৭. জাতীয় সংসদ : পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সমরূপ অনুকরণ (Isomorphaic mimicry)
৭.১ পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সমরূপ অনুকরণ
জীববিজ্ঞানে সমরূপ অনুকরণ (Isomorphaic mimicry) নামে একটি ধারণা (concept) প্রচলিত আছে।[১] এই ধারণার বক্তব্য হলো যে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনেক জীবজন্তু এমনভাবে বিবর্তিত হয়, যাতে তাদের হিংস্র বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে আদৌ হিংস্রতা নেই। একধরনের সাপ রয়েছে, যাদের মধ্যে কোনো বিষ নেই। কিন্তু এ ধরনের সাপকে সবাই আক্রমণ করে। সুতরাং সেই সাপকে বেঁচে থাকার জন্য নীল রং ধারণ করতে হয়। সাপের রং দেখে সবাই একে প্রচণ্ড বিষধর সাপ মনে করে এড়িয়ে যায় এবং এর ফলে এরা বেঁচে যায়। জীববিজ্ঞানের এ ধারণাকে সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োগ করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রিটচেট ও তাঁর সহকর্মীরা।[২] তাঁর বক্তব্য হলো যে উন্নয়নশীল দেশসমূহ উন্নত দেশসমূহ থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান ধার করেছে, যারা দেখতে উন্নত দেশসমূহের প্রতিষ্ঠানের মতো, কিন্তু আদতে তাদের কোনো কার্যকারিতা নেই। অনেক দেশে পুলিশ বাহিনী রয়েছে, যাদের সাজসজ্জা, বন্দুক, অবকাঠামো—সবই উন্নত দেশের পুলিশের মতো অথচ কার্যক্ষেত্রে এরা দুর্বৃত্ত। পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচিত জাতীয় সংসদ রয়েছে যাকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। বাস্তবে অনেক দেশেই সংসদ পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সমরূপ অনুকরণ : এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন, সংবিধানে তাঁদের ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু আসলে এসব ক্ষমতার কোনোটাই তাঁরা প্রয়োগ করতে পারেন না, বা করছেন না। সমাজজীবনে সমরূপ অনুকরণের তিনটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে :
ক. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো (forms) এবং কার্যাবলির (functions) সমান্তরাল ভুবন। অনেক সময় মনে করা হয় যে প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোকে অনুসরণ করে। অনেক ক্ষেত্রেই কার্যাবলি ও কাঠামোর মধ্যে সুস্পষ্ট যোগসূত্র লক্ষ করা যায় না। প্রিটচেট ও উইজার যথার্থই লিখেছেন, ‘It is easier to create an organization that looks like police force- with all the de jure forms, organizational charts, ranks, uniforms, buildings, weapons- than it is to create an organization with the de facto function of enforcing the law.[৩]
খ. ক্ষমতার বেশি দায়িত্ব গ্রহণ (premature load-bearing)। অনেক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নত দেশসমূহের কার্যরত প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষমতা নেই। তবু উন্নয়নশীল দেশসমূহের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্ষমতার বেশি দায়িত্ব নেয় এবং তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হয়। এর ফলে বাস্তবতা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ফারাক তৈরি হয়।
গ. অযোগ্যতার ফাঁদ (Capability Trap) ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। যখন উন্নয়নশীল দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নত দেশসমূহে কার্যরত প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা নেই অথচ সেসব দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অনুকরণ করে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। অথচ সে কাঠামোর পক্ষে উক্ত দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। বস্তুত ত্রুটিপূর্ণ পুরোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া সোজা।
উন্নত দেশসমূহের অনুকরণে উন্নয়নশীল দেশসমূহে সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাত্ত্বিক দিক থেকে সংসদের চারটি বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভাজন (Separation of power), যার মূলে রয়েছে একটি স্বাধীন সংসদ। যদি সংসদ স্বাধীনভাবে কাজ করে, তবে ক্ষমতার বিভাজন রক্ষা করা সম্ভব। আর যদি সংসদ নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে নির্বাচিত স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, সংসদের দায়িত্ব হলো সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা। সংসদ হলো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তি। যেহেতু প্রাচীন গ্রিসের তুলনায় আধুনিক রাষ্ট্রে জনসংখ্যা বিশাল, সেহেতু এখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত শক্ত। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে এখানে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় গণপ্রতিনিধিরা প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জনগণের ভোটারদের প্রতিনিধি। তাঁর কাজ হলো সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করছে কি না, তার তদারক করা। যদি সরকার ব্যর্থ হয়, তবে তাঁর দায়িত্ব হলো সে সরকারকে অনাস্থা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া। পক্ষান্তরে আজকের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে যে গণপ্রতিনিধিরা দলীয় রাজনীতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সরকার সম্পর্কে তাঁদের ব্যক্তিগত মূল্যায়নের কোনো প্রভাব শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয় না। সরকার থাকবে কি থাকবে না, সেটা গণপ্রতিনিধিরা নির্ধারণ করেন না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় রাজনৈতিক দল। পক্ষান্তরে কে গণপ্রতিনিধি থাকবেন বা থাকবেন না, সেটাও নির্ধারণ করে রাজনৈতিক দল। তাই যেসব রাষ্ট্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা অত্যন্ত সংকীর্ণ, সেসব রাষ্ট্রকে সমরূপ অনুকরণ গণ্য করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, সংসদের দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও অনুমোদন। দেশে কোনো নতুন আইন প্রবর্তন করতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগে। প্রচলিত আইন বাতিল ও সংশোধনের জন্যও সংসদের অনুমোদন লাগে। আইন প্রণয়নের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হলে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে হয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই আইন প্রণয়ন ও অনুমোদনের এই দায়িত্ব সংসদ পালন করে থাকে।
চতুর্থত, সরকারের আয় ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ সংসদের একটি বড় দায়িত্ব। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংসদীয় গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে ‘জনপ্রতিনিধিদের অনুমোদন ছাড়া কোনো কর নয়’ (No taxation without representation) এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য। পৃথিবীর সব দেশেই সরকারের বাজেট অনুমোদনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সংসদ সদস্যদের বাজেট অনুমোদন ও বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণে কোনো ভূমিকা নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিকেও সমরূপ অনুকরণ গণ্য করা যেতে পারে।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় সংসদের দায়িত্ব ও ভূমিকা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে সংসদের পক্ষে সব সময় চারটি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো দায়িত্ব আংশিকভাবে প্রতিপালিত হয় আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনো দায়িত্বই পালন করা হয় না। সংসদ পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই আছে। নির্বাচিত জাতীয় সংসদ থাকলেই চলবে না, সংসদকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো, জাতীয় সংসদের লক্ষ্য এবং অর্জনের তুলনা করে বাংলাদেশে সংসদের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ পেশ করা। প্রবন্ধটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে জাতীয় সংসদের লক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সংসদের ধারণা উন্নত দেশসমূহ থেকে ধার করা হয়েছে। এর ফলে অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সংসদ উন্নত দেশের সমরূপ অনুকরণ। কিন্তু কার্যকারিতায় এরা নিষ্ফল। তাই এ প্রসঙ্গে প্রথমেই সমরূপ অনুকরণ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ তার লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু সফল হয়েছে, সে সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে জাতীয় সংসদ তার আইনগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। তবে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও সংসদ সদস্যরা তাঁদের নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরেও ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। এর ফলে সংসদের সাংবিধানিক ভূমিকা এবং বাস্তব ভূমিকার মধ্যে ফারাক দেখা দিয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে তাই সংসদ সদস্যরা তাঁদের মূল দায়িত্বের বাইরে যে কাজ করছেন, তার বর্ণনা করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে আগের তিনটি খণ্ডের বিশ্লেষণের আলোকে সংসদকে আরও কার্যকর ও প্রাণবন্ত করার জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
৭.২ বাংলাদেশে সংসদের ভূমিকার মূল্যায়ন
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন আকারে সংসদ রয়েছে। সংসদের প্রধানত চারটি দায়িত্ব রয়েছে :
• নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও তদারক
• আইন প্রণয়ন
• বাজেট অনুমোদন ও সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ
• জনগণের দাবিদাওয়া পূরণ।
নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও তদারক
নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকের মাত্রা দেশভেদে ভিন্ন হয়। সংসদের এ ধরনের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি হয় সংসদীয় গণতন্ত্রে। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের নিয়োগ এবং পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন ধরা যাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে। সংবিধানে এই সংসদের ক্ষমতাও চিহ্নিত করা হয়েছে কিন্তু নির্বাহী বিভাগের প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের কোনো ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ক্ষমতাও সংসদকে দেওয়া হয়নি। শুধু অভিসংশনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অপসারণ এবং অভিসংশনের মধ্যে তফাত রয়েছে। কেউ যদি যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর কাজ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁকে অপসারণ করা যাবে। কিন্তু অভিসংশনের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। শুধু শারীরিক অসামর্থ্য, ফৌজদারি অপরাধ ও সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিসংশন করা যেতে পারে, অন্যথায় নয়। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংসদ আছে কিন্তু সংসদীয় সরকার নেই। অন্যদিকে ভারতে নির্বাহী বিভাগের প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতে হয় এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদ হারান। সংসদের ওপর প্রধানমন্ত্রীর এই নির্ভরশীলতার ফলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়। তাঁকে মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্য যাঁরা তাঁর মতো সংসদ সদস্য, তাঁদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে সংসদে যে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে, সেটা ব্যক্তিগত নয়, গোষ্ঠীভিত্তিক বা Collegial। তাই প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হলেও তাঁকে সমকক্ষদের নেতা বা Primus inter pares বলা হয়ে থাকে। বিলাতে এই সংসদীয় গণতন্ত্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। এ ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাও অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শুধু সমকক্ষদের নেতাই থাকেন না, তাঁর ক্ষমতার পরিধি অনেক বেড়ে যায়। উপরন্তু নির্বাচনের সময় ভোটাররা শুধু সংসদ সদস্যই নির্বাচিত করেন না, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে বিষয়েও তাঁরা আগ্রহী। কাজেই সংসদ সদস্যদের দ্বারা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
ভোটের আগেই রাজনৈতিক দলকে প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁদের মনোনীত প্রার্থীকে তুলে ধরতে হয়। এর ফলে পৃথিবীর সর্বত্র সংসদীয় গণতন্ত্রে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। যদিও সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচন করেন ও অপসারণ করার ক্ষমতা রাখেন, তবু বাস্তবে এ ক্ষমতা অনেকাংশে জনগণের কাছে চলে গেছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদ শক্তিশালী হয়েছে। তবু বেশির ভাগ সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে প্রধানমন্ত্রীকে দলের সংসদ সদস্যকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি এই ব্যবস্থাতেও একটি চিড় ধরেছে। সংসদ সদস্যরা যদিও দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন, তবু পূর্বে তাঁদের দলের ক্রীড়নক হিসেবে গণ্য করা হতো না। এর ফলে সংসদ সদস্যরা সদস্য হিসেবে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের বিবেকের কাছে দায়ী থাকতেন। তাঁদের জন্য দলের আজ্ঞা সর্বত্র প্রতিপালন করার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। এই ব্যবস্থায় অনেক উন্নয়নশীল দেশে অপব্যবহৃত হয়। সংসদ সদস্যরা নগদ টাকা অথবা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার লোভে সরকার পরিবর্তনের জন্য তাঁদের ভোট বিক্রি করা শুরু করেন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে শুধু ভোট বিক্রিই হয়নি, সংসদ সদস্যরা সরকার পরিবর্তনের জন্য গুন্ডামি করে সংসদ ভবনে স্পিকার শাহেদ আলীকে হত্যা করেন। এর ফলে সংসদ সদস্যদের অধিকার খর্ব করার প্রশ্ন ওঠে। সেই স্পিকার হত্যার ঘটনাকে স্মরণ রেখে বাংলাদেশে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে নিম্নলিখিত বিধান করা হয়।
৭০(১) কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
ব্যাখ্যা— যদি কোন সংসদ সদস্য, যে দল তাহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া—
(ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা
(খ) সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।
(২) যদি কোন সময় কোন রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে কোন প্রশ্ন ওঠে তাহা হইলে সংসদে সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বের দাবিদার কোন সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে অবহিত হইবার সাত দিনের মধ্যে স্পিকার সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী উক্ত দলের সকল সংসদ সদস্যের সভা আহ্বান করিয়া বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত দলের সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করিবেন এবং সংসদে ভোটদানের ব্যাপারে অনুরূপ নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ যদি কোন সদস্য অমান্য করেন তাহা হইলে তিনি (১) দফার অধীন উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
(৩) যদি কোন ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার পর কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন, তাহা হইলে তিনি এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে উক্ত দলের মনোনীত প্রার্থীরূপে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধান সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী। সংসদীয় গণতন্ত্রে সব ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেওয়া হয়ে থাকে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা খর্ব করে সে ক্ষমতা রাজনৈতিক দলের হাতে দেওয়া হয়েছে। যদি দলের কর্মকাণ্ডে কোনো সদস্য অসন্তুষ্ট হন, তাহলে তাঁর দল থেকে পদত্যাগ করার স্বাধীনতা আছে। এই বিধান অনুসারে দল থেকে পদত্যাগ করলে তিনি সংসদ সদস্যের পদ হারাবেন। শুধু দল থেকে পদত্যাগ নয়, দলের বিপক্ষে কোনো ক্ষেত্রে ভোট দেওয়ার অধিকারও তাঁর নেই। এমনকি সংসদে অনুপস্থিত থাকলে অথবা উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকলে তাকেও বিপক্ষে ভোট হিসেবে গণ্য করা হবে। ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় দলের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে কীভাবে তা নির্ধারণ করা হবে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু নির্দলীয়ভাবে নির্বাচিত প্রার্থীরা সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে তাঁদেরকেও দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত সাংসদদের যেভাবে আচরণ করতে হয়, একই রকম আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক দলের ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছে। তাঁদের পক্ষে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, পক্ষান্তরে সরকারকে সংসদীয় দলের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ফলে বাংলাদেশে সংসদ আছে ঠিকই, কিন্তু সংসদীয় সরকার কতটা আছে, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিভাগের হাতে সব কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং সংসদের কার্যকারিতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।
পৃথিবীর বেশির ভাগ সংসদীয় গণতন্ত্রে ৭০ ধারার মতো বিধান নেই। সংসদ সদস্যদের তাঁদের বিবেক অনুসারে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবু সম্প্রতি কোনো কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো সংসদ সদস্যদের ওপর নিয়ন্ত্ৰণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাদেশের মতো বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব যেভাবে হ্রাস করা হয়েছে, পাকিস্তানে ততটা করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সংবিধানের ৬৩(এ) অনুচ্ছেদ নিচে উদ্ধৃত করা হলো :
63A. ‘(i) If a member of a Parliamentary Party composed of a single political party in a House-
(a) resigns from membership of his political party or joins another Parliamentary party; or
(b) votes or abstains from voting in the House contrary to any direction issued by the Parliamentary Party to which he belongs, in relation to-
(i) election of the Prime Minister or the Chief Minister; or
(ii) a vote of confidence or a vote of no-confidence; or
(iii) a Money Bill or a Constitution (Amendment) Bill.[৫]
অর্থাৎ, পাকিস্তানের সংবিধানে সংসদ সদস্যরা তিনটি ক্ষেত্রে দলের নির্দেশ অমান্য করলে তাঁদের সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। এ তিনটি ক্ষেত্র হলো : (১) প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে দলের নির্দেশ অনুসারে ভোট না দিলে। (২) আস্থা অথবা অনাস্থা ভোটে দলের নির্দেশ অনুসারে ভোট না দিলে এবং (৩) অর্থবিল ও সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিলের ওপর দলের নির্দেশ অনুসারে ভোট না দিলে। পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ইচ্ছামতো ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদ সদস্যদের এ ধরনের কোনো স্বাধীনতা নেই। যে দল সংসদ সদস্যকে নির্বাচিত প্রার্থীরূপে মনোনীত করেছে, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করে যদি সাংসদ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন অথবা ভোটদানে বিরত থাকেন অথবা বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। বাংলাদেশে তাই সংসদ সদস্যদের ওপর দলের নির্দেশ সর্বক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের কোনো ক্ষেত্রেই তাঁদের বিবেক অনুসারে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এ জন্যই সম্প্রতি সংসদ সদস্যদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা দিয়ে যে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, তার আইনগত মর্যাদা নেই বলে বাংলাদেশ হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছেন। হাইকোর্টের বক্তব্য হলো, অভিশংসন একটি বিচারপ্রক্রিয়া এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় বিচারক তাঁর বিবেকের নির্দেশে কাজ করবেন, অন্য কারও নির্দেশে নয়। বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে সাংসদেরা দলের নির্দেশে কাজ করতে বাধ্য। কাজেই এই বিচারকদের অভিশংসনের দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে, তবু হাইকোর্টের রায়ে বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে।
সংসদ সদস্যদের পক্ষে আইনগতভাবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে তাঁদের দল। যেহেতু তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সরকারপ্রধান এবং দলের প্রধান একই ব্যক্তি, সেহেতু সরকারপ্রধান দলীয় প্রধান হিসেবে তাঁর দলের সংসদ সদস্যদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সংসদ সদস্যরা কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রের সমর্থন পান না। কাজেই সংসদ সদস্যরা এমনিতেই রাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য নির্বাহী বিভাগের মুখাপেক্ষী থাকেন। তারপর দলের নিয়ন্ত্রণ নির্বাহী বিভাগের কুক্ষিগত থাকাতে বস্তুত সংসদ সদস্যদের সরকারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সংসদ সদস্যদের দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো আইন প্রণয়ন করা। সংবিধান অনুসারে সংসদ সদস্যরা দেশের আইন প্রণয়ন করেন এবং সে উদ্দেশ্যে সব বিল সরকার কর্তৃক সংসদে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু সেসব আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যরা কতটা অবদান রাখতে পারেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সারণি-৭.১-এ দশম জাতীয় সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রমে সংসদ সদস্যদের ব্যয়িত মোট সময়ের শতকরা হার দেখা যাবে।
সারণি – ৭.১
সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রমে সদস্যদের ব্যয়িত মোট সময়ের শতকরা হার

সারণি-৭.১ থেকে দেখা যাচ্ছে, দশম জাতীয় সংসদে সদস্যরা তাঁদের মোট সময়ের মাত্র ৬ শতাংশ সময় বাজেট ব্যতীত অন্যান্য আইন আলোচনায় ও প্রণয়নে ব্যয় করেছেন। এখন আইন যেহেতু সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষা করার পর জাতীয় সংসদে আলোচিত হয়, সেহেতু আইনসংক্রান্ত আলোচনা জাতীয় সংসদে কমে যাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তবু আইন প্রণয়নের জন্য মাত্র ৬ শতাংশ সময় প্রদান থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদের ভূমিকা কম। এমন নজিরও রয়েছে, যেখানে সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও প্রায় বিনা আলোচনাতেই পাস হয়ে গেছে। এর একটি বড় কারণ হলো, বেশির ভাগ সংসদেই বিরোধী দল সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নেয় না।
বর্তমান সংসদে আইনগতভাবে বিরোধী দলের উপস্থিতি থাকলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এর একটি বড় কারণ হলো, বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর আইন প্রণয়নে দক্ষতা থাকে না এবং এ বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ অনেক কম। সারণি-৭.২-এ বাংলাদেশের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের প্রধান পেশা সম্পর্কে উপাত্ত দেখা যাবে।
সারণি-৭.২ থেকে দেখা যাচ্ছে, গত চার দশকে সংসদে ব্যবসায়ী সাংসদেরা নিরঙ্কুশ প্রাধান্য লাভ করেছেন। প্রথম সংসদে মাত্র ১৮ শতাংশ সদস্যের প্রধান পেশা ছিল ব্যবসা। ৮ম সংসদে এই হার ৫৮ শতাংশে উন্নীত হয়, ৯ম সংসদে এই হার ছিল ৫৭ শতাংশ এবং ১০ম সংসদে এই হার ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সারণি-৭.২
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের প্রধান পেশা

অন্যদিকে অন্যান্য পেশাজীবীর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। প্রথম সংসদে ৩১ শতাংশ সংসদ সদস্যের প্রধান পেশা ছিল আইন। ৮ম শতাংশে এই হার ১২ শতাংশে নেমে আসে। ১০ম সংসদে এই হার ছিল ১৩ শতাংশ। ১ম সংসদে ১২ শতাংশ সদস্য কৃষিজীবী ছিলেন, ১০ম সংসদে কৃষিজীবীদের হার ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ১ম সংসদে ১১ শতাংশ সদস্যের প্রধান পেশা ছিল শিক্ষকতা, ১০ম সংসদে শিক্ষকদের হার ২ শতাংশে নেমে এসেছে। গত চার দশকে নির্বাচিত সাংসদদের পেশা পরিবর্তনের ফলে আইন প্রণয়নে আগ্রহী সাংসদদের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সংসদের তৃতীয় দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের পক্ষে সরকারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্ৰণ করা। এই লক্ষ্যে সংসদ সদস্যদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের প্রশ্ন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীকেও প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংসদে সংসদ সদস্যরা এ সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন। তবে সরকারের ওপর এর খুব একটা স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায় না। সরকারের তদারকিতে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা রয়েছে। সংসদের কার্যবিধিমালায় সংসদ সদস্যদের সংসদে প্রশ্ন উপস্থাপন করার ও তার জবাব পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সংসদ সদস্যরা এ অধিকার প্রয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ এবং জনগণের অবগতির জন্য তা বিতরণ করার ব্যবস্থা করতে পারেন। এভাবে তাঁরা সরকারের ক্রিয়াকলাপের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেন।
এ ছাড়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে সংসদীয় কমিটি নিয়োগ করা হয়েছে। এই সংসদীয় কমিটিসমূহ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সব কার্যকলাপ বিবেচনা করতে পারেন এবং এ সম্পর্কে সংসদের বিবেচনার জন্য সুপারিশ পেশ করতে পারেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কমিটি-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল কিন্তু এসব কমিটি ছিল অস্থায়ী এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব কমিটি স্থাপন করা হতো। পক্ষান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী কমিটি-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সম্প্রতি পৃথিবীর সব দেশেই স্থায়ী কমিটি-ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি উঠেছে। এর কারণ হলো দুটি। প্রথমত, যেহেতু সংসদ নির্বাচন চার-পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু দেশের শাসন সম্পর্কে জনগণের অভিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। যদি সংসদীয় কমিটি সব মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপের ওপর নিয়মিত শুনানির ব্যবস্থা করে, তাহলে সরকারের কার্যকারিতা সম্পর্কে জনমত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি সম্ভব। দ্বিতীয়ত, বাজেট-ব্যবস্থা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। এতে জনমত বিবেচনার কোনো সুযোগ থাকে না। কমিটি-ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সে সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
সরকারের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপায় হচ্ছে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ওপর সংসদের স্থায়ী অথবা স্ট্যান্ডিং কমিটি প্রতিষ্ঠা করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে স্ট্যান্ডিং কমিটিসমূহের মাধ্যমেই সংসদীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন তাই বলেছেন : It is not far from the truth to say that Congress in session is Congress on public exhibition whilst Congress in its committee rooms is Congress at work.৬ তবে সংসদীয় ব্যবস্থায় এ ধরনের কমিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতো না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষ উদ্দেশ্যে অস্থায়ী কমিটি স্থাপন করা হতো। স্থায়ী কমিটির রেওয়াজ সংসদীয় গণতন্ত্রে ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী কমিটিগুলোর সাফল্যের ফলে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রেও স্থায়ী কমিটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নিম্নলিখিত স্থায়ী কমিটিগুলো ছিল : (1) Business Advisory Committee (2) Committee on Private Member’s Bills and Resolutions (3) Committee on Petitions (4) Committee on Estimates (5) Committee on Public Undertakings (6) Committee on Government Assurances (7) House Committee (8) Library Committee এবং (9) Standing Committee on rules of Procedure। কিন্তু প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপের তদারক করার জন্য স্থায়ী কমিটি ছিল না। তবে সব মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটি বা স্থায়ী কমিটি প্রতিষ্ঠার জন্য সিভিল সমাজ থেকে দাবি উত্থাপিত হয় এবং দাতাদের পক্ষ থেকেও এ দাবিকে সমর্থন করা হয়। এর ফলে চতুর্থ সংসদ থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি করে কমিটি স্থাপন করা হয়। সারণি-৭.৩-এ বিভিন্ন সংসদে কমিটির সংখ্যা দেখা যাবে।
জাতীয় সংসদ : পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সমরূপ অনুকরণ ১৯৭
সারণি-৭.৩
বিভিন্ন সংসদে কমিটির সংখ্যা

১৯৯১ সালে নির্বাচিত পঞ্চম সংসদ থেকে বাংলাদেশের সংসদে প্রতিটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে গঠিত স্থায়ী কমিটি এবং অন্য কমিটিসমূহ কাজ করছে। বিধি অনুসারে প্রতিটি স্ট্যান্ডিং কমিটির মাসে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠান করতে হবে। সারণি-৭.৪-এ সপ্তম থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত স্থায়ী কমিটিসমূহের কয়টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সম্পর্কে উপাত্ত দেওয়া হলো।

সারণি-৭.৪ থেকে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ স্থায়ী কমিটি বছরে কমপক্ষে ১২টি সভা অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত নবম সংসদে ও সপ্তম সংসদে ১৭.১ শতাংশ স্থায়ী কমিটির গড়ে বছরে ১২টি বা তার চেয়ে বেশি সভা অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টম সংসদে এই হার ১১.১ শতাংশে নেমে আসে এবং নবম সংসদে এই হার ছিল ১২.৫ শতাংশ। অবশ্য গড়ে ৯ থেকে ১১টি সভা অনুষ্ঠিত হয়, এ ধরনের স্থায়ী কমিটির হার সম্প্রতি বেড়েছে। পঞ্চম সংসদে এই ধরনের স্থায়ী কমিটির হার ছিল ১৭.১ শতাংশ। নবম সংসদে এই হার ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবু সামগ্রিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে যে কমিটির সভা অনুষ্ঠানে সদস্যদের খুব একটা আগ্রহ নেই। নবম সংসদে প্রায় ৪৭.৫ শতাংশ স্থায়ী কমিটিতে চার থেকে পাঁচটির কম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদেশি দাতাদের খুশি করার জন্য সংসদে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য স্থায়ী কমিটি (Standing Committee) গঠন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দল থেকেও কমিটির সভাপতি মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং মন্ত্রী ছাড়া অন্য সংসদ সদস্যদের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১১ সালে পরিচালিত একটি মূল্যায়নে স্থায়ী কমিটির নিম্নলিখিত দুর্বলতাগুলো প্রকাশ পায়। এ
• স্বার্থের সংঘাত : গণমাধ্যমে এমন প্রচুর অভিযোগ করা হয়েছে যে যেখানে সংসদ সদস্যদের স্বার্থের হানি ঘটে, সেখানেই তাঁরা শুনানির উদ্যোগ নেন। এতে জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই উপকৃত হচ্ছে না।
• আইন প্রণয়নের কাজে সংসদ সদস্যদের অনীহা : ২০১১ সালে দেখা যায় যে নির্বাচিত সংসদ প্রথম ২০ মাসে ১১৩টি বিল পাস করে। এর মধ্যে ৪০টি বিল ৫ মিনিটের কম সময়ে পাস হয়ে যায়। অবশ্য এর একটি বড় কারণ ছিল সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের অনুপস্থিতি।
• স্থায়ী কমিটিগুলোর অর্জনে ব্যর্থতা : স্থায়ী কমিটিতে অনেক শুনানি হয় কিন্তু সুস্পষ্ট সুপারিশ আসে না। অষ্টম সংসদে Committee on Estimates-এর সব সভায় মিলে ১২০টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে ৭৩টি (৬০.৮ শতাংশ) সিদ্ধান্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। ১৯টিতে (১৫.৯ শতাংশ) কমিটি নিজস্ব কার্যকলাপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়। ১০টি সিদ্ধান্তে (৮.৩ শতাংশ) সাব-কমিটি গঠন করা হয়। মাত্র ১৮টি সিদ্ধান্তে (১৫ শতাংশ) মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করা হয়। এই ১৮টি সুপারিশের মধ্যে ১১টি সুপারিশে মন্ত্রণালয়কে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (যথা অর্থ ছাড় করা বা পদ সৃষ্টি করা) নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। ৪টি সিদ্ধান্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। মাত্র ৩টি সিদ্ধান্ত ছিল নীতিনির্ধারণ-সংক্রান্ত, অর্থাৎ ৫ বছর ধরে কমিটি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৩টি সিদ্ধান্ত ছিল নীতিনির্ধারণমূলক। আর এই ৩টি সিদ্ধান্তের একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
• স্থায়ী কমিটির ভূমিকা : স্থায়ী কমিটির ভূমিকা বিষয়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানেও জটিলতা রয়েছে। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলের পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার বর্ণনা ইতিমধ্যে অনেক গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিরগুলোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণও করা হয় না।
সংসদ সদস্যদের চতুর্থ দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের বাজেট অনুমোদন করা এবং সরকারের আয়-ব্যয়ের সঠিক পরিচালনা নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কোনো করারোপ করা চলবে না’ (No taxation without representation) নীতির বাস্তবায়ন। বাজেটের মাধ্যমে সংসদ এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু সংসদের অনুমোদন ছাড়া অথবা নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত খরচ করলে বাজেটের কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। এই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরীক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে এবং এই নিরীক্ষার তদারকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংসদকে। সরকারি হিসাব কমিটি (Public Accouncs Committee) এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাত্ত্বিক দিক থেকে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংসদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সংসদের প্রায় কোনো ক্ষমতা নেই বললেই চলে। সংসদে বাজেট প্রণয়ন করে সরকার এবং সংসদ সদস্যরা এ বাজেটে বিচার-বিবেচনাহীন অনুমোদন (Rubber-stamp) প্রদান করেন। সংসদ সদস্যরা বাজেট প্রস্তাব ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ করতে পারেন, কিন্তু তাঁরা বাজেট সংশোধন করতে পারেন না। তাঁরা নতুন কোনো ব্যয়ের জন্য অনুমোদন (সেগুলো যদি অত্যন্ত ছোটও হয়, তবু) প্রদান করতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা তাঁদের দল কর্তৃক প্রস্তাবিত বাজেটে ‘না’ বলতে পারেন না। যদি প্রস্তাবিত বাজেটের বিরুদ্ধে ‘না’ ভোট দেন, তাহলে তাঁরা দলের সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বাজেট আলোচনার ওপর একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। এই সমীক্ষা থেকে নিম্নলিখিত তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে।
১. বাজেট আলোচনার জন্য সংসদ সদস্যদের যে সময় দেওয়া হয়ে থাকে, তা অত্যন্ত অপ্রতুল। সারণি-৭.৫-এ ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের বাজেট আলোচনার জন্য সর্বোচ্চ সময় দেখা যাবে।
সারণি-৭.৫
বাংলাদেশে বাজেট উপস্থাপনার তারিখ, ১৯৯৭-২০০৭

সারণি-৭.৫ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত বাজেটের ওপর বিশদ আলোচনা এবং ভোটদানের জন্য সংসদকে ১৮ দিন থেকে ২৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। গড়পড়তা সংসদকে ২০.৭ দিন সময় দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে সংসদকে বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা করতে হয়। সম্পূরক বাজেট আলোচনা ও অনুমোদন করতে হয় এবং পরবর্তী অর্থবছরের ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্টকরণ বিল পাস করতে হয়। উপরন্তু কর-সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে নতুন অর্থ আইন পাস করতে হয়। এ ধরনের কাজ এত অল্প সময়ের মধ্যে সুচারুরূপে করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে ধরেই নেওয়া হয় যে বাজেট অনুমোদন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ামাত্র এবং এই আনুষ্ঠানিকতার জন্য বেশি সময় দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
২. সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, যদিও বাজেট আলোচনায় আরও বেশি সময় বরাদ্দের জন্য ওকালতি করার পক্ষে যুক্তি আছে, বাস্তবে সংসদ সদস্যরা তাঁদের জন্য বরাদ্দ অপ্রতুল সময়টুকুও ব্যবহার করেন না। (সারণি-৭.৬)
সারণি-৭.৬
বাজেট আলোচনায় বছরভিত্তিক মোট সময়

যদি সদস্যরা বাজেট আলোচনায় গড়ে প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা (৫ কর্মদিবসের জন্য প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে) সময় কাজে লাগাতেন, তাহলে বাজেট আলোচনায় তাঁরা গড়ে ৬০ ঘণ্টা সময় দিতে পারতেন। কিন্তু প্রতি বাজেট আলোচনার জন্য গড় সময় ছিল ৩৫.১ ঘণ্টা। এ তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সংসদ সদস্যরা বক্তব্য প্রদানের তাঁদের বরাদ্দ সময়ের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ ব্যবহার করেননি। এর একটি কারণ হতে পারে যে সংসদ সদস্যদের বক্তব্য দেওয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনা হয় অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০৬-০৭ সময়কালে সম্পূরক বাজেটের ওপর গড়ে মাত্র ৪.১৬ ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। সর্বনিম্ন আলোচনার সময় ছিল ১ বছর ২.২৫ ঘণ্টা। বাজেট তৈরিতে দুর্বলতার জন্য সম্পূরক বাজেট ছোটখাটো সংশোধনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, প্রায়ই এতে মূল হিসাবের আমূল পরিবর্তন করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূল বাজেট হচ্ছে শুধু একটি মুখোশ আর সম্পূরক বাজেট হচ্ছে প্রকৃত বাজেট। অথচ সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনার জন্য যে সময় বরাদ্দ করা হয়, সে সময়ে কোনো অর্থবহ আলোচনা করা সম্ভব নয়।
৩. পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রে বাজেটের অর্থবহ আলোচনার জন্য দুটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমত, সংসদের সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের ওপর যেসব স্ট্যান্ডিং কমিটি বা স্থায়ী কমিটি রয়েছে, সেখানে বাজেট আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে সংসদের বাইরে কোনো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বাজেট সম্পর্কে আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইংল্যান্ড, কানাডা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে যদি স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বাজেট আলোচনা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে তা না করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। দ্বিতীয়ত, সংসদ সদস্যদের বাজেট আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা চাইলে এ সময় দেওয়া মোটেও কষ্টকর হবে না।
শুধু যে বাজেট প্রণয়নের ওপর সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ নেই, তা নয়। সরকারের খরচের ওপরও সংসদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষীণ। বেশির ভাগ সময়ই নির্বাচিত সংসদ না থাকায় বাংলাদেশে সরকারি হিসাব কমিটি কাজ করেনি, দ্বিতীয়ত, মান্ধাতার আমলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ফলে এসব প্রতিবেদনের নিষ্পত্তি ও সহজসাধ্য নয়। এর ফলে সরকারি হিসাব কমিটিতে অনিষ্পত্তিকৃত আপত্তি ও অনিয়মিত ব্যয় বিরাট আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালের ২৩ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদকে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এই অঙ্ক ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট স্কুল জাতীয় উৎপাদের প্রায় ৪৯ শতাংশের সমান। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা আপত্তির সংখ্যা ৮ লাখ ৭৯ হাজার ২২।
সংসদের কার্যকারিতার একটি বড় শর্ত হলো সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ। বিরোধী দলের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো সরকারের দোষ-ত্রুটি ও ব্যর্থতা সংসদের সামনে উপস্থাপন করা। যদি বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সংসদে বিতর্কের মান অনেক নেমে যায়। বাংলাদেশে সংসদের বাইরে এবং ভেতরে সংঘাতের রাজনীতি চলছে। এর ফলে সংসদ অধিবেশনে যখন বিরোধী দল উপস্থিত থাকে, তখন সরকারি দল ও বিরোধী দল অসাংবিধানিক ভাষায় একে অপরকে আক্রমণ করে। এর ফলে সংসদের বিতর্ক অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। যখন সরকারি দল সংসদে বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করতে চায়, তখন বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে। এ অবস্থায় সংসদে সরকারি দল বিরোধী দলকে একতরফা আক্রমণ করে। তাই বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত থাকুক আর না-ই থাকুক, সংসদে জাতীয় সমস্যা নিয়ে খুব অল্প আলোচনা হয়। বেশির ভাগ আলোচনার বিষয় হলো প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা। সারণি-৭.৭-এ কয়েকটি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের শতকরা হার দেখা যাবে।
সারণি-৭.৭
কয়েকটি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের হার

সারণি-৭.৭ থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রধান বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অষ্টম সংসদে প্রধান বিরোধী দল প্রায় ৮২ শতাংশ অধিবেশনে অংশ নেয়নি। পঞ্চম সংসদে এই হার ছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ। সাংবিধানিকভাবে একটি সংসদ কার্যকর করার জন্য যেসব উপাদানের প্রয়োজন, তার অধিকাংশই বাংলাদেশে উপস্থিত। উপরন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সংসদসমূহ যে ধরনের কাজ করে, বাংলাদেশের সংসদেও সে ধরনের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তবু সংসদ সত্যিকার অর্থে কতটুকু কার্যকর, সে সম্পর্কে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। সংসদ হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিভাজনের জন্য একটি অত্যাবশ্যক শর্ত।
নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদ রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ। এরা কেউ কারও নিচে নয়। বাংলাদেশে সংসদ এই নীতি কতটুকু সমুন্নত রাখতে পেরেছে, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন রয়েছে। বিগত চার দশকের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংসদের ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বলে সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে আনা হয়েছে। দেশের বাজেট প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা নেই। বাংলাদেশের বাজেট নির্বাহী বিভাগ প্রণয়ন করে। নির্বাহী বিভাগ বাস্তবায়ন করে এবং কার্যত এর অনুমোদনও করে। কেননা, সংসদের বাজেটের বিষয়ে কোনো ভূমিকা নেই। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সংসদের ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে প্ৰায় বিনা বিতর্কে সংবিধান সংশোধনের মতো প্রস্তাবসমূহ সংসদে পাস করা হয়েছে। স্থায়ী কমিটিগুলো এখন পর্যন্ত সরকারের কার্যকলাপ তদারকিতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। সামগ্রিক বিবেচনায় মনে হয় যে বাংলাদেশে সংসদ একটি সমরূপ অনুকরণ। দেখতে অন্য দেশের সংসদের মতো হলেও ভেতরের দিক থেকে এরা এক নয়।
৭.৩ সংসদ সদস্যদের সংবিধানের অতিরিক্ত কার্যক্রমের সম্প্রসারণ
বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের আইনগত ক্ষমতার সংকোচন ঘটেছে। বাস্তবে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন, তবে সংসদ সদস্যদের এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। সংসদের ভেতরে তাঁদের ক্ষমতা হ্রাস পেলেও সংসদের বাইরে তাঁদের ক্ষমতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। প্রথমত, সংসদ সদস্যরা স্থানীয় নির্বাচনী এলাকায় নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রতিনিধির দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যকলাপ তদারকের পরোক্ষ ক্ষমতা সব দেশের সংসদেরই আছে। কিন্তু এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় সরকারের মাধ্যমে, প্রত্যক্ষভাবে নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যাঁরা সরকারদলীয় সংসদ সদস্য থাকেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার পরিচালকদের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। এই সম্পর্কের ভিত্তিতে তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর হম্বিতম্বি করেন। তাঁদের নির্দেশ অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ করতে বাধ্য করেন। যেসব সরকারি কর্মচারীর মধ্যে আনুগত্যের ঘাটতি দেখা দেয়, তাঁদের বদলি করার ব্যবস্থা করেন। যাঁরা তাঁদের প্রতি অনুগত, তাঁদের যাতে বদলি না করা হয়, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেন। সরকারি পদে নিয়োগ থেকে ঠিকাদারি সব কাজেই তাঁদের অনেকেই হস্তক্ষেপ করেন। নির্বাহী বিভাগের কার্যকলাপে তাঁদের এই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। কিন্তু বেশির ভাগ সাংসদই এ ধরনের ক্ষমতা সরাসরি প্রয়োগ করতে পছন্দ করেন।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সরকারসমূহের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু সংসদ সদস্যরা স্বাধীন স্থানীয় সরকারকে ভয় করেন। তাই তাঁরা স্থানীয় সরকারের ওপর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করতে চান। উপজেলা পরিষদ আইনে তাঁদের উপজেলা পরিষদের পরামর্শক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁরা জেলা পরিষদেরও উপদেষ্টা। বিধান করা হয়েছে যে স্থানীয় সাংসদের সব পরামর্শ উপজেলা পরিষদকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভার ব্যাপারেও তাঁরা হস্তক্ষেপ করেন। এদের সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রেও তাঁদের ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে তাঁরা স্থানীয় সরকারকে কুক্ষিগত করে ফেলেছেন।
তৃতীয়ত, সংসদ সদস্যরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের পদ থেকে আর্থিক সুবিধা হাসিল করছেন। সংসদ সদস্যকে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের রাজনীতির ফলে সংসদ সদস্যরা প্রায় কোনো ব্যাপারেই একমত নন, কিন্তু গাড়ির শুল্ক মওকুফের পক্ষে সব দলই একমত। এই সুবিধা দিতে হলে সেটি দেওয়া উচিত আইনের মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যবশত শুল্কমুক্তের সুবিধা কোনো আইনের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়নি। এই সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে নির্বাহী আদেশের বলে। সংসদ সদস্যদের এ ধরনের সুবিধা দেওয়া নৈতিক দিক থেকে কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে স্বীকার করে নেওয়াও হয় যে সংসদ সদস্যদের যাতায়াতের জন্য গাড়ি ক্রয়ের বিশেষ সুযোগ দেওয়া উচিত, তবু বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। বর্তমানে সংসদ সদস্যরা যেকোনো মূল্যের গাড়ি শুল্ক ছাড়া আমদানি করতে পারেন। এর ফলে উচ্চ শুল্ক দিয়ে যেসব গাড়ি ছাড় করাতে হয়, সেসব গাড়ি তাঁরা ছাড় করেন এবং তা বিক্রি করে অনুপার্জিত মুনাফা লাভ করেন। এ ধরনের ব্যবস্থা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুল্কমুক্ত গাড়ি না দিয়ে সংসদ সদস্যদের গাড়ি ক্রয়ের জন্য ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা এককালীন মঞ্জুরি দিলে এ ধরনের দুর্নীতি একেবারে বন্ধ করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, সংসদ সদস্যরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের অর্থে বিদেশে স্টাডি ট্যুর বা শিক্ষাসফর করতে যান। সংসদ সদস্যদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ইউএনডিপির অর্থায়নে আলাদা প্রকল্প রয়েছে এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এ ধরনের প্রকল্পে দাতাদের আগ্রহও রয়েছে। সংসদের বাজেটেও বিদেশ সফরের জন্য বরাদ্দ আছে। যদি শিক্ষাসফরের প্রয়োজন হয়, তাহলে এর জন্য অর্থের সংস্থান সংসদের বাজেটে করা যেতে পারে। কিন্তু সংসদ সদস্যরা এই ব্যবস্থায় রাজি নন, তাঁরা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের অর্থে শিক্ষাসফর করেন। এই ধরনের সফরের কোনো ফল লাভ হয় কি না, তা নিশ্চিত নয়, তবে এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ বেআইনি। উদাহরণস্বরূপ ২৫ আগস্ট ২০১৬ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘মন্ত্রণালয়ের টাকায় ১৫ সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফর’ শীর্ষক সংবাদটি উল্লেখ করা যায়। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে দশম জাতীয় সংসদের ৫০টি সংসদীয় কমিটির মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫টি কমিটির শতাধিক সদস্য ২৪ বার বিদেশ সফর করেছেন ও যেসব কমিটির সদস্যরা এখনো শিক্ষাসফরের সুযোগ পাননি, তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। একই পত্রিকার ২ জুন ২০১৬ সালের আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ১৩টি দেশে মন্ত্রী-সাংসদেরা মোট ২২ বার সফর করেছেন। এর মধ্যে ১১টি সফরে খরচ হয়েছে ২ কোটি টাকার বেশি। অন্য দুটি সফরে কত ব্যয় হয়েছে, তা জানা নেই। অথচ এই ২২টি শিক্ষাসফরের কোনো সুফল নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। আসলে এ ধরনের শিক্ষাসফর আদৌ কতটুকু প্রয়োজনীয়, সে সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, অনেক সংসদ সদস্য তাঁদের টেলিফোন বিল পরিশোধ করেন না। ২০০৬ সালে এই মর্মে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়।
সংসদ সদস্যরা সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন, তা নির্ধারিত হয় মেম্বার্স অব পার্লামেন্ট প্রিভিলিজেস অ্যাক্ট দ্বারা। এই আইনের বাইরে তাঁদের কোনো সুযোগ নেওয়ার অধিকার নেই। অথচ হরহামেশাই এ ধরনের কার্যকলাপ ঘটছে বলে গণমাধ্যমে অভিযোগ দেখা যায়। এর ফলে সংসদ সদস্যদের কার্যকলাপে নৈতিকতার নিশ্চয়তার কোনো উপায় নেই। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা তাঁরা গ্রহণ করছেন। তাঁরা রাজউকের জমি ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাচ্ছেন। এসব মিলে সংসদ সদস্যদের পদ একটি লাভজনক পদে উন্নীত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখানে একটি বড় সমস্যা হলো, সংসদ সদস্যদের জন্য এখনো কোনো আচরণবিধি (Code of Conduct) প্রণয়ন করা হয়নি। এর ফলে তাঁদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
সংসদ সদস্যরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও খবরদারি করেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা পর্ষদে সংসদ সদস্যরা নিজে সভাপতি হন অথবা তাঁদের মনোনীত ব্যক্তিরা সভাপতি হন। এভাবে একজন সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করেন। অতি সম্প্ৰতি মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন সংসদ সদস্যদের পদাধিকার বলে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি পদে মনোনয়ন বেআইনি ঘোষণা করেছেন। এই রায় সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সংগতিপূর্ণ। তবে সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করেছে।
সংসদ সদস্যদের এ ধরনের নেতিবাচক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ জনমনেও বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। সারণি-৭.৮-এ টিআইবি পরিচালিত একটি সমীক্ষার কিছু ফলাফল দেখা যাবে।
সারণি-৭.৮
সংসদ সদস্যদের নেতিবাচক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের হার

সারণি-৭.৮ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ৮১.৮ শতাংশ জনগণ বিশ্বাস করে যে সংসদ সদস্যরা প্রশাসনিক কাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। দ্বিতীয়ত, ৭৬.৯ শতাংশ জনগণ বিশ্বাস করে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ সংসদ সদস্যরা নিয়ন্ত্রণ করেন। ৭৫.৫ শতাংশ জনগণ বিশ্বাস করে যে সংসদ সদস্যরা উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার করেন। এই সমীক্ষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো যে ৭৫.৬ শতাংশ জনগণ বিশ্বাস করে, সংসদ সদস্যরা অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত বা তা সমর্থন করেন।
বাংলাদেশে সংসদকে কার্যকর করার জন্য সংসদ সদস্যদের আইনগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। সে কাজটি সহজসাধ্য নয়, এর জন্য নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং রাজনীতির সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে। পক্ষান্তরে সংসদ সদস্যদের সংবিধানের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ হ্রাস করতে হবে। এই ব্যবস্থা সংসদ সদস্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এর জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
৭.৪ উপসংহার
সাংবিধানিক দিক থেকে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তি। সংসদই আইন প্রণয়ন করে। সংসদই বাজেট অনুমোদন করে এবং সংসদের আস্থা নিয়েই নির্বাহী বিভাগ পরিচালিত হয়। আইনের দিক থেকে এর ক্ষমতা প্রশ্নাতীত কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠানটি আদৌ তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের অনুকরণে বাংলাদেশের সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই ক্ষমতা সংসদের পক্ষে প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ধরনের অনুকরণকেই সমরূপ অনুকরণ বলা হয়ে থাকে। সমরূপ অনুকরণ অনেক ক্ষেত্রে রূপকথার ঘুমন্ত পুরীর মতো। সেখানে রাজা আছেন, রানি আছেন, রাজপুত্র-রাজকন্যারা আছেন, আমির-ওমরারা আছেন, অভিজাত ও নিম্নবর্ণের লোকেরা আছেন, হাতিশালে হাতি আছে, ঘোড়াশালে ঘোড়া। একটি সভ্য সমাজে যা যা দরকার, সবই ঘুমন্ত পুরীতে আছে কিন্তু সমস্যা শুধু একটাই, তারা ঘুমিয়ে আছে। তারা কোনো কাজ করতে পারছে না। বাংলাদেশের সংসদকেও অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় ঘুমন্ত পুরীর মতো। কীভাবে ঘুমন্ত সংসদকে জাগানো যেতে পারে? অবশ্যই একটি ব্যবস্থা হতে পারে আইনকানুনের সংশোধন। বাংলাদেশের আইন পাশ্চাত্যের অনুকরণে রচিত হলেও এখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা হয়েছে। এই ব্যতিক্রমসমূহ সংসদের কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করেছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে :
– সংসদ সদস্যদের নির্বাহী বিভাগের কাছে জবাবদিহি থেকে মুক্তি। বাংলাদেশে নির্বাহী বিভাগ ততক্ষণই ক্ষমতায় থাকতে পারে, যতক্ষণ সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। পক্ষান্তরে সংসদ সদস্য, যাঁরা কোনো দলের থেকে নির্বাচিত হন, তাঁরা যতক্ষণ দলের প্রতি অনুগত থাকবেন, ততক্ষণ তাঁদের সদস্যপদ অক্ষুণ্ণ থাকবে। যখনই তিনি দলের বিরুদ্ধে যাবেন, তখন তাঁর সংসদ সদস্যপদ চলে যাবে। এভাবে সংসদ সদস্যদের দলের প্রতি অনুগত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থার ফলে নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদের ক্ষমতা কার্যত বাতিল করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ৭০ অনুচ্ছেদের অবলুপ্তি প্ৰয়োজন।
– সংসদের একটি বড় কাজ হলো বাজেট অনুমোদন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বাজেট তৈরি করে নির্বাহী বিভাগ এবং বাজেটের অনুমোদনও করে নির্বাহী বিভাগ। এতে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা বাস্তবে অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই ব্যবস্থা অবসানের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. বাজেটের ওপর আলোচনার সময়কাল কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ করা উচিত। প্রয়োজন হলে এ সময়সীমা আরও বাড়ানো যেতে পারে এবং বর্তমান সংবিধান অনুসারে ৩ মাসের খসড়া বাজেট অন্তর্বর্তী ভোটে অনুমোদন করে অর্থবছর শেষ হওয়ার পরও বাজেট আলোচনা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
২. অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটিতে বাজেটের অবয়ব এবং বিষয়বস্তু নির্দেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১১১(২) বিধিটি সংশোধিত হওয়া উচিত।
৩. বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই কর প্রস্তাবসমূহকে গোপনীয় বিবেচনা করা হয় না। কর প্রস্তাবসমূহ নিয়ে বাজেট পেশ হওয়ার অনেক আগেই সংসদে আলাপ- আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশেও অনুরূপ বিধি প্রচলন করা যেতে পারে।
৪. বর্তমানে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বিধান রাখা হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো মঞ্জুরি দাবির ওপর কোনো গণশুনানি করতে পারবে না। এ ব্যাপারে দোহাই দেওয়া হয় যে, এর ফলে বাজেট- প্রক্রিয়া অনুমোদন বিলম্বিত হবে। কিন্তু পৃথিবীর সব বড় সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে (যথা যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ইত্যাদি) মন্ত্রণালয়- সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিসমূহকে তাদের মঞ্জুরি বিবেচনা করার জন্য গণশুনানি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের সুযোগ প্রচলন করা যেতে পারে।
৫. বাংলাদেশে বর্তমানে সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে প্রায় কোনো আলোচনাই হয় না। সম্পূরক বাজেট বিবেচনার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া যেতে পারে।
৬. সংসদীয় কমিটিগুলোর গণশুনানিতে দরিদ্র মানুষ ও তাদের সংগঠনগুলোকে সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংসদকে। কিন্তু সংসদ এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। এই লক্ষ্যে সংসদীয় কমিটিকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আইনগত ক্ষমতা বাড়ালেই সংসদ অধিকতর কার্যকর হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সংসদের কার্যকারিতার জন্য সুষ্ঠু আইনই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে আরও দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্ৰথমত, এমন সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে হবে, যাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহী। দুর্ভাগ্যবশত ইদানীং বাংলাদেশে অধিকাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যের প্রধান পেশা হলো ব্যবসা। এর ফলে তাঁরা জনগণের স্বার্থরক্ষার বদলে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অনেক উৎসাহী হয়ে ওঠেন। দুর্ভাগ্যবশত সংসদ সদস্যরা যাতে তাঁদের মূল দায়িত্ব হারিয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেন, সে ব্যাপারে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অশুভ প্রবণতা রোধ করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা উচিত।
আচরণবিধি : বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের জন্য কোনো আচরণবিধি নেই। এর ফলে অনৈতিক কার্যকলাপ সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে একটি আইন অথবা বিধি অবিলম্বে জারি করা যেতে পারে।
অনুপার্জিত মুনাফা বন্ধ করা : বর্তমানে সংসদ সদস্যদের অনুপার্জিত মুনাফা অর্জনে বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আচরণ বৈষম্যমূলক এবং শুল্ক মওকুফের সুবিধা অনুপার্জিত মুনাফা অর্জনের সহায়ক। যদি গাড়ির জন্য সংসদ সদস্যদের সুবিধা দিতে হয়, তাহলে তাঁদের আমদানিকৃত গাড়ির শুল্ক মাফ না করে গাড়ি ক্রয় করার জন্য ন্যায়সংগত (১৫ থেকে ২৫ লাখ) অর্থ বরাদ্দ করা যেতে পারে। এ ধরনের বরাদ্দ এ সুবিধার অপব্যবহার হ্রাস করতে পারে। এ ছাড়া বর্তমানে সংসদ সদস্যরা নির্বাহী বিভাগের অর্থে বিদেশ সফরের জন্য যে ধরনের স্টাডি ট্যুরের ব্যবস্থা করছেন, তা অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আচরণবিধি এবং সদস্যদের Privileges Act. এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত, যাতে সংসদ সদস্যরা অনুপার্জিত মুনাফা অর্জন না করতে পারেন।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সদস্যদের স্বার্থের সংঘাত হ্রাস করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তবে শুধু আইন করে এ কাজ করা যাবে না, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এ ক্ষেত্রে কার্যকর থাকতে হবে। বর্তমানে সংসদ সদস্যরা তাঁদের দায়িত্বের বাইরে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রথমত, সংসদ সদস্যরা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে তাঁরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের ভোটারদের সন্তুষ্ট করেন, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই প্রভাব বিক্রি করে অনুপার্জিত মুনাফা অর্জন করেন। দ্বিতীয়ত, উপজেলা পরিষদের ওপর সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাঁদের পরামর্শ উপজেলা পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে তাঁরা ইউনিয়ন পরিষদকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। উপরন্ত সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার ফলেই বাংলাদেশে এতদিন নির্বাচিত জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকারের ওপর কর্তৃত্ব তুলে না দিলে সাংসদেরা স্থানীয় সরকারকে কুক্ষিগত করে তাঁদের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবেন। স্থানীয় সরকার ছাড়াও সংসদ সদস্যরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এই সব প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন সাধারণত সংসদ সদস্যরা এবং যদি কোনো সংসদ সদস্য সভাপতি না হন, তাহলে তিনি সভাপতি পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। এ ধরনের ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক। ইতিমধ্যে হাইকোর্ট এ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে সংসদকে কার্যকর করার জন্য শুধু সংসদের আইনগত ক্ষমতা বাড়ালেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে যেখানে সংসদ সদস্যরা তাঁদের মূল দায়িত্বের বাইরে যেসব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন অথবা অনুপার্জিত মুনাফা সৃষ্টি করেছেন, তা-ও দূর করতে হবে। এ কাজ সহজ হবে না। সংসদ সদস্যরা এ ধরনের সংস্কারে রাজি হবেন না। সরকারও সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা বাড়াতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
পাদটীকা
১. DeMaggio Paul and Walter P. Powell. 1983 “The Iron Cage Revisited: Institutional Isomorphism and Collective Rationality in Organizational Fields’. American Sociological Review Vol. 48 (April), 147-160
২. Pritchett Lant, Michal Woolcock and Matt Andrews 2012. Looking Like a State ‘Techniques of Persistent Failures in State Capability for Implementation’. (Mimeo). Helsinki, UNU-WIDER
৩. Pritchett Lant and Franke de Weijer. 2010 ‘Fragile States Stuck in a Capability Trap’ (Mimeo). World Development Report 2011 Background Paper. Washinston D.C. World Bank
৪. আইন মন্ত্রণালয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। ঢাকা।
৫. National Assembly Of Pakistan 2012. Constitution of the Islamic Republic of Pakistan. Islamabad.
৬. Wilson, Woodrow. 1885. Congressional Government. JCOC. Final Report (http//www.rules.house.gov/archives/ Jcoc26 htm)
৭. Akbar Ali Khan. 2010. Friendly Fires, Humpty Dumpty Disorder and Other Essays. Dhaka: University Press Ltd.
৮. BRAC Institute of Governance and Development. 2015. The State of Governance in Bangladesh: Institutions, Outcomes and Accountability. Dhaka: BRAC University.
৯. Akbar Ali Khan. 2008. People’s Participation in Budgetary Process in Bangladesh. Dhaka: Samunnay.
১০. দৈনিক প্রথম আলো। ২ জুন ২০১৬।