২. মা

২. মা

মাকে বৃদ্ধাবাসে রাখার আইডিয়াটা জিনার। মিতুল চেয়েছিল মাকে ফ্রাঙ্কফুর্টে রেখে দিতে। বাবার মৃত্যুর পরে মা শিবুদাদের ওই বাড়িতেই ছিলেন, সবাই চেনাশুনো—শিবুদারাও পরিবারের মতোই। ওখানেই সুবিধে স্বাচ্ছন্দ্য বেশি। মা ওখান থেকে কোথাও যেতে চান না। কিন্তু স্থানান্তরিত হতে হলই। শিবুদাদের পুরোনো বাড়ি প্রাোমোটারের হাতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভায়েরা। বাড়ি ভেঙে নতুন চারতলা অ্যাপার্টমেন্ট উঠবে—ভায়েরা একটা করে ফ্ল্যাট পাবে এবং কিছু নগদ টাকাও। যতদিন না নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে ততদিন প্রাোমোটারের ঠিক করে দেওয়া ভাড়া বাড়িতেই থাকবে ওরা। অতএব মায়ের জন্য নতুন নিরাপদ ঠিকানার ব্যবস্থা করা দরকার হয়ে পড়ল। তিতলি-মিতুল দুজনেই মাকে কাছে নিয়ে আসতে চাইল। বাবা নেই, মাকে একা কলকাতাতে রাখার কোনও যুক্তিই দেখল না তারা। মাকে রাজি করানো গেল এতদিনে। প্রথমে বড়মেয়ের সংসারে যাবেন, তারপরে ছোটর কাছে। দুই মেয়ের আনন্দের, উত্তেজনার অন্ত রইল না। মিতুল চলে এল কলকাতায়, মাকে সাহায্য করতে। কিছু ট্রাংক ছাড়া তেমন কোনও তো সম্পত্তি ছিল না—আসবাবপত্র বলতে একটা তক্তাপোশ, একটা আলমারি। শিবুদার মাকেই সেসব দিয়ে দেওয়া হল। ট্রাংক তিনটেও মাসিমার কাছে রইল। তাঁর জিম্মেদারিতে। একটায় বাসন, একটায় লেপ-কম্বল, একটাতে কিছু কাপড়চোপড়, কাগজপত্তর।

মিতুল মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্টে। মা সেখানে চারমাস ছিলেন। তারপর গিয়েছিলেন আমেরিকাতে, তিতলির কাছে। অ্যালাবামার একটা ছোট্ট শহরের ছোট্ট কমিউনিটি কলেজে। তিতলি বলেছিল মাকে, তার কাছে অ্যালাবামাতেই থেকে যেতে। ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রচণ্ড ঠান্ডা মায়ের পছন্দ হয়নি। কিন্তু অ্যালাবামাতে কখনও প্রচণ্ড শীত পড়ে না, দেশের মতোই গরম।

না। মা’র অ্যালাবামাও ভালো লাগেনি। একটা বাংলায় কথা কইবার মানুষ নেই। সবাই যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সবাই বিদেশি। তিতলি, রাহুল সকাল ৭ টায় বেরিয়ে যায়, রাত ৮টায় ফেরে। মা করবেনটা কী? টিভিতে মুখগুলোও সবই শুধু সাহেব আর মেমেদের। ফ্রাঙ্কফুর্টে তবু নাতি-নাতনিরা আছে। দিনে একবার অন্তত তাদের মুখগুলো চোখে দেখা যায়, ডিনার খাবার সময়ে একসঙ্গে সবাই মিলে বসে গল্পগুজব করা যায় বাংলাতে। কিন্তু তিতলি তো থাকে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। রাহুল ছেলেটি খুবই ভদ্র এবং মধুর স্বভাবের, কিন্তু বাঙালি নয়। ও-দেশেই তার জন্ম কর্ম ভাষা ইংরিজি।

না, মার পছন্দ হয়নি বিদেশের প্রবাসজীবন। তার চেয়ে কাশীবাসী হওয়া ভালো। আফটার অল, বারাণসীধাম বলে কথা।

‘আমাকে তোরা কাশী পাঠিয়ে দে।’ মা বলেই ফেলেছিলেন তিতলিকে।— ‘কাশী-বৃন্দাবনই আমাদের পক্ষে ঠিকঠাক জায়গা তিতু। এসব বিলেত আমেরিকা-জার্মানি-টার্মানিতে কী আমাদের মানায় রে? নাকি আমরাই সুখ পাই? না বাবা, যেখানকার প্রাণী সেখানে ফিরিয়ে দে।’ দাদাকেও মা লিখলেন কাশী-বৃন্দাবনের কথা। দাদা তো একপায়ে খাড়া।

বাধা দিল জিনা। ও তার আগেই কাশীর বাঙালি বিধবাদের বিষয়ে একটা শর্ট ফিল্ম দেখেছে। জিনার বম্বের ফিল্মি মহলের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিমন্ত্রণ পায়, ছবি-টবি দ্যাখে।

জিনা বলল, ‘নাথিং ডুইং। ওঁকে একটা মিডল ইনকাম গ্রুপের ওল্ড এজ হোমে রেখে দাও, শি উইল বি হ্যাপি। শি’ল হ্যাভ কোম্পানি।’

কাশীবাসী বৃদ্ধাদের দু:খকষ্ট, অভাব-বেদনার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, বেঁচে থাকতে চেয়ে টিকে থাকা—সব কিছুই অতি সুষ্ঠভাবে প্রকাশ পেয়েছিল সেই ছবিটিতে। জিনা বলল, ‘সংকর্ষণের নিন্দে হবে। কবে কোন নিউজপেপার জানতে পারলেই স্টোরি করে দেবে—এত বড় করপোরেট এক্সিকিউটিভের মায়ের এই দশা। কাশী-বৃন্দাবনে পড়ে আছে! আনওয়ান্টেড হয়ে!’

‘ও: নো, ফাইন্ড আ সুটেবল প্লেস ফর হার ইন ক্যালকাটা। যেখানে সব কিছুই পরিচিত—সবই ফ্যামিলিয়ার—দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ, দ্য কালচার, দ্য ফুড হ্যাবিটস দ্য টিভি সিরিয়ালস।—শি মাস্ট নট ফিল সাডেনলি আপরুটেড জাস্ট বিকজ শি লস্ট হার হাজব্যান্ড। লেট হার বি ইন হার ঔন সিটি। অ্যামং হার ঔন পিপল।’

অগত্যা মিতুল-তিতলিও মত দিল। অন্তত কাশীর চেয়ে ভালো। দাদা মা’র জন্যে ‘সন্ধ্যার কুলায়ে’ সিট ঠিক করে দিল বম্বে থেকেই। তিতলি মাকে নিয়ে ইউ এস এ থেকে ফিরে, মাকে সোজা পৌঁছে দিল ওই ‘সন্ধ্যার কুলায়ে’।

আধা-অন্ধকার ঘর, জানালাটা খোলে পাশের বাড়ির ছাতলা-ধরা শ্যাওলা পড়া দেওয়ালের দিকে। পুবদিকে একটি ছোট বারান্দা আছে, এই রক্ষে। সুর্যোদয় দেখা যায়। পড়ার টেবিল-চেয়ার, টেবিল-ল্যাম্প আছে। খাট আর আলমারি আছে। একটা একস্ট্রা সোফাও আছে অতিথি আপ্যায়নের জন্যে। মা জীবনে এত পাননি। কিন্তু অতিথি আর আসছে ক’জন?

.

ঘরটা তিতলির পছন্দ হয়নি। আর ছ’মাস পরেই ওরা ঘরটা বদলে দেবে বলেছিল। নতুন একটা উইং হচ্ছে। কিন্তু ছ’মাস পরে তো তিতলি মাকে ফ্ল্যাটেই তুলে নিয়ে যেত। এইবারে তো সেইজন্যেই আসা। বাড়ির চাবি তো তার ব্যাগে। চাবিটা রাখা উচিত ছিল মা’র ব্যাগেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মার ব্যাগেই রাখা উচিত ছিল চাবিটা। ভুল ডিসিশান হয়ে গেছে। সারপ্রাইজের আইডিয়াটা এত বয়েসে ঠিক নয়। মা-ই উলটে সারপ্রাইজটা দিলেন। আ ভেরি বিগ সারপ্রাইজ ইনডিড—কেন না মা’র বয়েস বেশি হয়নি। অসুস্থও ছিলেন না। কেন, ওঁর চেয়ে বেশি বয়েসেই তো আমাদের বাজপেয়ীমহোদয় ভারতের সিংহাসনে বসেছেন। এই সেদিন কে যেন সত্তর বছর বয়সে এভারেস্টেও চড়লেন। তবে মা কেন চলে গেলেন এত তাড়াতাড়ি?

.

এই জগতে কোনও কোনও মানুষের জীবন তো দেরিতে প্রস্ফুটিত হয়। যেমন মৌসুমির মায়ের। মৌসুমির মা তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরেই যেন নবজীবন প্রাপ্তা হয়েছেন। এতদিনে তাঁর পুনর্জন্ম হয়েছে। লিখতে শুরু করেছেন। প্রথমে স্মৃতিকথা। তারপরে নানা চিন্তা-ভাবনার কথা। মৌদের একটা কাগজ ছিল, ‘উপমন্যু’, সেখানেই শুরু। স্মৃতিকথাটি এত চমৎকার হচ্ছিল যে সেটা এক বিখ্যাত প্রকাশক বই করে বের করে দিলেন বইমেলাতে। সেই বই বেস্ট সেলার হয়ে গেল। মাসিমাও লেখিকা হয়ে গেলেন। ছোট ছোট গদ্যের টুকরো লেখেন—নিজের জীবনে যাদের দেখেছেন, যা দেখছেন, যা কিছু ভাবছেন, খবরের কাগজের প্রতিক্রিয়া। একটা জনপ্রিয় সচিত্র মেয়েদের পত্রিকায় ‘কলম’ লিখছেন, ‘খাগের কলম’ নাম দিয়ে। আজকালকার মেয়েরা তো শব্দটাই চেনে না। মেয়েদের সভাসমিতিতে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়, প্রধান বক্তা, বিশেষ অতিথি করে। রীতিমতো একটা পাবলিক লাইফ তৈরি হয়েছে মাসিমার। টিভি, রেডিও খবরের কাগজে ইন্টারভিউ দেন। মেয়ে-জামাইয়ের কাছেও থাকেন না আর। ছেলে-বউয়েরা তো মাদ্রাজে। মাসিমা একাই থাকেন। মাসিমার নাম যে কুসুমকানন চক্রবর্তী, সেটাও এতদিনেই জানতে পেরেছে সকলে। আগেকার মাসিমা আর আজকের মাসিমাতে চাঁদ-সূয্যির মতো তফাত। তিতলি চেয়েছিল তার মায়ের জন্যও অমনই একটা নতুন জীবন গড়ে দিতে। মাকে বলেছিল জার্মানিতে থাকার সময়ে একটা ডায়েরি রাখতে। প্রতিদিনকার ঘটনা, মনের কথা, স্মৃতিকথা, সবকিছু সেখানে লিখে রাখবেন বলে মাকে একটা মোটাসোটা বাঁধানো খাতা উপহার দিয়েছিল তিতলি।

মা লিখতে শুরুও করেছিলেন। অ্যালাবামাতে তিতলির কাছে এসেও লিখতেন। মায়ের সেই খাতাটা তিতলি আমেরিকায় কিনেছিল, চাবি-দেওয়া খাতা। মা লিখতেন, তারপর চাবি দিয়ে রাখতেন কিনা, প্রশ্ন করেনি তিতলি। এবারে খোঁজ করতে হবে সেই খাতার। বৃদ্ধাবাসে এসেও মা রোজ ডায়েরি লিখতেন। তাঁর সময় ভরানোর জন্যে বই পড়া, গান শোনা আর ডায়েরি লেখা এই তিনটেই কাজ ছিল। ইদানীং বই পড়তে কষ্ট হত। তবু চোখের ছানিটা অপারেশন করার ডেট কেবলই পিছোচ্ছিলেন মা—তিতলি আসুক, তিতলি আসুক করে। মিতু জার্মানিতে, তিতু অ্যালাবামাতে, সংকু বম্বেতে। দাদা কিন্তু বারবার বলেছে, বম্বেতে নিয়ে গিয়ে মায়ের ছানি অপারেশান করিয়ে দেবে—জিনার তাতে আপত্তি নেই। উৎসাহই আছে বরং। তার আপত্তি শাশুড়িকে সংসারে এনে পুষে রাখতে। অথবা নিজেরা শাশুড়ির সংসারে গিয়ে থাকাতে। জিনা মেয়েটা খারাপ নয়, তার মানসিকতাটা ঠিক আমাদের সঙ্গে মেলে না বড্ডই পাশ্চাত্য-ঘেঁষা কালচার জিনাদের বাড়িতে। ওর মা তো সত্যি সত্যিই বিলিতি মেম। স্কটল্যান্ডের মেয়ে। বাবা-মা একবারও বম্বেতে জিনার সংসারে গিয়ে থাকেননি। দাদা যখন মস্ত চাকরি পেয়ে বম্বে চলে গেল, দুই বোনই তখন বিদেশে। বাবা একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছিলেন। বাবা দাদাকে লিখেছিলেন—’সংকু, আমরা বুড়োবুড়ি আর একলাটি এখানে কেন পড়ে থাকব, আমাদের বরং তোর কাছে গিয়ে থাকতেই ভালো লাগবে। তোরও আমাদের জন্য ভাবনাচিন্তা কমবে। বাড়ি তো বড়ই পেয়েছিস, কাজের লোকজনও আছে, তোর মা’রও একটু আরাম হবে—আমাদের তোর কাছে নিয়ে যা। তোর মা তো অনেকদিনই সংসার করলেন—এবার ছুটি নিক একটু।’

দাদা এখানেই এক বিখ্যাত বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে কাজ করত। প্রায়ই বম্বে যেতে হত ওকে কাজে। তখনই জিনার সঙ্গে প্রেম। জিনার সঙ্গে থাকবে বলেই যে দাদা সেধে বম্বেতে ট্রান্সফার নিয়েছে, বাবা-মায়ের তো সেটা জানার কথা নয়? কোথায় দাদা আর জিনা লিভ-টুগেদার করবে বলে প্ল্যান করেছে, তারপর যদি দ্যাখে সংসারে ওদের দুজনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হচ্ছে, তাহলেই জিনা ওকে বিয়ে করবে বলেছে—এর মধ্যে মা-বাবার ঠাঁই কোথায়? বাংলো যতই বড় হোক, কামরা যত ক’টাই থাকুক, আর কাজের লোক যতগুলিই ঘুরুক না বাড়িতে, মা-বাবাদের জন্যে সেখানে স্থানাভাব প্রকট।

দাদা পারেনি বাবা-মাকে নিয়ে যেতে। জিনার সঙ্গে বিয়ের পরে, যখন ওরা বাবা-মাকে বম্বেতে নিমন্ত্রণ করল, ক’দিন ছুটিতে ঘুরে যেতে, ছেলের সংসার দেখে যেতে—বাবা গেলেন না। দাদার সমস্যাটা তো বাবা কোনওদিন জানতে পারেননি, আচরণের অর্থও বোঝেননি। আঘাত পেয়েছিলেন।

.

বাবার মৃত্যুর পরেও মার ‘ভার’ দাদা কাঁধে তুলে নিতে চায়নি। জিনার পক্ষে এত বছর পরে হঠাৎ শাশুড়ি নিয়ে ঘর করা সম্ভব নয়, জিনা স্পষ্টই বলে দিয়েছিল। জিনাই সাজেস্ট করেছিল বৃদ্ধাশ্রমে মাকে রাখা হোক। তিন ভাই-বোনেই শেয়ার করবে খরচ। দাদা কেন একা বইবে? বোনেদের বিদেশি পয়সার রোজগার কি কম? বাবা কি বোনেদের উচ্চশিঙার পিছনেও তাঁর অর্জিত ধন খরচ করেননি? ঋণশোধ করার দায় একা পুত্রেরই থাকবে কেন? এই লিঙ্গসাম্যের যুগে?

মিতুল বলেছিল, মায়ের সম্পূর্ণ খরচ সেই দেবে। তিতলিও বলেছিল সম্পূর্ণ খরচ সে-ও দিতে রাজি। ভাগের মা-য়ে কাজ নেই তাদের। দাদাকে দরকার নেই, দুই বোনেই খরচা চালাতে পারবে মায়ের। ওই মাসিক চার হাজার টাকা কিছুই না। তবু, দাদা মত দেয়নি। জমা রাখার মোট তিন লাখ টাকাটা তিন ভাই-বোনেই নিয়েছিল। দাদা দায়িত্বের ভাগ ছাড়েনি। মাকে যখন তুলে আনা হবে, টাকাটা তখন রিফান্ডেবল। মাসিক খরচও তিন ভাগ হয়। এটা দাদা ওদের সমান-সমান দিতে দেয়নি। ওরা দুই বোনে দু-হাজার দেয়, দাদা দু-হাজার।

মা বৃদ্ধাবাসে ভালোই ছিলেন মনে হয়। ফোন করলে বেশ হাসিখুশি শোনাত গলাটা। রেঁধে খেতে হচ্ছে না, বাড়া ভাত পাচ্ছেন, একটা একা ঘরে একটা খাটে একা শুচ্ছেন, বিছানাটাও কেউ করে দিয়ে যাচ্ছেন এবং একদম নিজস্ব একটা বাথরুম। এ সবই মায়ের কাছে লাক্সারি বইকি। মা নিরামিষ খেতেন, কিন্তু বৃদ্ধাবাসের বৃদ্ধারা খুব কমই নিরামিষাশী, অর্ধেক বিধবাই দেখা গেল মাছ-ডিম খাচ্ছেন, শুধু মাংসটা বাদ দেন অনেকে। দাঁতে লাগে। অথচ বাবা চলে যাবার পরে জার্মানিতে থাকার সময়ে মিতুই মাকে মাছ-মাংস-ডিম সবই খাইয়ে দিয়েছিল। তিতলির কাছে আমেরিকায় এসে মা আর কোনও বাছবিচারের চেষ্টাও করেননি। তিনজনে একই খাদ্য খেয়েছেন। শুধু ওই হ্যামটা, পর্কটা, বিফটা বাদে। মিতুও মাকে ওসব খাওয়ানোর চেষ্টা করেনি। দেশে গিয়ে যা খাবেন না, সেটা এখানে বৃথা কষ্ট দিয়ে খাওয়ানোর কী দরকার। মা’র লোভ ছিল না, কেবল ওদের খুশি করতেই আমিষ খেতেন। দেশে ফিরে আর আমিষ খাননি। কিন্তু নানাভাবে মা ক্রমশ পালটেছিলেন।

বিদেশে আসার ফলে মায়ের হাঁটাচলার ধরনটা বদলেছিল। জুতোমোজা পরে হাঁটতেন।—তিতলির হঠাৎ মনে হল, ‘দানে মাকে নুতন জুতোমোজা দিলে হত!’ কে জানে ওরা কেমন ‘পাদুকা’ দিচ্ছে? মা বাইরে বেরিয়ে বেশ স্মার্ট হয়ে উঠেছিলেন। মিত্যু বলে, ওরা সকালে সবাই অফিসে আর ইস্কুলে বেরিয়ে যাবার পরে, মাও বাড়িতে চাবি দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। দোকানপাট দেখতে-দেখতে হাঁটতেন, তারপর একটা সবুজ পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতেন। বসে বসে লোকজন, ছোটদের খেলাধুলো দেখতেন। কখনও কাঠবাদাম কিনে খেতেন, কখনও আইসক্রিম। আবার ওরা ফেরার আগেই বাড়িতে ফিরে আসতেন, দু-একটা পদ রান্না করে রাখতেন। বিদেশে রান্নাবান্নার এত সুবিধে পেয়ে মা’র বেজায় রান্নার শখ হয়েছিল। যে-মানুষটি সারাজীবন দু-বেলা তোলা উনুনে আর স্টোভে রান্না করেছেন—তাঁর ওই সাহেবি রান্নাঘরে একটুও অসুবিধে হয়নি, বরং পরম আহ্লাদেই রাঁধতেন মা জার্মানিতে। নিত্য নতুন পদের এক্সপেরিমেন্ট। তিতলির কাছে এসেও সেই অভ্যাস যায়নি মা-র। এখানে নাতি-নাতনিরা না থাক, তিতু তো আছে। রাহুল ছেলেটাও আছে। মা-র রান্না সেও দিব্যি আহ্লাদ করে খেত। সাধ এবং সাধ্য অবশেষে হাত মিলিয়েছে। মা মনের সুখে মেয়েকে খাওয়াতেন রেঁধে-বেড়ে। জীবনে প্রথম।—’ওটাই তো শিখেছি, ওটাই তো পারি, তোমরা কত কিছু পারো। আমরা তো আর কিছুই শিখিনি!’ মা বিনয় করে বলতেন।

শিবুদাদের কাছে মা রেখেছিলেন একটা বড় ট্রাংক, একটা মাঝারি ট্রাংক আর বাবার কাগজপত্রের একটা ট্রাংক। তিতলির নতুন ফ্ল্যাটে তারাই গৃহপ্রবেশ করেছে। বাবা-মায়ের বদলে। ট্রাংকের চাবিগুলি তিতলির ব্যাগে। একটু হাতে সময় নিয়ে বসতে হবে। ট্রাংকগুলো খোলার সময়ে দাদা, মিতুল এদের থাকা সম্ভব হচ্ছে না—ওরা বলে দিয়েছে, তিতলি নিজে নিজেই খুলতে পারে। ওরা জানে, ওর মধ্যে গুপ্তধনের সন্ধান মিলবে না। ভাগ বাঁটোয়ারার মতন কিছুই নেই। ও বাক্স-প্যাঁটরা খুললেও যা, না খুললেও তাই। কিন্তু তিতলি ভেবেছে ওরা থাকতে থাকতেই ট্রাংকগুলো খুলবে। মাথামুন্ডু যাই থাকুক—সেটা দাদা-দিদিরও দেখা উচিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *