মহাকাশের পালকওয়ালা মানুষ
ভোর চারটে দশ মিনিট, বিমান টাইম।
‘থিটা জিসোল’ সৌরমণ্ডলের একেবারে অন্দরমহলে এখন ‘নিকোলা’। ‘প্লিউমি’ সভ্যতার স্বদেশ যে এটা নয়, তা বিলক্ষণ জানা আছে নিকোলার ক্যাপ্টেনের। প্লিউমি মানে প্লিউম বা পালক পরে যারা বা প্লিউমকে প্রতীক চিহ্নরূপে ব্যবহার করে যারা।
না, ওদের বাসভূমি এটা নিশ্চয়ই নয়। হত যদি, রেডিয়োতে কোনো-না-কোনো ইশারা মিলত ওদের দিক থেকে। হত যদি, আন্তর্গ্রহ চলাচলের কোনো চিহ্ন ধরা পড়ত রাডারে। হত যদি, ওদের রকেটবাজিও চোখে পড়ত এধারে-ওধারে।
না, এ-অঞ্চলে ওরা নেই, আসে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে বলতে হয় নিকোলার এদিকে আসা বৃথা হয়েছে। প্লিউমিদের হদিশ এখানে মিলবে না কিছু। তবু নিকোলা ঘুরছে-ফিরছে এই আকাশে। প্লিউমির খোঁজে নয়, তাদের হাতে-গড়া সীমানাস্তম্ভ এক-আধটা পাওয়া যায় কি না এ-মণ্ডলের কোনো গ্রহে, তারই খোঁজে।
বারো-শো লাইট-ইয়ার* দূরত্ব জুড়ে প্লিউমিদের সীমানাস্তম্ভ ছড়িয়ে আছে, সমস্ত অক্সিজেন-প্রধান গ্রহে। চোঙের মতো গড়ন, উপরের দিকটা খোলা, সেইসব স্তম্ভের ভিতরে থাকে একখানা করে প্লেট। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ব্রোঞ্জের সঙ্গে সিলিকন মিশিয়ে সেসব প্লেট তৈরি। ব্রোঞ্জটা মিশ্র ধাতু বটে একটা, কিন্তু সিলিকন কোনো ধাতু নয়, গ্যাসজাতীয় জিনিস। আমাদের এই পৃথিবীর ভূত্বক গঠনে ওর ব্যবহার হয়েছে, প্রায় অক্সিজেনেরই সমান পরিমাণে।
কোনো কোনো সীমানাস্তম্ভের আশেপাশে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এভাবে হয়েছে— স্তম্ভগুলোর বয়স এক শতাব্দীর কম বলে কোনোমতেই ধারণা করা যায় না। আবার এমন স্তম্ভও চোখে পড়েছে পৃথিবী থেকে সদ্য-আগত বৈমানিকদের, যার গঠন হয়তো দুই-একদিন আগেই সমাপ্ত হয়েছে। পরিস্থিতিটা জটিল। একই ছায়াপথের ভিতরে কী এমন দুটো ভিন্নধর্মী সভ্যতা পাশাপাশি থাকতে পারে, যারা প্রত্যেকেই বিমানযোগে গ্রহনক্ষত্র পর্যটনে সক্ষম?
পারে না যে, তা একদা প্রমাণিত হয়েছিল প্রাচীন পৃথিবীতে। একই মনুষ্যজাতির দুটো শাখা ছিল, দুটোই জানত আগুনের ব্যবহার, দুটোই শিখেছিল অল্পস্বল্প পাথুরে হাতিয়ার চালনার কসরত। ফলে এমন সংঘর্ষ বেধে গেল দুটো শাখাতে যে একটা মরে নির্বংশ হয়ে গেল একেবারে, তাদের শুধু স্মৃতিটুকু এখনও জেগে রয়েছে ‘নিয়ানডার্থাল’ নামের মধ্যে।
মহাব্যোমেও কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে নাকি? এদিকে মনুষ্যজাতি, ওদিকে প্লিউমিজাতি। নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে পাড়ি দেবার মতো মহাবিমানের মালিক দুই পক্ষই। মানুষদের পক্ষে চিন্তাটাই ভয়াবহ। রেস দিচ্ছে দুটো জাতই। জ্ঞানার্জনের রেস। কে আগে গোলে পৌঁছোবে, টিকে যাবে সেই, অন্যটি হবে ধ্বংস।
নিকোলার এই অভিযান সেই কারণেই। সূর্যের দিকে সে চলেছে, থিটা জিসোল-এর সূর্য। অনেক পিছনে একটা বহির্গ্রহকে ফেলে এসেছে, সেটা একদম জমে আছে বরফে। অন্য তিন-তিনটে গ্রহের কক্ষপথ ভেদ করে এসেছে, তাদের মধ্যে তৃতীয়টা ছিল মহাকায় একটা গোলক, আগাগোড়া বাষ্প দিয়ে গড়া তার দেহ, সে-দেহকে ঘিরে ঘিরে ক্ষুদে ক্ষুদে চাঁদ ঘুরপাক খাচ্ছে, অগুনতি। এখন সেটা তিন কোটি মাইল পিছনে। সূর্যটা ঠিক সামনে, দাউদাউ করে জ্বলছে, মহাশূন্যকে পুড়িয়ে মারবার জন্যই যেন।
নিকোলার রাডার ঘরে দৃঢ়পদে পায়চারি করছে জন বেয়ার্ড। লোকটা শান্তিবাদী। মনে মনে এইমাত্র কামনা ওর— প্লিউমিরা যেন মানবজাতির স্বভাববৈরী না-হয়। কিন্তু তা ওরা হবে কী হবে না, কেমন করে বোঝা যাবে, যতক্ষণ-না চাক্ষুষ দেখা মিলছে ওদের? এ-সৌরমণ্ডলে তো দেখা হওয়ার কোনো ভরসা নেই।
অবশ্য প্লিউমির খোঁজে একা যে নিকোলা বেরিয়েছে, তা নয়। আরও অনেকে, অনেক বিমান চষে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সৌরমণ্ডল। কে দেখা পাবে, কে জানে! যে দেখা পাবে, সে আবার কীরকম ব্যবহার করবে প্লিউমিদের সঙ্গে, তাই বা জানে কে! বেয়ার্ডের এ-দুশ্চিন্তা বৃথাই। তার কাজ শুধু কাজ করে যাওয়া। এ-গ্রহপুঞ্জে হল না, নতুন কোনো গ্রহপুঞ্জে যাওয়া যাক। সেখানেও যদি না-হয়—
বেয়ার্ডের সামনে বসে কাজ করছে এক নারী, ডায়েন হোল্ট। বয়সে পঁচিশ, পদমর্যাদায় লেফটেনান্ট। মাথা নীচু করে রাডারের চিত্রলেখ পরীক্ষা করছে একটা। অকারণে নয়। ওর উপরে কাজের ভার পড়েছে গুরুতর, বেয়ার্ডই দিয়েছে ভার। এই সৌরমণ্ডলের যাবতীয় উল্কাপুঞ্জের একটা মানচিত্র আঁকতে হবে, তাতে দেখাতে হবে ধূমকেতুদের বিভিন্ন কক্ষপথ।
মহাশূন্য পরিক্রমার পথে এরা নানা ঝামেলার উৎস। এই উল্কারা আর এই ধূমকেতুরা। যেকোনো সৌরমণ্ডলে পাড়ি জমাবার আগে এদের একটা ম্যাপ সংগ্রহ করা বৈমানিকদের পক্ষে অত্যাবশ্যক। ম্যাপ বানানো সোজা কথা নয়। তবে ডায়েন হোল্টও আনাড়ি অফিসার নয়। কাঁচা বয়সেই মাথা ওর পাকা।
মহাবিমানের ভিতর সর্বত্রই সব কিছু শান্ত, স্বাভাবিক। ইঞ্জিনঘরে অতিমৃদু বোঁ-বোঁ শব্দ একটু, গতি বজায় রাখতে হলে ওটুকু অপরিহার্য। ক্যাপ্টেন কী করছেন? সহকারীদের দৃষ্টির আড়াল হতে পারলে সব ক্যাপ্টেনই সচরাচর যা করে থাকেন, অবশ্যই সেই কর্মই করছেন ইনিও। আর সামরিক অফিসার টেইন? নিজের চিন্তায় মশগুল তিনি।
কন্ট্রোল ঘরে দ্বিতীয় অফিসার প্রত্যেকটা যন্ত্রের দিকে একবার করে চোখ ফেরাচ্ছেন, পাঁচ মিনিট পরে পরে। চারিদিকে পর্দা ঝুলছে, মুহুর্মুহুঃ প্রতিফলিত হচ্ছে ছবির পরে ছবি, মহাকাশের চেহারা কখন কোন দিকে কীভাবে বদলাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তা ধরা পড়ে যাচ্ছে সেই ছবির ভিতরে। এগুলির দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখাও ওই দ্বিতীয় অফিসারেরই কাজ। ভৃত্যেরা ব্যস্ত বিগত ভোজের উচ্ছিষ্ট সরাতে, পাচকেরা ব্যস্ত আগামী ভোজের আয়োজনে।
রাডারের স্বচ্ছ চিত্রলেখটা বেয়ার্ডের হাতে দিয়ে দিল ডায়েন, ‘এইখানটাতে কী একটা গাদা-করা জিনিস দেখতে পাচ্ছি যেন। এটা সেই ধূমকেতুটা হতে পারে, যা একসময়ে ওই কক্ষে ঘুরে বেড়াত। এখন বুড়ো হয়ে ওর সব গ্যাস হারিয়ে বসে আছে, ওর ধূমকেতুত্বই লোপ পেয়েছে বলতে গেলে।’
ভোর চারটে পঁচিশ মিনিট তখন, বিমান টাইম। পাগলা-ঘণ্টি বেজে উঠল সেইসময়। বেয়ার্ডের ঠিক মাথার উপরেই বাজল প্রথম, তারপর বিমানের কোণে কোণে আরও ঢের ঢের ঘণ্টিতে শুনতে পাওয়া গেল তারই তীক্ষ্ন প্রতিধ্বনি। এদিকে-ওদিকে দৌড়োদৌড়ির আওয়াজ, দরজার পরে দরজা বন্ধ হচ্ছে সশব্দে।
একটামাত্রই মানে হতে পারে পাগলা-ঘণ্টির। বিমানের ভিতর প্রত্যেকটা লোকের মনে উত্তেজনার সঞ্চার হল অল্পবিস্তর। কারও মাথার চুলই খাড়া হয়ে উঠল, কারও-বা নিশ্বাসটাই দ্রুততর হল একটু। মেজাজ অনুযায়ী।
কন্ট্রোল থেকে সোজা লাইন আছে রাডার ঘরে। সেই লাইনের পর্দায় ভেসে উঠল ক্যাপ্টেনের মুখ। সে মুখে ভ্রূকুটি। রুক্ষ শোনাল তাঁর ভাষা, ‘মিস্টার বেয়ার্ড! প্লিউমি নাকি? প্লিউমি?’
বেয়ার্ডের আঙুলের টোকায় খটখট করে সুইচ উঠছে আর পড়ছে। রাডারের সমস্ত সরঞ্জাম ঢেলে সাজাচ্ছে সে। চোখা চোখা কথায় জবাব দিল, ‘একটা ঘা লেগেছে স্যার। মানে, লেগেছিল। কেটে গিয়েছে আবার। কেউ দেখতে পেয়েছে আমাদের। রাডারে একটা স্পন্দন টের পেলাম। একটাই মাত্র।’
‘একটামাত্র।’ এই কথাটাই দামি। যেরকম ব্যবস্থা থাকলে ‘একটামাত্র’ স্পন্দনে যথেষ্ট খবর ধরা পড়ে রাডারে, সেটা দস্তুরমতো পাকা ব্যবস্থা। যন্ত্রসংস্থান খুব উন্নত মানের হলে তবেই ওটা সম্ভব হয়। বেয়ার্ড তার সেই যন্ত্রসংস্থানকে এমনভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছে যে, সারা ব্রহ্মাণ্ডের ছবি তার চোখের সমুখে ফুটে উঠবে এক্ষুনি।
এতক্ষণ যে থিটা জিসোলের পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল দৃষ্টি। কিন্তু তার বাইরে যদি কিছুর আবির্ভাব ঘটে থাকে ইতিমধ্যে? ঘটেছেই। তা নইলে ওই যে একটামাত্র স্পন্দন, তা আসে কার তাড়নায়?
কয়েক সেকেন্ড কাটল। সেকেন্ড তো নয়, কয়েক বছর যেন। সারা ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এই পর্যবেক্ষণে যেকোনো দিকের যেকোনো জিনিস ধরা পড়বে। কিন্তু কই? এমন তো কিছুই নতুন দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আগেও যেখানে যা ছিল, এখনও তাই। মহাকায় সেই বাষ্পসম্বল গ্রহটা এখনও পড়ে আছে বহু পশ্চাতে। সূর্যের কোলের দিকে অন্য যে ওই একটা গ্রহ, ও থেকে স্পন্দন এ-পর্যন্ত আসতে কয়েক মিনিটই লেগে যাওয়ার কথা। রাডারে সব খবরই যথাযথ আসছে, কিন্তু নতুন খবর তবু আসছে না কিছু।
কিছুক্ষণ লক্ষ করবার পরে বেয়ার্ড জানাল ক্যাপ্টেনকে, ‘আধ মিলিয়ন মাইলের মধ্যে নতুন কিছু নেই।’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার যোগ করল তার সঙ্গে, ‘পৌনে এক মিলিয়নের মধ্যেও না।’ তার পরেই, ‘না, এক মিলিয়ন মাইলের মধ্যেও নতুন কিছু না।’
ক্যাপ্টেনের কথা তো কথা নয়, যেন বিষদাঁতের কামড়, ‘তাহলে বরং পুরোনো জিনিসগুলোই আর একবার ভালো করে লক্ষ করো।’
তারপর তাঁর স্বর শোনা গেল মৃদু পর্দায়, অন্য একটা মাইক্রোফোনে কথা কইছেন তিনি, ‘টেইন! তুমি সব রকেট তৈরি রাখো। জঙ্গিরা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে টিউবে টিউবে দাঁড়াক। ইঞ্জিন ঘর! আকস্মিক ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য তৈরি থাক। মেরামতি জোয়ানেরা! আকাশি পোশাক পরে মেরামতের যন্ত্রপাতি হাতে নাও—’
তারপর আবার তাঁর গলা শোনা গেল চড়া পর্দায়, ‘বেয়ার্ড! পুরোনো জিনিসে কিছু পেলে?’
ডায়েন বিরক্তভাবে বিড়বিড় করছে। বেয়ার্ড সংক্ষেপে বলছে, ‘সন্দেহজনক একটাই কিছু দেখছি স্যার, তবে তাকেও সন্দেহ করার কারণ কিছু খুঁজে পাই না। একটা জিনিস, যাকে আমরা ধরে নিয়েছিলাম নিঃশেষিত ধূমকেতু বলে, তার দিকে সন্ধানী রশ্মি পাঠাচ্ছি এইবার। এই পাঠালাম—’
ডায়েনই ওকে মৃত ধূমকেতু বলে মত প্রকাশ করেছিল। এইবার দূরসন্ধানী ট্রান্সমিটার সেই বাগিয়ে ধরেছে ওর দিকে। বেয়ার্ড বোতাম টিপে দিয়েছে। সঙ্গেসঙ্গে নানা তথ্যের জটপাকানো এলোমেলো আবর্তনের ভিতর দিয়ে একটা অদ্ভুত ছবি ভেসে উঠল পর্দার উপরে। ভেসে উঠল, যেন মহাশূন্যের ভিতর দিয়ে তিরবেগে এগিয়ে আসছে একটা তালগোল পাকানো বস্তু। এটিই কি সেই মরা ধূমকেতু?
পৃথক পৃথক দিক থেকে রশ্মি ছুটে আসছে— কোনোটা সমান্তরাল, কোনোটা বর্তুল। এখান থেকে ধাক্কা খেয়ে ওসব রশ্মি ফিরে যাবে যখন, ভিতরের তথ্য তখনই হবে উদঘাটিত।
গেল ওরা ফিরে কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই। খবরও মিলে গেল। যে-জিনিসটাকে ভাবা গিয়েছিল উল্কাপুঞ্জের সামিল একটা বৃহদাকার পিণ্ড বলে, এখন দেখা যাচ্ছে, পিণ্ড সেটা মোটেই নয়। কমসে-কম চাররকম আবর্তনের উৎক্ষেপ হচ্ছে ও থেকে, ব্রোঞ্জ ভিন্ন অপর কোনো ধাতু থেকে তা হতে পারে বলে তো জানা নেই। ব্রোঞ্জ সম্ভবত সিলিকন মেশানো ব্রোঞ্জ।
পিণ্ডটা আসলে উল্কাপিণ্ড নয় তাহলে, সিলিকন-ব্রোঞ্জের পিণ্ড একটা। গোল নিটোল অবয়ব তার, মসৃণ কাঠামো। আরও আরও খুঁটিনাটি অবশ্যই নজরে আসবে ক্রমশ।
বেয়ার্ড কথা কইল, তাতে উত্তেজনা কিছু নেই। ‘প্লিউমি বিমান।’
অদৃশ্য ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ করে সে জানাল, ‘প্লিউমি বিমান, স্যার। আমরা সন্ধানী রশ্মি পাঠিয়েছিলাম উল্কাপুঞ্জটার ভিতরে। তাই থেকেই ওরা টের পেয়েছে আমাদের অস্তিত্ব। এখন একটার পরে একটা ছুড়ে মারছে ওদের তরফের রশ্মি, আমাদের কোনো কিছুই আর গোপন থাকছে না ওদের কাছে।’
ক্যাপ্টেনের ছবি ফুটে উঠেছে পর্দায়। তাঁর কপালে ভ্রূকুটি, ‘ক-খানা ওরা? বিমানের বহর নাকি একটা?’
‘পরীক্ষা করে দেখছি, স্যার।’ বলল বেয়ার্ড, ‘এযাবৎ একটার অস্তিত্বই টের পেয়েছি। হয়তো আরও আছে, তারা হয়তো চেপেচুপে রেখেছে তাদের রশ্মি, আমাদের ফাঁদে ফেলার জন্য।’
‘দেখো, শিগগির দেখো কতগুলো আছে।’ খেঁকিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন, ‘যা-কিছু জানা সম্ভব ওদের সম্বন্ধে, চট করে জেনে নাও।’
রাডারের দিক দিয়ে নিকোলা খুবই অগ্রসর। ডায়েন প্রয়োজনমতো ওলটপালট করে ফেলল চোখের পলকে। ওই রহস্যাবৃত উল্কাপুঞ্জটার ভিতরে কিছুই আর অজানা থাকবে না নিকোলার। অজানা থাকলে চলছেও না আর। নিজের অজান্তে নিকোলা কি প্লিউমিদের ঘাঁটিতেই এসে পড়েছে নাকি? তাহলে তো মারাত্মক। প্লিউমিদের মোকাবিলা করার জন্য চব্বিশটা রকেটের টিউব আছে নিকোলাতে। মান্ধাতার আমলে থাকত গোলা ছুড়বার কামান, এখন তাদের জায়গা দখল করেছে রকেট ছুড়বার টিউব। তবু, এ-আকাশ যদি প্লিউমিদেরই নিজস্ব এলাকা হয়, তাহলে বলতেই হবে যে পরিস্থিতিটা মারাত্মক।
ডায়েনের নতুন বন্দোবস্ত মতো কাজ করে চলেছে রাডার। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে খোঁজখবর আসা একদদম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানকার উৎক্ষেপ যন্ত্রটা ক্রমাগত দুলছে, রশ্মির পরে রশ্মি ছুটে বেরুচ্ছে শূন্য প্রান্তর চষে ফেলবার জন্য। দুলছে আর চমক মারছে, দুলছে আর চমক মারছে। রশ্মির পরে রশ্মি, দূরে-নিকটে প্রত্যেকটা জিনিস পরখ করা তাদের কাজ, সিলিকন-ব্রোঞ্জ আর বর্তুল অবয়ব কোথায় পাওয়া যায়। প্রতি ইঞ্চি জায়গায় টোকা দিয়ে দিয়ে ছুটেছে। সময় লাগছে, লাগবেই সময়। যত তাড়াতাড়িই কাজ করুক, ত্রিবিস্তারে পরীক্ষা চালানো তুড়ির কাজ নয়। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বিচারেই নিশ্চিত হওয়া চলছে না এক্ষেত্রে, বিচার করতে হবে ঘনত্বটাও। মহাব্যোমে ত্রিবিস্তার সন্ধান চালানো সহজ নয় এ-যুগেও।
অবশেষে খবর পাওয়া গেল। সিকি-মিলিয়ন মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো সিলিকন-ব্রোঞ্জের বস্তু নেই। অর্ধ মিলিয়ন মাইলের মধ্যেও না। এক মিলিয়ন, দেড় মিলিয়ন, দুই মিলিয়নের মধ্যেও না।
বেয়ার্ড ডাকল কনট্রোলকে, ‘একখানা মাত্রই তো মনে হয় স্যার। অন্তত এটা নিশ্চিত যে দ্বিতীয় একখানা যদি থাকে তো তা এত দূরে আছে, রাডারেও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।’
ক্যাপ্টেনের গলায় ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ, ‘একখানা যখন, চলো আমরা দেখা করে আসি তার সঙ্গে।’ গলার স্বর হঠাৎ বদলে বাঘের গরর-গরে পরিণত হল, ‘টেইন! এখানে চলে এসো, পরামর্শ আছে।’
বেয়ার্ড নিজের মনে মাথা নাড়ল। পছন্দ হচ্ছে না ব্যবস্থাটা। নিকোলার উপর যা হুকুম আছে, তা এরকম নয় যে কোথাও প্লিউমি বিমান দেখতে পেলে বেপরোয়ার মতো তাকে তেড়ে ধরে লড়াই করতে হবে। অলক্ষ্য থেকে পর্যবেক্ষণ করা, সম্ভব হলে আটঘাট বন্ধ করা, বন্দি করা, ধরে নিয়ে আসা— এইসবই নিকোলা-জাতীয় বিমানদের কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে যাতে নিজেদের বিপন্ন হতে না-হয়, সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ রাখার নির্দেশ রয়েছে। অচেনাকে শত্রু বলেই ধরতে হবে গোড়ায়, তা ঠিক। কিন্তু সে-শত্রুকে আক্রমণ করা বা না-করা, এটা স্থির করবার বেলায় নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নকে দিতে হবে প্রাধান্য।
ওই টেইন! টেইনকে ডাকা হয়েছে পরামর্শের জন্য। ও লোকটা হিংস্র, প্লিউমিদের নাম হলেই ও ক্ষেপে ওঠে। স্বভাববৈরী ও প্লিউমিদের। শুধু প্লিউমিই বা কেন, মানবীয় সভ্যতার আওতায় যারা আসেনি, তারা যে-জগতের যে-জাতের জীব হোক না কেন, তাদের ও বিবেচনা করে শত্রু বলে, বধ্য বলে। যুদ্ধ এক্ষুনি বেধে যাবে। অথচ ওই প্লিউমিদের শক্তি বা স্বভাব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই নেই মানুষের। বস্তুত প্লিউমির সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎকারের ঘটনা এই প্রথম ঘটতে যাচ্ছে মহাশূন্যে।
প্লিউমিরা কী? সভ্য জীব যে ওরা, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে এযাবৎ একটামাত্র ব্যাপার থেকে। বারো-শো লাইট-ইয়ারের দূরত্ব জুড়ে বিভিন্ন অক্সিজেননির্ভর গ্রহে ওদের সীমানাস্তম্ভ পাওয়া গিয়েছে। সেসব স্তম্ভে থাকে একখানা করে প্লেট, তাতে দুর্বোধ্য আঁকজোঁক কাটা। আঁকজোঁকগুলো থেকে বড়ো পাখির লম্বা লম্বা পালকের আদল আসে। তাই প্লিউমি আখ্যা ওদের। প্লিউম মানেই তো পালক কিনা!
কিন্তু প্লিউমগুলো আসলে কী? মানুষ তা জানে না। কোনো একরকম লিখন হতে পারে, বা হতে পারে জ্যামিতিক চিত্রাঙ্কন। যাই হোক, অর্থহীন তারা নয়। কিন্তু কী অর্থ?
ভোর পাঁচটা দশ মিনিট, বিমান টাইম।
নিকোলা এর আগে সূর্যের দিকে ছুটছিল, একটা নির্দিষ্ট গতিবেগে। এইবার সে মোড় খেয়ে ঘুরে গেল সে-গতিপথ থেকে। প্লিউমি বিমানকে মুখোমুখি আটকাবার জন্যই। এতক্ষণ প্লিউমিরা উল্কাপুঞ্জের ভিতর আত্মগোপন করেছিল, এখন তারা ধরা পড়ে গিয়েছে। এখন ওদের ধরতে গিয়ে ধরা দিতে হয়েছে নিকোলাকেও। ওরা নিকোলার অস্তিত্বের কথা টের পেয়েছে, জেনেছে একথাও যে তাদেরই সন্ধানে বেরিয়েছে এই গোয়েন্দাবিমান।
জানার পরে? ওদের প্রতিক্রিয়া কী? ওরা কি খুশি হয়েছে অজানা মুলুকের এই অতিথিকে নিজেদের দেশে পেয়ে? ওরা কি একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে করমর্দনের জন্য? মনে তো হয় না। পরস্পরের অবস্থান জানাজানি হওয়ার পরে ওরা আর নিজেদের দিক থেকে একটাও রশ্মির উৎক্ষেপ করেনি। নিজেদের চারদিকে লৌহযবনিকা ফেলে দিয়েছে যেন ওরা। অবশ্যই এগিয়ে আসছে ক্রমশ। নিকোলার পর্দায় সে অগ্রগতি ধরা পড়েছে। কিন্তু মানে কী সে-অগ্রগতির? ওরাও কি তৈরি হচ্ছে শক্তিপরীক্ষার জন্য? টেইনের মতো মারমুখো অফিসার ওদের মধ্যেও আছে নাকি?
ওদের অগ্রগতি খুবই দ্রুত, শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী এই নিকোলারও ঈর্ষার বস্তু সে গতিবেগ। সিকি-মিলিয়ন মাইলের ব্যবধান ওরা গণ্ডুষে গণ্ডুষে পান করে ফেলছে যেন। কমে যাচ্ছে দূরত্ব। পর্দার উপরে যে পিণ্ডটাকে দেখা যাচ্ছিল, সেটা আকার পরিগ্রহ করছে ক্রমশ।
‘যাব আর লড়াই শুরু করে দেব? বর্বরের মতো?’ বেয়ার্ড নিজের মনে গজরায়। নিজেকে সংযত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। কন্ট্রোলকে ডেকে সে ক্যাপ্টেনকে বলল, ‘আপনি যদি অনুমতি করেন, আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা চেষ্টা দেখি। পারলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনই ভালো— একথা তো নিয়ন্ত্রকেরা বলেই রেখেছেন।’
টেইনের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল কন্ট্রোল থেকেই, ‘আমার তাতে আপত্তি আছে। যান্ত্রিক বিদ্যায় আমরা কতদূর অগ্রসর, তা ওদের জানতে দিয়ে লাভ কী?’
‘তা ওরা আগেই জেনেছে।’ জবাব দেয় বেয়ার্ড, ‘আমাডের রাডার, আমাদের রশ্মিক্ষেপণ, সব কিছুই ধরা পড়েছে ওদের চোখে।’
ক্যাপ্টেন তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘পরামর্শও চাই না, তর্কাতর্কিও চাই না। বেয়ার্ড, তোমাকে আমি ওই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। সংকেত করতে পারো ওদের।’
বেয়ার্ডের নির্দেশে ডায়েন ট্রান্সমিটারে টেপ পরিয়ে ফেলল একটা। টেপ খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ডায়েন হেডফোন পরেছে। প্লিউমির দিকে সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছে টেপ। কতকগুলো সংখ্যা। এমন সংখ্যা, যা সভ্য জাতিমাত্রেরই জানা থাকার কথা।
সংখ্যা! এক থেকে পাঁচ। তারপর একে-একে দুই, দুইয়ে-দুইয়ে চার, এইরকম করে এগিয়ে পাঁচে আর পাঁচে দশ। তারপর নামতা। একেক্কে এক থেকে পাঁচ-পাঁচা পঁচিশ। খুব বিজ্ঞোচিত সংকেত নয় অবশ্য, কিন্তু সকলের পক্ষেই সহজবোধ্য হওয়া উচিত এসব।
বেয়ার্ড দাঁতে ঠোঁট কামড়ে রয়েছে। ডায়েন কান খাড়া করে আছে, প্লিউমি থেকে পালটা সংকেত আসে কি না। নাঃ, কিছু না। লৌহযবনিকায় ধাক্কা খেয়ে ফিরছে সংকেত। ওদিকে সিলিকন-ব্রোঞ্জের বর্তুল অবয়বটা দ্রুত অগ্রসর।
ওদিকে ক্যাপ্টেনের আদেশ শোনা যাচ্ছে, ‘ইঞ্জিনঘর বন্ধ করো! জঙ্গিরা আকাশি পোশাক পরে নাও! মেরামতি জোয়ানেরা তৈরি হও!’
তারপর কর্কশ কণ্ঠ টেইনের, ‘জোড় সংখ্যার টিউব সব রাসায়নিক বিস্ফোরক দিয়ে ভরতি করো। বিজোড় সংখ্যায় পারমাণবিক।’
ডায়েন তখনও কান খাড়া করে আছে পালটা সংকেতের আশায়। নাঃ, কিছু না। বরং ওই পর্দায়—
ডায়েন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বেয়ার্ডকে। বেয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেনকে জানাল, ‘ওরা আলাপ আলোচনা চায় না। ছুটে আসছে আক্রমণ করতে। সেকেন্ডে শত শত মাইল বেগে।’
সূর্য উঠেছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে শূন্য কান্তারকে। অতিকায় গ্যাসগ্রহটা অপরূপ সমারোহে ঘুরপাক খাচ্ছে ওই কোণটাতে। সারা গায়ে ক্ষুদে-চাঁদের গয়না পরে। সূর্যের কোল-ঘেষা অক্সিজেন প্রধান গ্রহটাকে দেখা যাচ্ছে একটা অর্ধচন্দ্রের মতো। আলোকিত অর্ধাংশে কখনো ফুটে উঠছে মহাদেশের ছবি, কখনো-বা দ্বীপসংকুল মহাসমুদ্রের। পুঞ্জ পুঞ্জ উল্কা নিজের নিজের কক্ষপথে গা ভাসিয়ে দিয়েছে মৃদুমন্থর পরিক্রমায়।
সকাল ছ-টা পঁয়ত্রিশ মিনিট, বিমান টাইম। দু-খানা বিমান মুখোমুখি এখন। প্লিউমিটাকে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল সোনা-রং একটা চাকার মতন। সামান্য একটু মোড় খেয়ে সে তার গোটা দৈর্ঘ্যটাকেই এগিয়ে দিল নিকোলার আক্রমণের সমুখে। গতিবেগ ওরাও কমিয়ে দিয়েছে, নিকোলাও দিয়েছে। দুটোর মধ্যে ব্যবধান এখন কুড়ি মাইলও নয়। দুঃসাহসী! উভয়পক্ষই!
ক্যাপ্টেন ঘোঁৎঘোঁৎ করে উঠলেন, ‘স্পর্ধা কম নয় তো!’ তারপরই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেয়ার্ড! যোগাযোগ কিছু হয়েছে?’
‘না, স্যার,’ জবাব দিল বেয়ার্ড, ‘ওরা জবাব দেয় না।’
দুটো বিমান সমান্তরাল পথে সূর্যের দিকে ভেসে যাচ্ছে, সেই কুড়ি মাইলেরই ব্যবধান বজায় রেখে। নিকটেও আসে না কেউ, সরেও যায় না দূরে। এ তো অসহ্য! ক্যাপ্টেন আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বেয়ার্ড! খোঁচাও ওদের। একটা জবাব আদায় করো। আমরা কি সারাদিন পরস্পরের দিকে এমনি চোখ পাকিয়ে বসে থাকব?’
‘খোঁচাচ্ছি স্যার, ওরা সাড়া দেয় না।’ বলে বেয়ার্ড।
সাড়া যে কেন দেয় না, সে-সম্বন্ধেও একটা অনুমান আছে ওর। হয়তো ডায়েনের ওই নামতাপাঠকে প্লিউমিরা সংকেত বলেই বুঝতে পারেনি। ‘দুই-এক্কে দুই, পাঁচ-পাঁচা পঁচিশ।’— এরকম ছেলেমানুষি সংকেত যদি নিকোলার মতো একখানা আন্তর্নক্ষত্র বিমান থেকে আসতে শুরু করে, অন্যেরা তাকে স্বভাবতই উপেক্ষা করতে পারে যান্ত্রিক ব্যায়ামেরই রকমফের বলে।
পৃথিবীর নিয়ন্ত্রকেরা বেছে বেছে সংকেতের পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেছেন উত্তম! অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি, একটা কথা আছে না? এ তাই।
সংকেতের এইটিই পদ্ধতি কিন্তু। বেয়ার্ডের অধিকার নেই নতুন কোনোরকম সংকেত উদ্ভাবন করার। এক ক্যাপ্টেন যদি অনুমতি দেন—
সেই কথাই সে বলতে যাচ্ছে ক্যাপ্টেনকে, এমন সময় নিকোলা থেকে বহুকণ্ঠ ঐকতানে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখো, দেখো।’
দেখবার মতোই কিছু ঘটছে বাইরে। বেয়ার্ডকে বাইরে গিয়ে উঁকি দিতে হল না, যা দেখবার, পর্দাতেই সে তা দেখতে পেয়েছে।
দেখতে পেয়েছে প্লিউমির নাচ। হঠাৎ যেন বিমানখানা ক্ষেপে গিয়েছে একদম, শুরু করেছে অন্তরীক্ষপথে এক উদ্দাম আলোড়ন। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-ডিগবাজি খেয়ে, উপর থেকে নীচে, এপাশ থেকে ওপাশে, রুদ্ধশ্বাস তাথৈ নাচন যাকে বলে।
সকাল ছ-টা পঞ্চাশ মিনিট, বিমান টাইম তখন।
সোনালি-রং বিমানখানা নেচে বেড়াচ্ছে, ঝোড়ো হাওয়ায় হেমন্তের হলদে লাল ঝরাপাতার মতো। নিকোলার বৈমানিক, অফিসার সবাই সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এমন সময় টেইনের হুংকার শোনা গেল, ‘জোড় সংখ্যার সব রকেট, ফায়ার!’
ক্যাপ্টেনের অনুমতি না-নিয়েই অর্ডার দিয়েছে টেইন। ক্যাপ্টেন রেগে আগুন। কিন্তু আদেশ নাকচ করার সময় তিনি পেলেন না, তার আগেই ঘর্ঘর ঝনঝন শব্দে ছুটল এক ডজন রকেট। শব্দটা একটু ঝিমিয়ে আসতেই ক্যাপ্টেন ভয়ানক একটা তর্জন ছুড়ে মারতেই উদ্যত হলেন টেইনের মাথায়, কিন্তু তার আগেই তিনি শুনতে পেলেন টেইনের কৈফিয়ত, ‘দেখছেন না, নাচের ফাঁকে ফাঁকে বদমাইশেরা অন্তত চার মাইল এগিয়ে এসেছে।’
রাডারের দিকে তাকিয়ে বেয়ার্ড সত্যিই দেখল, প্লিউমি আগের চাইতে অনেক নিকটে এসে গিয়েছে ইতিমধ্যে। ক্যাপ্টেনকে সেই কথাই সে জানিয়ে দিল, ‘টেইনের কথা সত্যি।’
ওদিকে টেইন নতুন আদেশ দিল, ‘জোড় সংখ্যা টিউবে রাসায়নিক বিস্ফোরক ভরো! বিজোড় সংখ্যা থেকেও পারমাণবিক বিস্ফোরক বার করে নাও, তার জায়গায় ভরো রাসায়নিক। অ্যাটম ছাড়বার মতো দূরত্ব আর নেই।’
বেয়ার্ড বিবেচনা করল যে টেইনের কথা ঠিকই। এত নিকট থেকে অ্যাটম ছাড়লে প্লিউমির আর কিছু অবশেষ থাকবে না, ওরা কী বা কেমন, তা পরীক্ষা করে দেখার মতো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
এদিকে, আশ্চর্য!
প্রথম দফায় যেসব রকেট নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তারা কিছুদূর পর্যন্ত সোজা গিয়ে তারপর হঠাৎ ঘুরে উলটোমুখী ছুটল। ঠিক নিকোলার দিকেই। এমন আজগুবি কাণ্ড কেউ দেখেনি কখনো, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
তার পরের দফায়ও তাই। নিকোলাতে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন, অফিসার, ক্ষুদে বৈমানিক— সবাই যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে আড়ষ্ট হয়ে বিভীষিকা দেখছে একটা। একমাত্র টেইনের চিৎকার শোনা গেল সেই ভয়াবহ নিশ্চেষ্টতার মাঝখান থেকে, ‘ফাটিয়ে দাও! ফাটিয়ে দাও সব রকেট! ওসব দুশমনের হাতে গিয়ে পড়েছে। ওই রকেটই ওরা আমাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে। ফাটিয়ে দাও! ফাটিয়ে দাও!’
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় একাকার সমস্ত আকাশ। এক-একটা সরলরেখা ছুটে আসছে, আর তার মুখ থেকে হচ্ছে বিস্ফোরণ। রকেট সব ফেটে, শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার আকারে। করা যাবে কী? তারা শত্রুর দখলে চলে গিয়েছিল। রকেটবাজিতে তাহলে প্লিউমিরা মানুষের চেয়েও ওস্তাদ। ওইসব রকেটকে যদি নিকোলার কন্ট্রোল ফাটিয়ে দিতে না-পারত, ওদের আঘাতে এতক্ষণ চুরমার হয়ে যেত নিকোলা।
বেয়ার্ডই বোধ হয় একমাত্র লোক, যে নিজের মাথা ঠিক রেখেছে। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘রাডার থেকে বলছি কন্ট্রোলকে। প্লিউমি বিমান এখনও এগিয়ে আসছে। তেমনি নাচতে নাচতেই আসছে।’
ক্যাপ্টেনের শান্ত কণ্ঠস্বর থেকে প্রশ্ন এল, ‘অন্য কোনো প্লিউমি বিমান দেখা যায়?’
উত্তর দিল ডায়েন, ‘না।’
‘তাহলে এর সঙ্গে আমরা এঁটে উঠতে পারব।’ বললেন ক্যাপ্টেন, ‘টেইন! সব ক-টা রকেট আয়ত্তে আনতে প্লিউমিদের সময় লেগেছে চল্লিশ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক-একটার জন্য তিন সেকেন্ড অন্তত। সেইসময় যখন ওরা পাবে না, তখন রকেট অবশ্যই পারবে ওদের আঘাত করতে। আরও নিকটে আসুক ওরা, একেবারে কাছে এলে তখন—’
একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমি বিমান চালিয়ে দিচ্ছি ওদের দিকে। একেবারে গায়ে গায়ে এলে তখন রকেট ছুড়বে।’
এক মাইলও তখন নেই দুটো বিমানের মাঝখানে। রকেট সব ছুটল নিকোলা থেকে। আর প্লিউমি বিমানও ছুটে এল, সেইসব ছুটন্ত রকেটের মাঝখান দিয়ে দিয়ে এঁকেবেঁকে। ছুটে এল, যেন নিকোলার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার জন্যই।
নিকোলার ক্যাপ্টেন নিকোলাকে ঘোরালেন যেন জাদুকরের মতো নিপুণ হস্তে। প্রায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু শেষমুহূর্তে এক জায়গায় ঘষা লেগে গেল প্লিউমির সাথে।
একটা ঘষা মাত্র! কিন্তু তারই ফলে দুটো বিমানই ধ্বংসের মুখে উপনীত হল। সেই ঘষাতে দুটো বিমানেরই পাশের দিকে বিশ ফুট আন্দাজ খোল গলে গেল একেবারে, আর গলা অংশ দুটো পরস্পরের সাথে জোড় খেয়ে গেল নিশ্ছিদ্রভাবে। নিকোলা উলটো হয়ে পড়ল, তার মেজে হয়ে উঠল পাশের দেয়াল, অন্য একটা দেয়াল হয়ে পড়ল মেজে।
দুটো বিমান জুড়ে গেল। দুটো থেকেই বিদ্যুৎ নিভে গেল। সব যন্ত্র নিশ্চল। জড়ামড়ি-খাওয়া দুটো কাটা ঘুড়ি যেন একসাথে ঘুরপাক খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে সূর্যের গহ্বরে, সেখানকার অনির্বাণ হুতাশনে পুড়ে ছাই হওয়ার জন্য।
সকাল দশটা বারো মিনিট, বিমান টাইম।
প্লিউমিরা ছুটে বেরিয়েছে তাদের বিমানের এয়ার-লকে। এমন পরিণতির কথা তারা ভাবেনি। এখন ভয়ে মুষড়ে পড়েছে তারা। দু-একজন মাথার লম্বা শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলল নৈরাশ্যের তাড়নায়। বেয়ার্ড দেখল, লোকগুলোর মাথায় লম্বা লম্বা পালক, ঠিক পাখির পালকের মতো। এই পালকই তারা এঁকে রেখেছে সীমানাস্তম্ভের প্লেটে।
আর লোকগুলো? ওদের ভিতর পূর্ণবয়স্ক যারা, তারাও দেখতে পৃথিবীর দশ বছরের বালকের মতো। মায়া হয় দেখলে। এ জাতির সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের মিত্রতা কি হতে পারত না? কেন হল না, কে জানে।
দুটো বিমানই পড়ে যাবে সূর্যের দিকে। জ্বলন্ত চিতায় পুড়ে মরতে।
____
* আলোকের গতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। একটা আলোকরশ্মি এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, তাকেই বলা হয় এক লাইট-ইয়ার দূরত্ব। তার পরিমাণ পাঁচ লক্ষ সাতাশি হাজার কোটি মাইল।