২. ছেলেবেলা : ২
ডাঃ নিশিকান্ত বসুর ডাক্তারি পসার জমে ওঠে। তিনি তাঁর বাড়িওলা নলিনীরঞ্জন সরকারের কাছ থেকে দক্ষিণ কলকাতায় দু’বিঘা জমি কেনেন। বিশ শতকে শহরের এই দিকটা ছিল একেবারে গ্রামের মত। শহরের আকাশ-রেখায় তখন অ্যান্টেনা আঁকিবুকি আর বহুতল বাড়ির চৌকো মাথা দেখা যেত না। চারিদিকে দেখা যেত সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, জলাজমি আর শালুক ফুটে থাকা পুকুর। ছিল সারি সারি নারকেল গাছ, ঘন বাঁশঝাড় আর আমগাছের ছড়াছড়ি। বসু বললেন, “রাতে শেয়াল ডাকত, পাকা রাস্তা তখনও হয়নি। ট্রামলাইনও পাতা হয়নি, জমি থেকে অনেক দূরে বাবাকে গাড়ি পার্ক করতে হত।” প্রতি রবিবার সকালে ছোট্ট গনা গাড়ি করে বাবার সঙ্গে জমি দেখতে যেত। মাইলের পর মাইল ফাঁকা মাঠ আর ধানক্ষেত। দুজনে ধানক্ষেতের সরু আল ধরে সাবধানে এগোতেন। চারিদিক শুনশান, কোনও লোকজন নেই, দূর থেকে নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে—ছোট ছেলেটির খুব ভাল লাগত
যখন তার বয়স দশ তখন তারা ৫৫এ হিন্দুস্তান পার্কে তাদের নিজেদের বাড়িতে উঠে যায়। পরে তার বাবা ঐ একই জমিতে আর একটি তিনতলা বাড়ি (৫৫বি) করেন। পরবর্তীকালে ডাঃ বসু তাঁর ছোট পুত্রবধূ শ্রীমতী কমল বসুকে ঐ বাড়িটি দান করেন। ৫৫এ এবং ৫৫বি এই দুই বাড়িতেই বসু তাঁর জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছরগুলো কাটিয়েছেন। অনেক পারিবারিক ঘটনা আর রাজনৈতিক ঘটনার সুখদুঃখের সাক্ষী এই বাড়ি দুটি। সেই সময়কার হিন্দুস্তান পার্ক তাঁর স্মৃতির পরতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
এই তো সেদিন কিছু দরকারি বই খুঁজতে গিয়েছিলেন পুরোনো বাড়িতে। চারিদিকে ধূলো আর ফাটলে অশ্বত্থ গাছ দেখে একটুও ভাল লাগেনি। পাড়া তো একেবারে “অন্যরকম” হয়ে গেছে। বললেন “সে সময় যাঁরা ছিলেন, আমাদের পুরোনো প্রতিবেশী তাঁরা প্রায় কেউই নেই—–সব ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট হয়ে গেছে— একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হয়েছে দেখলাম।”
“নতুন বাড়ি থেকে বাবা গাড়ি করে স্কুলে পৌঁছে দিতেন” বসুর মনে পড়ে, “গাড়ির পেছনের বুটে আমার সাইকেলটা নিয়ে যেতাম, সেই সাইকেল চড়ে বাড়ি ফিরতাম।” নিশিকান্ত বসুর বেড়ানোর খুব নেশা ছিল। যখন শীতের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হত তখন বসুপরিবার তাঁদের বার্ষিক ভ্রমণে বেরোতেন। বসুও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন কবে ক্রিসমাসের ছুটি হবে। যাওয়া হত কখনও বারাণসী, কখনও বিন্ধ্যাচল, কখনও বা বৃন্দাবন বা গয়া। পুরীতে তো প্রায়ই যাওয়া হত। বসুর নিজের কথায় “স্কুল ছাড়ার আগেই উত্তরভারতের সব তীর্থক্ষেত্র আমার ঘোরা হয়ে গিয়েছিল।” এখনও তাঁর মনে পড়ে বারাণসীর ঘাটের সেই বিরাট বিরাট ছাতা, পাণ্ডাদের ঠেলাঠেলি আর বাঁদরের পাল। একবার বৃন্দাবনের মন্দিরে বাঁদর তাঁর মাথা থেকে বেতের টুপি তুলে নিয়ে পালিয়েছিল, বসু একটুও ভয় পাননি। প্রথমবার সমুদ্র দেখে স্নান করতেও তাঁর কোন ভয়ডর ছিল না। “তবে আমার খুব ভাল লাগত পাহাড়। প্রথম দেখা দার্জিলিং আর শিলং পাহাড় এখনও মনে আছে”–বললেন বসু। স্কুলজীবন থেকেই পাহাড়ের রাজকীয় গাম্ভীর্য বসুর ভাল লেগে যায়। স্কুল ছাড়ার আগেই তাঁর দেখা হয়ে যায় দিল্লী, মনে গেঁথে যায় চাঁদনীরাতে দেখা গলানো রুপোয় ঝলমলে তাজমহল। ছেলেবেলার বেড়ানোর কথা মনে করতে গিয়ে বসুর মনে পড়ে যায় বেনারসের এক মজার ঘটনা। “বেনারসে মা আমাকে একবার এক জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের জানার ইচ্ছা ছিল আমি ব্যারিস্টার হব কিনা। জ্যোতিষীর ঘরের বাইরে বিরাট লম্বা লাইন। ভেতরে গিয়ে দেখি বিরাট ভুঁড়িওয়ালা এক মোটা মত লোক, খুব মন দিয়ে আমার হাত দেখে মা-কে বললেন “হ্যাঁ, মা তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে, তোমার ছেলে বিলেত যাবে, আইনজীবী হবে।” আসল কথা মা বাবা দুজনেই ছোট ছেলের জন্য তাই চেয়েছিলেন— গোলাপ পাপড়িতে ঢাকা মসৃণ সামাজিক সফলতার পথ।
সময়টা তখন ছিল বড় উত্তাল। স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। বসুপরিবার পুরোপুরি অরাজনৈতিক হলেও স্বদেশিয়ানার আঁচ পরিবারের অল্পবয়সী ছেলেদের বেশ ভালভাবেই ছুঁয়েছিল। তখন তিরিশের দশক। বসু সেন্টজেভিয়ার্সে পড়াশোনা করছেন। সারা বাংলায় সাম্রাজ্যবিরোধী আগুন গনগন করে জ্বলছে; প্রায়ই বিচারবিভাগের ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা করা হচ্ছে, আমলাদের সশস্ত্র আক্রমণ তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। একদিন বসু শুনলেন গান্ধীজি দেশের জন্য অনশন করছেন—খবরটা শুনে বসুর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল, স্কুলে যেতে সেদিন আর ইচ্ছে করল না। বাবাকে গিয়ে সে কথা বলাতে বাবা ছেলের মনের কথা বুঝলেন, ক্লাসটিচারকে অনুপস্থিতির কারণ দর্শিয়ে চিঠি লিখে দিতে সম্মত হয়ে গেলেন।
কোনও অন্যায় মেনে নেওয়া বসুর ধাতে ছিল না। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর স্কুলে জেসুইট ফাদাররা এই ঘটনাকে “নির্লজ্জ” বলে বর্ণনা করে পুস্তিকা বিলি করেন। বসু কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি বললেন, “এ ভারী অন্যায়। বাঙালীরা তো নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, স্কুলের শিক্ষকরা এমন একটা মহান উদ্দেশ্যকে কেন নিন্দা করছেন?” এই নিয়ে সাহসী, স্বদেশী মনোভাবাপন্ন সেই বাঙালি ছেলেটির সঙ্গে লেগে গেল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আর ইংরেজ ছেলেদের যুদ্ধ। সেই ছিল দেশের জন্য ন্যায়ের জন্য ছাত্রজীবনের জ্যোতি বসুর প্রথম জেহাদ।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে বসু শুনতেন সে সময়কার অসমসাহসী স্বদেশী বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিকের গল্প। তিনি মায়ের বারদির বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন, কখনও কখনও সেখানে গোপন আশ্রয় নিতেন। এ গল্প বসুর কাছে যেন কখনও পুরোনো হত না, মায়ের কাছে বার বার শুনতে চাইতেন সেই বিপ্লবীর চরম সাহসের গল্প, নিজেও মনে মনে হয়ে উঠতে চাইতেন এক বিষমসাহসী মানুষ
বাড়ির সব ছেলেরাই ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর পরমভক্ত। একদিন শোনা গেল তিনি অটারলনি মনুমেন্টের নীচে এক সভায় বক্তৃতা দেবেন। জ্যোতি আর তাঁর জ্যেঠতুতো ভাই ঠিক করলেন সেই স্বদেশী সভায় যাবেন। নেতাজীকে একবার নিজের চোখে দেখতে হবে, তাছাড়া ইংরেজবিরোধী সভা, চারিদিকে রীতিমত উত্তেজনা। ময়দান জুড়ে সশস্ত্র পুলিস, ঘোড়ায় চড়ে গোরা পুলিস টহল দিচ্ছে, প্রচুর ভিড়, মনুমেন্টের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করলেই পুলিস ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে, কর্ডনের মধ্যে ঢোকাই যাচ্ছে না। জ্যোতি আর তার দাদা পরে গেছে মোটা খদ্দরের জামা। ভিড়ের মধ্যে দুই নব্য স্বদেশীকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিস সহজেই ধরে ফেলে, লাঠির ঘা পড়ে পিঠে, পায়ে, তবুও অতি উৎসাহী দুই কিশোর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সহজে নড়তে চায় না। ফলে আঘাত বেশ ভালরকমই লাগে। দুই সাহসী বিপ্লবী খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিঃশব্দে বাবার চেম্বারে গিয়ে ঢোকে, তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বাড়ি ঢুকেই বসু একেবারে মায়ের মুখোমুখি। মুখে কিছু না বললেও মায়ের চোখ এড়াবার উপায় নেই। মৃদু ভর্ৎসনা করে মা চুন হলুদ গরম করে চোটের ওপর লাগিয়ে দেন। বসুর জীবনে আইন অমান্য বা স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব অস্বীকার করা সেই প্রথম—সে বয়সে সেটা ছিল যথেষ্ট স্বাভাবিক।
পরিবারের কেউ সরাসরি রাজনীতি না করলেও স্বদেশী হাওয়া বাড়ির অন্দরমহলেও ঢুকে পড়েছিল। বসুর জ্যাঠাইমা ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের এক দরদী সমর্থক। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন বসুপরিবারের আত্মীয়, বাড়িতে তাঁর নিত্য আনাগোনা ছিল, তাঁর সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভালমত যোগাযোগ ছিল। ছেলেরা স্বদেশী উত্তাপ বহন করতেন গোপনে, বাইরে থেকে কোনও কিছু বোঝার উপায় ছিল না, বড়রা তার এতটুকু টেরও পেতেন না। বসুকে ছোটরা ডাকতেন ‘দাদামণি’ বলে। ‘দাদামণি’ ছিল চাপা, নির্বিরোধী ধরনের ছেলে। সব কিছুতেই তার অপার আগ্রহ, মনে বেশ তেজ, কিন্তু তেমন প্রকাশ নেই। তাঁর তীব্র স্বদেশিয়ানার জগৎ ছিল নিজের পরিবারের গন্ডীর মধ্যেই নিবদ্ধ। বাইরের জগতের রোমাঞ্চ তখনও তাঁকে তেমনভাবে হাতছানি দেয়নি। তবে সেই বয়সে, ভাইবোনেদের সঙ্গে ইংরেজবিরোধী নানা অনুভূতির শরিক হয়েছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কয়েকটা মজার ঘটনা তাঁর এখনও বেশ মনে পড়ে। একবার বিখ্যাত বিপ্লবী বিজয় মোদক (পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির এক বড় নেতা) বসুর এক জ্যেঠতুতো দাদা পবিত্রর কাছে একটা পিস্তল রাখতে দিয়েছিলেন। তাদের বাড়ি ছিল নিষিদ্ধ অস্ত্র রাখার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা কারণ বসুর জ্যাঠামশাই জাস্টিস নলিনীকান্ত বসু তখন ছিলেন বিপ্লবীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনালের জজ। পবিত্র পিস্তলটা খুবই সাবধানে কাপড়ে মুড়ে একটা বাক্সে রেখে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে ছোটভাইয়ের চোখ এড়াতে, সার্টের নীচে লুকিয়ে সেটা বাথরুমে নিয়ে যেত পরিষ্কার করতে। কিন্তু একদিন আচমকা ধরা পড়ে গেল। ছোটভাইয়ের নজরে পড়ে গেল। পবিত্র যখন কয়েকদিনের জন্য কলকাতার বাইরে গেল, ছোটভাই তার কৌতূহল সামলাতে না পেরে দাদার সেই বাক্সটা খুলে ফেলল—দেখে তো ভয়ে উত্তেজনায় সে অস্থির! কাপড়ে মোড়া জিনিসটা তাহলে একটা পিস্তল! এক দৌড়ে গিয়ে সে বাড়ির বড়দের জানিয়ে দেয় তার বিশেষ আবিষ্কারের কথা। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আবহাওয়া পালটে যায়। নলিনীকান্ত বসু স্বভাবতই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, পরের দিন যথারীতি দু’দিকে দুজন পুলিস নিয়ে ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে, কাছেই একটা পুকুরে সেই নিষিদ্ধ অস্ত্রটা ছুড়ে ফেলে দেন। ঘটনাটা বর্ণনা করতে গিয়ে বসু বললেন “দাদা ফিরে এসে যখন জানতে পারল এত সব কাণ্ড হয়ে গেছে তখন আমাদের তার গোপন জিনিসপত্রে হাত দেওয়ার জন্য খুবই বকাবকি করল কিন্তু ভয়ে বেশি গলা উঁচু করতে পারল না। এর পরে আমাদের বাড়িতেও একটা হৈ চৈ পড়ে গেল, বাড়িতে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন হল।”
জ্যাঠামশাই-এর এই ট্রাইবুনালের কাজটা বাড়ির কিশোরদের বিশেষ অপছন্দ ছিল। তাদের জ্যাঠামশাই কেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে বিচার করবেন? একবার নলিনীকান্ত বসু মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় নিরঞ্জন সেনের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনালের জজ নিযুক্ত হন। ছেলেরা আর সহ্য করতে পারে না। অথচ খোলাখুলি আপত্তি জানাবার সাহস তাদের নেই। এদিকে প্রতিবাদের ইচ্ছাও তাদের প্রবল। তখন বসু এবং তার জ্যেঠতুতো দাদা দেবপ্রিয় দুজনে মিলে একটা বেনামী চিঠি লিখলেন, তারপর সেটা টাইপ করে তাদের দেশপ্রেমিক’ জ্যাঠার ঠিকানায় অর্থাৎ তাদের নিজেদের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিলেন। সেই চিঠির বয়ান ছিল অনেকটা এইরকম :
শ্রদ্ধেয় মিঃ বসু,
‘দেশপ্রেমিক’ কাকে বলে? আমাদের মনে হয় আপনার মতে তিনিই একজন দেশপ্রেমিক যিনি নিজের স্বদেশবাসীকে স্বদেশের জন্য লড়াই করার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। আপনি কি স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেন? ধিক্! যদি নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে, এখনই এই কাজ ছেড়ে দিন।”
জ্যাঠমশাই ঠিক সময়ে চিঠি পেলেন। বাড়ির আবহাওয়া হয়ে উঠল থমথমে। বাড়ির সবাই খাবার টেবিলে জড় হলেন। নিশিকান্ত বসু চিন্তিতমুখে স্ত্রীকে বললেন : “কতবার আমি দাদাকে বলেছিলাম এই চাকরি না নিতে, দাদা কিছুতেই শুনলেন না, এখন দাদার জীবন নিয়ে টানাটানি।” দুই কিশোর নিষ্পাপ মুখে নীরবে বড়দের উদ্বেগ আশঙ্কা লক্ষ্য করতে থাকে। আশা জাগে বোধহয় জ্যাঠামশাই ভয় পেয়ে কাজটা এবার ছেড়েই দেবেন। কিন্তু না, ঐ পর্যন্তই। ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হল না। পুলিসি নজরদারি আরও কড়া, আরও জোরদার হল, বাবা, জ্যাঠামশাই দুজনেই তাঁদের সকালে বেড়াতে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন। কয়েকছত্রের এই সোজাসরল চিঠিটাই ছিল—’এই দেশটা আমার’ এরকম একটা আবেগময় নির্ভেজাল অনুভূতির সুস্পষ্ট অঙ্গীকার।
এইভাবে স্বদেশী আন্দোলনের পরোক্ষ উত্তাপের মধ্যেই বসু বড় হয়েছেন। সে সময়কার দুটো ঘটনা তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র, বাবা হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে চেম্বারে রোগী দেখেন। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা বসু দেখেন একদল লোক একটি লোককে ধরাধরি করে বাবার চেম্বারে নিয়ে গেল—বসু দেখলেন লোকটির পেটে গুলি লেগেছে, ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। ডাঃ বসু ক্ষতস্থান থেকে রক্তমাখা গুলিটি বার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল, আহত লোকটি তখনও যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। বসুর চোখের সামনে এখনও সেই উদ্বিগ্ন অথচ দীপ্ত মুখগুলো ভেসে ওঠে। আরও ছোটবেলায় হিন্দুস্থান বিল্ডিংস-এ থাকার সময় দেখা আর একটা ছবি এখনও তাঁর মনে পড়ে। তখন গনা বেশ ছোট। বাড়ির বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতো গোরা পলটনের মার্চ। লাইন করে পলটনের দল হাতে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে আসছে, আর কি আশ্চর্য, সামনে যেই কোনও দেশি লোক দেখছে তাদের দিকে ছড়ি দেখিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে কি সব বলছে, কখনও বা ইচ্ছা করে তাদের কোণঠাসা করে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তখন মনে মনে খুব রাগ হত গনার। স্বাধীনতা কাকে বলে, স্বদেশই বা কি—এসব বোঝার বয়স তখন তার হয়নি। তবুও মনে হত ঐ লোকগুলো তো কোনও ‘দোষ’ করেনি, তবে সাহেবরা ওদের সঙ্গে ঐরকম ‘খারাপ’ ব্যবহার করছে কেন?
বাড়িতে জ্যাঠামশাইএর কাজের টেবিলে রাখা থাকত স্বদেশি আমলের বাজেয়াপ্ত বইয়ের তাড়া। বসুর ছিল অদম্য কৌতূহল। জ্যাঠামশাই কোর্টে বেরিয়ে গেলেই ডুবে যেতেন সেই সরকারি নিষিদ্ধ সাহিত্যে। ঝটিতি পড়ে নিয়ে জ্যাঠামশাই বাড়ি ফেরার আগেই আবার যথাস্থানে এমন সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখে দিতেন, বোঝে করে সাধ্য! এমনি করেই পড়েছিলেন শরৎচন্দ্রের বিতর্কিত উপন্যাস ‘পথের দাবী’। এক জন্মদিনে বাবা তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জীবনী, সেটা পড়ে দেশবন্ধুর প্রতি তাঁর রীতিমত শ্রদ্ধা জন্মায়। দেশকে মনে মনে নিজের বলে ভাবতে শুরু করেন, তবে স্বদেশী আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, দেশের ভাল করাটাই জীবনের ব্রত হবে এমন কথা তখন স্বপ্নেও ভাবেন নি। জাতপাতের ব্যাপারটাও তাঁর কাছে অদ্ভুত ঠেকত। বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন আধুনিক চিন্তাভাবনার মানুষ। নিজে ধার্মিক হলেও ধর্ম, জাতপাতের বিচার একেবারেই করতেন না। বাড়িতে মুসলমানদের অবাধ আনাগোনা ছিল। তবুও ছেলেবেলায় জ্যোতি দেখতেন রান্নাঘরে ইংরেজ বা খ্রীস্টানের ঢোকার অধিকার থাকলেও মুসলমানকে সে অধিকার বাড়ির মেয়েরা দিতেন না। এই সব অদ্ভুত সামাজিক বিধিনিষেধ কে তৈরি করল?—অবাক হয়ে অনেক সময় ভাবতেন, মাকে জিজ্ঞাসাও করতেন, মনোমত উত্তর পেতেন না।
বসুর দাদা সৌরীন্দ্রকিরণ বিয়ে করলেন উত্তরবঙ্গের রাজপরিবারের এক মেয়েকে। “বৌদি দাদার কাছে দাঁত পরীক্ষা করাতে এসেছিলেন। সেখানেই তাঁদের আলাপ, ভালোবাসার শুরু”, মৃদু হেসে বলেন বসু। রাজকুমারী প্রতিভা ছিলেন জলপাইগুড়ির রাজা প্রসন্ন দেব রায়কতের মেয়ে। দেব রায়কতরা ছিলেন তপশীলি সম্প্রদায়ভুক্ত, এদিকে বসুরা ছিলেন সম্পন্ন কায়স্থ বংশ। এই বিয়ে নিয়ে পরিবারের রক্ষণশীল সদস্যরা অনেকেই ভুরু কুঁচকোলেন। তপশীলি জাতির মেয়ের হাতের ‘জল চলবে’ কি করে? এই ‘জল চলা’র ব্যাপারটা বসুর খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল। বসু বললেন যে তখনকার দিনে বেশিরভাগ লোকই ছিলেন খুব রক্ষণশীল। পাড়ার বহু লোকই নিমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও বিয়ের অনুষ্ঠানে আসেন নি। পরে বসু বলসাহেব ও আরও অনেকের বাড়িতে গিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা জাতটাকেই বড় করে দেখলেন। আমার বৌদি শিক্ষিত, ডায়োসে কলেজে পড়েন—জাতটাই তো মানুষের আসল পরিচয় নয়!” যাই হোক পরিবারের অনেকের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সৌরীন্দ্রকিরণ সেই মেয়েকেই বিয়ে করে হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে বাস করতে লাগলেন। তখন তিনি ডেনটিস্ট হিসাবে প্র্যাকটিস্ শুরু করেছেন। এই প্রসঙ্গে পুরোনো একটা কথা বসুর মনে পড়ে যায় : “বাবা তখন দিদির বিয়ের জন্য ভাল পাত্র খুঁজছেন। এক জ্যোতিষী দিদির হাত দেখে বলল, যার সঙ্গে দিদির বিয়ে হবে তার নামের আদ্যক্ষর হবে ‘স’–বসু মৃদু হেসে বললেন, দিদির বিয়ে হল ফিজিক্স-এর অধ্যাপক ডঃ স্নেহময় দত্তের সঙ্গে।”
বয়স অল্প হলেও বসু মানুষের বানানো নির্বোধ নিয়মকানুন কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। কোনও নিয়মটা তাঁর কাছে মনে হত অদ্ভুত, কোনটা অর্থহীন, কোনটা বা নিছক হাস্যকর। এইভাবে গড়ে ওঠে তাঁর যুক্তিবাদী মন। তবে উল্টো স্রোতে যাওয়ার প্রবণতা তখনও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেনি।
২
সতের বছর বয়সে বসু ছিলেন ছিপছিপে, মেদহীন চেহারার এক অন্তর্মুখী কিশোর। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের এক পুরোনো গ্রুপ ছবিতে দেখা যায় ধুতির ওপর কালো কোট পরে বসু দাঁড়িয়ে আছেন পেছনের সারিতে। বাঁদিকে টেরিকাটা সোজা কালো চুল। চওড়া কপাল, লম্বাটে চিবুক। উজ্জ্বল অনুসন্ধিৎসু চোখ, তীক্ষ্ণ নাক আর অভিজাত ঠোঁটের ভঙ্গি। বয়সছাড়া গম্ভীর, সমাহিত মুখের ভাব। স্বভাবটা ছিল স্বল্পভাষী, ভাবুক, ভেতরকার চাপা রোমান্টিক বিদ্রোহের আগুন বাইরে তখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। পাকা গমের মত গায়ের রঙ, পরিচ্ছন্ন মসৃণ মুখ, শান্ত অথচ ভীষণ চটপটে ভাবভঙ্গি। বাইরে থেকে মনে হয় পেলবকঠোর এক ব্যক্তিত্ব একা থাকতে ভালবাসেন, আবার বন্ধুদেরকে বাড়িতে, বাবার চেম্বারেও নিয়ে যান। বই পড়তে খুব ভাল লাগে। ভাল লাগে ক্রিকেট খেলতে, সাঁতার কাটতে। কখনও কখনও ভাল লাগে শ্মশানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে একা বসে থাকতে। কলেজের বিতর্কসভায় অংশ নেওয়ার কোনও ইচ্ছে জাগে না, হুল্লোড় করাও স্বভাবে নেই। দু’চোখে তখন ইংল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন।
দেশের অবস্থা তখন ভাল নয়। মন্দার বাজার। কিন্তু ডাঃ নিশিকান্ত বসু ছোটছেলের ভবিষ্যতের ছবি আগে থেকেই ছকে রেখেছেন। ছেলে ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পাস করবে, তারপর দেশে ফিরে প্র্যাকটিস করবে। আর ইংল্যান্ডে যখন যাবেই তখন আই. সি. এস্ পরীক্ষাতেও বসবে। প্রতি রবিবার রাতে নিয়ম করে পুরো পরিবার খাবার টেবিলে জড় হতেন। ছোটছেলের দিকে তাকিয়ে বার বার নিশিকান্ত বসুর মনে পড়ে যেত লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের এক সাধুর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। তিনি বলেছিলেন “এই ছেলে তোমার পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে, সারা বাংলার রাজা হবে।” নিশিকান্ত বসুর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাত এই ভবিষ্যদ্বাণী ফলবেই।
“১৯৩২ সালে যখন আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ি, সেই সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে ইণ্টারমিডিয়েট পাশ করে কলেজে ঢুকেছি সবে”, বসু বললেন “তখন আমার আধখানা মন ইংল্যান্ডে চলেই গেছে। তবুও কলেজ জীবনটা খারাপ লাগেনি।” প্রথম দিন কলেজ বিল্ডিংটা বেশ লেগেছিল। বাড়ির মাথায় একটা ঘড়ি, অনেকটা সেই ছেলেবেলায় দেখা হোয়াইটএ্যাওয়ে লেইল দোকানের মত; বড় গাড়িবারান্দা আর তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছের সারি। ডিটেলগুলো আছা হয়ে গেছে, অনুভূতির রেশটুকু স্থায়ী হয়ে আছে। বসুর কলেজ জীবনের সহপাঠী জাস্টিস শিশিরকুমার মুখার্জি বললেন “জ্যোতি ছিল শান্ত, চুপচাপ, বেশি কথা বলত না। ইংলিশ অনার্স ক্লাসে তেইশ নম্বর ঘরে আমাদের বসার একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। জ্যোতি শেষের দিকে বেঞ্চে বসত, জ্যোতির পাশে বসত একটি মুসলমান ছেলে—নাম রহমান। জ্যোতি ছাত্র হিসাবে ‘স্কলার’ না হলেও ‘ব্রিলিয়ান্ট’ ছিল বৈকি, একবার প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মত স্বনামধন্য অধ্যাপকের প্রশংসা সে পেয়েছিল। ‘হ্যামলেট’-এর ওপর তার একটা লেখা অধ্যাপক ঘোষের খুব ভাল লেগেছিল।”
সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি বিভাগ ছিল রীতিমত তারকাখচিত। ছিলেন প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক সি. এইচ্ টনি, জন মান, হেনরি রশার জেমস্ আর জে. এইচ. হোম্স। আরও ছিলেন এইচ্. এম. পারসিভাল, মনমোহন ঘোষ এবং অবশ্যই প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ পড়াতেন শেক্সপীয়রের নাটক। বসু মুগ্ধ হয়ে শুনতেন, “উনি আমাদের তিনটে নাটক পড়াতেন—হ্যামলেট, জুলিয়াস সীজার আর হেনরি দ্য ফোর্থ-এর প্রথম পার্ট। প্রত্যেক নাটক তাঁর পড়ানোর গুণে যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।” হ্যামলেটের দোটানা বসুকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলত, ভাল লাগত ফলস্টাফের বাড়াবাড়ি। ইংরেজিতে অনার্স ছাড়াও পাসকোর্সে বসুর বিষয় ছিল অর্থনীতি আর দর্শন। বসু বললেন “বাংলায় আমি ভীষণ কাঁচা ছিলাম, আমাকে বাংলা শেখাবার জন্য বাবা আগেই টিউটর রেখেছিলেন, তিনি খুব যত্ন করে আমায় বাংলা শেখাতেন—’কৃষ্ণ’—এসব বানান খুব শক্ত মনে হত।” ১৯৩৫ সালে বসু গ্র্যাজুয়েট হন, সে বছর কেউ ফার্স্টক্লাস পায়নি।
স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া তখন প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্রমহলে ভালভাবেই বইছে। সেদিকে বসুর তেমন আগ্রহ ছিল না। বসন্ত কেবিন বা কফি হাউসে আড্ডা, বিতর্কে যোগ দেওয়ারও উৎসাহ ছিল না। মন দিয়ে বিবেকবান ছাত্রের মত পড়াশোনা করতেন। আগ্রহ ছিল না রাজনীতিতে অথবা প্রেম ভালবাসায়—বসু ও শিশিরবাবু দুজনেই জানালেন, “কোনও মহিলা ছাত্রী তখন কলেজে পড়তেন না।” রিসের সময় বসু প্রায়ই কাটাতেন ফুটপাতে পুরোনো বইএর স্টলে বই নাড়াচাড়া করে। এইভাবেই হঠাৎ একদিন পেয়ে যান টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পীস’ উপন্যাস। পড়ে খুব ভাল লেগে যায়। শেকস্পীয়রের নাটক আর জন ডান্-এর কবিতা পড়তে খুব ভাল লাগত। ঝড়ের মত কেটে যায় দুটো বছর—”আমি তখন প্রতিদিন ইংল্যাণ্ডে যাবার দিন গুনছি।” ইংল্যাণ্ডের বছরগুলো যে তাঁকে আমূল পাল্টে দেবে সে কথা তখন কে-ই বা ভেবেছিল!