লতার নাম হাঁউ-মাঁউ-খাঁ
নীচের দিকে নেমে আসছে বিমানখানা। নেমে আসছে এত দ্রুত যে তাকে অবতরণ হিসেবে নিরাপদ বলা মুশকিল। কলকবজা না বিগড়োলে এমনটা হয় না সাধারণত।
বৈমানিকের সংখ্যা একুশ, তার মধ্যে সতেরো জনই কাজের বার এই মুহূর্তে। এই অস্বাভাবিক ক্ষিপ্র অধোগতির জন্যই। যে যেখানে কর্মরত ছিল, সেইখানেই বসে বা শুয়ে পড়েছে, যেভাবে সম্ভব সেইভাবেই; কোনো একটা থাম্বা রেলিং প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে। অনেকের দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছে, চোখ সবায়েরই বোজা।
তাহলেও বলতে হবে একুশ জনের মধ্যে এই সতেরো জনেরই জোর বরাত। কারণ এদের তো আর কিছু নয়; দেহের উপর দিয়ে কষ্ট যাচ্ছে খানিকটা। সেইটুকু সহ্য করে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করবার নেই এখন। কিন্তু বাকি চার জন? কষ্ট সহ্য করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আবার কাজও তো করতে হচ্ছে। এবং সে কাজ শুধু পেশির নয়, মস্তিষ্কেরও। তারা আছে ইঞ্জিনঘরে।
এই চার জনের একজন হল চালক। বিমানখানার উপরে যাহোক কিছু অতিসামান্য নিয়ন্ত্রণ এখনও যা একটু আছে, তা এরই দক্ষতার দরুন। এর কাজের ভিতরে ঘূর্ণি বইছে একটা। কিন্তু বাইরে থেকে তা কিছুই বোঝার জো নেই, লোকটি প্রায় অবিচলিত। বহিরাকাশের হাইড্রোজেন স্তর থেকে অব্যবহিত নীচের ট্রপোস্ফিয়ারে বিমানটাকে নামিয়ে আনতে দস্তুরমতো ওকে একটা লড়াই করতে হয়েছে। আগে সম্ভাবনা ছিল বিমানখানার উল্কার মতো জ্বলে ওঠার, এখন আশঙ্কা শুধু ডুবতে ডুবতে মৃত্যুর গহ্বরে নেমে যাওয়ার।
এই লড়াইয়ের দুই প্রস্থ ইঞ্জিন তার হাতের ভিতরেই অক্কা পেয়েছে। এখন সে কাজ চালাচ্ছে তেসরা ইঞ্জিন দিয়ে। এইটি বিকল হলেই, ব্যস দফা শেষ। আর ইঞ্জিন নেই। অতুলনীয় নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছে মানুষটা। একটু আগেই এই ‘পার্সিফোন’ দুর্বার গতিবেগে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে পাড়ি দিচ্ছিল। সেই গতি হঠাৎ সংযত করে তাকে নিম্নমুখী করা, বিগড়োনো ইঞ্জিন নিয়ে— এ বাহাদুরির তারিফ না-করে উপায় নেই।
ক্যাপ্টেন বেচারি। হাওয়ার অভাবে ফুসফুস ফেটে যেতে চাইছে তাঁর। তবু লৌহমুষ্টিতে মাইক্রোফোন ধরে রেখেছেন ঠোঁটের কাছে, আর থেকে থেকে একটা একটা করে শব্দ ছুড়ে দিচ্ছেন তার ভিতরে। ছুড়বার সেই চেষ্টায় প্রাণটা যেন বেরিয়ে যেতে চাইছে ভদ্রলোকের। অন্য দু-জন এটা-ওটা কাজে ব্যস্ত, মুখের ভিতর পাকানো কাগজের ঢ্যালা তাদের, যাতে দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগার শব্দে ক্যাপ্টেনের ক্ষীণ দূর ভাষণ আরও অস্পষ্ট হয়ে না-যায়।
এইবার নীচে কী যেন কী দেখা যাচ্ছে। চালক ইঞ্জিনের চাপ কমিয়ে দিয়ে সরে এল, ‘অন্তিম সময়ে এসে পড়েছি। এক্ষুনি নেমে পড়া দরকার ওইখানে। ইঞ্জিন গেল বলে।’
ক্যাপ্টেন ব্যাসকুম শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন ওই কী যেন কী-র দিকে। কোনো গ্রহ সন্দেহ নেই। কোন গ্রহ? অনেক গ্রহই পুরোনো বৈমানিকদের চেনা। যেকোনো একটা বৈশিষ্ট্য দূর থেকে চোখে পড়লেই বলে দিতে পারেন গ্রহটার নাম-ধাম-পরিচয়। কিন্তু এটার তো কোনো বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে না। একান্ত মামুলি চেহারা। ন্যাড়া পাহাড়ে ভরতি একটা মহাদেশ। তার ও প্রান্তে উজ্জ্বল নীল সমুদ্র। একটা মোহানা, শ্যামল একটা উপত্যকা, একটা নদীও। আর গায়ে গায়ে এক সারি হ্রদ, তার এক একটার জল এক এক রং-এর।
‘সিরিয়াস না-হয়ে যায় না’— বললেন ক্যাপ্টেন। চালককে নির্দেশ দিলেন, ‘ওইখানটাতে নামাও বিমান। ওই লাল হ্রদের ধারে। উদ্ধার করতে যারা আসবে, সহজেই তাদের নজরে পড়বে ওটা।’ সংকেতী অফিসারকে বললেন, ‘মহাকাশে খবর পাঠাও, পার্সিফোন নেমে পড়েছে একটা মহাদেশের পশ্চিম প্রান্তে। একটা দুটো তিনটে চারটে পাঁচটা বলো যে, পাঁচটা রঙিন হ্রদ আছে পাশাপাশি এক লাইনে। তার ভিতর লাল হ্রদটার পাশে আমরা আছি।’
লাল হ্রদের কূলে কূলে উদ্ভিদের সবুজ সমারোহ। ওরই উপরে নামবে পার্সিফোন। ন্যাড়া পাহাড়ে নামলে বিমানে চোট লাগবে। কারণ নামছে ওটা বিপুল বেগে। বিকল ইঞ্জিনের এমন শক্তি নেই যে, পিছুটানে সে বেগকে খানিকটা সংযত রাখবে। উপত্যকার বনবাদাড়ের উপরে নামতে পারলে চোটটা কম লাগতে পারে।
এত সাবধান হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু পার্সিফোন এমনভাবে পড়ল মাটিতে, তার আপাতমস্তক কেঁপে উঠল থরথর করে।
চালক এতক্ষণে মুঠি তুলে নিল কন্ট্রোলের উপর থেকে। পাটাতনের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে হাতের উপরে মাথা রেখে সে নিশ্চল হয়ে রইল দারুণ অবসাদে। কেউ তার পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতে গেল না। সবাই জানে যে ওই লোকটিরই কৃতিত্বে তাদের সবাইয়ের জীবনটা বেঁচে গিয়েছে এ যাত্রা। কিন্তু তা নিয়ে হইচই করবার কী আছে? আকাশ পারাপারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই তো লেগেই আছে সারাক্ষণ! যার যা কর্তব্য, প্রাণপণে সে তা করে। যেকোনো একজনের এতটুকু বিচ্যুতিতে ঘটে যেতে পারে দারুণ অনর্থ। প্রাণ দিয়ে খাটাই ওখানে প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র উপায়। খাটাই রীতি, তার জন্য কারও উপরে কারও কৃতজ্ঞ হওয়ার কথাই ওঠে না।
চালক পড়ে আছে হতজ্ঞানের মতো, কেউ বিশ্রামে ব্যাঘাত করছে না তার। অন্য সবাই কিন্তু তার চারপাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নানান কাজে। মরতে বসেও তারা শেষপর্যন্ত বেঁচে আছে— এই আনন্দে তারা মশগুল। ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যাকুল হওয়ার সময় এখনও আসেনি তাদের।
সিগন্যালার তখন সংকেত ছড়িয়ে দিচ্ছে মহাকাশের দিকে দিকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে— ‘বাঁচাও! বাঁচাও! পার্সিফোন বিকল হয়ে পড়ে আছে এমন এক গ্রহে, সিরিয়াস পুঞ্জের কোনো গ্রহ বলে সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, যাকে সঠিক শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। পাহাড়ে ঢাকা গ্রহপৃষ্ঠে এক লাইনে পাঁচটা হ্রদ, এক একটা এক এক রং! লাল হ্রদের কূলে নেমেছে পার্সিফোন, লাল হ্রদের কূলে— লাল হ্রদ— লাল-লাল—
ব্যাটারিতে একটা ঝিকমিক আলো দেখা দিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য, তারপরই ইঞ্জিন নিথর, নিস্পন্দ। তৃতীয় প্রস্থ ইঞ্জিনও গতাসু। আর কিছু করবার নেই। প্রথম পাহারার লোক বাছাই করে দিয়ে ক্যাপ্টেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন। উদ্ধার করবার জন্য অন্য কোনো বিমান যতক্ষণ না আসছে, করবার বিশেষ কিছু নেই।
প্রথম পাহারার কয়েকটি লোক ছাড়া অন্য সবাই ঘুমিয়ে পড়ল একে একে।
ঘণ্টা চার বা সাড়ে-চার তারা ঘুমোল। তারপরই গোলমালে ঘুম ভেঙে গেল তাদের। পাহারাওলারা চাঁচাচ্ছে সমস্বরে। এদিকে বিমানখানাও নড়ছে, কাঁপছে, দুলছে ক্রমাগত। কাত হয়ে পড়েছে বিপজ্জনকভাবে, এখনও কাত হচ্ছেই প্রতি মুহূর্তে। হল কী?
কেন হচ্ছে কাত? চারদিকে চোখ বুলিয়ে আনতেই কারণটা ধরা পড়ে গেল।
নিবিড় ঝোপঝাড়ের উপরে নেমেছিল পার্সিফোন। দলে পিষে গিয়েছিল সব গাছগাছড়া তার চাপে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! যেখানটায় তারা চাপা পড়েছিল, সেইখানেই তারা মাথা খাড়া করে উঠেছে আবার, পার্সিফোনকে মাথায় নিয়ে। মাথা শুধু খাড়াই করেনি, মাথা চাড়া দিয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে। প্রায় একটা টিলার সমান উঁচু। বিমানের একপাশ রয়েছে সেইসব উদ্ভিদের মাথায়, আর একপাশ রয়েছে মাটিতে। কাজেই কাত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কাত হতে হতে উলটে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
উলটে পড়বে, কিন্তু ডাঙায় কোথাও পড়বে না। যেদিকে ওলটাচ্ছে সেইদিকেই লাল হ্রদের জল। বিমান থেকে হ্রদ-কূল পর্যন্ত সমস্ত জায়গাটাই গড়ানে। সেই গড়ানটার দিকেই অনিবার্যভাবে নেমে যাচ্ছে পার্সিফোন। ইঞ্জিন মৃত না-হলে সহজেই এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারত। মাথা ঝাড়া দিয়ে শূন্যে উঠে পড়ত বিমান। কিন্তু এখন?
এখন কারও কিছু করবার নেই। চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে বৈমানিকদের। তাদের চোখর উপরেই তাদের নিয়ে পার্সিফোন গড়াতে গড়াতে নেমে যাবে এক্ষুনি হ্রদের ভিতর। লাফিয়ে নামা? উপায় নেই তারও। দরজা বন্ধ। হাইড্রোজেন স্তর ভেদ করে বিদ্যুতের বেগে নেমে আসার সময় অসহ্য উত্তাপ লেগেছিল পার্সিফোনের গায়ে। বাইরের ধাতব আবরণ আগাগোড়া গলে দেয়াল দরজা সব একসাথে জুড়ে গিয়েছে নিশ্ছিদ্র হয়ে।
উপায় নেই বেরুবার। এদিকে বিমান নামছে। গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে একটু একটু করে। আর নিশীথ শয্যায় বোবায়-ধরা ঘুমন্ত মানুষের মতো একুশটা মানুষ আড়ষ্ট হয়ে শুধু গোঙাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়!
পার্সিফোনের বিপদ সংকেত ধরা পড়েছে দুটো বিমানের বেতারে। তখনই তারা ছুটেছে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে। ‘হানিবল’খানাই নিকটে ছিল। এটার গতিপথ হল পৃথিবী থেকে গ্রহ, গ্রহ থেকে আবার পৃথিবী। আকারে অপেক্ষাকৃত ছোটো, বৈমানিকের সংখ্যাও কম। ক্যাপ্টেনের নাম ব্রিটহাউস। উইলিয়াম বেঞ্জামিন ব্রিটহাউস।
দ্বিতীয়টা হল ‘বেরেনিস’। এটা আন্তর্গ্রহ বিমান, বিচরণ এর গ্রহ থেকে গ্রহে। পৃথিবীর কন্ট্রোলকে মেনে চলে অবশ্য, কিন্তু পৃথিবীতে নামে কদাচিৎ। এর অধ্যক্ষ হলেন কমান্ডার জাপ। ব্রিটহাউসের প্রত্যক্ষ উপরওয়ালা না-হলেও পদমর্যাদায় তার চেয়ে অনেক উপরে। প্রত্যক্ষ উপরওয়ালা নন শুধু এই কারণে যে দু-জনের চাকরি দুটো আলাদা বিভাগে মহাশূন্য বিজয়ের বিরাট প্রকল্পে দুটো বিভিন্ন শাখায় কাজ করে তো! এটা হল গ্রহমুখী, অন্যটা আন্তর্গ্রহ।
ব্রিটহাউস বা জাপ সংকেত পেয়ে খুশি কেউ হতে পারেননি। দুইজনেরই জরুরি কাজ ছিল অন্যত্র। ব্রিটহাউসকে তিনদিনের ভিতর পৃথিবীতে ফিরতেই হবে, অন্তত একদিনের জন্য। তার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে আছে আজ থেকে চতুর্থ দিবসে। না পৌঁছোতে পারলে সব ভেস্তে যাবে, সমূহ মনস্তাপ।
ওদিকে জাপ, গার্হস্থ্য ব্যাপার না হলেও গুরুতর অসুবিধা তাঁরও আছে। দশ বছর পরে পরে সমস্ত আন্তর্গ্রহ বিমানের একটা সমবেত মহড়া হয়, মহাশূন্যের কোনো এক পূর্বনির্দিষ্ট তেপান্তরে। আগামী মহড়ার দিন ধার্য হয়েছে পরশু স্বয়ং অ্যাডমিরাল তত্ত্বাবধান করবেন সমগ্র অনুষ্ঠানের। কমান্ডার রুপার্ট জাপ আবার খুব প্রিয়পাত্র অ্যাডমিরালের। অন্য সবাইয়ের আগেই ওঁর সেখানে হাজিরা দেওয়ার মতলব ছিল। মাঝখান থেকে এল এই বাগড়া।
খুশি কেউ নন, কিন্তু কর্তব্য তো করতেই হবে। যথাসম্ভব দ্রুতই রওনা হল দুই বিমান— হানিবল আর বেরেনিস।
সহযোগিতা? করা উচিত, কিন্তু সহযোগিতার অনুকূল মনোভাব— তা না-আছে ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিটহাউসের, না-আছে কমান্ডার রুপার্ট জাপের। একে তো আলাদা শাখার লোক ওরা, ওই শাখা দুটোর মধ্যে রেষারেষি একটা চিরন্তন ব্যাপার। পরস্পরের উপরে শ্রদ্ধা না-থাকলে সহযোগিতার প্রবৃত্তি নিজে থেকে আসতে পারে নাকি?
পার্সিফোনের ব্যাপারে সেই রেষারেষির মনোভাবটা গোড়া থেকেই প্রকট হয়ে উঠল। কারণ আছে বই কী! ব্রিটহাউস ভাবছে, পার্সিফোন এসে পড়েছে গ্রহমুখী বিমানদের চলাচলের এলাকায়। সুতরাং অনুসন্ধানের ব্যাপারটায় কর্তৃত্ব করবে গ্রহমুখী হানিবলই। ওদিকে জাপ ভাবছেন, পার্সিফোন বিমানটাই যখন আন্তর্গ্রহ যান, সে যেখানে গিয়েই বিপন্ন হয়ে থাকুক-না কেন, তার উদ্ধারের ব্যাপারে আন্তর্গ্রহ বেরেনিসই নেতৃত্ব দেবে।
তা ছাড়া, দুটো শাখার ভিতরে আন্তর্গ্রহেরা যে মর্যাদায় উঁচু, তা কে না জানে? তার সঙ্গে আবার এটাও হিসাব করো যে, ক্ষমতায়, চাকরির দৈর্ঘ্যে ও গৌরবে, এমনকী বয়সেও জাপ ওই ক্ষুদে ক্যাপ্টেনটার চাইতে অনেক বড়ো। তাহলে, নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব কার পাওয়া উচিত, সে বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে আর?
এ নিয়ে যে ঝগড়া বাধবে, তা কিন্তু বড়োকর্তাদের অজানা ছিল না। ঊর্ধ্বতম মহাশূন্যের কোনো এক জায়গায় বসে তাঁরা একটা আপোশ-মীমাংসার সূত্র খুঁজে বার করলেন এ ব্যাপারে। নির্দেশ পাঠালেন একইসঙ্গে বেরেনিসে ও হানিবলে যে, ঘটনাস্থলে যে বিমানটা আগে পৌঁছাবে, কর্তৃত্ব করবে সেই। কিন্তু গেরো দেখো! সিরিয়াসপুঞ্জের আবহাওয়ার ভিতরে দুটো বিমানই প্রবেশ করল একই সময়ে, দুই বিভিন্ন দিক থেকে। কর্তাদের এত কষ্টে উদ্ভাবিত মীমাংসার সূত্রটা কোনো কাজেই এল না। আর এল না দেখে হানিবলের পাটাতনে দাঁড়িয়ে তরুণ ব্রিটহাউস উচ্চহাস্যে আকাশ ফাটিয়ে ফেলল একেবারে।
হাসি? তা, পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক এখনও ঘনিষ্ঠ আছে বলে হানিবলের বৈমানিকেরা উপযুক্ত ক্ষেত্রে হাসে বই কী! আকাশ ফাটানো হাসিই হাসে। কিন্তু ওইরকম হাসি কোনো আন্তর্গ্রহ বিমানে কেউ হাসবে, এটা স্রেফ কল্পনাতীত। জাপের কথাই ধরা যাক। ভদ্রলোক সদাই গম্ভীর, কেতাদুরস্ত, নিজের পদগৌরব সম্বন্ধে অতিমাত্র সচেতন। কদাচিৎ কখনো হাসি যদি পায়ই, তাহলে সে হাসি যাতে ঠোঁটের কোণ ছেড়ে মুখের অন্য কোনো অংশে ছড়িয়ে পড়তে না-পারে, সে বিষয়ে উনি সতর্ক হয়ে যান সঙ্গে সঙ্গেই। শব্দ করে হাসা? কমান্ডার হওয়ার আগে থেকেই উনি ও বদভ্যাস ত্যাগ করেছেন।
এহেন জাপ বেরেনিসের তাপনিয়ন্ত্রিত অফিস ঘরে বসে একটা রেডিয়োগ্রাম পেলেন হানিবলের কাছ থেকে। ক্যাপ্টেন ব্রিটহাউস সম্মান জানিয়েছেন এবং প্রস্তাব দিয়েছেন একটা সাক্ষাৎকারের। উদ্দেশ্য, পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র ও প্রকৃতি আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া।
জাপ রেগে কাঁই। তিনি আশা করছিলেন যে ব্রিটহাউস বলে পাঠাবে, ‘আমি আপনার হুকুমমতো চলবার জন্য প্রস্তুত। কী করতে হবে, বলে পাঠান।’ তা নয়, এল সহযোগিতার প্রস্তাব। সহযোগিতা? সে তো হয় সমানে সমানে! একে তো ছোকরাটা গ্রহমুখী বিভাগের লোক, তাতে আবার পদ ওর তুচ্ছ ক্যাপ্টেনের। কী স্পর্দ্ধা! আন্তর্গ্রহের কমান্ডার জাপকে ও বলে পাঠায় কি-না সহযোগিতার কথা!
জাপ রেগেমেগে উপরতলার কর্তাদের বলে পাঠালেন, ‘এ পরিস্থিতি অসহ্য। ছোকরাটাকে শায়েস্তা করুন।’ এদিকে ব্রিটহাউসকে উত্তর দিলেন, দেখাসাক্ষাৎ পরে হবে, আগে পার্সিফোনটাকে খুঁজে বার করা যাক।
ভিতরে ভিতরে তাঁর মতলব, পার্সিফোনকে খুঁজে পেলে তখন আর প্রভুত্বের কোনো প্রশ্ন থাকবে না। ক্যাপ্টেন ব্যাসকুম তো আন্তর্গ্রহ শাখার লোক। নিজের শাখার কোনো কমান্ডারের সংস্পর্শে এসে পড়লে তিনি তো তক্ষুনি সেই কমান্ডারকে উপরওয়ালা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। তাহলে আর ব্রিটহাউসকে তখন আমল দেবার দরকার কী থাকবে?
কিন্তু মুশকিল বাধল ওইখানেই। পার্সিফোন কোথাও নেই।
ক্যাপ্টেন ব্রিটহাউস খেতে বসেছেন, লেফটেন্যান্ট মাইকেল খবর দিলেন, একবারটি কন্ট্রোল ঘরে আসতে হবে। ক্যাপ্টেন সমস্ত খাবারটা একসাথে পাকিয়ে ফেললেন পাটিসাপটার মতো করে, আর সেইটাকেই কামড়াতে কামড়াতে গিয়ে দেখা দিলেন কন্ট্রোলে। হানিবল ছুটে যাচ্ছে সমুদ্রের উপর দিয়ে, অদূরেই উপকূল। সমুদ্রটা উজ্জ্বল নীল, ধোঁয়াটে নীল নয়, আসল নীলবর্ণ, অস্বচ্ছ। রঙের কার্ডে যাকে বলা হয় ২৭নং নীল, সেই রয়্যাল ব্লু। তাকানো যায় না ওই গাঢ় নীলের দিকে, চোখ টাটায়।
‘নামো তো! নামো তো নীচে, মাইক!’ বলল ব্রিটহাউস, ‘ভালো করে দেখা যাক! এমন আশ্চর্য নীল রং কোনো সমুদ্রে তো দেখিনি!’
নামতে নামতে ভুল ভাঙল। রং জলের নয়, উদ্ভিদের। কোটি কোটি চক্রাকার পাতা। কুমুদ ফুলের পাতার মতো। কোটি কোটি পাতার ঠাস বুনুনি। সারা সমুদ্রটা, শত শত মাইল পর্যন্ত সেই পাতার বুনুনিতে আচ্ছন্ন একেবারে। মাঝে মাঝে যেখানে স্রোত বইছে প্রবল তোড়ে, সেইখানেই এক একটা খোলা জলের ধারা। সে জল কালো, ঢেউয়ে ঢেউয়ে উচ্ছল, দেখলে ভয় করে।
ক্যাপ্টেনের ইঙ্গিতে হানিবল উপরে উঠে গেল আবার। না উঠলে চারিদিকে দেখা যায় না। পার্সিফোন কোথায়, খুঁজতে হবে।
বিপদসংকেত যা গিয়েছিল পার্সিফোন থেকে, তা ওই যে মাইকেলের হাতে কাগজে লেখা আছে। মাইকেল বার বার সেটা পড়ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না, ‘নানা রঙের এক লাইন হ্রদ। আমরা লাল হ্রদের কূলে নেমেছি। এঞ্জিন একেবারে বিকল, ব্যাটারিও…’
এইখানেই সংকেত শেষ।
ব্রিটহাউস তার ঘাড়ের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। পর্দায় ছবি পড়ছে উপকূলের। একটা জায়গায় আঙুল রেখে ব্রিটহাউস বলল, ‘এই সেই এক লাইন হ্রদ।’
মাইকেল তাকিয়ে দেখল, সত্যিই এক লাইন হ্রদের ছবি টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে উঠেছে। পাঁচ রঙের পাঁচটা হ্রদ— একটা লাল, একটা নীল, একটা বেগুনে। প্রত্যেকটারই চারপাশে গাঢ় নীল উদ্ভিদের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী। অদ্ভুত পরিবেশ।
কিন্তু পার্সিফোন কোথাও নেই।
নেই? কোথায় যাবে? বিপদসংকেত যা বলেছিল, তা যদি অবিশ্বাস করতে না-হয়, ওইখানে ওই লাল হ্রদের ধারে সে নেমেছিল। সেখান থেকে সে কোথায় যাবে? যাবে কেমন করে? তার নিজের ইঞ্জিনের তো এমন শক্তি ছিল না যে তাকে এক ইঞ্চি নিয়ে যায় কোনো দিকে? তা হলে ধরে নিতে হবে যে তার স্থানান্তর গমনের ভিতরে হাত আছে অন্য কিছুর। কী সেই অন্য কিছু?
ওইখানে নেমেছিল পার্সিফোন। ওই লাল হ্রদের পাশে। না, হানিবলকে ওখানে নামিও না। একটা বিমান যেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছে, ঠিক সেইখানেই আর একটা বিমানকে না নামানোই ভালো। তার চেয়ে, ওই যে ন্যাড়া পাথরের চাতালটা, যার উপরে একগাছা ঘাসও জন্মায়নি, নামাও হানিবলকে সেইখানে। তারপরে দেখা যাক।
নামবার আগে সমুদ্র আর হ্রদ, নদী আর উপত্যকা একবার ভালো করে দেখে নিল ব্রিটহাউস। জলেও যে উদ্ভিদ, কূলেও সেই উদ্ভিদ। একই রং, একরকমই পাতা, একই ঠাস বুনুনি। কোথাও ছেদ নেই, জলে স্থলে একাকার। লতা বেয়ে গিয়েছে আপনমনে। তা থেকে ডাঁটি উঠেছে পরের পর। সেই ডাঁটির মাথায় পাতার গুচ্ছ। সর্বত্রই ডাঁটির উচ্চতা প্রায় সমান। কেবল লাল হ্রদের কূলে ছাড়া। ওইখানে একটা ধারে ডাঁটিগুলো অনেক বেশি লম্বা। ব্রিটহাউস ধোঁকায় পড়ে গেল। যেখানে কতক ডাঁটি উঁচু, কতক ডাঁটি নীচু, সেইখানেই পার্সিফোন নামতে গেল কেন বেছে বেছে?
আর এক প্রহেলিকা! লম্বা ডাঁটি একটাও থ্যাতলায়নি, বেঁটেগুলো থেঁতলেছে। নিশ্চয়ই পার্সিফোনের চাপে। কিন্তু যেটুকু জায়গা জুড়ে থেঁতলানো ডাঁটির অবস্থান দেখা যাচ্ছে, পার্সিফোনের নামবার পক্ষে তা তো যথেষ্ট পরিমাণে প্রশস্ত নয়! তার ওদিকে ওই লম্বা ডাঁটির পাড়, এদিকে হ্রদে নামবার গড়ান। বেছে বেছে ওইটুকু সরু জায়গায় পার্সিফোন নামবে কেন? যেখান থেকে গড়িয়ে হ্রদের জলে পড়ে যাওয়ার প্রচুর আশঙ্কা?
অথচ, বিপদসংকেতকে যদি অবিশ্বাস করতে না-হয়, ওইখানেই নেমেছিল পার্সিফোন। নেমেছিল, কিন্তু তারপর? সমস্যা জটিল হয়ে উঠছে।
‘জায়গাটা কেমন মনে হচ্ছে?’ নামবার ঠিক আগে জিজ্ঞাসা করল মাইকেল।
‘পৃথিবীর মতোই।’ বলল ব্রিটহাউস, ‘তফাত শুধু এই যে, অক্সিজেনের পরিমাণ শতকরা দশ।’
কমান্ডার জাপ কিন্তু নামেননি এই পৃথিবীর মতো গ্রহটাতে। যেখানে বিমান নামাবার বৈজ্ঞানিক বন্দোবস্ত নেই, সেখানে নামতে ওঁর রুচিই হয় না। উনি গ্রহটার উপরে উড়তে উড়তে চক্কোর দিচ্ছেন। যা-কিছু দেখবার দেখে নিচ্ছেন উড়তে উড়তেই। দেখে নিয়েছেন যে পার্সিফোন নেই। কোথাও নেই।
পার্সিফোন যে নেই, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তিনি নিজের কন্ট্রোলে গিয়ে ঘাঁটি হয়ে বসেছেন। রিপোর্ট লিখছেন, আন্তর্গ্রহ সংস্থায়।
নামবার পরে পার্সিফোন নিখোঁজ হয়েছে। নিজে উড়ে যাবার শক্তি তার ইঞ্জিনে ছিল না। সুতরাং সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও শক্তিসম্পন্ন কোনো শত্রু এ গ্রহে আছে। শত্রু যেখানে আছে, সেখানে দলবদ্ধ না-হয়ে হানা দেওয়া নিষেধ আছে, আন্তর্গ্রহ সংস্থার তরফ থেকে। সুতরাং আমি একা কিছু করা অনুচিত মনে করছি। ধরতে গেলে একাই আমি। ওই গ্রহমুখী বিমান হানিবলটা আছে বটে নিকটেই, কিন্তু ও আর আমার কী সাহায্য করতে পারবে, সংঘর্ষ বাধলে? আমার বক্তব্য হচ্ছে, অন্তত পাঁচখানা আন্তর্গ্রহ বিমান চলে আসুক এখানে, কামান দেগে গ্রহটা চূর্ণবিচূর্ণ করে গুপ্ত-শত্রুকে টেনে বার করি আমরা।’
রিপোর্ট নিয়ে রেডিয়োগ্রাম চলে গেল। জাপ আশা করছেন, কালই কামান দাগা শুরু করা যাবে। পার্সিফোনকে যারা চুরি করেছে, হাতে হাতে উচিত সাজা পাবে তারা।
ব্রিটহাউস এদিকে চুপ করে বসে নেই। হানিবল থেকে গাড়ি নামিয়ে সে চষে বেড়াচ্ছে গ্রহজোড়া উদ্ভিদের রাজ্য। চাকার পেষণে গলগল করে রস বেরুচ্ছে ওই গাছগুলো থেকে, আর গাড়িটা ভিজে যাচ্ছে সেই রসে। তা যাক। এই উদ্ভিদ রাজ্যটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতেই হবে, দেখতে হবে যে পার্সিফোনের নিপাত্তা হওয়ার কোনো কারণ কোথাও চোখে পড়ে কিনা।
তা অবশ্য চোখে পড়েনি। তবে অন্য কিছু পড়েছে চোখে। তা হল এই যে— গ্রহজোড়া এই উদ্ভিদের রাজ্যটাতে উদ্ভিদের সংখ্যা সাকল্যে এক। নিছক একটিমাত্র রাক্ষুসে লতা সমুদ্র থেকে বেয়ে এসেছে ডাঙায়। ডালের ডাল, তস্য ডাল ছড়িয়ে দিয়েছে গ্রহময়, পাতায় নীল রং ধরিয়ে দিয়েছে সর্বত্র। অথচ, এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে, এ লতার কোনো শিকড় নেই! স্রেফ মাটির উপর দিয়ে বেয়ে গিয়েছে লতাটা, আর মাটির সঙ্গে সেই সংস্পর্শই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বংশবিস্তারের শক্তি যুগিয়েছে ওকে।
কী আছে তাহলে এই মাটিতে?
এখানে-ওখানে লতার নীচে থেকে গ্রহের পাথুরে মাটি খানিকটা করে তুলে নিল ব্রিটহাউস, হানিবলের রাসায়নিক ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করা হবে ওই মাটি। আরও বিশ্লেষণ করা হবে, পাঁচটা হ্রদের পাঁচ রঙের জল। কী কারণে ওই সব জলের অত বর্ণ-বৈচিত্র্য। তা হয়তো জানা যাবে তাহলে। সব জলেরই আলাদা আলাদা নমুনা নেওয়া হল বোতল ভরতি করে।
গ্রহটির দিবা-রাত্রির পরিমাণ মোট ত্রিশ ঘণ্টা। আঠারো ঘণ্টা দিন, আর বারো ঘণ্টা রাত। কাজেই কাজ করার ইচ্ছা যার আছে, একদিনেই সে ঢের কাজ করতে পারে। হানিবলের ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট আর লেবরেটরি কর্মীরা ঢের কাজই করে ফেলল প্রথম দিনে। পরীক্ষায় জানা গেল—
ক. উদ্ভিদের যে অংশ সমুদ্রের ভিতর আছে, তা জলের উপরে ভাসে। কিন্তু যে অংশ আছে হ্রদের ভিতরে, সেটা থাকে জলের তলায়। এর কারণ সমুদ্র জল আর হ্রদের জলে সাপেক্ষিক গুরুত্বের তারতম্য।
খ. ডাঙার উপরে সেই জায়গা দিয়েই লতাটা বেয়ে গিয়েছে, যেখানে পাথরের তলায় একটা দীর্ঘ শিরা বর্তমান, ক্রোমিয়াম ধাতুর।
এ লতা ওই ক্রোমিয়াম থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করে।
গ. পাঁচ রং পাঁচটা হ্রদও গলিত ক্রোমিয়ামে ভরতি। ক্রোমিয়ামের সঙ্গে হলদে হ্রদে আছে ক্ষার, লালে অ্যাসিড, নীলে অম্লজান, বেগুনে হ্রদে পত্রহরিৎ।
এসবই বোঝা গেল। বোঝা গেল না শুধু একটি কথা। পার্সিফোনের কী হল?
রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে ব্রিটহাউস ভোর বেলায়ই হুকুম করল, ‘সার্জেন্ট, গাড়ি বার করো।’ আর তক্ষুনি রেডিয়ো ঘরে ডাক পড়ল তার। আন্তর্গ্রহ বিমান বেরেনিস তাকে ডাকছে। কথা কইছেন কমান্ডার জাপ, ‘আন্তর্গ্রহ বিমান এক স্কোয়াড্রন এক ঘণ্টার মধ্যে এসে পড়বে। আমরা কামান দেগে দীর্ণ বিদীর্ণ করে দেব এই দেশটা। তার আগেই আপনার হানিবলকে নিয়ে আপনি এদিক থেকে সরে যান।’
ব্রিটহাউস বলল, ‘কচু!’
যাবে না সে। তার মনে একটা সম্ভাবনার কথা উদয় হয়েছে, পার্সিফোন সম্পর্কে। সেটাকে যাচাই করে না-দেখে সে এখান থেকে নড়বে না। জাপ তো অন্য শাখার লোক, তার নিজের শাখার সর্বাধ্যক্ষ এসে হুকুম করলেও না। করুক জাপ রিপোর্ট।
গাড়ি বার করবার হুকুম দিয়ে রেখেছে ব্রিটহাউস। কিন্তু সে গাড়ি কই? বেচারি সার্জেন্ট এসে কাঁচুমাচু হয়ে নিবেদন করল, ‘গাড়িটা বোধ হয় কাজের বার হয়ে গেল।’
‘তার মানে?’ তীক্ষ্ন প্রশ্ন ক্যাপ্টেনের।
‘যেখানে কাল ওইসব পাতার রস লেগেছিল, সেখানটাই ক্ষয়ে গিয়েছে। গাড়িটা এমন জখম হয়েছে যে তাকে চালাবার চেষ্টা করলে বিপদ হতে পারে।’
‘কী বোকা! কী বোকা!’ চেঁচিয়ে উঠল ব্রিটহাউস।
সার্জেন্ট হঠাৎ লোহার ডান্ডার মতো শক্ত হয়ে গেল, ‘ক্যাপ্টেন আমি!’
‘আরে, না, না, তোমার কথা বলিনি।’ তাড়াতাড়ি তাকে আশ্বস্ত করে ব্রিটহাউস, ‘বোকা আমিই! নিরেট বোকা! ও কথা ছেড়ে দাও। কাজ। কাজ শুরু করো এক্ষুনি। তা নইলে ওই জাপ মুখ্যুটা কামান দেগে সব পণ্ড করে দেবে। কন্ট্রোল আমার হাতে দাও তো মাইকেল। এখন ছুটতে হবে বিদ্যুতের বেগে।’
চালক চমকে গেল, ‘তাহলে কি আপনি টের পেয়েছেন পার্সিফোন কোথায়?’
‘আলবাত।’ চেঁচিয়ে উঠল ব্রিটহাউস, ‘লাল হ্রদের তলায়।’
আর কথা কইবার সময় পেল না কেউ। ব্রিটের হাতে হানিবল খেলতে লাগল ছেলের হাতের লাট্টুর মতো। পাথরের চাতাল থেকে তিরবেগে খাড়া উঠে গেল আকাশে, তারপর উপত্যকার অল্প উপর দিয়ে কান-ফাটানো বাঁশি বাজাতে বাজাতে অর্ধবৃত্তাকারে চক্কর দিয়ে দিল একটা। আর তার পরে?
তারপরে, সবুজ হ্রদের উপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল এমন বেগে নীচুপানে, যে বৈমানিকদের পেটের ভিতরে নাড়িভুঁড়িতেও নাড়া লাগল একটা। এইবার বিমানের মুখ লাল হ্রদের দিকে। গোলন্দাজেরা তখন দুটো টর্পেডো ভরে ফেলছে টিউবে।
আদেশটা ব্রিটহাউসের জিভের ডগায় এসে গেছে, এমন সময়ে আন্তর্গ্রহ বিমান বহরের ছ-খানা মহাকায় ব্যোমযান ঠিক তার মাথার উপরে এসে চক্কোর দিতে লাগল। রেডিয়োম্যান ছুটে এসে খবর দিল, ‘অ্যাডমিরাল নিজে আদেশ দিয়েছেন, ব্রিটকে অপসৃত হওয়ার জন্য। ওদের বিমান বহর কাজ শুরু করবে এইবার।’
‘কচু!’ জবাব দিল ব্রিটহাউস। তার ইঙ্গিতে দুটো টর্পেডো নিক্ষিপ্ত হল একসঙ্গে। লাল হ্রদের ঠিক শেষপ্রান্তে।
নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই হানিবল হুস-স শব্দে পাক খেয়ে উঠে পড়ল উপর আকাশে। লাল হ্রদের প্রান্তে ততক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে নারকীয় কাণ্ড। লাল হ্রদ আর নীল হ্রদের মাঝখানে ওই যে এক-শো গজের মতো জায়গা, তা ফেটে গিয়েছে চৌচির হয়ে, আর লাল হ্রদের সমস্ত জল প্রবল স্রোতে সেইসব ফাটল বেয়ে ছুটে চলেছে নীল হ্রদের দিকে।
দুটো হ্রদের জল যেখানে মিশছে, সেখানে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আর কী কটু গন্ধ সেই ধোঁয়ার! নানারকম গ্যাস আর খনিজ বস্তুর সংমিশ্রণে এক বীভৎস পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেখানে।
হানিবলকে ওদিকে ডাকছে বেরেনিস, ‘তোমার নামে রিপোর্ট হবে।’
‘স্বচ্ছন্দে।’ জবাব দিল ব্রিটহাউস, ‘রিপোর্টে কিন্তু দয়া করে এ কথাটাও উল্লেখ করবেন যে, লাল হ্রদের জলের তলা থেকে পার্সিফোনকে বার করেছিল এই অধমই।’
জল বেরুতে বেরুতে লাল হ্রদ ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। পার্সিফোনকে দেখা যাচ্ছে হ্রদের তলায়। কী চেহারা সে বিমানখানার। গায়ে ধাতুর আবরণ ক্ষয়ে গিয়েছে এই দু-দিনেই। এমন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে তার গায়ের ক্রোম ইস্পাত যে তার জঠরস্থ বন্দি বৈমানিকেরা গাঁইতির ঘা-কতক ভিতর থেকে তার উপর বসিয়ে দিতেই সব ভেঙে চুরে বেরুবার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল ওদের।
আগে আগে ক্যাপ্টেন ব্যাসকুম, তাঁর পিছনে কুড়িটা বৈমানিক। উৎকণ্ঠা ছাড়া আর কিছু কষ্ট তাদের হয়নি এই দু-দিনে। কারণ খাবারদাবারের কোনো অভাব পার্সিফোনে ছিল না। উপর আকাশে আন্তর্গ্রহ সংস্থার বিমানবহরকে দেখতে পেয়ে ব্যাসকুম ওইখান থেকেই অভিবাদন জানালেন অ্যাডমিরালকে আর কমান্ডার জাপকে।
হানিবলের দিকে দৃষ্টিপাত করার কোনো দরকার ব্যাসকুম বুঝলেন না। আর হানিবলও তাঁর কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্যলাভে ধন্য হওয়ার আশায় বসে নেই। ব্রিটহাউসের সময় সংক্ষেপ। এখানে আর দেরি করলে সে সময়মতো পৃথিবীতে পৌঁছোতে পারবে না। না-পারলে বিয়েটাই ফসকে যাবে তার।
যেতে যেতে সে তার বৈমানিকদের বোঝাচ্ছে, ‘ওই লতাটাই সব অনর্থের মূল। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি রাখে। ধাতু ওর খাদ্য। সেই ধাতুর গন্ধ পেয়েই সমুদ্র থেকে স্থলে উঠে এসেছে, হ্রদগুলোকে পরিণত করেছে ধাতু গলাবার চৌবাচ্চায়। হঠাৎ ধাতুময় একখানা বিমান নাগালে এসে পড়তে ও মনস্থ করল তাকে গ্রাস করবে। বিমানের তলায় যে সব ডাঁটি চাপা পড়েছিল, একপাশ দিয়ে তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, বিমান গড়িয়ে পড়ল হ্রদে। লাল হ্রদের জলে আছে অ্যাসিড। সেই অ্যাসিডে গলতে শুরু হল ক্রোম ইস্পাত। আর দুটো দিন থাকলে, বিমানের কাঠামো আর দেখতে পাওয়া যেত না।’
দূরবিন লাগিয়েও বোঝা গেল না বিশেষ কিছু। এই পাহাড়ের মাথাটা মোটামুটি সমতল, যেখানে ওরা নেমেছে। কিন্তু এ থেকে নীচে নামা খুব সহজ হবে না। এর গা খাড়া বললেই হয়। নীচে লালচে বালির মহাকান্তার, ঢেউ খেলতে খেলতে চলে গিয়েছে দিগন্ত অবধি। মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো পাহাড় চোখে পড়ে, অনুচ্চ, মসৃণ, ঘাসে-ঢাকা। চূড়াও আছে এক-আধটা, সেগুলি কিন্তু ন্যাড়া, রুক্ষ নিরেট পাথর ছাড়া আর কিছু না।
লোকালয় চোখে পড়ে না কোথাও, ছোটো বা বড়ো জন্তুজানোয়ারের চিহ্ন নেই কোনোদিকে। এমনকী গাছপালা বনজঙ্গলেরও ষোলো আনা অভাব গ্রহটাতে।
কাটা-কাটা কথায় কে একজন বলে উঠল পেছন থেকে, ‘উপনিবেশ গড়ে তুলবার পক্ষে আদর্শ জায়গা, ক্যাপ্টেন স্পেনসার!’
স্পেনসার দূরবিন নামিয়ে নিল চোখ থেকে, ‘তা হয়তো হতেও পারে স্যার!’
মেজর রাফেলের নাক একটা বিশেষরকম আওয়াজ ছাড়ল। যারা তাঁকে জানে, তারা এটাও বিলক্ষণ জানে যে, ওই বিশেষ আওয়াজটা মেজরের বিরক্তির পরিচায়ক।
ঘাড়ে-গর্দানে দশাসই মনিষ্যি এই রাফেল, পঁয়তাল্লিশে কান পিঠের চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে, চালচলন পরিপাটি রকম কেতাদুরস্ত। যে ভঙ্গিতে চারদিকে তিনি তাকাচ্ছেন, তাতে বব স্পেনসারের বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি ইতিমধ্যেই মনস্থির করে ফেলেছেন।
‘তোমার মতো খুঁতখুঁতি আমার নেই হে ক্যাপ্টেন।’ বিচারক যে সুরে মামলার রায় দেন, সেই সুরই ধ্বনিত হয়ে উঠছে তাঁর কথায়, ‘ওই আকাশটা দেখ, খণ্ড খণ্ড মেঘ ভাসছে তাতে। দূরের ওই পাহাড়গুলি দেখ, বাসন্তী রোদের নীচে ঝলমলে সবুজ। কোনোদিন আবাদ হয়নি ওসব জমি, ওদের উর্বরতা দেখে একদিন তাক লেগে যাবে তোমাদের। পৃথিবী থেকে যা-কিছু বীজ আনো, সোনা ফলাবে তাতেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, আদিবাসি নেই একটাও, ওই উৎপাত যেখানে আছে, সেখানেই ঝামেলা।’
তারপরে খাকি ঢাকা ঘাড় পিছনে হেলিয়ে তিনি সশব্দে নিশ্বাস নিলেন একবার, ‘আবহাওয়া বিশুদ্ধ, ক্লারেটের মতো নির্মল। আর তুমি কী চাও ক্যাপ্টেন?’
বব জবাব দেয় না। হয়তো ঠিক কথাই বলছেন মেজর রাফেল। কিন্তু কেমন যে ওঁর স্বভাব, নীচের লোকেদের মুখ থেকে আপত্তি বেরুবার আগেই উনি সেটা আন্দাজ করে নেন, আর সোৎসাহে তা খণ্ডন করতে লেগে যান। বাহ্যত এই অ্যান্টলকে; হ্যাঁ, মাটিতে নামবার আগেই মেজর গ্রহটার নামকরণ করেছেন ‘অ্যান্টল’।
অ্যান্টলকে বাহ্যত পৃথিবীরই মতো বলে মনে হয় বই কী! কিন্তু এটাও তো ভাবা উচিত যে ওই ‘আর্গেমোন’ বিমানখানা অপার মহাশূন্যের ভিতর দিয়ে দশ দশটা লাইট-ইয়ারের দূরত্ব অতিক্রম করে সবে এই অ্যান্টলে পৌঁছোল আজ। পৃথিবী থেকে এত এত দূরে এসে, অজানা পরিবেশে, বিশেষরকম বিচারবিবেচনা না-করে হঠাৎ কোনো গুরুতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কি উচিত হবে?
মেজরের অতখানি উচ্ছ্বাসের উত্তরে সে শুধু সতর্কভাবে ছোট্ট জবাব দিল একটা, ‘গ্রহটা বাসযোগ্যও হতে পারে বই কী স্যার!’
কাল সন্ধ্যায় অ্যান্টলে নেমেছে আর্গেমোন। সারারাত্রি ওরা সবাই ভিতরেই ছিল। রেডিয়োম্যান স্যান্ডি ট্রেনহ্যাম হাওয়ার কোনো স্তরেই স্থানীয় কোনো সংকেত বা শব্দের পাত্তা পায়নি। তাতেই প্রমাণ যে সভ্য বা বিজ্ঞানবিদ কোনো মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব এখানে নেই। খবরটা রাফেলকে করেছে উল্লসিত। আবহাওয়ার গুণাগুণ পরীক্ষার ফলে সে উল্লাস আরও বেড়ে গিয়েছে তাঁর। ভাবে ভঙ্গিতে এমনটাই যেন তিনি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন যে ব্যক্তিগতভাবে একটা মহাযুদ্ধ জয় করে ফেলেছেন তিনি।
এইবার প্রভাত হয়েছে, সবাই বিমান থেকে নেমে আবিষ্কারে বেরুবেন। স্যান্ডি ট্রেনহাম নীচে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘মেজর কি শুধু সুপ্রভাত জানাচ্ছিলেন, না ”সব ঠিক হ্যায়” বার্তা পাঠাবার ব্যাপারে তোমার সম্মতি চাইছিলেন?’
হালকা সুরে কথা কইছে স্যান্ডি, যেমন ওর চিরকেলে স্বভাব। তবু যেন বব স্পেনসারের সন্দেহ হল ওর আসল মতলব ববকে সতর্ক করে দেওয়া।
সে পালটা প্রশ্ন করল, ‘মেজর পৃথিবীতে রেডিয়ো করতে বলেছেন, নয়?’
‘তা তো বলছেনই।’ জবাব দিল স্যান্ডি, ‘প্রাথমিক বার্তা আমি নিম্ন মহাকাশ বেতারে আগেই চালান দিয়েছি। কেন্দ্র বদল হতে হতে খবরটা ঘণ্টা বারোর ভিতর আমাদের কাছে পৌঁছোবে, আশা করি। তারপরই কথা উঠবে, ”সব ঠিক হ্যায়” ছাড়পত্র দেওয়ার। সেটা দেওয়ার ক্ষমতা ওঁর একার হাতে নয়। তাইতেই জানতে চাইছিলাম, সে-ব্যাপারে তোমার সম্মতি আদায়ের চেষ্টা উনি করেছিলেন কি না।’
‘এখনও খোলাখুলি কিছু বলেননি বটে, তবে—’ বব শেষ করল না তার কথা। নিজের ঢাক সব চাইতে জোরে বাজুক, সেদিকে রাফেলের অখণ্ড মনোযোগ। অতএব বারো ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তিনি নির্ঘাৎ চাপাচাপি শুরু করবেন যে, সব ঠিক হ্যায় বার্তা পাঠাতে কর্মচারীরা সবাই রাজি হয়ে যাক। ওটা পৌঁছোনো মাত্র পৃথিবীতে জয়জয়কার পড়ে যাবে রাফেলের। সবাই জানবে যে, মেজর রাফেল নিজের টুপিতে আর একটা রঙিন পালক গুঁজে ফেলেছেন, এমন একটা নতুন গ্রহ খুঁজে বার করেছেন দশ লাইট-ইয়ার দূরের মহাকাশে, যেখানে পৃথিবী থেকে কিছু বাড়তি মানুষকে অনায়াসে সরিয়ে দেওয়া যায়।
কথা বব শেষ করেনি, কিন্তু তার মনের কথা বুঝে ফেলতেও স্যান্ডির দেরি হল না। সে পাদপূরণ করল ববের অকথিত উক্তির, ‘বলেননি বটে, তবে বলবেন দুই-এক ঘণ্টার মধ্যেই। তুমি কী বলবে? সায় দেবে?’
‘যতক্ষণ জায়গাটাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে বুঝতে না-পারছো, ততক্ষণ দেব না।’ উত্তর দিল বব।
‘মেজর রেগে যাবেন।’
‘তা কী করব? ব্যাপারটা বোঝো। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা এমন বেড়ে গিয়েছে, সব ঠিক হ্যায় বলে একটা খবর পাওয়া মাত্র ওরা বিমান রওনা করে দেবে দু-হাজার লোক ভরতি করে। ভেবে দেখ, অত বড়ো একখানা বিমানকে দশ লাইট-ইয়ার দূরে পাঠাবার খবরটা কী। তড়িঘড়ি একটা খবর পাঠাব আমরা, সে খবরটা যদি শেষকালে ভুয়ো প্রতিপন্ন হয়, ওই বিরাট ব্যয়টা তখন হয়ে দাঁড়াবে অপব্যয়। তখন রাফলের তো মুখে চুনকালি পড়বেই, আমাদের মুখও নিষ্কলঙ্ক থাকবে না।’
‘তা তো নিশ্চয়ই।’ মাথা নাড়ল স্যান্ডি, ‘সব ঠিক হ্যায় বার্তা পাঠানোর ব্যাপারে আমাদেরও যখন দায়িত্ব আছে।’
দু-জন বৈমানিক, হবস আর গ্রিফিথস তখন গাড়ি নামাচ্ছে বিমান থেকে।
বব স্পেনসারও বেরুবে গাড়িতে, তার আগে বিমানে উঠে নিজের কেবিনে ঢুকল একবার। নিরিবিলিতে চিন্তা করতে চায় একটু, অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্যও।
পর্যবেক্ষণে এ যাবৎ যা জানা গিয়েছে, অ্যান্টলের সম্পর্কে, বব খতিয়ে দেখছে একে একে। না, না, খুঁত চোখে পড়েনি কোথাও। উপনিবেশ গড়ে তুলবার জন্য পৃথিবী থেকে কেন মানুষ আসবে না অ্যান্টলে, এর কোনো কারণ দেখাতে পারে না বব। রেডিয়োযোগে পৃথিবীকে যা যা খবর জানানো হয়েছে এ যাবৎ, তার ভিতরে কোথাও এমন কিছু নেই, যা শুনে ওখানকার কর্তাদের মনে সন্দেহ বা আতঙ্ক জাগতে পারে।
‘তাহলে রাফেলই হয়তো ঠিক বলছেন।’
মনে মনে এই কথা বলতে বলতেই বব নেমে এল আবার। ক্যাটারপিলার ট্রাক নামানো হয়েছে। যুদ্ধে যেসব ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয় পৃথিবীতে, এ ট্রাক অনেকটা সেই ধরনের। তবে তার চেয়ে লম্বা অনেক বেশি। হবস বসেছে চালকের সামনে, তার পাশেই রয়েছে গ্রিফিথস। মেজর রাফেল গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ফিটফাট কেতাদুরস্ত, যেন এইমাত্র ব্যারাক থেকে বেরুলেন প্যারেড দেখবার জন্য।
স্যান্ডি ট্রেনহাম যাবে না এ অভিযানের সঙ্গে, পৃথিবী থেকে যদি রেডিয়োর খবর আসে, ধরতে হবে তা। আরও দু-জন বৈমানিক রয়েছে আর্গেমোনে, তারাও যাবে না সঙ্গে। দীর্ঘদিনের আকাশযাত্রার পরে বিমানটার তদ্বির তদারক অনেক কিছু করবার আছে। সেই সবই করবে ওরা।
বাকি থাকে আর একজন, মহিলা বৈমানিক একটি, জীববিদ্যার বিশেষজ্ঞ তরুণী, অনূঢ়া। সম্পর্কে ইনি আবার মেজরের ভ্রাতুষ্পুত্রী হন। যেকোনো ব্যাপারেই ইনি কাকামশাইয়ের মতে মত দিয়ে থাকেন, ওটা এঁর স্বভাব। নাম জেনি মুর, ইনিও সঙ্গে আসছেন না শুনে আশ্বস্ত হল বব। যখন আসেন, তখন তো এঁর কাজ হল শুধু নীল চোখে ঝিলিক হেনে, বোঁচা নাক ঈষৎ কুঁচকে, চোখা চোখা বাক্যবাণে সঙ্গীদের (অবশ্য কাকামশাইকে ছাড়া) ক্রমাগত বিদ্ধ করা।
বিমান থেকে এক-শো গজ গিয়েই গাড়ি নামতে শুরু করল। প্রায় খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে গাড়িটা যে উলটে গেল না, তার কারণ শুধু এই যে ওলটাবার মতো করে ওটা তৈরি হয়নি। নীচে বালুকাস্তর, সেদিকেই তাকিয়ে রাফেল তখনও দাঁড়িয়ে আছেন, দু-হাতে রেলিং ধরে।
বালির উপরে গাড়ি নামতেই তিনি বললেন, ‘আদর্শ জায়গা উপনিবেশের পক্ষে, কী বলো ক্যাপ্টেন? বিমানে ফিরে এসেই সব ঠিক হ্যায় রেডিয়ো করে দেওয়া যাক।’
আসনে বসে গাড়ির দোলানির সঙ্গে নিজেও অল্প অল্প দুলছে বব। কিন্তু ভাবে মন্তব্য করল, ‘সেটা যে বড্ড হুটোপাটির ব্যাপার হবে স্যার! খোঁজখবর তেমন কিছুই তো নেওয়া হয়নি!’
‘দরকার আছে আরও খোঁজ খবরের?’ খেঁকিয়ে উঠলেন রাফেল, ‘বসে বসে আরাম করব যে এখানে, তার খরচা দেবে কে? অপব্যয় পছন্দ নয় উপরওয়ালাদের। আমি নিজেও অপছন্দ করি, অপব্যয় এবং অহেতুক দেরি— দুটোকেই।’
একটা হাঙ্গামাই বাধবে, তাতে সন্দেহ নেই ববের। অ্যান্টল যে আদর্শ স্থান, এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছেন মেজর, সংকল্প ওঁর স্থির।
কেনই-বা হবে না স্থির? তড়িঘড়ি স্থির করতে পারলেই তো লাভ ওঁর।
লাভ এই যে, করিতকর্মা লোক বলে সুনাম হবে পৃথিবীতে। দশ লাইট-ইয়ার উড়ে এসে মাটিতে নামার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক বলে এত্তেলা দিতে পারা কম বাহাদুরি নয়। চাই কী, এই থেকেই মস্ত একটা পদোন্নতি হয়ে যেতে পারে মেজরের।
চাকা ধরে বসে আছে হবস, হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘ওগুলো কী, অ্যাঁ? দেখুন, দেখুন কী ওগুলো?’
একটা পাহাড়ের সবুজ সানুতে কী যেন জন্তু চরে বেড়াচ্ছে কতগুলি। লম্বা ঠ্যাং, আকারে পৃথিবীর ছোটো জাতের ছাগলের মতোই। চরছে বটে, কিন্তু কেমন যেন অস্থির ভাবভঙ্গি তাদের। তাড়াতাড়ি কয়েক খাবল খেয়ে নিচ্ছে, তারপরই মাথা তুলে এদিক-ওদিক চাইছে। গাড়িটা আসতে দেখে তারা দৌড় মারল তক্ষুনি, উধাও হয়ে গেল পাহাড়ের ওপিঠে।
রাফেল বললেন, ‘খেতে ভালো হবে বোধ হয়।’
বব কিন্তু খুশি হতে পারেনি, অপ্রসন্নভাবে তাকিয়ে আছে জন্তুগুলোর গমনপথের দিকে।
‘ওতেও বিপদের গন্ধ দেখতে পাচ্ছ বুঝি ক্যাপ্টেন?’ ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন এল রাফেলের দিক থেকে।
বব শুধু মাথা নাড়ল, ‘না স্যার, আমি শুধু ভাবছি বড়ো গাছ একটাও নেই কেন, পাখি নেই কেন, কীটপতঙ্গেরও এখনও পর্যন্ত সাক্ষাৎ পাইনি কেন। পৃথিবীতে লক্ষ রকম প্রাণী, এখানে তো আর কিছুই দেখি না! অথচ এমন আবহাওয়া, এত রোদ্দুর—’
‘স্বর্গে সাপ দেখতে পাচ্ছ না, এই অজুহাতে তুমি সব ঠিক সংকেত পাঠাতে আপত্তি করবে নাকি?’ হেসে উঠলেন রাফেল।
কথার জবাব না-দিয়ে বব বলল, ‘এক মুঠো ঘাস নমুনা স্বরূপ নিয়ে গেলে হত। মিস মুর বিশ্লেষণ করে অনেক কিছু বলতে পারতেন ও থেকে।’
গাড়ি থামিয়ে নমুনা নেওয়া হল। এ কি ঘাস নাকি? ইঞ্চিখানেক লম্বা, তারের মতো সরু, শিকড় খাটো, কড়া, তার গায়ে গায়ে ঘন চুল। একমুঠো ঘাস তুলতেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে বালি আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মাটিতে ভিজে ভাব একদম নেই।
রাফেল তাকিয়ে আছেন ববের দিকে, ওর মনের কথা টের পেয়ে গেছেন, ‘সেচ পেলেই মাটি ঠিক হয়ে যাবে ক্যাপ্টেন! সেচ দিয়ে তাতে পৃথিবীর ঘাস বসিয়ে দিতে হবে, বড়ো জাতের গাছের চারাও।’
ওই যে সেই পাহাড়, যার উপরে ছাগল চরছিল। কিন্তু কই, অতগুলো ছাগলের একটারও পদচিহ্ন নেই তো বালিতে! হাওয়া নেই যে বালি উড়ে এসে দাগ বুজিয়ে ফেলবে? তবে? বালি কি নিজে নিজেই চলে বেড়ায় এখানে?
ওই কথাটাই বার বার ঘুরপাক খেতে থাকল ববের মনে— পদচিহ্ন কেন নেই ছাগলদের? বালি কি চলে বেড়ায় এ গ্রহে? গাড়ি ততক্ষণে কয়েক মাইলের একটা বৃত্তাংশ রচনা করে বিমানের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। জেনি মুর এসে ঘাসের নমুনাগুলো তুলে নিল ববের হাত থেকে। নিয়েই কিন্তু সে চলে গেল না, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঘাড়টা বেঁকাল ববের দিকে, আর তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এখন পর্যন্ত তো কোথাও এমন কিছু দেখিনি, যার দরুন সব ঠিক বার্তা বন্ধ রাখা যায়। দেখি এইবার এই ঘাসের নমুনার ভিতর কিছু মেলে যদি—’
ওর সুরটা যে ঝাঁঝালো, তা লক্ষ করেছে বব, ‘এত তাড়াতাড়িই বা কী?’ জিজ্ঞাসা করল সে, ‘গ্রহটার বলতে গেলে কিছুই দেখলাম না, এরই মধ্যে পথ খোলসার সংকেত পাঠাবার কি মানে হয় কিছু?’
‘দেরিতে খরচ নেই বুঝি?’ রাফেলেরই কথা জেনির মুখে।
বব বুঝি রেগেই গেল, ‘হ্যাঁ, খরচ আছে দেরিতে। কিন্তু আমাদের ভুল খবরের উপরে নির্ভর করে এক জাহাজ উপনিবেশি যদি এখানে এসে হাজির হয়, আর ভুল ধরা পড়ার পরে বাধ্য হয় ফিরে যেতে, তাতে খরচ হবে যে আরও অনেক— অনেক বেশি?’
‘ভুলটা কোথায় থাকতে পারে, তা তো বুঝতে পারছি না।’ জেনির কথায় ঠিক রাফেলের মতোই মেজাজ, ‘মানুষের অনিষ্ট করতে পারে, এমন জন্তু বা উদ্ভিদ বা বীজাণু কোথাও দেখছি না। হাওয়া যা, তা স্বাস্থ্যনিবাসের উপযুক্ত।’
‘একটা গাছ নেই, একটা কীটপতঙ্গ নেই, বালি নিজে নিজে চলে বেড়ায়—’ আপত্তি জানাতে ছাড়ে না বব।
বালির দল চলে বেড়াবার কথা শুনে হেসে উঠল জেনি। তারপর বলল, ‘বালির কথা ছেড়ে দাও। কীটপতঙ্গের অভাব যা বলছ তা অমন হয়। স্থানীয় কোনো বৈশিষ্ট্যের দরুন ক্রমবিবর্তনের ধারায় দুই-একটা পর্যায় বাদ পড়ে যায় কখনো কখনো। সে বৈশিষ্ট্য যে এক্ষেত্রে কী, তা যথাসময়ে বোঝা যাবে নিশ্চয়ই।’
‘তাহলে আপনি বলতে চান যে, সেটা বোঝার আগেই সব কিছু ঠিক আছে বলে খবর দেওয়া উচিত আমাদের?’
বব আর দাঁড়াল না। দরজাটা যেভাবে খটাং করে বন্ধ করল জেনি, তা থেকেই বোঝা গেল তার মেজাজের অবস্থা।
এর পরেই ববের ঘরেতে এল স্যান্ডি। সেও বোঝাতে এসেছে ওকে। তবে অন্যদিক দিয়ে সে বলছে, ‘আমাদের সাবধান হওয়া দরকার নিশ্চয়ই। কিন্তু মেজর উপরওয়ালা, সে যদি সাবধান হতে না-চায়, আমরা কী করতে পারি? ধরো, আমরা বাধা দিলাম, ফলে এক্ষুনি সব ঠিক বার্তা যেতে পারল না পৃথিবীতে। কিন্তু ধরো, অনেক কিছু সন্ধান গবেষণার পরেও গলদ কিছুই বেরুল না অ্যান্টলে। তখন? তখন তো সব ঠিক বার্তা পাঠাতেই হবে? আর তখনই তাঁর নালিশ দায়ের করবেন মেজর। উপরওয়ালাদের বলবেন, ক্যাপ্টেন স্পেনসারের একগুঁয়েমির জন্য কতখানি মূল্যবান সময় হয়েছে নষ্ট, কত অর্থের হয়েছে অপব্যয়। তখন কী হবে?’
বব স্বীকার করতে বাধ্য হল সেরকম পরিস্থিতিতে তার নিজেরই জীবনটা মাটি হয়ে যাবে, মহাকাশ গবেষণার দপ্তরে সে চিহ্নিত হয়ে যাবে অতি সাবধান কর্মনাশা লোক বলে।
কিন্তু, সে-আশঙ্কা সত্ত্বেও সে যে নিজের বিচারবুদ্ধি বিসর্জন দিতে রাজি নয়, একথাও সে শুনিয়ে দিল স্যান্ডিকে। ‘নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারছ বন্ধু,’ বলে স্যান্ডি বিদায় নিল।
সন্ধ্যার ঠিক আগে সে দেখল, হবস আর গ্রিফিথস আবার গাড়ি নিয়ে বেরুচ্ছে। এবার যেন বড়ো রকমের তোড়জোড়। বব জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কি বাইরে রাত কাটাবে ভাবছ?’
ওরা বলল, ‘হুকুম তো সেইরকমই, ক্যাপ্টেন—’
বব অবাক হয়ে বলল, ‘সে কেমন কথা? ”সব ঠিক” সিদ্ধান্ত নেওয়া যতক্ষণ না হচ্ছে, বিমানের বাইরে কারও রাত কাটানো তো নিয়ম নয়!’
পিছন থেকে কড়া জবাব দিলেন রাফেল, ‘নিয়মেরও ব্যতিক্রম মাঝে মাঝে করতে হয় বই-কী! সিদ্ধান্তটা যদি অকারণে আটকে দেয় কেউ, হাত গুটিয়ে বসে থাকব নাকি আমরা? যতদূর এগুতে পারি, এগুই।’
হবস আর গ্রিফিথস রওনা হয়ে গেল। বব মুষড়ে পড়ল অজানা আশঙ্কায়। এ কাজ ভালো হল না— এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু রাফেলকে বোঝাবে কে?
সন্ধ্যার পর জেনি আবার এসেছে। কাঁচুমাচু হয়ে অনেক কথা বলল ববকে। তড়িঘড়ি সব ঠিক বার্তাটা পাঠাবার জন্য কেন যে মেজর অত ব্যস্ত হয়েছেন, সেই সম্পর্কেই ভিতরের কথা। আর্গেমোন একা বেরোয়নি উপনিবেশ-যোগ্য নতুন গ্রহের সন্ধানে, মহাশূন্যের তিন কোণ লক্ষ্য করে তিনখানা বিমান বেরিয়েছে একসঙ্গে। এই তিনটির তিন অধ্যক্ষের ভিতরে চলছে এক গোপন রেষারেষি। যে আগে উপযুক্ত গ্রহের সন্ধান দিতে পারবে, সে প্রমোশন পেয়ে যাবে অন্য দু-জনকে টপকে। অ্যান্টল সম্বন্ধে সব ঠিক হ্যায়টা জানাতে পারলেই রাফেল সেই প্রমোশনের মেওয়া হাতে পেয়ে যেতে পারেন। সবুরে তা ফসকে যেতেও পারে। অন্য দু-জনও তো চেষ্টা করছে প্রাণপণে। এইরকমই কিছু নিজেও অনুমান করেছিল বব। ঠান্ডা হয়ে বসে জেনির ওকালতি সে শুনল। কিন্তু ভিজল না তার কাকুতিতে। উলটে বলল, ‘আপনি একটা দিকই দেখছেন। আশঙ্কার দিকটাও দেখুন। সব ঠিক জানিয়ে দেবার পরে যদি কিছু বেঠিক বেরিয়ে পড়ে, প্রমোশনের বদলে আপনার কাকাকে যে পেতে হবে অর্ধচন্দ্র! আমি অ্যান্টল সম্বন্ধে এখনও সন্দিগ্ধ। আর সে সন্দেহ দূর হওয়ার আগে আমি কখনোই পৃথিবীকে বলতে পারব না, ‘জাহাজভরতি উপনিবেশি চলে আসুক স্বচ্ছন্দে।’
জেনি রাগে-দুঃখে কেঁদেই ফেলত আর একটু হলে। কোনোরকমে সামলে নিয়ে চলে গেল নিজের কেবিনে।
পরেরদিন নীচে নামতে ইচ্ছে করেই দেরি করল বব। রাফেল অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন, দেখা হলেই একটা রাগারাগি হয়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। অশুভস্য কালহরণং নীতিটাই এক্ষেত্রে সে অনুসরণ করবে।
নামেনি সে। কিন্তু ঘরে বসেই সে স্যান্ডির গলা শুনতে পেল। ‘কোনো খবর নেই স্যার—’ জোরগলায় হাঁকছে সে। অবশ্যই রাফেলের উদ্দেশ্যেই একথা বলা। কিন্তু খবর নেই, মানে কী? কীসের খবর নেই? ব্যস্ত হয়ে নেমে এসে বব রেডিয়ো ঘরে ঢুকল।
স্যান্ডি জানাল, খবর নেই হবস আর গ্রিফিথসের। কাল সন্ধ্যার আগে তারা বেরিয়েছে, কথা ছিল, রাত ভোর হলেই তারা রেডিয়ো মারফত রাতের অভিজ্ঞতা জানাবে মেজরকে। ট্রান্সমিটার তারা সঙ্গে নিয়েছে। সেটা কোনো কারণে বিগড়ে গিয়েও থাকে যদি, তা মেরামত করবার মতো উপকরণ যন্ত্রপাতিও সঙ্গে আছে তাদের। তবে খবর কেন আসে না?
অপেক্ষা! অপেক্ষা! অধীর পায়চারি! ঘণ্টার পরে ঘণ্টা! কিছু-একটা গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়! ঘটেছে কিছু বিপদ! রাফেলের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। দূরবিন চোখে নিয়ে তিনি দূরদিগন্তে তাকিয়ে আছেন। দূরবিন ঘোরাচ্ছেন একবার এদিকে, একবার ওদিকে। তাঁর সে স্বয়ংসন্তুষ্ট আত্মম্ভরিতায় দারুণ চিড় খেয়েছে একটা। ববের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই যেন পারছেন না ভদ্রলোক।
বেলা দশটা নাগাদ তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন। এক্ষেত্রে একমাত্র সিদ্ধান্ত যা নেওয়া যেতে পারে, তা নিলেন অবশেষে। রওনা হতে হবে লোক দুটোর খোঁজে। গাড়ি তারাই নিয়ে গিয়েছিল। এঁদের যদি যেতে হয়, পায়দলে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অগত্যা রওনা হয়ে পড়লেন দুপুর রোদ মাথায় করে— মেজর নিজে, বব স্পেনসার আর স্যার স্যান্ডি ট্রেনহ্যাম। রেডিয়োর ঘরে কান রাখবার জন্য জেনি রইল বিমানে। দৈবাৎ যদি হবস আর গ্রিফিথস বেতারে কিছু খবর দেয়, ও পারবে তা ধরতে, ও-বিদ্যে জানা আছে ওর খানিকটা।
ট্রান্সমিটার সঙ্গে নিয়েছেন মেজরও। মাঝে মাঝে জেনিকে তিনি ডাকবেন বেতারে। জেনে নেবেন, হবসদের খবর কিছু এল কিনা।
সব বন্দোবস্ত পাকা রইল পিছনে। এখন সমুখের কাজে অখণ্ড মনোযোগ দিতে পারবেন মেজর। এগিয়ে চললেন আগুন রোদে তপ্ত বালুর প্রান্তর বেয়ে। পাহাড়ের লাইনে পৌঁছোতেই বেলা পড়ে গেল। গোধূলি এখানে ক্ষণস্থায়ী। সন্ধ্যা নামবে এক্ষুনি। আজ আর হারিয়ে যাওয়া সাথীদের সন্ধানে বেশি ঘোরা-ফেরার সময় নেই। আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই রাতের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে একটা। নিরাপত্তার জন্য চিন্তা করবারও একটা দরকার যে আছে এই অ্যান্টলে, তা প্রায় একরকম স্বীকার করে নিয়েছেন মেজর। অ্যান্টল যে স্বর্গ নয়, ববের এ সন্দেহ বুঝি তাঁরও মনে সংক্রামিত হচ্ছে একটু একটু করে।
এসব পাহাড়ে গুহাজাতীয় কিছু নেই। কাজেই ফাঁকা জায়গাতে শোয়া ছাড়া উপায় নেই। তা, জায়গা তো সবই ফাঁকা। ঝোপঝাড় কোথাও নেই। একটা নীচু পাহাড়ের মাথায় ঘাসে-ঢাকা সমতল মাঠ দেখতে পেয়ে সেইখানেই পাশাপাশি শুয়ে পড়লেন তিনজন। তার আগে অবশ্য জেনিকে একটা খবর পাঠাতে ভুল হয়নি রাফেলের। ওদিক থেকে জেনিও দিয়েছে খবর। যতদূর খারাপ খবর হতে হয়। হবসরা ফেরেনি।
এ আকাশে চাঁদ নেই, থাকবার কথা নয় কিছু। তবে নক্ষত্র অগুন্তি, ছায়াপথটাও এখানে অনেক বেশি উজ্জ্বল। পাহাড়ের মাথাটাকে অন্ধকার কোনোমতেই বলা চলে না। শুয়ে পড়েছে তিন অভিযাত্রী। পাশাপাশি বটে, তবে গায়ে গায়ে নয়। বব পরামর্শ দিয়েছিল, অন্তত আট-দশ ফুট দূরে দূরে এক একজন শোবে। যাতে, হঠাৎ বিপদ ঘটলে, তা একসাথে তিনজনকেই গ্রাস করতে না-পারে।
বিপদ? বিশ্বাস করতে মন চায় না যে এমন শান্তির পরিবেশে বিপদের আশঙ্কা থাকতে পারে কোথাও ওত পেতে। ধীরে বইছে নাতিশীতল হাওয়া, নক্ষত্রের আলো থেকে আসছে রহস্যময় হাতছানি, একটা অতিক্ষীণ ঝিরঝির শব্দ কানে আসে নতুন কোনো ভাষায় ঘুমপাড়ানিয়া গানের মতো—
হঠাৎ বব সজাগ হয়ে উঠল। কীসের ওই ঝিরঝির শব্দ? কীসের? মাথা তুলে একবার চারদিক তাকিয়ে দেখল সাবধানে। জলের শব্দ নয়, কারণ নদী-টদি নেই এখানে। শব্দ বাতাসেরও নয়, গাছ নেই, পত্রমর্মরের প্রশ্নই ওঠে না। পোকামাকড় এদেশে এসে অবধি চোখে পড়েনি। পড়ত যদি তো নতুন ধরনের ঝিল্লি বলে ধারণা করা যেত।
অতএব বব সিদ্ধান্ত করল যে শব্দটা বাইরেকার নয়, ওটা তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। হতেই পারে। সারাদিন মাথায় রোদ লেগেছে খুব। ঝিরঝির শব্দ না-হয়ে ঝনঝন হলেও বলবার কিছু থাকত না।
একসময়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, তা কে বলবে? হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল। একটা অস্বস্তি লাগছে কেমন। গুমোট যেন খুব। পাহাড়ের মাথায় খোলা মাঠে ঘুমোনো, গুমোট আসে কোথা থেকে? কাত হয়ে শুয়েছিল, ঘুম ঘুম চোখে তাকাল পাশের দিকে। এ কী? অন্ধকার যে? এই তো ঘুমোবার আগে আকাশকে দেখা গিয়েছিল ঝলমলে উজ্জ্বল, পাহাড়টা চাপা হাসি হাসছিল আধ আলোর ঘোমটার আড়াল থেকে। হঠাৎ অন্ধকার কোথা থেকে? চিত হয়ে উপরপানে তাকাল বব। কই, এক টুকরো মেঘও তো নেই নির্মল আকাশে! কোটি কোটি তারা সেখানে যেন প্রতিযোগিতায় মেতেছে— কে কতখানি আলো ছড়াতে পারে।
তবে?
উপরে আলোর বান ডেকেছে, পাশে কিন্তু অন্ধকার। ডাইনে ফেরে, অন্ধকার! বাঁয়ে ফেরে, অন্ধকার। একবার শিওরের দিকে, একবার পায়ের দিকে তাকাল, দু-দিকেই আঁধারের উঁচু দেওয়াল। তাকে ঘিরে ফেলেছে একটা আঁধার বেষ্টনী। আর—
সেই ঝিরঝির ঝিরঝির আওয়াজ। তবে এখন আর তো ক্ষীণ নয় আগের মতোন। কর্কশ, একটানা একটা অশুভ শাসানি। কার? কার শাসানি? মরণের নাকি?
অন্ধকার বেষ্টনীর দিকে হাত বাড়াল বব। ঝিরঝির নয়, ঝরঝর করে তার হাতের উপর ভেঙে পড়ল এক রাশি বালি। বালি এ গ্রহে চলমান। তাই ছাগলের পায়ের দাগ সঙ্গে সঙ্গেই বুজে গিয়েছিল।
ডাইনে হাত দেয়, বালি। বাঁয়ে হাত দেয় বালি, মাথার দিকে হাত বাড়াতে মাথায় বালি ভেঙে পড়ল। দু-পা লম্বা করে ছড়িয়ে দিতে বালিতে বালিতে চাপা পড়ে গেল কোমর পর্যন্ত।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বব। পরিত্রাহি চিৎকার করতে করতে। ‘মেজর! স্যান্ডি! স্যান্ডি! মেজর!’ না, তাদের ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙার আগেই জ্যান্ত সমাধি হবে তাদের।
কিন্তু তাদের কথা পরে, আগে ববকে নিজে বাঁচতে হবে। মাথার উপরেও এক ফুট উঠেছে বালির দেওয়াল। চারিদিক নিশ্ছিদ্র। ভেঙে পড়ছে বালি গায়ে মাথায়। ডুবে যাবে, তলিয়ে যাবে এক্ষুনি। মরিয়া হয়ে সে হাঁচড়-পাঁচড় করতে লাগল সেই বালির দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠবার জন্য। ভেঙে বেরুনো যে সম্ভব হবে না— তা সে আন্দাজেই বুঝেছে। অনেক, অনেক পুরু এ দেওয়াল, তা নইলে এত বালি ঝরে পড়া সত্ত্বেও অটুট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেমন করে?
বেয়ে ওঠা কি যায়? যেখানে হাত দেয়, ভেঙে পড়ে। যেখানে পা বাঁধিয়ে দেয়, ভেঙে পড়ে। ছ-ফুট লম্বা বব মরিয়া হয়ে উঁচুপানে দিল এক লাফ, নাগালে পেল দেওয়ালের মাথাটা। সে মাথা ভেঙে পড়ল সঙ্গেসঙ্গে, আরও খানিকটা নিজেই ভেঙে নামাল বব। এইবার দেওয়াল ওর কাঁধ বরাবর নেমে এসেছে। আর ভয় নেই। সেই ভঙ্গুর দেওয়ালের মাথায় হাতের ভর রেখে সে এক লাফে ওপিঠে গিয়ে পড়ল। মুক্ত! মক্ত! এখানে আলোয় আলো চারধার। কিন্তু পায়ের তলায়? পায়ের তলায় অ্যান্টলের মাটি চঞ্চল হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। চারধার থেকে বালুকণাগুলো সজীবের মতো ছুটে গিয়ে গেঁথে যাচ্ছে দেওয়ালে, তিন তিনটি মানুষের দেহকে চাপা দেওয়ার জন্য।
‘মেজর! স্যান্ডি! স্যান্ডি! স্যান্ডি! মেজর!’ ববের ব্যাকুল চিৎকারে ওদিককার দুটো প্রাকার বেষ্টনীর ভিতর থেকে হতাশ হাহাকার শোনা যায় দুটো মানুষের।
‘ঠ্যালো! ভাঙো!’ চ্যাঁচায় বব, আর বাইরে থেকে ঝুড়ি পরিমাণ বালি টেনে নামায় এক এক টানে। ভিতরে-বাইরে সমান ঘা খেয়ে অবশেষে দুটো সমাধিই তাদের শিকারকে উগরে দিতে বাধ্য হল।
ঘর্মাক্ত, সন্ত্রস্ত মেজর মাটিতে পড়ে হাঁইফাঁই করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হবস আর গ্রিফিথসের ভাগ্যে কী যে ঘটেছে— তা আর বুঝতে বাকি নেই!’
‘কী সর্বনেশে দেশ!’ বলল স্যান্ডি, ‘ভাগ্যিস আমরা ”সব ঠিক” বার্তা পাঠাইনি! এক জাহাজ উপনিবেশি এখানে এসে নামলে কী যে অবস্থা হত, কে জানে!’
‘স্পেনসার! তুমি আমায় রক্ষা করেছ একটা ঘোর বিপদ থেকে। ওই সংকেত যদি চলে যেত পৃথিবীতে—’
মেজরের কথায় কান না-দিয়ে বব ট্রান্সমিটার খুলেছে ততক্ষণ। কথা কইছে জেনি ওপিঠে, ‘কী খবর?’
বব বলল, ‘এখানকার খবর পরে শুনো। একবার চট করে নীচে নেমে দেখ তো, বিমানের গায়ে গায়ে বালির দেওয়াল গড়ে উঠেছে কি না!’
তিন চার-মিনিট বাদে জেনির স্বর শোনা গেল আবার। সে-স্বর ভয়-বিস্ময়-নৈরাশ্যে ভরা, ‘বিমানের আধাআধি বালির তলায় পুঁতে গিয়েছে।’
বব বলল, ‘মেজরের আদেশ, দু-জন বৈমানিক আছে তো এখনও বিমানে? তাদের বলো, ইঞ্জিনে পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে আর্গেমোনকে এক্ষুনি আকাশে তুলে ফেলতে। এক্ষুনি! তোলার পরে আকাশে ধীরে ধীরে চক্কোর দাও ওইখানেই। আমরা যতক্ষণ না-পৌঁছাই।’
মেজরের দিকে ফিরে বব বলল, ‘ঠিক বলিনি, মেজর?’
রাফেল তার হাত চেপে ধরলেন, ‘ঠিক বলেছ, ঠিক করেছ! তুমি বাঁচিয়েছ আমায়! চলো, এক্ষুনি রওনা হই আর্গেমোনের উদ্দেশে। একবার তাতে উঠে বসতে পারলে আর এক সেকেন্ডেও অ্যান্টলে নয়।’
____
* আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে, তাকে বলে এক ‘লাইট-ইয়ার’ দূরত্ব। তার পরিমাণ পাঁচ লক্ষ সাতাশি হাজার কোটি মাইল—৫৮৭০০০০০০০০০০।