মোড়ের দোকান
কিছুই ভালো লাগছে না রাজীব উকিলের। শেয়ালদা কোর্ট থেকে বেরিয়েই হন্টন শুরু করেছে। জানে যে ট্রামে বা বাসে ওঠা— এই অফিস ছুটির সময়টাতে— তার মতো ক্ষীণজীবী লোকের পক্ষে অসম্ভব।
মা স্বর্গে গিয়েছেন। বিয়ে-থা করেনি। সাত পুরুষের পৈতৃক বাড়িতে ছয়টি শরিক, বখরায় ও পেয়েছে দেড়খানি কামরা। একঘরেই তাকে উঠতে-বসতে ও মক্কেল বসাতে হয়। রাত্রে চেয়ার-টেবিল সরিয়ে ফেলে সেইখানেই ক্যাম্পখাট পাততে হয় শোয়ার জন্য। বাকি আধখানা ঘরে থাকে রাজীবের কুকার ও কুকুর। নিজের হাতে কুকারে রান্না করে, এবং নিজের হাতেই রান্নার একাংশ কুকুরটাকে ধরে দেয়।
ওই কুকুরটার জন্যই একটা গলাবন্ধ না কিনলেই নয়। এতদিন ছিল না, কিন্তু ইদানীং পৌরসভা বড়ো আড়ে-হাতে লেগেছে বেওয়ারিশ কুকুরদের উপরে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর খতম করে দিচ্ছে। কেলোকে যদি তাদের হাত থেকে বাঁচাতে হয়। গলায় মোটা করে চামড়ার কলার পরাতে হবে।
রাজীব হেঁটেই চলেছে। হঠাৎ একী? কোথা থেকে উড়ে এল একখানা ভবঘুরে মেঘ। নামল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। রাজীবের চিন্তা মাথা বাঁচাবার জন্য নয়, কোটটা বাঁচাবার জন্য। মাথা মুছলেই শুকোবে, কিন্তু ভিজে পোশাক শুকোনোর জন্য চাই রোদ্দুর। কাল সকালেই চনচনে রোদ্দুর উঠবে, এ ভরসা কে দিচ্ছে?
অগত্যা ভিজতে ভিজতেই দ্রুত পা চালিয়ে দিয়েছে রাজীব। এসে পড়ল একটা গলির মুখে। এগলি দৈনিক দুই বার পারাপার করছে সে, চোখ তুলে কখনো তাকিয়ে দেখেনি যে নাম কী গলিটার। আজও নাম নিয়ে মাথা ঘামাল না, মাথাটা গলিয়ে দিল ঠিক মোড়ের মাথার দোকানটাতে।
সমুখটা তত চওড়া নয়, কিন্তু খুবই পরিচ্ছন্ন। তিন ধাপের লাল সিঁড়ি রাস্তা পর্যন্ত নেমে এসেছে। সিঁড়ির মাথায় কাঠের দরজা। এখন ভাঁজে ভাঁজে গুটোনো রয়েছে, যে দরজা লোকে চোখে দেখতে পাচ্ছে, সেটা পুরু কাচের, তার উপরে মাঝারি আকারের লাল হরফে লেখা— ‘দুর্লভের বিপণি’।
দুর্লভের বিপণি? সে জিনিসটা কী?
কাচের দরজাটা আদ্ধেক খোলাই ছিল, তার ভিতর মাথাটা গলিয়ে দিতে দিতেই রাজীব থমকে গেল।
চেয়ারে পাশাপাশি বসে ছিল দু-টি মেয়ে, রাজীবকে ভিতরে ঢুকতে দেখে তারা দু-জনেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, আর দু-জনের ভিতর যেটির বয়স অপেক্ষাকৃত বেশি বলে মনে হল, সে এগিয়ে এসে মধুর হাস্যে জিজ্ঞাসা করল— ‘আসুন, কী দিতে পারি আপনাকে?’
‘দিতে পারেন খুব প্রয়োজনীয় জিনিস একটা এই বৃষ্টির সময়টাতে, অর্থাৎ আশ্রয়—’ এই বলে, কাটখোট্টা উকিলের পক্ষে যতটা সম্ভব, রাজীবও মধুর হাস্য করল একটু।
দুই বোনেই হেসে ফেলল রাজীবের উত্তর শুনে, আর বড়ো বোন বলল— ‘আসুন, বসুন, বৃষ্টিটা অসময়ে নামল বটে—’
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রাজীব বসে পড়ল তাতে, রুমালে মাথা মুছতে মুছতে চিন্তা করল যে বৃষ্টি মাথায় করে হন্তদন্ত হয়ে পয়দলে ছোটার দরুন একটা সন্তোষজনক কৈফিয়ত তার দিতে পারা উচিত। যাতে মেয়ে দুটো এমন ধারা একটা ধারণা করার অবকাশ না পায় যে কোটপ্যান্টধারী হলেও পায়ে হেঁটে অফিস করাই এই জীবটার চিরন্তন রীতি।
উকিল মানুষ, চট করে কৈফিয়ত একটা বার করে ফেলল—
‘দরকার মতো জিনিস মেলানো আমাদের এই শহরে যে কী কঠিন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানে না। একটা কলার কিনবার জন্য কী হয়রানই যে হয়েছি—’
‘কলার? কেন, মানিকতলা বাজারে—?’ নির্দোষভাবেই প্রশ্ন করল মেয়েটি।
একবার ঢোঁক গিলতে হল রাজীবকে— সত্যিই তো! মানিকতলা বাজার ছেড়ে দুই পা এগুবার পরেই যদি কেউ নালিশ জানায় যে কলার খুঁজে খুঁজে সে হয়রান হয়েছে, তাহলে স্বভাবতই লোকের আশ্চর্য লাগতে পারে। অতএব, উকিল সুলভ উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সে কলারের কথাটাকেই চাপা দিয়ে ফেলল একেবারে— তার বদলে প্রশ্ন করল—
‘যদি কিছু মনে না করেন, ‘দুর্লভের বিপণি’ এ নামের অর্থটি কী? ওই নামই তো দেখলাম দরজায় আপনাদের—’
আবার ওরা হাসল দুই বোনেই, ‘ইংরেজি কিউরিও শপ কথাটার বাংলা করেছি আমরা, অবশ্য বাংলাটা সংগত ও সহজবোধ্য হয়েছে কিনা, তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। তর্ক তুলেছেনও আমাদের বন্ধুজনেরা। কিন্তু ওর চেয়ে—’
‘ওঃ কিউরিও শপ! তা, এখন বলে দিলেন বলে আমার তো কথাটা বেশ সহজই লাগছে। দুর্লভ জিনিসকেই তো কিউরিও বলি আমরা—’
একটু থেমে রাজীব নির্দোষ রসিকতার চেষ্টা করল একটু ‘কুকুরের কলার দুর্লভের পর্যায়ে পড়ে না, সুতরাং ও জিনিস আপনাদের আছে কিনা, তা আর জিজ্ঞাসা করব না—’
ছোটো বোন হঠাৎ হাততালি দিয়ে উঠল— ‘কিন্তু সেদিনকার সেই লটের ভিতরে, সেই যে দিদি, মল্লিক বাড়ির নিলাম থেকে টুকিটাকির যে একটা লট আমরা কিনলাম— একটা সুন্দর কুকুরের কলারও ছিল না তাতে?’
বড়ো বোন একটু ভেবে বলল— ‘তা ছিল, কিন্তু মল্লিক কর্তার নামও যে লেখা আছে তাতে—’
রাজীব উৎসাহিত হয়ে উঠল— ‘থাকে মুচিকে দিয়ে চেঁচে ফেলে দেব। জিনিসটা যদি বিক্রির জন্য রেখে থাকেন দয়া করে বার করুন না—’
কলার বেরুল, নাম মাত্র দামে রাজীব কিনে ফেলল সেটা এবং পুনশ্চ রসিকতা করে বলল— ‘আমার ভাগ্যে দুর্লভের বিপণিই সুলভের বিপণি হল।’
বড়ো বোন বলল— ‘নিলামে এমন সব লট বিক্রি হয় মাঝে মাঝে, যাতে একটা দুর্লভ জিনিসের সঙ্গে মিশে থাকে এক-শো গণ্ডা মামুলি জিনিস। এই যে লটটা, এর ভিতর ওই কলার জাতীয় জিনিস ছিল এক লরি, সত্যিকার দুর্লভ জিনিস ছিল একটি মাত্র, কষ্টিপাথরের একখানি জগদ্ধাত্রী, যা উপযুক্ত খদ্দের যখন আসবে কেউ, বিক্রি হবে অন্তত হাজার টাকায়—’
‘শিগগিরই যেন আসেন সে খদ্দের!’—বলল রাজীব— ‘আপনাদের সৌজন্যের জন্যে এটুকু শুভকামনাও যদি না জানাই, আমার পক্ষে অকৃতজ্ঞতা হবে। বৃষ্টিটা থেমেছে, এইবার উঠি। বড়ো উপকার করলেন, এবং বড়ো আনন্দ পেলাম—’
ওপক্ষ থেকে দুই একটা মিষ্টি কথা, দুই এক ঝলক মিষ্টি হাসি, তারপর নমস্কার প্রতিনমস্কারের মধ্য দিয়ে বিদায় পর্ব সাঙ্গ হল।
রাজীব বাড়ি ফিরল। ভুলেও গেল আকস্মিকভাবে মিলে যাওয়া সেই অসময়ের আশ্রয়, দুর্লভের বিপণির কথা।
কিন্তু মাস দুই পরে মর্মান্তিক দরকারই হল একদিন। ঠিক অফিস ছুটির পরেই নামল ঝমাঝম বৃষ্টি। যাকে বলে মরণকামড়। পার্টিং কিক, বিদায় বেলার লাথি।
ভাগ্যহীন রাজীব উকিল ঠিক সেইসময়টাতে সেই দুর্লভের বিপণির কাছাকাছি জায়গায় রয়েছে। পা চালিয়েছে ঝড়ের বেগে, কিন্তু চালানোতে ফল যে কিছুই হবে না, তাও মর্মে মর্মে বুঝতে পারছে।
যাক, ওই সেই দুর্লভের বিপণি আবার।
তিন ধাপ লাল সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পরে কাচের দরজা ঠেলতে যাবে, এমন সময় রাজীবের খেয়াল হল— কাচের দরজা তো দৃশ্যমান নয়। যা তার গাতিরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, তা হল গুটোনো পাল্লার কাঠের দরজা। রাজীব অনুমান করল— বৃষ্টিটা জোরে নেমেছে বলেই এটা টেনে দিয়েছে মালকিনরা।
মারাত্মক দরকার না হলে এরকম ক্ষেত্রে কেউ ভিতরের লোককে বিরক্ত করে না। রাজীবও করত না। কিন্তু আজকের বিপদ মারাত্মকই। বৃষ্টিটা, ইংরেজি বাগধারার অনুবাদ করে বলতে গেলে, ঠিক যেন কুকুর বেড়াল বৃষ্টি করছে। এখানে আশ্রয় না পেলে সত্যিই বিষম বিপন্ন হবে রাজীব। এক সেকেন্ডে তার হাড়ে মজ্জায় পর্যন্ত জল সেঁধিয়ে যাবে। না, তা হয় না, ভিতরে ঢুকতেই হবে তাকে। দরজায় জোর জোর ধাক্কা দিল সে।
শব্দ হচ্ছে ভিতরে। কাচের দরজা খোলার খুট খুট শব্দ। তারপর কাঠের দরজার ছিটকিনি খোলার খটাং খটাং শব্দ। গুটোনো পাল্লার একটা ভাঁজ আধখানা খুলে অবশেষে একখানা মুখ বেরুল।
এ কী! এ তো মেয়েরা নয়! সেদিন যাদের হাসি হাসি মুখ দেখে প্রাণটা ভরে উঠেছিল আনন্দে, তারা তো নয় এ। এ একটা পুরুষ! আমসির মতো চিমসে শুকনো একখানা মুখ, তাতে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। কে এই বুড়ো?
‘দোকান তো বন্ধ আজ।’ —কাঁপা গলায় বলল বুড়ো!
বন্ধ? বন্ধ কেন হতে গেল? আজ তো রবিবার নয়! শনিবার বিকেল বা সোমবার সকালও নয়। এরকম বেহিসেবি বন্ধ কেন হতে গেল? কিন্তু সে কৈফিয়ত চাইবার অধিকার কারো যদি থাকে, তবে আছে একমাত্র খরিদ্দারের। রাজীব তো কিনতে আসেনি কোনো জিনিস! কেলোর গলার কলার ছিঁড়তে অনেক দেরি আছে এখনও।
‘ওঃ, বন্ধ’—বলে দিশেহারার মতোই বুড়োর দিকে চেয়ে রইল রাজীব, তারপর ঢোঁক গিলে গিলে বলতে লাগল— ‘বড্ডই জোর বৃষ্টি হচ্ছে, এ দোকানের মহিলাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল একদিন, ভাবলাম যদি ওখানে গিয়ে দাঁড়ানো যায় একটু। এ রাস্তায় দাঁড়াবার জায়গা একদম নেই, দেখছেন তো!’
‘ওঃ, তাই’ বুড়োর কথায় কিছুমাত্র উত্তাপ নেই, না সমাদরের না বিরক্তির। একান্ত নিস্পৃহ উদাসীন স্বরে সে বলল— ‘তা আসুন! ভিতরে আসুন— আলোটাও ফিউজ হয়ে রয়েছে। তা মাথাটা অন্তত বাঁচাতে পারবেন— আসুন—’
কাচের দরজা ফাঁক করে, কাঠের দরজা খুলে কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই বুড়ো ভিতরে নিয়ে ফেলল রাজীবকে। তারপর সে লেগে গেল খোলা দরজা আবার বন্ধ করতে। আলো নেই, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, গা কেমন ছমছম করতে লাগল রাজীবের। দুর্লভের বিপণির সেদিনকার সেই আলোকোজ্জ্বল পরিবেশ, দুই-দুটো সুশ্রী তরুণীর সহৃদয় সান্নিধ্য— তার সঙ্গে আজকার অবস্থার কী নিদারুণ তফাত! এরকম হবে জানলে বৃষ্টি মাথায় করেও হয়তো পথই চলত রাজীব, এখানে কদাপি ঢুকত না। দুটো দরজাই এঁটে বন্ধ করে বুড়ো তখন বলছে— ‘চুপ করে দাঁড়ান একটু। নড়লেই হয়তো চেয়ারে টেয়ারে গুঁতো খেয়ে যাবেন। আমি দেখছি যদি আলো-টালো জ্বালানো যায়—’ আগের মতোই নিরুত্তাপ নিস্পৃহ তার কণ্ঠ।
রাজীবের হঠাৎই মনে হল একটা কথা। বুড়োটা নিজে এতক্ষণ অন্ধকারে বসে ছিল কেন এবং কেমন করে? আলো জ্বালার উপায় যদি থাকে, তবে এযাবৎ জ্বালায়নি কেন? রাজীবকেও নড়তে বারণ করছে, নড়লেই গুঁতো খেতে হবে। ওর নিজের বুঝি গুঁতোগাতার ভয় নেই?
হঠাৎ দেশলাই কাঠি একটা ফস করে জ্বলে উঠল, আর সরু একটা মোমবাতির মাথায় দেখা দিল এক ফুলকি আলো। জানালায় সেটা বসিয়ে বুড়ো বলল রাজীবকে— ‘আপনি বসুন মশাই, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? মেয়েরা আজ নেমন্তন্নে গেছেন, দোকান বন্ধ সেই জন্যেই। আমায় বন্ধের দিনও আসতে হয় এক একবার—’
রাজীবের মনে হল— এ বুড়ো অবশ্যই ঝাড়ুদার, সাফসুতরোর কাজ তো বন্ধের দিনেই করে লোকে, সুবিধাও বন্ধের দিনেই করা।
‘তুমি বুঝি অনেকদিন আছ এ দোকানে?’ জিজ্ঞাসা করল রাজীব। চুপ করে থাকাটা কেমন কেমন লাগে বলেই জিজ্ঞাসা করল এই একটা অপ্রয়োজনীয় কথা। তা নইলে, এ বুড়োর এখানকার চাকরি বিশ বৎসরের না বিশ মিনিটের, তা জেনে কী পরমার্থ লাভ হবে রাজীবের।
বুড়ো কিন্তু প্রশ্ন শুনে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল একটু— ‘তা গোড়া থেকে আছি তো!’
একটু থেমে বুড়োই বলল আবার— ‘অনেক দিনের দোকান মশাই! কত রকম জিনিস যে আছে এখানে, মালকিনরাও জানে না। এটা তো দোকান ঘর, পিছনে আছে গুদামঘর। কত-কত দুর্লভ জিনিস সেখানে ডাঁই করা পড়ে আছে— দেখবেন?’
বসে থাকতে সত্যিই ভালো লাগছিল না রাজীবের। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি, ভিতরে অন্ধকারের একচ্ছত্র আধিপত্যকে সামান্যই ক্ষুণ্ণ করতে পেরেছে ওই পেন্সিলের মতো সরু মোমের কাঠিটি, পরিস্থিতিটা একান্ত অসোয়াস্তির। বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবার চাইতে যদি নানারকম জিনিস নাড়াচাড়া করা যায়, সময়টা ভালোই কাটবে বরং।
‘তা চল না দেখি—’ বলল সে বুড়োকে—
বুড়োর উদাসীন ভাবটা চট করে কেটে গেল অমনি, তার নড়াচড়াতেও ফুটে উঠল খানিকটা ক্ষিপ্রতা। আর একটা মোম সে সত্যিই জ্বালাল। দুটো আলোর একটা সে রাজীবের হাতেই দিল, আর একটা নিল নিজে। ‘চলুন’ —বলে সে পা বাড়াল দোকানের পিছন দিকে। আলমারির আড়ালে এখানে সরু দরজা একটা। তারই ভিতর ঢুকে বাঁয়ে সামান্য মোড় ঘুরে রাজীব দেখতে পেল মস্ত একটা অ্যাসবেস্টসের চালা সেখানে। আর কত যে আলমারি আর তাক আর র্যাক সে চালায়! গাদা গাদা জিনিসে সেসব ভরতি।
হাতের মোম বাগিয়ে ধরে ধরে প্রত্যেকটা জিনিসের উপর আলো ধরছে রাজীব। কী সেখানে নেই? মিসরি কাপড়, ব্যাবলনি দেবমূর্তি, ফিনিশিয় হাতিয়ার, গ্রিক ভস্মাধার। অশোকের তাম্রলিপি, শশাঙ্কর মুদ্রা, ঢাকাই শাঁখা, কেষ্টনগরের মাটির পুতুল। জাপানের ফুলদানি, চীনের পোর্সেলেন, মালয় থেকে সংগ্রহ করা আঙ্কোর ভাটের মডেল।
কোনটা যে কী জিনিস, রাজীবের সাধ্য ছিল না চেনা বা জানার। কিন্তু কী আশ্চর্য! এই বুড়ো ঝাড়ুদারের যেন নখদপর্ণে প্রত্যেকটা বস্তুর ইতিহাস। একটা করে জিনিস হাতে তুলে দিচ্ছে রাজীবের, আর গড় গড় করে বলে যাচ্ছে তার বিবরণ— কোন দেশের থেকে আমদানি, কোন কারিগরের গড়া! কত শতাব্দী আগের গড়া, কার কার দখলে ছিল আগে, এ দোকানে এল কেমন করে— ঐতিহাসিক মূল্য এর কত, বাজারে কত মূল্য হতে পারে এখানে—
সব! সব! বুড়ো যেন এ ব্যবসার সব কিছু জানে। অথচ লোকটা তো ঝাড়ুদার ছাড়া আর কিছু নয়। রাজীব আর কৌতূহল দমন করতে পারল না— ‘তুমি এত কথা কেমন করে জানলে মুরুব্বি? এসব যে অনেক পণ্ডিত লোকেও জানে না—’
বুড়ো একটু করুণ হাসি হাসল— ‘অনেকদিন আছি তো—’
অনেকদিন থাকলেই ঝাড়ুদার প্রত্নতাত্ত্বিকে পরিণত হয়, এরকম কোনো কথা প্রাণীবিজ্ঞানে বলে কিনা, রাজীবের তা জানা নেই। কাজেই ওকথা নিয়ে সে আর কথা বাড়ানোর দরকার বুঝল না।
বুড়োর উচ্ছ্বাস কিন্তু আর থামতে চায় না। সে আধমিনিট হয়তো চুপ করে থেকে এটা ওটা হাতড়ায়, তারপরই দুই মিনিট ধরে চালিয়ে যায় বক্তৃতা— ‘মেয়েরা এর মর্ম কী বুঝবে, বলুন! ওরা এসব শেখেনি, শিখবার দরকারও দেখে না। এই গুদামটাতে ওরা পা দেয় নাকি কোনোদিন? কত কী যে আছে এখানে—’
‘তুমি বলে দিলেও তো পার—’ রাজীবের মন্তব্যটা ঠাট্টা নয়।
আন্তরিকভাবেই সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এই বুড়ো ঝাড়ুদারের পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে তরুণী মালকিনরা সত্যিই উপকৃত হতে পারে।
‘তুমি বলে দিলেও তো পার’— বলেছে আগন্তুক ভদ্রলোক।
বুড়ো যেন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল— ‘সুযোগ হয় না তার—’
এই বলেই তাকের মাথায় হাত দিয়ে একটা জিনিস নামিয়ে আনল বুড়ো। তারপর ঝাড়ন দিয়ে সেটা ভালো করে মুছে হাতে দিল রাজীবের—
রাজীব বলে উঠল, ‘এ তো ব্যাং দেখছি। পাথরের? না, লোহার? এ কোথাকার জিনিস?’
বুড়ো গলাটা নামিয়ে উত্তর দিল— ‘না, এটা এমন কিছু ভালো জিনিস নয়। ওটা আপনাকে দিয়েছি এই ভেবে যে টেবিলের উপরে কাগজ-টাগজ চাপা দিতে পারবেন ও দিয়ে।’
কাগজ চাপা? কথাটা মন্দ বলেনি বুড়ো। অবশ্য রাজীবের টেবিলে কাগজের তেমন প্রাচুর্য নেই। দুই একটা পিতলের পেপার ওয়েট যা আছে, তাইতেই কাজ চলে যায় তার। তবে বুড়োটা এত খাতির করছে, ওর অনুরোধে একটা কিছু কেনা, নিজের সঙ্গতির মধ্যে যদি হয়, মন্দ কী?
‘বেশ! বেশ! দাম যদি বেশি না হয়, এই টাকা-খানিকের মধ্যে যদি হয়, আমি নেব এটা। তার বেশি উপস্থিত আমার পকেটে নেই। ওতে হবে?’ জিজ্ঞাসা করে রাজীব।
বেশ আগ্রহের সঙ্গেই বুড়ো বলল— ‘হবে! হবে! এক টাকা কী বলছেন, সাধারণ পাথরের ব্যাং, আট আনা যদি দেন ওর দাম, সেই যথেষ্ট।’
একটা আধুলি বুড়োর হাতে দিয়ে ব্যাংটা পকেটস্থ করল রাজীব। বৃষ্টি তখন নেই। যেমন হঠাৎ নেমেছিল, তেমনই হঠাৎই থেমেছে। বুড়োর কাছে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময়ে মনটা যেন কেমন করে উঠল রাজীবের। আহা, বেচারি! সারা জীবন ঝাড়ু দিচ্ছে এই গুদাম। অথচ যে জ্ঞান ওর ভিতর আছে, তা গুদামের অধিকারীর নেই।
‘তোমায় অনেক খাটিয়েছি মুরুব্বি, আমার সামান্য শক্তির মধ্যে কিছু যদি তোমার উপকার করতে পারি’ —এই বলে পকেট থেকে একটা সিকি নিয়ে রাজীব বুড়োর হাতে দিতে গেল।
আর বুড়ো? জোড়হাত করে সে পিছনে হয়ে দোকানের ভিতর সেঁধিয়ে গেল— ‘উপকারের কথা বলছিলেন। মানুষের উপকার মানুষে সবসময়েই করতে পারে। আমারও আপনি উপকার করতে পারেন, যদি সেরকম মতি আপনার হয়। আবার যদি আসেন কখনো, আবার কথা হবে তখন—’
দরজাটা বুড়ো বন্ধই করে দিল।
রাজীব প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত তুলল। রাস্তায় হাঁটুজলই জমেছে। জুতোটা রবারের আছে। ওর জন্যে ভয় নেই। কোটটা বেঁচেছে, এখন প্যান্ট বাঁচিয়ে অমেত্তো শীলের গলিতে পৌঁছোতে পারলে তবে রাজীব বুঝতে পারে যে এ যাত্রা সে বেঁচে ফিরল। ছপ-ছপ-ছপাৎ জল ভাঙছে রাজীব। আর ভাবছে দুর্লভের বিপণির রহস্যময় ঝাড়ুদারের কথা। ঠিক এরকম লোক আর কাউকে দেখেনি রাজীব এযাবৎ। এত জানে! অথচ এত অল্পে সন্তুষ্ট! না, অন্যায় লোভ ওর নেই। বকশিশের সিকিটা নিলে না। সুতরাং এই ব্যাং বিক্রির আধুলিটাও মালকিনদের হাতে পৌঁছে দেবে— এমন ভরসা অনায়াসে করা যায়।
এ ঘটনাটা ঘটেছিল বেস্পতিবারে।
পরের রবিবারে বাড়িতে বসে স্টেটসম্যানের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছে রাজীব। বিজ্ঞাপনের পাতাটাই ওর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বড়োলোক, অনেক যৌথ কোম্পানির ম্যানেজার বা সেক্রেটারি চায়। চায় এমন লোক যে কয়েক বছর আইন ব্যবসা করেছে—। মাইনে পত্তর এমন যে বেশি দেয় এরা, তা নয়। এই তিন চার-শো-র ভিতরেই। কিন্তু রাজীবের পক্ষে তাই তো অনেক! সাত বৎসর লেগে থাকার পরও কোর্ট থেকে এখনও সে সব মাসে শ-টাকা আনতে পারে না।
স্টেটসম্যান সে হপ্তায় একখানাই কেনে, ওই বিজ্ঞাপনগুলি দেখবার জন্য, রবিরারে। অন্যদিন কাগজ পড়ে না, তা নয়। কোর্টে অনেক কাগজ আসে বার লাইব্রেরিতে, কোর্টে ওর অবসরও অঢেল। পড়ে, রাজীব তিনখানা কাগজ আদ্যোপান্ত পড়ে লাইব্রেরিতে বসে, পড়ে না কেবল সেখানে বিজ্ঞাপনের পাতাগুলি। উকিল হয়ে চাকরি খোঁজা? দেখলেই তো লোকে সেটাকে ব্যর্থতার স্বীকৃতি বলে ধরে নেবে। পশার বলতে কিছু যদি থাকে তার, তাও টং-এ উঠবে তখুনি।
হ্যাঁ, এক গেলাস চা তাকে সুফল চা-ওলার ছোকরা চাকরটা দিয়ে গিয়েছে। রোজ সকালেই এটা আসে। তার নিজের মন নেই এসব বিলাসিতায়, কিন্তু কেলোর জুলুমের সঙ্গে পেরে ওঠে না রাজীব। কেমন করে এ নেশায় কুকুরটাকে পেয়ে বসল, তা বুঝতে পারে না সে। একদিন চা ওলার চাকর জ্বরে পড়েছিল, চা আসেনি। রাজীব যেই শুকনো মুড়ি ঢেলে দিয়েছে কেলোর সামনে, লাফিয়ে উঠে খচমচ করে কেলো রাজীবেরই হাত কামড়ে দিল। রক্তারক্তি কাণ্ড! সেই থেকে দোকানের লোক যদি নির্দিষ্ট সময়ে চা নিয়ে না আসে, রাজীব নিজে ছুটে যায় টি পট নিয়ে। চা আনে, কেলোকে ঠিক আদ্ধেক ঢেলে দেয় তার নিজস্ব এনামেলের বাটিতে, তারপর নিজের টুকু গেলাসে ঢেলে নিয়ে মেজোখুড়ির কাছ থেকে চেয়ে আনা দালদার টিন থেকে মুড়ি বার করে প্রাতরাশের জন্য।
সেই এক গেলাস চা আজও এসেছে। মুড়ি ঢালা হয়েছে বাটিতে, স্টেটসম্যান মজুদ টেবিলের উপরে, হঠাৎ মুশকিল হল, অতিথি এল একজন। মক্কেল নয়, তাহলে তো নবগ্রহকে লাল সেলাম জানাত রাজীব। মক্কেল নয়, বন্ধু শিবেন। ও কালে-কস্মিনে এরকম হানা দেয় মাঝে মাঝে। ধর এই দেড় বছরে একবার। ছেলেবেলার সম্পর্কটা বাতিল করে দেয়নি ছেলেপুলে হওয়া সত্ত্বেও।
শিবেন আসে। যখনই আসে, খালি হাতে আসে না। ‘কাল আম কিনেছিলাম রে, তোর জন্যে দুটো নিয়ে এলাম।’ কিংবা ‘জামাইষষ্ঠীতে এবার যাইনি কিনা, শাশুড়ি পুকুরের মাছ পাঠিয়েছেন, মাছটা কুটছে দেখে তোর জন্যে আর কেলোর জন্যে চারখানা তুলে নিয়ে এলাম—’ ইত্যাকার কৈফিয়ত—
শিবেন আজ এসেছে খানকতক পিঠে হাতে করে। তার বউ ভেজেছিল কাল। ‘তোকে আর সুফলের দোকানে ছুটতে হবে না আমিই বলে এসেছি আর এক গেলাস চায়ের কথা! পয়সা কিন্তু তুই দিবি। তুই যখন গেরস্ত, আর আমি যখন অতিথি—’
খানিকটা সময় কুশল প্রশ্নে গেল। শিবেনের ছেলে নেই, ছয়টি মেয়ে হয়েছে, বিবাহিত জীবনের এই আট বছরের ভিতরেই। তাতে সে এক বিন্দুও দমেনি। ‘ছেলেই হোক, মেয়েই হোক, আমার কাছে সব সমান। ছয় বছর বয়স হলেই রোজগার করতে লাগিয়ে দেব। ঠোঙা বানাবে, বিড়ি বাঁধবে, এক-শো এক রকম কাজ আছে যা একটু তালিম দিয়ে দিলেই ছয় বছরের ছোটো ছেলে-মেয়েরাও বেশ করতে পারে।’
কুশল প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই চা এসে গিয়েছে, ও রাজীব তার দাম দিয়ে দিয়েছে। তারপর রাজীবের কর্ম হল পিঠে ভাগ করা। ঈশপের গল্পের বানর একরকম পিঠে ভাগ করেছিল, সেরকম ভাগ করা রাজীবের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের কোলে বেশি টানতে গেলে শিবেন কিছু বলুক-না-বলুক, কেলো তাকে আস্ত রাখবে না। কেউ বিশ্বাস করুক-না-করুক। কেলো হিসেব বোঝে।
পিঠে খেতে খেতে শিবেন হঠাৎ ব্যাংটা তুলে নিল হাতে। সেই ব্যাং, যা দুর্লভের বিপণি থেকে বেস্পতিবার নগদ আট আনায় খরিদ করেছে রাজীব—
‘আরে এটা কী?’ —চোখ দুটো ঠিকরে পড়ে যেন শিবেনের।
‘দেখছিস তো! কাগজ চাপা! জবাব দেয় রাজীব। শিবেনের উত্তেজনার কারণ কিছু বুঝতে পারে না সে—
‘কাগজ চাপা? তোর মুণ্ডু! এ জিনিস তুই পেলি কোথায়?’
রাজীবকে আনুপূর্বিক সব বলতে হল ব্যাং কাহিনি।
‘আট আনা? আট আনায় পেয়েছিস? বরাত বটে তোর—’
এই বলে এমন একটা সম্ভাষণ সে করে বসল রাজীবকে, যা গত বিশ বৎসরের মধ্যে সে একবারও করেনি। কারণ শব্দটা স্থান বিশেষে বিশেষ বিশেষ অর্থ বহন করে, কখনো আত্মীয়তা ও সমাদর ব্যঞ্জক, কখনো হয় নিছক ইতর গালাগালি সূচক। কে কখন কী অর্থে নেবে, হিতে বিপরীত ঘটে যাবে— এই ভয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রই ওই বহুলার্থ কথাটাকে সযত্নে পরিহার করে চলে থাকে। শিবেনও চলেছে এতদিন, কিন্তু শেষরক্ষা আর হল না।
পশার না থাকুক, ভড়ং সব রকমই রাখতে হয় উকিলদের। রাজীবেরও ছাপানো প্যাড আছে চিঠির কাগজের। প্যাডটা টেবিলেই পড়ে রয়েছে। সেইটে কাছে টেনে নিয়ে নিজের কলম দিয়েই তাতে খচ খচ করে অনেকখানি কী লিখল শিবেন। তারপর কাগজটা রাজীবের হাতে দিয়ে বলল— ‘পড়’—
রাজীব অবাক হয়েছে ওর ভাবগতিকে, এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না। সে হতভম্ব হয়েছে, ওর জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকবে কিনা ভাবছে, পাছে ও ঝাঁপিয়ে প’ড়ে টুটি চেপে ধরে—এই ভয়ে আত্মরক্ষার জন্যও প্রস্তুত হচ্ছে তলে তলে।
কিন্তু কিছুই করতে হল না। শিবেন একখানা কাগজ দিল পড়তে।
রাজীব পড়ল— ‘আমি, উকিল রাজীব চাকলাদার একটা পাথরের ব্যাং কিনেছি আট আনায়। বন্ধু শিবেন সমজদার বলছে ওটা— সাধারণ পাথর নয়, শিয়াজেড যা হিরের চেয়ে বেশি দামি ইউরোপের বাজারে। আমি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে এই ব্যাং বিক্রি করার ভার শিবেনকে দিচ্ছি। যে দামে সে বিক্রি করবে, তার উপর শতকরা পাঁচ টাকা কমিশন আমি শিবেনকে দেব বলে স্বীকৃত রইলাম—।’
রাজীবের পড়া শেষ হলে— শিবেন মৌখিক জানাল— ‘কমিশনটা আমার জন্য নয়, আমার কোম্পানির জন্য । কোম্পানির মারফতই আমি বেচব ওটা, আমার যা পাওনা হবে তা কোম্পানিই দেবে। ”ইন্টার কন্টিনেন্টাল অ্যান্টিকুইটি ডিলার্স লিমিটেড—” ওইখানেই আমি চাকরি করি, জানিস তো? শিয়াজেড ওইখানেই আরও দুই চারখানা আমি দেখেছি। তাইতেই আমার সন্দেহ যে এই আট আনার ব্যাং সেই দুর্লভ সামগ্রী দিয়েই তৈরি— শুনেছিস নামটা কোনোদিন? শিয়াজেড?’
রাজীব অম্লান বদনে স্বীকার করল যে তা শোনেনি—
‘এই দেখ! কালোর ভিতর থেকে স্পষ্ট ফুটে বেরোচ্ছে কয়েকটা আগুনের শিরা। শিরার সংখ্যা যত বেশি হবে, জেড হবে তত বেশি দামি। তা, তোর এইটুকু ব্যাং-এর দেহে শিরা দেখছি ছয়টা। বেশ সরেস জেডই বলতে পারি একে। তবে আমি তো ওখানকার কেরানি মাত্র, বিশেষজ্ঞরা কী বলেন দেখা যাক—’
শিবেন কেতাদুরস্ত লোক। চিঠিখানার দুটো কপি সে করল। রাজীবের সই করা কপিখানা রাখল নিজে, নিজের সই করা কপিখানা দিল রাজীবকে— ‘দেখ এখন তোর বরাতে কী হয়। সত্যিই শিয়া যদি হয়, আমার বড়ো মেয়েটা তোর কাঁধে চাপিয়ে যাব।’
‘তা যাস, কেলো যদি তাকে খেয়ে না ফেলে, সুখেই থাকবে সে—’ বলল রাজীব।
জেড প্রসঙ্গে দুই বন্ধু এমন মশগুল হয়েছিল যে পিঠের দিকে কারো নজর ছিল না, কেলো সেই সুযোগে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠেছে, এবং টেবিল থেকে একটি একটি করে টেনে নিয়ে বিলকুল ছয় গণ্ডা পিঠে একাই উদরসাৎ করেছে। এখন মেয়ে-খাওয়ার কথা শুনে একটা পরিতৃপ্তির হাই তুলল, যার অর্থ হল এই, যে তাতেও সে পিছপা নয়।
শিবেনের কথাগুলোকে একেবারে গাঁজাখুরি বলে অবশ্য উড়িয়ে দেয়নি রাজীব। সত্যিই হয়তো শিয়াজেড বলে থাকতেও পারে কিছু, কবিগুরু তো লিখেই গিয়েছেন— ‘বিপুল এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!’ কিন্তু শিয়াজেড আছে বলেই যে তার আট আনার ব্যাং সেই শিয়াই হবে, এমন কি কথা?
শিয়াই হত যদি, দুর্লভের বিপণির সেই সবজান্তা ঝাড়ুদার কি তা জানত না? আর জানত যদি, তাহলে সে কি আর যেচে তা আট আনায় বেচে দিত রাজীবকেই? না, না, সব বাজে। শিবেনটা চিরদিনের ছিটগ্রস্ত, ছয় মেয়ে হওয়ার পরেও যে দিব্যি খেয়ে-দেয়ে অফিস যাচ্ছে, তাকেও যদি না ছিটগ্রস্ত বলি, তবে কাকে বলব শুনি?
আশা মোহময়ী। মাঝে মাঝে মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে বই কী রাজীবের! যদিই ওটা শিয়া হয়, ধর যদি হাজারটা টাকাই ও থেকে আসে, রাজীব আড়াই-শো টাকা গুণোগার দিয়ে অ্যাডভোকেট বনে যাবে, আর দু-জোড়া প্যান্ট আর দুটো কোট তৈরি করাবে ধর্মতলা থেকে। গাউনটা বদ রং মেরে গিয়েছে, দোষ গাউনের নয়, ওর বয়স এই সাত বছর। একটা নতুন গাউন, আর একটা রিস্টওয়াচ।
সবচেয়ে যা বেশি দরকার, তা হল একটা সুদক্ষ টাউট। মাসে এক-শো টাকা পেলে ওই নাকিব মুন্সিকেই পাওয়া যায়। কত নতুন উকিলকে যে মানুষ করে দিয়েছে ও, তার লেখাজোখা নেই। দেবে রাজিব, তিনটি মাস ও নাকিবকে এক-শো টাকা করে দিয়ে যাবে, দেখা যাক বরাত ফেরে কি না— মক্কেল জোটাতে পারে কি না—
কিন্তু এসব চিন্তা মাথায় এলেই রাজীব চোখ রাঙিয়ে ওঠে চিন্তার উপর— ‘ওসব ননসেন্স চাই না আমি’—হুংকার করে ওঠে— ‘খাটব খুটব, করে খাব। উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মী। দৈবেন দেয়মিতি কাপুরুষা বদন্তি। আট আনার ব্যাং হাজার টাকা এনে দেয় যদি, তাকে দৈব ছাড়া কী আর বলা যাবে? সেই দৈবের দয়া প্রত্যাশা করে বসে থাকবে, এমন কাপুরুষ রাজীব চাকলাদার নহে, নহে, নহে।’
সেদিন বেলা নয়টা নাগাদ সে খেয়ে উঠল। সে ও কেলো একসাথে। একসাথে বসেই তারা খায় চিরদিন। দু-জনের দু-খানা এনামেলের প্লেট আছে আর দু-জনের দুটো এনামেলের বাটি। কোনটা কার, চিনতে অসুবিধা নেই, কারণ রাজীবের জিনিস দুটো আয়তনে অনেক ছোটো।
একসাথেই খায়। মাঝে মাঝে কেলো যদি রাজীবের থালার দিকে মুখ বাড়ায়, রাজীব বাঁ-হাতে মারে এক চড় সেই মুখের উপরে। কেলো দাঁত বার করে এই অপমানে। কিন্তু খাওয়া বন্ধ করে চেঁচামেচি করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে বিবেচনা করতে পারে না। শান্তিতেই আহারপর্ব মিটে যায় রোজই, আজও তাই মিটেছে।
রাজীব পেন্টুলন পরেছে, জুতো পায়ে দিয়েছে, কোটটা গায়ে চড়িয়েছে, এমন সময় কেলো সদর দরজার দিকে দৌড়োলো। কেউ একজন বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, কড়া নড়ে উঠবার আগেই টের পেয়েছে কেলো। ‘ঘেউ’ —হাঁকল কেলো। অর্থাৎ ‘কে?’
কড়া নড়ল, কোটের বোতাম আঁটতে আঁটতেই রাজীব গিয়ে ঘড়াং করে দোর খুলে ফেলল—
পাড়ার ডাকপিয়োন। সে একগাল হেসে বলল, ‘উকিলবাবুর দর্শন তো পাই না কোনোদিন! আজ এই এক্সপ্রেসখানা রয়েছে বলে—’
এক্সপ্রেস লেটার। ইন্টার কন্টিনেন্টাল অ্যান্টিকুইটি ডিলার্স লিমিটেড থেকে! শিবেনটার কোনো বুদ্ধি যদি থাকে! হল না তো হল না! কে আর তোর ওই শিয়ার জন্য হাত তুলে বসে আছে বল। ঘটা করে এক্সপ্রেস লেটার লিখে তা জানাবার দরকার কী ছিল?
পিয়োনের এক গাল হাসির উত্তরে নিজেও একটু কাষ্ঠহাসি হাসতে বাধ্য হল রাজীব। সই নিয়ে বিদায় হওয়ার সময় সে আর একগাল হাসি উপঢৌকন দিয়ে গেল— ‘পুজোয় কিন্তু আসছি স্যার—’ রাজীব চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছিল— ‘আমার চেয়ে তোমার রোজগার তো অনেক বেশি দোস্ত! তুমি আমার কাছে বকশিশ চাও কোন হিসেবে?’ কিন্তু বলার দরকার হল না, পিয়োনেরা বরাবরই জোর পায়ে হাঁটে, ‘পুজোয় কিন্তু আসছি স্যার’ বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটি হাওয়া হয়ে গিয়েছে।
দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে তালা মারল রাজীব। রোজই মারে। তারপর চিঠিটা অপরিসীম তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই ছিঁড়ল। কিছু সুখবর থাকলে শিবেন নিজেই ছুটে আসত। যত কেতাদুরস্ত চিঠি— ‘উই ফিল দ্য ডিপেস্ট রিগ্রেট টু হ্যাভ টু ইনফর্ম ইউ’ ইত্যাদি।
—এসবের মোদ্দা কথা হল এই যে— ‘কিছু হল না, কিছু হবে না!’ কিন্তু একী? একী? একী?
চিঠি ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে বেরিয়ে পড়ল একখানা ক্রশ দেওয়া চেক— চার হাজার সাত-শো পঞ্চাশ টাকার।
সন্ধ্যা হয় হয়। রাজীব ট্যাক্সি থেকে নামল দুর্লভের বিপণির সামনে। তার চোখে কীরকম একটা উদভ্রান্ত চাউনি। কী করবে, কোথায় যাবে, তা সে যেন বুঝতে পারছে না।
দুর্লভের বিপণি আজও বন্ধ। রাজীবের কিন্তু মনে মনে আশা— সেই বুড়ো ঝাড়ুদারকে সে অবশ্যই পাবে ভিতরে। দরকারও তাকেই রাজীবের। শিয়াজেড সেই বুড়োই বেচেছিল। রাজীবের যা কিছু করণীয় আছে, তা বুড়োর সাথেই করবে সে। তারপর বুড়ো গিয়ে বলুক তার বাচ্চা মনিবনীদের।
দরজায় কড়া নাড়তেই বুড়ো বেরিয়ে এল সত্যি সত্যি। মুখ বাড়িয়ে দেখল রাজীবকে। তার লক্ষ্যহীন দৃষ্টি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠল কিনা, রাজীব ঠিক বুঝতে পারল না। নিস্পৃহ স্বরে বুড়ো শুধু বলল— ‘আজও দোকান বন্ধ, মালিকেরা ফেরেননি নেমন্তন্ন থেকে। শহরের বাইরে কিনা! তা বসবেন না কি? আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে না—’
রাজীব ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার গলা বুজে আসছে কথা বলতে গিয়ে— ‘শোনো মুরুব্বি, আমার দরকার তোমাকেই আজ। তুমি যে ব্যাং আমায় বেচেছিলে আট আনায়, সেটা শিয়াজেড, হিরার মতোই দামি জিনিস। তা আমি বিক্রি করেছি পাঁচ হাজার টাকায়—’
বুড়োর মুখের উপর রাস্তার আলো এসে পড়েছে এক ঝলক— রাজীব স্পষ্ট দেখল— স্বভাবতই যে দৃষ্টি লক্ষ্যহীন, এই মুহূর্তে তা উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ন হয়ে উঠছে, কী যেন উগ্র প্রত্যাশায় রাজীবের মুখের পানে চাইছে। রাজীব ভাবল— বখরার প্রত্যাশা, তা ছাড়া আবার কী প্রত্যাশা হতে পারে?
সে বলে যাচ্ছে— ‘অবশ্য পাঁচ হাজার থেকে দালালি দিতে হয়েছে আড়াই-শো, আমার হাতে এসেছে চার হাজার সাত-শো পঞ্চাশ। চেক আমি ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছি, কালই টাকা তুলতে পারা যাবে। তোমার এই দোকানের জন্য আমি একটা চেক লিখে এনেছি ”দুর্লভের বিপণি”র নামেই। ঠিক আধাআধি বখরা— দুই হাজার তিন-শো পঁচাত্তর টাকা। চেকটা তুমি মালিকদের দিও। তা ছাড়া, তোমায় আমি দু-শো টাকা নিজে থেকে দেবো, টাকাটা তুলি আগে—’
বুড়ো দু-হাত নাচাতে লাগল, পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো।
কথা যখন কইল, তখন তারও গলা রাজীবের মতোই ধরা— ‘কিন্তু কেন? আদ্ধেক বখরাই বা বিপণিকে দেওয়া কেন? আর আমাকেই বা দু-শো টাকা বখশিশ দেওয়া কেন? আপনার বরাতে পাঁচ হাজার টাকা মেপে রেখেছিলেন বিধাতা, আপনি তা পেয়েছেন, অন্যকে এক পয়সা দেওয়ারও দায় আপনার নেই—’
রাজীব মাথা নাড়ল জোরে জোরে— ‘এ কোনো কথাই নয়। তুমি জানতে না যে ওই ব্যাং এত দামে বিক্রি হতে পারে বাজারে। আমি যে ওটা পেয়েছিলাম, সে শুধু তোমরা ওর উচিত দাম জানতে না বলে। তোমাদের না জানার সুযোগ নিয়ে আমি যদি ওটা আত্মসাৎ করি, সে হবে আমার অধর্ম। সম্পূর্ণ টাকাটাই তোমাদের দিয়ে দিতে পারলে আমি আরও খুশি হতাম, কিন্তু আমি এ দোকানের মালিকদের চেয়ে ঢের গরিব। আমার বিবেক বলছে— আদ্ধেক টাকা ফেরত দিলেই ন্যায় নিষ্ঠার প্রচুর পরিচয় দেওয়া হবে। নাও তুমি চেক—’
এরপর আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল একটা। বুড়ো হঠাৎ আনন্দে অধীর হয়ে চেঁচিয়ে উঠল— ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে। তার সারা দেহ যেন জ্বলে জ্বলে উঠতে লাগল একটা নিজস্ব আগুনে। তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গেল, রাজীবের চোখের সামনেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল চোখের পলকে।
পরের দিন বেলা দুপুরেই রাজীব আবার এল। দুর্লভের বিপণি দুর্নিবার আকর্ষণে টানছে তাকে। আজ দোকান খোলা— তরুণী মালিকেরা উপস্থিত।
অনেকদিন আগে এক বাদলায় সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়েছিল মাত্র। মেয়েরা তো চিনতেই পারে না রাজীবকে। পরিচয় দিয়ে, তার পরে রাজীব জিজ্ঞাসা করল— ‘আপনাদের এক বুড়ো ঝাড়ুদার আছে, সে কোথায়?’
উত্তর হল— ‘আছে’ বলবেন না, বলুন ‘ছিল’। মাসখানেক সে কাজে আসেনি, অসুখে শয্যাগত ছিল। কাল সকালে সে মারা গিয়েছে।’
মারা গিয়েছে? অতঃপর রাজীব কী বলবে? যে লোক এক মাস এখানে আসেনি মোটে, সে পর পর কয়েক দিন দেখা দিয়েছে রাজীবকে, নানান কথা কয়েছে তার সঙ্গে, ব্যাং বিক্রি করছে তাকে, এসব বললে ওরা রাজীবকে পাগল ঠাওরাবে না তো?
ভাবছে রাজীব, হঠাৎ টেবিলের উপর দাঁড় করানো একখানা ছোটো ফটোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল তার। অবাক হল সে। ঝাড়ুদারের ফটো কেউ ফুলের মালা জড়িয়ে টেবিলে রাখে, এ তো তার স্বপ্নের অগোচর ছিল!
সে শুধু বলল— ‘কার ফটো ওই?’
‘বাবার! বৎসর দুই হল মারা গিয়েছেন তিনি’—
রাজীব নিস্তব্ধ। কয়েক মিনিট নিস্তব্ধ। তার যেন হুঁশই নেই যে সে কোথায় এসেছে, কেন এসেছে। বড়ো মেয়েটিই তার ধ্যান ভঙ্গ করল— ‘আপনি খুব চিন্তায় পড়েছেন মনে হচ্ছে—’
তখন রাজীব সব কথা খুলে বলল—
আর শুনতে শুনতে মেয়ে দু-টির কপোল বেয়ে নামতে লাগল অশ্রুধারা।
রাজীবের কথা শেষ হলে বড়ো মেয়েটি বলল— ‘সত্যি কথাই বলি আপনাকে। বাবা অনেক লোককে দুর্লভ জিনিস বলে চড়া দামে বিক্রি করেছিলেন খেলো জাল জিনিস। শেষ বয়সে সেই পাপের জন্য তাঁর অনুতাপ হয়। অনেক চেষ্টায় এক সিদ্ধ পুরুষের কৃপালাভ করেন তিনি। সেই সিদ্ধ পুরুষ বলেন দেহান্তে কষ্ট বাবাকে পেতেই হবে। ভূত হয়ে তাঁকে এই দোকানেই ঘুরতে হবে বহুদিন। মুক্তি হবে সত্যিকার কোনো ন্যায়নিষ্ঠ লোকের কোনো উপকার যদি তিনি করতে পারেন কখনো।’
‘বাবার’ প্রেতাত্মা যে এই দোকানে ছিলেন, তা আমরা জানতাম। তাই সন্ধ্যা হতে-না-হতেই আমরা দোকান বন্ধ করে চলে যেতাম। ঝাড়ুদার হরিচরণ আসীম সাহসী ছিল। সে বিকাল বেলায় একবার গুদামের মেঝেটা ঝাটপাট দিয়ে আসত। সে মাঝে মাঝেই এসে বলত— অমুক তাকে অমুক জিনিসটা নেই—
‘আমরা বুঝতাম বাবাই কোনো পথচরকে ডেকে নামমাত্র দামে বেচে দিয়েছেন সেটা। উচ্চবাচ্য করতাম না কখনো। কাঁদতাম শুধু বাবার কষ্টের কথা ভেবে। দিনের পর দিন তিনি লোকের উপকারই করে যাচ্ছেন। এই আশায় যে উপকৃতদের মধ্যে একজনও হয়তো ন্যায়নিষ্ঠ লোক মিলবে কোনোদিন সে লোক হয়তো ফিরে এসে বলবে— ‘এক টাকার জিনিস পাঁচ হাজারে বেচেছি, এই নাও সে টাকা। আমি গরিব, ইচ্ছামতো আমায় দাও কিছু—’
‘নাঃ, আসেনি কেউ এতদিন। আজ এলেন আপনি। বাবার হয়ে আমরা ধন্যবাদ দিচ্ছি আপনাকে। মানুষেই পারে মানুষের উপকার করতে। আপনি যে উপকার করলেন আমাদের, তার তুলনা হয় না। বাবাকে নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করলেন আপনি। তিনি মুক্ত হয়ে গেলেন আপনারই দয়াতে।’