৭. শ্রীমণীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খাতা

৭. শ্রীমণীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খাতা

আমার পিতৃদেবকে যখন জেলখানাতে যাইতে হইল, তখন আমার ঠাকুরদা পরলোকে। কিন্তু বৃদ্ধা ঠাকুরমা বাঁচিয়া আছেন। আমার মা গিয়া তাঁহাকে বলিলেন—’মা, তোমার জন্যই তোমার ছেলে আজ জেল খাটিতে গেল। তুমি উহাকে প্রশ্রয় দিয়া অমানুষ বানাইয়াছ। এখন ঠেলা বুঝিতে হইবে আমাকে, আমার সন্তানদিগকে। আমাদের আর কিছুই রহিল না। তুমি তো রাজরানি ছিলে। আমি আজ পুত্র-পুত্রবধূকে লইয়া ভিখারিণী হইলাম।’

তিনবৎসর বাদে পিতৃদেব জেল হইতে ছাড়া পাইলেন, কিন্তু আর ঘরে ফিরিলেন না।

ফিরিবেন কোথায়?

‘ঘর’ই তো নাই।

ঠাকুরমাকে, আর প্রাচীনা দাসী, বিনুদিদিকে লইয়া আমরা একটি ভাড়ার বাসাতে বসবাস করি। আমাদের সর্বস্ব ক্রোক হইয়া গিয়াছে। জমিজমা, বসতবাটি, গহনাগাঁটি, টাকাকড়ি কিছুই আর নাই। পিতৃদেব মায়ের স্ত্রীধন পর্যন্ত কাড়িয়া লইয়াছিলেন। ঠাকুরমার সর্বস্ব তো আগেই বাগাইয়া লইয়াছিলেন। পিতা গৃহে ফিরিলেন না। ঠাকুরমা তাঁহার প্রিয় পুত্রের প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকিতে থাকিতে শেষে অন্নজল ত্যাগ করিলেন। তাঁহাকে জলপানও করাইতে পারা গেল না। আমার মা-জননী অতিশয় কঠিন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ঠাকুরমার মৃত্যুর পরে পরেই একদিন গঙ্গার ঘাটে যাইয়া আমাদের নিরুদ্দিষ্ট পিতৃদেবের শ্রাদ্ধ-শান্তি করাইয়া সকল সধবার চিহ্ন ত্যাগপূর্বক থান ধারণ করিয়া ঘরে আসিলেন। এবং আমাদিগের নিকট বিদায় লইয়া বৃন্দাবনের এক মহান্তের আশ্রমে চলিয়া গেলেন। সেখানে মাসিক খরচ-খরচা দিতে হয় না। দুইবেলা হরিনাম করিলেই দুইবেলা খাইতে দেয়। মন্দিরেই শয়নের ব্যবস্থা। জেদ করিয়া মা চলিয়া গেলেন। আর ফিরিবেন না বলিয়াই গেলেন। কাজলরেখা তখনও ছেলেমানুষ। প্রথম সন্তান সংকর্ষণ সদ্য জন্মিয়াছে। আমার মা এতদূর কঠোর প্রাণ, ওই কচি শিশুর মুখখানি দেখিয়াও উহাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। পারিলেন কী করিয়া, প্রথম নাতি, পৌত্র বলিয়া কথা! মায়ায় জড়াইলেন না।

মহান্তর আশ্রমে মাকে জোড়া পোস্টকার্ড পাঠাইলে উত্তর পাইতাম। একবার আমার পত্রের উত্তর আসিল অপরিচিতা এক ইন্দুবালা বসুর নিকট হইতে। তিনি লিখিয়াছিলেন, আমার মা বিভাবতী চট্টোপাধ্যায় আর আশ্রমে থাকেন না, তিনি তীর্থে তীর্থে ঘুরিয়া বেড়েইতেছেন। অথচ সেই সংবাদ মা আমাদিগকে জানান নাই।

আমার জীবৎকালে আর মায়ের সহিত দেখা হয় নাই। মাঝেমধ্যে মা পোস্টকার্ড পাঠাইতেন। বিভিন্ন পোস্টাপিসের ছাপ থাকিত—’বিজয়ার আশীর্বাদ লইবে’, ‘নববর্ষের আশীর্বাদ লইবে।’ ঠিকানা দিতেন না। আমাদের সংবাদে তাঁহার আগ্রহ ছিল না। মা কেন আমাদের পরিত্যাগ করিলেন? ওই যে! আশায় আশায়। যদি বা তীর্থে তীর্থে ঘুরিলে কোনও একদিন মৃত বা জীবিত স্বামীটির দর্শন মিলিয়া যায়। যে ব্যক্তিটির জন্য আমাদের সর্বস্ব গেল, আমার ও আমার স্ত্রী বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ধ্বংস হইয়া গেল, যত নষ্টের মূল সেই ব্যক্তিটির জন্যই মা তীর্থে তীর্থে ঘুরিতেছেন বলিয়া আমার গোপন বিশ্বাস। দেখা হইয়াছিল কি? জানিতে পারি নাই।

.

ক্রমশ আমাদিগেরও সংসার বৃদ্ধি পাইল। সংকর্ষণের পরে একে একে মিতুল ও তিতলির আবির্ভাব হইল। কাজলরেখা আর আমাদের বৃদ্ধা বিনুদিদিই সব সামলাইতেন। আমি অফিস করিয়া ঘরে কোনওই সাহায্যে আসিতাম না। আমি আর কাজলরেখা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম পুরাতন ইতিহাস, পারিবারিক কাহিনি আমরা কাহাকেও কহিব না, সন্তানদেরও বলিব না। বিনুদিদিকে বারণ করিয়া দিয়াছিলাম। সে-বুড়ি তো আমাকে মানুষ করিয়াছিল, কাজলরেখাকে বিবাহ দিয়া আনিয়াছিল সে কেবলই কাঁদিত। ছেলেমেয়ে ছোট ছোট থাকিতেই বিনুদিদি একবার দেশে গিয়া আর ফিরিল না।

পুরাতন জীবনের শেষ সাক্ষীটি মুছিয়া গেল।

কিন্তু বিনুদিদির মুখে মনে হয় একটু আধটু শুনিয়াছিলেন আমাদিগের বাড়িওয়ালি। পঞ্চাশবার বারণ করা সত্বেও বুড়ি মাঝে মাঝে দু:খের কথা কহিয়া ফেলিত। বাড়িওয়ালি আমাদের মুখে কিছু বলেন নাই কিন্তু আচরণের পরিবর্তনে বুঝিয়াছিলাম বুড়ি কিছু কিছু কহিয়া থাকবে। একদিন শিবুর মা কাজলরেখাকে বলিয়াছিলেন—’দিদিদের নিজেদের বাড়িতেই একদিন মোষবলি হইত, আর এখানে কত কষ্ট করিয়া পড়িয়া আছেন।’ কাজলরেখা তাঁহাকে ঐকান্তিক অনুনয় করিয়াছিল—’শিবুকে বলিবেন না, দিদি! আমি চাহি না আমাদের ছেলেমেয়েরা বৃথা হাহাকার করিতে করিতে, কী পাই নাই, কী ছিল, কী হারাইয়াছি, সেই হিসাব কষিতে কষিতে বড় হয়। আমাদের বর্তমানই সত্য। সেই বর্তমান দারিদ্র্যের। উহারা বিনাপ্রশ্নে পরিশ্রম করিতে প্রস্তুত হউক। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শ্রমসাধ্য।’

আমরা মনে করি, পুরুষকারকে আয়ত্তে রাখাটাই জরুরি। যে-অতীত উহাদের স্পর্শই করিল না, সে-গল্প তো রূপকথার সমান। উহা শুনিলে মনে অতৃপ্তি বাড়িবে, হতাশা আসিবে, ‘প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হইয়াছি’ এমন ধারণা লইয়া বড় হইলে কাহারও মনে শান্তি থাকে না। আমরা চাই উহাদের মনের শান্তিটুকু ব্যাহত না হোক। শান্তিও তো মহৎ ঐশ্বর্য, সেটুকু আমরা উহাদের দিতে চাই। লোভহীন, পরিতাপহীন শৈশবের সরল আনন্দ উহাদের ভোগ করিতে দিব। সত্যি তো যাহা গিয়াছে তাহা আর ফিরাইতে পারিব না। পরিতাপ করিয়া কী লাভ?’

শিবুর মা কী বুঝিলেন জানি না, কিন্তু তিনি আমাদের কথা রাখিয়াছিলেন। শিবুকে কিছুই বলেন নাই। ফলে শিবু ও সংকুর সহজ বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে নাই।

যদি অর্থ না থাকে, ‘অর্থ এককালে ছিল’, এই সচেতনতা কিন্তু বড়ই ক্ষতিকারক হইতে পারে। ‘বড় ঘরের ছেলে’ এই অহংকার কম নয়। আমি ও কাজলরেখা আমাদের সন্তানদের এই সকল ফাঁদে পা দিতে দিব না। ফিউডাল প্রতিপত্তির প্রেক্ষাপট পুরাপুরি বিস্মৃতির গর্ভে দিয়া উহাদের প্রপার প্রাোলেটারিয়ান করিয়াই মানুষ করিতে চাহি। খাটিয়া খাইতে হইবে।

যুগোপযোগী হইতে হইবে। উহাদের জমিদারি সম্পত্তি নাই। উহাদের ব্যবসায়ীর গদিও নাই। উহাদের চাই বোধ, বুদ্ধি, শ্রম, সততা এবং বিদ্যা। মৌখিক উপদেশের অপেক্ষা কৃতকর্মের উদাহরণ বেশি কার্যকরী ভাবিয়া, আমি এবং কাজলরেখা বাহিরে ও ঘরে সারাদিন পরিশ্রম করি। এবং সন্তানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বোধ ও সততা সঞ্চারিত করিয়া দিতে চেষ্টা করি। বিদ্যার কোঠাটি তাহাদের নিজেদেরই পূরণ করিতে হইবে। তিনজনেই তীক্ষ্মধী। তিনজনের নিকটেই আমাদের প্রভূত আশা।

আমরা পুত্র-কন্যাদের একইভাবে ‘মানুষ’ করিব এই ইচ্ছা। বর্তমান যুগে কে কবে কখন একাকী হইয়া পড়ে। বিদ্যার স্তম্ভটি না থাকিলে জীবনের সৌধটি ভাঙিয়া পড়িবে। তিনজনকেই যথাসাধ্য সুশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা দিতে মনস্থ করিয়াছি। ভাগ্যদোষে আমরা দুজনেই জীবনে যে সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইয়াছি, উহারা যেন সেই সুযোগ গ্রহণ করিতে পারে। মঙ্গলময় ঈশ্বরের কৃপায় এতটুকু যেন উহাদের দিয়া যাইতে পারি! আজকাল পুত্র কন্যায় ভেদ নাই। মিতু-তিতুকে স্ত্রীধন তো কিছু দিতে পারিব না, বিদ্যাই তাহাদের স্ত্রীধন হইবে।

.

আবার খাতা বন্ধ করতে হল।

চোখ মুছতে হচ্ছে।

তিতলি, তুমি কত মূল্যবান তা কি জানতে? ‘আহা, মা বেচারা কোনওদিনও খাটে শোননি’ ভেবে তুমি দয়া করে মায়ের জন্যে ‘দান’-এ দামি খাট কিনেছিল—তোমার সেই মা যে কত দামি মেহগনির পালঙ্ক থেকে নেমে এসে মহিম হালদার লেনের দেড়তলার ঘরের মেঝেয় আঁচল বিছিয়ে শুয়েছিলেন তা তোমার যেমন জানা ছিল না সেদিন পর্যন্তও, আজ তেমনি জানতে পারলে মিতু-তিতুরা কত দামি ছিল, তাদের বাবা-মায়ের কত ঝকঝকে স্বপ্ন ছিল তাদের নিয়ে।

না। সেই স্বপ্ন তোমরা বিলীন হতে দাওনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *