সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৬. মঙ্গলের প্লেগ

মঙ্গলের প্লেগ

রেডিয়োর ও-মাথায় কথা কইছে নিকোলে বেলভ। জাত্যংশে রুশ, ব্যবহার করছে ইংরেজি ভাষা। এ-মাথা অর্থাৎ বিমানের কন্ট্রোল থেকে জবাব দিচ্ছে মার্কিন পাইলট প্রেস্টন ও-ব্রায়েন, সে কিন্তু কথা কইছে রুশি জবানে।

‘ওহে, ওহে, ওহে ও-ব্রায়েন’— বেলভ যেন চনমন করছে উত্তেজনায়, ‘কী কাণ্ড করে ফেলেছি, মরে গেলেও আন্দাজ করতে পারবে না! মঙ্গলের মহানগর আবিষ্কার করে ফেলেছি একটা!’

বেলভের কাজ হল ভূতাত্ত্বিক গবেষণা। মহাবিমান মঙ্গলের মাটিতে নামল যেদিন, সেদিন আর বেরুনো হয়নি। ক্যাপ্টেন ঘোষ সব বৈমানিককে আটকে রেখেছিলেন, অবতরণের মাঠে একটা স্মারকস্তম্ভ গড়বার জন্য! কিন্তু পরেরদিন, ভোর হতে-না-হতেই, ক্যাটারপিলার গাড়িখানা নামিয়ে নিয়ে বেলভ বোঁ করে ছুট মেরেছে লাল গ্রহের মরুকান্তার ভেদ করে। বেশি দূর যায়নি, ছ-মাইল তফাতেই—

ও-ব্রায়েন কম্পিউটার যন্ত্রটাকে খট করে বন্ধ করে ফেলল। বালতির আকারের আসনটাতে হেলান দিয়ে বসে ধীরে ধীরে আঙুল চালাতে লাগল কদমছাঁট লাল চুলের ভিতর। মঙ্গলের মহানগর? ওদের তো সকলেরই ধারণা ছিল যে এই ধুলোয়-ডোবানো, ঠান্ডায়-জমানো, জলশূন্য গ্রহটাতে নবাগত এই তারা কয়েকটি প্রাণীই একেশ্বর। হঠাৎ যদি এখন সেই ধারণাটা ভুয়ো প্রতিপন্ন হয়, সমূহ মুশকিলের কথা তো!

ও-ব্রায়েন ভিড় পছন্দ করে না। হঠাৎ চমকে যেতে হলেও সে খুশি হয় না। মনের রাগ মুখেই খানিকটা প্রকাশ করে সে বেলভকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহানগর কী বলছ হে? মানুষ আছে তাতে? জ্যান্ত?’

‘আরে, না, না।’ বেলভ আশ্বস্ত করল তাকে, ‘জ্যান্ত মানুষ তুমি কোথা থেকে পাবে মঙ্গলে? যেখানকার গোটা আবহাওয়াটাকে একটা গামলায় পুরে ফেলা যায়? জ্যান্ত বলতে যা এখানে দেখছি— তা কয়েকরকম শ্যাওলা আর দুই-এক জাতের কেঁচো। সে তো বিমানের কাছাকাছিও পাবে। তবে হ্যাঁ, এককালে এখানে আবহাওয়া ছিল, মানুষও ছিল। ধরো, এই লাখ দশেক বছর আগে। কিন্তু শহরটা আছে হে। শহরটা আস্তই আছে— ও-ব্রায়েন।’

ভূতত্ত্বে পাইলট মশাই আকাট মুখ্যু। তবু সে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘আস্ত? তুমি বলতে চাও যে দশ লক্ষ বছরেও শহরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়নি?’

‘একদম না।’ বলল বেলভ, ‘কেন যাবে বলো? শহরটা মাটির তলায়। আমার চোখে পড়ল একটা বিরাট গহ্বর, তার ভিতর ঢালু সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ মুখ থেকে অবিরাম একটা হাওয়া বেরুচ্ছে, বেশ জোর হাওয়া। তারই দরুন গহ্বরটা বুজে যেতে পারেনি বালি জমে। আমি সোজা গাড়ি চালিয়ে দিলাম সুড়ঙ্গের ভিতর, পঞ্চাশ-ষাট গজের মতো নেমে গেলাম নীচে, ব্যস! তারপরই সেই বিশাল শহর, বিলকুল ফাঁকা, নিষ্প্রাণ, আশ্চর্য রকমের সুন্দর। আমার মনে হল, আমাদের মস্কো শহরের সৌষ্ঠব যদি এখন দশ হাজার বছর ধরে ক্রমাগত বাড়িয়ে যাওয়া যায়, একদিন তাহলে এই শহরের কাছাকাছি তা পৌঁছাতেও পারে।’

বেলভের উচ্ছ্বাসে বিচলিত না-হয়ে ও-ব্রায়েন উচ্চারণ করল এক টুকরো গদ্য, ‘কোনো কিছু ছুঁয়ো না খবরদার! কোনো মতেই ছুঁয়ো না।’

বেলভ যেন কানই দিল না সে-কথায়, ‘তুমি বিশ্বাস করছ না আমার রিপোর্ট? আমি ফোটো নিচ্ছি এইবার, দাঁড়াও না। আলোর এখানে অভাব নেই। দশ লক্ষ বছর আগে কী যন্ত্রের সাহায্যে মঙ্গলের লোক এই ভূগর্ভে এত আলো এনেছিল, তা জানি না, কিন্তু এটা দেখতে পাচ্ছি যে সে-যন্ত্র এখনও দিব্যি চালু রয়েছে। চারদিকে ফুটফুটে আলো এখানে।’

‘আশ্চর্য তো!’ ও-ব্রায়েন বিশ্বাস না-করেও প্রশংসা করতে বাধ্য হল।

বেলভ উৎসাহিত হয়ে উঠল, ওইটুকু প্রশস্তি শুনে, ‘কী চমৎকার শহর, কী বলব বন্ধু! রাতপথের দু-ধারে রঙিন স্তম্ভ! বাড়িগুলি— ব্যাবিলন দেখেছ? মহেঞ্জোদোড়ো-হরপ্পা দেখেছ? এর কাছে সেসব কিচ্ছু না একেবারে!’

ওর অত্যুৎসাহ দেখে এ-মাথায় হেসে ফেলল ও-ব্রায়েন। রুশেরা যে লোক মন্দ নয়, ওদের এই দিলখোলা উচ্ছ্বাসের বিরল মুহূর্তগুলিতেই সেটা ধরা পড়ে শুধু। মুখে কিন্তু এসব চিন্তার আভাস না-দিয়ে সে শুধু বলল, ‘অভিনব আবিষ্কারের জন্য তোমায় অভিনন্দন জানাই। ফোটো তুলে নিয়ে চটপট চলে এসো। আমি ক্যাপ্টেন ঘোষকে বলছি তোমার কথা।’

‘আরে, দাঁড়াও, ছেড়ো না এক্ষুনি।’ চেঁচিয়ে উঠল বেলভ, ‘শোনো আর একটা কথা। মঙ্গলের এই যে লোকেরা, মানে সেই দশ লাখ বছর আগেকার লোকেরা ঠিক আমাদের মতোই মানুষ ছিল তারা। রীতিমতো মানুষ, বুঝলে?’

ও-ব্রায়েন সত্যিই চমৎকৃত, ‘বলো কী? রীতিমতো মানুষ?’

ও-মাথায় উল্লসিত হাস্যধ্বনি, ও-ব্রায়েনের ইয়ার-ফোনে আলোর ঝলক খেলে গেল সে-হাসিতে।

‘মানুষ না-হলে এমন সুন্দর সুন্দর মানুষের মূর্তি তারা গড়ল কেমন করে?’ অকাট্য যুক্তি বেলভের, ‘সুড়ঙ্গ থেকে উঠে সমুখেই একটা স্কোয়ার। তার মাঝখানে দুটো নিরাবরণ মূর্তি যা আছে; ফিডিয়াস বা মাইকেল-অ্যাঞ্জোলো তার চেয়ে ভালো জিনিস কখনো গড়েননি। তার উপর বিবেচনা করো, যে-যুগে এখানে ওই সব মূর্তি গড়ছে মঙ্গলবাসীর মানুষ, পৃথিবীতে সে-যুগে সবচেয়ে উন্নত জীব ছিল— মনে করো খাঁড়া দাঁতি বাঘেরা।’

ও-ব্রায়েন একটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করল শুধু, তারপরে রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়ে গবাক্ষের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বিমানের গবাক্ষ সংখ্যা সাকুল্যে দুই, একটা এই কন্ট্রোলে, আর একটা ক্যাপ্টেনের কেবিনে।

গবাক্ষপথে ওই দেখা যায় মঙ্গলের দিগন্তবিস্তারী লাল বালুর মরুভূমি। ছোটো-বড়ো কুঁজের মতো তার পিঠে পরের পর উঁচিয়ে আছে টিলা আর ছোটো পাহাড়ের সারি। তার আর অন্ত পাওয়া যায় না চর্মচক্ষুর দৃষ্টি দিয়ে।

এই-ই মঙ্গল। মৃতগ্রহ। অত্যন্ত আদিম স্তরের কিছু কিছু উদ্ভিদ আর প্রাণীর কথা বাদ দিলে গ্রহটা মৃতই। আগের দিনে, অর্থাৎ দশ লক্ষ বছর আগে এখানে যে-জল আর যে-বায়ুর অস্তিত্ব ছিল, তার অতিসামান্য, ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ এখনও পড়ে আছে এই ভূপৃষ্ঠে আর ওই আকাশের বুকে। তাই সম্বল করেই জীবনধারণ ওই শ্যাওলা আর পোকামাকড়গুলির।

কিন্তু মানুষ ছিল এখানে, ও-ব্রায়েন আর বেলভের মতোই মানুষ। তাদের ব্যুৎপত্তি ছিল চারুকলায়, জ্ঞান ছিল বিজ্ঞানে। বিভিন্নমুখী দার্শনিক মতবাদও ছিল অবশ্যই। তারা এইখানেই ছিল একদিন, আজ আর নেই। কেন নেই? পৃথিবীর মানুষের সমুখে যে সমস্যা আজ মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে, সেই সহাবস্থানের জটিল প্রশ্নই কি তাদেরও জীবনকে দুর্বহ করেছিল সেদিন? সেই প্রশ্নের সমাধান করতে না-পেরেই কি ধ্বংস হয়ে গেল মঙ্গল গ্রহের সমুন্নত সভ্যতা?

নীচের তলা থেকে আকাশি পোশাক-পরা দুটো মূর্তি উঠে আসছে।

শিরস্ত্রাণ সকলেরই এক ধাঁচে তৈরি। তবে চিত্রণের দিক দিয়ে প্রত্যেকটা একটু একটু আলাদা, চিনবার সুবিধার জন্য। কোন ছবি কার টুপিতে, সেটা মুখস্থ রাখতে হয় বৈমানিকদের। ও-ব্রায়েন চিনল, ওই দু-টি লোকের একটি ছিল চিফ ইঞ্জিনিয়ার গুরানিন আর একটি হল তারই সহকারী টম স্ম্যাদার্স। অবশ্যই এতক্ষণ ইঞ্জিনগুলোর তদ্বির তদারক নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা। পৃথিবী থেকে আসবার পথে কোনো যন্ত্রের যদি কিছুমাত্র ক্ষতি হয়ে থাকে, ফিরতি-পথে পা বাড়াবার আগে তা মেরামত করে তোলা চাই তো!

গুরানিন রুশ, স্ম্যাদার্স মার্কিন। স্ম্যাদার্স আর ও-ব্রায়েনের মধ্যে হাতের সংকেতে নমস্কার বিনিময় হল, গুরানিনকে কিন্তু দেখা গেল, ও-ব্রায়েনের দিকে হাত নাড়বার আগে এক মুহূর্ত ইতস্তত করতে। আর গুরানিন যখন ইতস্তত করেছে, ও-ব্রায়েনেরই বা দ্বিধা না-হবে কেন? বেশ একটুখানি সময় নিয়ে তারপরে গুরানিনকে প্রতি-নমস্কার জানাল ও-ব্রায়েন।

জানাবার পরেই ও নিজের মনে হাসল। এইটুকু সৌজন্যের আদান-প্রদান রুশ আর মার্কিন বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে স্বচক্ষে দেখতে পেলেই সুবোধ ঘোষ আহ্লাদে আটখানা হত। ক্যাপ্টেন সুবোধ ঘোষ, ভারত গভর্নমেন্টের নির্বাচিত অধিনায়ক এই অভিযানে।

ব্যাপারটা খুলে বলা দরকার। বিমানখানা ভারতের। বারাণসীতে তৈরি। বারাণসীর পলিটেকনিকেই মহাকাশচারণের বিভিন্ন বিদ্যায় শিক্ষা নিয়েছে এই ‘মৈত্রী’ বিমানের সতেরোজন বৈমানিক। সতেরোজন অবশ্য ক্যাপ্টেনকে নিয়ে। উনি একাই ভারতীয় এ দলে। বাকি ষোলোজনের অর্ধেক রুশ, অর্ধেক মার্কিন।

রুশ মার্কিনের রেষারেষি যে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রহান্তরে পরিব্যাপ্ত হতে চলেছে— এটা ভারত সরকারের শ্যেনদৃষ্টিতে ধরা পড়তে দেরি হয়নি। এই রেষারেষিকে এইবেলা সংযত করতে না-পারলে পারমাণবিক সংঘষর্, এবং তার পরিণামে আমূল ধ্বংস যে অনিবার্য, তাও তাঁরা ভেবে দেখেছেন।

প্রতিকারের কথাও কি তাঁরা চিন্তা করেননি? করেছেন। উপায়ও উদ্ভাবন করেছেন নানারকম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রুশ আর মার্কিন যুবকদের একসাথে মেলামেশার সুযোগ দাও। অবাধ মেলামেশার। বাইরের প্রভাব যেখানে দন্তস্ফুট না-করতে পারে, এমন পরিবেশে। তাতে করে জাতীয়তার উগ্রতা ঢিমিয়ে আসবে হয়তো, প্রবল হয়ে উঠবে মানবতার উদারবুদ্ধি। রুশেরা নিজেদের নিছক রুশ বলেই ভাববে না, মার্কিনেরা জোর দেবে না নিজেদের মার্কিনত্বের উপরে। প্রত্যেকে প্রত্যেককে ভাববে মানুষ বলে, একই গোষ্ঠীর সন্তান বলে— একই সভ্যতার গর্ভজাত সহোদর বলে।

নানাস্থানে, নানাক্ষেত্রে এইরকম ছোটো ছোটো মিলনকেন্দ্র গড়ে ওঠে যদি, তাদের চরিত্র প্রভাব ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে গোটা মার্কিন আর গোটা রুশজাতির উপরে। হিংসা দ্বেষে ভাটা পড়ে আসবে আপনা থেকেই, রণডংকায় ঘা দেবার কথা কোনো জাতিই আর চিন্তা করবে না তা হলে।

এই পরিকল্পনা থেকেই বিমানের নামকরণ হল ‘মৈত্রী’, আটজন রুশ আর আটজন মার্কিন, সুদক্ষ ষোলোজন বৈমানিকের নেতৃত্ব গ্রহণ করে মঙ্গলের দিকে অভিযান করলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন সুবোধ ঘোষ; পাশ্চাত্য জগতের বিজ্ঞান আর অতীত ভারতের প্রজ্ঞান একত্র মিশে যাঁর চরিত্রকে করে তুলেছে রুশ-মার্কিন দুইয়েরই কাছে এক অপরিমেয় বিস্ময়।

সুবোধ ঘোষের কথা মনে হতেই ও-ব্রায়েনের খেয়াল হল, লোকটির সঙ্গে দেখা করার জরুরি দরকারই রয়েছে তার নিজের।

কোলেভিচ, বিমান চালনার ব্যাপারে ও-ব্রায়েনের সহকারী। বাবুর্চি-মহলের হেড বাবুর্চিও সে, কারণ রান্নাটা সে ভালো জানে এবং ভালোবাসে। নিজে শখ করেই এই বাড়তি কাজ সে চেয়ে নিয়েছে। তাকে ও-ব্রায়েন দেখতে পেল, লাঞ্চের তোড়জোড়ে ব্যস্ত। টিনের পরে টিন খুলে যাচ্ছে নানাবিধ খাবারের। অন্যদিকে নজর দেবার সময় নেই।

তাকে জিজ্ঞাসা করল ও-ব্রায়েন, ‘ক্যাপ্টেন কোথায়, জানা আছে নাকি?’ রুশ ভাষাতেই কথা কইল, কারণ কোলেভিচ মানুষটা হল রুশ!

ইঞ্জিনঘরের প্রধান গুরানিন হল রুশ, সহকারী স্ম্যাদার্স মার্কিন। তারই পালটা হিসেবে কন্ট্রোল ঘরে পাইলট পদ পেয়েছে মার্কিন ও-ব্রায়েন, আর তার সহকারী হয়ে আছে রুশ কোলেভিচ। সহাবস্থান আর কী!

কিন্তু সহাবস্থান থেকে সম্প্রীতি যে স্বভাবতই গজিয়ে উঠবে বন-কচুর মতো— তা তো নয়। নয় যে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই ও-ব্রায়েন আর কোলেভিচ। ঝগড়া হওয়ার উপায় নেই ক্যাপ্টেন ঘোষের বিমানে, তাই হয় না ঝগড়া। কিন্তু দু-জনেই এবিষয়ে সচেতন যে, রুশে-মার্কিনে সম্পর্ক হল তেল আর জলের মতোন। যতই মেশাবার চেষ্টা হোক, মিশবেই না।

কোলেভিচ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাল উপরওয়ালা ও-ব্রায়েনের দিকে। যে-টিনটা খুলছিল, সেটা খুলে শেষ করল, কেটে-তোলা ঢাকনাটা ছুড়ে ফেলল আবর্জনার ঝুড়িতে, তারপর সোজা ইংরেজিতে ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘না।’

যাহোক, ক্যাপ্টেনের খবর ডাক্তার স্নিডারের কাছে পেল ও-ব্রায়েন। স্নিডার রান্নামহলেই আসছিলেন, ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে রান্নাবাড়ির কাজ তিনিও কিছু কিছু করেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই ও-ব্রায়েন জানতে পারল, ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনঘরে আছেন।

ইঞ্জিনঘরের দেয়ালে একখানা মস্ত ম্যাপ, বিমানের সবগুলো জেটের অবস্থান তাতে দেখানো রয়েছে। ক্যাপ্টেন ঘোষ তাকিয়ে আছেন সে ম্যাপের দিকে।

বয়স পঁচিশেরও নীচে সুবোধ ঘোষের। এই বয়সেই কিন্তু দুই চোখের নীচে কালো গর্ত হয়ে গিয়েছে বেচারির। এই ডবল দায়িত্বের চাপ আর কী! ক্যাপ্টেনের একটা নিজস্ব দায়িত্ব সব বিমানেই থাকে, কিন্তু ‘মৈত্রীর’ ক্যাপ্টেনের বারো-আনা দুশ্চিন্তার উৎস হল অধীনস্থ বৈমানিকদের সহজাত রেষরেষির সম্পর্ক। সে-রেষারেষি থেকে হঠাৎ যাতে বিস্ফোরণ ঘটে না-যায়, তাও দেখবার দায়িত্ব ক্যাপ্টেনেরই।

ও-ব্রায়েনের প্রথম কাজ হল বেলভের বার্তা ক্যাপ্টেনকে জানানো।

ঘোষের মুখখানা কালো হয়ে এল। বলতে যাচ্ছিলেন, ‘দেখ দেখি বোকামি!’ কিন্তু এক সহকারীর সমুখে অন্য সহকারী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য তিনি কখনো করেন না, তাই ও-কথাটা চেপে গেলেন তাড়াতাড়ি; তার বদলে শুধু বললন, ‘আশা করি, কোনোকিছু স্পর্শ করবে না বন্ধু বেলভ।’

‘না, তা করবে না নিশ্চয়ই।’ বলল ও-ব্রায়েন, ‘আমি সতর্ক করে দিয়েছি তাকে। তা ছাড়া নিজেও সে খুব বুদ্ধিমান ছেলে। আমরা সবাই বুদ্ধিমান ছেলে, কী বলেন ক্যাপ্টেন?’

ও-রসিকতার জবাবে কিছুই বললেন না ক্যাপ্টেন, যা বললেন, তা একেবারেই অন্য কথা, ‘ওরকম একটা প্রাচীন শহর, ওতে এখনও জীবনের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয়। বেলভ যদি সেই জীবনের গণ্ডিতে কোনো আলোড়নের সৃষ্টি করে বসে, তার পরিণাম কী হবে, বলতে পারি না। কী আছে ওখানে, ঠিক কী? স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা বাহিনী-ই যে নেই একটা, তা কে বলতে পারে? সে-বাহিনী যে বোমা বা তার চেয়েও মারাত্মক অন্য কিছু ছুড়ে মারবে না আমাদের মাথায়, তারই বা নিশ্চয়তা কে দেবে?’

‘বোমা-টোমা কী বলছেন ক্যাপ্টেন?’ সমবয়সির পক্ষে একটুখানি ঘনিষ্ঠতার দাবি করা অস্বাভাবিক নয়, তারই সাহসে ও-ব্রায়েন বলে বসল, ‘বোমা যদি কোথাও থাকে, আপনার মাথাতেই তা আছে ক্যাপ্টেন।’

ঘোষ স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন ওর দিকে, ‘ঠিক কথাই বলেছেন মাননীয় ও-ব্রায়েন মশাই, আমার মাথাটাতে বোমা ছাড়া আর কিছুই নেই।’

ভয়ানক লজ্জা পেলেন ও-ব্রায়েন। তাড়াতাড়ি কথা পালটে ফেলল এই বলে, ‘স্ম্যাদার্সকে আমি দু-ঘণ্টার জন্য পেতে পারি কি? কম্পিউটারগুলো কাজ ঠিকই করছে, তবু কোথাও কিছু গলদের আভাস আছে কিনা, একবার দেখে নিতে চাই।’

‘তাহলে তো গুরানিনকে জিজ্ঞাসা করতে হয়। কিন্তু তোমার নিজের সহকারীকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারছ না, এ কেমন কথা?’

পাইলট মুখটা বিকৃত করল, ‘ইলেকট্রনিক্স সম্বন্ধে স্ম্যাদার্সের জ্ঞান অনেক বেশি, কোলেভিচ ওর অর্ধেকও জানে না। আঁকে কোলেভিচ পাকা, তা ঠিক। খুব ভালোই জানে ওটা। কিন্তু ওই পর্যন্তই।’

ঘোষ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে লক্ষ করছেন ওকে। ওর মনের কথাটা বুঝতে চাইছেন। কোলেভিচ সম্বন্ধে ওর আসল আপত্তিটা কোনখানে? জাতে ও রুশ বলে?

প্রায় আধ মিনিট বাদে ওকে বললেন, ‘তা হবে হয়তো। কিন্তু একটা কথা মনে পড়ে গেল। তুমি কিন্তু বিমান থেকে মোটেই নামবে না, মঙ্গলের মাটিতে।’

‘সে কী কথা ক্যাপ্টেন?’ ও-ব্রায়েন ব্যাকুল হয়ে উঠল, ‘একটুখানি হাত-পা খেলাতে পারব না? অন্য সবাই নামবে, আমার কী অপরাধ হল?’

আসল অপরাধ হল এই যে ও রুশদের দেখতে পারে না, একমাত্র বেলভকে ছাড়া। বেলভকে খানিকটা পছন্দ করে তার আমুদে স্বভাবের জন্য, ছেলেটা রুশ হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু অন্য রুশ বৈমানিকেরা ওর চক্ষুঃশূল। ক্যাপ্টেনের চোখের আড়ালে, মরুপ্রান্তরের নিভৃতে কোনো রুশকে পেলে ও যে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসবে না তৎক্ষণাৎ— এর নিশ্চয়তা কিছুমাত্র নেই।

আসল ভয় সেইখানে। কিন্তু সে কথা তো ওকে বলা যায় না মুখের উপর! তাই ঘোষ অন্য কারণ দেখালেন ওকে, ‘অজানা গ্রহ, কোথায় কী বিপদ লুকিয়ে আছে, কে জানে। বাইরে বেরুলে কার যে কখন কী ঘটবে ভাগ্যে, কেউ বলতে পারে না। তুমি হলে পাইলট, মৈত্রীকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার ভার তোমার উপরে। তোমার যদি কোনো বিপদ ঘটে, তখন উপায় কী হবে, বলো দেখি? উঁহু, তুমি হলে এ বিমানের একমাত্র অপরিহার্য লোক, তোমার নিরাপত্তার কথা আমায় আগে ভাবতে হবে।’

ও-ব্রায়েন কি আসল কথাটা বুঝল? বোঝারই কথা, কারণ সে সত্যি বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু বুঝলেও মনের ভাব মুখে প্রকাশ পেতে দিল না। একান্ত বাধ্য সহকারীর মতো নিরীহভাবে বলল, ‘আদেশ অবশ্যই পালন করব। আপনি তাহলে দয়া করে গুরানিনকে বলবেন কথাটা।’

এই বলে সে ফিরে গেল কন্ট্রোলে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে স্ম্যাদার্স এসে যোগ দিল তার সঙ্গে। কাজ শুরু করার আগে কিন্তু দু-জনের মধ্যে আলোচনা শুরু হল বেলভের আবিষ্কারের কথা নিয়ে।

সে আলোচনাও কিন্তু বেশিক্ষণ চলতে পেল না, স্বয়ং বেলভই এসে বিমানে দেখা দিল নাচতে নাচতে, স্ফূর্তির আর সীমা নেই, উৎসাহে টগবগ করছে একেবারে।

‘কী হে? কতদূর কী করে এলে? ক্যাপ্টেনকে বলেছি তোমার কথা।’

ও-ব্রায়েনের সম্ভাষণের জবাবে বেলভ একপাক পলকা নাচ নেচে নিল গোড়ায়, তারপর বলল, ‘ছবি তুলেছি দেদার। ডেভালপ করি আগে, তারপরে দেখাব এখন। কিন্তু ছবি দেখে তোমাদের খুশি হতে বলব না, আমি চাই, তোমরা জনে জনে গিয়ে গিয়ে নিজের চোখে দেখে এসে। মঙ্গলবাসীদের ওই মহতী কীর্তি। ক্যাপ্টেনকে রিপোর্টটা দিই—’

চলে যাবার জন্য এক পা বাড়িয়েই সে কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, একখানা হাত তুলল কপালে, ‘মাথাটা আবার ধরল কেন ছাই! পুরো অক্সিজেনই তো নিচ্ছি।’

‘রোদটা লেগেছে তো?’ বলল ও-ব্রায়েন।

‘সেইজন্যেই বোধ হয়।’ বলতে বলতে বেলভ বেরিয়ে গেল।

ও-ব্রায়েন আর স্ম্যাদার্স তখন মেতে গেল কাজে। ঘণ্টা দুই পেরিয়ে গেল কোন দিক দিয়ে, কেউই খেয়াল করল না।

তারপর বাজল লাঞ্চের ঘণ্টা, কাজ বন্ধ করে ওরা চলে গেল খাবারের ঘরে। একে একে সবাই জমতে লাগল এসে, সবাইয়ের মুখে বেলভের আবিষ্কারের কথা, সবাই সংকল্প করে ফেলেছে, ক্যাপ্টেনের অনুমতি পেলেই শহরটা দেখে আসবে এক চক্কোর। পৃথিবীতে ফিরে গল্প করার বিষয় পাওয়া গেল একটা, কম কথা নাকি?

সবাই এসেছে, আসেনি কেবল দু-জন। এদিকে বেলভ, ওদিকে ডাক্তার স্নিডার। কারণ? খাওয়ার টেবিলে অনুপস্থিত থাকা তো অস্বাভাবিক ব্যাপার!

স্নিডার শেষপর্যন্ত এলেন যদিও, বেলভ এল না। তবে বেলভ যে কেন আসেনি, সেটা জানা গেল স্নিডার আসার পরে। বেলভ অসুস্থ। তার সেই সামান্য মাথাধরা ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া ঘাড়-পিঠ ফেটে যাচ্ছে বেদনায়, গায়ে তাপও বেড়েছে বেশ কিছু। স্নিডার তাকে হাসপাতাল ঘরে রেখে এসেছেন শুইয়ে, ওষুধপত্রও দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন নিজে আছেন কাছাকাছি, রোগীর উপরে নজর রাখবার জন্য।

ক্যাপ্টেন প্রায়ই সহকর্মীদের সঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করেন। তবে বিশেষ ব্যস্ত থাকলে, কখনো হয়তো নিজের কেবিনে বসে একা একাও সে কাজ সারেন। আজও সেইরকমই করতে হবে তাঁকে, খেয়ে-দেয়ে স্নিডার ফিরে গেলে, তারপরে।

ও-ব্রায়েনের মাথায় একটা কথা ঘুরছে শুধু। ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, ‘বেলভ যদি সেই জীবনের গণ্ডিতে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে বসে, তার পরিণাম কী হবে, তা কে জানে?’

খাওয়া শেষ করে ও-ব্রায়েন ভাবতে ভাবতে উঠে গেল। স্ম্যাদার্স আর কন্ট্রোলে যেতে পারবে না এখন, ইঞ্জিনঘরে তাকে হাজিরা দিতে হবে এক্ষুনি। কারণ, ক্যাপ্টেনের অনুরোধে গুরানিন তাকে ছুটি যেটা দিয়েছিল, সেটা মাত্র দুই ঘণ্টারই জন্য। সে দু-ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। একাই ও-ব্রায়েন কন্ট্রোলে ফিরল।

একা একা করবার মতো কী কী কাজ হাতে আছে, হিসাব করে নিচ্ছে ও-ব্রায়েন। তারই একটাতে এখন লেগে পড়বে ও। চেয়ারের পিঠে দু-হাত রেখে দু-চোখ আর্ধেক বুজে মনে মনে সে ভাবতে শুরু করেছে শুধু, এমন সময় চন করে উঠল মাথার ভিতরটা।

এ কেমন হল? ক্যাপ্টেনের কথা আবারও মনে পড়ে গেল, ‘পরিণাম কী হবে, কে জানে?’

ও-ব্রায়েন চেয়ারে বসে পড়েছে। ভাবছে, ভাবছে একটা গুরুতর কথা। মৈত্রীতে মার্কিন আছে আটজন, রুশও আছে আটজন। বেলভ অসুস্থ হয়ে পড়াতে সমর্থ রুশের সংখ্যা নেমে এসেছিল সাতে। এখন ও-ব্রায়েন যদি হাসপাতালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, মার্কিনের দলও দুর্বল হয়ে আসবে সমান অনুপাতে। খুব ক্ষতি তাতে হবে না। দুইদিকের সংখ্যা সমান আছে যতক্ষণ, ক্ষতির আশঙ্কা কিছু নেই। কিন্তু স্ম্যাদার্স—

বেলভ যখন কন্ট্রোলে ঢুকল বাইরের কাজ সেরে, স্ম্যাদার্সও তখন ছিল এখানে ও-ব্রায়েনের পাশেই। এখন ও-ব্রায়েন যদি অসুখে পড়ে যায়, স্ম্যাদার্সও পড়বে না— এমনটা কী করে আশা করা যায়? আর একসাথে দুটো মার্কিন যদি শয্যা গ্রহণ করে, ও-ব্রায়েন আর স্ম্যাদার্স, মার্কিনদের সংখ্যা দাঁড়াবে ছয়, রুশেরা থেকে যাবে সেই সাতজনই। সে অবস্থায় কী না হতে পারে? ঘোষকে কতক্ষণ মানবে রুশেরা? জোর করেই বিমান দখল করে বসবে হয়তো, মার্কিনদের এই মরুগ্রহে ফেলে রেখে বা মেরে রেখে নিজেরা কয়েক জন ফিরে যাবে পৃথিবীতে।

কিন্তু সত্যিই কি স্ম্যাদার্স অসুস্থ হয়ে পড়বে এই সঙ্গিন সময়ে?

কোলেভিচকে আসতে দেখে ও-ব্রায়েন তাকে বলল, ‘এখানটায় থাকো খানিকটা, আমি ঘুরে আসছি এক্ষুনি।’

ঘোরাঘুরি নয়, সোজা হাসপাতাল ঘরের দিকেই চলল ও-ব্রায়েন। যা ভেবেছে, তাই। তারও চেয়ে বেশি। স্ম্যাদার্স পাঁচ মিনিট আগে এসে ভরতি হয়েছে হাসপাতালে, বললেন স্বয়ং স্নিডার। অসুখ? বেলভের যা, স্ম্যাদার্সেরও ঠিক তাই। মাথা ফেটে যাচ্ছে, ঘাড়ে-পিঠে অসহ্য বেদনা, তাপ বেড়ে উঠছে লাফিয়ে লাফিয়ে—

‘আমারও একটা বিছানা দিন।’ বলল ও-ব্রায়েন।

শুতে শুতেও স্নিডারের কানে কানে ও-ব্রায়েন বলছে, ‘মার্কিন দাঁড়াল ছয়, রুশ সাত। হুঁশিয়ার ডাক্তার!’

বলা বাহুল্য, স্নিডার নিজেও মার্কিন।

কিন্তু হুঁশ থাকতে থাকতেই ওদিককার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেল ও-ব্রায়েন, টলতে টলতে কোলেভিচ এসে আশ্রয় নিল হাসপাতালে। ও-ব্রায়েনের চেয়ারে একবারটি বসেছিল বেচারি, দু-মিনিটেই ঘায়েল।

চোখ বুজতে বুজতেই এক ঝলক হেসে নিল ও-ব্রায়েন, ‘এদিকেও ছয়, ওদিকেও ছয়।’

কিন্তু ছয় নেমে পাঁচ, পাঁচ নেমে চার— সংখ্যা দু-দিকেই কমতে লাগল দ্রুতবেগে। স্বয়ং ডাক্তার স্নিডারও শয্যা নিলেন। হাসপাতালের ভার নিলেন ক্যাপ্টেন ঘোষ।

‘কিন্তু আপনি পড়লে তখন কী হবে?’ যন্ত্রণার এক ফাঁকে প্রশ্নটা ক্যাপ্টেনের দিকে ছুড়ে মারলেন স্নিডার।

‘আমি পড়ব না ডাক্তার, চিন্তা করো না।’ বললেন ঘোষ।

পরদিন সকালে দেখা গেল, ঘোষ ছাড়া আর কেউ সুস্থ নেই মৈত্রীতে। হাসপাতালের ঘর তো ভরে গিয়েছেই, খাওয়ার ঘরেও বিছানা ফেলতে হয়েছে কয়েকটা। ক্যাপ্টেন একবার এ-ঘর, একবার ও-ঘর এই করে বেড়াচ্ছেন সারাক্ষণ। ওষুধ পথ্যের ব্যাপারটা স্নিডার যথাসম্ভব তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নিজে অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগেই, কাজেই রোগীদের পরিচর্যা মোটামুটি চলে যাচ্ছে একরকম।

সব রোগীর অসুখ এক পর্যায়ে নেই। তিনদিন ক্রমাগত লক্ষ করে করে ঘোষ একটা বিশ্লেষণে পৌঁছোলেন ও সম্বন্ধে। ব্যাধিটা যা-ই হোক, ওর চারটা পর্যায় এ পর্যন্ত চোখে পড়েছে তাঁর। প্রথম পর্যায়ে মাথাধরা, ঘাড়ে-পিঠে বেদনা ও তাপের বৃদ্ধি। দ্বিতীয় তাপমাত্রার বারংবার অতিদ্রুত ওঠা-নামা, তার সঙ্গে প্রলাপ। তৃতীয়ে একেবারে কোমা, মোহাচ্ছন্ন অবস্থা, চতুর্থে কোমার ঠিক উলটো, উদ্দাম হুটোপাটি, বিছানা থেকে নেমে ঘরময় দাপাদাপি।

এই চতুর্থ পর্যায়ে যে যখন উপনীত হচ্ছে, ক্যাপ্টেন তাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে বেঁধে ফেলছেন ব্যাঙ্কের সাথে। এ পর্যন্ত বেলভ আর স্ম্যাদার্সই বাঁধা পড়েছে এভাবে। লোক দুটোই ষণ্ডা, ধস্তাধস্তিও তারা কম করেনি; কিন্তু ক্যাপ্টেনের হাত ছাড়িয়ে পালাবার শক্তি তাদের কারও হয়নি। অবাক হওয়ার মতো সুস্থ মস্তিষ্ক তখন কারও যদি থাকত সেখানে, সে নিশ্চয়ই অবাক হত এই ভেবে যে ওই লম্বাটে রোগা দেহে এত শক্তি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন।

চতুর্থের পরে অন্য কোনো পর্যায় আছে কিনা, এখনও জানেন না ঘোষ। যদি থাকে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার জন্য তিনি তৈরি আছেন। তৈরি হচ্ছেন অনেক বছর ধরেই, সেই সুদূর কৈশোর থেকেই। তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া শুধুমাত্র খানিকটা যোগাভ্যাস প্রত্যহ গভীর নিশীথে। প্রক্রিয়াগুলি জটিল, সন্দেহ নেই, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ঘোষের পক্ষে তা এখন সাদামাটা রুটিনে পরিণত হয়েছে।

পর পর তিনদিন একাজ করবারই সময় পাননি ঘোষ। আজ চতুর্থ রজনীতে হঠাৎ তিনি দেখলেন, দুই ঘরেই রোগীরা সব শান্ত হয়ে আছে, ঘুমিয়েই পড়েছে বোধ হয়। এই অবসরে দশটা মিনিট যদি তিনি ছিনিয়ে নিতে পারেন নিজের জন্য, দুটো প্রক্রিয়া অন্তত করে আসতে পারেন তারই ভিতর। প্রযুপ্ত শক্তিকে চাঙ্গা করে নিয়ে আসতে পারেন তাতেই।

গুটিগুটি নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেলেন ঘোষ।

ফিরে এলেন দশ মিনিট বাদে। এসে চক্ষুস্থির। বেলভ নেই, স্ম্যাদার্সও নেই শয্যায়!

কোথায় গেল? কোথায় গেল? তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাদের দেখতে পান না ঘোষ, হঠাৎ বিমানের বাইরে থেকে একটা হাসির গররা তাঁর কানে এল। গবাক্ষ দিয়ে বাইরে দিকে সঙ্গেসঙ্গে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। এক আশ্চর্য দৃশ্য সেখানে চোখে পড়ল তাঁর। বেলভ আর স্ম্যাদার্স হাত ধরাধরি করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। না, দাঁড়িয়ে তো নেই, ভাসছে হাওয়ায়। কেমন করে ভাসে? ভাসবার মতো অত হাওয়া কোথায় মঙ্গলে?

ভাসছে, আর হাসছে। এবারে তারা উড়ে চলল। যেদিকে মঙ্গলের সেই প্রাচীন শহর ঘোষ অনুমান করলেন, সেই দিকেই যাচ্ছে ওরা।

কী এ ব্যাপারখানা? বিমানের দরজা অর্থাৎ এয়ার-লক বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় বিমান থেকে বেরুনো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। অসম্ভব, আকাশি পোশাক না-পরে মঙ্গলের মাটিতে একমুহূর্তও ঘোরাফেরা। আরও অসম্ভব, নরদেহ নিয়ে শূন্যপথে উড়ে যাওয়া, যেভাবে ওরা গেল।

হ্যাঁ, সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু—

মানুষটা যদি অসাধারণ হয়? যেমন অসাধারণ ঘোষ নিজেই?

তিনি অবশ্য অসাধারণ এই কারণে যে, তিনি যোগী পুরুষ। কিন্তু বেলভ আর স্ম্যাদার্স তো যোগী নয়! তারা অসাধারণের পর্যায়ে উঠল কী করে?

পিছন থেকে কে কথা কয়ে উঠল। যে প্রশ্ন ঘোষের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়নি, সেই প্রশ্নেরই উত্তর তিনি পেলেন ও-ব্রায়েনের মুখ থেকে।

হ্যাঁ, ও-ব্রায়েন। ক্যাপ্টেনের কেবিনের দেয়ালের ভিতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল ও-ব্রায়েন, আর জবাব দিল, ‘এই ব্যাধিটার পঞ্চম পর্যায়ে এরকমই অসাধারণ শক্তির অধিকারী হয় মানুষ। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে, যখন ইচ্ছা অদৃশ্য হতে পারে, সব সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সারা বিশ্বকে আপন বলে কোলে তুলে নিতে পারে।’

‘তুমি তাহলে রুশ কোলেভিচকে এখন কন্ট্রোলের ঘরে নিজের যোগ্য সহকারী বলে স্বীকার করতে পারো?’ প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন ঘোষ।

‘হাঃ হাঃ হাঃ, কোলেভিচ? ও তো আমার ভাই! ভাইকে কেউ অযোগ্য মনে করে নাকি? এই বলে ও-ব্রায়েন গবাক্ষ দিয়ে বেরিয়ে গেল ভাসতে ভাসতে, ‘অনুমতি করুন, আমিও একবার শহরটা দেখে আসি।’

ক্যাপ্টেন ঘোষও যাবেন একদিন শহর দেখতে। ব্যাধি তাঁর না-হয়ে থাকলেও উড়তে উড়তেই যাবেন তিনি, কারণ যোগাভ্যাসের ফলে অণিমা লঘিমা প্রভৃতি অষ্টসিদ্ধির তিনি অধিকারী।

হ্যাঁ, তিনি যাবেন, এই অভিনব প্লেগের জীবাণু কিছু সংগ্রহ করবার জন্য তিনি ওই শহরে যাবেন। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ জাতীয় মনোবৃত্তি ওই জীবাণু থেকেই সঞ্চারিত হবে পৃথিবীর মানুষের মনে।

অনেক সহজেই ওকাজ হতে পারত, পৃথিবীর মানুষ ভারতের যোগ অভ্যাস করলে। তা তো কেউ করবে না যখন, হোক, এই মঙ্গলে প্লেগের যমযন্ত্রণার ভিতর দিয়েই দিব্যবুদ্ধি লাভ করুক তারা।