৬. তিতলি

৬. তিতলি

দাদাটা হুড়োহুড়ি করে বম্বে ফিরে গেল বিকেলের প্লেনেই। দিদি ফিরে যাবে ক’দিন বাদে—মৎসমুখীর পরের দিন—গভীর রাতের প্লেনে। আজই মা-বাবার কথা খুব মনে হচ্ছে বলে ভাবছি আজই ট্রাংকটা খুলে ফেললে হত। দিদি যাবার আগেই ট্রাংকটা খোলা হোক। অন্তত ও জেনে যাক, কী আছে। যদিও দুজনেই বলেছে ওরা চলে গেলে যেন ধীরেসুস্থে ট্রাংক খুলি। কী আর থাকবে ওতে?

বাবার ট্রাংকে খাতার পর খাতা। কিছু কিছু বাবার ঠাকুরদার। কাছারির হিসেবের খেরোর খাতা। এসব খাতাপত্তর সযত্নে কেন যে ট্রাংকে বন্দি করে রাখা, জানি না। মান্ধাতার আমলের খাতার ভিতরে নিমপাতা, তামাকপাতা দেওয়া আছে। পাতলা কাপড়ে জড়ানো আছে। যাতে পোকা না ধরে।

মোটা হরফে, কালো কালিতে লেখা হিসেব। অবিশ্বাস্য সব দাম।

আর অবিশ্বাস্য সব খরচ।

জমিদারবাড়ির দোল-দুর্গোৎসবের খরচ-খরচা। সত্যি সত্যিই দুর্গাপুজো হত বাবার ঠাকুরদার বাড়িতে! তিনদিনে পঁচাত্তরটা পাঁঠা এবং একটা মহিষ বলি হত।

হাউ হরিবল!

প্রতিদিন পুজোবাড়িতে ভোগ খেতে আসত গ্রামসুদ্ধু মানুষ। কাঙালি ভোজন নয়, গ্রামসুদ্ধু মানুষের পুজোয় ভোগ খাওয়ার নেমন্তন্ন—পঙক্তি ভোজন। কোনও বাড়িতে রান্না নেই।

এসব আমাদেরই বাবার ঠাকুরদার সংসারের হিসেবের খাতা?

আমাদের ঠাকুরদা কী কুকর্মটি করেছিলেন, যেজন্যে আমরা অত কষ্টে দেড়খানা ঘরের মধ্যে মানুষ হলাম? বাবাকে একটা দিন বিশ্রাম নিতে দেখলাম না, মাকে একটা দিন আরাম করতে দেখলাম না।

হোয়াট ডিড হি ডু টু অল দ্যাট ওয়েলথ? হোয়্যার ডিড ইট গো? শুধু ভোগ খাওয়ানোয়?

এই যে, শাড়ি-ধুতি বিলি হত। জোড়ায় জোড়ায়। পুজো উপলক্ষে মহাষষ্ঠীর দিনে ব্রাহ্মণদের দু-জোড়া করে ধুতি, শাড়ি বিলি করা হচ্ছে।

কেন? শুধু ব্রাহ্মণদের কেন? অন্যদের নয় কেন? ভীষণ কমিউনাল ছিল বাপু এরা—বামুন-টামুন, জাতপাত খুব মানত।

ধুতি-শাড়ির বেলায় জাত দিয়ে নয়, আর্থিক স্বাচ্ছল্য দিয়ে গ্রুপ ভাগ করা উচিত ছিল, যারা গরিব, তাদের সবাইকে দেবে। চাষিদের, নিম্মজাতির মানুষদের নিশ্চয়ই নতুন নতুন ধুতি-শাড়ি কেনবার টাকাপয়সা থাকত না, তখনকার দিনেও। সম্ভবত আরও দুরবস্থা ছিল। না, গরিবদের সাহায্য মানেই দেখছি ব্রাহ্মণদের সাহায্য করা। ‘দরিদ্র ব্রাহ্মণ’ কথাটা খুব চালু ছিল। ‘দরিদ্র শূদ্র’ ব্যাপারটা নিয়ে কেউ ভাবতই না। ওরা তো অমন হবেই। এই তো, দরিদ্র ব্রাহ্মণ ভট্টাচায্যি মহাশয়ের কন্যার বিবাহে একশত মুদ্রা দান এবং তাতে বরবধূর বিবাহের চেলি, বরের অঙ্গুরীয়, ‘সালঙ্কারা’ কন্যার আপাদমস্তক গয়নাগাঁটি (মাথার টিকলি, গলার হার, হাতের শাঁখাপলা, কানের ফুল, নাকছাবি, পায়ের নূপুর)—সবই হয়ে গেছে। মায় পুরোহিতের দক্ষিণাও। দামগুলিও লেখা আছে। অবিশ্বাস্য।

এই ট্রাংকের খাতাগুলো সত্যি সত্যিই গুপ্ত নয়, লুপ্তধনের হদিস—যে ধন এককালে সত্য ছিল। এখন চিরতরে লুপ্ত। যার হদিস শুধু অতীতেই।

.

বাবার কাছে খাতাগুলোই একমাত্র প্রমাণ তাঁর পিতৃধনের। অথচ কোনওদিনই গর্ব করে আমাদের জানাননি—পুজোর সময়েও বলেননি, ‘জানিস, আমাদের দেশের বাড়িতে দূগগাপুজো হত, মোষ বলি হত, তিনদিন ধরে গাঁসুদ্ধ কোনও মানুষের বাড়িতেই উনুন জ্বলত না। সবাই পুজোবাড়িতে খেত।’

—কেন বলেননি? ওই উত্তরাধিকার তো বাবার একার ছিল না, ওতে দাবি তো আমাদেরও।

কী অভিমানে, কীসের কারণে বাবা আমাদের ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি আমরা কেমন বংশের ছেলেমেয়ে?

মা-ও বলেননি। মা-ও তো জানতেন।

এখানে হিসেবের খাতাতে গোটা গোটা হরফে সমস্ত হিসেব লেখা আছে, শ্রীমান মণীন্দ্রের সহিত চিরায়ুষ্মতী কাজলরেখার শুভপরিণয়ের। প্রবল ঘটাপটা করেই নাতবউ ঘরে এনেছিলেন বাবার ঠাকুরদা রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমাদের ঠাকুরদা মানবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই হলেন সেই ছিদ্র, সেই রন্ধ্র, যার ভিতর দিয়ে সংসারে প্রবেশ করেছিল শনি। এবং তরুণ যুবক মণীন্দ্রকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অকূল সমুদ্রে। রাঘবেন্দ্রকে আশা করি সেটা দেখে যেতে হয়নি। পুত্র মানবেন্দ্রর পতনও কি তিনি দেখে গেছেন? আমরা তো ঠাকুরদা-ঠাকুমাকে দেখিওনি, তাঁদের বিষয়ে নামগন্ধও শুনিনি। মানবেন্দ্র তবে কী স্বল্পায়ু ছিলেন? খাতাগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে সবই হয়তো জানা যাবে। হিসেবের খাতায় নিশ্চয় পাওয়া যাবে রাঘবেন্দ্রের শ্রাদ্ধের খরচের হিসেবও। পৌত্র মণীন্দ্রের বিবাহের আড়ম্বরের বহর দেখেই তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। না জানি রাঘবেন্দ্রের নিজের শ্রাদ্ধের জন্য তিনি কী কী দানসাগর পরিকল্পনা করে রেখে গিয়েছিলেন!

.

কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না, এই বিলাসের ইতিহাস আমাদেরই পূর্বপুরুষের। এমনভাবে বাজি পুড়িয়ে ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে যে-বধূটিকে আদর করে সংসারে আনা হয়েছিল, এতদিন ধরে বাড়িতে মোচ্ছব চলেছিল যার জন্যে, তার জীবন কেন কাটল এমন বঞ্চনায়? ঈশ্বরের হিসেবের খাতায় তিনি এটা কেমন করে মেলাবেন?

.

এতদিন পরে, ভাবতে বসে স্পষ্ট হচ্ছে অনেক কিছু।

বাবা ও মা, দুজনের মধ্যেই একটা স্বভাব-সুস্থির আভিজাত্য ছিল। দারিদ্র্য যাকে স্পর্শ করেনি। একথা ঠিকই, সত্যি সত্যিই ওই দেড়খানা ঘরে ওঁদের মানাত না। শিবুদা, তার মা, বাবা, ওঁরা দেড়খানা ঘরের ভাড়াটে বাবা-মাকে যে এত শ্রদ্ধা করতেন—সেটা কেবল বোধহয় ওঁদের স্বভাবগত আভিজাত্যের প্রভাবে। আভিজাত্য যেমন ছিল তাঁদের আচরণে, তেমন আকারেও। বলে না, পয়লা দর্শনধারী! সেদিক থেকে, বাবা যেমন সুপুরুষ ছিলেন, মা’ও তেমনিই সহজ সুন্দরী। অত দু:খকষ্টের মধ্যেও তাঁদের চেহারা থেকে রূপের রাজটিকা যে ঘুচে যায়নি, তার কারণ সেই শ্রী ওঁদের আকস্মিক ছিল না। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ।

তারই ছিটেফোঁটা জুটেছে আমাদেরও।

.

দাদা চিরদিনই হ্যান্ডসাম, দিদি টিপিকাল বাঙালি সুন্দরী, আর আমি, তিতলি, আমার সৌন্দর্য একটু অন্য ধরনের। আমি রোগা, লম্বা, একটু বেশিই লম্বা, দিদির মতন ফরসাও নই, কিন্তু দেখতে ভালোই। শাড়ি পরতাম যখন, তখনও লোকের চোখে আমাকে মন্দ দেখাত না। এখন ও-দেশে ড্রেস পরি, ট্রাউজার্স পরি, এখনও লোকে তো বলে সুন্দর।

এই কথাটা রাহুলই প্রথম আমায় বলেছিল—’তোমাকে ট্রাডিশনাল ইন্ডিয়ান ড্রেসেও যতটা অ্যাট্রাকটিভ দেখায়, ওয়েস্টার্ন ক্লোদসেও তুমি ঠিক তেমনিই ফ্যাবুলাস—ইউ হ্যাভ অ্যান আইডিয়াল ফিগার।’—কিন্তু জেনি আসার পরে সবই কেমন উথাল-পাথাল হয়ে গেল। রাহুলের পাদুটো আর যেন মাটিতে রইল না। প্রথমে একের পরে এক মিথ্যে দিয়ে মিথ্যেকে ঢাকার চেষ্টা, তারপরে লজ্জাহীনভাবেই, যেন জাদুবলে, জেনির আজ্ঞাবহ দাসের ভূমিকায় চলে গেল সে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *