৪. শ্রীমণীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খাতা
আমার পিতার ব্যবসা বাণিজ্যের বোধ বিন্দুমাত্র ছিল না, তাহা সত্বেও তিনি ব্যবসায়েই পরিবারের যাবতীয় ধনসম্পদ, স্থাবর, অস্থাবর সকলই ঢালিয়া দিয়াছেন। তাঁহার মধ্যে এক নির্বোধ, অন্ধ জেদ ছিল। সেই জেদের পিছনে দৌড়িয়া পিতা তাঁহার নিজের বর্তমান এবং সকল সন্তানের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করিয়া ফেলিয়াছিলেন। ব্যবসায়ের নেশা ঘোড়দৌড়ের মাঠের নেশার অপেক্ষা আরও ভয়াবহ হইতে পারে। আমার পিতামহ তাঁহার পুত্র প্রপৌত্রদিগের জন্য কম ধনসম্পত্তি রাখিয়া যান নাই। কিন্তু আমাদিগের দুর্ভাগ্য, আমার পিতারও, যে সেই উত্তরাধিকার আমাদিগের জীবনে আর আসিয়া পৌঁছিল না।
.
অদ্য আমার পুত্র শ্রীমান সংকর্ষণ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হইল। উহাকে দয়াময় করুণাময় ঈশ্বরের হাতেই ছাড়িয়া দিয়াছি। আমার কন্যা দুইটিকেও যথাসাধ্য উচ্চ শিক্ষাদান করিবার বাসনা রহিল। একমাত্র বিদ্যা ভিন্ন আর কোনও সম্পদই তো আমি উহাদের জন্য রাখিয়া যাইতে পারিব না। আমার পিতার কল্যাণে আমার বিদ্যার্জনেও বিঘ্ন ঘটিয়াছিল। পিতার আশীর্বাদে আমার কপালে না জুটিয়াছে লক্ষ্মীর কৃপা, না সরস্বতীর করুণা। লক্ষ্মীর করুণা আপনিই আসিবে, যদি সরস্বতী উহাদিগকে কৃপা করেন।
.
জীবনে সার্থককামা হইতে হইলে কী কী চাই? আমার পিতার মধ্যে অসীম স্পৃহা ছিল সফলতার, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল অন্তহীন, পরিশ্রমীও তিনি ছিলেন না, তাহা নহে। তবে কেন তাঁহার সকল প্রচেষ্টা বিফলে গেল?
এবং তাঁহার পুত্র, তাঁহার একমাত্র পুত্র, এই আমিও কেনই বা এমনভাবে আমার মানবজন্মটি ব্যর্থ করিলাম? আমার মধ্যে ক্রোধ ছিল। অত্যন্ত প্রবল ক্রোধ, পুরুষ বলিয়া ক্রোধ। যদি নারী হইতাম ইহারই নাম হইত অভিমান। কাহার প্রতি অভিমান? কাহার প্রতি ক্রোধ? আমার পিতৃদেবের প্রতি।
আমার জন্ম যিনি দিয়াছেন, তাহার পরে কেমনভাবে বাঁচিয়া থাকিব সেই কথাটি তিনি ভাবেন নাই।
দিদিদের কপাল ভালো ছিল, পিতৃদেবের হাতে তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি বাকি থাকিতে থাকিতেই তাহাদের বিবাহ সুসম্পন্ন হইয়াছিল। আর আমি অধিক বয়সের সন্তান। আমার পড়াশুনা শেষ হইবার পূর্বেই পিতৃদেবের পকেট শূন্য হইয়া গেল। তিনি অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্খী হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার সেই উচ্চাভিলাষের মাশুল আমি সপরিবারের অদ্যাপি গুনিয়া চলিতেছি। আমার সন্তানেরা জানে তাহাদের পিতাটি জীবনে ব্যর্থ পুরুষ। পায়ের নীচে মাটি পায় নাই। জানে না, তাহার পিছনে কী কাহিনি ছিল। আমি কদাচ গল্প করি নাই। আমি জানি কাজলরেখাও কোনওদিনও কিছু বলিবে না।
আমার জীবনে, কাজলরেখাই একমাত্র মঙ্গলের স্বর্ণরেখা। এই নারীটিকে যত দেখিতেছি ততই বিস্ময়ে হতবাক শ্রদ্ধায় নতশির হইয়া পড়িতেছি।
কাজলরেখা ধনীর কন্যা, ধনীর পুত্রবধূ, দরিদ্রের অর্ধাঙ্গিনী। পিতা কিশোর বয়সে এক বালিকার সহিত আমার বিবাহ দিলেন। তখন সদ্য ম্যাট্রিক পাস করিয়া ইন্টারমিডিয়েটে সায়েন্স পড়িতে শুরু করিয়াছে। খুবই রংঢং-এর বিবাহ হইল, জাঁকজমক আড়ম্বরের অভাব ছিল না। জৌলুস বেশিদিন টিকিল না। বালিকাবধুর অলঙ্কারসমুদয় শ্বশুর মহাশয়ের ব্যবসায়ের ভোগে লাগিল।
কিন্তু অদ্যাবধি আমাকে কোনও গঞ্জনা শুনিতে হয় নাই। এত দু:খকষ্ট, এত অভাব-অনটন, এত পরিশ্রম, এত ক্লান্তি, শান্তি নাই, বিশ্রাম নাই, সাধ-আহ্লাদ নাই, কিন্তু কাজলরেখার মুখে অভিযোগের রেখাটি পর্যন্ত নাই।
ঈশ্বরের করুণা যদি আমার উপর কোনও রূপে বর্ষিয়া থাকে উহা কাজলরেখার রূপেই বর্ষিয়াছে। উহার সহ্য-ধৈর্য ও ক্ষমার শক্তি যত দেখি, ততই অপরাধবোধে ও অক্ষমতার তাড়নায় আমার মস্তক ঝুঁকিয়া পড়ে।
আমাদের পুত্র-কন্যাগুলি যদি তাহাদের মায়ের স্বভাবগুণের কণিকামাত্রও পায় তবে এই কঠোর জগতে তাহাদের তুলনা মেলা ভার হইবে।
বারোমাস নিত্যদিন শীত-গ্রীষ্ম নাই কাজলরেখা ভূমিশয্যায় নিদ্রিত থাকে। অথচ আমি তক্তাপোশে শুই, শিশুকন্যাদের লইয়া এই ব্যবস্থা তাহারই। স্বাভাবিক হইত, মা যদি মেয়েদের লইয়া শয়ন করেন। কিন্তু আমাকে সে মাটিতে শুইতে দিবে না। সংকু তাহার বন্ধু শিবুর নিকটে গিয়া ঘুমায়। উহাদের পরিবারটি উদার।
আহা, আমাদের বাড়ির সেই বিশাল মেহগনিকাঠের খাটটি যদি থাকিত, আমরা স্বামী-স্ত্রী, তিন সন্তান, সকলে মিলিয়াই মহানন্দে নিদ্রা যাইতে পারিতাম। কে জানে সেই হাতির মতো পায়াধারী বিপুল বৃহৎ খাটটি এখন কোথায়? তিনধাপ সিঁড়ি ছিল, উঁচু খাটে উঠিবার জন্য। চারকোনায় চারটি স্তম্ভ ছিল, মশারির জন্য। আর খাটের তলদেশে একটি ভারী দেরাজ ছিল, তাহাতে ঘটি-বাটি, গ্লাস সরপোশ, রেকাবি, ইত্যাদি তোলা থাকিত, অতিথি সমাগম হইলে বাহির হইত। সেই খাটে, আমার মা-বাবা ঘুমাইতেন শুধু আমাকে লইয়া। দিদিরা অন্যত্র ঘুমাইত, অর্থাৎ বড় পিসিমার খাটে। অথচ ওই খাটে এত ফাঁকা জায়গা ছিল আমার তিন দিদি অনায়াসেই শুইতে পারিত। কিন্তু তখনকার দিনে পিতার সহিত এক শয্যায় বয়স্থা কন্যাদের শুইবার চল ছিল না। তা সে মা থাকুন, বা নাই থাকুন।
ইদানীং সংবাদপত্রে কত কিছু প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, সামাজিক নীতিবিরুদ্ধ পৈশাচিক ক্রিয়াকর্মের খবর পাই। এবং মন ভাঙিয়া পড়ে। মহাপাপ! মহাপাপ! ভাবিতেই পারি না এই সকল দুর্যোগপূর্ণ ঘটনাগুলির দু:খস্মৃতি মানুষ কীভাবে কাটাইয়া ওঠে। নহে, মর্যাল ডিজাস্টার। শরীরের অপেক্ষা মনের উপরেই ইহাদের প্রভাব ঢের বেশি পড়ে। এমন নৈতিক দুর্যোগ যদি পরিবারেই ঘঠে, তবে শিশুর সুরক্ষা কবচটি কোথায়? অথচ দুই কন্যাকে আদর করিয়া তক্তাপোশে শোওয়াইয়া, স্বামীকেও সেইখানেই ঠাঁই করিয়া দিয়া, কাজলরেখা স্বয়ং ভূতলশায়িনী। এবং পুত্রটিকে প্রেরণ করেন গৃহস্বামিনীর হেপাজতে, তাঁহার পুত্রের কামরাটির আধখানার দখল লইতে। বাপকেও যত বিশ্বাস, কন্যাদেরও ততই। আমি কেবল মনে মনে চিন্তা করি কিছুই তো রাখিয়া যাইতে পারিলাম না, হিন্দু এনুয়িটি ফান্ডের ওই তুচ্ছ দুই শত টাকার বিধবা পেনশন ছাড়া। আমি মরিলে সন্তানগুলি তাহাদের জননীর প্রতি কর্তব্য অবহেলা করিবে না তো? যা দিনকাল আসিতেছে, আর হলফ করিয়া কিছুই বলিতে পারা যায় না। আমার পুত্র কন্যাগণ হয়তো আমার মনোভাবটি জ্ঞাত হইলে বিরক্তিবোধ করিবে, কিন্তু এই উদ্বেগ অসত্য নহে। মানুষ আজ একরকম থাকে, কালই তাহার আর একরূপ। আমার সন্তানগুলি এখনও পর্যন্ত সৎ, মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এবং বাধ্যপ্রকৃতির। আমি যে তাহাদের কিছুই দিতে পারি নাই তাহা লইয়া উহাদের নিকট কোনও গঞ্জনা শুনি নাই। অথচ অধুনা তো পিতামাতাকে গঞ্জনা দেওয়ার একটা রেওয়াজই হইয়াছে। সাহিত্য পাঠ করিলেই উহা জানা যায়। আমি একজন ব্যর্থ স্বামী, একজন ব্যর্থ পিতা।
কিন্তু কাজলরেখার আচরণে আমার প্রতি শ্রদ্ধার, সম্মানের এতটুকু হেরফের হয় নাই বলিয়াই, মায়ের দেখাদেখি পুত্রকন্যারাও আমাকে সম্মান দিতে শিখিয়াছে। আমি সামান্য বেসরকারি ফার্মের কনিষ্ঠ কেরানির কাজ করিয়া এবং টিউশনি করিয়া সংসার চালাইলাম, একফোঁটা জমিও কিনিতে পারিলাম না। এ জন্য কাজলরেখার কি মনোবেদনা নাই? তাহার বিবাহ হইয়াছিল এক ধনীর দুলালের সহিত। ঘোড়াশালে সত্য সত্যই ঘোড়া ছিল। দুগ্ধবতী গাভী ছিল গোশালায়, গ্যারাজে একটি ডেইমলার, একটি মার্সেডিজ বেনজ, এবং ঘোড়ায় টানা ল্যানডো। প্রত্যহ রূপার বাসনে ভাত খাইত যে-বধূটি, সে এখন পায়রা তাড়াইয়া স্টোভ ধরাইয়া কেরানি স্বামীর অফিসের ভাত রাঁধিয়া দেয়, ছেলেমেয়ের স্কুলের ভাত দিয়া টিফিন পর্যন্ত বানাইয়া দেয়। আমি যে সামান্য টাকাটুকু আনিয়া কাজলরেখার হস্তে দেই, কোন ইন্দ্রজালে যে সেইটুকু লইয়াই সকলের সকল প্রয়োজন পূরণ করে, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না। ‘লক্ষ্মীশ্রী’ বোধহয় ইহাকেই বলে। প্রচুর দাসদাসী লইয়া বৃহৎ পরিবারে লালিত হইয়াছে যে কন্যাটি, আজ তাহাকে সংসারধর্ম পালনের নামে দাসীত্বই তো করিতে হইতেছে। আমার মতো হতভাগ্য স্বামী যেন কোনও নারীর কপালে না জুটে! মর্মর প্রাসাদে যাহার বাস ছিল, সে এখন দেড়খানি ক্ষুদ্র কামরার মধ্যে দিনযাপন করিয়া মরিতেছে।
এতদূর পড়ে তিতলি বাবার খাতাটি বন্ধ করে ফেলল। মোটা, খয়েরি রংয়ের মলাট। সাদা চামড়ায় স্পাইন আর কর্নার্স বাঁধানো। ভিতরে মুক্তাক্ষরে বাবার হাতে লেখা। কখনই বা লিখতেন বাবা এসব? হঠাৎ এই একখানা খাতা তার চেনা মা, তার চেনা বাবা, তাঁদের বাল্য, কৈশোর—সমস্ত কিছুর উপরে অন্য এক অচেনা ভূখণ্ডের আলো ফেলতে শুরু করেছে।
এই বাবাকে সে চিনত না।
এই বাবার চোখে যে ‘কাজলরেখা’ ফুটে উঠেছেন সেই মাকেও কি চিনত? বাবা-মায়ের মুখে ঠাকুরদার জমিদারি নষ্ট করে ফেলার কাহিনির বীজটুকুই শুনেছে, অতি সংক্ষেপে। ঘটনাটাকে গুরুত্বও দেয়নি। ওরাও যে জানে, দেশভাগের পরে গরিবরা সকলেই বিরাট বিরাট জমিদারির মালিক ছিল বলে দাবি করে থাকে। দাদামশায়ের বিষয়ে তো কদাচই কিছু শোনেনি। মা বড় স্বল্পভাষিনী ছিলেন। মা তাদের কিছুই বলে যাননি।
দাদাটা চলে গেছে। দিদি আছে। এতরাত্রে ওকে ডাকা যায় না। তিতলির হঠাৎ প্রবল রাগ হতে থাকে। এবং প্রবল কান্না পেতে থাকে।
কেন এমনভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের, নিজেদের পরিবারের ইতিহাস থেকে? প্রকৃতপক্ষে ওদের তো মার বিষয়েও কিছুই জানা নেই। বাবার বিষয়েও না। বাবা-মায়ের মধ্যে যে এত প্রেম ছিল, সেটাও তো তাঁরা বুঝতে দেননি কোনওদিন। কটাই বা কথা কইতেন দুজনে?
বাবার দিন কাটত অফিসে, সন্ধ্যা কাটত টিউশনিতে, রাত্রে ফিরে খেতে বসেই দুজনের যেটুকু কথাবার্তা। সেখানেও তো তাঁরা একা নন, ছেলেমেয়েদের নিয়েই খেতে বসতেন বাবা। কথাবার্তার মধ্যে ওরাও উপস্থিত থাকত, তিন ভাইবোনে। কোথাও কোনও প্রিভেসি ছিল না মা-বাবার। দাদা বেশির ভাগ সময়টাই বাইরে বাইরে কাটাত। স্কুলের সময় থেকেই দাদা বাইরে। বন্ধুদের বাড়িতে পড়তে যেত। বন্ধুদের বাড়িতে শুতে যেত। বন্ধু মানে ওই শিবুদা আর নীলুদা। শিবুদারাই ওদের বাড়িওয়ালা ছিল। আর নীলুদা দাদার ক্লাসফ্রেন্ড পাশের গলিতেই থাকত। নীলুদার সঙ্গে পড়তে যেত দাদা। শিবুদা অন্য স্কুলে, অন্য ক্লাসে পড়ত। লেখাপড়ার তত ভালোও ছিল না শিবুদা। একটু মাস্তানি স্বভাব ছিল ওর। কিন্তু মানুষটা খুব ভালো। নীলুদা খুব সিরিয়াস স্টুডেন্ট, দাদা আর নীলুদা একসঙ্গে পড়ত, দুজনেই রেজাল্ট ভালো করত।
আর মিতুল-তিতলি? ওরা পড়ত খাটে বসে। ওরা পড়ত নিজে নিজে। স্কুলের দিদিমণিরা ওদের খুব যত্ন করতেন—দুজনেই পড়াশুনোতে ভালো ছিল, লক্ষ্মী মেয়ে দুই বোনে। মা ওদের সংসারের কোনও কাজে ডাকতেন না। তবু ওরা যেত, নিজেরাই যেত। মিতুল আটা মেখে রুটি বেলে দিত, তিতলি বাটনা বেটে দিত। সে যুগ গুঁড়োমশলার ছিল না, অথবা থাকলেও ওদের জন্য ছিল না।
মাঝে মাঝে ছোট মাছ হত। মাঝেমধ্যে ডিম। মাকে নিরামিষাশী বলেই জানত ওরা। কিন্তু না, একাদশীর দিনে মা ক্যালেন্ডার দেখে নিয়ম করে মাছ খেতেন। পড়াশুনোতে মেয়েরা ছেলের সঙ্গে সমান সুযোগ পাবে, শোবার সময়ে মেয়েরাই বাড়িতে, খাটে শোবে, কিন্তু খাবার সময়ে বড় মাছটা বাবার পাতে, পরেরটাই দাদার। ছোটগুলো মিতু-তিতুর জন্যে। মিতু-তিতুও কিছু মনে করত না তাতে। মায়ের যে মোটে মাছই নেই, তাতেও অবাক লাগত না। প্রশ্নই ওঠেনি মনে, মা’র মাছ কই? মার মাছ নেই কেন? মাঝে মাঝে অবশ্য কুচোচিংড়ির ঝোল, কিংবা ডিমের ওমলেটের ঝোল হলে মা-ও ভাগ পেতেন। রবিবার রবিবার শিবুদাদের বাড়িতে মাংস রান্নার গন্ধ বেরুত। তিতলিরা সেই গন্ধ দিয়েই ভাত মেখে খেয়ে নিত। মাংস রান্না ওদের বাড়িতে কদাচ কখনও, উৎসবেরপ্রসঙ্গে। দাদার জন্মদিনে হতই। মিতু-তিতুর জন্মদিনেও মা মাংস রান্নার চেষ্টা করতেন। আর নববর্ষে।
মাকে এই ফ্ল্যাটে এনে, চমৎকার মডার্ন কিচেনে প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছে ছিল তিতলির। যেরকম কিচেনে উনি রান্না করে সুখ পেয়েছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে, অ্যালবামাতে। ঠিক তেমনটি না হলেও সেই ধরনের তো বটে।—মা কত খুশি হবেন মার্বেলের কাউন্টার দেখে। কত আহ্লাদ করবেন স্টেনলেস স্টিলের উনুন আর আভেন, স্টেনলেস স্টিলের সিংকটা দেখে। মা’র জন্যে কিনে এনেছিল মিক্সি, জ্যুসার, ফুড প্রসেসর। নিউইয়র্কের ইন্ডিয়ান পাড়া জ্যাকসন হাইটসে গিয়ে ২২০ ভোল্টের যন্ত্রপাতি কিনেছে তিতলি। একটা স্পেশাল ট্রিপ নিয়েছিল সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু সবই কেমন ব্যর্থ হয়ে গেল, হারা উদ্দেশ্যে হয়ে গেল।
এখন এই ফ্ল্যাট, এই সুন্দর কিচেন, এসব নিয়ে কী করবে তিতলি? কে থাকবে এখানে? তাকে তো ফিরে যেতেই হবে চাকরিস্থলে। আজকের দিনে কেউ পাকা চাকরি ছাড়ে না। তবু মায়ের কাছে থাকবার জন্যে তিতলি সেই চাকরিও ছাড়তে প্রস্তুত হয়েছিল। দেশে একটা কাজ জোগাড় করতে পারলেই অ্যালাবামার চাকরি সে ছেড়ে দিত।
তার মন বলেছিল, চাকরি কি জীবনের জন্যে? না জীবনটা চাকরির জন্যে? জীবন যদি চাকরির দাসত্ব হয় তবে তিতলি তুমি অ্যালাবামাতেই থাকো, আর তোমার মা জননী তাঁর শেষ ক’টা বছর কাটিয়ে যাক বৃদ্ধাশ্রমের শীতল দূরত্বে। আর চাকরির উদ্দেশ্য যদি হয় জীবনযাপনের পথ সুগম করা, তবে তুমি কলকাতায় যাও, মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ ক’টা বছর কাটাও। তাঁকে সঙ্গ দাও, তাঁর সঙ্গ উপভোগ করো, জীবনে যেটার অবসর হয়নি কখনও। সূর্যোদয় থেকে নিশীথের দ্বিতীয় যাম পর্যন্ত মা ছিলেন সংসার বন্দিনি—গার্হস্থ্যের সীমাহীন কর্তব্যের শাস্তি ছিল তাঁর মাথায়। এতদিনে একটা অবকাশ মিলেছে মাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার। পুরী, ভুবনেশ্বর, মথুরা বৃন্দাবন, দিঘা, দার্জিলিং। মার তো কোথাওই যাওয়া হয়নি। কেবল বেনারস গিয়েছিলেন, আর গয়া। বাবা যখন ঠাকুরদার পিণ্ড দান করতে গয়া গেলেন, তখনই মাকেও নিয়ে যান। ওরা তিনজনে এ বাড়িতে ছিল। শিবুদার মায়ের হেপাজতে। মা’র বেনারস খুব ভালো লেগেছিল। তাই বারবার বলেছিলেন, ‘আমাকে তোরা কাশী পাঠিয়ে দে।’ জিনার আপত্তিতে মা’র আবদার টেঁকেনি, বারাণসী নয়, বৃদ্ধাবাসে গিয়েই মায়ের বানপ্রস্থ যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল।
মা’র নাম যে কাজলরেখা চট্টোপাধ্যায় সেটাও ছেলেমেয়েদের নতুন করে মনে পড়েছিল বাবা মৃত্যুর পরে। পাসর্পোট তৈরি করতে, ভিসা করাতে এবং বৃদ্ধাবাসের আবেদন করতে গিয়ে। বাবা তো মাকে কাজলরেখা বলে সর্বসমক্ষে ডাকতেন না। সেই ওল্ড-ফ্যাশনড ‘ওগো—হ্যাঁগো’ ই চলত ওঁদের দুজনের মধ্যে।
তিতলি উঠে মুখেচোখে জলের ছিটে দিতে বাথরুমে গেল। নতুন ঝকমকে বাথরুম। মা’র জন্য মার্বেল পাথরের মেঝে করেছে। এবং শৌচকর্মের জন্য একটা সুন্দর স্টিলের হ্যান্ড-হেলড স্প্রে লাগিয়েছে। যাতে মা একবারে অবাক হয়ে যান। এ বস্তু তো বিদেশেও দেখেনি! এ-দেশি ফাইভস্টার হোটেলে থাকে। মা’র কিছু দেখাই হল না! সব মিথ্যে হয়ে গেল।