মিষ্টি!
খাওয়ার সময় জাইলো পাশেই ছিল। কথা এমন কিছু বলেনি সে, কিন্তু না, নিজেকে দুর্বল হতে দেওয়া চলবে না। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল বার্ট। বাইরে গিয়ে আগুন জ্বালল একটু, আর শুরু করল একটার পর একটা বাসনের ঝালাইয়ের কাজ। মাথা নীচু করেই কাজ করে যাচ্ছিল, হঠাৎ একসময়ে কী যেন মনে করে সে মাথা তুলল, আর তুলতেই দেখল, অদূরে বসে আছে জাইলো, ডাগর আঁখির দৃষ্টি খালের জলে ভাসমান বোটখানার দিকে নিবদ্ধ করে।
‘দরজাটা মেরামত করে আসি।’ বলে বার্ট তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।
পরদিন সকালে অ্যানিকারা আবিষ্কার করল, বার্ট চলে গিয়েছে রাত থাকতেই। তার পাওনাগণ্ডাও নিয়ে যায়নি। পাওনাগণ্ডা মানে মুদ্রা নয় কোনো রকমের। উপনিবেশের বাইরে মুদ্রার চল নেই কোথাও। নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে সামান্য খাদ্যসামগ্রী ছাড়া বার্ট কিছু নেয় না।
জাইলোর বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে অ্যানিকা মৃদুস্বরে বলল, ‘ও আসবে আবার। বরাতে ওর আরও কিছু কষ্ট আছে। সেটার ভোগ শেষ না-হলে ঠান্ডা হয়ে বসবে কেমন করে?’
অ্যানিকার খামার থেকে ফিরতি-পথে প্রথমেই পড়ে বাঁয়ের দিকে ফার্গাসের খামার। সেখানে পৌঁছোল দুপুর নাগাদ। এসেই নতুন খবর পেল বার্ট। চোদ্দো বছর পরে মঙ্গলের আকাশে বিমান দেখা গিয়েছিল কাল রাত্রে। ফার্গাস দেখেছে। কোথাকায় বিমান হতে পারে? পৃথিবী আর নেই, এখন মঙ্গলে বিমান পাঠাবে কে?
বার্ট বলল, ‘অন্য কোনো গ্রহ, যার ভাঁড়ারে পৃথিবীরই পুরোনো বিমান মজুদ আছে এখনও।’
ফার্গাসের বাড়িতে ঝালাইয়ের কাজগুলো চটপট সেরে ফেলল বার্ট, তারপর না-খেয়েই বিদায় নিল ওখান থেকে। ওরা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেখে সান্ত্বনা দিল এই বলে, ‘বুঝছো না বন্ধু, কোন গ্রহ থেকে কী খবর এল, জানা তো দরকার। নিজে হাজির থেকে জানা হল একরকম, আর ওরা চলে যাবার পরে উপনিবেশিদের মুখে ঝাল খাওয়া হল অন্যরকম। পরের বার এসে খাঁটি খবর দিতে পারব তোমাদের।’
পাঁচদিন লাগল উপনিবেশে ফিরতে।
বিমান সত্যিই এসেছে। শুক্র থেকে। পৃথিবীর উপনিবেশ শুক্রেও ছিল, তা অজানা নয় বার্টের। যেমন মঙ্গলে, তেমনি শুক্রেও দুই হাজার উপনিবেশি পাঠিয়েছিল তার মাতৃভূমি ওই পৃথিবী। এমন আরও কত কত গ্রহে পাঠিয়েছিল, অপরাপর সৌরমণ্ডলে, অপরাপর ছায়াপথে, তার পুরোপুরি হিসাব আজ কে রাখে?
শুক্র তো এই সৌরমণ্ডলেই! বলতে গেলে প্রতিবেশী। ইচ্ছে করলে অনেকদিন আগেই তারা যোগাযোগ করতে পারত মঙ্গলের সঙ্গে। যেমন পারত শুক্রের সঙ্গে মঙ্গলের উপনিবেশিরাও, যদি সে উদ্যম তাদের থাকত।
শুক্র থেকে বিমান এসেছে রুদারফোর্ড এ-৪। আটজন বৈমানিক ওতে। তাদের নেতা যে, দাড়িওয়ালা ঢ্যাঙাপানা লোক একটা, আজ পাঁচদিন যাবৎ চষে বেড়াচ্ছে উপনিবেশটা। সে একটা বিশেষ মতলব নিয়ে এসেছে। এখান থেকে সে লোক নিয়ে যেতে চায় শুক্রে। যত লোক যেতে চাইবে, নিতে রাজি সে। ওখানে কাজ চলেছে পুরোদমে। শুক্রের মানুষ মঙ্গলের মতো আয়েশি নয়, শুয়ে-বসে গুলতানি করে করে দিনের দিন নিঃশব্দে কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না।
না, তা যাচ্ছে না তারা। পৃথিবী আজ নেই, শুক্রের মাটিতে নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দ্বিতীয় আর এক পৃথিবী, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমুন্নত, সুসভ্য, সমৃদ্ধ, কর্মচঞ্চল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। এ মহৎ প্রচেষ্টাকে রূপায়িত করার পক্ষে জনসংখ্যা তাদের পর্যাপ্ত নয়। মাত্র দু-হাজার। তাতে নারীর অনুপাত কম আবার। বংশবৃদ্ধি মন্থর। তাই তারা মঙ্গলের দ্বারস্থ। আড্ডার মায়া কাটিয়ে যারা শুক্রে যেতে চাইবে, আদর করে তাদের নিয়ে যাবে রুদারফোর্ডের ক্যাপ্টেন। যতজন যেতে চাইবে, ততজনকেই নেবে। দরকার হলে বার বার আসবে সে।
বার্ট নাম লিখিয়ে ফেলল। অন্য চারজন উপনিবেশির সঙ্গে রুদারফোর্ডে উঠে বসল সে শুক্রে পাড়ি জমাবার জন্য। মঙ্গলে জীবনপ্রবাহ স্তিমিত, সে জীবন— মরণের কোলে ঢোলে পড়ছে দিনের দিন। ওদিকে শুক্রের বৃষ্টিঝঞ্ঝা তুষারবর্ষণের নীচে অহোরাত্র উঠছে রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি, প্রতিকূল প্রকৃতিকে মরণপণ যুদ্ধে পরাজিত করে করে পৃথিবীর বীর সন্তানেরা বিজয়কেতন উড়িয়ে দিচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে, খনিগর্ভে, পর্বতচূড়ায়, জলে-স্তলে-অন্তরীক্ষে।
জয় শুক্রবাসীর জয়! ওদেরই সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জীবনের জয়গান গাইবে বার্ট।
শুক্রে পৌঁছোবার পরই বার্ট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল তার চার সঙ্গীর কাছ থেকে। দল বেঁধে কাজ করবার জন্য আনা হয়নি তাদের। সাধারণ কর্মী তো তারা নয়। পৃথিবীর মানুষ যত আছে এ-গ্রহে, কেউই তারা গায়ে-গতরে মেহনত করে না। প্রত্যেকেই এক একটা দলের খবরদারির ভার পেয়েছে, বলতে গেলে ক্ষুদে এক একটা সেনাপতি তারা প্রত্যেকে।
এরা যদি সেনাপতি, তাহলে সৈনিক কারা? গায়ে-গতরে খাটুনিটা খাটে কারা?
গ্রিফারা। শুক্রের আদিবাসি বামনজাতীয় জীবেরা। মানুষেরই মতো, তবে গায়ে লম্বা লম্বা লোম তাদের। আর লম্বায় তিন ফুটের বেশি হয় না। পৃথিবী যতদিন ছিল, শুক্র থেকে রপ্তানির প্রধান জিনিস ছিল গ্রিফাদের গায়ের ওই লোম, অমন উজ্জ্বল শুভ্র পশম পৃথিবীর কোনো জন্তু জানোয়ারদের দেহ থেকে পাওয়া যায়নি কোনোদিন।
গ্রিফারা বনে জঙ্গলে থাকে, সংখ্যায় তারা কোটি কোটি। বনে ঢুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আনলেই হয়। অত্যন্ত ভীতু, নিরীহ জীব ওরা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা মগজেই আসে না তাদের।
মানুষেরা তাদের লাখে লাখে ধরে আনে যখন-তখন। পঞ্চাশ থেকে এক-শোটা গ্রিফার এক একটা দল ছেড়ে দেয় এক একজন দলপতির হাতে, সে ওদের খাটায়, যতদিন না খাটতে খাটতে শ্রান্ত হয়ে ওরা মারা পড়ে।
বলা বাহুল্য দলপতিরা প্রত্যেকেই পৃথিবীর মানুষ। তাদের উপর কড়া হুকুম রয়েছে, দয়া নয়, মায়া নয়— একটা গ্রিফাও যেন এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম না-পায়। দেড়ে-মুশে কাজ আদায় করো। কাজ করতে করতে যেটা মরে যাবে, সেটাকে টেনে ফেলে দিয়ে সেখানে আর একটাকে বহাল করো। বনে গ্রিফার অভাব নেই, একটা মরলে দশটা পাওয়া যাবে।
গ্রিফারা আকারের অনুপাতে দুর্বল নয়, তা ছাড়া নির্বোধ তো নয়ই। যেকোনো কাজ একবার বুঝিয়ে দিলে তারা বুঝতে পারে, আর কাজটা যত শ্রমসাধ্য হোক, বহুজনের মিলিত চেষ্টায় তা সমাধা করে তোলেই। অবাধ্য নয়, উগ্র নয়, চাবুক তুললেই ভয়ার্ত করুণ দৃষ্টিতে দলপতির দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। একজনের উপরে তুললে কাঁপতে থাকে একসঙ্গে পঞ্চাশটা।
চাবুকের প্রয়োগে ঢিলেমি করলে চলবে না, উপরওয়ালাদের কড়া হুকুম। গ্রিফাদের হাড় পাঁজরার উপরে গেঁথে তুলতে হবে শুক্রের বুকে পৃথিবীর সভ্যতা। বার্ট একদিন তর্ক তুলেছিল এক সহকর্মীর সাথে। সে-সহকর্মী আগের আমলের উপনিবেশি, নিষ্ঠুরতার আর হিংস্রতার কট্টর সমর্থক।
বার্টের বক্তব্য ছিল, মানুষ তার নিজের সমৃদ্ধির জন্য গ্রিফাদের সমূলে ধ্বংস করে যদি, সেটা চরম অন্যায় হবে।
সে উত্তর পেয়েছিল মুখের মতন, এক জাতির উপরে শোষণ আর পীড়ন চালাতে না পারলে আর এক জাত বড়ো হতে পারে না কখনো। কোথাও যে কোনো জাত পেরেছে তা, ইতিহাসে এমন নজির নেই। গ্রিফাদের উপর দয়া করতে গেলে শুক্রে মানুষ বড়ো হতে পারবে না কোনোদিন।
সহকর্মী তাকে উপদেশও দিয়েছিল খানিকটা, ‘তুমি শুক্রে এসেছ। শুক্রের নাগরিক অধিকার এখনও পাওনি। সেটা পেতে হবে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে। শুক্রের মানুষেরা নিজেদের জন্য সমাজনীতি রাজনীতি বেঁধে নিয়েছে আগেই, বেছে নিয়েছে নির্দিষ্ট একটা কর্মসূচি। তোমায় যদি যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়, তাহলে মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে হবে সেই নীতি আর সেই সূচি। না-করলে—’
‘না-করলে কী হবে?’ একটু উষ্ণভাবেই প্রশ্ন করেছিল বার্ট।
উত্তর পেয়েছিল, ‘না-করলে দেখতে পাবে যে, মঙ্গল থেকে আসা তোমার বিফল হয়েছে। শুধু বিফল নয়, মারাত্মকও।’
কীভাবে মারাত্মক, তা আর খুলে বলেনি সহকর্মী। তবে আন্দাজ করে নিতে কষ্ট হয়নি বার্টের। ‘কাজ করব না’ বললেই যে এরা ফিরে যেতে দেবে তাকে, এমন আশা না-করাই ভালো। মঙ্গলে গিয়ে সে শুক্রবাসীদের নিন্দা ছড়িয়ে বেড়াবে, এমন সুযোগ তাকে কিছুতেই দেবে না এরা। তাহলে?
অনুশোচনায় নিজের হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে করে বার্টের। গ্রিফাদের রক্ত মাংসে যে-সভ্যতার বনিয়াদ তৈরি হচ্ছে শুক্রের বুকে, তার অংশীদার হতে পারা কি এমনই একটা বাঞ্ছনীয় বস্তু যে, তারই লোভে মঙ্গলের শান্ত নিরুদ্বেগ জীবনকে প্রত্যাখ্যান করে আসার দরকার ছিল? না-থাকুক সে-জীবনে উচ্চাশার উন্মাদনা, উদ্দাম লালসার আস্ফালনও তো ছিল না! সে-জীবন ছিল যদি অলস— এ-জীবন যে দস্তুরমতো পঙ্কিল!
এই যখন তার মনের ভাব, তখনই একদিন তার কাজ পড়ল পাহাড়ের গায়ের এক নতুন খামারে। উপনিবেশ থেকে দেড়শো মাইল দূর। রাত্রি শেষে গাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল কর্মস্থানে পৌঁছে দেবার জন্য। শুক্রবাসীরা বিরাট বিরাট মোটর গাড়ি চালায় বিদ্যুতের শক্তিতে, সে বিদ্যুৎ তৈরি হয় গাড়ির ভিতরেই।
ঝমঝম বৃষ্টি, সোঁ সোঁ ঝড়। শুক্রের বারোমেসে আবহাওয়াই এই। তারই মধ্যে বর্ষাতি গায়ে টুপি মাথায় রবারের বুট পায়ে বার্ট দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ চাবুক হাতে। গোটা পঞ্চাশ-ষাট গ্রিফা কাজ করছে তার সামনে। তিন তিন জন করে একসাথে শিকলে বাঁধা। যাতে পালাতে না-পারে, তারই জন্য এ ব্যবস্থা।
খামার? খামার এখনও হয়নি এখানে। পাহাড়ের ঢালু গায়ে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই পড়ে আছে। সেগুলো ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে প্রথমে। রাখতে হবে গাদা গাদা করে। ট্রাক আসবে সন্ধ্যায়, তখন সেইসব পাথর তুলে দিতে হবে ট্রাকে। চলে যাবে সেসব অন্য কোথাও, যেখানে পাথর নেই, অথচ ইমারত গড়বার বা রাস্তা বানাবার জন্য পাথর দরকার।
পাহাড়ের গায়ে যখন পাথর একখানাও থাকবে না আর, তখন সেখানে লাঙল চালাবে গ্রিফারা, তারপর হবে খামারের পত্তন।
বার্ট একটু অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেই ভালোবাসে। ক্ষুদে জীবগুলোর ভারী ভারী পাথর নিয়ে টানাটানি— এ দৃশ্য দেখতে গেলেই কষ্ট হয় তার।
তেমনিই তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ যেন বাজ ডেকে উঠল অদূরে, ‘হেই জানোয়ারগুলো! কাজে ঢিলেমি করছিস?’
বার্ট তাকিয়ে দেখল, উপরওয়ালা সমুখে। এরও হাতে চাবুক, কিন্তু কোমরে একটা পিস্তলও। ওই পিস্তলই পরিচয় দিচ্ছে, দলপতিদের উপরেও এ হল পরিদর্শক।
‘তুমি তো কিছুই দেখছ না হে?’ বার্টের উপরে তর্জন শুরু করল সে, ‘জানোয়ারগুলো যে ডাহা ফাঁকি দিচ্ছে! এইভাবে তুমি নাগরিক অধিকার পাবে ভেবেছ?’
যেহেতু বার্টকে চাবুক মারা চলে না, সেইজন্যই বোধ হয় পরিদর্শক চাবুক তুলল গ্রিফাদের উপরে। বারো ফুট লম্বা চাবুকের ফালিটা সোঁ সোঁ করে হাওয়ায় ঘুরপাক খেল একটা। তারপর সপাং করে পড়ল গিয়ে একটা মেয়ে গ্রিফার গলায়। সাদা লোমের তলা দিয়ে রক্ত ছুটল ফিনকি দিয়ে, গ্রিফাটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
রক্ত দেখে বোধ হয় রক্তের নেশাতেই মেতে উঠল পরিদর্শক। চাবুকের পরে চাবুক সে হাঁকাতে লাগল গ্রিফাদের উপরে। শিকল-বাঁধা পায়ে দৌড়োবার ব্যর্থ চেষ্টা ওদের, কান্নাকাটি, চেঁচামেচি—
হঠাৎ সাঁ সাঁ করে দ্বিতীয় একখানা চাবুক চক্কোর দিল হাওয়ায়। এ-চাবুক বার্টের। এ-চাবুক পড়ল গিয়ে পরিদর্শকের গলায়। তিন পেঁচ জড়িয়ে গেল চোখের পলকে। তখন এক হাঁচকা টানে তাকে মাটিতে ফেলে দিল বার্ট। পরিদর্শক শুয়ে শুয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে পিস্তলটা কোমর থেকে হাতে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। বার্ট তখন রক্ত দেখছে চোখে। সে এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে পিস্তলটা কেড়ে নিল, আর তারই এক গুলিতে পরিদর্শকের মাথার খুলি উড়িয়ে দিল।
তারপর তার প্রথম কাজ হল গ্রিফাদের শিকল খুলে দেওয়া। তারা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। ‘শ্যূ!’ বলে দু-হাত নেড়ে ওদের পালাতে বলল বার্ট। ওরা দৌড়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকল।
বার্টের দ্বিতীয় কাজ হল, পাথরের গাদার উপরে বসে ট্রাকের প্রতীক্ষা করা। ট্রাকেই সে ফিরে যাবে উপনিবেশে। সাথে নিয়ে যাবে পরিদর্শকের মৃতদেহ। আর ওই মরা গ্রিফাটাকেও। কর্তাদের সমুখে দুটো দেহ পাশাপাশি রেখে তার যা বলবার, তা বলবে। দণ্ড? তা ওরা দেবে নিশ্চয়ই। মৃত্যুদণ্ডই দেবে হয়তো। কিন্তু তাতে কী? বার্ট তার কর্তব্য করেছে। পৃথিবী আজ বিধ্বস্ত। কিন্তু তা বলে পৃথিবীর মানুষের আমূল মহিমা যার ভিতরে নিহিত ছিল, সেই বিবেক যে এখনও নিঃশেষে বিধ্বস্ত হয়নি— তার প্রমাণ সে দিতে পেরেছে; শুক্রের এই মদান্ধ উপনিবেশিদের কাছে।