সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৫. নক্ষত্র? না, ক্ষেপণাস্ত্র

নক্ষত্র? না, ক্ষেপণাস্ত্র

‘শুভ নববর্ষ, বন্ধু হ্যারল্ড! মিসেস হ্যারল্ড! নববর্ষ সুখে কাটুক আপনার!’

আজ আর লিফট নেননি বুড়ো সিমসন। সিঁড়ি দিয়েই নেমে আসছেন, ডাইনে-বাঁয়ে প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে নববর্ষের শুভকামনা জানাতে জানাতে।

একাই পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাট দখল করে আছেন মিস্টার সিমসন, আজ এক যুগ ধরে। মহলে মহলে কত ভাড়াটে এল-গেল ইতিমধ্যে, কেউ দু-বছরের জন্য, কেউ-বা মাত্র দু-হপ্তার জন্য। যে যখন আসছে, সিমসন যেচে এসে আলাপ করে যাচ্ছেন; যতদিন থাকছে তারা, মাঝে মাঝে এসে নিয়ে যাচ্ছেন খোঁজখবর। বলতে গেলে ওই করেই দিন কাটে ভদ্রলোকের! বসুধৈব কুটুম্বকম আর কী! এই সৃষ্টিছাড়া লোকটিকে নতুন আলাপিরা দ্যাখে সন্দেহের চোখে, ভাবে— লোকটা ধার চাইবে দুই-একদিনের ভিতরই। আর পুরোনোরা? তারা ভাবে, বুড়োটা ছিটগ্রস্ত, একটু মিষ্টিমুখে ওর সঙ্গে কথা কইলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না।

খবরের কাগজ? আসে সিমসনের ঘরে একখানা, কিন্তু সেটার উপরে চোখ বুলোবার সময় তাঁর লাঞ্চের আগে হয় না। তাই নববর্ষের শুভকামনার জবাবে মিসেস হ্যারল্ড যখন খনখনিয়ে উঠলেন, টাইমসখানা তাঁর নাকের উপরে মেলে ধরে, বৃদ্ধ চমকে উঠলেন দারুণরকম। ‘কী? কী? কী লিখছে? পৃথিবী ধ্বংস হতে যাচ্ছে? বলে কী!’

‘আর বলে কী!’ এগিয়ে এলেন মিস্টার হ্যারল্ড, ‘নেপচুনের ওপাশ থেকে একটা নক্ষত্র নাকি এগিয়ে আসছে একেবারে নক্ষত্রবেগে। দুই-একদিনের মধ্যেই নাকি সে হুমড়ি খেয়ে পড়বে নেপচুনের ঘাড়ে। ওরা দুটো তো চুরমার হয়ে যাবেই, সেইসঙ্গে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই উলটেপালটে ছত্রখান হয়ে যাবে মশাই। আমাদের এই ক্ষুদে পৃথিবীর বরাতে কী যে হবে, তা দেখতেই পাবেন সেইদিন। এর মাঝে আপনি কামনা করছেন শুভ নববর্ষ?’

‘নেপচুন?’ সিমসন ভ্রূ কুঞ্চিত করে ভাবলেন একটু, ‘নামটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে। গ্রিকদের বা রোমানদের বা মিশরীয়দের একটা দেবতা ছিল বোধ হয় ওই নামে। হয় আগুনের দেবতা, নয়তো জলের, আর তাও যদি না-হয় তো বাতাসের। তা সে যাই হোক না কেন, তার ঘাড়ে নক্ষত্র পড়তে যাবে কোন দুখখে? আর পড়েই যদি, নেপচুন দেবতা যখন, আমাদের না-হোক, অন্য জাতের হলেও, কিন্তু দেবতা যখন, সে অবশ্যই সে-হামলা রুখতে পারবে। উলটেপালটে ছত্রখান— আরে না না, আমাদের এ লন্ডন শহর অমন পলকা জিনিস নয়। নেপোলিয়ন ভিড়তে পারেনি এর কাছে, তো নেপচুন তো চুনোপুঁটি।’

তখন সিমসনের এক কান দখল করে বসলেন স্বয়ং হ্যারল্ড, অন্য কান তস্য পত্নী। দু-জন মিলে নিরীহ বৃদ্ধকে জ্ঞানদানে লেগে গেলেন— প্রথমে গ্রিক পুরাণ, তারপরে ইতিহাস ভূগোল, সবশেষে জ্যোতিষী গণনার সম্পর্কে। সিমসন বুড়োর হাঁইফাঁই অবস্থা!

সিমসনের দোষ কেউ দেবে না। সে বেচারি নিরীহ বুড়ো মানুষ, আকাশের জ্যোতিষ্ক নিয়ে জীবনে কোনোদিন মাথা ঘামাননি। বাদ দিন সিমসনের কথা। কিন্তু সারা পৃথিবীর সাড়ে তিন-শো কোটি মানুষের হাল কী সেই নববর্ষের শুভক্ষণটিতে? বেছে বেছে এই দিনটাতেই মানুষের মাথায় এ বোমা না-মারলে চলছিল না খবরের কাগজওলাদের?

সাড়ে তিন-শো কোটি একটি অতিশয়োক্তি হল। ওর মধ্যে অন্তত দেড়শো কোটি খবরের কাগজ চোখে দেখেনি এই বিংশ শতাব্দীতেও। তারা এখনও দিন কতক নিশ্চিন্ত থাকুক, যতদিন গুজবের পাখায় ভর করে দুঃসংবাদটা শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে জঙ্গলে, বেদুইনের তাঁবু থেকে এস্কিমোর ইগলুতে, মহাসমুদ্রের বিজন দ্বীপে নির্বাসিত রবিনসন ক্রুসোদের কাছ থেকে ক্যাটস্কিল গিরিমালায় নিভৃত গুহায় সুখসুপ্ত রিপ ভ্যান উইংকলদের কাছে অনিবার্যভাবে পৌঁছে না-যায়।

থাকুক তারা আপাতত নিশ্চিন্ত, লন্ডনের কথা হচ্ছে— সেই কথাই হোক। প্রাতরাশের টেবিলে, গির্জার প্রাঙ্গণে, দোকানের কাউন্টারে বা রাস্তার ফুটপাথে অন্য কোনো আলাপ নেই কারও মুখে। ডিক যদি হ্যারিকে নববর্ষের সম্ভাষণ জানায়, হ্যারি ঠিক হ্যারল্ডগিন্নির মতোই খেঁকিয়ে উঠবে, ‘আর নববর্ষ! নববর্ষ যে ডুমসডে হতে চলল!’

সংবাদটা কিন্তু একেবারে আকস্মিক নয়। ডিসেম্বর থেকেই কানাঘুসো চলছে এ নিয়ে। জ্যোতির্বিদ ওগিলভি ওই সময়েই বিজ্ঞানী সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, নেপচুনের গতিবেগ ব্যাহত করে দেবার মতো একটা কিছু ঘটছে বহিরাকাশে।

এখন নেপচুন হচ্ছে আমাদের এই সৌরমণ্ডলের সীমান্তরক্ষী। ওর বাইরে আর গ্রহ নেই। ওর কক্ষপথের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে যে বহিরাকাশ, তার বিস্তার মিলিয়ন মাইলের দুই কোটি গুণ দূরত্ব পর্যন্ত একদম অবারিত। শূন্য, শূন্য— শূন্যাকার সব। নেই তাপ, নেই আলো, নেই শব্দ, নিকষ কালো এক মহাশূন্যতা নিথর হয়ে পড়ে আছে অনন্ত মরণের মতো।

এখন এই বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এক অচেনা আগন্তুকের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে এই দুই কোটি মিলিয়ন মাইলব্যাপী তেপান্তরে। বিরাট, অপরিমেয় এর কলেবর, রহস্যময় কালো আকাশের বক্ষ মথিত করে দুর্বার বেগে ছুটে এসে ঢুকে পড়ছে সৌরমণ্ডলের আলোর রাজ্যে। ২ জানুয়ারি নাগাদ যেকোনো মাঝারি রকমের দূরবিনেই ধরা পড়ে গেল এই অবাঞ্ছিত অতিথির চেহারা, সিংহরাশির নক্ষত্রপুঞ্জের ভিতর রেগুলাসের খুব সন্নিকটেই অতিক্ষীণ এক কণা আলোর আভাস।

নতুন বছরের তৃতীয় দিন, সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রগুলিতে দেখা গেল বৃহৎ অক্ষরের একই অভিন্ন শিরোনাম, ‘গ্রহে গ্রহে সংঘর্ষ’। বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই নবাগত নক্ষত্র হয়তো নেপচুনের গায়ে ধাক্কা মারবে এসে। খবরটা পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সারা পৃথিবীর সব শহরে একটা অস্পষ্ট প্রত্যাশা জাগল এইরকম যে, হয়তো আজই কিছু অনৈসর্গিক দুর্লক্ষণ দেখা যাবে আকাশে। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই কোটি কোটি চক্ষুর দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হল উপরপানে। কিন্তু কই, সেখানে তো চিরপরিচিত পুরোনো পুরোনো নক্ষত্র ছাড়া অন্য কিছু নেই!

বুড়ো সিমসন রাতদুপুরে নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে, মিসেস হ্যারল্ডকে আশ্বস্ত করবার জন্য, ‘বাজে গুজবে কান দিও না বাছা! এখানে কিছু হবে না। লন্ডন অত পলকা জায়গা নয়। নেপোলিয়ন এখানে পাত্তা পায়নি— নেপচুন তো কোন ছার!’

লোকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। রাতের বেলা ঘুমোল নিশ্চিন্ত হয়ে। ঘুমোল ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে পর্যন্ত। অবশেষে, আঁধার যখন কাটল, মাথার উপর তারার মালা যখন মলিন হয়ে গেল—

শীতের প্রভাত। দিনের আলো যেন ফিলটারের ভিতর দিয়ে ক্ষীণ ধারায় চুইয়ে চুইয়ে পৃথিবীতে পড়ছে। জানালায় জানালায় গ্যাস আর মোমবাতির আলোগুলোকে দেখাচ্ছে হলদে; কাজের তাড়ায় সকাল সকাল যাদের শয্যাত্যাগ করতে হয়, আলো না-জ্বেলে তারা চলাফেরা করবে কেমন করে?

সেই সময়। পুলিশের পাহারাওয়ালারা হাই তুলছে রাত্রি জাগরণের পরে। তারা দেখতে পেল জিনিসটা। বাজারে বাজারে ভিড় জমছে কেনা-বেচার জন্য; ভিড়ের সব লোক উপরপানে একবার তাকিয়ে চোখ আর ফেরাতে পারল না। দিনমজুরেরা কাজে বেরিয়েছে, গয়লারা দুধের জোগান দিতে যাচ্ছে, খবরের কাগজের গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার, মাতালের উশকোখুশকো চেহারায় টলতে টলতে বাড়ির পানে ফিরছে, গ্রামের মাঠে চাষি চলেছে লাঙল নিয়ে, জমিদারের পার্কে রাতের বেলায় যারা চুরি করে হরিণ মেরেছে, তারা শিকার কাঁধে নিয়ে গলির পরে গলি পেরুচ্ছে সদর রাস্তা এড়িয়ে।

এরা সবাই—

তা ছাড়াও, সমুদ্রে সমুদ্রে যেসব নাবিক উদয় সূর্যকে অভিবাদন জানাবার জন্য জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে দিগন্তে দৃষ্টি বিন্যাস করে—

সবাই দেখতে পেল সেই আধো-আঁধার শীতের ঊষায় প্রকাণ্ড একটা সাদা নক্ষত্র। হঠাৎ যেন কোথা থেকে লাফিয়ে এসে পড়ল সে পশ্চিমের আকাশে।

আমাদের এই আকাশের মামুলি নক্ষত্রদের চাইতে অনেক উজ্জ্বল। সন্ধ্যাতারার ঝলমলানি এক-একদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু এটা উজ্জ্বল তার চেয়েও। দিনের আলো ফুটল, তবু এ বস্তুটির মিলিয়ে যাবার নাম নেই। এক ঘণ্টা বেলাতেও এ জ্বলজ্বল করছে আকাশে। একবিন্দু মিটমিটে আলো নয়, বেশ বর্তুল একটা চাকা, ছোটো হলেও উজ্জ্বল। যেসব অঞ্চলে বিজ্ঞান এখনও শিকড় বসাতে পারেনি, সেখানে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর পানে, আর পরস্পরকে শোনাচ্ছে— এসব দুর্লক্ষণের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হচ্ছে মহামারি আর মহাযুদ্ধ!

মানমন্দিরে মানমন্দিরে জ্যোতির্বিদদের ব্যস্ততারও সীমা নেই, উত্তেজনারও না। সুদূর অন্তরীক্ষে ওই দুটো জ্যোতিষ্ক পাশাপাশি ছুটছে যেমন, এখানে তেমনই পাশাপাশি দৌড়োচ্ছে ক্যামেরাম্যান আর বর্ণবীক্ষণযন্ত্রীরা। গ্রহ-নক্ষত্র দুটোর বিভিন্ন অবস্থা ধরে রাখতে হবে ছবিতে, তার চেয়েও যা জরুরি, আসন্ন ধ্বংসের প্রাক্কালে ও সমকালে পৃথিবীতে ঘটে কীরকম বিপর্যয়, জলোচ্ছ্বাস না বিস্ফোরণ, সর্বগ্রাসী অন্ধকারের প্লাবন না সব জ্বালিয়ে-দেওয়া বহ্ন্যুৎপাত, হুবহু প্রত্যেকটা পর্যায় ফুটিয়ে তুলতে হবে ফোটোর বুকে। ভবিষ্য পুরুষদের অশেষ উপকারে আসবে সে-সব, যদি অবশ্য এর পরেও ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে।

ওই যে দেখা যায় সাদা গোলকটা, ভাবতে প্রচণ্ড বিস্ময় লাগে যে ওটাও একটা পৃথিবী, আমাদেরই পৃথিবীর মতো। হয়তো নদী আছে পাহাড় আছে ওখানে, প্রান্তর আছে সুশ্যামল, সমুদ্র আছে নিবিড় নীল। প্রাণের অস্তিত্বই বা অসম্ভব কী? হয়তো আমাদেরই মতো মস্তিষ্কবান বিবেকবান মানবজাতি ওখানে বাস করে, গ্রামে নগরে সুখনীড় রচনা করে, প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে বিশ্বজগতের কল্যাণকামনায় আত্মনিয়োগ করে। আজ তারা আমাদের ধ্বংস করতে চাইছে কেন?

কেন? এতদিন তো ওই অপয়া অতিথির বেশ চলছিল, আমাদের দেশে না-এসে! তার মতো সে ছিল, আমাদের মতো আমরা ছিলাম। দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান ছিল দুই কোটি মিলিয়ন মাইলের চাইতেও বেশি। আজ সে কেন আসে? কার নির্দেশে? ভগবানের নির্দেশ যদি হয় সেটা, কে বলবে যে সে নির্দেশ মঙ্গলময়?

কিন্তু সে কথা থাকুক। মরবার সময় আর ভগবানের দোষ ধরে লাভ নেই। রোজ কেয়ামত। এ-সময়ে তিনি ছাড়া ত্রাতা কেউ নেই। সূর্যোদয়ের পরেও পুরো দুটো ঘণ্টা সগৌরবে পশ্চিম আকাশে ও আসর জাঁকিয়ে রইল। পণ্ডিতেরা বললেন, দুটো জ্যোতিষ্ক একসাথে গেঁথে গিয়েছে প্রচণ্ড এক টক্কর খেয়ে। দুটো জ্যোতিষ্ক— নেপচুন আর তার আততায়ী। সংঘর্ষের ফলে জ্বলে পুড়ে গলে গলে একসাথে মিশে গিয়েছে দুটো গ্রহ। একটামাত্র আকাশজোড়া বহ্নিবলয়ে পরিণত হয়ে ধেয়ে এসেছে পৃথিবীকেও কুক্ষিগত করবার জন্য।

পরদিনও ইউরোপের আকাশে ও উঠল। বাড়ির ছাদে ছাদে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে, মাঠে-ময়দানে সর্বত্র নরমুণ্ডের সারি কেবল, পুবের আকাশে সবাই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দর্শন লাভের জন্য। উঠবার আগে ওর সাদা-কালো অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল শূন্যমণ্ডলে। আগের দিন যারা ওকে দেখেছিল, আজ তারা চেঁচাতে লাগল, ‘বড়ো হয়েছে আরও, উজ্জ্বল হয়েছে আরও।’ কৃষ্ণপক্ষের অর্ধচন্দ্র অস্ত গিয়েছে একটু আগেই, যাবার আগে এক মুহূর্তের জন্যও এতখানি ভস্বর তাকে একবারও দেখায়নি।

রাস্তার লোক চেঁচাচ্ছে ‘আরও উজ্জ্বল’ বলে। মানমন্দিরের ঘরে ঘরে চিন্তাকুল জ্যোতির্বিদেরা কিন্তু চুপিচুপি বলাবলি করছেন, ‘নিকটে, আরও নিকটে এসেছে।’ নিকটে! কতখানি আতঙ্কের বাহন যে ওই একটিমাত্র ছোট্ট শব্দ, তা জানেন শুধু তাঁরাই। ওই সর্বধ্বংসী আগুনের পাহাড় নিকটে আসার মানে যে আমাদেরও নিশ্চিত ধ্বংস, তাতে তাঁদের তিলমাত্র সংশয় নেই।

টেলিগ্রাফে টেলিগ্রাফে সকল দেশে সংবাদ চলে গেল, ‘আরও নিকটে! আরও নিকটে!’ অফিসে বসে কেরানিরা খাতা লিখছিল, কলম হাতে নিয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। কেন? না, আরও নিকটে এসেছে। শেয়ার বাজারে ফাটকাবাজেরা দরকষাকষিতে ব্যস্ত ছিল, হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করল, ‘ওই যে! নিকটে এসেছে আরও!’ গেরস্তরা দরজায় দাঁড়িয়ে পথচরদের ডেকে ডেকে বলতে লাগল, ‘কোথায় যাচ্ছ আর? আরও নিকটে এসে গিয়েছে শেষের দিন!’

শীতের রাত্রে নিরাশ্রয় ভবঘুরে পথে পথে ঘুরছে। খবর শুনে সে হাসছে একটু তিক্ত হাসি, ‘অতবড়ো আগুনটা নিকটে এল, তবু গা তো একটু গরম হচ্ছে না!’ স্বামীর মৃতদেহের পাশে বসে রোরুদ্যমানা স্ত্রী হাহাকার করছে, ‘আসুক! আসুক! আগুনের গ্রহ চলে আসুক তাড়াতাড়ি, পুড়ে মরে সকল জ্বালা জুড়োই!’

সেদিন শেষরাত্রির দিকে দ্বিতীয় বার দেখা দিল ওই নতুন গ্রহ। এবার আরও ভাস্বর, আরও চোখধাঁধানো। গণিতের অধ্যাপক নিজের ঘরে খিল এঁটে হিসাব কষছিলেন। আজ চার রাত্রি ক্রমাগতই কষছেন। টেবিলের উপর একটা শিশিতে ঘুমনিবারক ওষুধ। চারদিন চাররাত চোখ বোজেননি ভদ্রলোক। দিনের বেলায় ছাত্রদের সমুখে দাঁড়িয়ে যথারীতি বক্তৃতা দিয়েছেন। বক্তৃতা শেষ হলেই এসে ঢুকেছেন এই ঘরে, নতুন করে শুরু করেছেন হিসাব। এইভাবে তপস্যা করে চলেছেন ডক্টর বোনার্ড, বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞ; রহস্যময় এই অশুভ গ্রহের স্বরূপ উদঘাটনের জন্য।

সে রাত্রেও সেই তপস্যায় তিনি মগ্ন রয়েছেন। হঠাৎ কী যেন মনে করে তিনি উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে, জানালার কাছে গিয়ে খুলে দিলেন তার কবাট। ছাদের পরে ছাদ দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত তাঁর সমুখে, মাঝে মাঝে তা থেকে উঁচু হয়ে উঠেছে এখানে একটা চিমনি, ওখানে একটা গির্জার চূড়া। আর সবাইয়েরই মাথার উপরে ঝুলে রয়েছে সেই অশুভ নক্ষত্র, অন্য সব জ্যোতিষ্ককে আবছা আঁধারের ভিতর কোণঠাসা করে দিয়ে।

দ্বন্দ্বযুদ্ধের আগে মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখের দিকে তাকাত যেভাবে আগেকার কালে, সেইভাবে নক্ষত্রটার দিকে তাকালেন অধ্যাপক, বিড়বিড় করে বললেন, ‘তুমি আমাকে হত্যা করবে হয়তো, কিন্তু তোমার জীবনরহস্য তুমি গোপন রাখতে পারবে না আমার কাছ থেকে। তোমার সব কিছু আমি গেঁথে ফেলেছি এই মস্তিষ্কের ভিতরে।’

সেদিন ক্লাসে গিয়ে তিনি ছাত্রদের সম্বোধন করে বললেন, ‘বৎসগণ! পড়াশুনোর ব্যাপারে যা-কিছু পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা, সবই হয়তো বাজে হয়ে গেল। এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা ঘটবার কোনো সম্ভাবনা আগে বোঝা যায়নি, যা রুখবার কোনো উপায় আমাদের জানা নেই। আশঙ্কা হচ্ছে, মানবজাতির এতদিন টিকে থাকাটা বুঝি একান্তই বৃথা হল। নিষ্ফল হল তার এতখানি প্রগতি, শাখায় শাখায় সম্প্রসারিত এই সুমহান সভ্যতা।’

তারপর তিনি প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিলেন এই ব্যর্থতা আর এই নিস্ফলতার হেতু। ছাত্রেরাও বুঝল।

সে-রাত্রে নক্ষত্রটা উঠল দেরিতে। কারণ এর পূর্বমুখী গতি একে সিংহরাশির আওতায় নিয়ে ফেলেছে। সেখান থেকে চলে যাচ্ছে কন্যারাশিতে। ফলে এর ভাস্বরতা এত বেড়ে গিয়েছে যে উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সারা আকাশকে এ জ্যোতির্ময় করে তুলেছে একেবারে, অন্য সব নভশ্চরেরা বিলীন হয়ে গিয়েছে সেই জ্যোতির্মালায়, সবাই; একমাত্র বৃহস্পতি, লুব্ধক আর সপ্তর্ষিমণ্ডলের দুই-একটি নক্ষত্র ছাড়া।

নক্ষত্রটাকে দেখাচ্ছে অত্যন্ত সাদা, যদিও পৃথিবীর কোনো কোনো অংশ থেকে এর চারপাশে একটা ফিকে জ্যোতির্মণ্ডল দেখতে পাচ্ছে লোকে। আকার এর আরও বড়ো হয়েছে আজ, পূর্ণচন্দ্রের সিকি-পরিমাণ প্রায়। নিদাঘের উজ্জ্বল চন্দ্রালোকের মতো এ সারা পৃথিবী আলোকিত করে তুলেছে, সে-আলোকে ছাপা হরফ অনায়াসে পড়তে পারা যায়।

সারা পৃথিবী জেগেও আছে সে-রাত্রে। গির্জায় গির্জায় ঘণ্টা বাজছে থেকে থেকে, ধর্মনিষ্ঠদের ডেকে ডেকে বলছে, ‘ভগবানের শরণ নাও। শেষ দিন সমাগত, রোজ কেয়ামত। এ-সময় তিনি ছাড়া ত্রাতা আর কেউ নেই।’

ইউরোপ আজ রাত্রে বিনিদ্র। পাহাড়মুখী সমস্ত রাজপথ জনাকীর্ণ। আকাশের আলো তো আছেই, তা ছাড়াও আঞ্চলিক পৌরশাসকেরা বিশেষভাবে আলোর ব্যবস্থা করেছেন ওইসব রাস্তায়, কারণ সমতলের লোক কাতারে কাতারে ছুটেছে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেবার জন্য।

‘পালাও, পালাও’ রব চারিদিকে। রেডিয়োতে বিশেষ বার্তা ডক্টর বোনার্ডের নাম দিয়ে। বার্তাটা এই যে, নতুন এই নক্ষত্র আর নেপচুন, দুইয়ে মিলে একটামাত্র জ্যোতিষ্কে পরিণত হয়েছে এক মহাসংঘাতের ফলে; আর সেই জ্বালাময় জ্যোতিষ্ক সূর্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য ক্ষ্যাপার মতো ছুটে চলেছে, সেকেন্ডে শতাধিক মাইল বেগে। সে বেগ ক্রমেই বাড়ছে, বাড়তে বাড়তে যে কোথায় পৌঁছোবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।

যেভাবে ছুটেছে গ্রহটা, সেভাবেই যদি বরাবর ছুটতে পারে সূর্য পর্যন্ত, তাহলে আমাদের এই পৃথিবীতে খুব বেশি উৎপাত ওর দরুন ঘটবার কথা নয়। কারণ সেক্ষেত্রে কোনো সময়েই ও পৃথিবীর এক-শো মিলিয়ন মাইলের মধ্যে আসবে না। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, সেই নির্দিষ্ট গতিপথই যে ও আঁকড়ে থাকতে পারবে, তার সম্ভাবনা খুব কম। না পারবার কারণ হল জুপিটার, গ্রহরাজ বৃহস্পতি। সে তার কতিপয় চন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে যে-কক্ষপথে সূর্য প্রদক্ষিণ করে চলেছে, নবাগত ওই গ্রহকে তা অতিক্রম করে যেতে হবে, সূর্যে পৌঁছোতে হলে।

আর সেই অতিক্রমণের সময়টাই হবে সংকটের সময়। বৃহস্পতির একটা প্রচণ্ড আকর্ষণ রয়েছে। তাইতেই পথভ্রংশ ঘটবে এই নবাগতের। সোজা পথ ছেড়ে সে ছিটকে পড়বে পৃথিবীর দিকে। পৃথিবীর উপরেই এসে হুমড়ি খেয়ে না-পড়ুক, অন্তত কানের কাছ ঘেঁষে যে বেরিয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আর সেই অতি-সান্নিধ্যের ফল? ভূমিকম্প হবে পৃথিবীতে, বিস্ফোরণ হবে আগ্নেয়গিরি থেকে, সাইক্লোন, সমুদ্রে সমুদ্রে তরঙ্গোচ্ছ্বাস এবং প্রলয় বন্যা। আর সেইসঙ্গে উত্তাপ বেড়ে যাবে বায়ুমণ্ডলের, সে বৃদ্ধির শেষসীমা যে কোথায়, তা বলা যায় না।

উত্তাপ? সেইদিক দিয়েই ডক্টর বোনার্ডের ভবিষ্যদবাণী ফলে গেল সর্বপ্রথম। রাত্রিতে এমন গরম পড়ল যে জানুয়ারির তুষার-আস্তরণ গলতে আরম্ভ হল মাটির বুক থেকে।

গ্রহটা বাড়ছে আয়তনে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়ে যাচ্ছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যগগনের দিকে। উজ্জ্বল থেকে হয়ে উঠছে উজ্জ্বলতর। আগে ছিল চাঁদের সিকি-পরিমাণ, ক্রমে সে এখন তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আকারের চাইতে দীপ্তিই বৃদ্ধি পাচ্ছে অনেক বেশি পরিমাণে। রাত্রিকে ও করে তুলেছে দিনের মতো আলোকিত।

আমেরিকার লোক ওকে দেখল আরও বড়ো, আরও উজ্জ্বল, আরও গরম। ওর উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা গরম ঝড় বইতে লাগল ওদিকে ভার্জিনিয়া থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত, এদিকে সেন্ট লরেন্সের বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মেঘের গর্জন, বেগুনে বিদ্যুতের ঝিলিক, অভূতপূর্ব শিলাবৃষ্টি। ম্যানিটোবাতে বান এল দুর্বার বেগে, ভেসে গেল নগর গ্রাম।

পৃথিবীর যেখানে যত গিরিশিখরে পুঞ্জীভূত বরফ ছিল, সব গলতে শুরু করল সেই রাত্রে। জলস্রোত নামতে লাগল সমতল ভূমিতে, নদীতে নদীতে ডাকল বান, সমুদ্র থেকে এল উত্তাল তরঙ্গ, উপকূলবর্তী প্রত্যেক দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল হল প্লাবিত। চীনে, জাপানে, জাভায় একই অবস্থা। ব্রহ্মে ও ভারতে ঢল নামছে হিমালয়চূড়া থেকে, সমগ্র উত্তর ভারত জলের তলায়।

গ্রহটা আরও বড়ো হয়ে উঠছে, সূর্যের চাতেও বড়ো— সূর্যের চাইতেও গরম। উষ্ণমণ্ডলের সমুদ্রে ফসফোরাসের দ্যুতি আর দেখা যায় না, আকাশের আলো তার চেয়ে অনেক উজ্জ্বল। কালো কালো ঢেউ থেকে ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে, জাহাজে জাহাজে নাবিকদের শ্বাসরোধ হয়ে আসছে সেই ধোঁয়ায়।

আকাশে চাঁদ উঠছে, সে-চাঁদ কালো। সে এসে কিন্তু অনেকখানি বাঁচিয়ে দিল অভাগা পৃথিবীকে। সর্বনাশা গ্রহটার পূর্ণ দৃষ্টি থেকে তাকে আড়াল করে ফেলল। মানুষ তখন সমবেত কণ্ঠে তারস্বরে ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছে চাঁদের এই অনুকম্পাটুকুর জন্য। আর সেই মুহূর্তেই পুব দিক থেকে আকাশে লাফিয়ে উঠল সূর্য, একটা যেন লড়াই বেধে গেল সূর্যে আর গ্রহে, মধ্যগগনে জ্বলতে লাগল ওদের মিলিত উজ্জ্বলতার প্রলয়ানল। চাঁদকে আর দেখা যাচ্ছে না ওই আলোর সমারোহের মাঝে।

সূর্যমুখী অভিযানে আবার ছুটে চলেছে গ্রহটা। পৃথিবীর অতি নিকটেই ও এসেছিল। পৃথিবী আর ও পরস্পরকে প্রদক্ষিণও করেছিল কয়েক বার। কিন্তু সর্বরক্ষা, দুটোতে সংঘর্ষ ঘটতে পারেনি। ঘটলে পৃথিবীর হয়তো ধ্বংসই হত।

যা ঘটেছে, তা সর্বধ্বংস না-হলেও খণ্ডপ্রলয়। আর সে প্রলয়ের এখনও শেষ হয়নি। শেষ পর্যায়ে নামল বৃষ্টি। অবিরাম, মুষলধার, হাতির শুঁড়ের মতো মোটা ধারায় মহাবর্ষণ। তা হোক, জলের তলা থেকে মাটি আবার দেখা দেবে একদিন, মানুষের নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা নেই এ থেকে। গ্রহটা অল্পের জন্য রেহাই দিয়ে গিয়েছে তাদের।

মঙ্গল গ্রহের জ্যোতির্বিদেরা কিন্তু অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছে ঘটনাটার। হ্যাঁ, মঙ্গলেও জ্যোতির্বিদ আছে, যদিও মানুষের থেকে অন্য ধরনের প্রাণী তারা, ডক্টর বোনার্ডের চেয়েও তাদের খ্যাতি বেশি, যদিও সে-খ্যাতি স্বভাবতই মঙ্গলের ভিতরেই সীমাবদ্ধ।

তাদের ব্যাখ্যা এইরকম— নেপচুনের ওপাশে যে দুই কোটি মিলিয়ন মাইলব্যাপী বহিরাকাশ, তারও ওপার থেকে একটা বহ্নিময় ক্ষেপণাস্ত্র এসেছিল পৃথিবীকে বিধ্বস্ত করবার জন্য। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে পৃথিবী। তবে পরের বার হয়তো বাঁচবে না। ওপারের শত্রু পৃথিবীকে ঘায়েল না-করে ছাড়বে না।

কারা সে শত্রু, কেন পৃথিবীর উপর জাতক্রোধ তাদের, মঙ্গলের জ্যোতির্বিদেরা তা খুলে বলেনি। ডক্টর বোনার্ড গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ও-সম্পর্কে। কিন্তু গবেষণার কোনো ধার না-ধেরে বুড়ো সিমসন এখনও বলে যাচ্ছেন ‘নক্ষত্র হোক, ক্ষেপণাস্ত্র হোক, লন্ডনের ওতে কিছু হবে না। হুঁ-হুঁ, লন্ডন অত পলকা জিনিস নয়! নেপোলিয়ানও দন্তস্ফুট করতে পারেননি এখানে।’