সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

৩. দশ লাইট-ইয়ার দূরত্বে

দশ লাইট-ইয়ার দূরত্বে*

দূরবিন লাগিয়েও বোঝা গেল না বিশেষ কিছু। এই পাহাড়ের মাথাটা মোটামুটি সমতল, যেখানে ওরা নেমেছে। কিন্তু এ থেকে নীচে নামা খুব সহজ হবে না। এর গা খাড়া বললেই হয়। নীচে লালচে বালির মহাকান্তার, ঢেউ খেলতে খেলতে চলে গিয়েছে দিগন্ত অবধি। মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো পাহাড় চোখে পড়ে, অনুচ্চ, মসৃণ, ঘাসে-ঢাকা। চূড়াও আছে এক-আধটা, সেগুলি কিন্তু ন্যাড়া, রুক্ষ নিরেট পাথর ছাড়া আর কিছু না।

লোকালয় চোখে পড়ে না কোথাও, ছোটো বা বড়ো জন্তুজানোয়ারের চিহ্ন নেই কোনোদিকে। এমনকী গাছপালা বনজঙ্গলেরও ষোলো আনা অভাব গ্রহটাতে।

কাটা-কাটা কথায় কে একজন বলে উঠল পেছন থেকে, ‘উপনিবেশ গড়ে তুলবার পক্ষে আদর্শ জায়গা, ক্যাপ্টেন স্পেনসার!’

স্পেনসার দূরবিন নামিয়ে নিল চোখ থেকে, ‘তা হয়তো হতেও পারে স্যার!’

মেজর রাফেলের নাক একটা বিশেষরকম আওয়াজ ছাড়ল। যারা তাঁকে জানে, তারা এটাও বিলক্ষণ জানে যে, ওই বিশেষ আওয়াজটা মেজরের বিরক্তির পরিচায়ক।

ঘাড়ে-গর্দানে দশাসই মনিষ্যি এই রাফেল, পঁয়তাল্লিশে কান পিঠের চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে, চালচলন পরিপাটি রকম কেতাদুরস্ত। যে ভঙ্গিতে চারদিকে তিনি তাকাচ্ছেন, তাতে বব স্পেনসারের বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি ইতিমধ্যেই মনস্থির করে ফেলেছেন।

‘তোমার মতো খুঁতখুঁতি আমার নেই হে ক্যাপ্টেন।’ বিচারক যে সুরে মামলার রায় দেন, সেই সুরই ধ্বনিত হয়ে উঠছে তাঁর কথায়, ‘ওই আকাশটা দেখ, খণ্ড খণ্ড মেঘ ভাসছে তাতে। দূরের ওই পাহাড়গুলি দেখ, বাসন্তী রোদের নীচে ঝলমলে সবুজ। কোনোদিন আবাদ হয়নি ওসব জমি, ওদের উর্বরতা দেখে একদিন তাক লেগে যাবে তোমাদের। পৃথিবী থেকে যা-কিছু বীজ আনো, সোনা ফলাবে তাতেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, আদিবাসি নেই একটাও, ওই উৎপাত যেখানে আছে, সেখানেই ঝামেলা।’

তারপরে খাকি ঢাকা ঘাড় পিছনে হেলিয়ে তিনি সশব্দে নিশ্বাস নিলেন একবার, ‘আবহাওয়া বিশুদ্ধ, ক্লারেটের মতো নির্মল। আর তুমি কী চাও ক্যাপ্টেন?’

বব জবাব দেয় না। হয়তো ঠিক কথাই বলছেন মেজর রাফেল। কিন্তু কেমন যে ওঁর স্বভাব, নীচের লোকেদের মুখ থেকে আপত্তি বেরুবার আগেই উনি সেটা আন্দাজ করে নেন, আর সোৎসাহে তা খণ্ডন করতে লেগে যান। বাহ্যত এই অ্যান্টলকে; হ্যাঁ, মাটিতে নামবার আগেই মেজর গ্রহটার নামকরণ করেছেন ‘অ্যান্টল’।

অ্যান্টলকে বাহ্যত পৃথিবীরই মতো বলে মনে হয় বই কী! কিন্তু এটাও তো ভাবা উচিত যে ওই ‘আর্গেমোন’ বিমানখানা অপার মহাশূন্যের ভিতর দিয়ে দশ দশটা লাইট-ইয়ারের দূরত্ব অতিক্রম করে সবে এই অ্যান্টলে পৌঁছোল আজ। পৃথিবী থেকে এত এত দূরে এসে, অজানা পরিবেশে, বিশেষরকম বিচারবিবেচনা না-করে হঠাৎ কোনো গুরুতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কি উচিত হবে?

মেজরের অতখানি উচ্ছ্বাসের উত্তরে সে শুধু সতর্কভাবে ছোট্ট জবাব দিল একটা, ‘গ্রহটা বাসযোগ্যও হতে পারে বই কী স্যার!’

কাল সন্ধ্যায় অ্যান্টলে নেমেছে আর্গেমোন। সারারাত্রি ওরা সবাই ভিতরেই ছিল। রেডিয়োম্যান স্যান্ডি ট্রেনহ্যাম হাওয়ার কোনো স্তরেই স্থানীয় কোনো সংকেত বা শব্দের পাত্তা পায়নি। তাতেই প্রমাণ যে সভ্য বা বিজ্ঞানবিদ কোনো মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব এখানে নেই। খবরটা রাফেলকে করেছে উল্লসিত। আবহাওয়ার গুণাগুণ পরীক্ষার ফলে সে উল্লাস আরও বেড়ে গিয়েছে তাঁর। ভাবে ভঙ্গিতে এমনটাই যেন তিনি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন যে ব্যক্তিগতভাবে একটা মহাযুদ্ধ জয় করে ফেলেছেন তিনি।

এইবার প্রভাত হয়েছে, সবাই বিমান থেকে নেমে আবিষ্কারে বেরুবেন। স্যান্ডি ট্রেনহাম নীচে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘মেজর কি শুধু সুপ্রভাত জানাচ্ছিলেন, না ”সব ঠিক হ্যায়” বার্তা পাঠাবার ব্যাপারে তোমার সম্মতি চাইছিলেন?’

হালকা সুরে কথা কইছে স্যান্ডি, যেমন ওর চিরকেলে স্বভাব। তবু যেন বব স্পেনসারের সন্দেহ হল ওর আসল মতলব ববকে সতর্ক করে দেওয়া।

সে পালটা প্রশ্ন করল, ‘মেজর পৃথিবীতে রেডিয়ো করতে বলেছেন, নয়?’

‘তা তো বলছেনই।’ জবাব দিল স্যান্ডি, ‘প্রাথমিক বার্তা আমি নিম্ন মহাকাশ বেতারে আগেই চালান দিয়েছি। কেন্দ্র বদল হতে হতে খবরটা ঘণ্টা বারোর ভিতর আমাদের কাছে পৌঁছোবে, আশা করি। তারপরই কথা উঠবে, ”সব ঠিক হ্যায়” ছাড়পত্র দেওয়ার। সেটা দেওয়ার ক্ষমতা ওঁর একার হাতে নয়। তাইতেই জানতে চাইছিলাম, সে-ব্যাপারে তোমার সম্মতি আদায়ের চেষ্টা উনি করেছিলেন কি না।’

‘এখনও খোলাখুলি কিছু বলেননি বটে, তবে—’ বব শেষ করল না তার কথা। নিজের ঢাক সব চাইতে জোরে বাজুক, সেদিকে রাফেলের অখণ্ড মনোযোগ। অতএব বারো ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তিনি নির্ঘাৎ চাপাচাপি শুরু করবেন যে, সব ঠিক হ্যায় বার্তা পাঠাতে কর্মচারীরা সবাই রাজি হয়ে যাক। ওটা পৌঁছোনো মাত্র পৃথিবীতে জয়জয়কার পড়ে যাবে রাফেলের। সবাই জানবে যে, মেজর রাফেল নিজের টুপিতে আর একটা রঙিন পালক গুঁজে ফেলেছেন, এমন একটা নতুন গ্রহ খুঁজে বার করেছেন দশ লাইট-ইয়ার দূরের মহাকাশে, যেখানে পৃথিবী থেকে কিছু বাড়তি মানুষকে অনায়াসে সরিয়ে দেওয়া যায়।

কথা বব শেষ করেনি, কিন্তু তার মনের কথা বুঝে ফেলতেও স্যান্ডির দেরি হল না। সে পাদপূরণ করল ববের অকথিত উক্তির, ‘বলেননি বটে, তবে বলবেন দুই-এক ঘণ্টার মধ্যেই। তুমি কী বলবে? সায় দেবে?’

‘যতক্ষণ জায়গাটাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে বুঝতে না-পারছো, ততক্ষণ দেব না।’ উত্তর দিল বব।

‘মেজর রেগে যাবেন।’

‘তা কী করব? ব্যাপারটা বোঝো। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা এমন বেড়ে গিয়েছে, সব ঠিক হ্যায় বলে একটা খবর পাওয়া মাত্র ওরা বিমান রওনা করে দেবে দু-হাজার লোক ভরতি করে। ভেবে দেখ, অত বড়ো একখানা বিমানকে দশ লাইট-ইয়ার দূরে পাঠাবার খবরটা কী। তড়িঘড়ি একটা খবর পাঠাব আমরা, সে খবরটা যদি শেষকালে ভুয়ো প্রতিপন্ন হয়, ওই বিরাট ব্যয়টা তখন হয়ে দাঁড়াবে অপব্যয়। তখন রাফলের তো মুখে চুনকালি পড়বেই, আমাদের মুখও নিষ্কলঙ্ক থাকবে না।’

‘তা তো নিশ্চয়ই।’ মাথা নাড়ল স্যান্ডি, ‘সব ঠিক হ্যায় বার্তা পাঠানোর ব্যাপারে আমাদেরও যখন দায়িত্ব আছে।’

দু-জন বৈমানিক, হবস আর গ্রিফিথস তখন গাড়ি নামাচ্ছে বিমান থেকে।

বব স্পেনসারও বেরুবে গাড়িতে, তার আগে বিমানে উঠে নিজের কেবিনে ঢুকল একবার। নিরিবিলিতে চিন্তা করতে চায় একটু, অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্যও।

পর্যবেক্ষণে এ যাবৎ যা জানা গিয়েছে, অ্যান্টলের সম্পর্কে, বব খতিয়ে দেখছে একে একে। না, না, খুঁত চোখে পড়েনি কোথাও। উপনিবেশ গড়ে তুলবার জন্য পৃথিবী থেকে কেন মানুষ আসবে না অ্যান্টলে, এর কোনো কারণ দেখাতে পারে না বব। রেডিয়োযোগে পৃথিবীকে যা যা খবর জানানো হয়েছে এ যাবৎ, তার ভিতরে কোথাও এমন কিছু নেই, যা শুনে ওখানকার কর্তাদের মনে সন্দেহ বা আতঙ্ক জাগতে পারে।

‘তাহলে রাফেলই হয়তো ঠিক বলছেন।’

মনে মনে এই কথা বলতে বলতেই বব নেমে এল আবার। ক্যাটারপিলার ট্রাক নামানো হয়েছে। যুদ্ধে যেসব ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয় পৃথিবীতে, এ ট্রাক অনেকটা সেই ধরনের। তবে তার চেয়ে লম্বা অনেক বেশি। হবস বসেছে চালকের সামনে, তার পাশেই রয়েছে গ্রিফিথস। মেজর রাফেল গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ফিটফাট কেতাদুরস্ত, যেন এইমাত্র ব্যারাক থেকে বেরুলেন প্যারেড দেখবার জন্য।

স্যান্ডি ট্রেনহাম যাবে না এ অভিযানের সঙ্গে, পৃথিবী থেকে যদি রেডিয়োর খবর আসে, ধরতে হবে তা। আরও দু-জন বৈমানিক রয়েছে আর্গেমোনে, তারাও যাবে না সঙ্গে। দীর্ঘদিনের আকাশযাত্রার পরে বিমানটার তদ্বির তদারক অনেক কিছু করবার আছে। সেই সবই করবে ওরা।

বাকি থাকে আর একজন, মহিলা বৈমানিক একটি, জীববিদ্যার বিশেষজ্ঞ তরুণী, অনূঢ়া। সম্পর্কে ইনি আবার মেজরের ভ্রাতুষ্পুত্রী হন। যেকোনো ব্যাপারেই ইনি কাকামশাইয়ের মতে মত দিয়ে থাকেন, ওটা এঁর স্বভাব। নাম জেনি মুর, ইনিও সঙ্গে আসছেন না শুনে আশ্বস্ত হল বব। যখন আসেন, তখন তো এঁর কাজ হল শুধু নীল চোখে ঝিলিক হেনে, বোঁচা নাক ঈষৎ কুঁচকে, চোখা চোখা বাক্যবাণে সঙ্গীদের (অবশ্য কাকামশাইকে ছাড়া) ক্রমাগত বিদ্ধ করা।

বিমান থেকে এক-শো গজ গিয়েই গাড়ি নামতে শুরু করল। প্রায় খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে গাড়িটা যে উলটে গেল না, তার কারণ শুধু এই যে ওলটাবার মতো করে ওটা তৈরি হয়নি। নীচে বালুকাস্তর, সেদিকেই তাকিয়ে রাফেল তখনও দাঁড়িয়ে আছেন, দু-হাতে রেলিং ধরে।

বালির উপরে গাড়ি নামতেই তিনি বললেন, ‘আদর্শ জায়গা উপনিবেশের পক্ষে, কী বলো ক্যাপ্টেন? বিমানে ফিরে এসেই সব ঠিক হ্যায় রেডিয়ো করে দেওয়া যাক।’

আসনে বসে গাড়ির দোলানির সঙ্গে নিজেও অল্প অল্প দুলছে বব। কিন্তু ভাবে মন্তব্য করল, ‘সেটা যে বড্ড হুটোপাটির ব্যাপার হবে স্যার! খোঁজখবর তেমন কিছুই তো নেওয়া হয়নি!’

‘দরকার আছে আরও খোঁজ খবরের?’ খেঁকিয়ে উঠলেন রাফেল, ‘বসে বসে আরাম করব যে এখানে, তার খরচা দেবে কে? অপব্যয় পছন্দ নয় উপরওয়ালাদের। আমি নিজেও অপছন্দ করি, অপব্যয় এবং অহেতুক দেরি— দুটোকেই।’

একটা হাঙ্গামাই বাধবে, তাতে সন্দেহ নেই ববের। অ্যান্টল যে আদর্শ স্থান, এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছেন মেজর, সংকল্প ওঁর স্থির।

কেনই-বা হবে না স্থির? তড়িঘড়ি স্থির করতে পারলেই তো লাভ ওঁর।

লাভ এই যে, করিতকর্মা লোক বলে সুনাম হবে পৃথিবীতে। দশ লাইট-ইয়ার উড়ে এসে মাটিতে নামার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক বলে এত্তেলা দিতে পারা কম বাহাদুরি নয়। চাই কী, এই থেকেই মস্ত একটা পদোন্নতি হয়ে যেতে পারে মেজরের।

চাকা ধরে বসে আছে হবস, হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘ওগুলো কী, অ্যাঁ? দেখুন, দেখুন কী ওগুলো?’

একটা পাহাড়ের সবুজ সানুতে কী যেন জন্তু চরে বেড়াচ্ছে কতগুলি। লম্বা ঠ্যাং, আকারে পৃথিবীর ছোটো জাতের ছাগলের মতোই। চরছে বটে, কিন্তু কেমন যেন অস্থির ভাবভঙ্গি তাদের। তাড়াতাড়ি কয়েক খাবল খেয়ে নিচ্ছে, তারপরই মাথা তুলে এদিক-ওদিক চাইছে। গাড়িটা আসতে দেখে তারা দৌড় মারল তক্ষুনি, উধাও হয়ে গেল পাহাড়ের ওপিঠে।

রাফেল বললেন, ‘খেতে ভালো হবে বোধ হয়।’

বব কিন্তু খুশি হতে পারেনি, অপ্রসন্নভাবে তাকিয়ে আছে জন্তুগুলোর গমনপথের দিকে।

‘ওতেও বিপদের গন্ধ দেখতে পাচ্ছ বুঝি ক্যাপ্টেন?’ ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন এল রাফেলের দিক থেকে।

বব শুধু মাথা নাড়ল, ‘না স্যার, আমি শুধু ভাবছি বড়ো গাছ একটাও নেই কেন, পাখি নেই কেন, কীটপতঙ্গেরও এখনও পর্যন্ত সাক্ষাৎ পাইনি কেন। পৃথিবীতে লক্ষ রকম প্রাণী, এখানে তো আর কিছুই দেখি না! অথচ এমন আবহাওয়া, এত রোদ্দুর—’

‘স্বর্গে সাপ দেখতে পাচ্ছ না, এই অজুহাতে তুমি সব ঠিক সংকেত পাঠাতে আপত্তি করবে নাকি?’ হেসে উঠলেন রাফেল।

কথার জবাব না-দিয়ে বব বলল, ‘এক মুঠো ঘাস নমুনা স্বরূপ নিয়ে গেলে হত। মিস মুর বিশ্লেষণ করে অনেক কিছু বলতে পারতেন ও থেকে।’

গাড়ি থামিয়ে নমুনা নেওয়া হল। এ কি ঘাস নাকি? ইঞ্চিখানেক লম্বা, তারের মতো সরু, শিকড় খাটো, কড়া, তার গায়ে গায়ে ঘন চুল। একমুঠো ঘাস তুলতেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে বালি আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মাটিতে ভিজে ভাব একদম নেই।

রাফেল তাকিয়ে আছেন ববের দিকে, ওর মনের কথা টের পেয়ে গেছেন, ‘সেচ পেলেই মাটি ঠিক হয়ে যাবে ক্যাপ্টেন! সেচ দিয়ে তাতে পৃথিবীর ঘাস বসিয়ে দিতে হবে, বড়ো জাতের গাছের চারাও।’

ওই যে সেই পাহাড়, যার উপরে ছাগল চরছিল। কিন্তু কই, অতগুলো ছাগলের একটারও পদচিহ্ন নেই তো বালিতে! হাওয়া নেই যে বালি উড়ে এসে দাগ বুজিয়ে ফেলবে? তবে? বালি কি নিজে নিজেই চলে বেড়ায় এখানে?

ওই কথাটাই বার বার ঘুরপাক খেতে থাকল ববের মনে— পদচিহ্ন কেন নেই ছাগলদের? বালি কি চলে বেড়ায় এ গ্রহে? গাড়ি ততক্ষণে কয়েক মাইলের একটা বৃত্তাংশ রচনা করে বিমানের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। জেনি মুর এসে ঘাসের নমুনাগুলো তুলে নিল ববের হাত থেকে। নিয়েই কিন্তু সে চলে গেল না, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঘাড়টা বেঁকাল ববের দিকে, আর তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এখন পর্যন্ত তো কোথাও এমন কিছু দেখিনি, যার দরুন সব ঠিক বার্তা বন্ধ রাখা যায়। দেখি এইবার এই ঘাসের নমুনার ভিতর কিছু মেলে যদি—’

ওর সুরটা যে ঝাঁঝালো, তা লক্ষ করেছে বব, ‘এত তাড়াতাড়িই বা কী?’ জিজ্ঞাসা করল সে, ‘গ্রহটার বলতে গেলে কিছুই দেখলাম না, এরই মধ্যে পথ খোলসার সংকেত পাঠাবার কি মানে হয় কিছু?’

‘দেরিতে খরচ নেই বুঝি?’ রাফেলেরই কথা জেনির মুখে।

বব বুঝি রেগেই গেল, ‘হ্যাঁ, খরচ আছে দেরিতে। কিন্তু আমাদের ভুল খবরের উপরে নির্ভর করে এক জাহাজ উপনিবেশি যদি এখানে এসে হাজির হয়, আর ভুল ধরা পড়ার পরে বাধ্য হয় ফিরে যেতে, তাতে খরচ হবে যে আরও অনেক— অনেক বেশি?’

‘ভুলটা কোথায় থাকতে পারে, তা তো বুঝতে পারছি না।’ জেনির কথায় ঠিক রাফেলের মতোই মেজাজ, ‘মানুষের অনিষ্ট করতে পারে, এমন জন্তু বা উদ্ভিদ বা বীজাণু কোথাও দেখছি না। হাওয়া যা, তা স্বাস্থ্যনিবাসের উপযুক্ত।’

‘একটা গাছ নেই, একটা কীটপতঙ্গ নেই, বালি নিজে নিজে চলে বেড়ায়—’ আপত্তি জানাতে ছাড়ে না বব।

বালির দল চলে বেড়াবার কথা শুনে হেসে উঠল জেনি। তারপর বলল, ‘বালির কথা ছেড়ে দাও। কীটপতঙ্গের অভাব যা বলছ তা অমন হয়। স্থানীয় কোনো বৈশিষ্ট্যের দরুন ক্রমবিবর্তনের ধারায় দুই-একটা পর্যায় বাদ পড়ে যায় কখনো কখনো। সে বৈশিষ্ট্য যে এক্ষেত্রে কী, তা যথাসময়ে বোঝা যাবে নিশ্চয়ই।’

‘তাহলে আপনি বলতে চান যে, সেটা বোঝার আগেই সব কিছু ঠিক আছে বলে খবর দেওয়া উচিত আমাদের?’

বব আর দাঁড়াল না। দরজাটা যেভাবে খটাং করে বন্ধ করল জেনি, তা থেকেই বোঝা গেল তার মেজাজের অবস্থা।

এর পরেই ববের ঘরেতে এল স্যান্ডি। সেও বোঝাতে এসেছে ওকে। তবে অন্যদিক দিয়ে সে বলছে, ‘আমাদের সাবধান হওয়া দরকার নিশ্চয়ই। কিন্তু মেজর উপরওয়ালা, সে যদি সাবধান হতে না-চায়, আমরা কী করতে পারি? ধরো, আমরা বাধা দিলাম, ফলে এক্ষুনি সব ঠিক বার্তা যেতে পারল না পৃথিবীতে। কিন্তু ধরো, অনেক কিছু সন্ধান গবেষণার পরেও গলদ কিছুই বেরুল না অ্যান্টলে। তখন? তখন তো সব ঠিক বার্তা পাঠাতেই হবে? আর তখনই তাঁর নালিশ দায়ের করবেন মেজর। উপরওয়ালাদের বলবেন, ক্যাপ্টেন স্পেনসারের একগুঁয়েমির জন্য কতখানি মূল্যবান সময় হয়েছে নষ্ট, কত অর্থের হয়েছে অপব্যয়। তখন কী হবে?’

বব স্বীকার করতে বাধ্য হল সেরকম পরিস্থিতিতে তার নিজেরই জীবনটা মাটি হয়ে যাবে, মহাকাশ গবেষণার দপ্তরে সে চিহ্নিত হয়ে যাবে অতি সাবধান কর্মনাশা লোক বলে।

কিন্তু, সে-আশঙ্কা সত্ত্বেও সে যে নিজের বিচারবুদ্ধি বিসর্জন দিতে রাজি নয়, একথাও সে শুনিয়ে দিল স্যান্ডিকে। ‘নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারছ বন্ধু,’ বলে স্যান্ডি বিদায় নিল।

সন্ধ্যার ঠিক আগে সে দেখল, হবস আর গ্রিফিথস আবার গাড়ি নিয়ে বেরুচ্ছে। এবার যেন বড়ো রকমের তোড়জোড়। বব জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কি বাইরে রাত কাটাবে ভাবছ?’

ওরা বলল, ‘হুকুম তো সেইরকমই, ক্যাপ্টেন—’

বব অবাক হয়ে বলল, ‘সে কেমন কথা? ”সব ঠিক” সিদ্ধান্ত নেওয়া যতক্ষণ না হচ্ছে, বিমানের বাইরে কারও রাত কাটানো তো নিয়ম নয়!’

পিছন থেকে কড়া জবাব দিলেন রাফেল, ‘নিয়মেরও ব্যতিক্রম মাঝে মাঝে করতে হয় বই-কী! সিদ্ধান্তটা যদি অকারণে আটকে দেয় কেউ, হাত গুটিয়ে বসে থাকব নাকি আমরা? যতদূর এগুতে পারি, এগুই।’

হবস আর গ্রিফিথস রওনা হয়ে গেল। বব মুষড়ে পড়ল অজানা আশঙ্কায়। এ কাজ ভালো হল না— এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু রাফেলকে বোঝাবে কে?

সন্ধ্যার পর জেনি আবার এসেছে। কাঁচুমাচু হয়ে অনেক কথা বলল ববকে। তড়িঘড়ি সব ঠিক বার্তাটা পাঠাবার জন্য কেন যে মেজর অত ব্যস্ত হয়েছেন, সেই সম্পর্কেই ভিতরের কথা। আর্গেমোন একা বেরোয়নি উপনিবেশ-যোগ্য নতুন গ্রহের সন্ধানে, মহাশূন্যের তিন কোণ লক্ষ্য করে তিনখানা বিমান বেরিয়েছে একসঙ্গে। এই তিনটির তিন অধ্যক্ষের ভিতরে চলছে এক গোপন রেষারেষি। যে আগে উপযুক্ত গ্রহের সন্ধান দিতে পারবে, সে প্রমোশন পেয়ে যাবে অন্য দু-জনকে টপকে। অ্যান্টল সম্বন্ধে সব ঠিক হ্যায়টা জানাতে পারলেই রাফেল সেই প্রমোশনের মেওয়া হাতে পেয়ে যেতে পারেন। সবুরে তা ফসকে যেতেও পারে। অন্য দু-জনও তো চেষ্টা করছে প্রাণপণে। এইরকমই কিছু নিজেও অনুমান করেছিল বব। ঠান্ডা হয়ে বসে জেনির ওকালতি সে শুনল। কিন্তু ভিজল না তার কাকুতিতে। উলটে বলল, ‘আপনি একটা দিকই দেখছেন। আশঙ্কার দিকটাও দেখুন। সব ঠিক জানিয়ে দেবার পরে যদি কিছু বেঠিক বেরিয়ে পড়ে, প্রমোশনের বদলে আপনার কাকাকে যে পেতে হবে অর্ধচন্দ্র! আমি অ্যান্টল সম্বন্ধে এখনও সন্দিগ্ধ। আর সে সন্দেহ দূর হওয়ার আগে আমি কখনোই পৃথিবীকে বলতে পারব না, ‘জাহাজভরতি উপনিবেশি চলে আসুক স্বচ্ছন্দে।’

জেনি রাগে-দুঃখে কেঁদেই ফেলত আর একটু হলে। কোনোরকমে সামলে নিয়ে চলে গেল নিজের কেবিনে।

পরেরদিন নীচে নামতে ইচ্ছে করেই দেরি করল বব। রাফেল অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন, দেখা হলেই একটা রাগারাগি হয়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। অশুভস্য কালহরণং নীতিটাই এক্ষেত্রে সে অনুসরণ করবে।

নামেনি সে। কিন্তু ঘরে বসেই সে স্যান্ডির গলা শুনতে পেল। ‘কোনো খবর নেই স্যার—’ জোরগলায় হাঁকছে সে। অবশ্যই রাফেলের উদ্দেশ্যেই একথা বলা। কিন্তু খবর নেই, মানে কী? কীসের খবর নেই? ব্যস্ত হয়ে নেমে এসে বব রেডিয়ো ঘরে ঢুকল।

স্যান্ডি জানাল, খবর নেই হবস আর গ্রিফিথসের। কাল সন্ধ্যার আগে তারা বেরিয়েছে, কথা ছিল, রাত ভোর হলেই তারা রেডিয়ো মারফত রাতের অভিজ্ঞতা জানাবে মেজরকে। ট্রান্সমিটার তারা সঙ্গে নিয়েছে। সেটা কোনো কারণে বিগড়ে গিয়েও থাকে যদি, তা মেরামত করবার মতো উপকরণ যন্ত্রপাতিও সঙ্গে আছে তাদের। তবে খবর কেন আসে না?

অপেক্ষা! অপেক্ষা! অধীর পায়চারি! ঘণ্টার পরে ঘণ্টা! কিছু-একটা গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়! ঘটেছে কিছু বিপদ! রাফেলের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। দূরবিন চোখে নিয়ে তিনি দূরদিগন্তে তাকিয়ে আছেন। দূরবিন ঘোরাচ্ছেন একবার এদিকে, একবার ওদিকে। তাঁর সে স্বয়ংসন্তুষ্ট আত্মম্ভরিতায় দারুণ চিড় খেয়েছে একটা। ববের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই যেন পারছেন না ভদ্রলোক।

বেলা দশটা নাগাদ তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন। এক্ষেত্রে একমাত্র সিদ্ধান্ত যা নেওয়া যেতে পারে, তা নিলেন অবশেষে। রওনা হতে হবে লোক দুটোর খোঁজে। গাড়ি তারাই নিয়ে গিয়েছিল। এঁদের যদি যেতে হয়, পায়দলে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অগত্যা রওনা হয়ে পড়লেন দুপুর রোদ মাথায় করে— মেজর নিজে, বব স্পেনসার আর স্যার স্যান্ডি ট্রেনহ্যাম। রেডিয়োর ঘরে কান রাখবার জন্য জেনি রইল বিমানে। দৈবাৎ যদি হবস আর গ্রিফিথস বেতারে কিছু খবর দেয়, ও পারবে তা ধরতে, ও-বিদ্যে জানা আছে ওর খানিকটা।

ট্রান্সমিটার সঙ্গে নিয়েছেন মেজরও। মাঝে মাঝে জেনিকে তিনি ডাকবেন বেতারে। জেনে নেবেন, হবসদের খবর কিছু এল কিনা।

সব বন্দোবস্ত পাকা রইল পিছনে। এখন সমুখের কাজে অখণ্ড মনোযোগ দিতে পারবেন মেজর। এগিয়ে চললেন আগুন রোদে তপ্ত বালুর প্রান্তর বেয়ে। পাহাড়ের লাইনে পৌঁছোতেই বেলা পড়ে গেল। গোধূলি এখানে ক্ষণস্থায়ী। সন্ধ্যা নামবে এক্ষুনি। আজ আর হারিয়ে যাওয়া সাথীদের সন্ধানে বেশি ঘোরা-ফেরার সময় নেই। আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই রাতের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে একটা। নিরাপত্তার জন্য চিন্তা করবারও একটা দরকার যে আছে এই অ্যান্টলে, তা প্রায় একরকম স্বীকার করে নিয়েছেন মেজর। অ্যান্টল যে স্বর্গ নয়, ববের এ সন্দেহ বুঝি তাঁরও মনে সংক্রামিত হচ্ছে একটু একটু করে।

এসব পাহাড়ে গুহাজাতীয় কিছু নেই। কাজেই ফাঁকা জায়গাতে শোয়া ছাড়া উপায় নেই। তা, জায়গা তো সবই ফাঁকা। ঝোপঝাড় কোথাও নেই। একটা নীচু পাহাড়ের মাথায় ঘাসে-ঢাকা সমতল মাঠ দেখতে পেয়ে সেইখানেই পাশাপাশি শুয়ে পড়লেন তিনজন। তার আগে অবশ্য জেনিকে একটা খবর পাঠাতে ভুল হয়নি রাফেলের। ওদিক থেকে জেনিও দিয়েছে খবর। যতদূর খারাপ খবর হতে হয়। হবসরা ফেরেনি।

এ আকাশে চাঁদ নেই, থাকবার কথা নয় কিছু। তবে নক্ষত্র অগুন্তি, ছায়াপথটাও এখানে অনেক বেশি উজ্জ্বল। পাহাড়ের মাথাটাকে অন্ধকার কোনোমতেই বলা চলে না। শুয়ে পড়েছে তিন অভিযাত্রী। পাশাপাশি বটে, তবে গায়ে গায়ে নয়। বব পরামর্শ দিয়েছিল, অন্তত আট-দশ ফুট দূরে দূরে এক একজন শোবে। যাতে, হঠাৎ বিপদ ঘটলে, তা একসাথে তিনজনকেই গ্রাস করতে না-পারে।

বিপদ? বিশ্বাস করতে মন চায় না যে এমন শান্তির পরিবেশে বিপদের আশঙ্কা থাকতে পারে কোথাও ওত পেতে। ধীরে বইছে নাতিশীতল হাওয়া, নক্ষত্রের আলো থেকে আসছে রহস্যময় হাতছানি, একটা অতিক্ষীণ ঝিরঝির শব্দ কানে আসে নতুন কোনো ভাষায় ঘুমপাড়ানিয়া গানের মতো—

হঠাৎ বব সজাগ হয়ে উঠল। কীসের ওই ঝিরঝির শব্দ? কীসের? মাথা তুলে একবার চারদিক তাকিয়ে দেখল সাবধানে। জলের শব্দ নয়, কারণ নদী-টদি নেই এখানে। শব্দ বাতাসেরও নয়, গাছ নেই, পত্রমর্মরের প্রশ্নই ওঠে না। পোকামাকড় এদেশে এসে অবধি চোখে পড়েনি। পড়ত যদি তো নতুন ধরনের ঝিল্লি বলে ধারণা করা যেত।

অতএব বব সিদ্ধান্ত করল যে শব্দটা বাইরেকার নয়, ওটা তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। হতেই পারে। সারাদিন মাথায় রোদ লেগেছে খুব। ঝিরঝির শব্দ না-হয়ে ঝনঝন হলেও বলবার কিছু থাকত না।

একসময়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, তা কে বলবে? হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল। একটা অস্বস্তি লাগছে কেমন। গুমোট যেন খুব। পাহাড়ের মাথায় খোলা মাঠে ঘুমোনো, গুমোট আসে কোথা থেকে? কাত হয়ে শুয়েছিল, ঘুম ঘুম চোখে তাকাল পাশের দিকে। এ কী? অন্ধকার যে? এই তো ঘুমোবার আগে আকাশকে দেখা গিয়েছিল ঝলমলে উজ্জ্বল, পাহাড়টা চাপা হাসি হাসছিল আধ আলোর ঘোমটার আড়াল থেকে। হঠাৎ অন্ধকার কোথা থেকে? চিত হয়ে উপরপানে তাকাল বব। কই, এক টুকরো মেঘও তো নেই নির্মল আকাশে! কোটি কোটি তারা সেখানে যেন প্রতিযোগিতায় মেতেছে— কে কতখানি আলো ছড়াতে পারে।

তবে?

উপরে আলোর বান ডেকেছে, পাশে কিন্তু অন্ধকার। ডাইনে ফেরে, অন্ধকার! বাঁয়ে ফেরে, অন্ধকার। একবার শিওরের দিকে, একবার পায়ের দিকে তাকাল, দু-দিকেই আঁধারের উঁচু দেওয়াল। তাকে ঘিরে ফেলেছে একটা আঁধার বেষ্টনী। আর—

সেই ঝিরঝির ঝিরঝির আওয়াজ। তবে এখন আর তো ক্ষীণ নয় আগের মতোন। কর্কশ, একটানা একটা অশুভ শাসানি। কার? কার শাসানি? মরণের নাকি?

অন্ধকার বেষ্টনীর দিকে হাত বাড়াল বব। ঝিরঝির নয়, ঝরঝর করে তার হাতের উপর ভেঙে পড়ল এক রাশি বালি। বালি এ গ্রহে চলমান। তাই ছাগলের পায়ের দাগ সঙ্গে সঙ্গেই বুজে গিয়েছিল।

ডাইনে হাত দেয়, বালি। বাঁয়ে হাত দেয় বালি, মাথার দিকে হাত বাড়াতে মাথায় বালি ভেঙে পড়ল। দু-পা লম্বা করে ছড়িয়ে দিতে বালিতে বালিতে চাপা পড়ে গেল কোমর পর্যন্ত।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বব। পরিত্রাহি চিৎকার করতে করতে। ‘মেজর! স্যান্ডি! স্যান্ডি! মেজর!’ না, তাদের ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙার আগেই জ্যান্ত সমাধি হবে তাদের।

কিন্তু তাদের কথা পরে, আগে ববকে নিজে বাঁচতে হবে। মাথার উপরেও এক ফুট উঠেছে বালির দেওয়াল। চারিদিক নিশ্ছিদ্র। ভেঙে পড়ছে বালি গায়ে মাথায়। ডুবে যাবে, তলিয়ে যাবে এক্ষুনি। মরিয়া হয়ে সে হাঁচড়-পাঁচড় করতে লাগল সেই বালির দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠবার জন্য। ভেঙে বেরুনো যে সম্ভব হবে না— তা সে আন্দাজেই বুঝেছে। অনেক, অনেক পুরু এ দেওয়াল, তা নইলে এত বালি ঝরে পড়া সত্ত্বেও অটুট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেমন করে?

বেয়ে ওঠা কি যায়? যেখানে হাত দেয়, ভেঙে পড়ে। যেখানে পা বাঁধিয়ে দেয়, ভেঙে পড়ে। ছ-ফুট লম্বা বব মরিয়া হয়ে উঁচুপানে দিল এক লাফ, নাগালে পেল দেওয়ালের মাথাটা। সে মাথা ভেঙে পড়ল সঙ্গেসঙ্গে, আরও খানিকটা নিজেই ভেঙে নামাল বব। এইবার দেওয়াল ওর কাঁধ বরাবর নেমে এসেছে। আর ভয় নেই। সেই ভঙ্গুর দেওয়ালের মাথায় হাতের ভর রেখে সে এক লাফে ওপিঠে গিয়ে পড়ল। মুক্ত! মক্ত! এখানে আলোয় আলো চারধার। কিন্তু পায়ের তলায়? পায়ের তলায় অ্যান্টলের মাটি চঞ্চল হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। চারধার থেকে বালুকণাগুলো সজীবের মতো ছুটে গিয়ে গেঁথে যাচ্ছে দেওয়ালে, তিন তিনটি মানুষের দেহকে চাপা দেওয়ার জন্য।

‘মেজর! স্যান্ডি! স্যান্ডি! স্যান্ডি! মেজর!’ ববের ব্যাকুল চিৎকারে ওদিককার দুটো প্রাকার বেষ্টনীর ভিতর থেকে হতাশ হাহাকার শোনা যায় দুটো মানুষের।

‘ঠ্যালো! ভাঙো!’ চ্যাঁচায় বব, আর বাইরে থেকে ঝুড়ি পরিমাণ বালি টেনে নামায় এক এক টানে। ভিতরে-বাইরে সমান ঘা খেয়ে অবশেষে দুটো সমাধিই তাদের শিকারকে উগরে দিতে বাধ্য হল।

ঘর্মাক্ত, সন্ত্রস্ত মেজর মাটিতে পড়ে হাঁইফাঁই করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হবস আর গ্রিফিথসের ভাগ্যে কী যে ঘটেছে— তা আর বুঝতে বাকি নেই!’

‘কী সর্বনেশে দেশ!’ বলল স্যান্ডি, ‘ভাগ্যিস আমরা ”সব ঠিক” বার্তা পাঠাইনি! এক জাহাজ উপনিবেশি এখানে এসে নামলে কী যে অবস্থা হত, কে জানে!’

‘স্পেনসার! তুমি আমায় রক্ষা করেছ একটা ঘোর বিপদ থেকে। ওই সংকেত যদি চলে যেত পৃথিবীতে—’

মেজরের কথায় কান না-দিয়ে বব ট্রান্সমিটার খুলেছে ততক্ষণ। কথা কইছে জেনি ওপিঠে, ‘কী খবর?’

বব বলল, ‘এখানকার খবর পরে শুনো। একবার চট করে নীচে নেমে দেখ তো, বিমানের গায়ে গায়ে বালির দেওয়াল গড়ে উঠেছে কি না!’

তিন চার-মিনিট বাদে জেনির স্বর শোনা গেল আবার। সে-স্বর ভয়-বিস্ময়-নৈরাশ্যে ভরা, ‘বিমানের আধাআধি বালির তলায় পুঁতে গিয়েছে।’

বব বলল, ‘মেজরের আদেশ, দু-জন বৈমানিক আছে তো এখনও বিমানে? তাদের বলো, ইঞ্জিনে পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে আর্গেমোনকে এক্ষুনি আকাশে তুলে ফেলতে। এক্ষুনি! তোলার পরে আকাশে ধীরে ধীরে চক্কোর দাও ওইখানেই। আমরা যতক্ষণ না-পৌঁছাই।’

মেজরের দিকে ফিরে বব বলল, ‘ঠিক বলিনি, মেজর?’

রাফেল তার হাত চেপে ধরলেন, ‘ঠিক বলেছ, ঠিক করেছ! তুমি বাঁচিয়েছ আমায়! চলো, এক্ষুনি রওনা হই আর্গেমোনের উদ্দেশে। একবার তাতে উঠে বসতে পারলে আর এক সেকেন্ডেও অ্যান্টলে নয়।’

____

* আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে, তাকে বলে এক ‘লাইট-ইয়ার’ দূরত্ব। তার পরিমাণ পাঁচ লক্ষ সাতাশি হাজার কোটি মাইল—৫৮৭০০০০০০০০০০।