৭. ধারালো ক্ষুরের ওপর দিয়ে

৭. ধারালো ক্ষুরের ওপর দিয়ে

৩১শে জুলাই ১৯৫৯ সাল। বসু তখন দিল্লীতে বসে সাংবাদিক বৈঠক করছেন। একের পর এক উত্তর দিচ্ছেন সাংবাদিকদের। প্রতিটি কথাই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। সহজ কথায় সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগের গুরুত্বটুকু। সঙ্গে রয়েছেন ভূপেশ গুপ্ত। এমন সময় খবরটা এল। কেরালা সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল এই দুঃসংবাদ। সংবিধানের ৩৫৬নং ধারা প্রয়োগ করে নাম্বুদিরিপাদ সরকারকে এরকম অগণতান্ত্রিকভাবে ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করাকে বসু বললেন “স্বৈরাচারী”। সন্ধ্যাবেলা বসু আর ভূপেশ গুপ্ত গেলেন ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। ফিরোজ গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রীর ভবনে থাকেন না। তিনি ছিলেন নর্থ এ্যাভিনিউএর একটা এম. পি. ফ্ল্যাটে। তিনিও ঘটনাটিকে সমর্থন করতে পারেন নি। তিনি বললেন : “আজ একটি হত্যাকাণ্ড হয়েছে—কেরালার গণতন্ত্রের হত্যা ঘটেছে।” বোঝাই গেল এর পেছনে রয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তখন সারা ভারত কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট। ইন্দিরা কেমন করে এমন নির্মম একনায়ক হয়ে উঠলেন? ফিরোজ গান্ধী বসুকে বলেছিলেন, যদি তুমি নেহরুর বাড়িতে থাকতে তাহলে দেখতে কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতারা এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও নির্লজ্জভাবে কেমন ইন্দিরার তোষামোদ করছে। একটা অল্পবয়সী মহিলার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট।”

বসু কলকাতায় ফিরলেন। শুরু হল প্রতিবাদী সভা সমিতি, মিটিং মিছিল। সামনে তখন চড়াই-এর লম্বা রাস্তা। উত্তরণের পথ তখনও অনেক দূরে। ৩রা জুলাই বসু আর ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিলেন। বসুর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ। মনে মনে তিনি তখনও এক রাগী প্রতিবাদী যুবক। কাঁটা আর পাথর ছড়ানো পথ দিয়ে হেঁটে যেতে এতটুকু আপত্তি নেই। মনের ভেতরে আগুন, বুকের ভেতর স্বপ্ন। সঙ্গে ছিল সমস্ত বামপন্থী শক্তি, নিজের পার্টি আর বিশিষ্ট নাগরিকদের সক্রিয় সমর্থন।

কেরালায় গণতন্ত্রের হত্যার ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই এসে পড়ল আর এক কঠিন পরীক্ষা। ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। জুন থেকে আন্দোলনের শুরু। আগষ্ট মাসে আন্দোলন ব্যাপক চেহারা নিল। শুরু হয়ে গেল সরকারী গ্রেপ্তার, আটক, অত্যাচার। বহু কমিউনিস্ট এবং অকমিউনিস্ট, বামপন্থী অ-বামপন্থী নেতাও অকারণে গ্রেপ্তার হলেন। বসু অবশ্য গ্রেপ্তার হন নি। গ্রেপ্তার হন নি আরও অনেকেই—যেমন, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, হেমন্ত বসু প্রমুখ। ৩১শে আগষ্ট খাদ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ ও খাদ্যের দাবিতে অক্টালনি মনুমেন্টের তলায় ময়দানে তিন লক্ষ মানুষ জমা হলেন। তারপর শুরু হল রাইটার্স বিল্ডিংস্ অভিযান। পুলিস নির্বিচারে মিছিলের ওপর গুলি চালাল। হাজারখানেক মানুষ আহত হলেন, নিহতও হলেন কয়েকজন। পুলিসি আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে বসু ও অন্যান্য বামপন্থী নেতারা বিবৃতি দিলেন। শেষ পর্যন্ত সরকার খাদ্য আন্দোলনের কয়েকটি দাবি মেনে নিল। কয়েকজন বন্দী নেতাও ছাড়া পেলেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বসানো হল খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মরণস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর। ৩১শে আগষ্ট শহীদ দিবস পালিত হবে একথা ঘোষণা করা হল।

সামনে তখন আরও দুর্দিন। ভারত চীনের মধ্যে সীমান্তবিরোধ নিয়ে তিক্ততা শুরু হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি চেয়েছিল দুই দেশের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি। “কিন্তু দুঃখের বিষয়”, বসু বললেন, “চীন- ভারত বিরোধ বিষয়ে আমাদের ভুল বোঝান হয়েছিল। এক সময় পরিস্থিতি এতই সঙ্গীন হয়েছিল যে সমস্ত কোপ, সমস্ত অভিযোগ সমস্ত আক্রমণটা হয়েছিল আমার একার ওপর।” ১৪ই নভেম্বর কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের মীরাট অধিবেশনে চৌ এন লাই-নেহরু বৈঠকের দাবি তোলা হয়। সপ্তাহখানেক পর এই সীমান্তবিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টি ও মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের উদ্যোগে কলকাতার ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশ হয়। বসু এই সমাবেশে সীমান্ত বিষয়ে পার্টির অভিমত ব্যাখ্যা করেন। তিনি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সম্বন্ধে দেশবাসীকে সাবধান করে দেন এবং শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার ওপর বিশেষ জোর দেন। কংগ্রেসীরা অত্যাচার করতে ছাড়ে না। ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসীদের এক মিছিল সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে খাদ্য আন্দোলনে নিহত শহীদবেদিতে অগ্নিসংযোগ করে। “আসল কথা হল”, বসু বলেন, “ওদের এই সব অপকর্মের পেছনে কোনও দেশত্মাবোধ ছিল না। ওদের উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিহত করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশটা আরও খারাপ করা।”

১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে কংগ্রেস একটা জনবিরোধী বিল আনে—বিলটির নাম ‘পশ্চিমবঙ্গ মিছিল ও সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৬০’। “এটা আমাদের দমন করার জন্য করা হয়েছিল”, বসু বললেন। বসু এই প্রস্তাবিত কালাকানুনের বিরুদ্ধে ময়দানে এক কেন্দ্রীয় সমাবেশে ভাষণ দিলেন। রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হল ২৪শে জানুয়ারি। প্রতিরোধ কমিটি গড়া হল। স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রতিবাদপত্র পেশ করা হল সরকারের কাছে। এর মধ্যেই চলে এল কেরালায় নির্বাচন। বসু ভূপেশ গুপ্ত, মহম্মদ ইসমাইল, হীরেন মুখার্জির সঙ্গে কেরালায় নির্বাচনী প্রচারে গেলেন। জয় হল না, কিন্তু আগের তুলনায় ফল ভাল হল। আবার শুরু হল আর এক আন্দোলন। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের ধর্মঘট। ১২ই জুলাই থেকে শুরু হল ধর্মঘট, শেষ হল ১৬ই জুলাইএর মাঝরাতে। এরপর সরকার যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠল। সাসপেনশন, ছাঁটাই নোটিশ জারি করা হল হাজার হাজার কর্মচারীর ওপর। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিরোধ আন্দোলন আরও জোরদার হল। শেষ পর্যন্ত মোরারজি দেশাই সরকারী কর্মচারীদের পে-কমিশনের প্রধান সুপারিশগুলো মেনে নেবেন এই মর্মে ঘোষণা করেন।

ষাটের দশকে বসুর ওপর বেশ কয়েকবার আক্রমণ হয়। ১৯৬০ সালে মে দিবসের আগের দিন বসু বরানগরে এক কারখানায় শ্রমিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন। সভার কাছাকাছি যেতেই কংগ্রেসী পতাকা হাতে এক দল সমাজবিরোধী বসুর গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গাড়ির পেছনের কাঁচটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। লাঠি দিয়ে তারা গাড়ির বনেটের ওপর দুমদাম করে মারতে লাগল। বসু মুহূর্তের মধ্যে ঠিক করে নিলেন কি করা উচিত। ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি থানার দিকে ঘোরাও। ড্রাইভার ছিল বেশ সাহসী, কোনও রকমে গাড়ি নিয়ে থানায় পৌঁছানো গেল। বরানগর থানায় গিয়ে বসু সোজা পুলিস অফিসারকে বললেন তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিতে। খবর পেয়ে ব্যারাকপুরের এস ডি পি ও চলে এলেন। এদিকে তখন প্রচুর বোমা পড়ছে। বসু এতটুকু বিচলিত হন নি, ধৈর্যও হারান নি। ফেরার পথে অবশ্য আর কেউ আটকায়নি।

আরও এক বছর বসু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক রইলেন। টানা ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। তিনি নিজেই রাজ্য সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬১ সালে বর্ধমানে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির অষ্টম সম্মেলনে তিনি এই পদের দায়িত্বভার ছেড়ে দেন এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত সর্বসম্মতভাবে রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬২ সাল এল দুঃস্বপ্নের পসরা নিয়ে। তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থির অনিশ্চয়তা, পার্টির দোটানাভাব, চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ—সব মিলিয়ে বসুর রাজনৈতিক জীবনে তখন ঘোর দুঃসময়।

নির্বাচনী প্রচারে কাকদ্বীপ যাওয়ার পথে বসুর ওপর আবার আক্রমণ হল। কাকদ্বীপ বাজার থেকে মাইলখানেক দূরে হঠাৎ শ’খানেক লোক বসুর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে যায়। গাড়ি এগোবার চেষ্টা করতেই তারা গাড়ি ঘিরে ধরে। তারপর শুরু হয় অশ্রাব্য গালিগালাজ। “আসলে তখন পুলিস তো ইচ্ছা করে কিছু করত না, আমাদের নানারকম অসুবিধা সৃষ্টি করাই তাদের কাজ ছিল”–বসু বললেন। বসু পুলিসকে ডেকে বললেন, আপনারা যদি ব্যবস্থা নেন তো নিন, না হলে আমি নিজেই আত্মরক্ষার উপায় দেখি। ইতিমধ্যে বসুর ওপর আক্রমণ হয়েছে এই খবর পেয়ে সভাস্থল থেকে বিরাট জনতা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। জনতার ভিড় দেখেই দুষ্কৃতকারীরা চম্পট দেয়। বসু গাড়ি ছেড়ে জনতার সঙ্গে হেঁটে মিছিল করে সভাস্থলে পৌঁছোন।

১৬ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন শুরু হল। কয়েকদিন ধরে দফায় দফায় নির্বাচন চলল। বসু এবারও বরানগরে দাঁড়ালেন। কংগ্রেসের ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জিকে তিনি ১৩, ৪১২ ভোটে পরাজিত করেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নির্বাচনী ফল আশানুরূপ হল না। বিধানসভায় সামান্য সংখ্যক (৫টি) আসন বেড়েছিল, লোকসভায় আসনের সংখ্যা অপরিবর্তিতই ছিল। সারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি লোকসভায় লাভ করেছিল ২৯টি আসন। বসু বিধানসভায় আবার পার্টির পরিষদীয় দলের নেতা হিসাবে নির্বাচিত হলেন। আবার তিনি বিরোধী দলের নেতা হলেন।

২০শে অক্টোবর শুরু হল চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ। সারা ভারতে যুদ্ধের উন্মাদনা দেখা দিল। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা সর্বত্র আক্রান্ত হলেন। পার্টির প্রাদেশিক দপ্তরের (৬৪-এ লোয়ার সার্কুলার রোডে) সামনে প্রায় রোজ বিক্ষোভ দেখানো হত। ক্রমশ চীন-ভারত বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। জরুরী অবস্থা ঘোষিত হয় বসুর ওপর বিশেষ আক্রমণ শুরু হয়। কালীঘাটে একটা কুশপুত্তলিকার দোকান খোলা হল, সেখানে চৌ এন লাই-এর কুশপুত্তলিকা, জ্যোতি বসুর কুশপুত্তলিকা বিক্রয় করা হত। রাস্তায় রাস্তায় পোড়ানো হত জ্যোতি বসুর কুশপুত্তলিকা।

বসুকে ‘চীনের দালাল’, ‘চীনপন্থী’, ‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করা হত। তখন অনেকেই মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বসুর মনের জোর ছিল অটুট। রোজই পার্টি অফিসে যেতেন। বিধানসভার ভেতরে বাইরে বিরোধী পার্টি তাঁকে যথেষ্ট অপমান করত। পুলিসের কড়া নজর এড়িয়ে তিনি ঘোরাফেরা করতেন। গোয়েন্দা-পুলিস তাঁকে সর্বদা অনুসরণ করত। যথেষ্ট সাবধান হওয়া সত্ত্বেও বসু গ্রেপ্তার হলেন। এক রাতে বন্ধু স্নেহাংশু আচার্যের বাড়ি বসুর নিমন্ত্রণ ছিল। সঙ্গে ছিলেন দীনেশ রায়। খাবার সময় বসু বাইরের দিকে তাকাতেই দেখলেন একটা গাড়ি সেখানে নজরদারি করছে। বসু বুঝলেন সামনে বিপদ আসতে পারে। বেরোবার সময় স্নেহাংশু আচার্য বসুকে বললেন দেখো, আজ রাতেই তোমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। বসু সতর্কভাবে নিজের বাড়ি পৌঁছলেন। ভোর তিনটের সময় ঘরের দরজায় পুলিসের লাঠির টটক্ আওয়াজ। দরজা খুলতেই পুলিস অফিসার এ্যারেষ্ট ওয়ারেন্ট দেখায়, ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তোলপাড় করে, বসু দেখলেন বাইরে প্রচুর পুলিসের গাড়ি। ঘরে তখন চন্দন কান্না শুরু করে দিয়েছে। চন্দনের তখন দশ বছর বয়স। আর স্ত্রীও দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। চন্দন দেখল তার মা কাঁদছে আর বাবাকে জোর করে পুলিস ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বসুর স্ত্রী জানালেন, একজন পুলিস অফিসার ছিল অত্যন্ত অভদ্র, বসেই কনুই দিয়ে বসুকে গুঁতো দিলেন। বসুর স্ত্রী বললেন “এটা কি করছেন আপনারা, উনি না লিডার অব্ অপোজিশন?” গাড়ি চলতে শুরু করল। একজন পুলিস যেতে যেতে বলল “বেশিদিন নয়, আপনাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবে, চীন তো একতরফাভাবে গুলিবর্ষণ করেছে।” যুদ্ধ ১৪ দিন চলল, কিন্তু বসু জেলে রইলেন টানা এক বছর। সেই সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ অবস্থা। মাথায় অন্যায্য অসম্মানের বোঝা। তার সঙ্গে ছিল পুলিস ও প্রশাসনের চরম দুর্ব্যবহার। নির্জন সেলে বসুর সঙ্গী ছিল কয়েকটি বই আর দু’টি ছবি। ছোট্ট একটা নীলচে সাধারণ প্লাসটিকের খাপের মধ্যে থাকত স্ত্রী কমলের আর ছেলে চন্দনের ছবি। ছবি দু’টি প্রায়ই তিনি দেখতেন। মনটা আরও খারাপ হয়ে যেতো। চন্দনের জন্য ভীষণ চিন্তা হত। চন্দন ছিল খুব দুরন্ত, হয়ত ছাত থেকে ঝুঁকছে, হয়ত রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছে, হয়ত বা পড়াশোনায় ঠিকমত মন দিচ্ছে না— এই সব ভাবনা হত। ভাবতেন পার্টির ভেতরকার মতবিরোধ আর মতপার্থক্যের কথা। একা থাকার সময় চিন্তাগুলো যেন তাঁকে চেপে ধরত। এর মধ্যেই এল আর এক দুঃসংবাদ। তাঁর বাবা মারা গেলেন। পুলিস তাঁকে কিছুতেই ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত তিনি ছাড়া পেলেন প্যারোলে। তাঁর স্ত্রীর সনির্বন্ধ অনুরোধে। তিনি মুখ্যসচিবকে আবেদন করলেন যাতে তাঁর স্বামী তাঁর বাবার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। সহজে তাঁর সেই অনুরোধ কেউই রাখেন নি। অনেক কাকুতিমিনতির পর তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন নেহরুর, এ. কে. গোপালনের। এ. কে. গোপালন তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। বসু সশস্ত্র পুলিস পাহারায় শ্মশানে গেলেন। “দাদাই সব কাজ করেছিলেন”, বসু জানালেন “আমি চুপচাপ বসেছিলাম, চারধারে পুলিস।” বসুর তখন একটা কথাই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল—”মনে হচ্ছিল বাবাকে তো খুশী করতে পারলাম না।” বাড়িতেও চারধারে পুলিস। কয়েক ঘণ্টার জন্য থাকা। স্ত্রীর সঙ্গে, ছেলের সঙ্গে ভাল করে কথা বলবার তাঁর উপায় নেই, ঘাড়ের ওপর পুলিস নিঃশ্বাস ফেলছে। “সে একটা ইম্পসিবল সিচুয়েশন”–বসু মন্তব্য করলেন। একদিন মুখে একটু ভাত দিয়েছেন, পুলিস অফিসার তাড়া দিতে শুরু করল—“চলুন, উঠুন, যেতে হবে, সময় হয়ে গেছে।” স্ত্রী বললেন “খাওয়াটা অন্তত শেষ করতে দিন।” বসু বললেন “কাদের অনুরোধ করছ। চলুন, যাচ্ছি”, বলে আধখাওয়া অবস্থাতেই উঠে পড়লেন। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখে বসু জেল থেকে মুক্তি পান।

তখন আর্ন্তর্জাতিক বিষয়ে ও বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে পার্টির মতানৈক্য বেশ তীব্র আকার ধারণ করেছে। লম্বা কাহিনী ছোট করে বলতে গেলে, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে একটা অংশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মতের অনুগামী, আর একটা অংশ ছিল চীনের অবস্থানের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক প্রশ্নে তাঁদের পরিচয় ছিল যথাক্রমে ‘সোভিয়েত-পন্থী’ বা ‘রুশপন্থী’ এবং ‘চীনপন্থী’ হিসাবে। বাম-দক্ষিণ বিচারে যথাক্রমে ‘দক্ষিণপন্থী’ এবং ‘বামপন্থী’। চীন-ভারত বিরোধ তুঙ্গে ওঠার সময় এই আন্তঃপার্টি বিতর্কও তীব্র হয়ে ওঠে। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে পালঘাট কংগ্রেসে এই বিতর্কই ছিল প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তখন থেকেই ভাঙন শুরু। পার্টি কাগজে কলমে দ্বিখণ্ডিত হয় ১৯৬৪ সালে। ‘মধ্যপন্থী’ হিসাবে পরিচিত জ্যোতি বসু ছিলেন ভাঙনের বিরোধী, তিনি পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সব রকম চেষ্টা চালিয়েছিলেন। নাম্বুদিরিপাদ ও ভূপেশ গুপ্তকেও তখন ‘মধ্যপন্থী’ বলা হত।

১৯৬৪ সালের ৯ই এপ্রিল দিল্লীতে কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের বৈঠক বসে। বসু তখন জাতীয় পরিষদের অন্যতম সদস্য। নানা ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে ‘বামপন্থী’ ও ‘দক্ষিণপন্থী’ কমিউনিস্টদের মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়। বিতর্ক ওঠে ‘ডাঙ্গে পত্রাবলী’ নিয়ে। ১১ই এপ্রিল জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ৩২ জন সদস্য সভা ত্যাগ করেন এবং আলাদা বিবৃতি দেন। এর মধ্যে ছিলেন নাম্বুদিরিপাদ, ভূপেশ গুপ্ত, জ্যোতি বসু। এর পরেই ৭ থেকে ১১ই জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের তেনালিতে এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে সারা দেশ থেকে ১৪৬ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। জ্যোতি বসু ও নাম্বুদিরিপাদ এই কনভেনশনে যোগ দিয়েছিলেন। জ্যোতি বসু কনভেনশনের কাজ পরিচালনার জন্য সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর ‘মধ্যপন্থী’ অবস্থান ত্যাগ করে পুরোপুরি যোগ দিলেন ‘বামপন্থী’ কমিউনিস্টদের সঙ্গে। তেনালি কনভেনশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্টির সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার ত্যাগরাজ হলে। চলে ৩১শে অক্টোবর থেকে ৭ই নভেম্বর। তার ঠিক আগেই সারা দেশ থেকে ‘বামপন্থী’ কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করা হয়। জ্যোতি বসু অবশ্য সে সময় গ্রেপ্তার হন নি। সপ্তম কংগ্রেসে পি. সুন্দরাইয়া সি. পি. আই. (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরো দু’জায়গাতেই বসু সদস্য নির্বাচিত হন। ৭ই নভেম্বর মনুমেন্টের নীচে ময়দানে নতুন সি. পি. আই. (এম)-এর প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশ হয়। জ্যোতি বসু এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন।

সি পি আই (এম) দলের বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন অংশ পার্টির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের কর্মসূচী সমর্থন করেন নি। তাঁরা চেয়েছিলেন সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে। পরবর্তীকালে নকশালবাড়ির সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থানের সমর্থনকে কেন্দ্র করে এই অংশকে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। তারা একটি নতুন দল তৈরি করে, নাম দেয় সি পি আই (এম এল), ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী)।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস জনগণের চাহিদা পূরণে তখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষ কংগ্রেসী শাসন সম্বন্ধে মোহমুক্ত হতে চলেছেন। বাতাসে একটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বসুর উৎসাহে উদ্দীপনায় এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। পরম উৎসাহে তিনি সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে চলেছেন। তখন তাঁর বয়স বাহান্ন, দেখায় ত্রিশ বত্রিশ। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, মন আর শরীরের ওপর দিয়ে এত ঝড় ঝাপটা গেছে। ১৯৬৫-৬৬ সালে খাদ্য-আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, ট্রামভাড়াবৃদ্ধি আন্দোলন চলছে। বসু গ্রেপ্তার হলেন ট্রামভাড়াবৃদ্ধি আন্দোলনের সময়। তখন প্রায় প্রত্যেক নেতাই জেলে। বসু ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। এই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর ওজন কমে যায়, শরীর দুর্বল হয়ে যায়। ডাক্তারের মতে দীর্ঘদিন অনিয়ম আর অবহেলা করার ফলে শরীরের এই অবস্থা হয়েছিল। পুষ্টিকর পথ্য আর বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তার। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসের শেষ নাগাদ রাজবন্দীরা মুক্তি পেতে শুরু করেন। খাদ্য-আন্দোলনের জের তখনও চলছে। পুলিসী অত্যাচারও চলছে। বসু ছাড়া পান ১৪ই মার্চ। ২০শে মার্চ সে সময়কার মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের সঙ্গে জ্যোতি বসু ও অন্যান্য বামপন্থী নেতারা আলোচনা শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বন্দীমুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বসু দিল্লী গেলেন। খাদ্য-আন্দোলন এক সময় শেষ হল, সব দাবি মেনে না নিলেও কয়েকটা দাবি সরকার মেনে নিলেন। এ প্রসঙ্গে বসু বললেন : “তখন গণ-আন্দোলন না করলে আমরা জেলেই পচতাম, কারণ কর্তৃপক্ষ বা সরকার তখন একটা ভাষাই বুঝত, সেটা হল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ভাষা।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *