৪. মাদ্রাজ-বম্বে-কলকাতা

মাদ্রাজ-বম্বে-কলকাতা

ব্যবসায়িক দিক দিয়ে হরমুজ দখল খুব লাভজনক হওয়ার কথা ছিল না। পর্তুগিজ আমলেই হরমুজের ব্যাবসাপাতির পড়ন্ত অবস্থা। কিন্তু যুদ্ধজয়ের প্রভাব পড়ল কোঙ্কন উপকূলে। ১৬২৬ সালে নিজেদের মধ্যে বিস্তর অশান্তির জের কাটিয়ে উঠে ডাচ ও ইংরেজরা যৌথ অভিযান চালাল ‘বাম্বাই’ খাঁড়ির উপর অবস্থিত পর্তুগিজ বাসেইনে। বন্দর হিসেবে বাসেইনের অবস্থান সুবিধাজনক। কিন্তু এই বন্দর তখন প্রায় পরিত্যক্ত। একটা পুরনো কেল্লা ও জেলেদের বস্তি বাদ দিলে এখানে বিশেষ কিছু নেই। যৌথবাহিনী পৌঁছনোর আগেই সৈন্যরা দামি জিনিসপাতি সব নিয়ে গোয়ায় পালাল। বাহিনী এসে পেল কয়েক বস্তা চাল। এই ঘটনার পরে কোঙ্কন অঞ্চলে পর্তুগিজ-ইংরেজ বিবাদ মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। ১৬৩৪ সালের শান্তি চুক্তি সেই সহাবস্থান আরও পাকাপাকি করল।

কিন্তু এই বিবাদের জেরে কোম্পানির স্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হল উপকূল অঞ্চলে দুর্গ বানানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। দুর্গের ধারণাটা পুরনো, পর্তুগিজরাই এ ব্যাপারে পথপ্রদর্শক। পর্তুগিজদের সঙ্গে শান্তি বজায় থাকলেও ডাচদের বিশ্বাস নেই। সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর (১৬৬৬) আগে থেকেই আগ্রায়, বস্তুত সারা উত্তর ভারতে, শুরু হয়ে গেছে ক্ষমতাদখলের লড়াই। সেই খবরও নিশ্চিন্ত থাকার মতো নয়। ১৬৩২ থেকে ১৬৯০ সালের মধ্যে তিনটে নতুন বন্দরের পত্তন হল, যথাক্রমে মাদ্রাজ, বম্বে ও কলকাতা। দুর্গ গড়ে উঠল। কোম্পানির ব্যাবসাপাতি অনেকটাই সুরাট-মসুলিপতনম- হুগলি থেকে চলে এল এই নতুন উপনিবেশগুলিতে। পরের একশো বছরে এই উপনিবেশগুলি শুধু যে কোম্পানির ব্যাবসার ধাঁচ পালটে দেয় তাই নয়, ভারতীয় ব্যাবসার ইতিহাসে ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনেও এদের ভূমিকা বৈপ্লবিক। এই তিন শহরের গোড়াপত্তনের কথা এবার দেখা যাক।

মাদ্রাজ

১৬১১ সালে অ্যান্টনি হিপনের অধিনায়কত্বে কোম্পানির সপ্তম সমুদ্রযাত্রার সময়ে করমণ্ডল উপকূলের পুলিকটে একটা ছোটখাটো আড়ত গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। তখন ইন্দোনেশিয়া এশিয়ার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও সেই কারণে সুতির কাপড়ের উৎস করমণ্ডল উপকূলও গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় রানির দরবারে ডাচ প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানালে অবশ্য সে চেষ্টা সফল হয়নি। দমে না গিয়ে হিপন চললেন উত্তরে, কৃষ্ণা নদীর মোহনায়। উপকূলের এই অঞ্চল সাইক্লোনের কারণে কুখ্যাত। অতএব দরকার এমন একটা জায়গা যেটা ঝড়ের রাস্তা থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত। এই অঞ্চলে খুবই ছোট একটা আড়ত চলে ১৬৮৭ সাল পর্যন্ত। শেষে জ্বরের প্রকোপে উপনিবেশ বন্ধ করে দিতে হয়। হিপনের তিন বছর পরে আর-এক দল পুলিকটে আস্তানা গড়তে সচেষ্ট হয়। ডাচরা ইংরেজ প্রতিনিধিদের বিপুল ভোজে আপ্যায়িত করে বিদায় দেওয়ার সময়ে শাসিয়ে দেয় যে ব্যাবসার মতলব থাকলে ফল ভাল হবে না।

হিপনের দল মসুলিপতনমে এসে পৌঁছয়। এই বন্দর গোলকোন্ডা রাজ্যের অধীনে, তবে ১৬৩২ সালের আগে মসুলিপতনমে গোলকোন্ডার আধিপত্য পাকাপাকি হয়নি। সেই কয়েক বছর আর্মাগাঁও নামে এক জায়গায় টিমটিম করে ইংরেজ অস্তিত্ব টিকে ছিল। ১৬৩২ সালের পরে মসুলিপতনমে ফিরে এসে কোম্পানির কর্মচারীরা দেখল যে কয়েক বছর আগে যেসব তাঁতিদের সঙ্গে তাদের কারবার হয়েছিল প্রায় সবাই ১৬৩০ সালের ভয়াবহ মড়কে ফৌত হয়েছে। তবু মসুলিপতনমে কারখানা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তার একটা কারণ গোলকোন্ডার শাসকরা চায় এটিকে মুক্ত বন্দর করে রাখতে, অর্থাৎ ডাচদের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা এখানে কম। আর দ্বিতীয় কারণ ব্যান্টামের একটা পার্টনার পাওয়া গেল। গোলমরিচের বিনিময়-মাধ্যম সুতির কাপড় কেনার জন্যে এই শহর উপযুক্ত। অন্ধ্র উপকূলের বিখ্যাত শিল্প, হাতে-আঁকা কলমকারী কাপড় তখন ইউরোপের বাজারে আদর পাচ্ছে। এসব ছাড়াও কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে মসুলিপতনমের বিরাট আকর্ষণ ছিল গোলকোন্ডার হিরে। হিরের বাজার সর্বত্র, তা ছাড়া বিদেশে একসঙ্গে অনেকটা টাকা পাঠানোর জন্যে হিরের বিকল্প প্ৰায় নেই।

১৬৩২ সালে ফ্রান্সিস ডে (১৬০৫-১৬৭০) আর্মাগাঁওয়ের প্রায় ভেঙে— পড়া কারখানার দায়িত্ব নিয়ে এসে পৌঁছলেন। আর্মাগাঁওয়ের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে ভয় পেয়ে ডে খুঁজছিলেন আরও নিরাপদ একটা বন্দর। একবার মসুলিপতনম থেকে পণ্ডিচেরি উপকূল যাওয়ার পথে মাদ্রাসিপতনম ও চিন্নাপতনম নামে সমুদ্রতীরের দুই গ্রামের মাঝে একটা জায়গা পছন্দ হল। সেখানে তখন একটা পর্তুগিজ গির্জা ও বসতি রয়েছে। জমি কেনা হল স্থানীয় ‘নায়ক’ রাজা দামার্লা ভেনকাদ্রির কাছ থেকে। ডে মসুলিপতনমের সহকর্মীদের বোঝালেন কেন ব্যাবসা ও সুরক্ষার জন্যে জায়গাটা সুবিধাজনক। জাহাজ বাঁধার সুবিধা, সুতির কাপড় সংগ্রহ ছাড়াও এই জায়গাটা কলমকারদের গ্রামের আরও কাছে। ভেনকাদ্রি প্রতিশ্রুতি দিলেন ইংরেজরা আর্মাগাঁওয়ের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসার আগেই তিনি একটা দুর্গ গড়ে দেবেন। বিনিময়ে চাই ইরানি ঘোড়া। হাতে টাকাকড়ি কম, তাই ডে এই ব্যবস্থায় রাজি হয়ে আর্মাগাঁও ফিরলেন।

১৬৪০ সালে পাকাপাকি ভাবে ফিরে এসে দুর্গ দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠল। ভেনকাদ্রির দুর্গ তালপাতা দিয়ে তৈরি। তড়িঘড়ি সব লোকজন খাটিয়ে ডে শুরু করলেন আরও মজবুত রসদ দিয়ে দুর্গ বানাতে, নিজের অর্থ ব্যয় করে। কাজ আরম্ভের দিনটা সম্ভবত সেন্ট জর্জের স্মরণ দিবস। লন্ডনে কোম্পানির মালিকরা বাধা না দিলেও পুরো ব্যাপারটায় সায়ও দিল না। বিনা অনুমতিতে দুর্গ নির্মাণের হুকুম দেওয়ায় ডে-র শাস্তি পাওয়া উচিত কি না সে বিচার ছেড়ে দেওয়া হল সুরাট ও মসুলিপতনমের কর্তাদের উপরে। সুরাটের কর্তারা জানাল, তাদের আশা যে মসুলিপতনমের কর্তারা সব দিক খতিয়ে দেখেছে। মসুলিপতনমের কর্তারা ডে-র বন্ধু। অর্থাৎ লন্ডনের আদেশ সবিনয়ে উপেক্ষা করে মাদ্রাজে ফোর্ট সেন্ট জর্জ গড়ে উঠল।

কড়া রকমের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, এমনকী মাদ্রাজে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুকুমও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু মাদ্রাজ সেই পরিণতি থেকে বেঁচে গেল ব্যাবসার চমকপ্রদ সাফল্যের কারণে। দেখতে দেখতে শয়ে শয়ে তাঁতি, কাপড়ের ব্যাপারী ও কারিগররা মাদ্রাজের উপকণ্ঠে চলে এসে বসতি স্থাপন করল। পর্তুগিজ সান তোমে বসবাসকারী ব্যবসায়ীরা ইংরেজ অঞ্চলে চলে এল। পর্তুগিজ ও পুলিকটের ডাচরা সতর্ক দৃষ্টিতে মাদ্রাজের কাজকর্ম দেখছিল, কিন্তু সেদিক থেকে কোনও আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। ব্যান্টামের ব্যাবসায় মাদ্রাজ অপরিহার্য হয়ে উঠল। এক ফরাসি কাপুচিন পাদরি এফ্রায়িম দ্য নিভের্স ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট নির্বিশেষে সকলের হিতার্থে এক চার্চ খুলে বসলেন। এমনকী প্রথম যুগের এক স্প্যানিশ পর্যটক লিখলেন মাদ্রাজের আবহাওয়া বড় মনোরম। আজকের দিনে চেন্নাইয়ের বীভৎস গরমে ঘামতে ঘামতে এর মানে বোঝা কঠিন।

তবে ডে রেহাই পেলেন না। ১৬৪১ সালের গ্রীষ্মে ডে-র তলব পড়ল লন্ডনে। অনেক জেরা ও হম্বিতম্বির পর ডে-কে ফেরত পাঠানো হল, সঙ্গে একতাড়া কাগজপত্র, সেই কাগজে মাদ্রাজের কারখানা মঞ্জুর করে দুর্গবাবদ অনাবশ্যক খরচখরচার জন্যে ডে-কে বকাবকি করা হয়েছে। ১৬৪২ সালে মসুলিপতনমের অফিস উঠে এল মাদ্রাজে। এই প্রস্তাবের পেছনে ডে-র বড় সমর্থক ছিলেন অ্যান্ড্রু কোগান, মসুলিপতনমের কর্তা ও ‘লন্ডনে ক্ষমতাশালী লোক’। ১৬৫৬ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজ ব্যান্টামের অধীনে ছিল। সেই সম্পর্কও শেষ হয় ১৬৫৭ সালে। তার অনেক আগেই ১৬৪৫ সালে ডে ফিরে এসেছেন ইংল্যান্ডে। ১৬৭০-এ মৃত্যু পর্যন্ত পরবর্তী পঁচিশ বছরে তাঁর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় না।

সুরাট ও মসুলিপতনমে ইংরেজদের ছিল শুধু বাস করা ও ব্যাবসা করার অধিকার। মাদ্রাজে তারাই জমির মালিক, তারাই রাজা। মালিকানা খুব ছোট্ট একটা ভূখণ্ডের এবং সেও খুব পাকাপাকি মালিকানা নয়। তা হলেও তফাতটা বিরাট। এই ছয় বর্গমাইল অঞ্চলের সুরক্ষার জন্যে অফিসাররা সীমানা বরাবর দেওয়াল তুলল আর সৈন্যসামন্তর সংখ্যা বাড়াল। নিয়মমাফিক কোম্পানির লন্ডনের কর্তারা আবার এইসব বেহিসেবি খরচের কড়া সমালোচনা করলেন। গোয়া বাদ দিলে ভারতের মাটিতে প্রথম ইউরোপীয় শহর গড়ে উঠল। দেওয়ালের বাইরে ছিল কারিগর ও নানারকম আধা- শহুরে বৃত্তিজীবীদের পাড়া। পরবর্তী কালে দেওয়ালের ভিতর ও বাইরের জগৎ দুটোর পরিচিতি হল সাদা ও কালো শহর নামে। উপনগরের বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বিপুল সংখ্যায় কারিগর, যারা প্রধানত তামিল, এবং বেশ কয়েক ঘর পয়সাওয়ালা তেলুগু ব্যবসায়ী। ১৬৭০-এ জন ফ্রায়ারের বর্ণনায় এদের নাম খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টান শহর। প্রায় সমসাময়িক টমাস বাওরির হিসেবে, দুই শহরের মিলিত জনসংখ্যা ছিল ৪০,০০০। সংখ্যাটা উত্তর ভারতের লাহোর-দিল্লি-আগ্রার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও, পুরোপুরি সামুদ্রিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশালী শহর হিসেবে গৌণ নয়।

করমণ্ডল উপকূলে ইউরোপীয় বাণিজ্য মাঝেমাঝেই দেশি রাজাদের বিবাদে জড়িয়ে পড়ত। না পড়লেও দেশি ঝগড়ার প্রভাব পড়ত বিদেশি ব্যবসায়। যে চন্দ্রগিরি নায়কদের কাছ থেকে ইংরেজরা মাদ্রাজ কিনে নেয় তাদের মধ্যে গৃহবিবাদ চলে ১৬৪০-এর দশক জুড়ে। গোলকোন্ডা ও বিজাপুরের সুলতান আর মাদুরা, তাঞ্জোর আর জিঞ্জি-র নায়করা দাক্ষিণাত্যের এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করার জন্যে মাঝেমাঝেই লড়াই লাগাত। কোচিন-পুলিকটের ডাচরা ও মাদ্রাজের ইংরেজরা কাকে সমর্থন করে বিপদে পড়বে এই ভয়ে গা বাঁচিয়ে চলত।

১৬৪৬ সালে মোগল সেনাধ্যক্ষ মীরজুমলা দক্ষিণে এসে উপস্থিত হলেন। মাদুরার নায়কদের হারিয়ে যেখানে ঘাঁটি গাড়লেন মাদ্রাজ থেকে সেটা দু’দিনের রাস্তা। কয়েক দিন কোম্পানিকে ভয়ে ভয়ে রেখে মীরজুমলা মাদ্রাজে ইংরেজ অধিকার মেনে নিয়ে ফিরে গেলেন। হয়তো তাঁর নিজের বাহিনীতে ইংরেজ গোলন্দাজদের অবদানের কথা মনে পড়েছিল। হয়তো প্রথম জীবনে নিজের ব্যাবসা করার স্মৃতি ফিরে এসেছিল। এটাও মানতে হবে যে ততদিনে মাদ্রাজে দেওয়াল উঠেছে। বাহিনীও নেহাত ফেলনা নয়। শহর আক্রমণ করলে অযথা ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে!

ব্রিটেনের নিজস্ব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও মাদ্রাজের সামনে কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করে। ১৬৬৫ সালে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড উইন্টার ঠিক করলেন নৌবল বাড়ানো জরুরি। আবার একদফা খরচ হবে ভয়ে লন্ডনের ডিরেক্টররা সাবধানী জর্জ ফক্সক্রফটকে প্রেসিডেন্ট করে মাদ্রাজে পাঠাল। ফক্সক্রফট তাঁর ছেলে ন্যাথানিয়েলকে সঙ্গে করে যখন এসে পৌঁছলেন, তাঁকে উইন্টারের দলবল প্রায় অগ্রাহ্য করল। একদিকে রাজার সমর্থক ‘রয়ালিস্ট’, অন্যদিকে ‘লেভেলার’। ন্যাথানিয়েল আগে থেকেই দ্বিতীয় দলের সদস্য। দুই দলের লড়াইয়ে ফক্সক্রফটকে জেলে যেতে হল। পরের তিন বছর উইন্টারই মাদ্রাজের কর্তা রইলেন আর কোম্পানির লন্ডন অফিস তাঁকে সরানোর চেষ্টা

চালাতে লাগল। অবশেষে ১৬৬৮ নাগাদ একদল নৌসেনা মাদ্রাজে আসছে খবর পেয়ে উইন্টার-গোষ্ঠী ক্ষমতা ছাড়ল। রাজার নিযুক্ত তদন্ত কমিটির সামনে উইন্টার-গোষ্ঠী জানাল যে তারা রাজার সমর্থক, মাদ্রাজ রাজার সম্পত্তি, তারা রাজার সম্পত্তি রক্ষার জন্যে লড়ছিল। ১৬৭২ সালে উইন্টার ও ফক্সক্রফট ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে মামলার শেষ হল। তবে বিদ্রোহীর কোনও সাজা হয়নি।

বম্বে

১৬৬১ সালে ইংরেজ-পর্তুগিজ শান্তিপ্রচেষ্টা চরম সাফল্য পেল। দ্বিতীয় চার্লস ও পর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথারিনের মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ পাকাপাকি হল। ঘটকালির পেছনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ছায়া পড়েছিল। ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও ডাচদের সঙ্গে পর্তুগিজদের কোনও সমঝোতা হয়নি। ১৬৫৬ সালে ১৭০ বছরের পর্তুগিজ শাসন অপসারণ করে ডাচরা সিংহল দখল করে। এবার কি গোয়ার পালা? কোম্পানির দুশ্চিন্তা যে সুরাট, হুগলি, বালেশ্বর— মাদ্রাজ বাদ দিলে সর্বত্র— তাদের ব্যাবসা বড় বেশি স্থানীয় রাজা ও নবাবদের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করার উপায় নেই, শত্রু ও প্রতিযোগীদের কথা তো দূরের ব্যাপার। কিছু দিন কথা হয়েছিল কোঙ্কনের রাজাপুরে (বর্তমানে রাজাপুরি আমের জন্যে বিখ্যাত) দুর্গ গড়ে তোলা হবে। তখন রাজাপুর সিদি নাবিকদের দখলে। কিন্তু রাজাপুর গোয়ার বেশি কাছে। সিদিদেরও বিশ্বাস নেই। সমস্যার সমাধান নিয়ে এল দুই রাজপরিবারের মধ্যে বিয়ে। এবার যৌতুক আদানপ্রদানের পালা। দ্বিতীয় চার্লস যৌতুক পেলেন বম্বে (বা বাসেইন) দ্বীপপুঞ্জ, এবং সাত বছর পরে তা কোম্পানির হাতে তুলে দিলেন। একসাথে বন্দর ও দুর্গ হাতে চলে এল।

বম্বের হস্তান্তরণ কোম্পানির ব্যাবসায় কোনও তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেনি। বরং বম্বে শহরে নিজেদের শাসন কায়েম করতে কোম্পানিকে হিমশিম খেতে হয়। যে কয়েক ঘর পর্তুগিজ সেখানে বাস করছিল তারা ইংরেজদের যথাসাধ্য বাধা দেয়। আর যেসব ইংরেজ রয়ালিস্টরা ১৬৬১ থেকে ১৬৬৬ সালের মধ্যে বম্বেতে আস্তানা গেড়েছিল তারাও কোম্পানি- শাসন চায়নি। পর্তুগিজদের ভয়, দীর্ঘদিন ধরে যে জমিজমা তারা ভোগ করেছে তা হাতছাড়া হবে আর করব্যবস্থা বদলে যাবে। বম্বের অদূরে আরব সাগর বেশ বিপদসংকুল, একদিকে মালাবার অন্যদিকে দিউ জলদস্যুদের ঘাঁটি। বম্বে কোম্পানির হাতে আসায় ডাচরা মোটেও খুশি নয়। মোগলকর্তাদের কেউ কেউ এই অঞ্চলে মোগল আধিপত্য বিস্তারের পক্ষপাতী। এদিকে দাক্ষিণাত্যে মোগল-মারাঠা যুদ্ধ চলছে। শিবাজীর টাকার দরকার, সুরাটে অঢেল টাকা ও সেখানে লুঠপাটের তোড়জোড় চলছে। বম্বে কতদিন রক্ষা পাবে?

দু’জন দূরদর্শী ও কর্মঠ নেতা— জর্জ অক্সেন্ডেন (১৬২০-৬৯) ও জেরাল্ড অঞ্জিয়ের (১৬৩৫-৭৭)— এই অনিশ্চয়তা কাটাতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অক্সেন্ডেন কেন্টের এক সমৃদ্ধ পরিবারের সন্তান, বারো বছর বয়েসে এক পাদরির সহকারী হয়ে ভারতে আসেন। বুদ্ধিমান, চটপটে, আর হিন্দুস্তানি ভাষার উপর অসামান্য দখল, এইসব গুণের জন্যে সুরাটে চাকরি পেতে দেরি হয়নি। ১৬৪১ সালে অক্সেন্ডেন সুরাটে সামান্য পুঁজিতে ব্যাবসা আরম্ভ করলেন। পরবর্তী কুড়ি বছর সুরাটের হয়ে নানারকম কূটনীতিক কাজকর্মে কেটে যায়। অবশেষে ১৬৬১ সালে সুরাটের প্রেসিডেন্ট পদ যখন তাঁকে দেওয়া হল তখন বম্বের ঝামেলা চরমে।

১৬৬৪ সালে অক্সেন্ডেন তাঁর জীবনের সবথেকে কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনাসামনি হলেন। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠাবাহিনী সুরাটে এসে পৌঁছল। শিবাজী শহর দখল করতে আসেননি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা নিতে এসেছেন। কোম্পানির কোষাগার ও গুদামই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। কোম্পানির ফ্যাক্টর ও কর্মচারীরা জমায়েত হয়ে এমন সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ চালাল যে ইতিহাসে প্রথম বার মোগলদের দেখা গেল ইংরেজদের সামরিকশক্তির উপর নির্ভর করতে। অক্সেন্ডেন এই ঘটনার নেতৃত্ব দিলেন। পরের দু’বছরে বম্বের অধিকার গ্রহণ করাতেও অক্সেন্ডেন ভরসা। বম্বে অধিগ্রহণের দু’বছর বাদে ১৬৬৮ সালে অক্সেন্ডেন সুরাটেই মারা যান।

১৬৬৯ সালে অক্সেন্ডেনের মৃত্যুর পরে অঞ্জিয়ের প্রথমে সুরাটের প্রেসিডেন্ট ও পরে বম্বের গভর্নর হলেন। আইরিশ পাদরি পরিবারের সদস্য অঞ্জিয়ের কোম্পানির চাকরি নেন ২৬ বছর বয়েসে, ১৬৬১ সালে। সুরাটের ফ্যাক্টরের কাজ। সাত বছর এই কাজ করার পরে দ্রুত পদোন্নতি হয়। পশ্চিম ভারতের রাজনীতি অঞ্জিয়ের বুঝতেন ভাল, তাই সুরাট কাউন্সিলের দুই নম্বর হয়ে বসলেন। গভর্নর থাকাকালীন অঞ্জিয়েরই বম্বে প্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করে দিলেন। গঠিত হল আইন-আদালত, জমির মালিকানা সংক্রান্ত নিয়মকানুন ও করব্যবস্থা। শহর চালাবার জন্যে তৈরি হল পরামর্শসভা, যাতে সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নেওয়া হল। প্রথম টাউন প্ল্যান, সমুদ্রের তীরবর্তী জমি উদ্ধার, এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা হল। সুরাট থেকে পশ্চিম উপকূলে কোম্পানির ব্যাবসার কেন্দ্র নিয়ে আসা হল বম্বেতে। ১৬৮৪ সালে অঞ্জিয়েরের মৃত্যুর সাত বছর পরে এই ব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী ফলাফল বোঝা গেল।

১৬৭৮ নাগাদ বম্বের নৌবাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন রিচার্ড কেইগউইন, কয়েক বছর আগে ডাচদের সঙ্গে যুদ্ধে সেন্ট হেলেনায় ইনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কয়েক বছর ধরে মারাঠারা পশ্চিম উপকূলে নৌবাহিনী তৈরি করতে চেষ্টা চালাচ্ছিল। এই প্রচেষ্টা বম্বের মহা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কেইগউইন স্থির করলেন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ধরে নেওয়াই ভাল। ১৬৭৯ সালের অক্টোবরে যখন আক্রমণ হল তখন বম্বের বাহিনী ভালই প্রস্তুত।

মুশকিল হল কেইগউইন তার আগে থেকেই কোম্পানির সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছেন প্রতিরক্ষা খাতে অনেক টাকা খরচ করে। কোম্পানিও কেইগউইনকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্ডার জারি করেছে। যথারীতি তদন্ত হল। কেইগউইন জোরালো যুক্তি দিয়ে নিজের পক্ষ সমর্থন করতে পারলেন ও ক্যাপ্টেন-জেনারেল পদ পেয়ে জাঁকিয়ে বসলেন। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার খরচ নিয়ে গন্ডগোল। এবার কোম্পানি কিছু করে বসার আগেই কেইগউইন প্রচার করলেন বম্বে কোম্পানির জমিদারি নয়, রাজার উপনিবেশ ও তিনি এই উপনিবেশের কর্তা।

এই প্রস্তাবে যে বম্বের অনেক নাগরিকের জোরালো সমর্থন ছিল তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ‘বিদ্রোহী’ দলের অনেকেই ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী, আরও অনেকে ফের মারাঠা আক্রমণ হতে পারে এই ভয় পোষণ করত। এই দুই দলের কেউ-ই কোম্পানির মামলা লড়তে রাজি নয়। ফলে কার্যত ১৬৮৪ সাল পর্যন্ত বম্বে প্রশাসনের রাশ বিদ্রোহীদের হাতেই রইল। সেই বছর সুরাটের কর্তা জন চাইল্ড মিটমাটের রাস্তা খুঁজতে বম্বে এলেন। নানা কারণে লন্ডনে চাইল্ডের খুব সুনাম ছিল না। শেষ পর্যন্ত কেইগউইন যখন ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন, তাঁর ভাগ্যে জুটল রাজার সাদর সংবর্ধনা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজগামী ফ্রিগেটের ক্যাপ্টেন পদ।

কলকাতা

বাংলার মাটিতে রাল্ফ ফিচের পদার্পণের পুরো পঞ্চাশ বছর বাদে কোম্পানি বাংলায় প্রবেশ করে। বাংলা বিদেশে কাপড় রপ্তানির জন্যে অনেক দিক দিয়ে উপযুক্ত জায়গা। সুতির কাপড় এখানে অপর্যাপ্ত, সমৃদ্ধ শিল্প, অনেক রকম কাপড় সস্তায় পাওয়া যায়। কাপড়ের দাম কম হওয়ার কারণ চাষবাসের অবস্থা ভাল ও খাবারের দাম অপেক্ষাকৃত কম। গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলের বিশাল বিশাল নদীগুলি ধরে মাল নিয়ে যাওয়া কম খরচের। বাংলার উপকূল অনেক দিন ধরেই আরাকান, বর্মা, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করে চলেছে। জলের অভাব বিশেষ নেই, অন্তত দক্ষিণবঙ্গে। সব দিক দিয়েই এখানে কারখানা খোলার যুক্তি অকাট্য। প্রথম বাংলামুখী অভিযান ১৬৩৩ সালে উড়িষ্যার উপকূলে বালেশ্বরে একটা ছোটখাটো গুদাম প্রতিষ্ঠা করে শেষ হয়। পরবর্তী সফল পদক্ষেপ পড়ল কুড়ি বছর বাদে ১৬৫৬ সালে গ্যাব্রিয়েল বাউটন নামে এক ডাক্তারের মধ্যস্থতায়।

কথিত আছে যে, রাজকুমারী জাহানারা— তখন বয়েস তিরিশ ও অন্দর মহলের প্রধান— সন্ধ্যার সময়ে বাবার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে নিজের মহলে যখন ফিরছিলেন তখন তাঁর সুগন্ধি মসলিন কাপড়ের প্রান্ত প্রদীপে লেগে গায়ে আগুন ধরে যায়। সঙ্গের সখী ও দাসীরা রাজকুমারীকে বাঁচাতে গিয়ে আগুন আরও ছড়িয়ে দিল। দু’জন মারাও গেল। জাহানারা প্রাণে বাঁচলেন, কিন্তু কোনওক্রমে। সুস্থ হয়ে ওঠার আশা খুবই কম। পরের কয়েক মাস রাজকুমারী শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন, অনেকেই ধরে নিলেন এটাই মৃত্যুশয্যা। এই ক’মাস সম্রাট শাহজাহান দিনরাত মেয়ের পাশে বসে, উদ্বেগে পাগলের মতো অবস্থা। ঠিক কী ভাবে জাহানারা সুস্থ হয়ে উঠলেন তা নিয়ে নানান গল্প আছে। হয়তো বাবার আকুল প্রার্থনা শুনে ঈশ্বর নরম হলেন। আর একটা মতে গ্যাব্রিয়েল বাউটনের ডাক্তারিতে শেষ পর্যন্ত কাজ হয়।

বাউটন ১৬৪৫ সাল থেকে মোগল প্রাসাদের খাস ডাক্তার হয়ে ছিলেন এবং অবশ্যই জাহানারার চিকিৎসায় তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজকুমারী সুস্থ হলে শাহজাহান যখন পারিশ্রমিক দিতে চাইলেন তখন বাউটন চাইলেন বাংলায় কোম্পানির কারখানা তৈরি করার অনুমতি। এই গল্প নিয়ে কিছু সংশয় আছে, তবে কারখানার প্রাথমিক কথাবার্তায় বাউটনের হাত থাকতে পারে। শাহজাহান এ নিয়ে কোনও আপত্তি তোলেননি। বরং ১৬৩২ সালে পর্তুগিজদের হুগলি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরে দক্ষিণবঙ্গে বিদেশি ব্যাবসায় যে ফাঁক তৈরি হয় সেটা পূরণ করতে পেরে খুশি হয়েছিলেন বলে মনে হয়। হুগলিতে প্রথম কারখানা তৈরি হওয়ার পরে পরেই পাটনা ও কাশিমবাজারেও কারখানা ও বালেশ্বরে ব্যাবসা বাড়ল।

১৬৬০ থেকে ১৬৮০-র মধ্যে বাংলায় কোম্পানির ব্যাবসা দ্রুত বাড়তে থাকে। এর পিছনে বড় অবদান দুটো পণ্যের, ঢাকাই কাপড় ও বিহারের সোরা। কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে বাংলায় ব্যাবসা করার উপায় ছিল না। করমণ্ডলে এমনকী সুরাটেও সাম্রাজ্যের খবরদারি হয় অনুপস্থিত, নয়তো একটু দূরের ব্যাপার। কিন্তু বাংলা মোগল সাম্রাজ্যের প্রধান রাজ্য। বাংলার শাসকরা সম্রাটের সবথেকে কাছের ও সবথেকে বিশ্বাসভাজন। এদের একজন মীরজুমলা। ১৬৫৭ সালে মীরজুমলা বাংলার শাসক, নিজেই বেশ কয়েকটা বাণিজ্য জাহাজের মালিক। কোম্পানি ঋণের দায়ে একটা ভারতীয় জাহাজ আটক করাতে তিনি খেপে গেলেন। সেসময় উত্তর ভারতে বিদ্রোহ দমনে মীরজুমলার ডাক পড়লে ফাঁড়া কেটে গেল। তবে কোম্পানির শিক্ষা হল।

বাংলায় ব্যাবসা করার আরও বড় বাধা ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা। কোম্পানি যে কারণে বাংলায় আসে, একই কারণে বহু ইউরোপীয় ভাগ্যসন্ধানীও এ দেশে চলে আসে। কাশিমবাজার ও হুগলিতে তাদেরও গুদাম। মোগল নবাব কোম্পানির পক্ষ নিয়ে এদের বাধা দেবে কেন? বরং শক্তিশালী সরকার থাকায় এরাও দরবারে প্রতিপত্তি তৈরি করার জন্যে চেষ্টা করে চলেছে। ১৬৭০-এর দশকে এদের কয়েক জন নবাব শায়েস্তা খানের দরবারে আর্জি জানাল তারা কোম্পানির অনুরূপ শর্তে ব্যাবসা করতে চায় ও কোম্পানির থেকে বেশি হারে কর দিতে রাজি। শুল্ক বিভাগের কর্তা বালচন্দ্র দাস এদের প্রতি প্রসন্ন। কথাবার্তা আশানুরূপ হওয়ায় এরা বুক ফুলিয়ে কোম্পানির একচেটিয়ার তোয়াক্কা না করে ঢাকা-হুগলির মধ্যে মাল নৌকা চালাতে লাগল। কোন এক ক্যাপ্টেন অ্যালিকে দেখা গেল সুসজ্জিত ও সশস্ত্র নৌকায় চড়ে ‘টকটকে লাল রঙের ফিতে বাঁধা জামা পরে’ ঘুরতে, পরিচয় বালচন্দ্র দাসের বন্ধু।

১৬৮২ সালে অবস্থা ঘোরালো হয়ে ওঠে। সে বছরেই কোম্পানি উইলিয়াম হেজেসকে বাংলার অফিসের কর্তা করে পাঠায়। হেজেসের প্রধান দায়িত্ব ব্যক্তিগত ব্যাবসা দমন করা আর শায়েস্তা খানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করা। নবাবের কাছ থেকে যে চুক্তিপত্র পাওয়া যেত তাতে কী হারে বাণিজ্য শুল্ক দেওয়া হবে লেখা থাকত, সাধারণত দামের সাড়ে তিন শতাংশ। কিন্তু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি সেই শুল্ক দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি এড়ানোর চেষ্টা করত। এই মনোভাবের পিছনে দুটো জিনিস কাজ করত। এক, দেয় শুল্ক কিছুটা অবশ্যই নির্ভর করত যুদ্ধ-বিদ্রোহ ইত্যাদি অপ্রত্যাশিত ঘটনার উপরে। অর্থাৎ অনিশ্চয়তার অজুহাতে অল্পবিস্তর দরকষাকষি করা যেত। আর দুই, ছয় লক্ষ পাউন্ড দামের মালের উপর যদি ২১,০০০ পাউন্ড সরকারের পাওনা হয়, ‘তার অর্ধেক টাকা খরচ করে’, অর্থাৎ ঘুষ দিয়ে কোনও রকম সমঝোতায় পৌঁছতে পারলে সকলেরই লাভ। অন্তত হেজেসের উপর কোম্পানির এ রকমই নির্দেশ রইল।

লন্ডনের নির্দেশ সম্ভ্রান্তদের ঘুষ দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের রাস্তা থেকে সরাও। কিন্তু সেই খেলা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরাও খেলতে ওস্তাদ। মাঝখানে রেফারি শায়েস্তা খান। বয়েস আশি, কয়েক দিন পরেই দীর্ঘ ও গৌরবজনক কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে বাংলা থেকে বিদায় নেবেন। তাঁর কী দায় পড়েছে এই ঝগড়ায় যোগ দেওয়ার? কিন্তু তিনি দুষ্টুমির লোভ সামলাতে পারলেন না। দুই দলের আবেদনই মন দিয়ে শুনলেন, দুই দলের কাছ থেকেই উপহার নিলেন। কিন্তু কাউকেই কিছু দিলেন না। শেষ পর্যন্ত ‘ভীমরতিগ্রস্ত বুড়োটার’ কাছ থেকে হেজেস কোনও সাহায্যই পেলেন না।

বলাই বাহুল্য, হেজেসের চাকরি বেশি দিন টেকেনি। লন্ডনের ডিরেক্টররা এককালে তাঁকে ‘আমাদেরই একজন’ আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু বাংলার রাজনীতির ধাঁচ আন্দাজ করা হেজেসের পক্ষে সহজ হয়নি। রাজনীতির ব্যাপারে সবথেকে ঝানু লোক তখন বাংলায় একজনই, নাম জোব চার্নক (১৬৩০-৯৩)। চার্নক কোম্পানির চাকরি করছেন তিরিশ বছর ধরে, প্রথমে হাজিপুর ও পরে পাটনায় সোরার কারবারে। পাটনায় চার্নক এক হিন্দু বিধবাকে সহমরণের চিতা থেকে জোর করে উঠিয়ে এনে বিয়ে করেন। এঁদের তিনটে সন্তান হয়। পাটনায় বাস করার সময়েই চার্নক ভারতীয় পোশাক পরা অভ্যাস করেন ও স্বচ্ছন্দে ফারসি ও হিন্দুস্থানি বলতে শেখেন। ১৬৬৯ সালে চার্নক চলে এলেন হুগলিতে, কারখানার পাঁচ নম্বর হয়ে। ১৬৮৫ সালে তাঁর স্থান দুই নম্বরে, হেজেসের ঠিক নীচে।

নবাবি দরবারের সঙ্গে কী করে বোঝাপড়া করতে হয় এ ব্যাপারে চার্নকের নিজস্ব ধ্যানধারণা ছিল। সেই সুবাদে বলতে গেলে হুগলিতে তিনিই প্রধান। আবার কাশিমবাজারের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভাল। কাজেই হেজেসের পথ অনুসরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কোম্পানির ডিরেক্টররা অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে হেজেসকে সরালেন। কিন্তু তাঁরা অন্যদিকে একটা মারাত্মক ভুল করে বসলেন। মোগলসম্রাটের সঙ্গে পাকা চুক্তি হয়ে আছে। শায়েস্তা খান কোন সাহসে সে চুক্তি ভাঙবে? এ রকম একটা ধারণা থেকে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন নবাবকে ভয় দেখাতে। চার্নক যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, কিন্তু যুদ্ধ দেখতে দেখতে তাঁর ঘাড়ের উপর এসে পড়ল।

১৬৮৬ সালে যুদ্ধ আসন্ন এই ভয় থেকে লন্ডনের পাঠানো সৈন্যরা হুগলিতে এসে পৌঁছল। মাদ্রাজ থেকে আরও কয়েক ডজন যোদ্ধার আসার কথা। এই তিন- চারশো সৈন্য ৪০,০০০ নবাবি সৈন্যের মোকাবিলা করবে? প্রাণ রক্ষা করে পলায়নই শ্রেষ্ঠ পন্থা। কিন্তু পালানো কোন দিকে? চার্নক প্রথমে দেশি নৌকা বোঝাই করে অসামরিক লোকজন ও কোম্পানির সম্পত্তি পাঠিয়ে দিলেন নদী বরাবর দক্ষিণ দিকে, অর্থাৎ মোহানার দিকে। তারপর সৈন্যদের নিয়ে নিজেও সে দিকেই চললেন।

নদীর ধারে সুতানুটি গ্রামের কাছে নবাবের সৈন্যরা কোম্পানির সৈন্যদের ধরে ফেলল। মোগল কামানের গোলা রোগে ভোগা বুভুক্ষু সেপাইদের কচুকাটা করতে লাগল। সব যখন যায় যায় তখন অকস্মাৎ সন্ধির প্রস্তাব এল। চার্নক মহানন্দে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। কেন মোগল সেনাধ্যক্ষ এদের কোণঠাসা করে ছেড়ে দিলেন সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। বোধহয় ইংরেজদের সৈন্যবল নিয়ে তাঁর কাছে ভুল খবর এসেছিল। হয়তো দক্ষিণবঙ্গের জলাজমিতে যুদ্ধ করা মোগলদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল না। সে যাই হোক, সন্ধির আলোচনায় চার্নক একটাই শর্ত রাখলেন, দক্ষিণবঙ্গে একটা দুর্গ পত্তন করার অনুমতি দেওয়া হোক। শর্ত গৃহীত হল।

চার্নকের স্বপ্ন সার্থক হতে আরও তিন বছর সময় লেগেছিল। এই তিন বছর কোম্পানির বাংলা শাখার জন্যে সুখকর হয়নি। প্রথমে ১৬৮৯-৯০ সালে জলদস্যুদের হাঙ্গামা নিয়ে সুরাটের শাখার সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের গন্ডগোল বাধল, যার জেরে সব শাখাতেই কেনাবেচা কমে যায়। পশ্চিম উপকূলে শান্তি ফিরলে ঔরঙ্গজেব বাংলার সুবাদার ইব্রাহিম খানকে লিখলেন, ইংরেজদের ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, এদের ‘আগেকার সেই জৌলুস’ আর নেই, নিজেদের মতো ছোটখাটো ব্যাবসা যদি চালাতে চায় তো চালাক। অবশেষে চার্নকের সুযোগ এল। ১৬৯০ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজে অস্বস্তিকর নির্বাসন দশা থেকে ফিরে এসে তিনি জমিদারি কেনার ব্যবস্থা করলেন। সুতানুটি ও সংলগ্ন গোবিন্দপুর আর ডিহি-কলকাতা ১৩০০ টাকায় স্থানীয় জমিদার মজুমদারদের কাছ থেকে কিনলেন।

এই বিবাদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লন্ডন বাংলার কাজকর্ম মাদ্রাজের অধীনে রাখতে ও দরকার মতো কখনও চার্নককে ব্যবহার করতে আর কখনও তাঁর পাখা ছাঁটতে চেয়েছে। চার্নক আবার মাদ্রাজের কূটনৈতিক বা সামরিক শক্তির উপরে একবারেই ভরসা রাখতেন না। দুই কারখানার মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাও ছিল। ফ্রান্সিস ডে-র মতোই চার্নকও ঠিক করলেন অনুমতির অপেক্ষা না রেখে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে দেওয়াই ভাল। কলকাতা নির্মাণ শুরু হল। যথারীতি লন্ডন কিছুদিন বাদে দুর্গ নির্মাণে সম্মতি জানিয়ে চার্নককে বাংলার গভর্নর ঘোষণা করল। চার্নক আরও তিন বছর আক্ষরিক অর্থেই বাঁশবনে রাজা হয়ে থেকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

জীবনের শেষ কয়েকটা বছর তাঁর সুখের ছিল না। বহু বছরের পরিশ্রম ও মানসিক চাপের ফল এবার ফলল। চার্নক মনমরা ও ঝগড়াটে হয়ে উঠলেন। কারণে অকারণে চাকরদের মারধোর করতেন। অধস্তন কর্মচারীদের মধ্যে কলহ লাগিয়ে পরম আনন্দ অনুভব করতেন। এই বেসামাল মানসিক অবস্থায় একটাই স্থির বিন্দু হয়ে ছিল বহুদিন আগে চলে যাওয়া ভারতীয় স্ত্রীর স্মৃতি। প্রত্যেক বছর সেই মহিলার মৃত্যুবার্ষিকীতে চার্নক বিহারি স্ত্রীর প্রথা মেনে বিহারি ধাঁচে পূজা করতেন।

কলকাতা হবার আগে ওই জায়গায় ঠিক কী ছিল? ঐতিহাসিকরা এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর দিতে পারেননি। পুরনো বাংলা লেখালেখি থেকে আমরা জানতে পারি যে সপ্তদশ শতাব্দীতে নদীর দু’ধারে বেতোড় ও সুতানুটিতে শীতকালে কাপড়ের হাট বসত। বেতোড়ের হাট পর্তুগিজদের চেনা জায়গা। হয়তো পর্তুগিজদের টাকাও খাটত হাট বসানোর পিছনে। মধ্যবঙ্গে সরস্বতী নদী বুজে যাওয়ায় সপ্তগ্রাম বন্দরের পতনের কিছুকাল পরেই বেতোড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তগ্রাম থেকে পর্তুগিজ জাহাজ দক্ষিণে চলে আসে, কিছু ভারতীয় বণিকও সম্ভবত দক্ষিণে এসে আস্তানা গাড়ে। তবে কোম্পানির প্রবেশের আগে এইসব হাটের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ছিল এমন মনে করলে ভুল হবে। হাট থাকলেও সে হাটের পৃষ্ঠপোষকরা ছিল খুব বেশি হলে সামান্য অবস্থার জমিদার। তা ছাড়া কোম্পানি নিজে কাপড়ের খরিদ্দার হিসেবে দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ের চেয়ে বহুগুণ বড়।

শুরুতে বাঁশবনে ভরা হলেও কলকাতা শহর অত্যন্ত দ্রুত বাড়তে থাকে। মাদ্রাজের মতোই কোম্পানির নিজের পার্টনার কাপড়ের ব্যাপারীরা দলে দলে কলকাতায় বাস উঠিয়ে আনল। নদীর নাব্যতা এখানে হুগলির তুলনায় বেশি, যদিও নদীতে স্রোত ও বিপদও এখানে বেশি। আর মোহানার আরও কাছে হওয়ায় সমুদ্র থেকে জাহাজে কলকাতায় সৈন্য আমদানি করাও সহজ।

কলকাতা পত্তনের ইতিহাসে চার্নকের ভূমিকা বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা স্বাভাবিক। মনে হতে পারে চার্নক অসামান্য রকমের দূরদর্শী ছিলেন, এমনকী পূর্বদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন, তাই বাঁশবনে দুর্গ বানানোর মতো উন্মাদ পরিকল্পনা করতে পেরেছিলেন। চার্নকের এসব গুণ মনে হয় ছিল না। চার্নক নিতান্তই সাধারণ এক চাকুরে। ঘটনাচক্রে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। হাতে সামরিক শক্তি, কূটনৈতিক শক্তি, কর্তৃপক্ষের সাহায্য, কিছুই নেই। এ ব্যাপারে চার্নক একলা নন। ভারতে চাকরিরত অনেক কর্মচারীকেই নিজেদের পিঠ বাঁচানোর দায়িত্ব নিজেদের নিতে হয়। আরও অনেকের মতোই চার্নককেও সংকটকালে নিজেকেই সংকট থেকে বেরবার পন্থা বার করতে হয়।

তবে একটা ব্যাপারে চার্নক সত্যিই বিশিষ্ট ছিলেন। একালে ভারতে ইউরোপীয় বণিকরা গড়ে বেশি দিন বাঁচত না, রোগে ভুগে অল্পবয়েসেই মারা যেত। কাজেই চার-পাঁচ বছর কাজ করে কোনওক্রমে পয়সা জমিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার টান ছিল প্রবল। চার্নক সেই মুষ্টিমেয় পদস্থ কর্মচারীদের একজন যারা ভারতেই শিকড় গাড়ে। চার্নকের ঘরবাড়ি ভারত। পরবর্তী কালে জীবনীকাররা চার্নকের প্রথম যৌবন নিয়ে বিশেষ তথ্য বার করতে পারেননি, যার থেকে মনে হয় ইংল্যান্ডে ফিরে আসার কোনও টান তাঁর কোনও দিনই ছিল না। বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার, অর্থাৎ মাঝেমাঝেই উপরওয়ালার নির্দেশ অমান্য করে কাজ করার জন্যে দরকার ছিল একজন ‘ন্যাচারালাইজ়ড’ ভারতীয়ের। চার্নক ছিলেন সেই রকম ব্যক্তি।

বন্দর-শহর

এই তিনটি বন্দর-শহরের পরিমণ্ডল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ী শহরের সঙ্গে তুলনায় অনেক দিক দিয়েই স্বতন্ত্র ছিল।

প্রথমত এগুলি গড়ে ওঠে সমুদ্রের তীরে, যেখানে বাণিজ্য চললেও এত বড় মাপে নগরায়ন কোনওকালেই হয়নি। নগরায়নের কেন্দ্র বরাবরই ছিল সমুদ্র থেকে দূরে, বিশেষ করে নদীবিধৌত গাঙ্গেয় ও সিন্ধু সমভূমিতে। নদী- তীরবর্তী অঞ্চল আবাদি ভূমি। চাষের জমি থেকে আদায় করা কর সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত্তি। সেই করের উপর বড় শহরের অর্থনীতি নির্ভর করছে। বড় শহর মানে রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের রাজধানী, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। নাগরিক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও কারিগররা এই রাজনৈতিক-সামরিক ব্যবস্থার অঙ্গ, এবং নানাভাবে এই ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। এর সঙ্গে তুলনায় সমুদ্রতটে ব্যবসায়ী শহর যা ছিল তা আকারে অনেক ছোট। অনেক সময়ে মরশুম অনুযায়ী জনসংখ্যা বাড়ত-কমত। আর তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট ও দুর্বল রাজারা। সুরাট ও মসুলিপতনম এই ধাঁচ থেকে আলাদা ঠিকই। তবে এই দুই শহরও দেশীয় রাজ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতির কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি। কেন্দ্র ছিল হাজার মাইল দূরের লাহোর-দিল্লি-আগ্রা-মুলতান বা দক্ষিণে গোলকোন্ডা।

কোম্পানির শহরগুলি এই মডেল থেকে একেবারে আলাদা। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম দেখা গেল সুরক্ষিত বন্দর-শহর, যার ব্যাবসা প্রায় পুরোপুরি বৈদেশিক, যার কর আদায় হয় চাষের জমি থেকে নয়, ব্যবসায়ীদের লাভ থেকে। আর সবথেকে বড় কথা, রক্ষক সরকার নিজেই একটা বাণিজ্যিক সংস্থা, মনসবদার-জায়গিরদার-যুদ্ধবাজ সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা। এই মডেল যে বহু সংখ্যায় ভারতীয় ব্যবসায়ী-কারিগরদের আকৃষ্ট করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ফলে প্রথম থেকেই বম্বে-মাদ্ৰাজ- কলকাতা স্থানীয় ব্যাপারী-কারিগরদের আড্ডা হয়ে উঠছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় যে মাইগ্রেশন অল্প অল্প চলছিল, শতাব্দীর মাঝামাঝি যুদ্ধবিগ্রহের সময়ে তা জোয়ারের আকার নিল। এবার সুরাট থেকে পুঁজি ও কারিগরি দক্ষতা উঠে আসতে লাগল বম্বেতে, মসুলিপতনম থেকে মাদ্রাজে, হুগলি-পাটনা-কাশিমবাজার থেকে কলকাতায়।

অন্যদিকে, এই বন্দর-শহরগুলি কোম্পানির ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা দ্বিতীয় সত্তার পরিচায়ক বলা যায়। ১৬০০ শতকের শেষে বম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতায় শুধু কোম্পানির কারখানা নয়, সুরক্ষিত দুর্গও গড়ে উঠেছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দুর্গ নির্মাণ হয়েছে কোম্পানির লন্ডন ডিরেক্টরদের নির্দেশ ও ইচ্ছা অমান্য করে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে শহর প্রতিষ্ঠা ও নির্মাণে কোম্পানির লন্ডন অফিস বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে ও স্থানীয় কর্তারা উপরওয়ালার বুদ্ধিতে না চলে নিজেদের উপস্থিত বুদ্ধি ও স্থানীয় রাজনীতির হালচাল অনুযায়ী কাজ করেছে। কোম্পানির মধ্যে এই দ্বৈত সত্তা ব্যাপারটা বরাবরই ছিল। কিন্তু প্রথম যুগে দুয়ের মধ্যে অসংগতি ছিল কম। তিনটে কারণে। এক, স্থানীয় কর্মচারীদের পদোন্নতি হওয়ার সুযোগ ছিল বেশি। দুই, কোম্পানির ব্যাবসার পরিধি ছিল ছোট। আর তিন, স্থানীয় রাজনীতির পরিস্থিতি সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মতো ঘোরালো হয়ে ওঠেনি। কোম্পানির লন্ডন অফিস বন্দর-শহর নির্মাণে বাধা দিয়ে অসফল হলে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু দুই সত্তার মধ্যে এখন যে বিভেদের সৃষ্টি হল তার জের সাম্রাজ্য নির্মাণ পর্যন্ত চলেছিল।

কোম্পানির পরিচালনায় এই অসংগতি বেড়ে যাওয়ার পিছনে ইংল্যান্ডের রাজনীতির বড় ভূমিকা ছিল। কোম্পানি চাক বা না-চাক এই তিনটি শহর উপনিবেশ হয়ে উঠছিল। শুধু কারখানা ও দুর্গ যথেষ্ট নয়। এদের রক্ষা করার জন্যে দরকার শাসনব্যবস্থা, আইনকানুন, কোর্টকাছারি, জজ ও পুলিশ। শাসনব্যবস্থার জন্যে অনেক লোকজনের দরকার যাদের সঙ্গে কোম্পানির ব্যাবসার সম্পর্ক কম। তাদের আনুগত্য রাজার প্রতি, কোম্পানির প্রতি নয়। শাসন চালাতে অনেক স্থানীয় লোকজনের সাহায্য দরকার। তারা কোন দেশের নাগরিক? কোম্পানির নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকার আছে কি? তারা তো নিজেরাই ইংরেজ নাগরিক। কাজেই, স্থানীয় শাসক ও সৈন্যদের সামনে রাস্তা ছিল কোম্পানির তোয়াক্কা না করে রাজার নামে শাসন চালানোর।

কোম্পানির ডিরেক্টরদেরও এই রাস্তায় সাবধানে চলতে হত। না চললে রাজদ্রোহের অভিযোগ উঠতে পারে। কারখানার প্রধানদের এককালে বলা হত ‘এজেন্ট’। ইংল্যান্ডে রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলে এদের নতুন নাম হল ‘গভর্নর’। রাজার প্রতীক ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত প্রধান অফিসবাড়িগুলির মাথায়। শহরের প্রশাসন ব্যবস্থা লন্ডনের ধাঁচে তৈরি করা হল। মাথায় থাকবে মেয়র, অল্ডারম্যানরা, জাস্টিসেস অফ পিস। বিশেষ উৎসব- অনুষ্ঠানে এদের আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হবে, সে পোশাকও লন্ডন প্যাটার্নের। রুপোর গিলটি করা রাজদণ্ড হাতে নিয়ে মেয়র বেরবেন রাস্তায়। আদালত তৈরি হল, তাদের নাম মেয়র’স কোর্ট। সেখানে ইংল্যান্ডের ‘কমন ল’ অনুযায়ী বিচারের ব্যবস্থা হল। সেই বিচারের সুবিধা নিত সবথেকে বেশি করে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই। ঐতিহাসিক কনকলতা মুকুন্দ লিখছেন, ‘এই বহুজাতিক ব্যবসায়ী জগৎ ও সমাজ ইংরেজ আইন ও কোর্ট বিশেষ সুবিধাজনক বলে মনে করত।’ কেন তা বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভারতীয়দের নিজেদের ব্যবসায়িক নিয়মরীতি অনেকটাই ছিল সাম্প্রদায়িক। তা এই বহুজাতিক ইন্দো-ইউরোপীয় বৈদেশিক ব্যাবসার উপযোগী ছিল না।

১৬৮৭ সালে রাজার নামে চালানো কোম্পানির রাজত্ব স্বয়ং রাজাকেই ভাবিয়ে তুলল। কোম্পানির ডিরেক্টরদের প্রাসাদে তলব হল। রাজার সঙ্গে এঁদের মধ্যে যে মিটিং হয়েছিল তার বিবরণী পাওয়া যায় মাদ্রাজের গভর্নর এলিহু ইয়েলকে (ইয়েল ইউনিভার্সিটি যাঁর নামে ও টাকায় তৈরি) পাঠানো চিঠি থেকে। রাজা কোম্পানির পরিচালকদের কাছে জানতে চাইলেন মাদ্রাজ ও বম্বে প্রশাসন সংক্রান্ত ঘোষণা ইত্যাদি সরাসরি দরবার থেকে এলেই ভাল হয় না কি? কোম্পানির ডিরেক্টররা এই প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। তবে একটা শর্ত রাখলেন, সব দায়িত্বশীল পদে লোক নিয়োগের ব্যাপারটা তাঁদের হাতে ছেড়ে দিলেই ভাল হয়। আলোচনার পরে ঠিক হল সব জরুরি প্রশাসনিক ঘোষণা রাজার নাম নিয়ে কোম্পানিই করবে। পলিসি সংক্রান্ত একটা বড় সমস্যার এই রকম সমাধান হল। কোম্পানিও একটা বড় রকম জটিলতা থেকে বেঁচে গেল, কারণ রাজাকেই পরের বছর সিংহাসন ছাড়তে হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *