সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৪. অশরীরী স্নেহ

অশরীরী স্নেহ

বাবার সঙ্গে সামান্যই পরিচয় ধূর্জটির। সে ভদ্রলোক চিরকেলে ভবঘুরে। এ-বছর তিনি আন্ডিজ পর্বতের কোথাও না কোথাও আছেন, এর বেশি খবর তাঁর সম্বন্ধে ধূর্জটির মা-ও জানেন না।

তা ধূর্জটি, সত্যি কথা বলতে কী, বাবার চিরপ্রবাসের দরুন তার এই দশ বৎসর বয়সের মধ্যে কোনোদিনই মনখারাপ করেনি। একা মা-ই তার ভিতর বাহির সব জুড়ে বসে আছেন। তার পড়াশুনার বেলায় মা তার শিক্ষয়িত্রী, খেলাধুলার বেলায় মা তার খেলার সাথী। এবার অবশ্য বোডিং স্কুলে গিয়ে সমবয়সি ছেলেদের সাথে ডানপিটেমি সে পুরোদস্তুরই শুরু করেছে। কিন্তু সেদিন পর্যন্ত বাড়ির লনে ব্যাডমিন্টন বল, টেনিস বল, আর শিশুসংস্করণের ক্রিকেট বল, সব খেলাই মা তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। যার দরুন স্কুলে এসে এখনও তাকে লজ্জায় পড়তে হয়নি অপোগণ্ড বলে।

মাকে ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে সে কদাচ আসত না যদি মা অসুখে না পড়তেন। অসুখটা যে কী, তা ঠিক জানে না ধূর্জটি; সে শুধু জানে যে মায়ের খুব অসুখ, তিনি আছেন দার্জিলিংয়ের এক স্বাস্থ্য নিবাসে। অনেকদিন তাঁকে থাকতে হবে সেখানে, আর ততদিন তাঁকে চোখের দেখাটিও দেখতে পাবে না ধূর্জটি।

মায়ের চিঠি আসে হপ্তায় একখানা— প্রতি চিঠিতেই লেখা থাকে— ‘আমি ভালো আছি বাবা, ক্রমেই ভালো হয়ে উঠছি, শিগগিরই একেবারে ভালো হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসব, তুমি মন খারাপ করো না, লক্ষ্মীটি! তোমার স্কুলের সব খবর দিও।’

ধূর্জটিও হপ্তায় একখানা চিঠি দেয়; ক্লাসে কোনদিন সকলের উপরে উঠেছে, তাও যেমন লেখে, কোনদিন হঠাৎ অনেকখানি নেমে গেলে তাও তেমনি গোপন করে না। মায়ের কাছে লুকোছাপা তার কিছু নেই। কোনোদিনই ছিল না।

চলছিল এইভাবে। ক্রমে এসে গেল পুজোর ছুটি। এখন হবে মুশকিল। ছুটিতে ধূর্জটি এখন কোথায় যায়? মা-শূন্য বাড়িতে গিয়ে মন টিকবে কি তার? থাকার মধ্যে তো সেখানে এখন দারোয়ান টহলরাম আর বুড়ি ঝি জগা পিসি।

কিন্তু জগা পিসির কাছে ধূর্জটিকে হল না যেতে। দাদামশায় স্কুলে চিঠি লিখে ব্যবস্থা করে ফেললেন— ছুটি হলেই যেন ওকে তাঁর বাগানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মা-ও যেতে লিখেছেন দাদামশায়ের কাছে— ‘এই একটিবার মা-কে ছেড়েই থাকো বাবা! আগামী ছুটিতে আমাকে নিশ্চয়ই পাবে, আমি ভালো হয়ে ততদিন বাড়িতে চলে আসব। মন খারাপ করো না লক্ষ্মী বাবা—’

চিঠি পড়ে চোখের জল চাপতে পারল না ধূর্জটি। মা রইলেন কোথায়, আর সে চলল কোথায়! স্যানাটোরিয়ামগুলো এমন কেন? মা যখন রয়েছেন, তখন ছেলেকে সেখানে থাকতে দিতে দোষ কী!

ছুটি হল। দাদামশায়ের স্টেশনে নিরাপদেই পৌঁছোল ধূর্জটি। স্টেশনে দিদিমাই এসেছেন ওকে নিতে, সঙ্গে এসেছে এক পাল ছেলে-মেয়ে। তারা কেউ ধূর্জটিরই সমবয়সি, কেউ বা কিছু বড়ো বা কিছু ছোটো। সবই মামাতো বা মাসতুতো ভাই বা বোন।

গাড়ি ছিল সঙ্গে। কিন্তু গাড়িতে এতগুলিকে ধরবেও না, গাড়িতে যেতে রাজিও কেউ নয়। সুতরাং বুড়ি দিদিমাকে তাতে চাপতে হল একা একাই। তাঁর পায়ের কাছে স্থান পেল ধূর্জটির বাক্সটা।

হইহই করতে করতে চলেছে গোটা বারো ছেলে-মেয়ে। শালবনের ভিতর দিয়ে রাস্তা, গাছেগাছে অর্কিডের বাহার, গাছের আড়ালে আড়ালে হরিণের আনাগোনা। মাঝে মাঝে কুলুকুলু ধ্বনি শোনা যায়, শীর্ণা কোনো পাহাড়িয়া নদী নিশ্চয়।

দুই দিকেই শালবন ছিল এতক্ষণ, হঠাৎ ডান দিকের বনটা খতম হয়ে গেল। রাস্তার ধারেই দেখা গেল একটানা উঁচু পাঁচিল।

রাস্তাও চলেছে, পাঁচিলও চলেছে। কীসের এ-পাঁচিল? স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করে ধূর্জটি। কলরব ওঠে এক ডজন কণ্ঠে— ‘বাড়ি আছে ওর ভিতরে। পোড়োবাড়ি কতদিন থেকে যে লোক নেই ওতে, দাদামশায় দিদিমা ছাড়া আর কেউ জানে না।’

দিদিমার গাড়ি এগিয়ে পড়েছে খানিকটা, তাঁকে এই মুহূর্তে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা সম্ভব হল না। এদিকে সন্দীপ তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল ‘পোড়ো বাড়িই বলি আমরা, কিন্তু আসলে ওটা হানা বাড়ি। ভূত আছে। ভয়ে চোর পর্যন্ত ঢোকে না বাড়িতে, যদিও দামি দামি আসবাবপত্র নাকি এখনও পড়ে আছে ওর ভিতরে। আম কাঁঠালের সময় পাহাড়িয়া ছেলেরা দল বেঁধে ফল-টল পাড়ে অবশ্য, কিন্তু সূর্য ডুববার আগেই সব পিট্টান দেয়—’

অনেকক্ষণ পরে পাঁচিল শেষ হল। মানে, ঘুরে গেল সমকোণে। এখানে একটা অগভীর পাহাড়িয়া নদী। তারই কূল ঘেঁষে ঘেঁষে অনেক অনেক দূর চলে গিয়েছে পাঁচিল, কতদূর তা পষ্টো দেখা গেল না এখান থেকে।

সাঁকো আছে নদীর উপরে, মজবুত কাঠের সাঁকো। তারই উপর দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। ওপারেই দাদামশায়ের চা-বাগান।

দিন-দুই পরের কথা। দুপুরে খেয়ে উঠেই একদল ছেলে-মেয়ে বসেছে ক্যারামবোর্ড নিয়ে, আর একদল লেগে গিয়েছে ব্যাডমিন্টন কোর্টের লাইনগুলোতে চুন লাগাতে।

ধূর্জটি কিছুক্ষণ ক্যারাম পিটিয়েছিল, তারপর মাঠের দিকে বেড়াতে বেরুলো। বাংলোর ঠিক নীচে খানিকটা আছে ফুল বাগান, তারপরই খোলা মাঠ চলে গিয়েছে নদী পর্যন্ত।

হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারেই এসে পড়েছে ধূর্জটি।

নদীর ওপারেই সেই লম্বা পাঁচিল, পুবে পশ্চিমে টানা। পশ্চিমে চলে গিয়েছে সাঁকো পর্যন্ত, তা ধূর্জটি সেদিনই দেখেছে, স্টেশান থেকে আসার সময়। পুবে যে ওর দৈর্ঘ্য কত, কে তা বলবে?

এগিয়েই দেখা যাক ভাবল ধূর্জটি! নদীর কূল বরাবার পুব মুখো সে হাঁটল। ঠিক সোজা যায় না কোনো নদীই, এ নদীও তা যায়নি। বাঁকে বাঁকে এমন পাক খেয়েছে যে কিছু পথ যাওয়ার পরেই ধূর্জটির চোখ থেকে বাংলো বা বাংলোর মাঠ একদম অদৃশ্য হয়ে গেল।

আরও কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল ধূর্জটি। পোড়ো বাড়ির একটা গেট এখানে। নদীর ওপারে গেট, মস্ত তালা ঝুলছে তাতে। লোহার ফ্রেমে লোহার চাদর এঁটে গেট তৈরি, ও-পিঠের চেহারা কিছুমাত্র চোখে পড়ে না এ-ধার থেকে।

কিন্তু চেহারাটা দেখবার জন্য যে ভয়ানক ঝোঁক ধূর্জটির! পোড়ো বাড়ি! হানাবাড়ি! সন্দীপ বলেছে ভূত আছে ওখানে। ভূতের বাড়ির চেহারা যে কীরকম হয়, স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়েও সে দেখবে না? দেখে গেলে কিন্তু গল্প করা যেত স্কুলে ফিরে গিয়ে। বাহাদুরিও পাওয়া যেত খানিকটা। সব ছেলেই যে ভূতের বাড়ি দেখেছে, তা তো নয়!

চিন্তাটা মগজে ঢোকার পরের মুহূর্তেই ধূর্জটি জলে নেমে পড়ল, আর শ্যাওলা ঢাকা সবুজ জলে হাফ প্যান্টের প্রায় অর্ধেক ভিজিয়ে নদী পেরুবার চেষ্টা করতে লাগল।

সরু নদী, আধ মিনিটে ওপারে পৌঁছানোর কথা, তবু পা টিপে টিপে সেখানে দুই মিনিট সময় লাগিয়ে দিল ধূর্জটি; অ্যাডভেঞ্চারে নামলেই যে অসতর্ক হতে হবে, এমনকী কথা? অজানা নদী, বুনো নদী, কোথায় জলের তলায় কী আছে, তার ঠিক কী? হঠাৎ খালে পড়ে গেলেও ধূর্জটি ডুবে যাবে না, একথা অবশ্য ঠিক, কারণ মা তাকে সাঁতার শিখিয়ে দিয়েছেন ছয় বছর বয়সেই। কিন্তু না ডুবলেও, ওই নোংরা জল নাকে মুখে যায় যদি— রামঃ!

গেটের কাছে পৌঁছে উঁকি দেবার চেষ্টা করবে, এইরকমই ছিল ধূর্জটির পরিকল্পনা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উঁকি দেওয়ার দিক দিয়েও সে গেল না তো! দুই একবার মরচেধরা তালাটাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে, তারপর নদীর জল থেকে তুলে নিল একখানা বড়ো পাথর, আর তাই দিয়ে তালার উপরে মারল জোরে এক ঘা।

কতকালের পুরোনো তালা, এক ঘায়ের উপরে দুই ঘা আর দরকার হল না, তালা খুলে হড়াস করে জলে পড়ে গেল। আর সামান্য ঠেলা দিতে গেটও গেল হাঁ হয়ে। জল থেকে ধূর্জটি একেবারে উঠে দাঁড়াল পোড়ো বাড়ির হাতার মধ্যে। রোমাঞ্চ একটু না জাগল দেহে, তা নয়, কিন্তু ভয়ের রোমাঞ্চ সেটা নয়। অজানার দোর গোড়ায় পা পড়লে আধা-কৌতূহল, আধা-বিস্ময়ে দেহ অমন সজাগ হয়ে ওঠে কখনো-সখনো।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সমুখে তাকিয়ে আছে ধূর্জটি। একটা মাঝারি রকম চওড়া রাস্তা, লাল সুরকিরই রাস্তা সেটা এককালে ছিল, এখন শ্যাওলা জমে কালো-সবুজের মাঝামাঝি একটা রংয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোটো ছোটো আগাছাও হয়েছে এখানে-সেখানে, বেশি দাপট তাদের নেই এই কারণে যে রাস্তাটা রোদ্দুর মোটে পায় না।

রাস্তার দুই ধারে বড়ো বড়ো দেশি ফুলের গাছ, বকুল, চাঁপা, নাগকেশর, কদম। তাদের ডালাপালা দুইধার থেকে এসে নিশ্ছিদ্র চাঁদোয়া একটি তৈরি করেছে রাস্তাটির মাথায়। তাতে রোদ্দুর আটকেছে এমনভাবে যে বেলা দুটোর সময়ে এই মুহূর্তে গোটা রাস্তাটা প্রায় অন্ধকার।

যতদূর নজর চলে এখানে দাঁড়িয়ে, রাস্তার শেষ ধূর্জটি দেখতে পায় না। বাড়িটা কোন দিকে? সেই পোড়োবাড়ি? সেই ভূতের বাড়ি? বাড়িটার চেহারা না দেখেই যদি ফিরে যেতে হয়, তাহলে তো নোংরা জলে আধখানা শরীর ডুবিয়ে নদী পার হওয়া একেবারেই বৃথা হল! স্কুলে ফিরে গিয়ে অশান্ত, বাউন্ডুলে, ঠ্যাঙাড়ে নামধেয় বন্ধুদের কাছে গল্প করার মতো সম্বল তো কিছুই জোগাড় হল না!

অতএব, যা থাকে কুলকপালে! বাড়িটা দেখতেই হবে—

ঘড়াং-ঘড়! গেটের দুই পাল্লা ফাঁক করে ভিতরে ঢুকেছিল ধূর্জটি, একটাও জোর হাওয়ার ঝাপটা তারপর থেকে সে টের পায়নি এ-যাবৎ। তবু পাল্লা দুটো আপনা থেকে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল কেন? নিজেরই ভারে? নিজের ভারে আরও বেশি করে খুলেও তো যেতে পারত! খোলার বদলে বন্ধ হল কেন?

এক মুহূর্তের জন্য খুবই দমে গেল ধূর্জটি। দোর বন্ধ হওয়া মানে তো এটা নয় যে বহির্জগতের সঙ্গে ধূর্জটির সকল সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে গেল আপাতত? সেই মানেই যদি হয়, তাহলে তা ছিন্ন করল কারা? কী উদ্দেশে? তারা কি নজর রেখেছে এই বহিরাগত অনধিকার প্রবেশকারীর উপরে? তারা কি ওত পেতে আছে, সুযোগমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খপ্পরে পুরবার জন্য? খুবই দমে গেল ধূর্জটি—

কিন্তু মুহূর্তের জন্যই সেটা। তার বাবা যে আন্ডিজ পর্বতের তুষার ক্ষেত্রে একাকী বিচরণ করছেন আজ কয়েক মাস যাবৎ, মৃত্যুর সঙ্গে যে দিনে অন্তত দশ বার তাঁকে পাঞ্জা কষতে হয়, এ স্মৃতিটা ঠিক সময়েই তার মগজে জেগে উঠল। ‘ভিতু ছেলে! আমার নাম ডোবাবি?’ —বাবার তর্জন সে যেন শুনতে পেল দশ হাজার মাইলের ওপার থেকে— সে এক ছুটে অনেকখানি এগিয়ে গেল সেই ছায়াঢাকা আধা-অন্ধকার পরিত্যক্ত উদ্যানপথ বেয়ে।

কিন্তু কই? বাড়িটা কই?

ওই যে বাড়ি। আচমকাই দেখা দিল বাড়িটা। উদ্যানপথের ডাইনে একখানা ছোটো মাঠ অপরাহ্নের সূর্যালোকে ঝলমল ঝলমল করছে। সেই মাঠের শেষ যেখানে, সেইখানেই ভূতের বাড়ির শুরু।

মাঠে ঘাস লম্বাই বটে, কিন্তু এমন লম্বা নয় যে তার ভিতর বাঘ লুকিয়ে থাকবে। নির্ভয়ে মাঠ পেরিয়ে বারান্দায় এসে উঠল ধূর্জটি। দরজায় তালা, আর এ তালা রীতিমতো মজবুত এখনও। জল-ঝড় তো লাগেনি এর গায়ে!

মজবুত না থাকলেও তালা ভেঙে ঘরের ভিতরে ঢুকতে ধূর্জটির রুচিতে বাধত। বাগানে ঢোকা আর ঘরে ঢোকা ঠিক এক জিনিস তো নয়! সে এসে একটা জানালার ভাঙা কাচের ফোকর দিয়ে উঁকি দিল।

বাহবা! জানালাটা সাহেবি প্যাটার্নের, গরাদ বিহীন। আর ছিটকানিটাও তো নাগালে পাওয়া যাচ্ছে ভাঙা কাচের ভিতর দিয়ে!

পরিত্যক্ত! বহুকালের পরিত্যক্ত! মানুষ যেখানে বাস করে না, তাকে কি গৃহ বলা চলে? অট্টালিকা বল, হর্ম্য বল, যা-খুশি তাই বলতে পার, গৃহ তাকে বলা উচিত হবে না। এই পোড়োবাড়ি যদি গৃহ হয়, তাহলে তো তাজমহলও গৃহ! তাজমহলে ঢুকতে বিবেকে বাধে না যখন, এ বাড়িতে ঢুকতেই বা বাধবে কেন?

ছিটকিনি খুলে গরাদ বিহীন জানালার ভিতর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল ধূর্জটি।

একটা বিশাল হল ঘর। কাচের শার্সির ভিতর দিয়ে আলো যেটুকু ঢুকছে, তাতেই সব কিছু আবছা ভাবে ঠাহর করা যায়। দামি দামি সোফা সেট দেয়ালের গায়ে গায়ে, মাঝখানে লম্বা টেবিল একখানা, গদিআঁটা হাতলহীন সারিবন্দি চেয়ার দুই দিক থেকে সেই টেবিলের তলায় ঢোকানো।

দেয়ালের ধারের একটা সোফাতেই বসে পড়ল ধূর্জটি। ভয়? হাঁ, ভয় তার করছে। কিন্তু ভূতের ভয় নামক যে অতি-আশ্চর্য অবর্ণনীয় একটা ভয়ের অভিজ্ঞতা প্রত্যেকটা মানুষেরই অল্প-বিস্তর আছে, তার সঙ্গে ধূর্জটির এ ভয়ের তেমন সাদৃশ্য নেই। এটাকে বরং বলা যেতে পারে অনধিকারীর ভয়। অনুমতি না নিয়ে পরের ঘরে প্রবেশ করা হয়েছে, সেই ‘পর’ লোকটা কী ভাববে, কী বলবে বা কী করবে, সেই সম্পর্কে আতঙ্কমিশ্রিত যে অনুমান, সেইটাই এ-সময়ে ধূর্জটির মনটা জুড়ে রয়েছে। সে পর রক্তমাংসের জীব না হয়ে ছায়ামূর্তিও যদি হয়, তার দরুন ধূর্জটি কিছু ইতর বিশেষ টের পাচ্ছে না।

বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ধূর্জটি একটা জিনিস আবিষ্কার করল। একখানি বৃহৎ ছবি, ঠিক তার সামনে দেয়ালের গায়ে মাথা সমান উঁচুতে টাঙানো। কোনো শার্সির ভিতর দিয়ে চওড়া একটা রৌদ্ররেখা সোজা এসে সেই ছবিখানির উপরেই পড়েছে, ঝলমল আলোকে উজ্জ্বল করে তুলেছে তাকেই শুধু, চারিপাশের আধো-আঁধারি বেষ্টনীর মাঝখানে। ধূর্জটি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল ছবি।

মুগ্ধ হওয়ার কারণ আছে। ছবিখানিতে দুটি লোক, মা আর ছেলে। মা চেয়ারে বসে আছেন, ছেলে চেয়ারের পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এই ভঙ্গিতে ধূর্জটিকে নিয়ে তার মা ছবি তুলেছিলেন একখানা, সে ছবি আছে ওদের দেশের বাড়িতে।

সবচেয়ে আশ্চর্য, ছবির মা ধূর্জটির মায়েরই বয়সি হবেন, আর ছবির ছেলেটি? সে তো হুবহু ধূর্জটি বললেই হয়। অমিন হাড়ে-মাসে জড়ানো দোহারা চেহারা, লম্বা লম্বা চুল, নীল হাফ প্যান্ট আর সাদা হাতকাটা শার্ট। মুখ-চোখের আদলে তফাত থাকতে পারে, অবশ্যই আছে। কিন্তু সাধারণভাবে দেখেতে গেলে ও ছবিকে ধূর্জটির আর তার মায়ের ছবি বলে অনায়াসেই ধারণা করে নেওয়া যায়।

একটা আশ্চর্য ব্যাপার টের পাচ্ছে ধূর্জটি। মনে যে ভয় ভয় ভাবটা তার ছিল এতক্ষণ, এই মাতৃপুত্রের ছবিখানি দেখবার পর থেকে সেটা যেন একটু একটু করে উবে যাচ্ছে। তাপ লাগলে জল যেমন বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবে। ভূত? ভূতের ছায়াও নেই এ বাড়িতে। ওই যে মা আর ছেলে, ওদের স্নেহনীড়ের ভিতরে প্রেতের আশিব প্রভাব কোনোমতেই ছায়াপাত করতে পারে না, এইরকম একটা দৃঢ় বিশ্বাস ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে ধূর্জটির অন্তরে।

হল ঘরের একটা কোণ জুড়ে রেলিং দেওয়া সুপ্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি। তার ধাপে ধাপে পুরু কার্পেট পাতা। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে উপর পানে চাইছে ধূর্জটি। কে যেন উপর থেকে ডাকছে তাকে— ‘এসো না! এসো উপরে। ভয় কী? চলে এসো—’

সে আহ্বান দুর্নিবার হয়ে উঠল ক্রমে। পায়ে পায়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ধূর্জটি। বাঁক চূড় নেই, দোতলা পর্যন্ত সিঁড়ি সোজা উঠে গিয়েছে। দোতলার মুখেই একখানা ঘর। কী ও সব ঘরের মেজেতে ছড়ানো? তাকে সাজানো? টেবিলে গাদা করা?

পুতুল! খেলনা! হরেকরকম! কার এসব! কত কালের এসব? কিন্তু কী আনকোরা নতুন। কোন নধর শিশুর কচি হাত যেন এই মাত্র এই মোটর গাড়িটাতে দম দিয়ে দিয়ে ঘরময় চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। তা নইলে ঠিক মেজের মাঝখানে ওভাবে ও দাঁড়িয়ে আছে কেন? ঠিক যেন প্রতীক্ষায় রয়েছে— সেই কচি হাতখানি এইবার এসে নতুন করে দম দিয়ে চালিয়ে দেবে ওকে আবার!

সে ঘর পেরিয়ে ওর চেয়েও বড়ো ঘর একখানা। এটা শোবার ঘর, বিছানা করাই রয়েছে। রেশমের মশারি পর্যন্ত টাঙানো। টিপয়ের উপর মোমবাতি। জানালায় বই কয়েক খানা। ছবি অসংখ্য সেই সব বইয়ে। ধূর্জটির আবার অভ্যাস, বই দেখলেই নেড়েচেড়ে দেখা। জানালা খুলে ফেলে, সেই জানালাতেই সে বসে পড়ল। একখানার পর একখানা বই দেখতে লাগল খুলে খুলে।

সাধুসন্তদের ছবি আর কাহিনি। বুদ্ধদেব থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত। ছবির ভিতর থেকে মহাপুরুষদের আয়ত আঁখি কী যেন ইশারা করছে ধূর্জটিকে। বুঝতে পেরেছে ধূর্জটি সে ইশারার মর্ম। সবাই ওঁরা একই কথা কইছেন ওকে ‘মাভৈঃ’—

না, ভয়ডর নেই ধূর্জটির। ভূত? নেই। কিংবা থাকে যদি তো আছে। ভূতের সঙ্গে ধূর্জটির ঝগড়া কি? তুমিও আছ, আমিও আছি। তোমার কাজ যদি কিছু থাকে, তুমি তা কর। আমার কাজ অনেক আছে, আমিও তা করে যাব। তোমার মঙ্গল হোক, এই কামনা আমার। আমারও মঙ্গল তুমি যদি কামনা কর, আমি সুখী হব—

হাতে বই খোলা রয়েছে, হঠাৎ ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসল ধূর্জটি। সে কি? ঘরের ভিতর অন্ধকার যে? শুধু ঘরেই বা কেন? বাইরেও আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। সে কি? সন্ধ্যা হয়ে আসছে না কি? কেমন করে হবে? এইমাত্র তো ঢুকল ধূর্জটি এ বাড়িতে। বেলা দুটোয় সে মামাবাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এখন বেলা চারটের বেশি তো হতেই পারে না। জ্বলেজ্বলে রোদ থাকা উচিত ওই মাঠে, ওই গাছের মাথায়—

কিন্তু চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। অন্ধকার সত্যিই হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা আসন্ন। ভূতের বাড়িতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল বোকা ধূর্জটি, দিনের আলো কখন নিবে গিয়েছে, তা সে টের পায়নি। কে তাকে ঘুম পাড়াল? কী মতলবে পাড়াল ঘুম? নিশ্চয়ই সে মতলব সাধু নয়!

ভূত নেই বলে খুব বীরত্ব ফলাচ্ছিল মনে মনে, এইবার একটা নিদারুণ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে তার! বরফ হাওয়ার ঝাপটা যেন এসে লাগছে তার শিরদাঁড়ায়। সে যেন আড়ষ্ট হয়ে জমে যাচ্ছে ক্রমশ। এই জানালা থেকে তাকে যেন আর উঠতে হবে না। ওই যে রেশমি মশারি টাঙানো রয়েছে পালঙ্কে, ওর তলা থেকে একখানা দীঘল বাহু বুঝি ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি, বরফের মতো ঠান্ডা হাত দিয়ে ধীরে ধীরে আকর্ষণ করে নিয়ে যাবে ধূর্জটিকে, হয়তো ওই মশারির ভিতরেই।

কী আছে ও মশারির ভিতর, তা তো ধূর্জটি এক বারও উঁকি দিয়ে দেখেনি। কী না থাকতে পারে? নীচের হল ঘরে যে ছবি দেখেছিল মায়ের আর ছেলের— তাদের কঙ্কাল পড়ে থাকতে পারে লেপের তলায়—

মা! ছবির মায়ের কথা মনে হতেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। জামার পকেটে চিঠি রয়েছে মায়ের। আড়ষ্ট হাত নাড়বার শক্তি ছিল না এতক্ষণ, হঠাৎ সে শক্তি ফিরে এল ধূর্জটির। মায়ের চিঠিখানা স্পর্শ করল— মা লিখেছেন— ‘আমি ভালো আছি বাবা, ভালো আছি। তুমিও ভালো আছ নিশ্চয়। থাকবেই ভালো। ভয় কী? আমি শিগগিরই ভালো হয়ে উঠব, ফিরে আসব তোমার কাছে—’

মায়ের চিঠির প্রত্যেকটা কথা তার মনে আছে। মনে মনে সেই বয়ান আওড়াতে আওড়াতে সে উঠে দাঁড়াল, হাতে পায়ে একটা যে খিল ধরা অস্বাচ্ছন্দ্য এসে গিয়েছিল, সেটা কেটে গিয়েছে তার। কালো অন্ধকারের ভিতর খোলা দরজাটাই ধোঁয়াটে সাদা দেখা যাচ্ছে। সেই সাদা চৌকোণটার ভিতর দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই সেই পুতুলের ঘর—

মেজেতেই মোটর গাড়িটা ছিল, অন্ধকারে ঠোক্কর খেল ধূর্জটির পা। একটা শব্দ হল ঝং করে। নিস্তব্ধ বাড়িটাতে উঠল প্রতিধ্বনি। সে প্রতিধ্বনি আর থামে না যেন। একটার পরে একটা! তেতলা থেকে এক বার, একতলা থেকে একবার! ঘরে ঘরে খনখন করে হেসে উঠছে যেন হাড্ডিসার কঙ্কালেরা। সে হাসির একটাই অর্থ হয় ‘ছেলেটাকে ধর তো! ধর তো ছেলেটাকে!’

ধূর্জটি দৌড়োল। সিঁড়ি বেয়ে নামল ছুটতে ছুটতেই। ভাগ্যিস ডান হাত দিয়ে রেলিংটা আঁকড়ে ধরেইছল, তা নইলে পড়ে পা ভাঙত সেই অন্ধকারে।

হল ঘরে সে নামল যখন, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। ওই যে খোলা জানালা, যার ভিতর দিয়ে সে ঢুকেছিল এখানে। বাইরের মাঠ দেখা যায়। অন্ধকার যদিও ঘনিয়ে এসেছে, তবু তা মাঠখানাকে বিলুপ্ত করে দিতে পারেনি। মাঠের ওপারে উদ্যানপথেরও আভাস পাওয়া যায় যেন। ওই পথ দিয়ে আধ মিনিট ছুটে গেলেই শাঁওলি নদী, সেই নদী পেরুলেই মামাবাড়ি। বাইরের পৃথিবী তো হাতের গোড়াতেই রয়েছে তার! ভয়টা কীসের?

অকারণে ভয় পেয়েছে বলে মনে মনে খুব লজ্জা করছে ধূর্জটির। ভয় যে পায়নি— এইটেই নিজেকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মতলবে সে চেপে বসল সোফাতে আবার। রাত হয়েছে, বাড়িতে হইহই শুরু হয়ে গিয়েছে এতক্ষণ তার জন্য। এক্ষুনি তার ফেরা দরকার। সবই সত্য, কিন্তু একটুখানি তবু বসবেই সে। বসবে এইটে প্রমাণ করবার জন্য যে ভয়-টয় কিছু নয়, ভূতকে সে গ্রাহ্য করে না।

বসে আছে ধূর্জটি। কেন এমন হয়, তা কে জানে। এক সময় চোখ-কান সব ইন্দ্রিয়ই অতিরিক্ত সজাগ হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে ধূর্জটির তাই হল। তার মনের কানে ধরা পড়ল একটা অতি সূক্ষ্ম আহ্বান। এত সূক্ষ্ম যে সাধারণ অবস্থায় তা কোনোমতেই সে শুনতে পেত না।

আহ্বান। কে যেন তাকে ডাকছে। ডাকছে উপর থেকেই। যেখানে সে একটু আগে বসেছিল, সেই মশারি টাঙানো ঘর থেকেই। ডাক সে শুনতে পাচ্ছে। কণ্ঠস্বরটি যেন সে চিনতে পেরেছে। ও আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তো কোনোমতেই পারবে না ধূর্জটি! কেন এমন হল, কী তাৎপর্য এই অতি সূক্ষ্ম অনুভূতির, তা বুঝবার বয়স বা বুদ্ধি কিছুই ওর হয়নি। সে শুধু এইটুকুই জানে যে, এমন একজন ডাকছে তাকে, যাকে সে প্রাণ গেলেও উপেক্ষা করতে পারে না।

ওই সেই সিঁড়ি। যে সিঁড়ি বেয়ে একটু আগেই সে ছুটতে ছুটতে নেমে এসেছে প্রাণ হাতে করে। কারা যেন খনখন হেড়ো হাসি হাসতে হাসতে তেড়ে এসেছিল তার পিছনে। বাপমায়ের আশীর্বাদেই শুধু পালাতে পেরেছিল ধূর্জটি।

আবার এখন সেই সিঁড়ি বেয়েই উপরে উঠবে সে? অজানা আতঙ্কে ভরা উপরতলায়? সেই মশারি টাঙানো ঘরে? দুঃসাহসের কাজ নয়?

এক-শো বার দুঃসাহসের কাজ। তবু উঠতে ধূর্জটিকে হবেই। এখনও ক্রমাগত সেই আহ্বান তার কানে আসছে, কানের ভিতর দিয়ে মর্মে বিঁধে যাচ্ছে তার— ‘ধূর্জটি! বাবা! আয় এক বার ধূর্জটি—’

পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল সে। সিঁড়ি তো নয়, একটা উপরমুখী সুড়ঙ্গ যেন অন্ধকার ভূগর্ভে। শক্ত করে রেলিং চেপে ধরে পা টেনে টেনে সে উঠছে। এক্ষুনি আবার সেই হাড্ডিসার গলার খনখন হাসি সুপ্ত পুরীর প্রগাঢ় স্তব্ধতাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে না তো?

না, তা দিল না। খেলনার ঘর সে নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেল কোনো কিছুতে ঠোক্কর না খেয়ে। দোর গোড়ায় দাঁড়াল গিয়ে সেই মশারি টাঙানো ঘরের। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, সেখানে। কেবল ও-দিকে জানালাটা খোলাই পড়ে আছে এখনও, যে জানালার পাশে বসে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল ধূর্জটি। সেই জানালার চৌকোণটাকে দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারের কালো বেষ্টনীর মাঝখানে একটা ধোঁয়াটে সাদা পর্দার মতো। আর সেই সাদার একটু ক্ষীণ প্রতিফলন এসে পড়েছে টাঙানো মশারির রেশমি কাপড়ে। ধূর্জটির যেন মনে হল— মৃদু আন্দোলনে কেঁপে কেঁপে উঠছে ঘেরটা।

কেউ ঘুমিয়ে আছে ওর ভিতর? হয়তো পা নাড়ছে ঘুমের ঘোরে? তারই দরুন কাঁপছে মশারি? বাড়িটা যে এক যুগ ধরে পরিত্যক্ত এটা জানা না থাকলে সেইরকম ধারণাই হত ধূর্জটির।

না, ঘুমিয়ে কেউ নেই, হাত-পা কেউ নাড়ছে না। জ্যান্ত মানুষই হাত-পা নাড়ে, জ্যান্ত মানুষই ঘুমোয়। এখানে তার বালাই নেই। যদি থাকে তো ভূত আছে, তারা হাত-পা নাড়ে না, কারণ হাত-পা নেই তাদের, দেহই নেই—

কিন্তু— হঠাৎ ধূর্জটির চিন্তাধারা ধাক্কা খেল একটা। দেহ নেই তো হাসে কেমন করে? খনখন হাসি তো সে শুনেছিলই! সেটা কি শোনবার ভুল তার? হবেও-বা!

কিন্তু এই অতিসূক্ষ্ম আহ্বানটি, যা ধূর্জটির ঘোরতর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওকে টেনে এনেছে নীচের হল ঘর থেকে? হাসতে যারা পারে না তারা আহ্বান পাঠাবে কেমন করে হাওয়ার তরঙ্গে তরঙ্গে?

কিন্তু থাকুক সে চিন্তা। যিনি ডেকে এনেছেন ধূর্জটিকে, তিনি কোথায়? এই ঘর থেকেই যেন আহ্বানটি শোনা গিয়েছিল। এ ঘরে ধূর্জটি অন্ধকারেও আসতে পেরেছে রেলিং ধরে ধরে, দেয়ালে দেয়ালে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আসতে পেরেছে, কারণ দিনের আলোতেও সে আগে একবার এসেছিল এখানে।

কিন্তু অন্য কোনো ঘর তো সে দেখেনি দিনের বেলায়! এই অন্ধকারে অন্য কোথাও যদি তাকে যেতে হয়, সে কি পারবে তা? কিন্তু পারা-না-পারার প্রশ্ন অবান্তর। সে স্বর যদি ডাকে, উত্তর মেরুতেও যেতে হবে ধূর্জটিকে।

কিন্তু ডাক আর আসছে না, নিস্তব্ধ, নিস্পন্দ পৃথিবী আকাশ। অন্ধকার প্রেতপুরীতে একা দাঁড়িয়ে আছে ধূর্জটি, দশ বৎসরের বালক। দাঁড়িয়ে আছে একটি সকরুণ সাড়ার প্রতীক্ষায়। আর কী আসবে না সে সাড়া?

এল, কিন্তু কর্ণপথ দিয়ে নয়, দৃষ্টিপথ দিয়ে।

সেই জানালাতেই। যেখানে বসে সাধুসন্তদের ছবি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ধূর্জটি—

কী যেন দাঁড়িয়ে আছে সেই জানালার ধোঁয়াটে সাদা পশ্চাৎপটকে আংশিক ঢেকে। কী যেন! ওটা কি কোনো শরীর? না, ছায়ামূর্তি? না কোনো আসবাবেরই ক্ষীণ প্রতিচ্ছবি?

শরীরী? না, এ পুরীতে আজ রাত্রে একমাত্র শরীরী জীব হল ধূর্জটিই।

প্রতিচ্ছবি? না, আলোক থাকলে তবেই ফুটতে পারে প্রতিচ্ছবি, এখানে আলো কই?

তবে নিশ্চয় ছায়ামূর্তি। কে উনি? ওঁরই আহ্বান কি শুনেছে ধূর্জটি?

কিন্তু ছায়ার তো কণ্ঠ নেই, আহ্বান তিনি কেমন করে করবেন?

অকণ্ঠের আহ্বানও যে আছে মনোজগতে, তা বালক ধূর্জটি কেমন করে জানবে? সে অবাক হয়ে ভাবে শুধু।

ভাবে আর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে বাতায়নের সেই ছায়ার দিকে। ধূর্জটির দৃষ্টির সমুখেই সেই ছায়া একটু একটু করে ঘনীভূত হচ্ছে। সে যেন সকাতরে তাকিয়ে আছে ধূর্জটির পানে, সে যেন নীরব ভাষায় কাকুতি জানাচ্ছে ‘ভয় পেয়ো না, আমায় দেখে ভয় পেয়ো না তুমি—’

না, ভয় ধূর্জটি পাবে না। উনি তো ছায়া মাত্র, অনিষ্ট করবার ক্ষমতা ওঁর কিছুমাত্র নেই। তা ছাড়া, কী জানি কেমন করে ধূর্জটির মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে তার অনিষ্ট করবার জন্য তাকে উনি কাছে ডাকেননি। সেই অতীন্দ্রিয় আহ্বানে যদি কোনো কিছু ধরা পড়ে থাকে ধূর্জটির অন্তরের কোণে, তবে ধরা পড়েছে এক আত্মাহারা বাৎসল্যের সুর।

না, না, ওঁকে ভয় করবে না ধূর্জটি। একটুও ভয় করছে না তার।

কিন্তু, এমনও তো হতে পারে যে উনিই ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে ধূর্জটি আতঙ্কে অধীর হয়ে পড়বে? ওঁর নীরবতার মিনতি শুধু এই বাণীই বহন করে আনছে ধূর্জটির মনে— ‘ভয় পেয়ো না, আমায় দেখে ভয় পেয়ো না তুমি—’

‘না, না, আমি ভয় পাব না তোমাকে।’ ধূর্জটি চেঁচিয়ে বলে উঠল ‘তুমি এসো! কাছে এসো আমার—’

পায়ে পায়ে যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নিঃশব্দে সেই ছায়া একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ধূর্জটির দিকে। এল! একেবারে কাছে এল! দু-খানি বাহু মেলে বুকের উপর জড়িয়ে ধরল ধূর্জটিকে।

বাহু দু-খানি কী ঠান্ডা! কিন্তু হোক ঠান্ডা! সে আলিঙ্গনের ভিতর দেহটা, বুকের ভিতরটা জুড়িয়ে গেল ধূর্জটির— ‘মা! মাগো! মা!’ —কয়েক বার ডেকে উঠে নীরব হয়ে গেল ধূর্জটি।

তার জ্ঞান হল, যখন ভোরের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। সে বসে আছে সেই খোলা জানালায়, সামনে খোলা সেই সব ছবিওয়ালা বই।

নীচে নেমে যখন সে মাঠে পড়েছে, লন্ঠন হাতে একদল লোক হইহই করতে করতে এসে ঢুকল সেখানে। এরা মামাবাড়ির চাকর-বাকর, সন্দীপও আছে— এ দলে। সারারাত সারাবাগান ঢুঁড়েছে ওরা, সব শেষে দেখতে এসেছে এই পোড়ো বাড়িটা।

আশ্চর্য! কেউ একটুও অনুযোগ করল না। ওরা বাড়িতে পৌঁছবার পরে দাদামশায় দিদিমাও না।

না করবার কারণ আছে। কাল দুপুরে ধূর্জটি বেরিয়ে যাওয়ার পর টেলিগ্রাম এসেছিল একটা। ছোট্ট সংবাদ— ‘মা আর নেই।’