সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

২৮. মঙ্গলের পথে সেকেলে কাপ্তেন

মঙ্গলের পথে সেকেলে কাপ্তেন

শেষ বাঁশি বেজে গেল— তীক্ষ্ন শাণিত।

পাঁচটি সেকেন্ড বাকি আর। ‘র‌্যামেজে’র ভিতরে অনেকক্ষণ থেকে অনুনাসিক আওয়াজ হচ্ছিল একটা, হঠাৎ সেটা সপ্তমে চড়ে গেল। বেগবর্ধক রাসায়নিক যন্ত্র থেকে এমন গভীর, এমন সর্বগ্রাসী নির্ঘোষ বেরুতে লাগল যে তা কান দিয়ে মগজে ঢুকছে না দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে সোজা গিয়ে হাড়ে হাড়ে বাজনা বাজাতে শুরু করেছে, তা বোঝা কঠিন।

মহাবিমান আকাশে উঠছে। শব্দের চেয়ে গতি তার দ্রুত।

বেগ বাড়ছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে আরও উদ্দাম, আরও দুর্বার। বাতাস পিছলে যাচ্ছে ডানার উপর দিয়ে। বনবন ঘুরছে ‘জাইরো’র চাকা। সবে মিলে অনন্তের পথে ঠেলে দিচ্ছে র‌্যামেজকে।

অনন্তের পথ বটে, কিন্তু সে-পথ নিরুদ্দেশের নয়। মঙ্গলের দিকে স্থির লক্ষ র‌্যামেজের, গতি তারই অভিমুখে অবিচলভাবে নিয়ন্ত্রিত। মানুষের চালিত বিমান পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যে চলাচল করছে আজ পাঁচ-শো বছর, সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই। কিন্তু যাত্রীবাহী বিমান যাচ্ছে এই প্রথম, ও-পথে র‌্যামেজই পথিকৃৎ।

গতিবেগ শব্দের গতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ—

মনে কর মহাশূন্যে কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে র‌্যামেজের গতিপথের পাশে বিমানখানার বেগ যদি শব্দাতিগ না হত, তাহলে সে-মানুষ প্রথমে কানে শুনতে পেত র‌্যামেজের বজ্রনাদ, তারপর চোখে দেখতে পেত যে একটা বিরাট জ্যোতিপিণ্ড তার সমুখ দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে ঊর্ধ্বগামী অতিকায় হিমশিলার মতো। এক্ষেত্রে ঘটছে তার উলটোটা। র‌্যামেজ আসছে আগে, তার গর্জন শোনা যাচ্ছে পরে।

শব্দের গতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে র‌্যামেজ। এমন সময়ে ঘটনাটা ঘটল।

কন্ট্রোলঘর, যেখানে বসে চালক তাঁর বিমানকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সেইখানে চালকের মাথার কয়েক ফুট উপরে বসানো থাকে রেডিয়ো যন্ত্রটি, নানা সরঞ্জাম সাকুল্যে সে একটি বৃহৎ বস্তু। সেইটি হঠাৎ কী জানি কেমন করে খুলে গেল নিজের জায়গা থেকে। পড়ে গেল নীচের কৌচে, সেখান থেকে গড়িয়ে গেল বিদ্যুদবেগে যাত্রী কামরার ভিতরে।

যাত্রী কামরা পঁচিশ ফুট লম্বা। সেটা পেরিয়ে গেল বস্তুটা—

কীরকম বেগে পেরিয়ে গেল, কেমন করে বোঝাব? চেষ্টা করা যাক।

ধর— প্লেনখানা নিশ্চল হয়ে আছে মাটিতে। তাকে ঠেলে হাওয়ায় ভাসিয়ে তুলতে হলে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হয়, তাকে বলা হয় এক ‘জি’-পরিমাণ শক্তি এইরকম পাঁচ পাঁচটা ‘জি’ একসাথে ঠেলতে থাকলে যে গতিবেগ সঞ্চারিত হতে পারত রেডিয়োটাতে, সেই পরিমাণ বেগেই যন্ত্রটা এল আর গেল।

সেই দুর্বার বেগ নিয়েই ওটা ঝাঁপিয়ে পড়ল গুদাম ঘরের দরজার উপরে সে-দরজা সঙ্গেসঙ্গে চুরমার। রেডিয়ো গিয়ে ধাক্কা খেল স্তূপাকার মালপত্রে, ঠিকরে পড়ল গিয়ে ভাঁড়ার ঘরে, বিমানযাত্রীদের চার মাসের খাবার যেখানে সাজানো রয়েছে হরেকরকম আধারে।

এই ঘরের মেজেতে একটা বৃহৎ, আঁকাবাঁকা ফুটো তৈরি করে অবশেষে সেই সর্বনাশা রেডিয়ো বেরিয়ে পড়েছে মহাশূন্যে, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে সঞ্চিত খাদ্যের বারো আনা অংশ।

ওইখানেই ইতি নয় ক্ষতির তালিকার। জ্বালানির চৌবাচ্চা ভাঁড়ার ঘরেরই লাগোয়া। এ ঘরের মেঝে যখন ভাঙল, সেই ধাক্কায় জ্বালানির চৌবাচ্চাতেও খেল চিড়, কী পরিমাণ মাল যে চুইয়ে বেরিয়ে গেল, কে তা বলবে?

এত যে কাণ্ড ঘটে গেল চক্ষুর নিমেষে, কাপ্তেন সমেত বিমানের পাঁচ জন আরোহী জানতেও পরেনি তা। বিমান ছাড়বার আগে যাত্রী চতুষ্টয়কে নিজের নিজের বাঙ্কে শুয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন কাপ্তেন, দেওয়াই নিয়ম। শুয়ে তাঁরা আছেন, অন্তত আধ ঘণ্টা থাকতে হবে এইভাবে। উড্ডয়নের প্রথম দিকের কয়েক মিনিট বিমানকে নির্ভর করতে হয় জাইরোর আবর্তনের উপরে। তার পরে তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার নেয় রিঅ্যাক্টর। সেই রিঅ্যাক্টর নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কিনা, এটা বুঝে নিতে আরও কয়েক মিনিট লাগে কাপ্তেনের। সেদিক দিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলে তবেই তখন কাপ্তেন কন্ট্রোল ছেড়ে উঠে সারা বিমানটা দেখে আসেন এক বার। দেখার পর, কোথাও কোনো অস্বস্তির কারণ না দেখতে পেলে, তখনই কাপ্তেন অনুমতি দেন— যাত্রীরা উঠতে পারেন শয্যা ছেড়ে।

সবে মিলে আধ ঘণ্টা প্রায়।

চার জন যাত্রী, সবাই তাঁরা জানেন যে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া এই আধ ঘণ্টা তাঁদের করার কিছু নেই, করতে গেলে বিরাগভাজন হতে হবে কাপ্তেনের। তাঁরা তাই পড়ে আছেন চুপচাপ। একটু তন্দ্রার ভাবও বা এসেছিল হয়তো, মোটের উপর এক জন ছাড়া আর কেউই খেয়ালই করেননি যে বাধ্যতামূলক বিশ্রামের দৈর্ঘ্যটা অনেকক্ষণ হল আধ ঘণ্টা অতিক্রম করে এসেছে।

সে এক জন হচ্ছেন হার্ডম্যান। এক যুগ আগে নিজেও কাপ্তেন ছিলেন মহাকাশচারী বিমানের। এখন আর সে-কাজ নেই তাঁর, কিন্তু মহাকাশ গবেষণার উপরে আগের ঝোঁক এখনও রয়েছে অটুট। কীসে কী হচ্ছে, বা কী কারণে তা হচ্ছে না, এটা জানবার জন্য অদম্য একটা কৌতূহল ভদ্রলোকের। মঙ্গলে যাচ্ছেন, গ্রহটাতে মানুষের উপনিবেশ গড়ে উঠবার পরে সেখানকার অবস্থা এখন কীরকম দাঁড়িয়েছে, তাই দেখতে।

অধীর আগ্রহে তিনি গোড়া থেকেই অপেক্ষা করছিলেন, কখন হিসাবের আধ ঘণ্টা পেরুবে, কখন ইচ্ছামতো ঘুরে ফিরে দেখতে পারবেন যন্ত্রপাতির ক্রিয়াকৌশল; তাঁর যুগের যন্ত্র থেকে এদের পার্থক্য কোনখানে এবং কতটুকু, সুযোগ পাবেন তা পর্যবেক্ষণ করবার। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন হাতের, কাজেই আধ ঘণ্টা যে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পরিণত হতে চলেছে, সে-বিষয়ে তিনি অন্তত সচেতন আছেন পুরোমাত্রায়।

সচেতন আছেন, তবে তাতে উদবেগ বোধ করেননি। ভাবছিলেন কাপ্তেন হয়তো অন্য কোনো জরুরি কাজে আটকে পড়েছেন, আসতে পারছেন না সেটা শেষ না করে। ধৈর্য ধারণ ছাড়া উপায় কী?

কিন্তু এইবার? এইবার তো আর উদবেগকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। এ যে দারুণ ব্যাপার হল! বাতাসের চাপ কমে আসছে যেন বিমানের ভিতর। নিশ্বাস নিতে কষ্ট? না, তা হচ্ছে না। হওয়ার পথ খোলা নেই। পরনে রয়েছে আকশি পোশাক, বিশেষ ধরনের ইস্পাত দিয়ে যা তৈরি। অক্সিজেনের চোঙ যার অঙ্গবিশেষ। না, নিশ্বাস আগের মতোই স্বচ্ছন্দে নিতে পারা যাচ্ছে। কিন্তু—

মাথার চিরুনি খানা বালিশের পাশে ছিল, হাতের ধাক্কায় সেটা পড়ে গিয়েছে বিছানা থেকে। পড়ে যাওয়া উচিত ছিল মেজেতে, কিন্তু যায়নি তা। ভাসছে হাওয়ায়। চিরুনি ভাসছে মেঝে থেকে তিন ফুট উপরে, নিরলম্ব অবস্থায়। এর তাৎপর্য তো একটাই হতে পারে! চাপ নেই বাতাসের!

কেন এমনটা হল? দেখতে তো হয়! কাপ্তেনকে জানাতে তো হয়! কেনই বা কাপ্তেন আসছেন না? যত জরুরি কাজেই তিনি ব্যস্ত থাকুন না কেন, বিমানের ভিতর বাতাসের চাপ কমে আসছে, এমনধারা ব্যাপার তাঁর অজানা থাকে কেমন করে? কিংবা জানা থাকলেই বা তিনি উদাসীন থাকেন কেমন করে? সমস্যার কথা।

সমস্যা গুরুতর বলেই যেন সন্দেহ হয় হার্ডম্যানের। কিছু একটা ঘটেছে। এ অবস্থায় হার্ডম্যান চুপ করে থাকতে পারেন কেমন করে? কাপ্তেনের বিরক্তির ঝুঁকি নিয়েও তিনি বাঙ্ক ছেড়ে উঠে পড়লেন। তবে নিঃশব্দে। অন্য তিন যাত্রী চুপচাপ শুয়েই আছেন। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। থাকুন তাই। শুরুতেই একটা হইচই সৃষ্টি হতে দেওয়া কিছু নয়।

হার্ডম্যান উঠে দাঁড়াতেই টের পেলেন— বায়ুর চাপ কী পরিমাণ কমে গিয়েছে। তিনি হাঁটতে পারছেন না স্বাভাবিকভাবে। দেহটা ভেসে উঠতে চাইছে হাওয়ায়। হাঁটতে হলে তাঁকে কেবিনের দেয়াল ধরে হাঁটতে হবে।

কিন্তু কোন দিকে হাঁটা? স্বাভাবিক অবস্থায় কন্ট্রোলের দিকেই যেতেন হার্ডম্যান কাপ্তেনের সঙ্গে কথা কইবার জন্য। কিন্তু তা আর ঘটে উঠল না। প্রথমেই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল— গুদাম ঘরের দরজা। সেটা ভেঙে পড়ে আছে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে। যেন মুগুর দিয়ে পিটিয়ে কেউ ভেঙেছে তাকে। শব্দ? শব্দ অবশ্যই হয়েছিল, তবে রিঅ্যাক্টর চালু হওয়ার আগে জাইরোর চাকা থেকে যে বজ্রনাদ উত্থিত হচ্ছিল, তাকে ছাপিয়ে অন্য কোনো শব্দের পক্ষে যাত্রীদের শ্রুতিগোচরে আসার সম্ভাবনা ছিল না।

দরজাটা ভাঙল কে? কখন? কেন? কীভাবে?

অন্য চিন্তা বিসর্জন দিয়ে হার্ডম্যান এই সবই আবিষ্কারের জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। বিমানের ভিতরে বাতাসের চাপে এই যে আকস্মিক হ্রাস, এর সঙ্গে ওই ভাঙা দরজার অবশ্যই সম্পর্ক আছে কিছু। হয়তো আরও, আরও দরজা ভেঙেছে, অথবা দেয়াল বা মেঝে ফুটো হয়েছে, হয়তো যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে মহাশূন্যের হালকা হাওয়ার সঙ্গে—

হার্ডম্যানের আশঙ্কা যে সবই বর্ণে বর্ণে সত্য, তার চাক্ষুষ প্রমাণ সংগ্রহ করতে বেশিক্ষণ লাগল না। দেয়াল ধরে গুদাম, ভাঁড়ার, জ্বালানির চৌবাচ্চা সব এক বার ঘুরে আসার অপেক্ষা শুধু। মেঝেতে বিশাল ফুটো দেখে ব্যাপারটা আন্দাজ করা সহজ হয়ে এল, কিন্তু একটা ভারী জিনিস ওইখান দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে বিমান থেকে। কী সে জিনিস?

হঠাৎ মাথায় আসছে না কিছু। আগে কাপ্তেনকে তো বলা যাক। না জানি সে-ভদ্রলোকই বা কী অবস্থায় আছেন। বিমানের এই দশা হয়েছে যখন, কাপ্তেনেরও ওইরকমই কিছু হয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কারণ নেই।

তিন মিনিটের মধ্যেই এ আশঙ্কাও সত্য বলে প্রতিপন্ন হল। কন্ট্রোল ঘরে গিয়েই হকচকিয়ে গেলেন হার্ডম্যান। কাপ্তেন র‌্যামেজ—

এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। বিংশ শতাব্দী থেকেই একটা অভিনব রীতি চালু হয়েছে মহাকাশ নিয়ন্ত্রণের সংস্থায়। কাপ্তেনের নাম অনুসারেই তাঁর বিমানেরও নামকরণ হয়ে থাকে। কাপ্তেন র‌্যামেজের নামেই তাঁর এই বিমান র‌্যামেজের নাম। এমনকী, হার্ডম্যানের যুগেও এই রেওয়াজই ছিল। তিনি যে বিমানের চালক ছিলেন, তারও নাম ছিল হার্ডম্যান।

থাকুক সে-কথা।

হার্ডম্যান গিয়ে দেখলেন কাপ্তেন র‌্যামেজ মারাত্মক রকম আহত হয়ে পড়ে আছেন। আকাশিপোশাকের মাথার দিকটাতে যে শিরস্ত্রাণ থাকে, তা চেপটে গিয়েছে এভাবে যে দেখেই তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। টুপির ভিতরে মাথাটা যে আস্ত আছে, এমন আশা করা অসম্ভব।

জ্ঞান? জ্ঞান নেই কাপ্তেনের।

পোশাকটা খুলে পরীক্ষা করা? সেটা ডাক্তার দিয়ে করাতে পারলেই ভালো হয়। বিশেষত ডাক্তার যখন যাত্রীদের মধ্যে আছেন এক জন। ডাক্তার ফর্সাইদ। সামান্য আলাপ হয়েছিল বিমানে উঠবার সময়।

হার্ডম্যান ফিরে এলেন যাত্রী কামরায়। বাঙ্কের কাছে গিয়ে নাড়া দিলেন ডাক্তার ফর্সাইদকে, ‘আপনি তো ডাক্তার?’ —বললেন তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে।

‘নিশ্চয়। কিন্তু এখানে ডাক্তারি করব কার উপরে? শক্ত সমর্থ এক গণ্ডা প্রাণী আপনারা—’

‘এক জন অসমর্থ হয়ে পড়েছেন, মনে হচ্ছে। স্বয়ং কাপ্তেন। উঠে আসুন চটপট—’

কাপ্তেন অসুস্থ? এ যে ভয়ানক কথা! বিমানগুলিকে যথাসম্ভব হালকা করবার জন্য এই পঞ্চবিংশ শতাব্দী নির্মম হস্তে ছাঁটাই করেছে বিমানকর্মীদের সংখ্যায়। আগে তিন জন বৈমানিক থাকত প্রত্যেকটা মহাকাশযানে, দরকার মতো তাদের প্রত্যেকেই পারত বিমান চালনার পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে। আজ সেই তিন জনের বোঝা এক জনের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ভরসায় যে মানুষ কম থাকলেও যন্ত্র আছে বেশি। শুধু গুনতিতে বেশি নয়, আগের যুগের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত।

এখন এক জন মাত্র বৈমানিক নিয়ে যে বিমানটি চার কোটি মাইলের পথ পাড়ি দিতে বেরিয়েছে মহাশূন্যে, তার সেই সবে-ধন-নীলমণিটি যদি ঘায়েল হয়ে পড়েন যাত্রাপথের শুরুতেই, তাহলে?

তাহলে যে কী সর্বনাশ হতে পারে, তা আন্দাজ করা যেকোনো লোকের পক্ষে শক্ত নয়। ফর্সাইদ এক সেকেন্ডের ভিতর আন্দাজের পর্বটা সমাধা করে ফেললেন, এবং দুই সেকেন্ডের ভিতর উঠে পড়লেন বাঙ্ক থেকে।

‘দেয়াল ধরুন’ —বললেন হার্ডম্যান।

আকাশি পোশাক খুলে যখন পরীক্ষা করা হল কাপ্তেনকে, ফর্সাইদ সমুখে সমূহ বিপত্তি ছাড়া আর অন্য কিছুই দেখতে পেলেন না। মাথার একটা পাশ ভেঙেছে, একটা কাঁধের হাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছে, একখানা হাত অনড় হয়ে পড়েছে পক্ষাঘাত গ্রস্তের মতো। জ্ঞান তো নেই-ই। প্রাণ কতক্ষণ থাকবে, সেটাও জোর করে বলা যায় না।

এ রোগীর চিকিৎসা করতে হলে তারজন্য চাই অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সাজানো হাসপাতাল। বলা বাহুল্য এ বিমানে তেমন হাসপাতাল নেই। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যেসব উপকরণ দরকার হয় সচরাচর, আছে কেবল সেইগুলিই। হাসপাতালের সাহায্য পেতে হলে হয় পৃথিবীতে ফিরে যেতে হয়, নয়তো সোজা উড়ে চলতে হয় মঙ্গল পর্যন্ত।

তা মঙ্গল তো পুরো ষোলো হপ্তার পথ, এই শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী বিমানের পক্ষেও। কাপ্তেন র‌্যামেজের এখন যা অবস্থা, তাতে ষোলো হপ্তা কেন, ষোলো দিনও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিনা, ঘোরতর সন্দেহ আছে। এ-অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরে যাওয়াই কি ভালো নয়?

তারজন্য অনুমতি নিতে হবে অবশ্য। ‘আর্থ সেন্টার’-এর অনুমতি। পৃথিবীর কেন্দ্রীয় সংস্থার। একটা রেডিয়োগ্রাম পাঠালেই—

এতক্ষণে রেডিয়োর খোঁজ পড়ল। রেডিয়ো থাকে কাপ্তেনের মাথার উপরে ওই যে!

যাঃ কোথায় রেডিয়ো? অনেকখানি জায়গা রিক্ত, অনাবৃত। হাঁ করে আছে একটা দেয়ালের অর্ধা*ংশ। ওইখানেই থাকবার কথা রেডিয়োর, ছিলও। কিন্তু নেই।

কোথায় গেল?

এ প্রশ্নের জবাব হার্ডম্যান দিতে পারেন। রেডিয়ো যন্ত্রটা যে কোন পথ দিয়ে কোথায় উধাও হয়েছে, তা তিনি ফর্সাইদকে দেখিয়ে দিলেন। শুধু ফর্সাইদ নয়, অন্য দুই যাত্রী— ওয়ালেস আর ব্রেট, তাঁদেরও টেনে তুলে সমঝিয়ে দেওয়া হল বিপত্তিটার প্রকৃতি, পরিমাণ ও পরিধি।

রেডিয়ো নেই, অর্থাৎ পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কোনো খবর দেবার উপায় নেই, কোনো সাহায্য পাওয়ারও না। ‘র‌্যামেজ’ নামক মঙ্গলযাত্রী মহাবিমানখানা বর্তমান মুহূর্তে কী নিদারুণ সংকটে পড়েছে, তা জানাবারই পথ নেই আর্থ সেন্টারকে।

ওয়ালেস প্রস্তাব করলেন— ‘চুলোয় যাক অনুমতি, আমরা বিনা অনুমতিতেই ফিরে যাব। কাপ্তেনকে বাঁচানো তো দরকার!’

হার্ডম্যান জবাব দিলেন— ‘শুধু কাপ্তেনকে নয়, আমাদের নিজের প্রাণগুলোকেও বাঁচানো দরকার। কিন্তু কথা হল এই— বিমানকে ফেরাবে কে? একটা নির্দিষ্ট গতিপথ ধরে র‌্যামেজ ছুটেছে, তা থেকে তাকে বার করে আনা, এবং তার পরে পৃথিবীর অভিমুখে তাকে চালানো, এ তো আনাড়ির কাজ নয়!’

ব্রেট কথা বললেন এতক্ষণে— ‘আপনি নিজেই তো এক সময় মহাকাশ চষে বেড়িয়েছেন। নিজেকে আনাড়ি বলেন আপনি কোন হিসাবে?’

কোন হিসাবে যে হার্ডম্যান নিজেকে আনাড়ি বলছেন, তা বুঝিয়ে বলার সময় তখন হল না। কারণ ফর্সাইদ তাঁকে ডেকে নিলেন, কাপ্তেনকে ব্যান্ডেজ করার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। এক্স-রে যন্ত্র বিমানে আছে একটা, তারই সাহায্যে জখমগুলোর প্রকৃতি যথাসম্ভব নির্ণয় করে নিয়েছেন ফর্সাইদ। ওষুধপত্র সামান্য সামান্য যা মিলেছে তাই প্রয়োগ করে এইবারে মাথা, ঘাড় এবং হাত ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হল সাবধানে।

জ্ঞানও ফিরে আসছে কাপ্তেনের।

আসতে থাকুক। পুরোপুরি আসে যদি, তখন তাঁকে বলা যাবে সব কথা, উপদেশ ও নির্দেশ নেওয়া যাবে তাঁর কাছে। উপস্থিত তাঁকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম করতে দেওয়া অত্যাবশ্যক।

সুতরাং কাপ্তেনকে বাদ দিয়ে যাত্রী চার জনই বসে গেলেন পরামর্শ করতে। হার্ডম্যান এসব ব্যাপারে বোঝেন ভালো, তা ছাড়া অবস্থাটা সব দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণও একমাত্র তিনিই করেছেন, কাজেই বক্তার ভূমিকা তাঁকেই নিতে হল। যা তিনি বললেন— তা এই—

ফুটো দিয়ে খাদ্য প্রায় সবই পড়ে গিয়েছে। হাতে যা রয়েছে, তাতে পাঁচ জনের চলতে পারে মাত্র চার হপ্তা, অথচ মঙ্গলে পৌঁছোনো ষোলো হপ্তার ধাক্কা।

শুধু খাদ্যই পড়ে যায়নি, গিয়েছে জ্বালানিও কিছু। কী পরিমাণ যে গিয়েছে তা অবশ্য এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না। ট্যাঙ্কে নেমে মেপে দেখলে তবে মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে একটা। তবে আপাতত এইটেই ধরে নেওয়া উচিত যে জ্বালানিও বেশ কিছু লোকসান হয়েছে, এবং তার অনিবার্য ফল হচ্ছে এই যে হাতের মাল মঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছোনোর পক্ষে পর্যাপ্ত হবে না।

এই গেল ক্ষতির একটা দিক। অন্য দিকটাও মারাত্মক কম নয়। সেটা হল যোগ্য চালকের অভাব। এই কথারই আলোচনা হতে হতে থেমে গিয়েছিল একটু আগে। ফর্সাইদ, ওয়ালেস আর ব্রেট এঁরা হয়তো ধরে নিয়েছেন যে, হার্ডম্যানের দ্বারা ও-অভাব অনায়াসেই পূরণ হবে, কারণ এক সময়ে তিনি মহাকাশপথের বৈমানিকই ছিলেন।

ওঁদের তিন জনের ধারণা যে মোটেই ঠিক নয়, হার্ডম্যান তা ওঁদের বোঝাতে বসলেন। তিনি বৈমানিক ছিলেন। নিজের বিমান নিজে চালিয়ে এই আকাশপথেই তিনি মঙ্গলে পাড়ি দিয়েছেন এক যুগ আগে। এসব উপকথা নয়। কিন্তু তবু র‌্যামেজকে মঙ্গলে পৌঁছে দেওয়া সাধ্যাতীত হতে পারে হার্ডম্যানের পক্ষে। একথা গোড়াতেই সহযাত্রীদের নিশ্চিতরূপে জানিয়ে দিতে হার্ডম্যান নীতিগতভাবে বাধ্য।

কারণটা হল এই। দশ বারো বৎসর আগের মহাকাশযাত্রী বিমান, আর বর্তমানের এই র‌্যামেজ বিমান, এ দুইয়ের ভিতরে পার্থক্য অনেক। যতখানি পার্থক্য থাকে বালকে আর যুবকে, প্রায় ততখানিই। যন্ত্রপাতি পালটে গিয়েছে। হার্ডম্যান যেসব যন্ত্র নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত ছিলেন, তার অনেকগুলি বাতিল করে বিদায় দেওয়া হয়েছে আধুনিক বিমান থেকে। তাদের বদলে আরও উন্নত যেসব অস্ত্রের আমদানি করা হয়েছে আজকালকার বিমানে, হার্ডম্যান তা চোখেও দেখেননি কোনোদিন। সুতরাং—

সুতরাং মুশকিলটা গুরুতর সন্দেহ নেই। তবু ফর্সাইদেরা হতাশ হতে রাজি নন। তাঁরা বলেন— ‘র‌্যামেজ নিজের গতিপথে চলছে, চলবেও। চালাবার জন্য এখন তো চালকের বিশেষ কোনো হস্তক্ষেপের দরকার নেই! দরকার হবে মঙ্গলে নামবার সময়ে। বিমানকে নিরাপদে অবতরণ করানো— ওরই ভিতরে পাওয়া যায় পাইলটের নৈপুণ্যের পরিচয়।’

তা বেশ। কিন্তু নামবার প্রশ্ন উঠবে চার মাস পরে। ততদিন কি হার্ডম্যান এই নতুন যন্ত্রপাতিগুলোকে রপ্ত করে নিতে পারবেন না? আশা করা যাক যে তা তিনি পারবেন। যাতে সময়কালে তা পারা যায়, তারজন্য উনি চেষ্টা করুন যথাসাধ্য। তাতেও যদি না হয়, কী আর করা যাবে? অন্য উপায় তো নেই কিছু! হয় হার্ডম্যান পারবেন, নয় তো সবাইকে মরতে হবে। ভাববার কী আছে? হার্ডম্যান চেষ্টা করুন।

অগত্যা চেষ্টা করতে রাজি হলেন হার্ডম্যান।

তখন অন্য সব বিষয়েও আলোচনা হল কিছু। খাদ্যের বিষয়টাই প্রাধান্য পেল অবশ্য। চার হপ্তার খাবার মজুদ, চালাতে হবে ষোলো হপ্তা। অর্থাৎ দৈনিক খাবারের পরিমাণ সিকিতে এনে দাঁড় করাতে হবে। তাতে জীবনটা বাঁচতেও পারে চার মাস পর্যন্ত। কিন্তু মঙ্গলে নামবার সময়, যদি অবশ্য সেখানে নামা বরাতে থাকে, নামবার সময়ে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে নামতে হবে।

‘কিন্তু কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কোনো চালক বিমান নামতে পারে না’ —লজ্জার মাথা খেয়ে সেকথা হার্ডম্যানকেই বলতে হল।

অন্য তিন জন এক মুহূর্তে হতবুদ্ধি হয়ে রইলেন, তা ঠিক। কিন্তু তারপরই তাঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন— ‘সে তো ঠিক কথা! হার্ডম্যানকে পুরো খাবারই খেতে হবে। তার দরুন আমাদের অন্য সবাইকে সিকির চেয়েও কম খেতে হয় যদি, তা খাব। কী আর করা যাবে?’

সেইভাবেই দিন কাটে। হার্ডম্যান পুরো খাবার খেয়ে দিনরাত কন্ট্রোলে বসে যন্ত্রপাতি রপ্ত করার চেষ্টায় লেগে থাকেন। অন্য সবাই প্রায় অনাহারেই বাঙ্কেই পড়ে থাকেন সারাক্ষণ। কথা বলার শক্তিও লোপ পেয়েছে তাঁদের। রুচিও নেই বাক্যালাপের। তাঁদের দিকে তাকাতে পারেন না হার্ডম্যান, কিন্তু না-তাকিয়েও তো উপায় নেই! তাঁদের স্নান করাতে হয় হার্ডম্যানকে, নখ কেটে দিতে হয় হার্ডম্যানকে, আকাশি পোশাক কখনো পরানো, কখনো খুলে দেওয়া, তাও করে দিতে হয় হার্ডম্যানকেই। নিজের কোনো কাজ নিজে করবার মতো শক্তি তাঁদের কারও দেহে নেই।

র‌্যামেজ বেঁচে আছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায়। এই রোগীটাকেও সিকি খাবার খাইয়ে রাখতে হচ্ছে, এ চিন্তা প্রতিবার খাওয়ার সময়ে, প্রতি গ্রাস খাদ্যকে বিষিয়ে তোলে হার্ডম্যানের মুখে। কিন্তু উপায় নেই! ওঁদেরই বাঁচাবার জন্য ওঁদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে খেতে হচ্ছে হার্ডম্যানকে।

কিন্তু কই? বাঁচাবার কোনো উপায় তো হার্ডম্যান এখনও দেখতে পাচ্ছেন না। বিমানকে ইচ্ছামতো ঘোরানো ফেরানো ওঠানো নামানোর কৌশল তো এখনও আয়ত্ত করতে পারেননি তিনি! এদিকে ষোলো হপ্তার চৌদ্দো হপ্তা কেটে গেল।

হার্ডম্যান ছাড়া আর বাকি তিন জন যাত্রী, কে যে ফর্সাইদ, কে যে ওয়ালেস, আর কে যে ব্রেট, তা আর চিনবার জো নেই এখন। চেহারা সকলেরই একরকম হয়ে গিয়েছে। হাড়ের উপর হলদে থলথলে চামড়া ঝুলছে, তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আকাশি পোশাকের ভিতর তাঁদের দেহটা নড়ে বেড়ায় যখন, মনে হয় পিপের ভিতর একটা লাঠি এপাশ-ওপাশ করছে।

জ্বালানি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, প্লেন হালকা না করলে মঙ্গলে পৌঁছতে পারা যাবে না। তাই অপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিস হার্ডম্যান ফেলে দিচ্ছেন বাইরে। ওয়ালেস তাই দেখে রসিকতা করলেন সেদিন— ‘ওই সঙ্গে আমাদেরও ফেলে দাও হার্ডম্যান! দেহ তিনটের দরুন এমন কিছু বোঝা কমবে না অবশ্য, তবে ওই আকাশি পোশাকগুলোর তো ওজন কম নয়!’

হার্ডম্যান তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচেন।

আর মাত্র দুটো দিন হাতে আছে। মঙ্গল ওই দেখা যায়, ধোঁয়াটে লাল, র‌্যামেজের ঠিক নাক বরাবর। কিন্তু কী করে ওখানে নামবে র‌্যামেজ, ভাগ্যহীন হার্ডম্যান এখনও তা মাথায় আনতে পারেননি। এটা ধরেন, ওটা মুচড়ে দেন, কোনো যন্ত্রই ঠিকমতো সাড়া দেয় না। হার্ডম্যান মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রায় পাগল হওয়ার অবস্থা।

সেদিন ফর্সাইদকে স্নান করাতে নিয়ে যাবার সময় হার্ডম্যান অস্থিসার ডাক্তারের হাত ধরে ডুকরে উঠলেন— ‘পারলাম না ডাক্তার! তোমরা মিছেই নিজের নিজের খাবার খাইয়ে খাইয়ে তাগড়া করে রেখেছ আমায়। এ বিমান আমার বাগ মানছে না। এসব কলকবজা অবাধ্য আমার—’

ফর্সাইদও রসিকতা করলেন আজ— ‘নতুন কলকবজা বসিয়ে নিলে না কেন এত দিন? যারা বাধ্য হত তোমার?’

রসিকতা? না দৈববাণী?

হার্ডম্যান ছুটে গেলেন কন্ট্রোলে। নতুন কলকবজা বসানো। যারা বাধ্য হবে! না, নতুন নয়। অর্থাৎ র‌্যামজের কনট্রোলে নতুন হলেও হার্ডম্যানের কাছে চিরকেলে পুরোনো! যেরকম সব যন্ত্র নিয়ে কারবার ছিল তাঁর এককালে, তাই যদি বসিয়ে নেওয়া যায়? বিমান কী বাগ মানবে না তাতেও? কেন মানবে না? সেকালে কি মানেনি?

ঢং ঢং হাতুড়ি পড়তে লাগল কন্ট্রোলের দেয়ালে দেয়ালে। যন্ত্রপাতি সব উপড়ে ফেলছেন হার্ডম্যান, কোনোটা খুলে দু-খানা করছেন, কোনোটা বা জুড়ে দিচ্ছেন অন্য একটার সাথে। হাল-অমলের সব কলকবজাকে পুরোনো ধাঁচে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা। ঢং ঢং ঢং। ধাতুর উপরে হাতুড়ির ঘা—

হঠাৎ পিছন থেকে কে গলা টিপে ধরল হার্ডম্যানের।

‘আমার বিমান তুই ভেঙে ফেলছিস বদমাইশ? বেরিয়ে যা আমার কন্ট্রোল থেকে! বেরিয়ে যা!’

কী সর্বনাশ! পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সদা মুমূর্ষু কাপ্তেন র‌্যামেজ। নিজে পাশ ফিরবার শক্তি নেই যাঁর, তিনি এ কীসের আবেগে রোগশয্যা থেকে উঠে এসেছেন। নিজের স্বত্ব সাব্যস্ত করবার জন্য?

‘শুনুন কাপ্তেন! শুনুন একটু’ —কাতরান হার্ডম্যান।

আর শোনা? র‌্যামজের হাড্ডিসার দশটা আঙুল সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরেছে হার্ডম্যানের কণ্ঠনলী, দম আটকে দিতে চাইছে। র‌্যামেজের একটা হাত না অনড় হয়েছিল? কোন ম্যাজিকে তা সচল, সবল হয়ে উঠল চক্ষুর পলকে?

সাঁড়াশির পেষণ কোনোমতে খুলতে না পেরে অবশেষে হার্ডম্যানকে গায়ের জোরই খাটাতে হল কাপ্তেনের উপরে। বেশি নয়, একটা ঘুসি নাকের উপরে। না মেরে উপায় ছিল না। র‌্যামেজ নেতিয়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে, আর অপরিসীম অনুশোচনায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন হার্ডম্যান।

‘মুষড়ে পড়ো না হার্ডম্যান। কূলে এসে নৌকা ডুবিও না। তুমি ঠিক করছ। করে যাও নিজের কাজ। র‌্যামেজকে আমি দেখছি।’

এ কথা ডাক্তার ফর্সাইদের। কন্ট্রোল থেকে র‌্যামেজের ভাঙা গলার ক্রুদ্ধ চিৎকার শুনে তিনি ধুকতে ধুকতে উঠে এসেছেন বাঙ্ক থেকে।

র‌্যামেজকে বাঙ্কে রেখে এলেন হার্ডম্যানই। তারপর তিনি আবার লেগে গেলেন তাঁর পুনর্গঠনের কাজে। ঠিকই বলেছিলেন ফর্সাইদ। নতুন কলকবজা! হার্ডম্যান নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি নতুন যুগের বিমানের সঙ্গে। কাজেই এখন একমাত্র উপায় হল— এই নতুন ধাঁচের বিমানখানাকেই পুরোনো যুগের কাপ্তেনের জ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া।

ভাঙো, ভাঙো, সব ভেঙে ফেলে আবার নতুন করে গড়ো। ঢং ঢং হাতুড়ি পড়তে থাকল কন্ট্রোলের দেয়ালে দেয়ালে দুটো দিন ধরে।

ওই মঙ্গল। মাত্র বারো ঘণ্টার পথ।

হার্ডম্যান কন্ট্রোলে বসে আছেন দিগ্বিজয়ীর মতো উন্নতশিরে। কন্ট্রোল ঘরের চেহারা বারো আনা পালটে গিয়েছে। হঠাৎ কোনো ইন্দ্রজালের দৌলতে পূর্ণ স্বাস্থ্য ফিরে পেয়ে কাপ্তেন র‌্যামেজ যদি এই সময় এই কন্ট্রোলে এসে বসতে পারতেন আবার, তাঁর সাধ্য হত না নিজের বিমানকে নিজের হাতে মঙ্গলে নামনো।

ধুকতে ধুকতে ফর্সাইদ এসে বললেন— ‘কতদূর কী হল হার্ডম্যান?’

রণজয়ী সেনাপতির উল্লাস হার্ডম্যানের দুই চোখে— ‘আর ভয় নেই। বিমান বাগ মেনেছে। এক্ষুনি আমরা নেমে পড়ব মঙ্গলে। আঁচড়টি লাগবে না কারও গায়ে।’