৫. মিতুল

৫. মিতুল

জিনা ফিরে যাবার জন্য এত জেদ না করলে দাদা হয়তো আজই ফিরে না গিয়ে আরও কয়েকটা দিন থেকে যেত। শ্রাদ্ধ তো হল মঠে, খাওয়াদাওয়াও সেখানেই, তিতলি মৎসমুখী করছে মা’র জন্যে কেনা ফ্ল্যাটে। দাদা মৎসমুখীটা পর্যন্ত থাকল না! এত কীসের তাড়া? মা’র কাজ তো একবারই! আমি বিবাহিত মেয়ে, আমার তো চতুর্থী করা হয়েই গেছে। আমি কলকাতায় আসার দিনেই সেটার তিথি পড়েছিল। বিদেশে আচার নাস্তি। দেশে পা দিয়েই আমি শ্বশুরবাড়িতে চতুর্থী করে নিয়েছি। আমার পক্ষে বেশিদিন থাকা সম্ভব না। জার্মানিতে জিৎ-জয়াকে অশোকের কাছে রেখে এসেছি। ছেলেমেয়ে যদিও দুজনেই যথেষ্ট আত্ননির্ভর, যথেষ্ট দায়িত্বশীল হয়েছে। তবু। অশোক তো দুটোর কোনওটাই নয়। নিজেরটা নিজে করতে শিখল না এখনও। আমার শাশুড়ি ছেলের হাতে হাতে সব করে দিয়ে স্বভাব বিগড়ে দিয়েছেন—অথচ ছেলেপুলেও তো কম ছিল না তাঁর? তবু, অশোকের কথা আলাদা। সে প্রথম সন্তান। কী ভাগ্যি আমরা কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছিলাম নইলে আমাদের বিয়েটা টিকত না। ওই শাশুড়ির গুণে আমার দুই দেওরেরই বউয়েরা পালিয়েছে। কী জানি, দেশে থাকলে হয়তো আমিও পালাতাম? জিনা দাদাকে কোথাও একলা ছাড়ে না। এতদিন বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে তবুও দাদাকে বিশ্বাস করে না। অথচ দাদাটা চিরদিনই বউয়ের আঁচল ধরা, কখনও অন্যদিকে তার নজর যায়নি। জিনার কোনও প্রয়োজন ছিল না মায়ের শ্রাদ্ধে আসার। তাও মেয়েকে রেখে—মেয়ে একা আছে বলে শ্রাদ্ধ শেষ হতে-না-হতেই দাদাকে নিয়ে দৌড়ে ফিরে গেল। সেই দিনেই না গেলে চলছিল না? মৎসমুখীটা তিতলি একাই করবে। অবশ্য আমিও আছি। আত্মীয়স্বজনদের খুঁজে খুঁজে বের করেছে তিতলি। আমার মোটে সায় ছিল না—জীবনে যাদের দেখিনি, যাদের সঙ্গে যোগাযোগই ছিল না, তাদের ডেকে এনে কেন খাওয়াব? বাবার বেলায় মা ছোট করেই মৎসমুখী করেছিলেন। এত কাণ্ড হয়নি। কিন্তু তিতলির ধারণা মায়ের আত্মার শান্তি এতেই হবে। খুব আড়ম্বরের সঙ্গেই মৎসমুখী হচ্ছে এবং নির্লজ্জ বেহায়া যত আত্মীয়স্বজন—মা-বাবা বেঁচে থাকতে যাঁরা একবার খবর নেননি—মৃত্যুর পরেও যোগাযোগ করেননি, নিমন্ত্রণরক্ষা করতে কিন্তু আসবে বলেছেন তাঁরা সকলেই। যেহেতু আমরা দুই বোন NRI—আমাদের Social Status-ই এখন আলাদা। সংকর্ষণ চ্যাটার্জিরও প্রচণ্ড নামযশ ভারতবর্ষের বিজ্ঞাপনের জগতে। কার্ডে দাদার নামই তো ছিল সবার আগে। কিন্তু দাদা তো থাকেনি। তিতলিই কার্ডটা লিখে ছাপিয়েছে—কার্ডে আমাদের তিনজনেরই নাম, পৃথিবীর যে যেমন ভূমিষ্ঠ হয়েছি সেই অর্ডার। দাদা, তিতলি দুজনেই শ্রাদ্ধাধিকারী, দুজনেই শ্রাদ্ধ করল। দাদা এবারেও মাথা ন্যাড়া করেনি। বাবার মৃত্যুর পরেও না। মূল্য ধরে দিল। কীসের মূল্য? না-কাটা চুলের? না, না-মান্য করা আচারবিধির? জিনা সে-বারে দাদার সঙ্গে আসেনি। এবারে কেন যে এল! এসে, কী করছে? একটানা ইঞ্জিনের মতো সিগারেট খাচ্ছে আর দাদার ওপরে নজর রাখছে। যাতে আমাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে বিগড়ে না যায় দাদা! দাদার আর বিগড়োনোর যে কিছু বাকি নেই, সেটা জিনা বোঝে কি? এই সংকর্ষণ চ্যাটার্জি, আর আমাদের সেই দাদা, দুটো আলাদা মানুষ। শুধু দাদা যখন জার্মানিতে যায়, দু-একদিনের জন্য আমাদের কাছে থাকে, তখন হঠাৎ কোথা থেকে যেন ফিরে আসে সেই ছোটবেলার দাদাটা। জিনাবিহীন। তিতু-মিতুর সেই দাদাটা।

তিতুর জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে।

আমার তো সংসার আছে। দাদারও সংসার আছে। তিতু একলা। ও চেয়েছিল মাকে নিয়ে ছোট্টো করে একটা সংসার পাততে। সুন্দর ফ্ল্যাট কিনেছে। শুরু করছিল সাজাতে। মায়ের মনের মতো করে।

ওর মনের কথাটা আমি খুব বুঝি। সারাজীবন দেড়খানা ঘরের সংসারে গিন্নি ছিলেন মা। মাকে একটা আস্ত ফ্ল্যাট দিতে চেয়েছিল তিতু। মা’র একটা আস্ত শোবার ঘর থাকবে, একটা আলাদা বসার ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা গেস্টরুম। সেইখানে এসে থাকব আমরা। মায়ের প্রিয়তম গেস্টগুলি। আমাদের বাড়িতে বাথরুমটা ছিল শিবুদাদের সঙ্গে শেয়ার করা। দাদা, বাবা তো উঠোনের চৌবাচ্চার জলেই স্নান সেরে নিতেন, শিবুদাও। বাথরুমে স্নান করতাম শুধু আমরা! মেয়েরা উঠোনের একপাশে ছিল পায়খানা। বাড়িসুদ্ধু সবার জন্য। ওদের অবশ্য ওপরতলাতেও নতুন আরেকটা বাথরুম পায়খানা ছিল, সেটা ওদের নিজস্ব। এখানে মার নিজস্ব দু-ঘরে দুখানা বাথরুম। মা খুশি হবেন বলেই ফ্ল্যাট কেনা—মায়ের জন্য কাজের লোকও ঠিক করেছে তিতু, একটি আদিবাসীদের ক্রিশ্চান মিশন থেকে। সেই মেয়ে মা’র দেখাশুনো করবে চব্বিশ ঘণ্টা। সে-ও এসে গেছে, তিতুই ওকে আপাতত রাখবে, যতদিন ও নিজে কলকাতায় আছে। তারপর ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেবার বন্দোবস্ত করতে হবে। দাদা ওরই মধ্যে বলে গেল, ‘কোম্পানি গেস্ট হাউস’ করবার জন্যে ভাড়া দিতে। তাতে ভাড়াও নিশ্চিত, ফ্ল্যাটের কেয়ার টেকিংটাও ঠিকমতো হবে। দাদা বলেছে খোঁজ করবে বম্বেতে, কোনও আগ্রহী কোম্পানি পায় কিনা। এখানেও ওকে বিজ্ঞাপন দিতে বলল রবিবারের ইংরিজি সব কাগজে। চারমাসের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে থাকবে বলে আসা স্থির করেছিল তিতু। এসে পৌঁছোনোর আগেই হঠাৎ মা চলে গেলেন। আমরা কেউ ছিলাম না পাশে। কেউ না। ঠিক তিনদিন পরেই তিতলির এসে পৌঁছোনোর কথা—মা ওকে সেই সময়টুকু দিলেন না। মা’র খবর পেয়েই দাদা-জিনা এসে পড়েছিল। জিনার সুবুদ্ধিতে ওরা মাকে পিস-হ্যাভেনে রেখেছিল আমাদের আসার অপেক্ষায়। আমরা সবাই সেই এসে পড়লাম—কিন্তু মা’র সেটা জেনে যাওয়া হল না। তিন ভাইবোন একসঙ্গে ছুটে এসেছি শুধু মা’রই জন্যে, মাকেই দেখব বলে—এত সৌভাগ্য মায়ের ইতিপুর্বে হয়নি। কিন্তু সেই আনন্দটুকু তাঁর ভাগ্যে ছিল না। আনন্দ দেওয়ার কপালও তো থাকা চাই?

আমাদেরও ভাগ্যে ছিল না মা’র সেই আনন্দময়ী রূপটি দেখা।

তবে মার খুশি ভরা অবকাশ যাপনের চেহারাটি আমার দেখা হয়েছে, যখন মা আমার কাছে ফ্রাঙ্কফুর্টে গেলেন। সে যেন অন্য একজন মানুষ। রাত থাকতে উঠে সারাদিন পরিশ্রম করতেন, আর একটু ফাঁক পেলেই একটা বই নিয়ে শুতেন যে মা—ইনি তিনি নন। এই মা দোকানপাটে যেতে, ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মধ্যে ঘুরতে খুব পছন্দ করতেন। কেনাকাটায় মন ছিল না, শুধু ঘুরে ঘুরে দেখা। পথেঘাটে হেঁটে বেড়াতেও মহা উৎসাহ। আর ভালোবাসতেন পার্কে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে। ফ্রাঙ্কফুর্টের পার্কে জলাশয়ে রাজহাঁস চরে—ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকে পার্ক, সবুজে সবুজ হয়ে থাকে লন—মা মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। বাচ্চারা খেলা করছে, তরুণী মায়েরা তাদের পিছনে পিছনে ছুটছে। পোষা কুকুররা ছুটোছুটি করছে। মা’র সবই ভালো লাগত। মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখতেন নদী দিয়ে নৌকো যাচ্ছে—দেখতেন রাস্তা দিয়ে স্কেটিং বোর্ডে চড়ে ছেলেমেয়েরা হুশ হুশ দৌড়ুচ্ছে—মা যা দেখতেন তাতেই মুগ্ধ। অথচ যখন বললাম মাকে আমার কাছেই সারাজীবন রেখে দিতে চাই, কিছুতেই রাজি হলেন না। বলেন কি—’মিতু, এটা তো স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যে কি চিরকাল থাকা যায়। জেগে থাকতে হবে না?’ নাতি-নাতনিদের সাহচর্যের লোভও মাকে আটকাতে পারল না। তিতুর কাছ থেকে সোজা দেশে ফিরে গেলেন, দাদার ব্যবস্থা করে রাখা ওল্ড এজ হোমে। ইচ্ছে ছিল কাশীবাসী হবার। সেটা হল না।

‘সন্ধ্যার কুলায়’ কিন্তু জায়গাটি ভালো। মা’র খুব ভালোই লাগছিল ওখানে। তিতুরি নাকি ঘরটা পছন্দ ছিল না—মা’র কিন্তু অভিযোগ ছিল না কোনও। এটা অবশ্য বৃথাবাক্য বলা হল—মা’র কি জীবনে কখনও কোনও অভিযোগই ছিল? কাউকে নিয়েই? কোনও পরিস্থিতিতেই?

মাকে ‘সন্ধ্যায় কুলায়’ থেকে তুলে তিতু নিয়ে আসছিল এই ‘গ্রিন রিজেস’ হাউসিংয়ে। সত্যিই বেশ সবুজায়ন হয়েছে এই অঞ্চলটায়। ফাঁকা। খোলামেলা। গাছপাতার মধ্যে অনেকটা আকাশ—মা’র এখানে থাকলে মন ভালো লাগত, শরীরও ভালো থাকত। আয়ু বৃদ্ধি পেত। আমাদের কপালে ছিল না। মায়েরও না।

মায়ের সেবা করার ভাগ্য থাকা চাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *