সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৭. জীবন-মৃত্যুর লটারি

জীবন-মৃত্যুর লটারি

‘সর্বনাশ হয়ে গেল ক্যাপ্টেন—’

সশব্দে দরজা খুলে ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকনিল ককিয়ে উঠল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেল ক্যাপ্টেন!’ সব অক্সিজেন বেরিয়ে গেছে চৌবাচ্চা থেকে।’

ডেস্কে বসে দিনপঞ্জি লিখছিল গ্রান্ট, চমকে উঠল। দেহটা পিছনপানে ফেরানো সহজ নয়, কারণ চামড়ার দড়ি দিয়ে কোমর বাঁধা আছে চেয়ারের সঙ্গে। অগত্যা ঘাড়টাই ফেরাল শুধু, ‘বেরিয়ে গেছে? কী করে বেরুবে?’ ভয় আর সংশয় একসঙ্গে মেশানো তার প্রশ্নে।

‘উল্কা!’ বুড়ো আঙুল আর তর্জনির ফাঁকে যেটুকু ব্যবধান দেখাল ম্যাকনিল, বড়োজোর তা ইঞ্চিখানিক হতে পারে, ‘এতটুকুন উল্কা, দশ গ্রামের বেশি ওজন হবে না তার, বিমানের দেয়াল ফুটো করে ঢুকে পড়েছে অক্সিজেনের ট্যাঙ্কে।’

কোমর থেকে পেটি খুলে উঠে দাঁড়িয়েছে ক্যাপ্টেন। বেঁধে ছেঁদে নিজেকে বসিয়ে রাখা যায় যতক্ষণ, একটু তবু ভারী ভারী লাগে দেহটাকে। উঠে দাঁড়ালে তো তুলোর মতো হালকা। ভেসেই ওঠবার কথা। যদি-না দেয়াল বা দরজা বা আসবাবপত্র আঁকড়ে ধরা যায়। আসবাব? প্রত্যেকটা জিনিসই স্ক্রু দিয়ে আঁটা মেজের সঙ্গে, নইলে তাদেরও ভেসে বেড়াবার বাধা নেই।

বিমান তো সিন্দুক-বিশেষ। ‘এয়ার-লক’ কামরাটাই হল বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ। ওর দরজা বন্ধ করে দাও, ব্যস, মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থাতেও তোমার বিমান মহাশূন্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

সেই দরজার পাশেই অক্সিজেনের ট্যাঙ্ক। দেয়ালে সাঁটা। একপলক দেখে কিছু বুঝবার জো নেই। গ্রান্টের মাথার উপরেও তিন ইঞ্চি পরিমাণ খাড়াই। হালে লাগানো লাল রং ঝকঝক করছে সারা গায়ে। সৌষ্টবের দিক দিয়ে কোনো খুঁত হওয়ার কথা নয় এই দুর্ঘটনার দরুন, হয়ওনি তা।

তবে ওই কাঁটাটা! মজুদ অক্সিজেনের পরিমাণ নির্দেশ করে যেটা। সেটা এই মুহূর্তে স্রেফ জিরোর ঘরে। জিরো! শূন্য! কিছুমাত্র সঞ্চয় নেই ভাঁড়ারে। নিঃশেষে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে ওই বিশাল ট্যাঙ্ক।

করবার কিছু আছে কী? কিছু না। ক্যাপ্টেন তাকায় ইঞ্জিনিয়ারের দিকে, ইঞ্জিনিয়ার তাকায় ক্যাপ্টেনের দিকে। দু-জোড়া চোখে অগাধ নৈরাশ্য।

নৈরাশ্য? অবশ্যই আসতে পারে নৈরাশ্য। কিন্তু তা বলে এ কী?

অর্থাৎ ম্যাকনিলের এ হল কী? লোকটার মুখের দিকে এতক্ষণ ভালো করে তাকাবার ফুরসুত হয়নি গ্রান্টের। কিন্তু এইবার—

তাকাতে গিয়েই ক্যাপ্টেনের মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। নৈরাশ্য থাকতে পারে, কিন্তু মুখে-চোখে আতঙ্কেরও সুস্পষ্ট আভাস। ও-রকমটা থাকবে কেন? মৃত্যুভয়? সৌরমণ্ডলে পাড়ি জমানো যাদের দৈনন্দিন কাজ, তারা করবে জীবনের মায়া? অবশ্য এযুগে মহাকাশ পর্যটনে দুর্ঘটনা ঘটবার কোনো উপায় নেই; তবু দৈবাৎ কিছু ঘটে গেলে তা থেকে পরিত্রাণেরও তো কোনো রাস্তা এ-যাবৎ কেউ বাতলাতে পারেনি! সেই দৈব, লক্ষ জনকে যা একনাগাড়ে সবুজ সংকেত দেখিয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যের অচিহ্নিত রাজপথে; তা যদি হঠাৎ নিষ্করুণ হয়ে লাল আলো বাগিয়ে ধরে কোনো এক ভাগ্যহত বৈমানিকের মুখের উপরে—

তাহলে তার আর নিস্তার নেই, তা জানে সব বৈমানিকই। জানে এই ম্যাকলিনও। তবে তার কেন এই আড়ষ্ট মুহ্যমান অবস্থা, সংকটের আভাসমাত্র পেয়েই?

সুস্পষ্ট ঘৃণার চোখে গ্রান্ট তাকিয়ে রইল ম্যাকনিলের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ। ম্যাকনিল মাথা নীচু করেছে সে-দৃষ্টির সমুখে। তাকে কোনো কথা না-বলে গ্রান্ট চলে গেল কনট্রোল কামরায়। চেয়ারে বসে আবার চামড়ার দড়ি দিয়ে নিজেকে বাঁধল। এইভাবে বসেই কাজ করতে অভ্যস্ত গ্রান্ট। কাজ করতে এবং চিন্তা করতে।

চিন্তা? অ-নে-ক। ম্যাকনিল যদি মগজের দিক দিয়ে সুস্থ থাকত, আলোচনা করা যেত তার সঙ্গে। ভীতু হোক, যাই হোক, ওয়াকিবহাল লোক, তাতে তো আর সন্দেহ নেই। আন্তর্গ্রহ-পথের বিমানে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া তো আর তিন তুড়িতে মেরে দেওয়ার কাজ নয়! বহু লেখাপড়া, বহুদিনের শিক্ষানবিশীর ফলে তবেই কেউ পেতে পারে এই গুরুদায়িত্বের পদ।

ম্যাকনিল জানে সব। কিন্তু এ মুহূর্তে ওর সঙ্গে কথা কওয়া ঝকমারি মাত্র। বিভীষিকায় আড়ষ্ট হয়ে আছে ও। জ্ঞানবুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে আছে ওর। কিছু বলতে গেলেই আবোল-তাবোল বলবে।

কাজেই আলোচনা থাকুক। কর্তব্যনিরূপণের দায়িত্ব গ্রান্টেরই, গ্রান্টই করবে তা।

এই ‘স্টার কুইন’ পৃথিবী থেকে শুক্র গ্রহে যাতায়াত করছে আজ পাঁচ বছর। যেতে পাঁচ মাস লাগে, আসতে পাঁচ মাস। শুক্রে পৌঁছোনোর পরে একমাস বিশ্রাম, পৃথিবীতে পৌঁছোনোর পরেও একমাস। সাকুল্যে বছরে একবার যাওয়া, একবার আসা। যাত্রীবিমান নয় স্টার কুইন, স্রেফ মাল বওয়াই ওর কাজ।

যাত্রী বহনের জন্য অন্য জাতীয় বিমান আছে, তাদের গতিবেগ তিনগুণ বেশি, তাতে জ্বালানি খরচা দশগুণ। মাল-জাহাজের মতো অমন ধরাবাঁধা সময়সূচিও নেই তাদের যাতায়াতের। কারণ, যাত্রী চলাচল কমই হয়। দ্বাবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পৃথিবীর মানুষ যখন প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করে শুক্র গ্রহে, একসাথে হাজার দুই পুরুষ তখন গিয়েছিল সেখানে। মোটামুটি এরকম সংখ্যাই এখনও রয়েছে। কিছু মরেছে, কিছু ফিরেছে, আবার নতুন কিছু আমদানিও হয়েছে পৃথিবী থেকে। নবাগতদের ভিতর নারীর অনুপাত চারজনে একজন।

শুক্রের বাসিন্দারা বসে থাকে না, খাটে হাড়ভাঙা খাটুনি। গোটা গ্রহটারই জঠর বিবিধ খনিজ পদার্থে ভরতি। পৃথিবীতে একদম পাওয়া যায় না, এমন খনিজও আছে অনেক। সেইসব তোলা এবং পৃথিবীতে চালান দেওয়াই ওদের কাজ। স্টার কুইন-জাতীয় বিমানেরা প্রতি ক্ষেপেই পৃথিবীতে টেনে আনছে শত শত টন।

এসব বিমানে সাধারণত তিনটি করে লোক থাকে, ক্যাপ্টেন, সহকারী ক্যাপ্টেন ও ইঞ্জিনিয়ার। গ্রান্টের আসবার কথা ছিল সহকারী হিসেবে। হঠাৎ যাত্রা শুরুর কয়েক ঘণ্টার আগে সেই ভদ্রলোক এক দুর্ঘটনায় পড়ে গেলেন, ক্যাপ্টেন হয়ে যাঁর আসার কথা ছিল, পা ভেঙে গেল আছাড় খেয়ে। অল্প সময়ের মধ্যে অন্য একজন মহাকাশচারী ক্যাপ্টেন জোটানো সম্ভব নয়, অগত্যা গ্রান্টকেই ক্যাপ্টেন করে পাঠালেন কর্তারা।

তিনজনের কাজ দু-জনে করতে হবে শুনে গ্রান্ট আর ম্যাকনিল— দু-জনেই গোড়ায় বেঁকে বসেছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যখন ভগ্নজানু ক্যাপ্টেনের মাইনেটা ওদের দু-জনের ভিতরেই ভাগাভাগি করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন, তখন তারা রাজিই হয়ে গেল সাত-পাঁচ ভেবে।

সাত-পাঁচ তারা ভেবেছিল, কিন্তু সাত-পাঁচের উপরেও যে ভাববার অন্য কিছু থাকতে পারে, তা খেয়াল হয়নি তাদের। কর্তৃপক্ষেরও হয়নি। সেই অন্য-কিছুটা হল এই যে তিনটি লোক এক জায়গায় থাকলে তাকে সমাজ বলা যায়, কিন্তু দু-টি থাকলে তা যায় না। এবং যেহেতু মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব, দু-টি লোক পরস্পরের নিবিড় সান্নিধ্যে দীর্ঘদিন একান্ত নিভৃতে বাস করতে বাধ্য হলে তাদের জীবনযাত্রাই ঘোরতর অস্বাভাবিক হয়ে ওঠার একটা আশঙ্কা আছে।

নিজেদের অজ্ঞাতসারেই এই বৃহৎ আশঙ্কা মাথায় নিয়েই গ্রান্ট আর ম্যাকনিল আজ এক-শো কুড়িদিন অপার মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়ে আসছে, মনের আনন্দে না-হোক, অন্তত নিরাপদে। আর মাত্র ত্রিশটা দিনের পথ বাকি। এই সময়ে বাধল এই বিপত্তি। একান্ত অপ্রত্যাশিত বিপত্তি। এক মিলিয়নের ভিতরে একটামাত্র বিমানের ভাগ্যে যে-বিপত্তি ঘটলেও ঘটতে পারে বলে গ্রহবিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে সুদৃঢ় মত প্রকাশ করে আসছেন।

উল্কা? মহাশূন্যের কোন অংশে কোন ঋতুতে উল্কার চলাচল কী পরিমাণে হবে, বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে তার নির্ভুল চার্ট তৈরি করা হয়েছে। এ-সময়ে পৃথিবীর কক্ষ থেকে শুক্রের কক্ষে যাওয়ার পথে স্টার কুইনের সঙ্গে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উল্কার এই যে সংঘাত, এটাকে নেহাতই ভগবানের মার ছাড়া অন্য কিছু তো বলার উপায় নেই!

যাহোক, গ্রান্ট যখন ক্যাপ্টেন, আর ম্যাকনিলের মতো খরগোশের প্রাণ নিয়ে যখন সে বিমান চালায় না, তখন তার করণীয় আছে অনেক কিছু এক্ষেত্রে। পৃথিবী অনেক পিছনে, সে তুলনায় শুক্র হাতের নাগালে বললেই হয়। কন্ট্রোল রুম পৃথিবীতেও আছে, শুক্রেও আছে, যেখানে বসে মহা মহা বিশেষজ্ঞেরা নির্দেশ, উপদেশ এবং আদেশ দেন শূন্যচর বিমানদের। শুক্রের কন্ট্রোলে খবরটা দেওয়াই প্রথম কর্তব্য এখন।

ট্রান্সমিটার সুইচবোর্ডে বৈদ্যুতিক সংকেত বেজে উঠল। শুক্রের পিঠে আর্কল্যাম্প জ্বলছে সূর্যের মতো দীপ্তি নিয়ে। আর এখানে স্টার কুইনের বাইরের কাঠামোতে খাটানো আছে অর্ধবৃত্তাকার আয়না। সে-আয়নার মুখ ওই আর্কল্যাম্পের দিকে ফেরানো। দূরত্ব? দুটোর ভিতরে এই মুহূর্তে দশ মিলিয়ন কিলোমিটারের মতো। বিমান থেকে শব্দের ঢেউ আধ মিনিটে পেরিয়ে যাবে দূরত্বটা।

শুক্রের স্বয়ংক্রিয় নির্দেশক যন্ত্র থেকে উত্তর এল, ‘বলুন।’

গ্রান্ট ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল। ভয় আর নৈরাশ্যের আবেগকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলে রেখে। পরিস্থিতিটা বিশদভাবে বুঝিয়ে বলল, তারপর জানতে চাইল, ‘এখন আমার কর্তব্য কী?’

গ্রান্টের রিপোর্ট শুক্রের নির্দেশক যন্ত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে, এখন কিছুক্ষণ তো ফিলমটা নাড়াইয়ে জড়ানোই থাকুক! যথাসময়ে সংকেতপাঠক কেউ আসবে, পড়বে, চমকে উঠবে, অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ পেয়ে, তারপর যথাসময়ে বসবে বিশেষজ্ঞদের সভা, তারপর আসবে উপদেশ—

যদি অবশ্য দেবার মতো উপদেশ কিছু থাকে ওদের।

আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পরে গ্রান্ট দেখল, দেবার মতো উপদেশ সত্যিই কিছু নেই কন্ট্রোলের। বৈমানিক দু-জনের নিরাপত্তা কোন দিক থেকে আসতে পারে— তা ওঁরা ঠাউরে উঠতে পারেননি এখনও। তবে ভেবে দেখছেন, বিশেষ করেই ভেবে দেখছেন এবং আশা করছেন যে, অচিরেই একটা সহজবোধ্য উপায় তাঁরা বাতলে দিতে পারবেন।

উপস্থিত তাঁরা বৈমানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান স্টার কুইনের খোলে মজুদ মূল্যবান মালগুলোর উপরে। ওগুলো যেন কোনোমতে ক্ষতিগ্রস্ত না-হয়, কোনোরকম পরিস্থিতিতেই। শুক্র গ্রহের উন্নয়ন পরিকল্পনায় একান্তভাবে অপরিহার্য কতকগুলি জিনিস এবারে চালান হয়ে আসছে পৃথিবী থেকে। গুরুতর ক্ষতি হবে সেগুলি মারা পড়লে। তা ছাড়া ওখানকার বাসিন্দাদের নিত্যব্যবহারের গেরস্তালি জিনিস হাজারো রকমের। সেসব ঠিকমতো না-পৌঁছোতে পারলে তো জীবনযাত্রাই অচল হয়ে পড়বে মানুষগুলোর!

কথা বন্ধ হল ওদিককার। গ্রান্ট মুখ বিকৃত করলে একবার। যত চিন্তা ওদের ওই মালগুলোর জন্য। মানুষ দুটোর চাইতে মালের মূল্য বেশি। আর্থিক হিসাবে বেশি যে, তা অবশ্য গ্রান্টও অস্বীকার করে না। কারণ, ওসব তো ইনসিয়োর করাই হয়েছে দুই মিলিয়ন ডলারে! গ্রান্ট আর ম্যাকলিন কি আর দুই মিলিয়নে বিকোবার মতো দামি চিজ? কদাপি না!

কিন্তু দামি চিজ শুক্রের বাছাধনেরা হাতের মুঠোয় পাচ্ছেন কীভাবে? যদি কমদামি এই নরাধম দুটো মারাই পড়ে বেঘোরে? এ কথাটা ঠিক যে জাহাজটা মারা পড়বে না, অন্তত এক্ষুনি না। কিন্তু শুক্রে তো সে নামবেও না। নামাবে কে? যদি ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ার মারাই যায়? ঠিক সময়ে ঠিক যন্ত্রটা টিপলে তবেই তো ঠিক জায়গায় ভিড়তে পারে বিমান! সেই টেপার কর্মটি করছে কে?

কেউ করছে না। সুতরাং নিজের গতিপথে স্টার কুইন অপ্রতিহত বেগে ছুটতেই থাকবে। শুক্রকে বাঁয়ে ফেলে রেখে অনন্ত শূন্যে সে উধাও হয়ে যাবে, উড়তে পারবে যতদিন না জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। তা যখন ফুরোবে, তখন হয় কোনো গ্রহের চারদিকে আবর্তিত হতে থাকবে উপগ্রহের মতো নিজের একটা স্বতন্ত্র কক্ষপথ তৈরি করে নিয়ে; আর নয় তো পড়বে আর গুঁড়ো হয়ে যাবে কোথায়— তা কেউ বলতে পারে না।

শুক্র থেকে কোনো বিমান হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে মহাশূন্যের বুকেই স্টার কুইনকে পাকড়াবার জন্য। সে চেষ্টা তো বিফল হতে বাধ্য। সফল হতে হলে তার জন্য চাই স্টার কুইনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা। সে সহযোগিতা তো বিমান করতে পারে না, পারে বৈমানিক। কিন্তু বৈমানিক তো ততদিনে গতাসু!

মাল! মালের নিকুচি করেছে! চুলোয় যাক মাল!

হঠাৎ মাথা ঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে বসল গ্রান্ট।

চুলোয়? হ্যাঁ, চুলোয় যাবেই নিশ্চয়। কিন্তু গ্রান্ট যতক্ষণ বেঁচে বর্তে আছে, ততক্ষণ সে এটা দেখতে বাধ্য যে থানে-থান বজায় থাকে ওগুলো। তারপর যা হবার তা হোক, তার জন্য গ্রান্ট দায়ি নয়। যাবৎ জীবিতব্য, তাবৎ কর্তব্য।

গ্রান্ট উঠে দাঁড়িয়ে মালখানার দিক এগুল।

পাঁচ-শো বছর আগেকার, অর্থাৎ বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর সেকেলে বিমান নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁদের চোখে পঞ্চবিংশ শতাব্দীর এই স্টার কুইনের আকারটাই বেয়াড়া বিটকেল ঠেকবে। এর মাঝখানটা ঠিক যেন মোটা চোঙ একটা, এক-শো গজ লম্বা। এর দুই মাথায় দুটো চতুষ্কোণ অংশ, একটা বড়ো, একটা ছোটো। ছোটো অংশটাতেই কলকবজা ইঞ্জিন ইত্যাদি, এয়ার-লক এবং অক্সিজেন ট্যাঙ্ক। বড়োটাতে কন্ট্রোলরুম এবং বৈমানিকদের বাসস্থান।

কন্ট্রোলের পাশেই ক্যাপ্টেনের ঘর, এটা তালাবন্ধ। কারণ এ যাত্রায় স্টার কুইনে যাঁর ক্যাপ্টেন হয়ে আসার কথা ছিল, তিনি আসেননি। তার পাশে পর পর গ্রান্টের ও ম্যাকনিলের ঘর। ম্যাকনিলের ঘর পেরুলেই এক-শো গজ লম্বা সেই চোঙ। ওই চোঙই মালখানা।

তিনখানা ঘরের সামনে দিয়েই ঢাকা বারান্দা, সেই বারান্দার প্রান্তে মালখানায় ঢোকার দরজা। গ্রান্ট দেখে অবাক, সে দরজা খোলা!

মালখানার দরজা খোলা কেন? অবশ্যই ম্যাকনিল খুলেছে।

কেন খুলবে এ-সময়? খুলে যদি ও-মাথায় ইঞ্জিনঘরে গিয়ে থাকে, তাহলে তো ও-দরজা ওপিঠ থেকে বন্ধ করে যাওয়া উচিত ছিল!

ম্যাকনিলের কথা ভাবতে গিয়েই পাশের দিকে দৃষ্টি পড়ল গ্রান্টের, ম্যাকনিলের ঘরের পানে। তার দরজাও বন্ধ নয়, আধ-খোলা। সেই ফাঁক দিয়ে আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ল— একটা পিপে ভাসছে হাওয়ায়। ম্যাকনিলের বিছানার পাশে। অভিকর্ষ দুর্বল বলে যেকোনো জিনিসেরই উপরপানে ভেসে ওঠবার ঝোঁক থাকে, মহাশূন্যের এই স্তরে। সুতরাং পিপে ভাসছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

আশ্চর্য ঠেকল যে জিনিসটা তা হল— ইঞ্জিনিয়ার মশাইয়ের কাণ্ডকারখানা! পিপেটা ঠিক হাতের নাগালেই ম্যাকনিলের। বিছানায় আধশোয়া অবস্থাতেই সে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পিপের দিকে। এক হাতে নল খুলে দিয়ে অন্য হাতে গেলাস ধরেছে সেই নলের নীচে। কুলকুল করে সোনালি মদ গড়িয়ে পড়ছে গেলাসে। দেখতে দেখতে ভরে উঠল সেটা, তখন নল বন্ধ করে গেলাস মুখে তুলল ম্যাকনিল।

ক্রোধ আর ঘৃণা এমন সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল গ্রান্টের চোখে-মুখে যে ম্যাকনিল সোজা হয়ে বসে একটা জবাব দিতে বাধ্য হল, ‘মরতেই যখন হবে, তখন শেষ সময়টা একটু আরামেই কাটাতে চাই।’

‘নিজের পয়সায় মদ কিনে আরাম করলে আমার কিছু বলবার থাকত না। ওই পিপেটা আমারও নয়, তোমারও নয়। পৃথিবী থেকে চালান হয়ে যাচ্ছে শুক্রের উপনিবেশিদের কাছে। দাম দেবে তারাই, বা আগেই দিয়ে রেখেছে। সুতরাং আরামের লোভে যে-কাজটি তুমি করে বসেছ, তা হচ্ছে স্রেফ চুরি।’

ম্যাকনিল অন্যায় করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য সহকর্মী লোকটা, সুযোগ্য অভিজ্ঞ বৈমানিক একটা, তাকে চট করে চোর বলে বসাও কম অন্যায় হয়নি গ্রান্টের। দোষ কিন্তু গ্রান্টের নয়, দোষ হল এই পরিস্থিতিটার। পৃথিবীর মহাকাশ কন্ট্রোল দু-টি মাত্র লোককে স্টার কুইনে পুরে পাঁচ মাসের বিপজ্জনক পথ-পরিক্রমায় পাঠিয়েছেন। এটা হিসাব করে দেখেননি যে, দু-খানা কাঠে অনবরত ঘষা লাগাতে থাকলে তা থেকে আগুনও বেরুতে পারে, যদি-না মাঝেমাঝে জল ঢালবার জন্য মধ্যস্থ কেউ থাকে। এ ক্ষেত্রে নেই, গ্রান্ট ম্যাকনিলের ভিতরকার সম্পর্ক আগে থেকেই দিনের দিন তিতো হয়ে আসছিল, এই অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে যাওয়ায় সেই তিক্ততা এক এক লাফে একেবারে হিংস্রতার পর্যায়ে চড়ে বসেছে।

ম্যাকলিন অবশ্য দপ করে জ্বলে উঠল না চোর অপবাদ শুনে। জ্বলে-ওঠার মতো স্বভাবই তার নয়। ‘ও তো এখন বেওয়ারিশ মাল—’ বলল সে, ‘শুক্রে পৌঁছোবে, অমন আশা থাকলে আমি ওতে হাত দিই?’

ওর কণ্ঠ বাঘের মতো গর্জাচ্ছে না বটে, কিন্তু সাপের মতো হিসহিস করছে।

‘ও মাল শুক্রে পৌঁছোবে না— এমন কথা ভাববার সময় এখনও আসেনি। হয়তো তুমিই দেবে পৌঁছে’, এই কথা বলতে বলতে ভাসমান পিপেটাকে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে মালখানার দিকে নিয়ে গেল গ্রান্ট।

কথাটা গ্রান্ট অবশ্যই ঠাট্টা করে বলেছিল ম্যাকনিলকে। নিষ্ঠুর ঠাট্টাই বটে! কিন্তু সে-নিষ্ঠুরতা উপলব্ধি করার পরেও তা নিয়ে চিন্তা করার সময় পেল না গ্রান্ট। মুখ দিয়ে তার এ কী কথা বেরুল? সে শুধু এই কথাই ভাবছে, চোঙের ভিতর এধার-ওধার ঘুরতে ঘুরতে। ম্যাকনিলই হয়তো পৌঁছে দেবে, বলেছে ও। এ কী দৈববাণী? অসম্ভব কী?

দাঁড়াও। হিসাব করি আগে। ট্যাঙ্ক ফেটেছে, তাতে আর এক কণাও অক্সিজেন নেই। তবু বেঁচে আছি এখনও। ম্যাকনিল আর আমি দু-জনই বেঁচে আছি। তার কারণ, এই বিমানের হাওয়া এখনও নিশ্বাস নেওয়ার অযোগ্য হয়ে ওঠেনি। পৃথিবীর আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসার সময় যে বিশুদ্ধ বাতাস ভরে এনেছিল জঠরে, তা তত বিশুদ্ধ না হলেও এখনও মারাত্মক হয়ে ওঠেনি মানুষের পক্ষে। কারণ, এতদিন পর্যন্ত প্রতিদিনই ট্যাঙ্ক থেকে নতুন অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছে বিমানের বাতাসে।

তা ছাড়াও কলুষিত বাতাস বিশুদ্ধ করে নেবার যন্ত্র আছে বিমানে। সে তার কাজ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। নিশ্বাসের সঙ্গে যে দূষিত বাষ্প মানবদেহ থেকে বেরুচ্ছে, তা নিষ্ক্রিয় করে দেবার মতো ক্ষমতা আছে সে রি-জেনারেটরের। দূষিত জিনিসটা নষ্ট করে দিতে গিয়ে অবশ্য বাতাসের অক্সিজেন অংশটা ক্রমশ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে-ক্ষয় খুব দ্রুত নয়, হঠাৎ তার দরুন শ্বাসরোধ হওয়ার আশঙ্কা নেই। শ্বাসকষ্ট অবশ্য এখন শুরু হবে, দুই-এক দিনেই হবে; কিন্তু শ্বাসরোধের পর্যায় আসতে দেরি আছে।— কত দেরি?

কন্ট্রোলে পৌঁছে গ্রান্ট আঁক কষে বার করল, কুড়ি দিন দেরি। কুড়ি দিন পরে আর এই বিমানে নিশ্বাস নিতে পারবে না কোনো মানুষ।

গ্রান্ট আর ম্যাকনিলের জীবনের মেয়াদ তা হলে কুড়ি দিন। অথচ শুক্র রয়েছে ত্রিশ দিনের দূরত্বে। দশটা দিনের ফারাক। মাত্র দশটা দিন।

দাঁড়াও। দু-জন লোক শ্বাস নিচ্ছে, ছাড়ছে। দূষিত বাষ্প বেরুচ্ছে দুটো দেহ থেকে। তাতেই কুড়ি দিন লাগবে বাতাসটার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে।

কিন্তু দুটো না-হয়ে দেহ যদি একটা হয়? একটামাত্র মানুষের শ্বাস যদি কলুষিত করতে থাকে বাতাসটাকে?

তাহলে অবশ্য বাতাস আরও অনেক দিন নিশ্বাস নেওয়ার যোগ্য থাকবে। আবার খানিকটা আঁক কষল গ্রান্ট। ঠিক আছে। একজন যদি থাকে বিমানে, এই বাতাসই তাকে ত্রিশ দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।

গ্রান্ট সারারাত ভাবল। না। লটারি নয়। ম্যাকনিলের সঙ্গে লটারি। যে বিপদের মুখে পড়লে ভয়ে কাঁপে? সে ভয় তাড়াবার জন্য পরের মদ চুরি করে খায়? যিশু কহো! লটারি হয় সমানে সমানে। চক্ষু বুজে তাসের গাদা থেকে তুমি একটা তাস তুলে নাও, আমি একটা তাস তুলে নিই। যে বড়ো তাস তুলবে, সে বেঁচে থাকবে, যে ছোটো তুলবে—

না, ওসব নয়। ওসব হয় সমানে সমানে। ওই ভীতু, ওই চোর, ম্যাকনিলের সঙ্গে জীবন-মৃত্যুর লটারি করতে পারে না গ্রান্ট। তা ছাড়া, লটারিতে ঝুঁকি আছে, ও হয়তো সে-ঝুঁকি নিতেও চাইবে না। দরকার কী? জীবনটা ওকে ভিক্ষাই দিয়ে যাবে গ্রান্ট।

পরের দিন ও শুক্রের কন্ট্রোলকে ডেকে বলল, ‘ম্যাকনিল বিমান নিয়ে যাচ্ছে। দু-জনের বাঁচা সম্ভব নয়, কাজেই আমি স্টার কুইন থেকে নেমে যাচ্ছি।’

‘সে কী? সে কী? সে কী?’ এ ব্যাকুল প্রশ্নের আর জবাব পেলে না শুক্রের কন্ট্রোল।

সন্ধ্যা বেলায় ম্যাকনিলকে ডেকে নিয়ে গ্রান্ট এয়ার-লক খুলে দাঁড়াল। গ্রান্টের পিঠে একটা রকেট বাঁধা। রকেটের ধাক্কা খেয়ে দূরে গিয়ে না-পড়লে দেহটা বিমানের পাশে পাশে ভাসতে ভাসতে চলতে থাকবে, এমন একটা আশঙ্কা আছে।

‘এই রকেটে আগুন দিয়ে দাও, তারপর এয়াব-লক বন্ধ করে গিয়ে কন্ট্রোলে বসো। ত্রিশ দিনের দিন শুক্রে পৌঁছোবে, ইতিমধ্যে ওদের মদগুলো সাবাড় করে দিও না।’ বলল গ্রান্ট।

ম্যাকনিল গুম হয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, একবার বুঝি পিছিয়ে এসে ভিতরে ঢুকে পড়বার চেষ্টাও করল, কিন্তু তক্ষুনি সে এক ধমক খেল গ্রান্টের ‘ভীতু, অপদার্থ’ বলে। তারপরই দৃঢ় পদে এগিয়ে এসে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ধরিয়ে দিল ফিউজে।