৩. লণ্ডনের দিনগুলি

৩. লণ্ডনের দিনগুলি

১৯৯৫ সালের ৮ই জুলাই। ইংল্যাণ্ডে গ্রীষ্মের এক মনোরম সন্ধ্যা। ঘড়িতে ছ’টা বেজে গেলেও দিনের আলো তখনও এতটুকু ম্লান হয়নি। হবর্নে কনটরুমের ব্যাংকোয়েট হলে সুবেশ অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। বাইরের লনে গ্রীষ্মের মরশুমী ফুলের রংবাহার। গোলাপী আর গাঢ় বেগুনি প্যাসি, পার্পলরঙা লাইলাক আর বাসন্তী রঙের ড্যাফোডিল ফুলের সারি মৃদু হাওয়ায় নড়ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ডিনার অ্যাণ্ড ডান্স-পার্টি। বিশিষ্ট অতিথিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন—যে কোনও মুহূর্তে এসে পৌঁছবেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, শ্রী জ্যোতি বসু। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় বসু দ্রুতপায়ে হলে ঢুকলেন, পরনে নীল রঙের লাউঞ্জ স্যুট। লণ্ডনে ভারতের হাইকমিশনের মিঃ এল. এম. সিংভি এগিয়ে গেলেন বসুকে অভ্যর্থনা করতে।

হলের ভিতর বিরাট আয়োজন। স্ফটিকের বিশাল ঝাড়লণ্ঠন থেকে উজ্জ্বল আলো ঠিকরে পড়ছে, আর ঠিক মাঝখানে দুধসাদা ফ্রিসিয়া আর লালগোলাপের তোড়ার পাশেই রাখা রয়েছে তিন-থাক এক বিরাট কেক। বসুর এবার অবাক হবার পালা। ব্যাপারটা কি?—আজ যে জন্মদিন সেটা অজানা নয়, সকাল থেকেই অভিনন্দন আসতে শুরু করেছে, প্রথম ফোনটা আসে দেশ থেকেই। নিজের জন্মদিনে বাড়াবাড়ি করাটা তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়, বিনা আড়ম্বরেই দিনটা কাটাতে তিনি ভালবাসেন, ‘এসব কি?”—জিজ্ঞাসা করলেন পাশে দাঁড়ানো ডাঃ প্রশান্ত রায়কে। প্রায় ত্রিশ বছর ইংল্যাণ্ডবাসী বসুর বিদেশ সফরের নিত্যসঙ্গী ডাঃ রায় সসংকোচে জানালেন, জন্মদিন বলে ঠিক নয়। আজ থেকে ষাট বছর আগে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল…. তাই একটু এই ব্যবস্থা…। নিমেষেই বসুর মন উধাও হয়ে যায় সেই সুদূর অতীতে, শুরু হয়ে যায় স্মৃতির উথালপাথাল।

…সে অনেক অনেক দিন আগেকার কথা। ১৯৩৫ সাল। অক্টোবর মাস। ইংল্যাণ্ডে পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা তখন প্রবল, সেই ইংল্যাণ্ড যার কথা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছেন পরিবারের অনেক আত্মীয় পরিজনের মুখে, যেখানে বাড়ির অনেকেই পড়াশোনা করেছেন, যে দেশ থেকে এসেছিলেন বৌদি আইরিন, আর যে দেশের সাহিত্য পড়ে তাঁর ভালো লেগেছিল সেই দেশ তো চোখে দেখতেই হবে, আর হতে হবে ইংল্যাণ্ডে পাস করা ঝকঝকে ব্যারিস্টার!

কিন্তু প্রথম দশদিন ইংল্যাণ্ড একটুও ভাল লাগেনি বসুর। “বাড়ি আর নিজের লোকজন ছেড়ে অত দূরদেশে থাকা সেই প্রথম, তাই বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ লাগত”—বললেন বসু, “তাছাড়া তখন শীতের মুখ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ছাইরঙা আকাশ, ঘন কুয়াশা আর একঘেয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি যেন মনটা আরও খারাপ করে দিত। মনে পড়ত মায়ের কথা। বিদায় নেবার আগে মায়ের চোখে জল…বাবার ঈষৎ ম্লান মুখ। রাসেল স্ট্রীটে ভাঙা বাড়ির সস্তা ভাড়ার ‘অ্যাটিক’এ (চিলেকোঠায়) প্রথম কয়েকদিন একা খেতে খেতে মনে পড়ত কলকাতার বাড়ির জজমে খাবার টেবিল। মনে হত এই দেশে এত ঐশ্বর্য অথচ বাঙালীর হৃদয়ের সেই উষ্ণতা কোথায়?”

তবে জাহাজের যাত্রাটা কিন্তু মন্দ কাটেনি। জনা তিরিশ ভারতীয় ছিলেন, তার মধ্যে তেরজন বাঙালী। ছিলেন পরবর্তীকালের সমাজসেবিকা ফুলরেণু দত্তও। সবার চোখেই নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। একটা মুহূর্তও বিস্বাদ লাগেনি। বসু বললেন “জাহাজে একটা সুইমিং পুল ছিল, সেটা প্রায় সারাদিনই দখল করে রাখত সাদা চামড়ার সাহেবরা। আমরা একদিন ঠিক করলাম ওদের শিক্ষা দিতে হবে। পরের দিন কাকভোরে আমরা ভারতীয়রা সাঁতারে নামলাম—ওরা মুখভার করে ঘুরতে লাগল। ওহ্ বলা হয়নি, আমাদের কারোরই কিন্তু সাঁতারের পোশাক ছিল না। যে যা পেয়েছিল তাই পরেই জলে নেমেছিল।”

জাহাজ চলল, প্রথমে শান্ত আরবসাগর, তারপরে এডেন বন্দরে খানিকক্ষণ থেমে আবার লোহিত সাগর। এরপর সুয়েজ ক্যানাল হয়ে পোর্ট সঈদ, তারপর নীলরঙা ভূমধ্যসাগর। পি এ্যাণ্ড ও’ জাহাজ তখন মারসেই বন্দরে ভিড়ত। বসু নিজে বা সঙ্গীরা কেউ ফরাসিভাষায় পারদর্শী ছিলেন না, তবুও ভাঙা ভাঙা ফরাসি যাঁরা জানতেন তাঁরা কাজ চালানোর মত চেষ্টা করতে থাকেন, তাঁদের সেই ভাষা খাস ফরাসিরা কেউই বুঝতে পারে না। শেষে বসু বললেন, “যখন আমরাও ভাষাটা ভাল জানি না আর যেটুকু যে জানে সেটাও ওরা বুঝতে পারছে না, তখন যে ভাষা আমরা জানি আর সবাই মোটামুটি বুঝবে সেই ইংরেজি ভাষাই বরং চালানো যাক্।”

লণ্ডনগামী সঙ্গীরা ধরলেন মারসেই-ক্যালেই ট্রেন, ইংলিশ চ্যানেল ফেরি পার হয়ে উঠলেন ডোভারে, সেখান থেকে ট্রেনে করে লণ্ডন। ভিনদেশি খাদ্য নিয়ে বসুর একেবারেই কোনও বাছবিচার ছিল না। গোমাংস দেখে অনেক রক্ষণশীল সঙ্গী নাক কোঁচকালে বসু তাদের বলেছিলেন : “ওহে, বিদেশে গোমাংস খেলে দোষ নেই, খেয়ে নাও। বিদেশে গোমাংস অন্যরকম হয়ে যায়।” বসুর কথায় সঙ্গীরা না হেসে পারেন নি, রক্ষণশীলতা বিসর্জনও দিয়েছিলেন কেউ কেউ।

লণ্ডনে ভিকটোরিয়া স্টেশনে জ্যোতি বসুকে নিতে এলেন তাঁর কলেজ জীবনের সহপাঠী মৃণাল দত্তের দাদা। বসুকে তিনি তাঁর রাসেল স্ট্রীটের বাসায় নিয়ে গেলেন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে এই বাসাটা ছিল জীর্ণ আর ভেতরটা ছিল তেমনি কনকনে ঠাণ্ডা। সেন্ট্রাল হিটিং-এর কোনও ব্যবস্থাও ছিল না। একে মনখারাপ তার ওপর হাড় কাঁপানো শীত। বাসায় আর একজন বাঙালী ছিলেন, নামটা ঠিক বসুর মনে নেই, পদবী সেন, পাটনা থেকে এসেছিলেন। কিন্তু বসুর তখন বন্ধুত্ব করার মত মনের অবস্থা ছিল না। কিছুদিন বাদে তিনি উঠে গেলেন মর্নিংটন ক্রেসেন্টে আর একটি বাসায়, সেখানেও ঘর গরম করার তেমন ব্যবস্থা ছিল না, পুরোনো ঘরে রুমহীটারই ভরসা। আবার বসু বাড়ি পালটালেন। এবার উঠলেন বেলসাইজ পার্কে নাগেদের বাড়িতে। মিঃ নাগকে বসু তার মামার বাড়ি বারদির সূত্রে জানতেন। মিঃ নাগের স্ত্রী ছিলেন জার্মান। আরও কয়েকজন ভারতীয় ছাত্র সেখানে থাকত। মিসেস নাগ ছিলেন আর পাঁচজন জার্মান মহিলার মতই পরিশ্রমী। একাহাতে তিনি ছাত্রদের ঘর পরিষ্কার করা থেকে ব্রেকফাস্ট তৈরি করা, তাদের জামাকাপড় ইস্ত্রি করা, রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা—সবই করতেন। “কিন্তু ওনার একটা ব্যাপার খুব মজার ছিল”, হেসে বললেন বসু, “উনি আমাদের দুধে বেশ জলটল মিশিয়ে দিতেন, সকালে ডোরস্টেপে রেখে যাওয়া এক লিটার দুধের বোতল হয়ে যেত দু’লিটার, এ নিয়ে আমরা বোর্ডার ছাত্ররা একটা গান বেঁধেছিলাম। কখনো কখনো বৈঠকখানায় পিয়ানো বাজিয়ে গানটা গাওয়া হত। গানটা ছিল,

‘গয়লা দিদি লো, তোর ময়লা বড় প্রাণ!
এক সের দুধ দু’সের করিস, দুধে ডাকে বান!!”

“মজার ব্যাপার হল উনি নিজেই মাঝে মাঝে এই গানটা শুনে মাথা নেড়ে তাল দিতেন। ভাগ্যিস মানেটা বুঝতেন না!” এই বাড়িতে বসু ছিলেন পুরো একটি বছর। তারপর তিনি গোলডার্স গ্রীন-এ কিছুদিন ছিলেন, তারপর আবার চলে আসেন হ্যাম্পস্টেড্‌-এ।

বসু ভর্তি হলেন লণ্ডন ইউনিভার্সিটির ইউনিভার্সিটি কলেজে। পাঠ নিতে শুরু করলেন হিউ গেইস্কেল-এর কাছে। ধীরে ধীরে রোজকার একটা রুটিন হয়ে যায়। সকালে সাতটার সময় ঘুম ভেঙে যায়, গরম কম্বল সরিয়ে জানলার পর্দা সরাতেই চোখে পড়ে বাইরে মন খারাপ করে দেওয়া এক টুকরো ছাইরঙা আকাশ। ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখা হয় আরও কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে, বেকনভাজা, চিজ পাউরুটি টোস্ট, কোয়েকার কোম্পানীর ওটস্ আর কমলালেবুর রস খেতে খেতে ছোট্ট কুশল বিনিময়েই কথা শেষ হয়ে যায়। কারোর সঙ্গে তেমন ভাব জমে না, বসু বেরিয়ে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ইউনিভার্সিটি কলেজের ক্যাম্পাস এমন কিছু দৃষ্টিনন্দন ছিল না, লেকচার রুমের সারি আর সামনে বিস্তৃত গ্র্যাভেল ছড়ানো মাঠ। তার সামনে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই মেইন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিলডিং। কাছাকাছি ছিল ভারতীয় ছাত্রদের ইউনিয়ন আর ওয়াই. এম. সি. এ-র হস্টেল। কম দামে সেখানে পাওয়া যেত ভাত, কারি আর পাঁপড়ভাজা। ছেলেরা খেলত টেবিল-টেনিস আর অন্যান্য ঘরোয়া খেলা। মাঝে মাঝে তারা নাটক করত, বিতর্কের আসর বসাত, ভারতীয় সংগীতের অনুষ্ঠানও হত।

লেকচার শেষ হবার পর বসু টিউব ট্রেন ধরতেন ওয়ারেন স্ট্রীট স্টেশন থেকে। সন্ধ্যে সাতটায় ডিনারের আগেই বাসায় ফিরে আসতেন। খাওয়ার পর একটু পড়াশোনা, তারপর দশটাতেই বিছানায়। শনিবারগুলোতে সময় যেন আরও ভারী হয়ে উঠত। নিয়ম করে বসু চিঠি লিখতেন বাবাকে, কখনও কখনও হাঁটতে যেতেন হ্যাম্পস্টেড হী-এর সবুজ মাঠে। চুপচাপ বসে থাকতেন উঁচু টিলার ওপর। ছুটির দিনে লাঞ্চের পর কখনও কখনও বেরিয়ে পড়তেন। কোনওদিন যেতেন ক্যামডেন টাউনে, অদ্ভুত লাগত সেখানকার মেলা-মেলা পরিবেশ; প্রায়ই চলে যেতেন হাইড পার্কে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতেন স্পীকারস্ করনার্-এ কার্ডবোর্ড বাক্সের ‘মঞ্চে’ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানারকম মানুষের নানা বিষয়ে বক্তৃতা। তখন ব্রিটিশ রাজনীতিতে ভারত ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়—প্রায়ই ভারত নিয়ে থাকত ব্রিটিশ সোস্যালিস্টদের ভাষণ, থাকত কমিউনিস্টদের ফ্যাসিবাদবিরোধী ভাষণ। বসু ছিলেন নীরব মনোযোগী এক শ্রোতা—সাগ্রহে সব ধরনের বক্তৃতাই শুনতেন। কেউ হয়তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলে চলেছেন, আবার কয়েকগজের মধ্যেই চলেছে এক ভয়ংকর নাস্তিকের উগ্র ভাষণ। বেশ ভালই লাগত বসুর, সময় কেটে যেত অনায়াসে। সবচেয়ে ভাল লাগত মানুষের কথা বলার, নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার মর্যাদার ব্যাপারটা। “দেখতে দেখতে মনে হত কথায় পৃথিবী জয় হয়।”

দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে যায়। ক্রীসমাস এসে পড়ে। দোকানের জানলাগুলো সেজে ওঠে, ট্রাফালগার স্কোয়ারে বসানো হয় আলো ঝলমল এক বিশাল ক্রীসমাস ট্রি। তবে এই উৎসব নেহাতই পারিবারিক মিলনের উৎসব, বসুর আরও যেন একা লাগে। “চারদিকে এত আনন্দ, সুসজ্জিত মানুষের প্রিয়জনের জন্য কেনা হাতভর্তি উপহার দেখে মনে হত নিস্তেজ, ধূসর এই আবহাওয়া ভুলিয়ে দিতেই বোধহয় এত আয়োজন।” নতুন বছর এসে যায়, রাতভোর হৈ হুল্লোড়, নাচগান চলে, বসু যেন তার মধ্যে থেকেও ঠিক যেন ভেতরে নেই। মনে মনে তিনি যে কোনও বাড়াবাড়িকেই বিশেষ অপছন্দ করেন। অসংযম তাঁর ধাতে নেই। এখনও তাঁর মনে পড়ে প্ৰথম দিন লণ্ডনের এক পার্-এ বিয়ার পান করে বিবেক দংশনে ভুগেছিলেন। তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে সেই রাতেই বাবাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। আত্মভর্ৎসনার সেই রাতটা এখনও ভোলেন নি। বছর শেষ হবার আগেই বসু মিডল্ টেম্পলে নাম লেখান। বাবার উচ্চাশা তিনি পূরণ করবেন এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু তাহলেও “কেমন যেন”, বসু স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না, “আমার মনটা ঠিক পুরোপুরি ঐদিকে ছিল না।”

কবে এবং কেমন করে ব্যারিস্টার হতে হতে জ্যোতি বসু কমিউনিজম-এর মন্ত্রে দীক্ষা নিলেন? কবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আইন নয় রাজনীতিই হবে তাঁর জীবনের ব্রত? কেনই বা তাঁর মনে এমন পরিবর্তন দেখা দিল? এইসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু এইটুকুই বলা যায় লণ্ডনের দিনগুলি তাঁর জীবনের, জীবন সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আর এই মোড় ঘুরে যাওয়ার কারণ হিসেবে কোনও বিশেষ মুহূর্ত, কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা কোনও বিশেষ ঘটনাকে তিনি চিহ্নিত করতে রাজি নন। তাঁর মতে “কারণ অনেকগুলোই ছিল”, তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি, ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন, কমিউনিস্ট ধ্যানধারণা ভাল লেগে যাওয়া, কমিউনিস্ট মতাদর্শকে সঠিক সমাধানসূত্র বলে বিবেচনা করা ইত্যাদি—তাছাড়া ঘটনাচক্রে ভূপেশ গুপ্তর সঙ্গে আলাপ পরিচয়, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ, মার্ক্সীয় সাহিত্যপাঠ আর সব কিছু ছাপিয়ে সমাজের জন্য, নিজের দেশের ভাল করার জন্য তীব্র ইচ্ছাই তাঁকে করে তুলেছিল ‘কমিউনিস্ট’।

বসু যখন লণ্ডনে তখন বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিস্ত অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। তার অনেক আগেই ফ্যাসিস্ত মুসোলিনি ইতালিতে ক্ষমতা দখল করেছে। এ প্রসঙ্গে বসু নিজে লিখেছেন : “১৯৩৩ সালে জার্মানির দুর্বল প্রেসিডেন্ট হিণ্ডেনবুর্গ হিটলারকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করেছেন এবং ওয়াইমার রিপাবলিক ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নাৎসিরা সে সময় বড় বড় জার্মান শিল্পপতিদের সমর্থন পেয়েছিল, একমাত্র ইহুদী শিল্পপতিরা সমর্থন করেন নি। নাৎসিদের প্রচার ছিল ইহুদীদের বিরুদ্ধে, কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এবং সোভিয়েতের বিরুদ্ধে। সে সময় জার্মানির অবস্থা খুব খারাপ। প্রচণ্ড মন্দা চলছে। এদিকে তখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রেট ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান নেয়নি। বরং তারা নানাভাবে হিটলারকে তোষণ করার নীতি নিয়েই চলছিল। এরা ধরেই নিয়েছিল যে, হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নকেই আক্রমণ করবে। যদি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ হয় তাহলে দুই শত্রুই খতম হবে।”

উন্মীলনের কোনও বিশেষ মুহূর্ত না থাকলেও বসুর পরিবর্তন এসেছিল ১৯৩৬ সালে। অন্যান্য কলেজের আর পাঁচজন উৎসাহী ছাত্রের সঙ্গে তিনিও যেতেন লণ্ডন স্কুল অব্ ইকনমিক্স-এ হ্যারল্ড ল্যাস্কির উদ্দীপক বক্তৃতা শুনতে। মন্ত্রমুগ্ধের মত বসু শুনতেন তাঁর ফ্যাসিবাদবিরোধী শাণিত যুক্তি, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তীব্র নিন্দা। মনে হত তাঁকে কে যেন জাগিয়ে দিচ্ছে, খুব গভীরে নাড়া দিয়ে তাঁকে কে যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের অপমান, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দরিদ্রের যন্ত্রণা। রাতভর বসু পড়তে শুরু করলেন মার্কস-এর ‘দাস ক্যাপিটাল’ আর এঙ্গেল্স- এর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, ‘জার্মান রেমেড্ডি’ ইত্যাদি লেখা। পড়তে পড়তে মনে হত—এই তো সঠিক সমাধানের দিশা, সমাজতান্ত্রিক সমাজের পথ—কেন কিছুমাত্র লোকের হাতে থাকে ধনের সম্ভার আর কেনই বা অগণ্য মানুষ হয়ে থাকে নিঃসম্বল—তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর সহজেই মিলে যেত ঐ সব লেখাতেই। তিনি দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত স্বাধীন মানুষের উন্নত এক সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।

বস্তুতঃ ইংল্যাণ্ডে ফ্যাসিবাদবিরোধী কাজকর্মে অংশগ্রহণ করাটাই ছিল রাজনীতির ক্ষেত্রে বসুর প্রথম সক্রিয় পদক্ষেপ। তখন সি পি জি বি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি অব্ গ্রেট ব্রিটেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, ফ্যাসিবাদের বিপদ কি, এ সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা, সভা-বৈঠকে রীতিমত আলোচনা চলছে। বসু ‘লণ্ডন মজলিসে’-এর সদস্য হলেন। অন্যান্য ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে তিনিও ফ্যসিবাদবিরোধী প্রচারে অংশ নিলেন। সে সময় তাঁদের একটা কাজ ছিল ভারতের জাতীয় আন্দোলনের কোনও নেতা লণ্ডনে এলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু লণ্ডনে এলে বসু তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। ‘জন-গণ-মন’ গানটা আমরা এত বেসুরো আর উল্টোপাল্টা গেয়েছিলাম যে নেহরু আমাদের বকেছিলেন। বলেছিলেন, “তোমরা কি জানো যে এটা স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হবে?’ খুব লজ্জা পেলাম আমরা।” ইউরোপে তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলছে। জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর আক্রমণ থেকে স্পেনের সাধারণতন্ত্রকে বাঁচাবার লড়াই চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মহৎ কাজে সহায়তা করলেও ব্রিটেন, ফ্রান্স বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। এই সময় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক স্পেনে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড পাঠানোর আহ্বান জানায়। ফ্রান্স তখনই সীমান্ত রুদ্ধ করে দেয় যাতে স্পেনে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠানো যায়। পণ্ডিত নেহরু স্পেনের বার্সেলোনাতে গিয়েছিলেন সাধারণতন্ত্রী সরকারকে সমর্থন জানানোর জন্য। স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী ডলরেস ইবারুরি গৃহযুদ্ধ চলার সময় জনমত সংগ্রহের জন্য যখন প্যারিসে এসেছিলেন, তখন তাঁকে সেখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পণ্ডিত নেহরুও ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন কিন্তু ফরাসী সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বক্তৃতা দেওয়া নিষিদ্ধ থাকায় নেহরু ইবারুরিকে লাল গোলাপের গুচ্ছ তুলে দেন।

বসুর পক্ষে সে সময়টা ছিল উত্তেজনার এবং উদ্বেগের। প্রায় প্রতিদিন তাঁর দেখাশোনা হত নানাধরনের লোকের সঙ্গে। প্রায় প্রত্যেকেই একই মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাদের উত্তেজনার উত্তাপ তাঁকে ছুঁয়ে যেত। আর এই প্রথম বসুর মনে দেখা দেয় নিজের দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের আশঙ্কা মেশানো উদ্বেগ।

দেখতে দেখতে ছ’মাস কেটে যায়, দ্রুত পালটে যায় বিশ্বের চেহারা। কমিউনিস্ট ধ্যানধারণায় বসুর বিশ্বাস দিনে দিনে আরও যেন দৃঢ়মূল হতে থাকে। “সে সময় আমার ‘কফি হাউস’ ছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে ডঃ শশধর সিন্হার ‘বিলিওফাইল’। সেখানে বইটই কিনতাম আর সাথে চলত গরম গরম আলোচনা।” বেলসাইজ পার্কের ভারতীয় বাসিন্দারা তখন তাঁকে ভালভাবে চিনে গেছেন, চিনেছেন লণ্ডন মজলিস-এর অন্যান্য ফেড-ইণ্ড সদস্যরা, ইণ্ডিয়া লীগের কর্মীরা আর ‘ফেড-ইণ্ড’ অর্থাৎ বিদেশে ভারতীয় ছাত্রদের ফেডারেশন। এদের মধ্যে অনেককেই বসুর মনে হত বেশ উজ্জ্বল, তবে সবচেয়ে মনে রাখার মত ছিল ভূপেশ গুপ্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ১৯৩৬ সালে নাগেদের বাড়িতেই তাঁদের প্রথম দেখা হয়। ভূপেশ গুপ্ত ছিলেন মার্কসবাদী, বহু রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। একবার তিনি গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়। জেলে পড়াশোনা করে তিনি গ্র্যাজুয়েট হন। দেশ থেকে চলে যাবেন এই শর্তে নলিনীরঞ্জন সরকার তাঁকে জামিনে মুক্তি দেন। জেল থেকে ছাড়া পাবার পরই তিনি আইন পড়ার জন্য ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে রওনা হন। তাঁর সাধাসিধে জীবনচর্যা, বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য আর মার্কসবাদী মতাদর্শে গভীর বিশ্বাস সবই বসুর ভাল লেগেছিল। সে সময় বসুর আরও কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অরুণ বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, নিখিল চক্রবর্তী, মোহন কুমারমঙ্গলম, পি. এন. হাসার এঁরা সকলেই বসুর বন্ধু ছিলেন। ভূপেশ গুপ্তর হার্নিয়া অপারেশনের সময় হাসপাতালে গিয়ে বসুর পরিচয় হয় স্নেহাংশু আচার্যের সঙ্গে। ময়মনসিংহ রাজপরিবারের ছেলে হাস্যরসিক দরাজ মনের মানুষ স্নেহাংশু আচার্য। ভূপেশ গুপ্ত এবং স্নেহাংশু আচার্য আজীবন বসুর বন্ধু ছিলেন। এই সব ভারতীয় বন্ধুদের মাধ্যমেই বসুর যোগাযোগ হয় ইংল্যাণ্ডের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। সে সময় বিশেষ শ্রদ্ধেয় নেতা ছিলেন হ্যারি পলিট। বসু এই হ্যারি পলিট ছাড়াও রজনী পাম দত্ত, ক্লীমেন্স দত্ত এবং অন্যান্য পার্টিনেতার কাছে কমিউনিস্ট মতাদর্শের পাঠগ্রহণ করেন। বসুর গ্রুপের নেতা ছিলেন বেন ব্র্যাডলি যিনি আগে একবার পার্টি সংগঠনের উদ্দেশ্যে ভারতে এসেছিলেন। আর একজন সদস্য ছিলেন মাইকেল ক্যারিট, আই সি এস।

ঠিক এই সময়েই বসু নিজে কিছু কাজ করার সুযোগ পেলেন। হীরেন মুখোপাধ্যায়, সাজ্জাদ জাহির এবং ডাঃ জেড্. এন. আহমেদ লণ্ডন থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার পর ‘ফেড-ইণ্ড’ অর্থাৎ ফেডারেশন অব ইণ্ডিয়ান স্টুডেন্টস্ প্রায় উঠে যেতে বসেছিল। বসুকে বন্ধুরা বললেন এই সংগঠনের ভার নিতে। বসু উজ্জীবনের কাজে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন, নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক দক্ষ সংগঠকরূপে। লণ্ডন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক হলেন, ‘ফেড-ইণ্ড’ ঢেলে সাজালেন, এর নিয়ন্ত্রণসংস্থার সভা ডাকলেন, সমমতাবলম্বী বন্ধুদের একত্র করলেন। সঙ্গে চালালেন ইণ্ডিয়ান স্টুডেন্টস অ্যাণ্ড সোস্যালিজম’ পত্রিকার কাজ

এই প্রসঙ্গে বসুর একটা পুরোনো ঘটনা মনে পড়ে যায়। লণ্ডনে থাকার সময় সি পি জি বি তাঁকে একবার পাঠিয়েছিল ইস্ট লণ্ডনের বস্তিবাসী অশিক্ষিত ভারতীয় নাবিকদের ইংরেজি ভাষা শেখাতে। সেটাই ছিল বসুর অশিক্ষিত আর গরীবদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে করা কোনও কাজ। লণ্ডনের ইস্ট এণ্ড ছিল যথেষ্ট অপরিচ্ছন্ন আর ঘিঞ্জি। বাসিন্দারা ছিলেন নেহাতই গরীব। তবুও বসুর এই ভাষা শেখানোর অভিজ্ঞতাটা মন্দ লাগেনি। একবার তিনি এক সিলেটি নাবিককে ইংরেজি শেখাতে গিয়েছিলেন। ছোট্ট দমবন্ধ-করা ঘর, ভ্যাপসা গন্ধ, চারিদিকে ভিজে জামাকাপড়। ঘরে সেই নাবিকের ইংরেজ স্ত্রী আর ছোট দু’টি শিশু। নাবিকের স্ত্রী দুঃখ করে বসুকে বললেন তার অপদার্থ স্বামী একটা ইংরেজি শব্দও জানে না, কি করে সংসার চালাবে সে জানে না, তাদের ছেলেমেয়ের দুর্ভাগ্য ইত্যাদি। বসু ঘরে ঢুকতেই নাবিকটি অবশ্য স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ‘টি, টি’ বলে অস্থির হয়ে ওঠে। ভাষা জানে না অথচ ইংরেজি মেম বিয়ে করে বসল, এটা কি করে সম্ভব হল? “যখন দুজন প্রেমে পড়ে আর বিয়ে করবে ঠিক করে, তখন ভাষা জানাটা তেমন জরুরী নয়”- বসু মন্তব্য করেন।

বসুর সাংগঠনিক কাজকর্ম দিনে দিনে বেড়েই চলে। জাতীয় আন্দোলনের বিরাট নেতারা ভারত থেকে লণ্ডনে আসতে শুরু করেন। জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, ভুলাভাই দেশাই, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ইউসুফ মেহের আলি–তাবড় তাবড় নেতারা কেউই বাকি ছিলেন না। বসু আর তাঁর বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁদের সংবর্ধনার আয়োজন করতে, প্রেস কনফারেন্সের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। শান্তি ও সাম্রাজ্যের ওপর এক সম্মেলনে ১৯৩৮ সালের ১৫ এবং ১৬ই জুলাই পণ্ডিত নেহরু এক ভাষণ দেন। সম্মেলনটির অয়োজন করেছিলেন ইণ্ডিয়া লীগ এবং লণ্ডন ফেডারেশন অব পীস কাউন্সিলস। নেহরুর সঙ্গে বসুর সেই প্রথম দেখা। প্রথম সাক্ষাতেই বসু তাঁকে জানিয়েছিলেন তাঁরা ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নেহরু জবাবে জানিয়েছিলেন “আগে ভারত স্বাধীন হোক, তারপর আমরা সমাজতন্ত্রের কথা ভাবব।” অন্যান্য জাতীয়তাবাদী যুবকের মত বসুও সুভাষচন্দ্র বসুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। যখন সুভাষচন্দ্র ইংল্যাণ্ডে আসেন তখন তাঁর সাক্ষাৎকার নেন রজনী পাম দত্ত। সেই সাক্ষাৎকার, সি পি জি বি-র এক মুখপত্র ‘ডেইলি ওয়ার্কার’এ প্রকাশিত হয়। সুভাষচন্দ্রের ভাষণ বসুর বিশেষ ভাল লেগেছিল। এক সভায় যখন লেবার দলের এক নেতা বলেছিলেন “আমরাও স্বাধীন ভারতের পক্ষে”, সুভাষচন্দ্র উত্তর দিয়েছিলেন : “কথাটা শুনে ভালই লাগছে তবে আমাদের নিজেদের যুদ্ধ আমাদের নিজেদের শক্তি দিয়েই করতে হবে।” বসুর কথাগুলো খুব ভাল লেগেছিল, ভাল লেগেছিল সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিত্ব আর স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি। তাঁর সঙ্গে দেখা করে বসু বলেছিলেন তিনি ভারতে ফিরে রাজনীতি করতে চান। “তোমার দেশপ্রেমের আমি প্রশংসা করি, তবে রাজনীতি গোলাপের বিছানা নয় একথা মনে রেখো”——বলেছিলেন সুভাষ বসু। সে সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে স্বাধীনতা বিষয়ক নীতি নিয়ে মতভেদ দেখা গিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে যখন সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন ব্রিটেনের ভারতীয় মহলেও তার প্রভাব পড়ে। সুভাষচন্দ্র বসুর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জ্যোতি বসু ভাষণ দিলেও কৃষ্ণ মেনন তত জোরালো বক্তৃতা করেন নি, আর ফিরোজ গান্ধী সভায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কোনও ভাষণ দেননি। মেনন এবং ফিরোজ গান্ধী নেহরুর সমর্থক ছিলেন, সুভাষ বসুর নয়। তাছাড়া তখন ফিরোজ ছিলেন নেহরু কন্যা ইন্দিরার পাণিপ্রার্থী। “দুজনের প্রেমপর্ব তখন তুঙ্গে”, মৃদু হেসে বললেন বসু।

অন্যান্য স্বনামধন্য কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যাঁরা সে সময় ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভুলাভাই দেশাই এবং বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বসু বলেছিলেন “যখন হিটলার জার্মান মহিলাদের রান্নাঘরে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তখন ভারতে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মত মহিলারা ক্ষুদ্র পারিবারিক স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহৎ প্রশাসনিক দায়িত্ব বহন করছেন- এটা সত্যিই প্রশংসার কথা।”

সে সময় বসু প্রায়ই হ্যাম্পস্টেডে ও লণ্ডনের অন্যান্য জায়গায় বক্তৃতা দিতেন। একদিন তিনি আর ভূপেশ গুপ্ত ফ্যাসিবাদীদের এক সভায় উপস্থিত ছিলেন; সেই সভায় বক্তা ছিলেন ফ্যাসিবাদীদের ব্রিটিশ ইউনিয়নের নেতা স্যর অওয়াল্ড মোসলে। মোস্‌লে তাঁর বক্তৃতায় যেই ভারতের উল্লেখ করেছেন, বসু এবং গুপ্ত দুজনেই মঞ্চের কাছে গিয়ে সরাসরি তাঁদের অভিযোগ দায়ের করেন, “আপনাদের আদর্শ সম্বন্ধে আপনি যা খুশী তাই বলতে পারেন, কিন্তু ভারত সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করার অধিকার আপনার নেই।” কথাটা শোনামাত্র শ্রোতাদের মধ্য থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী জনতা উল্লসিত সমর্থন জানায়। মোস্‌লের শিষ্যরা দুই ভারতীয়র গায়ে হাত দেওয়ার আগেই পুলিস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। বসু এবং গুপ্ত ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান তবে ফ্যাসিবাদীদের সভা পণ্ড হয়ে যায়।

রাজনৈতিক সভা সমিতি, কাজকর্মের নেশা বসুকে পেয়ে বসে। প্রায়ই ভাবতে থাকেন ভবিষ্যতে কোন্ পথে যাবেন—আইন না রাজনীতি? রাজনীতির উত্তেজনাপূর্ণ আবর্ত সফল আইনজীবীর সুখী জীবন থেকে অনেক বেশি আকর্ষক মনে হয়। রোজই বই নিয়ে মিডল টেম্পলের উদ্দেশ্যে রওনা হন, কিন্তু বইগুলো সেখানে রেখে দিয়ে চলে যান ইণ্ডিয়া লীগের অফিসে কৃষ্ণ মেননকে নানা ধরনের কাজে সাহায্য করতে। সেখানে টাইপের কাজ, প্রেস নোটিস সাইক্লোস্টাইলের কাজ করে দেন। কয়েকদিন পরে মেননের মনে হয় বসু এবং গুপ্ত দুজনেই বামপন্থী চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী।

দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে যায়। বসু রাত জেগে পরীক্ষার পড়াশোনা করেন। সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে নেওয়ার ফলে রাতে খিদে পেয়ে যায়, দু’একটা ‘হট ডগ’ খেয়ে আবার পড়ায় মন দেন। পরীক্ষার পর বন্ধুরা ঠিক করে একটা উইক এণ্ডে তারা সেণ্ট অলবাস-এ বেড়াতে যাবে। লণ্ডন থেকে গাড়িতে গ্রেট নর্থ রোড ধরে এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে। ইচ্ছা ছিল হার্টফোর্ডশায়ারের গ্রাম দেখা, তা ছাড়া একাদশ শতাব্দীর সেই ঐতিহাসিক ক্যাথিড্রাল আর এছাড়াও বার্নার্ড শ-র বাড়ি তো আছেই। ঠিক হল একটা গাড়ি ভাড়া করা হবে। কাজটা খুব সহজ ছিল না। গায়ের চামড়ার রং দেখে কোনও সাহেবই গাড়ি ভাড়া দিতে চান না। অতি কষ্টে একজন রাজী হলেন। “বুঝতে পারলাম যে সাহেবদের চোখে সাদা চামড়া ছাড়া বাকি সমস্ত ‘বৰ্ণ’ই তাদের ভাষায় ‘কালারড্’।” ছেলেরা ভারী খুশী, সেই উপলক্ষে এক পাব্-এ কিঞ্চিৎ আনন্দও করা গেল। বন্ধুদের মধ্যে একজনেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। কিছুদূর যাবার পর তার সাথীদের মনে হল লাইসেন্সওলা ড্রাইভারকে যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, চালক বদল হল। গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল হাতে নিলেন সতীজীবন দাস। বেশ ভালই চালাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা ভ্যান সবেগে উল্টোদিক থেকে এসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে সতীজীবন ব্রেক কষলেন। ক্যাচ করে কর্কশ আওয়াজ করে গাড়ী শুধু থামলই না, পুরোপুরি উল্টেই গেল। সতীজীবনের মাথায় তখন বিরাট চোট লেগেছে, গল্প করে রক্ত বেরোচ্ছে। আর এক সঙ্গী বীরেন গুপ্তর পাঁজর ভেঙে গেছে। বসু অলৌকিকভাবে আঘাত এড়িয়ে গেছেন, কোনও রকমে গাড়ীর তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে দেখেন—সামান্য কাটাছড়া ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। তবে সেদিকে কারো মন নেই, সবাই তখন ভয়ে অস্থির। গাড়ী ইনসিওর‍্যান্স করা ছিল ঠিকই তবে এখনই যদি পুলিস এসে চালকের লাইসেন্স দেখতে চায়? এদিকে সতীজীবনকে তক্ষুনি হাসপাতালে পাঠানো দরকার। এমন সময় দেখা গেল দূর থেকে একটা নীল ফোর্ড গাড়ি আসছে। ছেলেদের উল্টোনো গাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়াল, গাড়ি থেকে নামলেন গাঢ় নীলরঙের ড্রেস পরা মধ্যবয়সী এক মহিলা। ‘আমি কি কোনও সাহায্য করতে পারি?—তোমাদের চোটগুলো জল দিয়ে ধোওয়া দরকার। আমার কাছে জল আছে, আমার কুকুরের জন্য আমি সব সময় জল নিয়ে বেরোই, দেবো কি?’

‘না না, অসংখ্য ধন্যবাদ, আমরা ঠিক আছি’—ছেলেরা জানায়।

ভদ্রমহিলা চলে গেলে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এই বিপদের মধ্যেও বসুর মাথা বেশ ঠাণ্ডা ছিল, কাছের একটা টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে তিনি অ্যামবুল্যান্স ডাকেন। সতীজীবনকে পাকা পনের দিন হাসপাতালে থাকতে হয় আর সারাজীবনের জন্য তাঁর মুখে আঁকা হয়ে যায় একটা বড় ক্ষতচিহ্ন। “আশ্চর্যের কথা এই ঘটনার দু’দিন আগে সতীজীবন দেশ থেকে মায়ের একটি চিঠি পান। তাঁর মা তাঁকে লিখেছিলেন খুব সাবধানে থাকতে, কারণ সামনে একটা ফাড়া আছে।”

দেশে ফেরার পর বসুর সঙ্গে সতীজীবনের আর কোনও যোগাযোগ ছিল না। প্ৰায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি স্থাপন উপলক্ষে লণ্ডনে নেহরু সেন্টারে এক ইংরেজ বৃদ্ধা বসুর কাছে এসে নিজেকে সতীজীবন দাসের স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। সতীজীবন এখন আর বেঁচে নেই, তাঁর স্ত্রীর কাছে তিনি সেণ্ট অলবাসে সেই অ্যাকসিডেন্টের গল্প করেছিলেন, বসুর গল্পও তিনি স্বামীর কাছে শুনেছেন। বসুও শুনেছিলেন সতীজীবন ইংরেজ মহিলা বিয়ে করেছেন, তাকে দেখলেন প্রায় পঞ্চাশ বছর পর।

গ্রীষ্মের ছুটিতে বসু বন্ধুদের সঙ্গে নানা জায়গায় বেড়াতে যেতেন। কখনও সমুদ্রের ধারে, ব্রাইটনে, ইস্টবোর্নে, বোর্নমাউথ বা সাউথসীতে। একবার বাবুজী নাগের সঙ্গে গিয়েছিলেন প্যারিসে। প্যারিস বসুর চমৎকার লেগেছিল। খাঁটি টুরিস্টদের মত সব দ্রষ্টব্যস্থানেই গিয়েছিলেন। আইফেল টাওয়ার, নেপোলিয়নের সমাধি, নত্রদাম, মোমার্ত আর শঁজেলিসে। তবে সবচেয়ে ভাল লেগেছিল সেইন্ নদীর বাঁদিকের তীরে পুরানো বইয়ের দোকানের সারি। বাবুজী নাগ ছিলেন শিল্পপ্রেমী, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে বসু কাটিয়েছিলেন লুভ্র মিউজিয়ামে। দেখলেন সযত্নে রক্ষিত নেপোলিয়নের জিনিসপত্র, বিশ্ববিখ্যাত সব শিল্পকর্ম, পরম উৎসাহে দেখতে গেলেন ‘মোনালিসা’ ছবি। এক সন্ধ্যায় চলে গেলেন মোমার্তে। দেখলেন নিবিষ্ট মনে রঙ-তুলি দিয়ে ছবি এঁকে চলেছেন অসংখ্য শিল্পী। আইফেল টাওয়ারের মাথায় ওঠার জন্য তখন ঘোরানো সিঁড়িই ভরসা। কিছুটা লিফটে কিন্তু বেশিরভাগটা হেঁটে।

বসু সঙ্গীদের নিয়ে ওপরতলায় উঠে দেখলেন টাওয়ারের নীচে সুন্দরী প্যারিস। সরু রূপোর সুতোর মত বয়ে চলেছে সেইন নদী। আর একদিন বুলেভার্ডের কাফের তলায় বসে খেলেন ফরাসী বাগেত্ রুটি আর সরু সরু আলুভাজা। টাকাপয়সার টানাটানির কারণে ‘ফোয়া গ্রা’ আর খাওয়া হল না। সবাই মিলে গিয়েছিলেন প্লাস পিগাল আর ফলিবারজার-এ। বসুর অবশ্য এই সব জায়গা তেমন রোমাঞ্চকর মনে হয়নি।

ততদিনে বসু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলেছেন। না, সফল ব্যারিস্টারি তাঁর জন্য নয়, তিনি রাজনীতিই করবেন। আধাআধি বা একসঙ্গে দুই পেশা চালাবেন না, পুরোপুরি রাজনীতি করবেন। ততদিনে মনস্থির করে ফেলেছেন তিনি কমিউনিজম- এর পথ ছাড়া অন্য কোনও পথে চলবেন না। আইনে আর তাঁর কোনও আগ্রহ নেই, এক সময় স্থির করলেন পরীক্ষাতেই বসবেন না। বেনব্র্যাডলে বললেন, “এমন কাজ কোরো না, পরীক্ষা না দিলে, ডিগ্রী না থাকলে সমাজ সেটা তোমার অসাফল্য ভেবে নেবে।’ কিন্তু প্রিয় শিক্ষক। বসু তাঁর উপদেশ শুনলেন। পরীক্ষায় বসলেন, তবে ফল বেরোনোর অপেক্ষা না করেই দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন।

তখনও ইতালি যুদ্ধে যোগ দেয়নি, ফলে বসু ঠিক সময়ে ফিরতে পেরেছিলেন। অন্যদের সে ভাগ্য হয়নি। পরে ইন্দিরা নেহরু, ভূপেশ গুপ্ত আর ফিরোজ গান্ধীকে রীতিমত ঘুরে, কেপ অব গুড় হোপ হয়ে বম্বে পৌঁছতে হয়েছিল। বসুর ইচ্ছা ছিল প্যারিস হয়ে মিলানে যাওয়া এবং সেখান থেকে ভেনিসে গিয়ে বম্বের জাহাজ ধরা। কিন্তু প্যারিস তখন যুদ্ধ-জ্বরে আক্রান্ত, মিলানের বাস সার্ভিস সাময়িক বন্ধ। সৌভাগ্যবশত হঠাৎ বসুর দেখা হয়ে যায় প্রমোদ সেনগুপ্তর সঙ্গে। সেনগুপ্ত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর কাছের মানুষ। বসু ভেনিসে কয়েকদিন থেকে যেতে বাধ্য হন। তখন দেশে ফেরার তাড়া, ভবিষ্যতের চিন্তা, ইউরোপের উত্তাল অবস্থা—এইসব কারণে বসু ভেনিসে গণ্ডোলা ভ্রমণ এতটুকু উপভোগ করতে পারেন নি। তখন তাঁর একটাই চিন্তা—দেশে ফিরে প্রথম বাবাকে জানাতে হবে তাঁর নতুন সিদ্ধান্তের কথা—যে সিদ্ধান্ত শোনার জন্য তিনি খুব ভাল করেই জানেন, তাঁর বাবা একেবারেই প্রস্তুত নন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *