৩.১ নয়া বসত

৩.১ নয়া বসত

চার বছর পরের কথা। শীতের সকালে একটা মরানদীতে অল্প জলটুকু যাই-যাই করিতেছিল। রাতের জোয়ার যে-টুকু জল ভরিয়া দিয়াছিল, ভোরের ভাঁটা তাহা টানিয়া খসাইয়া নিতেছে। স্রোত চলিয়াছে শিকারীর তীরের মতো। একটু পরেই শুখাইয়া ঠনঠনে হইয়া যাইবে। দুই বুড়ার ব্যস্ততার শেষ নাই। ডিঙ্গি নৌকায় বাঁশের মাচান পাতিতে পাতিতে একজন রুক্ষকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘অ গৌরা!’

গৌরার হাতের মোটামোটা আঙ্গুলগুলি শীতে কুঁকড়াইয়া আসিতেছিল। একরাশ এলোমেলো দড়াদড়ি। তার গিঁট খুলিয়া ওঠা এ আঙ্গুলের সাধ্যের বাইরে। তবু খুলিতে হইবে। বারবার চেষ্টা করে, পারে না; মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠে। রোদ উঠিতে এখনো ঢের দেরি, মালসার আগুনে হাতত্ত্বটি তাতাইয়া নেওয়া দরকার। কিন্তু মালসা কোথায়।

‘তুই একবার যা গৌরা, বরুণ-গাছের তলাত গিয়া ডাক দে।‘

স্রোত থাকিতে নৌকা খুলিতে না পারিলে, নদীর জল নিঃশেষ হইয়া যাইবে। তখন কোমরে দড়ি বাঁধিয়া কাদার উপর দিয়া টানিয়া নিতে হইবে, আর নৌকায় কাঁধ ঠেকাইয়া ঠেলিতে হইবে।

ওদিকের ঘাটে আরেকখানা ডিঙ্গি খুলিতেছে। সেখান হইতে ডাক আসে, ‘অ, নিত্যানন্দ দাদা, আ গৌরাঙ্গ দাদা?’

কান পর্যন্ত ঢাকিয়া মাথায় জড়ানো নেকড়ার রাশ। দুই বুড়া শুনিতে পায় না। কাছে আসিয়া ডাকিতে দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল! কিন্তু সে নৌকাতেও মালসা নাই দেখিয়া গৌরাঙ্গ বিমর্ষ মুখে দড়ির গিঁট খোলাতে মন দিল। যত খোলে, আবার জট লাগে। মাচান পাতা শেষ করিয়া দড়ির গেরোয় দাঁড় ঢুকাইতে গিয়া নিত্যানন্দ মুখ তুলিয়া চাহিল, ‘কি রে ছিনিবাস, বেপারে যাইবি?

‘হ দাদা। গাঙে মাছ পড়ছে। অখন কি না গিয়া পারি? তোমরা যাইবা না?’

‘যামু। আইজ না, কাইল। আইজ রাজার ঝিরে লইয়া গোকনঘাট যামু কিনা?’

দড়ি-খোলা ও বৈঠা-বাঁধা শেষ করিয়া গৌরাঙ্গ কাঁপিতে কাঁপিতে বাড়ির দিকে পা বাড়াইল। তার মুখে রাগে ও বিরক্তিতে কথা ফুটিতেছিল না। সে শুধু বিড় বিড় করিয৷ ‘রাজার ঝি,’ ‘রাজার ঝি’ করিতে লাগিল। উঠানে পা দিয়া গৌরাঙ্গের যত রাগ জল হইয়া গেল।

রাজার ঝি পা মেলিয়া বসিয়া বিলাপ করিতেছে।

বুড়ার চোখে জল আসিয়া পড়িল। সত্যি এই দুঃখী মেয়েটাকে দুই ভাই বড় স্নেহ করে। কিন্তু তার বুকভরা কান্না জুড়াইতে তাদের বুড়া হৃদয়ের স্নেহই যথেষ্ট নয়। ছেলেটা ঘরের এক কোণে মলাটের বাক্সে তার রূপকথার রাজ্য সাজাইতেছে। কয়েকটি ছবির টুকরা, দেশলাইর খালিবাক্স, জাল বুনিবার দুই একটা ভাঙা উপকরণ, কিছু সূতা, ছেঁড়া একখানা ভক্তিতত্ত্বসার, একটুকরা পেন্সিল। মলাটের বাক্সে সযত্বে সাজানো হইলে মাকে হাত ধরিয়া উঠাইল। বোগা, একটুকরা ছেলেটাব ইচ্ছার নিকট পরাজয় মানিয়াই যেন যুবতী মা কান্না থামাইয়া উঠিয়া পড়িল। এবার যাত্রা করিবার পালা।

ধরা গলায় গৌরাঙ্গ বলিল, ‘আর কিছু বাকি নাই ত?’

আর একটি কাজ বাকি আছে। তারা তুলসীতলায় প্রণাম করিতে গেল।

 

নৌকা কতক্ষণ স্রোতের টানে বেশ চলিল। গ্রাম্য নদী। খাল বলিলেও চলে। দুই পারে যেন ছবি আঁকা। রোদ উঠিয়াছে। তুই পারে গ্রামের পর মাঠ, তার পর গ্রাম। গ্রাম ছাড়াইয়া নৌকা চলিয়াছে।

অনন্ত মার কোল ঘোঁসিয়া বসিয়াছিল। নৌকাতে এই প্রথম উঠিয়াছে। আজ তার আনন্দের সীমা নাই। তুই চোখে এক রাজ্যের বিস্ময়। নদীর দুইটি তীরই এত কাছে! দুইদিকেই যখন গ্রাম থাকে তখন দুইটি গ্রামই কত কাছে। গ্রাম ছাড়াইয়া যখন মাঠে পড়ে,–জমির আলের উপর ক্ষেতের লোকে তামাক টানে, লাঙ্গলে-বাঁধা গরু ছুটি তার দিকে তাকায়।

নৌকাটা এক সময়ে আটকাইয়া গেল। ভাঁটার তখন শেষ টান। সবটুকু জল শুষিয়া নিয়া স্রোতের বেগ মন্দা হইয়া পড়িয়াছে। অনেক পিছনে, নদীর মরিবার পালা আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। রোগীর যেমন পা হইতে মরিতে মরিতে সবশেষে মাথায় আসিয়া শেষ মৃত্যু হয়, তাদের এ পোড়া গাঙেরও সেই দশা। যে-নৌকা যেখানে থাকে সেইখানেই আটকাইয়া থাকে।

গৌরাঙ্গ তখন হতাশ হইয়া হালের দাঁড় খুলিয়া ফেলিল। ইহার পর যে-কাজ করিতে হইবে, শীতের দিনে তাহা একান্ত বিরক্তিকর।

অনন্তর মা আগেই কলকেতে তামাক দিয়াছিল। মালসা হইতে এইবার জ্বলন্ত টিকাটি তুলিয়া গৌরাঙ্গের দিকে হাত বাড়াইয়া দিল। হুকা  হাতে করিয়া সামনের দিকে চাহিতে গৌরাঙ্গ দেখে তিতাসে পড়িতে আর বেশি দেরি নাই। এবার অনন্তর দিকে চাহিয়া তার মনে মমতা উছলিয়া উঠে। অনন্তর বড় গাঙ দেখার অত সাধ। বড় গাঙের কথা, তার বুকে মাছধরার কথা, রাত জাগার কথা, ভাসিয়া থাকার কথা, শুনিতে শুনিতে তার চোখ দুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এ ছেলে বড় হইলে খুব বড় জেলে না হইয়া যায় না। তখন কি সে এই গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দের মত এই মরা নদীর হাঁটুজলে টেংড়াপুটির জাল ফেলিবে। সে তখন তিতাসের অগাধ জলে ভেসাল জাল, ভৈরব জাল, ছান্দি জাল পাতিয়া বসিবে। কে জানে আরো বা’র গাঙে, মেঘনার বুকে গিয়া জগৎ-বেড়ই হয়ত ফেলিবে। তখন কি এই গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দর কথা তার মনে থাকিবে! কুড়াইয়া-পাওয়া তার মা হয়ত হইবে বড় নদীর বড় জেলের মা, সেও কি তখন অনন্তকে মনে করাইয়া দিবে যে, অনন্ত, তোর মা ডাকাতের নৌকা হইতে জলে ঝাঁপ দিয়া এক দুদিনের রাতে বড় নদীতে পড়িয়াছিল, তুই তখন পেটে। তোর মা মরি-বাঁচি করিয়া একটা বালুচরে উঠিয়াছিল মাত্র। আর কিছু মনে নাই। তারপর এই দুই বুড়া, তোর দুই দাদা, কোথা থেকে কোথায় নিয়া আসিল। কোথায় ভবানীপুর গ্রাম, কোথায় কি। দেখ, অনন্ত, আ-ঘাটাতে ঘাট হয়, আ-পথে পথ হয়, আ-কুটুমে কুটুম হয়। এই দুই বুড়া যদিও কেউ না, তবু এরা সব-কিছু। এরা ছজন আমার বাপ আর খুড়া। এ দুইজনকে তুই কোনোদিন ভুলিস না।

শীত ছাড়িয়া যাওয়ায় নিতানন্দ তাজা হইয়া উঠিয়াছে। প্রসন্ন মুখে বলে, ‘অনন্তরে ভাই, তুই না বড় গাঙের পাগল, ঐ দেখ বড় গাঙ্‌।

অনন্তর ছোট শরীর। তারপক্ষে এত দূরে থাকিতে বড় নদী দেখা সম্ভব নয়। বুড়োর বুকে-পিঠে কাপড় জড়ানো। তার উপর দিয়া টানিয়া তুলিয়া সে অনন্তকে বড় নদী দেখাইল।

এইখান হইতে বৈঠা আচল। গৌরাঙ্গ কোমরে দড়ি বাঁধিয়া জলে নামিল। সে টানিবে। নিত্যানন্দ নামিল পিছনের দিকে। সে কাঁধ ঠেকাইয়া ঠেলিবে। নৌকা হাল্কা করিবার জন্য অনন্তকে লইয়া তার মাও তীরে নামিল। তারা বাঁক ঘুরিয়া বড় গাঙে নামাইবে।

 

এইবার বড় নদী।

অনন্ত কোল হইতে নামিয়া পড়িল। একটা নেংটি ইঁদুর বুঝি ধানক্ষেতের প্যাঁচ হইতে বাহির হইয়া রূপকথার দেশের এক নদীর পারে গিয়া দেখিল সামনে রূপার নদী। গলানো উপছানো রূপার নদী, সে তো নদী নয়, হাজার বছরের না শোনা গল্প দুই তীরের বাঁধনে পড়িয়া একদিকে বহিয়া চলিয়াছে।

অনন্তর মুখে কথা নাই। সে নীরবে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে জলে নমস্কার করিল। তারপর মায়ের দেখাদেখি হাত পা মুখ ধুইয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল।

মা হুঁকা জ্বালাইয়া নিত্যানন্দ বুড়ার দিকে হাত বাড়ায়। বুড়ার দিকে সে চাহিতে পারে না। চোখ ফাটিয়া জল বাহির হয়। অসহায় দুই বুড়া। দুজনেরই বৌ কোন যৌবন কালেই মরিয়া গিয়াছে।

স্ফটিকস্বচ্ছ জলের দিকে অনন্ত একবার মুখ বাড়াইয়া দেখিল। জলে তার ছোট মুখের ছায়া পড়িয়াছে। তারই ভিতর দিয়া দেখা যায় জলের স্বচ্ছত ভেদ করিয়া জাগিয়া আছে বালিময় তলদেশ। দুই একটা শামুক হাঁটিয়াছে, তার রেখা বালির বুকে আঁচড় কাটিয়াছে। ছোট ছোট বেলেমাছ সে বালিতে বুক লাগাইয়া চুপ করিয়া আছে, যেন হাত বাড়াইলেই ধরা যাইবে। একটুও নড়িবে না। আর সেই শামুক চলার দাগ, কম জল হইতে ক্রমে বেশি জলের দিকে চলিয়া গিয়াছে। জলের নীচে বালিমাটি ক্রমে ঢালু হইয়া চলিয়াছে—এখানটা স্পষ্ট দেখা যায়, ওখানটা একটু একটু করিয়া অস্পষ্ট হইয়াছে, তারপর ওখানটাতে কিছুই আর দেখা যায় না। জল ওখানে বেশি কিনা। শামুকগুলি ওখানটাতেই গিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের পায়ে চলার দাগগুলিও অদৃশ্য হইয়াছে। ওখানটাতে কি রহস্য! নামিলে পায়ে মাটি ঠেকিবে না। আরও একটু দূরে বুঝি ঐ দাঁড় দিয়াও মাটি ছোঁয়া যাইবে না। সেখানটাতে আরও কত রহস্য! কত কি যে আছে সেখানে, হাজার চেষ্টা করিলেও অনন্ত কোনোদিন দেখিতে পাইবে না। তার চোখ আবার নিকটে ফিরিয়া আসিল। বেলে বাচ্চাগুলি এখনো শুইয়া আছে। হাত দিয়া জল নাড়িতেই মাছ ক’টা চড় চড় করিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। জলের উপর ভাসিয়া উঠিল না। বালিমাটিতে বুক লাগাইয়াই ক্রমে অস্পষ্ট হইয়া মিলাইয়া গেল, কোথায় জলের গভীরতার দিকে, যেখানে অনস্তু অনেক কিছুর মতই তাহাদিগকেও দেখিতে পাইবে না সেখানে।

শামুকের দাগগুলি দৃষ্টিসীমার যেখান থেকে উধাও হইয়াছে, সেখানটাতে অনন্ত আরো অনেক্ষণ চাহিয়া থাকিত, মা তাকে টানিয়া কোলের কাছে বসাইল, চুলের ভিতর আঙ্গুল চালাইবার জন্য।

 

 

মাতাপুত্রের দিকে স্নেহদৃষ্টিতে চাহিয়া নিত্যানন্দ বলে, ‘তিতাসের জল এত ফরসা! মাছ ত এই জলে মারা পড়ে না, মারা পড়ে ঘোলা জলে। এই সংকটকালে কি খাইয়া বাঁচবি মা, আমি তাই ভাবি?’

মাছের জো সামনে। তারজন্যে জেলেরা এখন থেকেই শক্ত জাল বোনে। তার জন্য চাই শণসূতা। সে-গাঁয় গিয়া বসিতে পারিলে এখন থেকেই সে মিহি ও মোটা দুই রকমের সূতা কাটিবে। বেচিবে। তাতে মা ছেলেতে দুর্দিন কাটাইবে।

খাই না-খাই দিন আমার যাইব, রাইত আমার পোহাইব। কিন্তু তোমরা ত জন্মের লাগি পর হইয়া গেল।’ তারাও যদি এ-নদীর পারে ঘর বাধিত। কিন্তু জন্ম-ভিটার এমনি তাদের মায়া, বুড়া হইয়াছে, সব ছাড়িবে, তবু জন্ম-ভিটা ছাড়িবে না।

তিতাসের জলের মতই অনন্তর মার চোখের ফরসা জল হু হু করিয়া ছুটিয়া আসিতে চায়।

হালে দড়ি পরাইয়া নিত্যানন্দ যৌবন-বেগে দুই-তিন টান দিয়া বলিল, ‘গৌরাঙ্গসুন্দর!’

‘কি দাদা?’

‘আমার গাতিটা খুইল্যা দে। শীত পলাইছে।’

গৌরাঙ্গমুন্দর নৌকার গলুই ধুইতেছিল। দাদার আদেশ পাইয়া তার পিঠের বড় গেরো খুলিয়া পরতে পরতে পেঁচানো কাপড়ের নিবিড় বন্ধন হইতে দাদাকে মুক্ত করিল। গাতি তাদের শীতের পোষাক।

এবার গৌরাঙ্গসুন্দর গঙ্গামার নাম স্মরণ করিয়া লগি ঠেলিয়া নৌকা ভাসাইল।

অনন্তকে মা আরো কাছে টানিয়া নিল। সে নীরবে মার বাহুর বেড়ায় বাঁধা পড়িল, কিন্তু তখন তার মন না ছিল মার দিকে না ছিল দাদাদের দিকে। নৌকাখানার অস্তিত্ব পর্যন্ত সে ভুলিয়া গেল। তার চোখের সামনে জাগিয়া রহিল শুধু একটা নদী। সে নদী তার সকল সত্তাকে, সারা অনুভূতিকে, লুতাতন্তুর মত টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। ভূত-ভবিষ্যত বিস্মৃত হইয়া সে এই সদাজাগ্রত মুখর বর্তমানের স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে। তার প্রকৃত যাত্রা শুরু যেন হইয়াছে এইখান থেকে।

দুপুর গড়াইয়া গেল। একটু পরেই বিকাল হইবে। অনন্তর মা সে গাঁ কোনো দিন চোখে দেখে নাই। শুধু জানে গাঁ খানা তিতাস নদীর তীরে। নদী সোজা উত্তর দিকে আসিয়া এ গাঁয়ের গাঁ ঘোঁসিয়া পশ্চিম দিকে মোড় ঘুরিয়াছে। এক একটা গ্রামের ছায়ায় নৌকা আসিলে চমকাইয়া উঠিয়াছে, বিহালের মত চাহিয়াছে, এই বুঝি সেই গাঁ। গাঁ খানা তার মনকে টানিয়াছে শুধু আজ নয়, অনন্ত যখন পেটে, তখন থেকে। অত বিস্মৃতির মাঝেও, বিপদের অত ঝড়তুাফানের মাঝেও, গাঁ খানার নাম সে মনে রাখিয়াছে। আর কিছু তার মনে নাই। এই গাঁ হইতেই সে প্রবাসে গিয়াছিল। তার নামও মনে নাই, দেখিতে যেন কি রকম ছিল তাও তার মনে নাই। কতবারই বা দেখিয়াছে। সেই প্রথম দিনের দেখা। সারা অন্তর তাকে চাহিয়াছিল, কিন্তু ভাল করিয়া কি তার দিকে চাহিতে পারিয়াছে। অত লোকের সামনে গানবাজনা, হৈ চৈ, মারামারি সব কিছু মিলিয়া সেদিন তাকে মূৰ্ছিত করিয়াছিল না? সেইত তখন আমাকে তুলিয়া ধরিয়াছিল, না হইলে মাটিতে গড়াইয়া পড়িতাম, যারা মারামারি করিতেছিল তাদের পায়ের তলায় পড়িয়া মরিয়া যাইতাম। মনে পড়ে যেদিন তাকে একান্তভাবে পাইলাম। আমার বড় ভয় করিতেছিল। হুরু হুরু বুকে তার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। সে আসিয়া বাহুর বাঁধনে বাঁধিয়া ভয় দূর করিল। এ যেন একটা পুতুলখেলার মত খেলা হইয়া গেল। আরো দুই একবার দেখিয়াছি; কিন্তু লোকের সামনে তার দিকে চাহিতে কেমন লজ্জ করিত, এজন্য পরিপূর্ণভাবে কি তাকে দেখিতে পারিয়াছি যে, চেহারা মনে থাকিবে। মনে পড়ে নৌকাতে যখন মাচানের তলে ছিলাম বন্দী, তার বন্ধু আসিয়া খাওয়াইত, কিন্তু সে থাকিত দূরে দূরে। বন্ধুকে সে বলিয়াছিল, আমি দেখিতে কেমন সে তা ভুলিয়াই গিয়াছে। আমার না হয় চাহিতে বাধা, তার চাহিতে বাধাটা ছিল কোথায়। এত ভোলা যার মন, সে কি এখনো দেখিলে চিনিতে পারিবে? চিনিতে পারা না পারা আমার কাছে দুইই সমান। চিনিতে পারিলে বলিবে, ডাকাতে যাকে ছু ইয়াছে, তার সঙ্গে আমার কি সম্বন্ধ। আর চিনিতে পারিলে বলিবে, অনাথা বিধবা, তাই সম্বন্ধ জড়াইয়া ঠাঁই করিয়া লইতে চায়। সামনে পতি নাই; হাতে নোয়া কপালে সিঁদুর পরণে শাড়ি মানায় না। বাপ জোর করিয়া বিধবার বেশ পরাইয়াছে। আপত্তি করিলে বলিয়াছে, ডাকাতে যখন ধরিয়াছিল, নিশ্চয়ই কাটিয়া ফেলিয়াছে, তা না হইলে, মোহানার স্রোতের পাকে যখন পড়িয়াছিল, নৌকা কি আর ছিল, নিশ্চয়ই ডুবিয়া গিয়াছিল। আমার সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া চিরদিন আমাকে মেয়ের মত কাছে রাখিবে বুড়ার মতলব ছিল এই। প্রতিবেশীদের কাছে তখন পরিচয় দিয়াছে, এর স্বামীকে ডাকাতে মারিয়া ফেলিয়াছে; একেও মারিয়া ফেলিত, জলে ঝাঁপ দিয়া বাঁচিয়াছে। সেই থেকে বিধবার বেশ। কিন্তু সে তে৷ বাহিরের। মনে মনে জানি সে আছে। সে ঐ গাঁয়েই আছে। কিন্তু না জানি তার নাম, না জানি তার বন্ধুর নাম।

রোদ কড়া হইয়া উঠিয়াছে। নৌকাখানা তাতিয়া উঠিয়াছে। দুই বুড়ার শক্ত চামড়াও তাতিয়া উঠিয়াছে। অনন্তর মার স্নেহ উথলিয়া উঠিল। বার বার ইচ্ছা করিল তার শাদা কাপড়ের আঁচল দিয়া তাদের গায়ে ছায়৷ দেয়। কিন্তু সে অসম্ভব। একটা বালিকাবয়সী নারীর আঁচলে গাঁ ঢাকা দেওয়ার বয়স তাদের নাই। সে-আঁচলে সে অনন্তর রোদে-তাতা ছোট শরীরখানা সূর্যের আড়াল করিল। কড়া রোদে, মায়ের মিষ্টি ছায়ার আড়ালে থাকিয়া অনন্ত কোনো এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। অনেক কিছু দেখিতে পারিত, ঘুমাইয়া পড়াতে দেখিতে পারে নাই। হয়ত স্বপ্নে তাহার সবই দেখিতে পাইয়াছে।

 

ঘাটে গিয়া নৌকাখানা শব্দ করিয়া ঠেকিল। চলতি নৌকা। গৌরাঙ্গ দাঁড় ঠেকাইয়া গতিরোধ করিল, কিন্তু সবটুকু গতি রদ্ধ হইল না। মাটিতে ঠেকিয়া অবশিষ্ট গতিটুকু রুদ্ধ হইতেই নৌকাটা ঝাকুনি খাইল। সেই বাকুনিতে অনন্তর মার চমক ভাঙ্গিল। এতক্ষণ সেও বুঝি স্বপ্ন রাজ্যেই ছিল। এখন ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া, কাপড় চোপড় সামলাইল, অনন্তকে ডাকিয়া উঠাইল। অনন্ত জাগিয়া চোখ কচলাইয়া ঘাটখানা একবার দেখিয়া লইল। তারপর নদীর দিকে ঘাটের লোকজনের দিকে আর ঘাটের অদূরবর্তী ছায়াঢাকা গ্রামখানার দিকে চাহিয়া দেখিল। ছোট চোখের দৃষ্টি যতদূর যায়, দেখিল, একটির পর একটি করিয়া বাঁধা নৌকা। সব নৌকা একই আকারের, একই গড়নের। সারি সারি বাঁশের খুঁটি পোঁতা আছে। তারই একটির সঙ্গে একটি করিয়া নৌকা বাঁধা। নৌকার পেছনের দিকে এক একটা ছই। ছইয়ের দুই দিকই খোলা।

দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। বেলা করিয়া যারা স্নান করিতে আসিয়াছে, ঘাটে নূতন নৌকাতে নূতন মানুষ দেখিয়া তারা কৌতুহলী চোখে চাহিয়া দেখিতেছে। অনন্তর মা এদের কাউকে চিনে না। কোনো দিন দেখে নাই। কিন্তু এরাই হইবে তার পড়শী। এদের বাড়ির পাশ দিয়াই উঠিবে তার কুটির। এদেরই সঙ্গে কাটাইতে হইবে তার মুখ দুঃখের দিনগুলি। পারে উঠিয়া দৈনন্দিন কাজেকর্মে এদেরই সঙ্গে সে মিশিয়া যাইবে। তার খুব আনন্দ হইল, এরা যেন কত আপন। তিতাসের ছোট ঢেউ তীরে আসিয়া মাথা রাখিতেছে। আমার বুকের ঢেউ বুঝি ঐ নারীদের বুকে মাথা রাখিবার জন্য উদাম হইয়া উঠিয়াছে।

একটা পাগলকে দুই বুড়াবুড়ি টানিতে টানিতে ঘাটের দিকে লইয়া আসিতেছে। পাগল একটা যুবক। হয়ত সুন্দরই ছিল। এখন কদাকার হইয়া গিয়াছে। হাড় দেখা দিয়াছে, চামড়ায় খড়ি উঠিতেছে। বিড়বিড় করিয়া কত কি যে বকিতেছে। বুড়াবুড়ির হাত ছাড়াইবার জন্য হুমড়ি খাইয়া পড়িতেছে। বুড়া তার শীর্ণ হাতখানা তুলিয়া গায়ের সব জোর একত্র করিয়া ঠাস-ঠাস পাগলটাকে মারিতেছে। মার খাইয়া পাগলটা ককাইয়া উঠিতেছে। কিছুতেই জলে নামিবে না। তারাও জলে না নামাইয়া ছাড়িবেনা। স্নান তাকে করাইবেই। পাগলের গায়ে এবার যেন হাতীর জোর আসিল। এক ঝটুকায় বুড়ার হাত ছাড়াইয়া দৌড় দিতে যাইতেছিল সে। হাতের কাছে একখণ্ড কঞ্চি পাইয়া বুড়ি সপাং সপাং করিয়া পাগলটাকে মারিল। পাগল এবার গলা ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। বুড়ার চোখেও জল আসিয়া পড়িয়াছে। বুক জোড়া নিশ্বাস ফেলিয়া সে আক্ষেপ করিতে লাগিল, ‘হায়রে বিধাতা, হায়রে উপরোল্লা, এ কি করলে, কোন পাপে তুই আমারে এ শাস্তি দিলে। সাধ করছিলাম জোয়ান পুতের কামাই খামু, তারে বিয়া-শাদি করামু, বউ ঘরে আমুম, নাতি কোলে নেমু। হায়রে আমার কপাল।’

বুড়া ছেলের গলা জড়াইয়া ধরিয়া ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আর ছেলেও বাপের গলা জড়াইয়া একটানা বিলাপ করিতে করিতে জলে নামিল। কাঁদিতেছে না কেবল বুড়িটা। হয়ত তার মা। কিন্তু কি পাষাণ। সব কান্না তার শুখাইয়া গিয়া বুঝি বা জমাট বাঁধিয়াছে। সে কেবল দুই হাতে জল তুলিয়া গামছা দিয়া পাগলের দেহটা ঘসিয়া দিতেছে। ঘাটের নারীরা স্তব্ধ হইয়া দেখিতেছে। তাদের দৃষ্টিতে দরদ ঝরিয়া পড়িতেছে। কারো কারো চোখ সজল হইয়া উঠিতেছে। অনন্তর মার মনে হইল এই সকল নারীর সবাই তার আপন। এদের বুকের মধ্যে মাথা রাখিয়া সেও পাগলটার দিকে দরদভরা দৃষ্টিতে তাকায়, সেও ঘরে যাওয়ার কথা ভুলিয়া পাগলটার দিকে জলভরা চোখে চাহিয়া থাকে। ইচ্ছা হইল পাগলটার গলা জড়াইয়া ধরিয়া সেও খানিক গলা ছাড়িয়া কাঁদে।

অনন্তর মা অনন্তকে শক্ত করিয়া বুকে চাপিয়া ধরিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *