সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৫. অশরীরী ঈগল

অশরীরী ঈগল

নবাবি আমল থেকেই ওঁদের রাজা খেতাব, ওই জটাইগড়ের রায় সিংহদের। কবে কে দিয়েছিলেন এ-খেতাব, কোনো কুলজি বা নামচা থেকে তার হদিশ মেলে না। দিয়েছে হয়তো প্রজারাই, লক্ষ লোকের অন্তর থেকে যার উদ্দেশে সাধুবাদ উৎসারিত হয় আপনা থেকেই সেই লোকই তো সত্যিকার রাজা বা সত্যিকার মহাত্মা।

তা স্বীকার করতেই হবে যে জটাইগড়ের রায় সিংহরা সাধুবাদের যোগ্য ছিলেন সেদিনে। পুরুষানুক্রমে অনেকগুলি দিকপাল ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল ও-বংশে, জনে জনে যাঁরা ছিলেন অতি উঁচুদরের মানুষ। ধর্মনিষ্ঠা আর কর্মশক্তি, তেজস্বিতা আর মহানুভবতা— আশ্চর্যভাবে মিশে গিয়েছিল তাঁদের চরিত্রে।

পার হয়ে গেল নবাবি আমল, দেশে চালু হল আংরেজি শাসন। জটাইগড়ের মর্যাদা আর প্রতিপত্তি এতটুকুও ক্ষুণ্ণ হয়নি সেই নতুন যুগে। তারপর সেই নতুন যুগও পুরোনো হল। কালস্রোতের ভাটির টান ইংরেজ রাজকে ঠেলে নিয়ে নিক্ষেপ করল বিলুপ্তির সমুদ্রে, জটাইগড়ের চূড়ায় সগৌরবে উড়ল স্বাধীন ভারতের তেরঙা পতাকা।

প্রৌঢ় রাজা সুজয় সিংহের কী আনন্দ সেদিন! সারা জমিদারির লোককে ডেকে নতুন বস্ত্র বিতরণ করলেন। দীয়তাং ভুজ্যতাং রবে মুখর হয়ে উঠল জটাইগড়ের প্রাচীন পুরী। ‘আট-শো বছরের পরাধীনতার পরে আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি। আজ সবাই মিলে আনন্দ করি এসো।’ —রাজার কথা শেষ হতে-না-হতে তুমুল জয়ধ্বনিতে দশদিক পূর্ণ হয়ে গেল— ‘জয় স্বাধীন ভারতের জয়, জয় সুজয় রাজার জয়।’

কিন্তু সুজয় রাজার ব্যক্তিগত আনন্দ যত বেশিই হোক, দুর্দিনের কৃষ্ণপক্ষ ক্রমশ ঘনিয়ে এল জটাইগড়কে ঘিরে। সাধারণ মানুষের মুখ চেয়ে সরকার জমিদারি প্রথার করলেন বিলোপ। অন্য পাঁচজন জমিদারের মতো সুজয় রাজা কিন্তু প্রতিবাদ করেননি এতে। ‘ভালোই তো! জমি তারই হওয়া উচিত, যে তাতে লাঙ্গল দেবে। ঠিক কথাই তো!’

দেওয়ান ত্রিলোচন বললেন— ‘কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু জমিদারি গেলে আপনার চলবে কীসে? এত শতাব্দীর মান সম্ভ্রম, রাজকীয় ঠাট বজায় রাখবেন কেমন করে?’

‘বজায় রাখার দরকার কী?’ জবাব দিলেন সুজয় রাজা— ‘আমরা তো ছিলাম পরগাছা। শতকরা দু-জন জমিদার হয়তো প্রজার ভালোর জন্য কিছু কিঞ্চিৎ চেষ্টা করেছি, বাদবাকি আটানব্বই জন নিজেদের শৌখিনতা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর চিন্তাকে মনেও ঠাঁই দিইনি। তা ছাড়া, আমার চলবার ভাবনা কী দেওয়ান? নিঃসন্তান, স্ত্রী গত হয়েছেন বহুকাল আগে। একা মানুষ, বয়েস পঞ্চাশ প্রায়। এ-বয়সে আগে লোকে বনে যেত। আমি হয়তো বনে আর যাব না, তবে জটাইগড় যদি বন হয়ে ওঠে পয়সার অভাবে, তাতে খুব বেশি অসুবিধা আমি বোধ করব না, দেখো—’

জমিদারি গেল, সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে এই আশা এখন ভূতপূর্ব ভূস্বামীদের। যাঁরা সঞ্চয়ী লোক, দু-পয়সা জমিয়ে রেখেছেন আগে থেকে, তাঁরা সেই ভরসার পুঁজি ভেঙে ঠাট বজায় রাখছেন আপাতত। কিন্তু যাঁরা তা রাখেননি, তাঁরা চোখে দেখছেন সরষে ফুল। উঠে-পড়ে লেগেছেন আইনসভায় ঢুকবার জন্য। অন্তত আড়াই-শো টাকা মাসোহারা তো আছে সেখানে।

টাকা জমিয়ে সুজয় রাজাও রাখেননি। বিলাসিতা তাঁর কোনোদিন ছিল না, শখ বলতে একমাত্র ছিল লোক খাওয়ানোর শখ, পূজাপার্বন উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষকে ষোড়শ ব্যঞ্জনে খাইয়েছেন। তা ছাড়া দান-ধ্যান, সেটা তো আর শখ নয়, সেটা কর্তব্য। পয়সা যতদিন ছিল, কর্তব্যবোধেই করতে হয়েছে ওসব।

যেভাবেই হোক, জমিদারি যখন গেল— সুজয় রাজা তখন দেখলেন যে তিনি দেউলে। থাকার মধ্যে সাত-শো বছরের পুরোনো গড়বন্দি রাজবাড়ি, এই জটাইগড়। আর সেই বাড়িরই খবরদারির জন্য এক পলটন চাকর-বাকর। বাড়িটা ঝাড়পোঁছ করবার জন্যই পঞ্চাশটা লোক দরকার। বিরাট বাগান রয়েছে, সেখানে মালি কয়েক ডজন, বিশাল গোয়ালবাড়ি রয়েছে, সেখানে রাখালে গয়লাতে দোহালে মিলিয়ে আরও কয়েক ডজন, পাচকে ভৃত্যে দারোয়ানে সান্ত্রীতে মিলিয়ে—

যাকগে, সে এক সুদীর্ঘ ফর্দ। জমিদারি চলে যাচ্ছে শুনেই দেওয়ান ত্রিলোচন ছাঁটাই করতে চেয়েছিলেন বারো আনা আন্দাজ লোক। কেউ যায়নি, রাজার কাছে এসে কেঁদে পড়েছিল— ‘আমরা কোথাও যাব না, মাইনে পাই না পাই, এক বেলা খেয়ে থাকব, সেও ভালো। কিন্তু সুজয় রাজার চাকরি করার পরে আর কাউকে মনিব বলে ভাবতে পারব না—’

রাজার চোখ ছলছল করতে লাগল। কিন্তু সত্যি সত্যিই এদের রেখে দেওয়া চলে না। বলছে বটে যে ওরা এক বেলা খাবে, কিন্তু সেভাবে তো আর সত্যিই বেশিদিন বাঁচে না মানুষ। তা ছাড়া এক বেলার সেই খোরাক, তাই বা জোগাবে কে?

অনেকের আবার ঘর-সংসারও আছে তো! নিজে না খাক, কাচ্চা-বাচ্চাকে তো খাওয়াতে হবেই। না, না, জটাইগড়ের মাটিতে রস নেই আর, ও মাটি কামড়ে থাকার মানেই হল ঝাড়ে বংশে শুকিয়ে থাকা।

কিন্তু ওটা একটা কথা বটে, ওই যে ওরা বলছে যে রাজবাড়ির চাকরি ছেড়ে অন্য মনিবের কাছে ওরা কখনোই কাজ করতে পারবে না, এটা ঠিক কথা ওদের। রাজবাড়ির চাকরি ছিল আয়েসের এবং পয়সার চাকরি। এ চাকরি যারা দীর্ঘদিন করেছে, অন্য জায়গায় গিয়ে আধা কড়িতে হাড়ভাঙা খাটুনি তারা বাস্তবিকই করতে পারবে না। করতে বাধ্য যদি করেন সুজয় রাজা, সেটা হবে নিষ্ঠুরতা। সেটা হবে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়া।

না, তা করতে পারেন না সুজয় রাজা। তাঁর বংশের ধারা সে শিক্ষা তাঁকে দেয়নি। নিজের পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে একটা লোকেরও অন্ন মারেননি তিনি, দোষ-ঘাট করলেও না। আজ, জমিদারি যদিও নেই, সে স্বভাব তাঁর এখনও রয়েছে। অন্ন মারবেন না, ‘দরকার নেই’ বলে তাড়িয়ে দেবেন না কাউকে।

তবে? কী তিনি করবেন?

ভেবে ভেবে উপায় একটা অবশেষে বার করলেন রাজা। দেওয়ানকে ঘুণাক্ষরে বললেন না কী তাঁর মতলব। একদিন তিনি হঠাৎ চলে গেলেন বাইরে। গিয়ে হাজির হলেন এস্টেটের পুরোনো উকিল কামাখ্যাবাবুর বাড়িতে। কয়েক মিনিট পরে সেখানেই তাঁর সঙ্গে মিলিত হল ভূঁইফোড় পোদ্দার।

আসল নাম তার কী, তা সাধারণে বহুদিন হল ভুলেছে। সম্ভবত সে নিজেও চট করে তা মনে করতে পারবে না। সে জানে, বেশ ভালো রকমেই জানে যে জনসাধারণের তরফ থেকে সে একটা আশ্চর্য খেতাব পেয়েছে ‘ভূঁইফোড়’, যেমন একদা জটাইগড়ের জমিদারেরা উপাধি পেয়েছিলেন ‘রাজা’। অন্য কেউ হলে হয়তো এই ভূঁইফোড় খেতাবে রেগে যেতে পারত।

কিন্তু পোদ্দারের সঙ্গে অন্য সবাইয়ের ওইখানেই তফাত। সে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করল শব্দটার মৌলিক অর্থের উপরে। ভূঁই ফুড়ে সে উঠেছে। নিজের শক্তিতে। স্বয়ম্ভূ সে, মহাদেবের মতো। মহাদেব বিষ ধারণ করেছিলেন কণ্ঠে, পোদ্দারও না হয় ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য সহ্য করবে খানিকটা। লোকে যে তার পৌরুষকে স্বীকার করে নিয়েছে ভূঁইফোড় খেতাব দিয়ে, তাতেই সে খুশি।

পৌরুষ? তা ছাড়া একে আর কী বলতে পারে লোকে? ছিল ভিখারি বালক, পঞ্চাশের মন্বন্তরে পথে পথে ফ্যান ভিক্ষা করেছে। বাপ মরেছে, মা মরেছে, ভাই-বোনেরা মরেছে। ওর সামনেই মরেছে, ফুটপাতে ওর পাশে শুয়েই। অনাহারে ছটফট করতে করতে মরেছে কেউ, কেউ-বা কুখাদ্য খাওয়ার ফলে কলেরা হয়ে। সবাই মরেছে, ও বেঁচে গিয়েছে কেমন করে যেন।

তারপর ঘুরল চাকা। এক ভিখিরি সে-দিন চোখ বুজল। ঠিক সেই সময়টায় আর কেউ ছিল না সেখানে, ওই পোদ্দার ছাড়া। মানুষটার দেহে আর প্রাণ নেই বুঝতে পেরেই পোদ্দার তার কোমরটা হাতড়াল এক বার। যা আশা করেছিল, পেল তা। বেশি না, গোটা-বারো টাকা।

ব্যাস, চাকা বনবন করে ঘুরল। বারো টাকা মূলধন নিয়ে যে বালক সে-দিন ফল-ফুলুরি ফিরি করতে লেগে গিয়েছিল, আজ সে বহু লক্ষ টাকার মালিক। ওই পঁচিশ বছর সময়ের মধ্যে সে কি না করেছে? ফিরিওয়ালা, যা-লেবে-তাই-ছয় আনা-ওয়ালা, মাংস বেচনে-ওয়ালা, পাঁঠায়-কুকুরে ভেজাল দিয়ে ছয় মাস এই ব্যবসা চালানোর ফলেই সে পাকা বুনিয়াদ গেঁথে ফেলল নিজের ভবিষ্যতের। তারপর মাছের আড়ত, খোঁয়াড়ের ইজারা, চিনির কালোবাজার, ধাপে ধাপে উর্দ্ধগামী পোদ্দার আজ কত যে ছোটো-বড়ো চোরাগোপ্তা কারবারের মালিক বা অংশীদার, তা ‘বর্ণিলে জীবনকাল না ফুরাবে তবু।’

জটাইগড়ের মাইল সাতেক তফাতে ওই যে বাঁধটা ইদানীং বাঁধা হচ্ছে নারাঙ্গি নদীতে, ওর ঠিকাদারকে টাকা জোগান দিচ্ছে এই পোদ্দারই। বখরা আধা-আধি। গাঁথুনিটা একটা বছর খাড়া রাখতে হলে একবস্তা সিমেন্টে কত বস্তা পর্যন্ত মাটি নিরাপদে মেশানো যায়, তারই পরামর্শ দেওয়ার জন্য পোদ্দার সশরীরে হাজির হয়েছিল নারাঙ্গি ক্যাম্পে। ওসব বিষয়ে সে রীতিমতো বিশষজ্ঞ একটি।

জটাইগড়ের রাজা দৈন্য দশায় পড়েছেন, এ-খবর তো এখন এ-অঞ্চলে সবাই জানে।

ভূঁইফোড় পোদ্দার নারাঙ্গিতে এসেই আঁচ পেল অবস্থাটার। দাঁওয়ের গন্ধ পেয়ে সে দালাল পাঠাল গোপনে। দালাল গিয়ে রাজার কাছে নিবেদন করল—

নিবেদনটা সঙ্গিন সময়েই এসে পৌঁছালো। রাজা তখন তাঁর ভৃত্য পটনের ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে পাগলের মতো।

সেই নিবেদনের ফলেই শহরে রাজা ও পোদ্দারের যুগপৎ আগমন এবং কামাখ্যা উকিলের বাড়িতে সাক্ষাৎ পরিচয়।

কামাখ্যা উকিল এস্টেটের শুভানুধ্যায়ী, রাজার ব্যক্তিগত বন্ধু। তিনি মাথা খুঁড়তে লাগলেন— ‘রাজা। এ কাজ করো না। এ মর্টগেজ কোনো মতেই খালাস করা যাবে না। জটাইগড় ওই পোদ্দারের উদরে যাবে—’

রাজা বললেন— ‘নিতান্তই যায় যদি, কী হয়েছে তাতে? ‘যদুপতে ক্ক গতা রাজা মথুরাপুরী?’ যাক জটাইগড়। যদি যাওয়ার সময়ও কতকগুলো গরিবের কিছু উপকার করে যেতে পারে, তবে জানব জটায়ু বাবার আশীর্বাদ সার্থক হয়েছে।’

কামাখ্যার কোনো যুক্তি, কোনো মিনতি টলাতে পারল না সুজয় রাজাকে। তিনি ভূঁইফোড় পোদ্দারের কাছে লক্ষ টাকা ধার করলেন জটাইগড় রেহান রেখে। চেক লিখে দিয়ে দলিল পকেটে পুরে ভূঁইফোড় কলকাতায় চলে গেল, নারাঙ্গির বাঁধের কাজ সে শহরে আসার আগেই শেষ করে এসেছিল।

রাজা সেই লক্ষ টাকা নিজের কর্মচারী ও ভৃত্যদের মধ্যে সমানভাগে বিলিয়ে দিলেন। দেওয়ানও যত টাকা, ঝাড়ুদারও তত টাকা। দেওয়ান অবশ্য নিলেন না সে অর্থ। চোখের জল ফেলতে ফেলতে জটাইগড় ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের মতো। করবার মতো কাজ সেখানে তাঁর কিছুই ছিল না, অনেক আগেই যেতে পারতেন, আটকে ছিলেন শুধু রাজার মায়ায়।

চলে গেল বেশিরভাগ লোকই। রাজার দান মূলধন করে তারা কেউ ব্যবসা করবে, কেউ করবে কৃষিকর্ম। ‘রাজার চাকরি করবার পরে অন্য লোকের চাকরি আর করতে পারবে না’— বলেছিল তারা। যাতে তা না করতে হয়। তার উপায় রাজাই করে দিলেন।

অল্প কিছু লোক জটাইগড়ে রয়ে গেল, আপন ইচ্ছাতেই। রাজার শেষ বয়সে রাজাকে ছেড়ে যাবে না তারা। পাচক রঘুরাম, সর্দার খানসামা নিকুচাঁদ, জনা পাঁচ ছয় মালি— এইরকম কিছু কিছু লোক। তারা রাজার কাছে রয়েছে কেউ ত্রিশ বছর, কেউ চল্লিশ বছর। কেউ রাজার সমবয়সি, কেউ বা আরও কিছু বড়ো। এরা ঘরগুলো বাসযোগ্য রাখবে, বাগানটা পরিষ্কার রাখবে, রাজাকে দুটো রেঁধে খাওয়াবে— এইরকম আর কী—

খাবে কী এরা? রাজার টাকাই লগ্নি খাটিয়েছে চাষিদের ভিতরে। তারই সুদ থেকে এরা উদরান্নের সংস্থান করবে। রাজার উপরে আর চাপ দেবে না প্রাণান্তেও। রাজা যে এখন তাদের চেয়েও নিঃস্ব, তা তারা জানে। ও-কথা যদি কখনো ওঠে তাদের মধ্যে, তারা জনে জনে কপালে করাঘাত করে আর বলে—

‘দারুণ রাহু এমন চাঁদেরেও হানে!

লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর বাহু,

চাহে না ধর্মের পানে।’

‘বলী’ বলতে অবশ্য তারা এখানে ভূঁইফোড় পোদ্দারকেই বোঝে, কুবুদ্ধির বলও তো একরকম বল!

* * *

যায় কয়েক বছর। জটাইগড় যেন নিঝুমপুরী। গড়খাই পরিখার উপরে সাঁকোটা এখনও আছে, কিন্তু ওর দুই পাশের লোহার রেলিং পড়ে গিয়েছে জলে। সিং দরওয়াজায় সান্ত্রি নেই আগের মতো। যে খুশি, সোজা ভিতরে চলে যেতে পারে; ঠেললেই লোহার কবাট ঘট-ঘটাং আওয়াজে একটু একটু করে খুলে যাবে।

দরওয়াজা পেরুলেই সমুখে চওড়া রাস্তা, আগে তাতে পরিপাটি করে সুরকি বিছানো থাকত, এখন সুরকির বালাই নেই, নীচের খোয়া জেগে উঠে উঁচু-নীচুর জাফরি রচনা করেছে মাটির বুকে। আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে গজিয়েছে ঘাস আর আগাছা। রামাদিন মালিরা সাধ্যমতো সেগুলোকে টেনে টেনে ওপড়ায় অবশ্য। কিন্তু তারাও বুড়ো হয়েছে, তাদের সাধ্যের পরিধি খুব বিস্তীর্ণ নয়।

উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এক-শো বিঘে জমির উপরে এই বাড়ি। বাড়িতে আর কতটাই বা জমি নিয়েছে, বেশিরভাগ জায়গাই বন আর বাগান। বাগানে আগে দেশি বিদেশি ফুলের সমারোহ বারো মাস সমানভাবে লেগে থাকত, এখন সেখানে বুকসমান জঙ্গল।

রাজা ঘর থেকেই বেরোন না। বেরুবার শক্তি নেই। জটাইগড় রেহান দিয়ে আসবার পরই তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। কামাখ্যাবাবু অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে দার্জিলিং বা পুরী পাঠাতে পারেননি হাওয়া বদলের জন্য। দুই জায়গাতেই নিজের বাড়ি আছে কামাখ্যার। যতদিন দরকার, রাজার ব্যবহারের জন্য সে বাড়ি তিনি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন।

না, কোথাও যাবেন না রাজা। ‘বৃন্দাবনং পরিত্যজ্য পাদমেকং ন গচ্ছামি’। ‘জটাইগড় থেকে এক পাও নড়ব না। শেষ নিশ্বাস এখানেই পড়বে। ওই রঘুরাম, নিকুচাঁদ, রামদিনরাই সৎকার করবে ওই পরিখার ধারেই। ব্যাস, নিশ্চিন্দি! জটাইগড়ের রাজগি খতম।’

কোথাও যাবেন না। ঘর আর ছাদ। ছাদ আর ঘর। বিশাল পুরীর উত্তর অংশটা পাঠান-মোগল আমলের কেল্লার কায়দায় তৈরি, এখনও তাদের গায়ে গায়ে কামান বসানো আছে, বাঙালি কামারের হাতে-গড়া দলমাদল ধাঁচের কামান।

তা সে কেল্লা এখন বড়ো বড়ো তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সুজয় রাজার কোন এক অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ কেল্লার দক্ষিণ গায়ে বিলিতি ফ্যাশানের বৃহৎ এক হর্ম্য গড়ে ছিলেন— আধুনিক প্রথায় জীবনযাপনের জন্য। এই হর্ম্যমালারই একাংশে এখন সুজয় রাজা বাস করেন, এইটুকুই কায়ক্লেশে পরিচ্ছন্ন রেখে চলেছে তাঁর ভক্ত স্বেচ্ছাসেবকেরা।

শরীর ক্রমেই অচল, রাজা বিছানাতেই কাটান বেশিরভাগ সময়। বয়স এখনও ষাট হয়নি তাঁর, এরই মধ্যে অথর্ব হয়ে পড়েছেন, হঠাৎ দেখলে মনে হবে অশীতিপর বৃদ্ধ বুঝি-বা। কামাখ্যাবাবু মাসে দুইবার ডাক্তার পাঠিয়ে দেন শহর থেকে, সে ডাক্তার শহরে গিয়ে রিপোর্ট দেয়— ‘আর বেশি দিন নয়। হার্ট এত দুর্বল— যেকোনো একটা শক্ত ধাক্কা খেলে তখুনি হয়ে যাবে—’

কামাখ্যাবাবু কথাটা নিকুচাঁদকে জানিয়ে রেখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন— রাজার এতটুকুও উত্তেজনার কারণ ঘটতে পারে, এমন কোনো ব্যাপার যেন তাঁকে জানানো না হয়। নিকুচাঁদ সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে।

এই সময় হঠাৎ একদিন অচেনা এক বাঙালি সাহেব এসে উদয় হলেন জটাইগড়ে। অচেনা অবশ্য নিকুচাঁদদের, রাজা তাকে দেখলেই চিনতেন। এ হ’ল সেই ভূঁইফোড় পোদ্দার, জটাইগড়ের ভবিষ্যৎ মালিক।

পোদ্দারের আগমন শুধু সম্পত্তিটা দেখবার জন্য। টাকার তাগাদা উদ্দেশ্য নয় তার, কারণ শত তাগাদাতেও এক পয়সা যে আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সে-খবর সে ভালোরকমই জানে। টাকার জন্য সে আসেনি, সে ধৈর্য ধারণ করে প্রতীক্ষা করছে— রাজাটা মরবে কবে।

টাকা ধার দেওয়ার সময়ে দলিলটা সে এইভাবে লিখিয়েছিল যে ঋণ শোধ না করে রাজা যদি স্বর্গারোহণ করেন, পোদ্দারকে আর নালিশ-ফরিয়াদের ঝামেলা পোয়াতে হবে না, আদালতে একটা দরখাস্ত দিয়েই সে রেহান সম্পত্তির দখল পেতে পারবে।

সেই ভাবেই সে পেতে চায় দখল। রাজার দেহান্তের আগে দখল পেতে হলে নালিশ ছাড়া উপায় নেই, অথচ নালিশ সে প্রাণান্তেও করবে না। করলে ক্ষতি হতে পারে। জটাইগড় একটা আট-শো বছরের পুরাতন মর্যাদার অধিকারী, এর অনেক রাজা ছিলেন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যোদ্ধা। নালিশ করলে এটা চাপা থাকবে না যে তুচ্ছ দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এমন একটা ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান যাকে জাতীয় গৌরবের ধারক হিসাবে রক্ষা করা উচিত সরকারের পক্ষ থেকে।

কথা এক মিনিটও চাপা থাকবে না, খবরে কাগজে লেখালেখি হবে এ নিয়ে, মনুমেন্টের নীচে সভা হবে, গণ-ডেপুটেশন যাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, দেশের লোক তো হুজুগের গন্ধ পেলেই নেচে ওঠে কি না।

এই সব ঝামেলার ফলে পোদ্দারের পোড়া শোল মাছও হয়তো— শেষপর্যন্ত জলে পালিয়ে যাবে, লগনির তুচ্ছ লক্ষ টাকাটা নিয়েই তাকে হাত ধুয়ে বেরিয়ে আসতে হবে আদালত থেকে। না, নালিশ টালিশ নয়। লোক জানাজানি নয়। নিঃশব্দে হাসিল করতে হবে কাজটা। দখল পাওয়ার আগে যাতে বাইরে প্রচার না হয় কিছু, হুঁশিয়ার হতে হবে সেদিকে। ভূঁইফোড় পোদ্দারের বাড়াভাতে ছাই পড়লে আহ্লাদে আটখানা হবে, এমন পরশ্রীকাতর লোকের অভাব নেই বাংলা দেশে।

সম্পত্তিটা এ-পর্যন্ত ভালো করে দেখারই সুযোগ করতে পারেনি পোদ্দার। অবশ্য দরকারও বোঝেনি কিছু। এর চেয়ে জরুরি কাজ হাজার গণ্ডা আছে তার। এটা তো হাতের মুঠির ভিতর এসেই রয়েছে, ব্যস্ত কী এর জন্য? রাজা মরুক, তখন দেখা যাবে।

কিন্তু সম্প্রতি একটা ওলোট-পালোট এসেছে পোদ্দারের চিন্তাধারায়। বিনা কারণে নয়। খুব সঙ্গত কারণই রয়েছে ওলোট-পালোটের। রেললাইন বসতে যাচ্ছে এই অঞ্চলে। জটাইগড় পড়বে সে লাইনের তিন মাইলের ভিতর। জমির দাম বিশগুণ বেড়ে যাবে। এক লক্ষ মাত্র টাকা দিয়ে যে সম্পত্তি সে আটকে রেখেছিল, তার দাম বিশ লাখ বা তারও উপরে উঠে যাবে। এখন আর ফেলে রাখা চলে না এটা।

জমিগুলো দেখতে হবে। কীভাবে এদের উন্নতি করা যায়, ভাবতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার এনে পরিকল্পনা গড়তে হবে একটা। সময়সাপেক্ষ কাজ। সুতরাং অবিলম্বে হাত দিতে হবে এতে। দু-টো জিনিস মাথায় আছে পোদ্দারের। এক হল কারখানা করা, দুই হল কলোনি করা। কারখানার ঝক্কিঝামেলা অনেক, কলোনি নির্ঝঞ্ঝাট। পোদ্দারের ঝোঁক কলোনির দিকেই।

পোদ্দার এসেছে। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। জটাইগড়ের চারিপাশে পরিখা। এখনও অগাধ জল তাতে। ভ্রূকুটি করে পোদ্দার তাকিয়ে রইল পরিখার পানে। এটা এখানে কীজন্য? সোজা জায়গা মেরেছে নাকি এই অপ্রয়োজনীয় জিনিসটা? সকলের আগে পোদ্দার এই পরিখা বোজাবে।

যাক, সে তো পরের কথা, এখন ওই যে পরিখার উপর পুল, ওর ওপর দিয়ে গাড়ি নেওয়ার চেষ্টা করা নিরাপদ হবে তো? উপরে তো দেখা যায় কাঠেরই পাটাতন। মেরামত হয়েছে কোন মান্ধাতার আমলে কে জানে! গাড়ি চালাতে গেলে যদি ভেঙেই পড়ে? ওরে ব্বাবা!

তা ছাড়া রেলিংও নেই। কোনো কারণে গাড়ি যদি আচমকা ঘুরে গেল, তবেই আর দেখতে হবে না। না, কাজ নেই ওতে। গাড়ি এইখানেই থাকুক, পোদ্দার হেঁটেই জটাইগড়ে ঢুকবে—

ঠেলতে ঠেলতে দরজা একটুখানি খুলে গেল। কোনোরকমে তার ভিতর দিয়ে গলে এবড়োখেবড়ো খোয়ার রাস্তায় পা দিল পোদ্দার। কোথাও একটা মানুষ চোখে পড়ে না। অনেকটা দূরে বড়ো বড়ো গাছগাছালির আড়ালে গড়ের চূড়া দেখা যায়, জটাইগড়— যার ভবিষ্যৎ মালিক এই ভূঁইফোড় পোদ্দার।

রীতিমতো হিংস্র দৃষ্টি এই ভবিষ্যৎ মালিকের চোখে। ‘গড়? দাঁড়াও না বাপু গড়, তোমায় ভেঙে গুঁড়িয়ে সেই রাবিশের পাহাড় দিয়েই ওই পরিখা বোজাব। কোন কর্মে লাগছ তুমি? জায়গা ছাড়ো, তোমার ওখানটায় সারি সারি দুইকামরার একতলা বাড়ি তুলব আমি। এক-শো খানা বাড়ি তুললে মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয়, এই অজপাড়াগাঁয়েতেও।

গড়ের সমুখে গিয়ে কয়েক মিনিট দাঁড়াল পোদ্দার। কেল্লা সে অনেক দেখেছে, পেল্লায় পেল্লায় কেল্লা, যাদের কাছে জটাইগড় ‘নকল বুঁদির’ মতোই খেলো জিনিস। কিন্তু একটা ব্যাপার এই নগন্য কেল্লাতে লক্ষ করছে পোদ্দার, যা অন্য কোথাও সে দেখেনি। গুম্বজে কার্নিশে যেখানে-সেখানে পাথরে গড়া ঈগল পাখি বসানো।

ঈগল পাখি? এ পাখি তো সমতল বাংলার পাখি নয়! হঠাৎ জটাইগড়ের রাজাদের অমন প্রচণ্ড ভক্তি জাগিয়ে উঠল কেন ঈগল পাখির উপরে? আর, কোন দেশের কারিগরই বা গড়েছিলেন ওই পাখিগুলো?’ এত যুগ ঝড় ঝাপটা সহ্য করেও ওরা এখনও অমন নিখুঁত অটুট রয়েছে, এ বড় আশ্চর্য তো!

 ‘আপনি কে?’ —সবিনয়ে প্রশ্ন হল পোদ্দারের পিছন দিক থেকে—

পোদ্দার ঘাড় ফিরিয়ে লক্ষ করল লোকটাকে— জবাব দিল না মোটেই।

নিকুচাঁদ এক এক বার আসে এসব জায়গায়। দুই চার দিন পরে পরে। রাজা যেদিন ওরই মধ্যে একটু ভালো থাকেন, সেইদিন। রাজাই জোর করে পাঠিয়ে দেন বাইরে— ‘তোমার নিজের দেহটাও তো সুস্থ রাখতে হবে। একটু খোলা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে এসো—’

আজ তাই নিকুচাঁদ বেরিয়েছে ঘর থেকে। রঘুরামকে বসিয়ে এসেছে রাজার ঘরের বারান্দায়, যদি রাজা ডাকেন কাউকে, সাড়া দেবে।

আগেকার দিনে জটাইগড়ে সাহেব সুবো অনেক দেখেছে নিকুচাঁদ। পোদ্দারকে দেখে ত্র্যস্ত হওয়ার তার কোনো কারণ নেই। সাধারণ ভদ্রতা হিসাবে যেটুকু বিনয় দেখানোর দরকার, তাই সে দেখিয়েছে।

কিন্তু পোদ্দার যে নেহাতই ভূঁইফোড়! এসব লোক নিজেরা যখন নত হয় বড়োদের কাছে, তখন কত নীচে যে নামছে তার হিসাব রাখে না। আবার নিজেদের চেয়ে ছোটোরা যখন কথা কইতে আসে এদের সঙ্গে, তারা নামতে নামতে মাটিতে সেঁধিয়ে না গেলে আর এরা খুশি হতে পারে না।

এ লোকটা কে? —ভাবছে পোদ্দার, এ লোকটা অবশ্য রাজারই চাকর, যে রাজা নিজে ভূঁইফোড়ের খাতক, যে রাজাকে ইচ্ছে করলে একটি নালিশ ঠুকে দিয়েই সে গলাধাক্কা দিতে পারে এই গড় থেকে। আর এ লোকটা কিনা পিছন থেকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে— ‘আপনি কে?’ অ্যাঁ? স্রেফ আপনি কে? ওই চাকরটা কি সমকক্ষ বিবেচনা করেছে পোদ্দারকে? যে পোদ্দার তার মনিবেরও মনিব? ‘আপনি কে?’ না-একটা হুজুর’, না একটা ‘মালিক’, না-একটা কিছু?

একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে সে হাঁকল— ‘তুমি তো ভয়ানক বেয়াদব হে!’

নিকুচাঁদ! বেচারা নিকুচাঁদ! এমন একদিন ছিল, যেদিন এস্টেটের প্রজারা কোনো প্রার্থনা নিয়ে রাজবাড়িতে এলে নিকুচাঁদকে আগে প্রসন্ন করত সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। সেদিন ওর মর্যাদা ছিল দেওয়ান ত্রিলোচনের চাইতে সামান্যই কম। সে মর্যাদাবোধ দুর্দিন এসেছে বলেই যে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ওর অন্তর থেকে তা নয়।

‘বেয়াদপ?’ —বাঘের মতো গর্জে উঠল নিকুচাঁদ— ‘নিকালো! জটাইগড়ের হাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিকুচাঁদকে বলে বেয়াদব, কোন লাটের ব্যাটা সে? নিকালো!’

ঘাড় ধরেই হয়তো পোদ্দারকে বার করে দিতে যাচ্ছিল নিকুচাঁদ, কিন্তু পোদ্দার ‘আচ্ছা, রাজা মরুক, তারপর দেখাব তোমায়’— এই কথাটা নিকুর পানে দূর থেকে ছুঁড়ে মেরে দ্রুত পিছু হটল।

আর নিকুচাঁদ! —’রাজা মরুক’ শুনে সে তেমনি খেপে গেল, লাল গামছা দেখলে ষাঁড় যেমন খেপে ওঠে— ‘রাজা মরবার আগে তুমি ব্যাটা তিন বার যমের দোর দেখবে— রাজার হয়েছে কী? তিনি দিব্যি আছেন—’

সিং দরওয়াজার দিকে ছুটতে ছুটতে পোদ্দারের কানে কথাগুলো সবই গেল। অপমানের বেদনা তুচ্ছ হয়ে গেল এই জ্বালা ধরানো দুঃসংবাদের তুলনায়। রাজা দিব্যি আছে? রাজা মরবার আগে পোদ্দারকে তিন বার যমের দোর দেখতে হবে? কী সাংঘাতিক কথা।

রাজার বয়স কত, তা মোটামুটি আন্দাজ আছে পোদ্দারের। ষাট বছরের মতো হল আর কী! কিন্তু ওরা সব দুধে ক্ষীরে মানুষ, পোদ্দারের মতো ফ্যান খেয়ে এবং কিছু না খেয়ে মানুষ তো নয়! ডাক্তার বলেছে রক্তের চাপ খুব বেশি পোদ্দারের। ও থেকে কী না হতে পারে! যা বলেছে লোকটা, এমনকী মিথ্যে বলেছে? এমনকী অসম্ভব কথা? এমনটা অনায়াসেই হতে পারে যে রাজা বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল জটাইগড়ে, ওদিকে হঠাৎ মাথা ঘুরে উলটে পড়ল ভূঁইফোড় পোদ্দার, ডাক্তার আসার আগেই পটল তুলল, ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে জমানো বহু বহু লক্ষ টাকাকে বেমালুম ফাঁকি দিয়ে! যাঃ চলে! তাহলে তো সব কিছুই পণ্ড হল।

পোদ্দারের গাড়িও চলেছে, পোদ্দারের মস্তিষ্কও চলেছে। দুটোর গাতিবেগ সমানই। শহরে কামাখ্যা উকিলের দোরগোড়ায় যখন গাড়ি থামল, তখন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা পোদ্দারের নখদপর্ণে এসে গিয়েছে।

গল্পের সাপকে কামড়াতেই নিষেধ করেছিলেন সাধু, ফোঁস করতে নিষেধ করেননি। পোদ্দারও কামড়াবে না, কিন্তু ফোঁস করবে। এমনভাবে ফোঁস করবে, যাতে ভয়ে কেঁচো হয়ে যাবে ওই মফস্ফল আদালতের বুড়ো উকিলটা। পোদ্দারের জানা আছে যে ওর কথাতেই ওঠে বসে সুজয় রাজা। দেখা যাক উকিলকে কিলিয়ে কাজ উদ্ধার করতে পারে কি না পোদ্দার।

বিনা ভূমিকায় পোদ্দার বলল— ‘জটাইগড়ের রেহানের ব্যাপারটা নিয়ে এসেছি, আমায় চিনতে পারছেন না বোধ হয়?’

‘নমস্কার, নমস্কার!’ —ত্র্যস্তে উঠে দাঁড়ান কামাখ্যাবাবু, ‘আসুন, বসুন। আপনি তো মিস্টার পোদ্দার? চিনতে পারব না মানে? বিলক্ষণ।’

চেয়ার একটা টেনে নিল বটে পোদ্দার, তবে তাতে না বসে পা তুলে দিল তাতে একখানা— ‘এখনও তামাদি হয়নি বটে, কিন্তু টাকাটা আমি ফেলে রাখতে পারছি না আর। লোকসান হয়ে যাচ্ছে। আপনার মক্কেল সুদ দেবেন আর কত? ওই টাকাটা নগদ পেলে ওটা খাটিয়ে আমি অনেক, অনেক বেশি রোজগার করতে পারি। বন্ধুভাবে একটা পরামর্শ দেবেন? আপনি তো রাজার পক্ষের উকিল, আপনার সমকক্ষ বা আপনার চেয়ে ভালো উকিল কে আছেন শহরে? যিনি আমার পক্ষ থেকে নালিশটা করে দিতে পারেন? আমি মশাই তৈরি হয়েই এসেছি—’

‘তৈরি হয়ে এসেছেন? নালিশ করতে? বলেন কী?’ কামাখ্যাবাবু হাঁসফাঁস করতে থাকেন, যেন তিনি অথই জলে ডুবে যাচ্ছেন।

‘এক ঘণ্টার ভিতর সুদে আসলে টাকা মিটিয়ে দেন যদি, নালিশের দরকার হবে না, তা যদি না দেন, দুই ঘণ্টার ভিতর আমি নালিশ ঠুকে দেব—’

‘বসুন! বসুন! আপনি অগাধ টাকার মালিক, লক্ষটা টাকার জন্য আপনার কী এসে যাচ্ছে?’

‘আর কিছু এসে যাচ্ছে না, কেবল নিজেকে বেজায় বোকা মনে হচ্ছে। ওই লক্ষ টাকা খেলাতে পারলে এতদিনে কত লক্ষ দাঁড়াত, তাই হিসাব করতে গেলেই— উঃ! আমি মশাই গাড়োল একটা। আমিই একজনকে জানি, বারো টাকা মূলধন নিয়ে ফলফুলুরি ফিরি করতে শুরু করে, শুধু ডান-হাতের টাকা বাঁ-হাত আর বাঁ-হাতের টাকা ডান হাতে ফেরাফেরি করে সে আজ কোটিপতি! আর আমি? এমন গাড়োল আমি যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লক্ষটি টাকা মাত্র সম্বল করেছিলাম, তা ফেলে রাখলাম জটাইগড়ের ভাঙা কেল্লায়— উঃ, গাড়োল ছাড়া নিজেকে আর কিছুই বলতে পারি না আমি—’

কামাখ্যাবাবু হাত কচলান আর বলেন— ‘সময় দিন! সময় দিন! আপনি যদি নালিশ করেন, সে আঘাত রাজা সইতে পারবেন না। লজ্জাতেই মারা যাবেন তিনি। হার্ট তাঁর দুর্বল! সাংঘাতিক দুর্বল!’

‘হার্টের কথা যদি বলেন, আমারও হার্ট ভয়ানক দুর্বল। আসতে আসতেই গাড়িতে বসে ভাবছিলাম— দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ডাক্তার বারনার্ডকে দিয়ে হার্টটা বদলেই না-হয় নিয়ে আসি। নালিশ করলে রাজা মারা যাবেন লজ্জায়, টাকা আদায় না হলে আমি মারা যাব মনস্তাপে। এ-অবস্থায়—’

নৈরাশ্য সূচক মাথা-নাড়া পুরো আধ মিনিট ধরে। তারপর, হঠাৎই যেন কথাটা মনে পড়ে গেল, এই ভাবে চমকে উঠল পোদ্দার— ‘তা একটা কাজ হয়তো করা যায়, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। দলিলে একটা শর্ত ছিল যে, রাজার মৃত্যুর পরে সম্পত্তিটা বিনা নালিশেই আমার দখলে আসবে। এখনই যদি সেটা এসে যায় বিনা নালিশে? রাজা যেমন আছেন, তেমনি থাকবেন। যতদিন বাঁচবেন, তাঁর মহলে আমি হাত দেব না কোনোদিন!’

কামাখ্যাবাবু কথাটা বুঝতেই পারলেন না হঠাৎ— ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন পোদ্দারের দিকে—

পোদ্দার চেয়ার থেকে পা নামিয়ে নিল। ঘুরে দাঁড়াল যেন ঘর থেকে সে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বে। তারপর ঘাড়টা বাঁকিয়ে বলল— ‘এক ঘণ্টার মধ্যে টাকা দিয়ে দেবেন, কিংবা সম্পত্তি হস্তান্তরের দলিল সই করে দেবেন। আমি জানি রাজার আমমোক্তার নামা আপনার আছে। রাজাকে জানাবারই কিছু দরকার নেই, আপনি দলিলে সই করে দেবেন—’

‘এতে— এতে আপনার লাভ কী? রাজারই বা লাভ কী?’

—প্রশ্ন দুটো কামাখ্যাবাবু মুখ থেকে বেরুবার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি উপলব্ধি করলেন যে খুব বিজ্ঞোচিত প্রশ্ন হয়নি এ দুটোই—

‘লাভ?’ —আবার উলটোদিকে ঘুরে কামাখ্যাবাবুর মুখোমুখি দাঁড়াল পোদ্দার। ‘আমার লাভ এই যে জটাইগড় হাতে পেয়ে আমি ও থেকে দু-পয়সা রোজগারের চেষ্টা করতে পারব। আর রাজার লাভ এই যে নালিশের লোকলজ্জা তাঁকে জীবনে কখনো ভোগ করতে হবে না, যতদিন বাঁচবেন নিজের বিছানায় মনের আনন্দে শুয়ে থাকতে পারবেন—’

আবার সে ঘুরে দাঁড়াল— ‘আপনি যদি রাজি না হন, নালিশ হবে। আজই হবে। আর নালিশের খবর পেয়ে রাজা যদি সেই আঘাতে মারাই যান— হার্ট তাঁর দুর্বল— হ্যাঁ তিনি যদি মারাই যান, সেজন্য দায়ী হবেন আপনি। এক ঘণ্টা পরে আসছি। এসে দুটোর একটা জিনিস পেতে চাই, হয় টাকা, নয় দলিল—’

সত্যি সত্যি পোদ্দার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে—

এক ঘণ্টা বাদেই সে ফিরেও এল সত্যি সত্যি। কামাখ্যাবাবু দলিল লিখে সই করে দিয়েছেন রাজার পক্ষ থেকে। রেজিস্টারি হবে কাল—

রাত্তিরটা পোদ্দার হোটেলেই রইল, কাল দলিল রেজিস্টারির পর সে আবার যাবে জটাইগড়ে। দেখে নেবে সেই বেয়াদব ভৃত্যটাকে—

পোদ্দার যাবে কাল, কামাখ্যাবাবু আজই ছুটলেন জটাইগড়ে। রাজাকে আগে থেকে খবরটা দেওয়া দরকার। যতটা সম্ভব মোলায়েম করেই কথাটা ভাঙবেন কামাখ্যাবাবু, তবু তাঁর দারুণ ভয় করছে। রাজা হার্টফেল না করেন—

কিন্তু দেখা গেল, ভয় তাঁর অমূলক। নির্জনবাসের ফলে বিষয়ে বৈরাগ্য এসেছে রাজার। প্রায় বারো বৎসর আগে তিনি কামাখ্যার বৈঠকখানায় বসে একটা শ্লোকের এক পংক্তি আবৃত্তি করেছিলেন। আজও আবার তাই করলেন, ‘যদুপতিঃ ক্ক গতা মথুরাপুরী’—

‘যাক! ও তো যাবেই। আফশোস কী? চল্লিশ পুরুষ এই গড়ে বাস করেছি আমরা। জটায়ুবাবার বর ছিল— সে কাহিনি তুমি জানো তো কামাখ্যা—’

গল্প ফেঁদে বর্তমানের এই শোকাবহ পরিস্থিতিটাকে যদি খানিকটা হালকা করে তোলা যায়, এই আশায় কামাখ্যা বললেন— ‘হ্যাঁ, তোমাদের বংশের আদিপুরুষকে শৈশবে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় এক ঈগল পাখি, তখন তোমরা নেপাল তরাইয়ের ওদিকটায় থাকতে—’

‘ঈগল পাখি ছাড়া এই বৈজ্ঞানিক যুগে তাঁর অন্য পরিচয় নেই, তা ঠিক। তবে সে যুগের লোকেরা, মানে আমার পূর্বপুরুষেরা বিশ্বাস করতেন যে তিনি ছিলেন দেবাংশী বিহঙ্গ, গরুড়ের পুত্র জটায়ুর বংশধর। ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে তিনি আমাদের আদি পিতামহকে খেয়ে ফেলেননি, মানুষ করেছিলেন পর্বতচূড়ায় এবং বড়ো হয়ে উঠলে, তাঁকে বঙ্গদেশে পাঠিয়েছিলেন এই বর দিয়ে যে হাজার বছর তাঁর বংশ এখানে সমৃদ্ধির সঙ্গে বাস করবে। তাঁরই নামে আমাদের এই গড়— জটাইগড়—’

‘তোমার পালঙ্কের মাথার দিকে ওই যে ঈগল পাখির মাথাটি হুকে বসানো রয়েছে’—বলতে যান কামাখ্যা—

‘শুধু পালংকের মাথা কেন, কেল্লার কার্নিশে গুম্বজে কয়েক শো ছিল ঈগল পাখি। কোনটার শুধু মাথা, কোনটা পুরো মূর্তি।’

‘সেই আদ্যিকালের জটায়ু বংশধরের স্মৃতিচিহ্ন?’ —জিজ্ঞাসা করেন কামাখ্যা।

‘অবশ্য, তবে তাঁকে আমরা জটায়ু বংশধর বলি না, জটায়ুবাবা নামেই পুজো করি। তিনি আরও বলেছিলেন যে এ বংশের অনিষ্ট যার দ্বারা হবে, তার সাজা দেওয়ার ভার তিনিই নেবেন।’

বলতে বলতে বৃদ্ধ রাজা হেসে ফেললেন— অতি করুণ সে হাসি। ‘উপকথার ঈগল এই বিংশ শতাব্দীতে প্রতিহিংসা নেবে দুঁদে কালোবাজরি ভূঁইফোড় পোদ্দারের উপর, এ কথায় বিশ্বাস করবার মতো শিক্ষা বা রুচি আমাদের নয়। আর তা ছাড়া, পোদ্দার অন্যায় বা করছে কি? টাকা ধার দিয়েছে, সেটা তো সে আদায় করবেই। আমায় থাকতে দিচ্ছে এখনও, এটা তার দয়াই তো বলতে হবে—’

পরের দিন রেজিস্ট্রি দলিল পকেটে নিয়ে ভূঁইফোড় পোদ্দার আবার জটাইগড়ে হাজির। গাড়ি পরিখার ধারে রেখে হেঁটেই সে সাঁকো পার হল। গরম মেজাজে সোজা হেঁটে চলল রাজার মহলের দিকে। আজ আবার সেই ভৃত্যটা এসে ‘নিকালো’ বলুক এক বার! পকেটে আজ রিভলভার এনেছে পোদ্দার। এক গুলিতে হাত বা পা উড়িয়ে দেবে। মামলা করবে? হুঁঃ! ঢের মামলা দেখেছে পোদ্দার। যার টাকা আছে, মামলায় তার ভয় কি?

সোজা গিয়ে রাজার মহলে হাজির। দোর খুলল নিকুচাঁদই। আজ নিকুচাঁদ পরিচয় পেয়েছে ওর। কামাখ্যাবাবুই জানিয়ে গিয়েছেন যে মালিক আসছে পত্রপাঠ। কিন্তু মালিক বলে জানবার পরেও নিকুচাঁদের ভাবভঙ্গিতে পরিবর্তন কিছু দেখা গেল না। সাধারণভাবে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করল, আর বিনীতভাবে বলল— ‘আসুন বাবু!’

তারপর, পোদ্দারকে রেগে ওঠার ফুরসত না দিয়েই সে বলে চলল— ‘আপনি কি সোজা রাজা বাহাদুরের সঙ্গে কথা কইবেন? তাহলে এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি খবর দিই তাঁকে—’

বলেই নিকুচাঁদ ভিতরে চলে গেল। এ লোকটা যে এখনও পোদ্দারকে তৃণাদপি তুচ্ছ মনে করছে, তাতে সন্দেহ করবারই কোনো উপায় নেই। প্রতি কথায়, প্রতি ভঙ্গিতে সেই একটা তথ্যই ও বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে দিচ্ছে পোদ্দারের গায়ে—

অপেক্ষা? নিজের বাড়িতে এসে, একটা চাকরের কথায় অপেক্ষা করতে হবে পোদ্দারকে? সে করবে না তা। নিকুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে রাজার ঘরে গিয়ে হাজির হল—

রাজা অবাক হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছেন। নিকু নিজেকে সংযত রাখবার চেষ্টা করতে করতে যথাসম্ভব শান্তভাবেই বলল— ‘পোদ্দারমশাই, অপেক্ষা করতে বললে অপেক্ষা করাই কি ভদ্রলোকের রীতি নয়?’

পোদ্দার হুংকার করে উঠল— ‘চোপরাও ব্যাটা চাকর, বেরিয়ে যা, আমি যতক্ষণ এখানে থাকব, আর আসবি না এ-ঘরে খবর্দার—’

নিকু ঠিক পালটা সুরেই হুংকার করতে যাচ্ছিল, রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। সে মুখকে এত বিপন্ন, এত অসহায় দেখাচ্ছে— সে ছুটে গিয়ে রাজার পায়ে হাত দিল— ‘রাজা! রাজা!’

রাজা বললেন— ‘তুমি ওঘরে যাও নিকু। লক্ষ্মী আমার, ওঘরে যাও’—

প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে নিকু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল—

পোদ্দার গর্জাচ্ছে কেউটে সাপের মতো—

রাজা নিজেকে প্রকৃতিস্থ রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, ‘বসুন পোদ্দারমশাই। নিকু আমার কাছে আছে ত্রিশ বছরেরও বেশি। ওদের মনে আঘাত আমি কখনো দিই না—’

‘ত্রিশ বছর তো অনেকদিন’—পোদ্দার জবাব দেয় রুক্ষস্বরে—’অনেকদিন আছে, এইবার দরওয়াজা দেখুক। ওসব বেয়াদব লোককে আমি ঝাড়ে বংশে বিদায় করব—’

রাজা দুইহাতে বুকটা চেপে ধরেছেন— ‘তা তো হতে পারে না। যে দলিলে সই দিয়েছেন কামাখ্যা, তাতে তো একথা স্পষ্ট করে লেখা আছে যে আমি যেমন আছি, তেমনি থাকব এখানে—’

‘আপনি থাকবেন। কিন্তু আপনার চাকর-বাকর থাকবে না। এই সব বিদঘুটে আসবাব থাকবে না— এই পাখির মাথাটা— এটা এখানে কীসের জন্য শুনি?’

এবার যা করে বসল পোদ্দার, তা করার কোনো কারণ ছিল না। এর একমাত্র কৈফিয়ত এই হতে পারে যে রাগে সে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। রাজার পালঙ্কের মাথায় হুক পুঁতে তাতে যে ঈগল পাখির মাথাটি বসানো ছিল, একটানে সে তা তুলে নিয়ে সশব্দে আছড়ে ফেলল মাটিতে।

রাজা তা দেখলেন। জটায়ুবাবার স্মৃতির উপরে যে এত গভীর শ্রদ্ধা তাঁর অন্তরে গাঁথা ছিল, তা নিজেও তিনি টের পাননি সারাজীবনে। আজ কিন্তু সেই জটায়ুর মূর্তিকে ঘৃণাভরে মাটিতে নিক্ষিপ্ত হতে দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন একেবারে। বুকের ভিতর কী একটা বাঁধন যেন সশব্দে ছিঁড়ে গেল তাঁর। একটা আর্তনাদ করে তিনি কাত হয়ে পড়লেন বিছানাতেই।

সেই শব্দ শুনে নিকু ওদিকে ছুটে আসছে এই ঘরে। এদিকে সেই শব্দ শুনেই পোদ্দার ছুটে বেরিয়েছে ঘর থেকে। রাজা কি মরে গেল? —ভাবছে পোদ্দার। হার্টের অসুখ, মনে শক লাগলেই ফল সাংঘাতিক হবে, একথা পই পই করে বলে দিয়েছিল ওই কামাখ্যা উকিল। অত কথা কি আর মনে থাকে?

যদিই রাজা মরে গিয়ে থাকে? —একটা ঝঞ্ঝাট হবে। এ অঞ্চলে রাজার অনুরক্ত সবাই, যদিও রাজগি তাঁর চলে গিয়েছে বহুদিন আগে। সেসব লোক আড়ে হাতে লাগবে পোদ্দারের পিছনে।

না। ছুটে পালানোই এখন দরকার। তাঁর ঘর থেকে—

রাজার মহলে ভৃত্যদের কান্নার রোল উঠেছে। পোদ্দার, এদিকে ছুটে পালাচ্ছে গড়ের বাইরে। ছুট! ছুট।

সিং দরওয়াজার কবাট এবার যেন আরও ভারী, আরও আঁটো। ঘাম বেরিয়ে গেল পোদ্দারের সেই দরওয়াজা খুলতে।

খুলে বেরিয়ে দে ছুট সাঁকো বেয়ে। ওপারেই গাড়ি। আর ভয় নেই।

‘কিন্তু একী! সামনে হাঁ করে ওটা কী আসছে? হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে? কী আশ্চয্যি। একটা বাজপাখি না? ঠিক যেরকম একটা পাখির মাথা আমি চুরমার করে এলাম এইমাত্র, তারই হুবহু জুড়ি যেন—’

‘কী বিপদ! এটা যেন তেড়ে আসছে আমাকে? দূর, দূর, দূর—’

ঈগল তেড়ে আসছে, পিছনে হটছে— পায়ে পায়ে— ঝপাং! রেলিং বিহীন সাঁকো থেকে পরিখার অগাধ জলে পোদ্দার! যে পরিখা বুজিয়ে ফেলার প্ল্যান কাল থেকেই তার মাথায় ঘুরছে—

পড়েই ডুবে গেল পোদ্দার, কিন্তু ভেসে উঠল প্রায় তখনই, উঠেই দেখে, ঠিক মুখের সামনে সেই ঈগল— বাঁকা নখ দিয়ে চোখ দুটো উপড়ে নেবার চেষ্টা করছে পোদ্দারের। চোখ বাঁচাবার জন্যই ডুব দিতে হল তাকে আবার। উঠলেই ঈগল—

এবার যখন সে ডুব দিচ্ছে, জটায়ু তার দেহটা চেপে ধরল দুই পায়ের সাঁড়াশি-নখ আর বাঁকা ভোজালির মতো ঠোঁট দিয়ে। আর উঠল না পোদ্দার।

রাজবাড়িতে ভৃত্যমহল তখন কেঁদে গড়াগড়ি দিচ্ছে। রাজা আর নেই। ওই ভূঁইফোড় পোদ্দারের নৃশংস ব্যবহারে হার্টফেল করেছেন রাজা।

হঠাৎ মেঝেতে জটায়ুবাবার মাথাটা চোখে পড়ল নিকুচাঁদের। সে সেটা ভক্তিভরে তুলে নিল। কী আশ্চর্য! জিনিসটা থেকে জল ঝরছে ঝপঝপ করে, যেন এইমাত্র গভীর জলে ডুব দিয়ে উঠল।