সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৩. রাক্ষসীর পূজা

রাক্ষসীর পূজা

বন তো বন বিন্ধ্যবন। এদিকে এক-শো ক্রোশ, ওদিকে এক-শো ক্রোশ। বাইরের লোকে বলে — সে বনের ভিতর এমন ঢের জায়গা আছে, যেখানে সৃষ্টির শুরু থেকে এযাবৎ কোনো মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েনি। লোকে আরও অনেক কথা বলে— যা অতি ভয়ানক; সেসব কথায় কান দেওয়াই দরকার মনে করল না অশোকেরা।

শিকারের শখ প্রচণ্ড এই অশোকের। রাইফেল চালাতে ওস্তাদ এই চব্বিশ বছর বয়সেই। তার বন্ধু বরুণও ওদিক দিয়ে কম যায় না। বাড়তির ভাগ, গায়ে তার অসুরের মতো জোর। একা একখানা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে সেবার সে তার মামাবাড়ির গাঁয়ে একটা গোটা ডাকাতের দলকে গোবেড়েন দিয়ে তাড়িয়েছিল।

এম এ-তে ফাস্টো কেলাস পেল দুই বন্ধুই। খবর যেদিন বেরুলো, সেই দিনই তারা তলপি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শিকারের উদ্দেশে। বরুণ নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে বনবাদাড় ভেঙে বেড়ানোর মধ্যে বিশেষ মজা পায় না। কিন্তু শখটা অশোকের, মতলবও তারই। অশোক শিকারে বেরুলে তাকেও বাধ্য হয়েই যেতে হয়। কারণ কীরকম দুর্বলতা বেচারির মনে— কেবলই ভয় হয়, সে পাশে না থাকলে বুঝি বনে-জঙ্গলে বাঘের মুখেই প্রাণটা যাবে অশোকের।

সেই শখের ফলেই অশোক বরুণ দু-জনই আজ বিন্ধ্যবনের দোরগোড়াতে রাবণগুহা গাঁয়ের অতিথি। ওইখানে কোনো গুহার ভিতর রাবণ রাজার নাকি জন্ম হয়েছিল সেকালে। তারই দরুন গাঁয়ের ওই নাম। গোটা অঞ্চলটা জুড়ে একটানা মহারণ্য, যার ভিতর হাতি, বাইসন, বাঘ, হরিণ আর অজগর গড়াগড়ি, ছড়াছড়ি।

শিকারি এ-গাঁয়ে মাঝে মাঝে আসে, এখান থেকে গাইড, বনতাড়ুয়া, মুটে, রান্নাবান্না করার লোক— এসব জোগাড় করে নিয়ে তবে ঢোকে বিন্ধ্যবনে। তারই জন্য মহীপত মুদি বুদ্ধি খাটিয়ে একটা হাফ চটি তৈরি করে রেখেছে তার দোকানের গায়ে। একখানা দোচালা ঘর, ছাউনি তার পলকা হলেও চারধারের দেয়াল কিন্তু নিরেট পাথরের, যাতে রাতের বেলায় বিন্ধ্যবনের পশুরা চরা করতে এসে চটি থেকে শিকারিদেরই শিকার করে নিয়ে যেতে না-পারে।

এই হাফচটিতে মুখোমুখি দু-খানা দড়ির খাটিয়া, তাতে এখন আস্তানা গেড়েছে অশোক আর বরুণ। ঘরের কোণে পাথরের বেদি, তার উপর ওদের হাতিয়ারপত্তর, স্টোভ, কুকার, চাল, ডাল, আটা, চিনি, বাসনকোসন।

দুই খাটিয়ার মাঝখানে পাথর বিছানো মেঝেতে বসে আছে গাঁয়েরই কয়েক জন লোক। এরাই সাধারণত শিকারিদের সঙ্গে গিয়ে থাকে বনতাড়ুয়া আর মুটে হয়ে। গাইড গাঁয়ে এক জনই আছে, মহীপতের ভাই, নাম তার গণপত। সে বসে আছে— মেঝেতে নয়, বরুণেরই খাটিয়ার এক কোণে; বিছানাটা সেখানে গুটোনো। বরুণ বেড়াতে বেরিয়েছে, লোকগুলির সঙ্গে দরদস্তুর করছে একাই অশোক।

টাকাপয়সার ব্যাপারে অশোকের হাত দরাজ, কাজেই কথা মিটে যেতে মোটেই সময় লাগল না। গণপত উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতে একটা তুড়ি মেরে বলল— ‘তাহলে কথা তো আর বাকি রইল না, মালিকজি, নিকষা-মাইয়ের পূজার টাকাটা দিয়ে দিন। আজ রাতেই পূজা চড়িয়ে কাল ভোরেই সবাই রওনা হয়ে পড়ব।’

‘নিকষা-মাইয়ের পূজা? সে আবার কী?’ —অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অশোক।

‘নিকষা! নিকষা! রাবণ মহারাজের মা!’ —গণপত একটা সেলাম বাজায় বোধ হয় নিকষা-মাইকেই স্মরণ করে। ‘তাঁর পুজো না দিয়ে বিন্ধ্যবনে ঢুকলে তো রাক্ষসের পেটেই ঢুকতে হবে!’

অশোক হেসে ফেলল— ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিন্ধ্যবনে রাক্ষস আছে— এ-কথা এ-গাঁয়ে পা দিয়েই শুনতে পেয়েছি বটে। তা বেশ, নিকষার পুজোর জন্যে কত দিতে হবে?’

‘পান সিকি, পান টাকা, পান মোহর— যার যেমন ভক্তি!’ —উদারভাবে জবাব দিল গণপত।

অশোক এবারও হেসে বলল— ‘আমার ভক্তিটা পাঁচ সিকে পরিমাণেরই বটে, তবে তোমাদের মুখ চেয়ে পাঁচ টাকার পুজোই আমি দেব। পাঁচ মোহর দেবার জন্য রাজারাজড়ারা আছেন। ওটা আমার কাছে আশা কর না।’

পাঁচ টাকা নিয়ে গণপতেরা বিদায় হল; নেমন্তন্ন জানিয়ে গেল— রাতদুপুরে মালিকেরা যদি নিকষা-মায়ের পুজো দেখতে চান, ওরা কেউ এসে ঠিক সময়ে ডেকে নিয়ে যাবে।

‘বেশ তো, এসো কেউ, আমরা যাব’ —বলল অশোক।

রাতদুপুরের অনেক আগেই, অর্থাৎ বিকেল নাগাদই কিন্তু লোক এসে গেল। আর কেউ নয়, খোদ গণপতই।

গণপতের শুকনো মুখ, ভয়ার্ত চোখ, এ যেন সে গণপতই নয়। কাঁদো-কাঁদো ভাবে সে জানাল— একটা অতি আশ্চর্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিকষা-মায়ের মূর্তি কে ভেঙে রেখে গিয়েছে।

‘ভেঙে রেখে গিয়েছে?’ —অশোক বন্দুকটা সাফ করছিল। সেটা হাতে নিয়েই সে উঠে দাঁড়াল।

বরুণ একটা উপন্যাস পড়ছিল, বই থেকে একবারটি মুখ তুলে গণপতের দিকে তাকাল, তার পরই একটা ‘ওহো!’ আওয়াজ করে আবার তক্ষুনি ডুবে গেল বইয়ের পাতায়।

গণপত তখন আঙুল মটকে অভিশাপ দিচ্ছে। নিকষার মূর্তি একটা ভাঙা মন্দিরের ভিতর; ইদানীং অনেকদিন সেখানে পুজো পড়েনি; নিশ্চয়ই মন্দির জঙ্গলে ভরে গিয়েছে— এই মনে করে গণপতেরা বেলাবেলি সেখানে গিয়েছিল জায়গাটা সাফ করবার জন্য। রাত্তিরে অনেক লোক জমায়েত হবে, পাঁঠাবলি হবে, নাচ-গান হবে সেখানে, চারধারে নোংরা থাকলে চলবে কেন?

কিন্তু সাফ করবে কী, মন্দিরে ঢুকেই তাদের মাথায় বাজ পড়ল যেন! নিকষা-মায়ের রক্তমাখা কালো পাথরের মূর্তি কে যেন ভেঙে রেখে গিয়েছে। একখানা প্রকাণ্ড পাথর পড়ে আছে সেখানে, ওই মন্দিরেরই দেয়ালের খসে-পড়া পাথর। বেশ বোঝা যায়— সেই পাথরখানায় ঘা মেরে মেরে মূর্তিটা গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যে-ই করে থাকুক, তার গায়ে অসুরের মতোই জোর আছে নিশ্চয়ই।

‘কিন্তু যেই করে থাকুক’ —দাঁত কিড়মিড় করে গণপত বলল— ‘যেই এ কাজ করে থাকুক, রাক্ষসের পেটে সে যাবেই। রাক্ষসেরা সব হল নিকষারই ছেলে-মেয়ে, মায়ের অপমান তারা সইবে না।’

অশোক বলল— ‘তা রাক্ষসের পেটে যে যাবার সে যাক, আমাদের শিকারে যাওয়ার কোনো বাধা তো হবে না এর দরুন?’

অজানা কালাপাহাড়ের উপর মনের ঝালটা অশোকের উপরই ঝাড়ল গণপত। কটমট করে তাকাল অশোকের দিকে; তারপর কড়া সুরেই বলল— ‘পুজোর টাকা মোড়লের কাছে জমা রইল; মূর্তি মেরামত হলে পরে পুজো দেব আমরা, ফিরে এসে। নিকষা-মা জানে আমরা বেচারিরা কোনো দোষ করিনি। আমাদের পাওনাগণ্ডা কেন ফসকে যায়? ভোর বেলাই রওনা হব আমরা।’

গণপত চলে গেলে অশোক বরুণের দিকে তাকিয়ে বলল— ‘কোনো পাগলের কাজ নিশ্চয়ই। নইলে আবহমান কাল যে-মূর্তি পুজো পাচ্ছে তাকে আজ হঠাৎ ভাঙতে যাবে কে? হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে খুনজখম করা, অসভ্যদের ভিতর এটা তো আখছারই দেখা যায়!’

বরুণ বই ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসল খাটিয়ায়। সজোরে একটা তুড়ি দিল দুই হাতের তালুতে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ল অশোকের উপর। তার কানে কানে ফিসফিস করে বলে ফেলল— ‘আমি অসভ্যও নই, মাথা খারাপও হয়নি আমার। কিন্তু মূর্তিটা আমিই ভেঙেছি বন্ধু!’

অশোকের মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না এক মিনিট! পুরো এক মিনিট সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বরুণের পানে। মানে? মাথা খারাপ না হলে বরুণ হঠাৎ একটা মূর্তি ভাঙতে গেল কেন এই বিঘোর বিদেশে এসে? আচমকা সুলতান মামুদের ভূত এসে তার কাঁধে ভর করল কোত্থেকে?

অশোকের মুখ দিয়ে প্রশ্ন না বেরুলেও উত্তর এল বরুণের তরফ থেকে। ‘কী জানো, বেড়াতে বেড়াতে রাস্তার ধারে হঠাৎই দেখলাম ওই বিশ্রী মূর্তিটা। তোমায় বলব কী ভাই, অত ঘৃণ্য, বীভৎস, গা-বমি-বমি করানো পদার্থ আমি জীবনে আর কখনো দেখিনি। নিছক ঘেন্নার বশেই একটা পাথর দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়। পাথরখানা ছিল বেশ ভারী, আর আমার গায়ে জোরও নেহাত কম নয়, কাজেই এক ঘায়েতেই—’

খানিকটা দম নিয়ে অশোক চুপি চুপি বলল— ‘যা করেছ তা করেছ, স্পিকটি নট! ও-কথা প্রকাশ হলে এ-গাঁয়ের কোনো লোক আমাদের সঙ্গে শিকারে যাবে না।’

দিন সাতেক বাদে।

বিন্ধ্যবনের মাঝামাঝি এসে পড়েছে অশোকেরা। শিকার এমন বেশি করেছে, তা বলা যায় না। স্রেফ বাঘ আর হরিণ। একটার বেশি দুটো হরিণ ওরা কোনোদিন মারে না। বলে— ‘খাদ্য পশু দরকারের চাইতে বেশি মারতে নেই। বাঘেও মারে না।’

সে-কথা শুনে গণপত বলে— ‘বাঘের কথা আলাদা। ওরা আমাদের মারবে— বাগে পেলে। তাই আগে থাকতে ওদের মারা কোনো দোষের কথা নয়। রাক্ষসের বেলাও ওই কথাই খাটে। পেলেই খেয়ে ফেলবে আমাদের। তাই আগে থাকতেই বলে রাখি— রাক্ষস দেখলেই মারবেন মালিকেরা। রাক্ষসের মুল্লুকে আমরা এসে পড়েছি।’

‘রাক্ষসের মুল্লুকে?’ —একসাথেই চেঁচিয়ে উঠল দুই বন্ধু ।

‘ওই যে ছোট্ট নদীটা পেরিয়ে এলাম আজ দুপুরে, ও হল সীতাসর। সীতার কুটিরের চারদিকে গণ্ডি টেনে রেখে গিয়েছিলেন না লক্ষ্মণ? সেই গণ্ডির রেখাটাই গভীর হতে নদী হয়েছিল একদিন। ওই গণ্ডির নদী পেরিয়ে রাক্ষসেরা যেতে পারে না ওদিকে। এদিকে ওদের অবাধ রাজত্ব।’

বরুণ অট্টহাসি হেসে অশোকের দিকে তাকাল; কিন্তু অশোক? —রাক্ষস-টাক্ষসে বিশ্বাস না থাকলেও সে কিন্তু গণপতের কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিতে পারল না। তার মনে কাঁটার মতো খচ খচ করে উঠল একটা কথা। নিকষার পুজো দিয়ে যারা আসে, রাক্ষসে তাদের কিছু করতে পারে না, গণপত বলেছিল এ-রকম। সে পুজো তারা দিয়ে আসেনি। অধিকন্তু— নিকষার মূর্তিটাই তারা ভেঙে দিয়ে এসেছে।

গণপত সত্যিই হয়তো আঁচ করেছে কিছু। অশোকের মনের কথাটাই বেরুলো তার মুখ দিয়ে। ‘আমাদের উপর রাক্ষসদের রাগ আছে এবার। ভালোয় ভালোয় সবাই ফিরব কিনা জানি নে। রাত্তির বেলা হুঁশিয়ার থাকবেন মালিকেরা।’

‘হুঁশিয়ার থাকব বইকী! রাক্ষস যদি আসে, দেখে যাবে এ যুগের রাম লক্ষ্মণের হাতে সে যুগের চাইতেও মারাত্মক অস্ত্র আছে!’ —হাতের রাইফেলটা নাচাল বরুণ।

সে-দিন বেলাবেলিই শিকার বন্ধ হল। তিনটি বাঘের ছাল ছাড়িয়ে মাটিতে পেতে রাখা হয়েছে। একটা হরিণ কেটেকুটে রান্নার জন্য তৈরি হচ্ছে। আগুন জ্বলেছে। সেই আগুনে কেটলি চাপিয়ে চায়ের জল গরম করছে বরুণ।

অশোক যেন একটু চিন্তায় পড়েছে। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল— ‘গণপতের তখনকার কথাগুলো লক্ষ করেছিলে? ”রাক্ষস দেখলেই মারবেন!” —আমার যেন মনে হয়েছিল— লোকটা ঠাট্টা করলে আমাদের!’

‘রাক্ষস দেখব না, এইটেই দুঃখ!’ বরুণ কেটলিতে চা-পাতা ফেলতে ফেলতে তীক্ষ্নস্বরে বলে উঠল— ‘রাক্ষস হোক আর খোক্কস হোক, রাইফেলের বুলেটের সমুখে সবাই যে হরিণের মতোই অসহায়, সেটা গণপতকে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ আমরা পাব না, এইটেই একমাত্র আপশোস।’

অশোক চিন্তিতভাবেই মাথা নাড়ল। ‘ওদের গল্পটা বেশ সাজানো কিন্তু। রাবণগুহা গাঁয়ে নিকষার মূর্তি, বিন্ধ্যবনের মাঝামাঝি সীতাসরের গণ্ডি, ওপারে মাভৈঃ, এপারে হইহই, চমৎকার সাজানো গল্প! হঠাৎ বিশ্বাস করা শক্ত যে এ-গল্পের পিছনে বস্তু নেই একেবারেই!’

‘গণপত আজ চা খাবে না, না কি?’ —হঠাৎ চারদিকে তাকাতে লাগল বরুণ— ‘তাকে তো ধারেকাছে দেখছি নে!’

অশোকও খানিকটা এদিক-ওদিক দেখে বলে উঠল— ‘শুধু গণপতকে দেখছি নে, তা নয়, দেখছি নে বাইশটা লোকের একটাকেও।’

দু-জনে উঠে দাঁড়াল চট করে। টিনের চোঙ ছিল থলের ভিতর। তাই মুখে দিয়ে অশোক হাঁকতে লাগল— ‘গণপত! ইন্দরমল! চকনু!’

কোনো জবাব নেই। চেঁচামেচিতে পাখিগুলোর ঝটাপটি শুরু হয়ে গেল গাছে গাছে; ঝোপেঝাড়ে দৌড়োতে লাগল ছোটো ছোটো চার পা-ওলারা, মানুষের সাড়া পাওয়া গেল না কিন্তু কোনো দিকেই।

দুই বন্ধু তাকাতে লাগল— এ ওর দিকে। বরুণ বলল— ‘একি! তুই কি ভয় পেলি না কি অশোক?’

‘তা একটু পেয়েছি’ —অশোক স্বীকার করল— ‘বাঘ-টাঘ একরকম বুঝি; রাক্ষস-খোক্কসের কথা আলাদা। অবশ্য ওরা নেই জানি; কিন্তু জানাটার ভিত ধ্বসিয়ে দিয়েছে ওই বাইশটা লোক। ভয় সংক্রামক।’

‘তোর থেকে কিন্তু আমাকে আক্রমণ করতে পারবে না ভয়’— বরুণ খট খট করে হেসে আবার বসে পড়ল, এবং চা তৈরি করতে লাগল পরম যত্নে। তারপর আবার মুখ তুলে অশোকের দিকে তাকিয়ে বলল— ‘কী বদমাইশ ওই লোকগুলো! ওই রাবণগুহার গণপতেরা! পালাবি তো সীতাসর পেরুবার আগেই কেন পালা না। তা নয়, রাক্ষসের এলাকায় আমাদের ভালোরকম পৌঁছে দিয়ে তারপর পালাল! এত দূরে এনে ছেড়ে দিয়ে গেল ইচ্ছে করলেও আমরা সন্ধ্যার আগে সীতাসর পেরিয়ে নিরাপদ এলাকায় ফিরতে পারি নে।’

অশোক মাথা নাড়ল— ‘অর্থাৎ, আমরা রাক্ষসের পেটে যাই, এইটেই চায় ওরা।’

আবার অট্টহাসি হেসে উঠল বরুণ। ‘কেমন আমরা রাক্ষসের পেটে গিয়েছি, কাল তা বুঝবেন বাছাধনেরা। ভোর হলেই আমরা ফিরছি। চুক্তিভঙ্গ একটা অপরাধ। নালিশ করে খেসারত আদায় না করি যদি ওদের কাছ থেকে— আমার নাম বরুণ নয়।’

অশোক সায় দিল— ‘ঠিক তো! বনের ভিতরটা রাক্ষসের রাজ্য যদি-বা হয়, বনের বাইরে স্বাধীন ভারত; সেখানে আইনকানুন আছে।’

ও কী ও? কানফাটানো একটা কোলাহল শোনা যায় পাহাড়ের দিক থেকে। অর্থাৎ গণপতেরা যেদিকে পালিয়েছে তার উলটো দিক থেকে।

চায়ের পেয়ালা ঠক করে মাটিতে নামিয়ে রেখে দুই বন্ধু উঠে দাঁড়াল আবার। তাকাতে লাগল এ ওর পানে।

বরুণ রাইফেলটা পরখ করতে লাগল। ঠিক আছে তো? রাক্ষস অবশ্য নয়, কিন্তু শত্রু হওয়াই সম্ভব। কোলাহলটা শুনে ওর ভিতর অন্তত পঞ্চাশটা গলার অস্তিত্ব আন্দাজ করে নেওয়া শক্ত নয়। দোনামনাভাবে অশোক বলল— ‘পিছু হটলে একটা লজ্জার কথা হবে, কি বল? কাপুরুষ ভাববে ওই গণপতেরা।’

‘পিছু হটব যে, তার কারণটা কী?’ —রেগে উঠল বরুণ। ‘একটা গোলমাল শুনছি, তা ঠিক। কিন্তু কোনো অসভ্য জাতের লোকেরা দল বেঁধে আমাদের উপর অকারণে চড়াও হয় যদি, অটোমেটিক রিপিটার হাতে থাকতে আমরা তাদের সমুখে পিছু হটব?’

‘কিন্তু গণপত যা বলছিল’— ঢোঁক গিলে অশোক বলল— ‘মানে রাক্ষস কি কোনোমতেই থাকতে পারে না? রাক্ষস মানে আসুরিক ধরনের জীব একটা, অসাধারণ শক্তি যার, অপরিসীম নিষ্ঠুরতা যার—’

‘রাক্ষস কোনোমতেই থাকতে পারে না। আর জীবনমাত্রই রাইফেলের বধ্য, সে যত আসুরিক আর যত অসাধারণ হক।’ —এই বলে বরুণ একটা বড়ো গাছের তেডালায় উঠে বসল হাতিয়ারপত্তর হাতে নিয়ে। অগত্যা অশোকও উঠে পড়ল তার পিছনে।

সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল, কোলাহলও এগিয়ে এল। অন্য দিন রাত্রির সঙ্গেই আসে বাঘ, আর গণ্ডার আর বুনো হাতির আওয়াজ; আজ কিন্তু পশুরা সব নীরব, তারা যেন এ-জঙ্গল ছেড়ে পালিয়েছে আজ। পশুরা পালিয়েছে আসছে রাক্ষসেরা।

বরুণ বিশ্বাস করুক আর না করুক, এরা যে রাক্ষস ছাড়া কিছু নয়, এ ধারণা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছে না অশোক। কোনো জানা জানোয়ারের গলা থেকে এমন বুকের-রক্ত-হিম-করে-দেওয়া দানবীয় হুংকার বেরুতে পারে না। আকাশ ফেটে যাচ্ছে সে চিৎকারে, বনের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত গুরগুর আওয়াজ গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে যেন বর্ষাদিনের মেঘের গর্জন। অশোকের মনে হল— তাদের গাছটা থেকে থেকে থরথর করে কেঁপে উঠছে যেন ভূমিকম্পের তাড়নায়।

চারদিক আলো হয়ে আসছে। এ কী আবার? সূর্য নয়, চাঁদ নয়, এ আলো কীসের?

বুঝতে দেরি হল না। শত শত মশালের এ আলো। রাক্ষসদের হাতে হাতে সরুপানা শুকনো ডাল এক একখানা, দাউদাউ করে জ্বলছে সে ডাল।

এল! এল! আলোয়-আলো হয়ে উঠল সারা বন। গাছের উপর বরুণ আর অশোক— এ ওর মুখ দেখতে পাচ্ছে! আশোকের মুখ কাগজের মতো সাদা, বরুণের মুখ লাল টকটক করছে; দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল— ‘রাক্ষস বলে কিছু আছে, এ আমি কখনো স্বীকার করব না। সেই পিশাচীর পুতুলটা ভেঙেছি, বেশ করেছি। আবার পেলে আবার ভাঙব।’

যেন তার কথা শুনতে পেয়ে তারই উত্তরে অট্টহাসি হেসে উঠল রাক্ষসেরা। আর ঠিক যেখানটায় আগুন জ্বেলে চা তৈরি করছিল বরুণেরা একটু আগে, সেইখানে— পিছনের বনছায়া থেকে ছিটকে ছুটে এল একটা মূর্তি। তার মাথাটা ভাঙা, নিকষ কালো অঙ্গে রক্ত ঝরছে শতধারে। এমন কুশ্রী, এমন ভয়ানক, এমন ঘৃণ্য কোনো কিছু কখনো দেখেনি অশোক।

হতবাক হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে আছে অশোক, এমন সময় সেই মূর্তি একখানা লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল নীচ থেকে। অন্তত পঁচিশ হাত উপরে অশোকেরা বসে আছে যে ডালে, তারই পানে ছুটে এল বিদ্যুতের বেগে সেই রাক্ষুসে হাত।

একটা আওয়াজ হলো বইকী রাইফেলের। একটা কী দশটা— তাও ঠিক ঠাহর করতে পারল না অশোক। হঠাৎ দেখল সেই হাত নেমে যাচ্ছে গাছের তেডালা থেকে; হাতখানা খালি নয়, সাপের মুখে ব্যাঙের মতো সেই হাতের মুঠিতে আটকে আছে তার বন্ধু বরুণ।

একটা গুলি কোনোমতে ফায়ার করে দিয়েই অশোক কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে গেল— সেই পঁচিশ হাত উপরের তেডালা থেকে।

অশোকের জ্ঞান হল পরদিন অনেক বেলায়। গণপত তখন তার চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। ব্যপারটা কী হয়েছিল, তা যখন ধীরে ধীরে তার মাথায় এল, সে আর্তনাদ করে উঠল— ‘বরুণ? বরুণ কোথায়?’

গণপত ধীরে ধীরে, যেন কাতর হয়েই বলল —’নিকষা-মাইয়ের পেটে। নিকষা-মাইকে আপনি দেখেছেন তো! কাল যিনি হাত বাড়িয়ে এই গাছ থেকে বাবুজিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে গেলেন।’

‘তোমরা দেখেছ?’ অবাক হয়ে অশোক জিজ্ঞাসা করল— ‘কোথায় ছিলে তোমরা?’

‘এইসব গাছের মাথাতেই ছিলাম! এরকমটা হবে, আগেই জানি তো!’

রাগে ঘৃণায় তার দিকে আর ফিরে চাইল না অশোক। উঠে দাঁড়াল, রাইফেলে ভর দিয়ে। তার সমুখেই একটা কাটা মাথা পড়ে আছে, দেখতে পেল। সে মাথা বরুণের।

সে আবার টলে পড়ছিল, গণপত তাকে ধরে মিষ্টি সুরে বলল— ‘ভয় পাবেন না মালিক আপনার উপর মাইয়ের কৃপা আছে। আপনি মাইয়ের পুজোর জন্য টাকা দিয়েছিলেন। আর মূর্তি ভাঙার ভিতরেও হাত ছিল না আপনার।’